Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,puja 2021 bangla golpo amitava das

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: গোপাল খুড়োর অসুখ । অমিতাভ দাস

Reading Time: 4 minutes
প্যাংলোর কথা বলে শেষ করা যাবে না। সে প্যাংটিটলো গ্রহ থেকে আগত প্রাণী। ইটরঙের একটা বিড়াল।কোথা থেকে যেন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। খুব-ই বিচক্ষণ বিড়াল সে। না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।সে মাঝে মাঝে কোথায় যেন চলে যায়- আবার ফিরেও আসে।একবার তো ওকে খুঁজতে গিয়ে বিষম বিপদে পড়েছিলাম। একেবারে ভূতের খপ্পরে। যদিও সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম।
 
এই প্যাংলো মাঝে মাঝে মানে ইচ্ছে হলে মানুষের ভাষায় কথা বলে। অনেক রকম অতিলৌকিক বা আধিদৈবিক জ্ঞান ওর করায়ত্ব। জানি বলেই একথা বলার সাহস পেলাম। দেখুন সব সময় যুক্তি , বিজ্ঞান এসব খুঁজলে আমার গল্পটাই আর বলা হবে না। আমি তো ধরেই নিয়েছি যেহেতু ও ভিনগ্রহ থেকে এখানে এসেছে সে অধিক ক্ষমতাবান। যদিও ওকে দেখলে কিছুই বোঝার উপায় নেই। একবার তো ও আমায় ওদের গ্রহের বিড়াল দেবতার সঙ্গে দেখা করিয়েও দিয়েছিল। সেসব অন্য গল্প।
 
আজ একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসল । একে ঘটনা বলব না দুর্ঘটনা আমি ঠিক জানি না। ছাদে বসে আছি। মাথার ওপর রঙিন ছাতা।সামনে চৌকো কাঠের টেবিলের ওপর মধু দেওয়া গ্রীন টি। চারপাশে টবে ফল ও ফুলের গাছ। ছোট্ট ছাদ জুড়েই এখন গাঁদা ,চন্দ্রমল্লিকা, কুন্দ আর বোগেনভেলিয়ার বিভিন্ন ফুলের রঙের সমারোহ। একটা গল্প পড়ছিলাম। ভূতের। বলা ভালো অদ্ভুতুরে গল্প। দূরে চলে যাচ্ছে লোকাল ট্রেন। আমাদের ছাদ থেকে দূরের ট্রেন দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম একটা ট্রেন চলে গেল। মাঘ মাসের মিঠে রোদ গায়ে লাগছে– বেশ একটা আমোদ বোধ হচ্ছে।
 
হঠাৎ পায়ের কাছে প্যাংলো। ডেকে উঠল, মিউউ। বললাম, কী খবর প্যাংলোবাবু, কাল রাতে কোথায় ছিলে? একদম দেখা নেই…
 
সে আবার বললে, মিউউ…
 
কিছুই বুঝলাম না। গল্প পড়ায় মন দিলাম। প্যাংলো পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর চটির ওপর মাথা রেখে মাথাটা এলিয়ে দিল।
 
মিনিট পাঁচেক পর আমার গল্প পড়া শেষ হল। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগারেট বার করে যেই ফস্ করে দেশলাই জ্বালালাম, প্যাংলো মানুষের ভাষায় কথা বলে উঠল।
 
-‘গোপাল খুড়ো অসুস্থ । সে খবর রাখো!’
 
আশ্চর্য হয়ে নিচে তাকালাম। প্যাংলো জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
 
বললাম, কীভাবে জানা গেল সে খবর? আমি ইচ্ছে হলে প্যাংলোর সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলে থাকি। এখন যেমন বলছি।
 
সে বললে, গিয়ে ছিলাম। দেখে এলাম।
 
বললাম, কাল রাতে বুঝি গোপাল খুড়োর বাড়িতে থাকা হয়েছিল?
 
সে বললে, হুম। ক’দিন ধরে জ্বর। কেউ নেই দেখার। একা মানুষ।
 
-তারপর? কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম, এখন কেমন অবস্থা?
 
প্যাংলো বললে, ভালো না। কাল আমি ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। জ্বরে বেহুঁশ। বুকে কান পেতে বুঝলাম। এখনো কয়েক বছরের আয়ু আছে তাঁর।
 
-তুই বুঝি বুঝতে পারিস এসব?
 
-পারব না কেন? মানুষদের থেকে অনেক কিছুই আগে থেকে আমরা বুঝতে পারি। যেমন বুঝতে পারলাম কখন তোমার ভূতের গল্প পড়াটা শেষ হল। তুমি ভূতের গল্প পড়তে ভালোবাসলেও ভূতকে ভয় পাও। আমাকে নিয়েও মজার সব গল্প লেখ। কিছু আগে প্রিয় গ্রীন টি খেলে। খেতে খেতে ভাবছিলে বন্ধু তন্ময়কে নিয়ে মধুপুর যাবে। ওকে একদিন গ্রীন টি খাওয়াবে…
 
বললাম, থাম থাম বাপু… বুঝেছি তুই সব আগে থেকেই জানিস। এখন চল তো গোপাল খুড়োর বাড়ি। দেখে আসি কেমন আছেন তিনি।
 
গোপাল খুড়োর বাড়িতেই আমার অনুমান প্যাংলোর জন্ম। কারণ গোপাল খুড়ো বিড়াল খুব ভালোবাসে। প্যাংলো মাঝে মাঝেই সে বাড়িতে যায় এবং খায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাসে রাতে ঘুমোয় পর্যন্ত। গোপাল খুড়োর বাড়িটা একটু নিরিবিলি। নির্জন গাছগাছালির ভিতর শান্ত সমাহিত পরিবেশ। যা প্যাংলোর মতো ভিনগ্রহী বিড়ালের অতি কাঙ্খিত তা বলাই বাহুল্য। আমাদের বাড়ি থেকে চার-পাঁচটা বাড়ি পরেই তাঁর বিরাট বাড়ি। আগে অনেক লোক থাকত। এখন কমতে কমতে একজন। কেউ বিদেশে, কেউ কলকাতায়, কেউ বা মরে গেছে। অধিকাংশ ঘরগুলো বন্ধ থাকে। বছর দুই আগে ছোটদের একটা স্কুল বসত। এখন তাও বন্ধ।
 
গিয়ে দেখলাম গোপাল খুড়ো বিছানায় শুয়ে আছে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। এখন তো আবার জ্বর হলে লোকে করোনার ভয় পায়। কাউকে যে পাওয়া যাবে না এই সময়ে তা বুঝলাম এবং আমার কর্তব্য ঠিক করলাম। বললাম, প্যাংলো এখানে থাক। আমি একটু মিশনে যাই। মিশনের ডাক্তারকে বলে ওষুধ নিয়ে আসি। এসে মাথায় জল ও জলপট্টি দোব। বলায় প্যাংলো এক লাফে গোপাল খুড়োর বিছানায় গিয়ে উঠে বসল। বোঝা গেল সে খুশি হয়েছে। ঘন ঘন লেজ নেড়ে তা জানান দিচ্ছে। 
মঠের ডাক্তারবাবু সব শুনে বললেন, ওসব কিছু নয়। হঠাৎ করে ঠান্ডা পড়েছে তাই। বয়স্ক মানুষ ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছেন। একা মানুষ -সব নিজের হাতেই তো করেন।
 
বললাম, হ্যাঁ।
 
তিনি খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। পাঁচ দিনের ওষুধ দিলেন বললেন কমে যাবে।
 
ওষুধ নিয়ে গোপাল খুড়োর বাড়িতে ঢুকতেই গা-টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। একটা অচেনা গন্ধ পেলাম। এই গন্ধ আমি আগে কখনো পাইনি। মাধবীলতার গাছটা পেরিয়ে কাঠের গেটটা সবে ঠেলেছি কুকুর ডেকে উঠল ডুকরে। ঠিক কান্নাও নয়। সারা শরীরে একটা শিরশিরে অনুভব হল।
 
বারান্দার পাশে কলতলাটা যাওয়ার সময় শুকনো দেখেছি। এখন দেখি কল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। কে কল পাম্প করেছ? যদিও পরে ভাবলাম কত ছেলেপুলে, লোকজন রাস্তা দিয়ে যায়। হয়ত জল খেয়েছে বা প্রয়োজনে হাত-পা ধুয়েছে। ভাবনাটা মাথা থেকে সরে গেল।
 
আমিও কেমন যেন ভিতু টাইপ। নিজের ওপর রাগ হল। আমি তো আসলে ভিতু নই। এত বেশি ভূতের গল্প পড়াটা ঠিক নয়। নানা রকম ভাবনা কাজ করে। যদিও সবটাই আজগুবি ভাবনা। নার্ভকে দুর্বল করে দেয়।
 
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হল ঘরের মধ্যে অনেক লোক যেন কথা বলছে। হয়ত পাড়ার লোকজন খবর পেয়ে এসেছে। তবে আসার কথা নয়। গোপাল খুড়ো কারো সঙ্গে তেমন মেশে না। চুপচাপ থাকা মানুষ। মাঝে মধ্যে বেড়াতে যায়। পেনশানের টাকায় দিব্য চলে যায়। বৌ মারা যাওয়ার পর কেমন যেন একা হয়ে গেছেন তিনি। মন মরা ভাব। শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
 
যাইহোক হাঁটতে হাঁটতে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি একটা বৌ গোপাল খুড়োর মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে জল দিচ্ছে। বললাম, কে আপনি? বউটি ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকাল। ভয়ে আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল । মনে হল রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেছে আমার। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পা এতটাই ভারী হয়ে গেছে যে নট নড়ন-চড়ন। দেখলাম, গোপাল খুড়োর বউ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, জ্বরে ওর গা-টা পুড়ে যাচ্ছিল। ও বিড়বিড় করে আমাকে ডাকছিল। তাই না এসে পারলাম না। আমি এসে এখন জল দিচ্ছিলাম। বলে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।
 
আমার আগে কেউ কখনো দুপুর বেলা ভূত দেখেছে বলে তো শুনিনি। আমার যে পরিমান ভয় পাওয়ার কথা ছিল কই পেলাম না তো! নীলকুঠির ঘটনা মনে আছে। সেখানে তো খুব ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। কেন ভয় পেলাম না আমি? বাইরে ঝকঝকে রোদ। আমি ঘরে ঢুকে সোফায় বসলাম। তাকালাম গোপাল খুড়োর দিকে। এবার আমার আশ্চর্য হবার পালা: কোথায় জল! গোপাল খুড়ো আগের মতোই বেহুঁশ হয়ে শুয়ে আছে। জলপট্টির সাদা ছোট্ট কাপড়ের টুকরোটাও নেই। আমি গোপাল খুড়োর কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলাম । জ্বর প্রায় নেই বললেই চলে। আমি তাঁকে উঠিয়ে বসালাম। ওষুধ ও পথ্য খাইয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখি প্যাংলো জলঘটের মতো বসে আছে। বললাম, তোকে না পাহাড়ায় রেখে গিয়েছিলাম। কোথায় গিয়েছিলি?
 
উত্তর দিল না। চুপ করে বসেই আছে। আমি এবার আমাদের বাড়ির দিকে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই সে বললে: খুড়ি মা এসেছিল যে। আমি তাই চলে এলাম। তিনি এখনো আছেন । তুমি দেখতে পাচ্ছ না কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি। শুনেই বুকটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠল। বিশ্বাস যোগ্য কথা তো নয়। প্যাংলো মনের কথা বুঝতে পারে। বললে, তিনি এখন বাগানে দোলনাটায় বসে আছে। বলাতে আমি তাকালাম বাগানের দিকে। দেখি আমগাছে লাগানো দোলনাটা দুলছে। অথচ চারপাশে কোনো হাওয়া-বাতাস নেই।
 
না আমি ভয় পেলাম না ঠিক-ই কিন্তু সম্মোহিতের মতো সেদিকে যেতে গেলাম। প্যাংলো পা জড়িয়ে ধরল। তারপর বাগানের দিকে তাকাল। স্পষ্ট দেখলাম ওর চোখ থেকে একটা নীলচে আলো মতন কী যেন বেরিয়ে গেল। দোলনাটাও থেমে গেল হঠাৎ করেই। সে বললে, চলো — এবার আমরা বাড়ি যাই। বুড়ো-বুড়িকে একটু একা থাকতে দাও।
 
 

One thought on “ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: গোপাল খুড়োর অসুখ । অমিতাভ দাস

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>