ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: যুদ্ধ । চুমকি চট্টোপাধ্যায়
16 অক্টোবর 2021
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
সিগারেটে শেষ টানটা মেরে রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে ডলে দিল বিক্রম। এই নেশাটা কিছুতেই ছাড়তে পারছে না ও। ভালো মন্দের সব জ্ঞানই আছে তাও মাথাটা একেক সময় এমন জ্যাম হয়ে থাকে যে মনে হয় একটু ধোঁয়া দিলে হয়তো আরাম হবে।
ধোঁয়া শব্দটা মায়ের কথা তুলে আনল জমা স্মৃতির সিন্দুক থেকে। কতদিন হয়ে গেল মাকে দেখে না সে। মা যখন জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে তখন কত ধোঁয়া! মায়ের স্মৃতি কখনো ফিকে হয় না। মা সামনেই থাকুক বা মনে, কী উজ্জ্বল তাঁর উপস্থিতি! জ্বলজ্বলে চোখ, কপালে বড় টিপ, নাকে ছোট্ট বেলকুঁড়ি নাকছাবি। মা, মা গো!
মাঝে মাঝে বিক্রমের মনে হয়, মানুষের শরীরটা স্মৃতি দিয়েই তৈরি। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবই তো স্মৃতি। চুলটা মায়ের মতো, পায়ের আঙুলগুলো পুরো বাবা কাকাদের মতো… এরকমই বলে সবাই। তাহলে? এগুলোও তো স্মৃতিই।
আচ্ছা মা থাকলে কি ওর জীবনটা একটু অন্যরকম হত? এখানে প্রশ্ন করাই উচিত নয়। অন্যরকম হতই! মা থাকলে উচ্চমাধ্যমিকের পর ও কানাডায় চান্স পাওয়া কলেজটায় পড়তে যেতে পারত। সেভেনটি পারসেন্ট স্কলারশিপ পেয়েছিল। ওখান থেকে বেরিয়ে তারপর কী করত সেটা তখন ভেবে দেখত নাহয়। তবে জীবনটা যে রঙিন হত সেকথা না বললেও চলে।
ছোটবেলা থেকে কলেজে ঢোকার আগে পর্যন্ত ভারহীন জীবন ছিল বিক্রমের। লেখাপড়া, গানের ব্যান্ডে ড্রাম বাজানো, পাড়ার পুজোয় নাটক করা, বেপাড়ার মেয়েদের একটু ইয়ে করা… এভাবেই কেটে যাচ্ছিল জীবন।
বাড়িতে ফিরে মায়ের হাতের তৈরি খাবার খাওয়া, বাবার সঙ্গে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম নিয়ে আলোচনা, একটু রাত অবধি গল্পের বই পড়া, তারপর পাশ-বালিশকে সুহৃতা ভেবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়া। পালক-পালক জীবনটা যে কখন পাথর-পাথর হয়ে মাথায় চেপে বসল, তার কোনো আগাম হদিশ ছিল না বিক্রমের কাছে।
কানাডায় যাবার বন্দোবস্ত চলাকালীন হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ল বিক্রমের মা। অসুস্থ বললে অসুখের গুরুত্বটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আসলে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল। ঠাকুরঘরে যাবে বলে হাতমুখ ধুচ্ছিল। দুম করে পড়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল। ডাক্তার বললেন, সেরিব্রাল স্ট্রোক।
বিক্রমের কথায়, ‘তারপর মা যম রাজার সঙ্গে মা দুর্গার মতো যুদ্ধ করল প্রায় এক মাস। এই যম প্রায় জিতে যায় তো মা দুরন্ত ফাইট করে ফিরে আসে। কিন্তু মা তো সত্যি সত্যি ঈশ্বরী ছিল না, তাই শেষমেশ যমই জিতে গেল। আমার রামধনু ওঠা আকাশটা মিশকালো মেঘে ঢেকে গেল। ‘
বাবা অসম্ভব ভেঙে পড়ল। বাবাকে সামলাতে গিয়ে মায়ের জন্য চোখের জল ফেলার সময় পেল না বিক্রম । বাইরে না বেরলেও সেই জল জমতে লাগল মনের ভেতরের গোপন জলাশয়ে। এখানে গল্পের আর একটা শাখা আছে। সেটা হল বিক্রমের থেকে দশ বছরের বড় দিদি বৈশালী।
বৈশালী এপিসোডটা এতক্ষণ সামনে আসেনি তার কারণ সে তার থেকে বয়েসে খানিক ছোট একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছিল। থানা পুলিশ হয়েছিল কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। প্রায় একমাস পর লুধিয়ানা থেকে ফোন করেছিল বৈশালী। কিন্তু বিস্তারিত শুনতে রাজী হয়নি বিক্রমের বাবা বা মা কেউই।
বৈশালীর অস্তিত্বটা হঠাৎ করেই নেই হয়ে গেছিল বিক্রমদের পরিবারে। বাবা মা কটা পাথর বুকে চাপিয়ে মেয়েকে ভুলে থাকার অভিনয় করেছিল কে জানে। তবে বিক্রম অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিল ওর দিদি এভাবে চলে যাওয়াতে। অনেকটা বড় হলেও দিদি বন্ধুর মতো মিশত বিক্রমের সঙ্গে। সুরক্ষাও দিত প্রয়োজনে। ওকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে কি দিদির একটুও কষ্ট হল না!
সুহৃতাকে খুব পছন্দ ছিল বিক্রমের। ওর বন্ধু সাগ্নিকের বোন। সুহৃতার হাঁটা চলায় একটা চাপা দম্ভ ছিল আর সেটাই ভালো লাগত বিক্রমের। যদিও কখনও বলে উঠতে পারেনি সুহৃতাকে। সাগ্নিককে ঠারে-ঠোরে বলেছে দু একবার। ‘সাহস থাকলে নিজে সরাসরি বল’ ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছে সাগ্নিক। সেই কাজটা করে ওঠার আগেই জীবনের পট পরিবর্তন হয়ে গেছে বিক্রমের।
সভ্য ভদ্র একটা চাকরি পেয়েছিল বিক্রম। ওটুকুই ছিল একমাত্র তৃপ্তির জায়গা। ঠিক করেছিল, কিছু সঞ্চয় করে বছর তিনেক পর বাবাকে নিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়াতে যাবে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা কোনো হোটেল বা হোমস্টে বুক করে বসে বসে শুধু প্রকৃতি দেখবে। বাবারও মনটা শান্ত হবে কিছুটা।
অফিসে টিফিন ব্রেকের পরপরই ফোন এল। ‘ দাদাবাবু, মেসোমশাই কলঘরে পড়ে গেছে। আমি একা তুলতে পারবনি। তুমি এসো।’
বিক্রম বসকে বলে তড়িঘড়ি বাড়ি ফেরে। আবার সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, ডাক্তারবাবু, অপারেশন থিয়েটার, পঙ্গত্ব। পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙেছে শুধু নয়, আঘাত লেগেছে নার্ভ জাংশনে। কোমরের নীচ থেকে অসাড় হয়ে গেছে, সারবে না। আর এক যুদ্ধ শুরু হল বিক্রমের। এ যুদ্ধে গোলা বারুদ লাগে না, লাগে কেবল ধৈর্য। দিন পনেরো হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরল বিক্রমের বাবা।
বিক্রমের কথায়, ‘মা চলে যাবার পর বাবার কথা বলা কমে গিয়েছিল। নিম্নাঙ্গ অসাড় হয়ে বাবার মুখে পুরো তালা পড়ে গেল। হ্যাঁ আর না ছাড়া কথা বলা বন্ধ করে দিল। আমি বুঝে গেলাম, নিজেকে বোঝা ভাবতে শুরু করেছে বাবা।
‘দুবেলা দুজন আয়ার ব্যবস্থা করলাম। দিনের আয়া সন্ধ্যাদি রান্নাটাও করে দিচ্ছিল। আমি ধৈর্য জড়ো করে দিন কাটাচ্ছিলাম। অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বাবার কাছে গিয়ে বসি। বাবা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কাঁদে হয়তো। আমি সারাদিনের বাছাই করা কিছু কথা বলি। আগে বাবার সঙ্গে অনেক কিছু আলোচনা করতাম। রাত্রে বসে বসে ইউটিউবে পাহাড়ি জায়গাগুলো দেখি।’
‘সুহৃতার বিয়ে হয়ে গেছে। খুব স্বাভাবিক। আমার বয়েস উনচল্লিশ। ওর খুব কম হলেও তেত্রিশ চৌত্রিশ হবে। তাছাড়া, সরাসরি কোনোদিন বলেই তো উঠতে পারিনি যে ওকে আমার খুব পছন্দ। সে কারণে আমার পাশবালিশ হয়েই থেকে গেল সুহৃতা।
‘বসে আই পি এল দেখছিলাম। নাইট রাইডার্সের খেলা ছিল। রাতের আয়া মাসি এসে ডাকল, বাবা নাকি সাড়া দিচ্ছে না। বাবার হাতটা ধরে পালস বোঝার চেষ্টা করলাম। নাকের কাছে হাত রাখলাম। বাবা, বাবা বলে ডাকলাম। মনে হল, বাবা হাসছেন। হাসারই তো কথা। কতদিন পর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে।’
শ্রাদ্ধশান্তি মেটার পর বিক্রমের এক অফিস কলিগ ওকে পরামর্শ দেয় দিন পনেরো ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে। বিক্রমও সেরকমই ঠিক করেছে। শূন্য বাড়িতে ঢুকতে ভয়ঙ্কর খারাপ লাগছে ওর। একটা মানুষ থাকা আর না থাকায় যে কতটা তফাত, সেটা ভীষণভাবে বুঝছে।
অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং -এ একটা রিসর্ট বুক করেছে বিক্রম। মনটা ভার হয়ে আছে। বাবাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে ভেবেছিল। এখন ও মুক্ত পুরুষ। কিন্তু মুক্তিও সব সময়ে আনন্দের হয় না! কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরেছে বিক্রম। বাবা চলে গেলেও সন্ধ্যাদি রয়ে গেছে। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অবধি থেকে বিক্রমের সংসার সামলে দিয়ে ফিরে যায়।
সন্ধ্যা বেরিয়ে যাবার কিছু পরে বেল বাজে। বিক্রমের কথায়, ‘আমি একটু অবাক হই, এখন আবার কে এলো ভেবে। দরজা খুলে দেখি পুলিশের ইউনিফর্ম পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে। আরো অবাক হয়ে জিগ্যেস করি, কী ব্যাপার?
‘আপনি কি বিক্রম দত্ত?’ আমি হ্যাঁ বলাতে প্রশ্ন করে, ‘বৈশালী দত্ত আপনার দিদি?’ আমি হকচকিয়ে যাই। এত বছর পর দিদির নামটাই কেমন অচেনা ঠেকছে। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি।
‘আরোগ্য নার্সিং হোম থেকে আমাদের থানায় ফোন করেছিল। আপনার দিদির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ওখানে ভর্তি আছে। আপনাকে যেতে বলেছে।’
‘পরের দিন অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে আরোগ্য নার্সিং হোমে যাই। দিদির বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার হাত দুটো ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে দিদি।
‘বৃত্তান্ত হল, পালিয়ে বিয়ে করার বছর দুই পরে ওর বর কী এক কাজ নিয়ে দুবাই চলে যায়। তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই। দিদি এরপর শাড়ির দোকানে একটা কাজ জুটিয়ে কোনোমতে নিজেরটা চালাচ্ছিল। সেই দোকান উঠে যায়।‘ কাজ খুঁজতে বেরিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে। সেই দালাল ওকে বিক্রি করে দেয় কোনো এক মাড়োয়ারির কাছে। সেখান থেকে পালাবে বলে তিনতলা থেকে ঝাঁপ দেয়। দুটো পা, পাঁজরের কয়েকটা হাড় ভেঙে এখন এখানে। এক বিক্রম ছাড়া ওর চারিদিকে আর কেউ নেই।’
এ যুদ্ধ লড়তে অনেক অনেক অনেক ধৈর্যের দরকার বিক্রমের। এখন ও শুধু পাগলের মতো ধৈর্যের সন্ধান করছে।
গল্পকার ও “কিশোর ভারতী” পত্রিকার সহ সম্পাদক।