| 9 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: সনাক্তকরণের চিহ্নমালা । দেবাশিস ধর

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
       ‘কাকু, বাবাকে দেখলেন নাকি ভিতরে’?- প্রশ্নকর্তা বয়সে সুনীলেশের চেয়ে কমসে কম বছর সাত বা আট বছরের বড় হলেও তার ‘কাকু’ সম্বোধন আদতে কলকাতার ছেলে সুনীলেশকে এখন আর অবাক করে না। উত্তরবঙ্গের কাছাকাছি নিম্ন অসমের এই অঞ্চলে ‘কাকু’ সম্বোধন অনেকটা ‘দাদা’ অর্থে। সাধারণভাবে বয়সে বা মর্যাদায় বড় কাউকে ‘কাকু’ বলে সম্বোধন করাটা নিতান্ত স্থানীয় দস্তুর। এই ক্ষেত্রে সুনীলেশ প্রশ্নকর্তার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও রেলের কারখানার একজন সুপারভাইজর হওয়ার সুবাদে ‘কাকু’ বলে সম্বোধিত হয়েছে। সুনীলেশদের মেসের রাঁধুনিকে ওরা ‘মাসি’ বলে ডাকলেও সেই মাসি আবার ওদেরকে ‘কাকু’ বলে ডাকে। বাইরের থেকে কেউ এলে এই নিয়ে বেশ হাসাহাসি হয়।         
      ‘রাঘববাবুর পেমেন্টতো অনেকক্ষণ আগেই হয়ে গেছে। কেন কিছু হয়েছে নাকি?- সুনীলেশের কথার উত্তরে রাঘববাবুর ছেলে ‘কাকু, জানেনই তো সব’ বলে চুপ করে রইল। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন উত্তেজিতভাবে তর্কাতর্কি করে যাচ্ছে যার মর্মার্থ রাঘববাবু কারখানা থেকে সবার সাথে বের না হয়ে ভেতরেই কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে, খানিকক্ষণ পরে সুযোগ বুঝে ঠিক বের হয়ে ভাগবে। কেউ আবার বলছে অমুক ঠিকমতো নজর রাখেনি তাই কোনওভাবে রাঘববাবু কারখানা থেকে বেরিয়ে টাউনের দিকে কেটে পড়েছে। ঘটনার মাথামুন্ডু কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সুনীলেশ সাইকেলে উঠে পড়ল।          
        অন্যান্য প্রতি মাসের বেতনের দিনের মত আজও রেলের এই কারখানার বাইরে ছোটখাট একটা মেলা বসে গেছে। জিলিপি, বোঁদে, খুরমা থেকে জামাকাপড়ের দোকানতো আছেই এমনকি দাঁত বাঁধানো, চশমা বা বলবর্ধক বিশেষ হাকিমি ওষুধের দোকানও যথারীতি বসে গেছে। অবশ্য জামাকাপড় বলতে বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে আসা সস্তা দামের পুরানো শার্টপ্যান্ট, সোয়েটার, কোটের দোকানও আছে। সম্ভবত একাত্তরের যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাহায্যার্থে ইউরোপ বা আমেরিকার লোকজনদের পাঠানো জামাকাপড় ছিল এইসব। কারখানার গেট থেকে রেল কলোনির দিকে যাওয়ার রাস্তাটার বিভিন্ন ‘স্ট্রাটেজিক পয়েন্টে’ সুদের কারবারিরা পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছে- তাদের খাতকরা কেউ যাতে সুদের টাকা না দিয়ে সটকে যেতে না পারে। বিকেল চারটায় কারখানার ছুটির সাইরেন বাজার পরের দেড়দু’ ঘন্টা এই জায়গাটা মানুষজনের হৈ হট্টগোলে জমজমাট থাকবে।          
        সুপারভাইজর হিসাবে পেইন্ট শপের কর্মীদের সে’মাসের বেতন দেওয়ার তত্বাবধান করার দায়িত্ব সেরে সুনীলেশ যখন কারখানার থেকে বেরোলো তখন প্রায় পৌনে পাঁচটা বাজে। মেলার হৈচৈ তখন তুঙ্গে। এই ভীড়ের মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া মুশকিল, তাই সাইকেল নিয়ে হেঁটেই জায়গাটুকু পার করে দেয় সবাই। দাঁত সারাইয়ের দোকানে একটু বেশী ভীড় চোখে পড়ে সুনীলেশের। একজনের দাঁত থেকে একটা কাঠির মাথায় দিব্যি চাম-উকুনের সাইজের সাদা একটা জ্যান্ত পোকা বের করে নিয়ে এল হাতুড়ে ডাক্তার। দাঁতে যে এমন পোকা হয়ইনা সেকথা কে বোঝাবে লোকদের- হাতুড়ে ডাক্তারের হাতসাফাইয়ের প্রশংসা না করে পারেনা সুনীলেশ।   
       ভীড়টা পেরিয়ে আসতেই একটা ছোটখাট জটলার মধ্যে থেকে উত্তেজিত গলায় বাদবিতন্ডার আওয়াজ শোনা যায়। সুনীলেশ দেখে সেই জটলার কেন্দ্রে তার পেইন্ট শপের কর্মী রাঘববাবুর ছেলে- যে প্রতিদিন তার বাবাকে সাইকেলে করে কারখানার গেটে পৌঁছে দিয়ে যায় আবার পরে এসে নিয়েও যায়। সেই সুত্রে অনেকের সাথে সুনীলেশেরও মুখচেনা। চোখাচোখি হতেই একটু এগিয়ে এসে রাঘববাবুর ছেলে উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চায়- ‘কাকু, বাবাকে দেখলেন নাকি ভিতরে’?        
       পরদিন গ্রেড ওয়ান পেইন্টার রাঘববাবু কারখানায় অনুপস্থিত থাকে। গতকালের ঘটনার প্রেক্ষিতে রাঘববাবুর আজকের অনুপস্থিতি সুনীলেশের মনকে অনুসন্ধানী করে তোলে। কিন্তু কার কাছেই বা এই ব্যাপারে জানতে চাওয়া যায়? ফোরম্যান সাহেব কড়া ধাতের লোক- মাত্র বছরখানেক আগে শিক্ষানবিশি শেষ করে সুপারভাইজর হিসাবে পোস্টিং পাওয়া সুনীলেশকে কাজের জায়গায় কোনও অধস্তন কর্মীর সাথে বেশীক্ষণ কথা বলতে দেখলে ভ্রু কোঁচকাবেই। কিন্তু মাথায় রহস্যের গন্ধ পাওয়া পোকাটাও তো মাঝেমাঝেই নড়েচড়ে উঠছে। আচ্ছা, অফিসের বড়বাবু মতিলাল চক্রবর্তীকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? একে স্থানীয় মানুষ তার উপর বহু বছর এই জায়গায় চাকরি করার সুবাদে সবারই হাঁড়ির খবর জানে। তবে ভদ্রলোক বড্ড বেশী কথা বলে- এই যা।                  
        ‘ও জমিদারবাবুর কথা বলছেন’- স্বভাবরসিক মতিলাল চক্রবর্তী ফিকফিক করে   হাসে- ‘কিছুই খবর রাখেন না দেখছি মশাই, খালি আউটটার্নের হিসাব রাখলে হবে? জমিদারবাবুর ভালোমন্দ খাওয়ার বাসনা আর এদিকে ঘরে এতগুলি লোক- এই বেতনে সবার দু’বেলা ডালভাত জোগাড় করাই মুশকিল- মাছমাংস, পায়েস আর কোত্থেকে জুটবে বলুন। কিন্তু সবার কথা ভাবতে গেলে ভালোমন্দ খাওয়ার ইচ্ছেটা কোনদিনই আর এই সংসারে পূর্ণ হওয়ার নয়।  তাই আগে বেতনের দিন টাকাপয়সা সব পকেটে নিয়ে বুড়ো বাড়ি না গিয়ে টাউনের দিকে চলে যেত।  একদু’দিন এখানে সেখানে লুকিয়ে থেকে টাউনের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মিষ্টির দোকানে প্রাণভরে চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় সাটিয়ে তারপর যথারীতি পেট খারাপ বাঁধিয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসত ততক্ষণে পকেট অনেক হালকা হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন হোল বেতনের দিন রাঘব চৌধুরীর ছেলে সঙ্গীসাথী নিয়ে কারখানার গেটের বাইরে ওৎ পেতে বসে থাকে- বাপ বের হলেই যাতে পাকড়াও করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বেতনের টাকাপয়সা কেড়ে নিতে পারে। কাল মনে হয় বাপ ছেলেকে টুপী পড়িয়ে ভেগে গেছে- মতিলাল আবার হাসে।           
        আশ্চর্য ব্যাপার! এমনও হয় নাকি!- সুনীলেশের কৌতূহল আরো বেড়ে যায়- কিন্তু ‘জমিদারবাবু’ বা ‘বুড়ো’ এই কথাগুলো কেন?   সুনীলেশের বাড়িয়ে দে’য়া সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে দুটো সিগারেট বের করে একটা পকেটে পুরে অন্যটা ধরিয়ে লম্বা টান দেয় মতিলাল চক্রবর্তী।             
        পার্টিশনের পরে পূর্ববাংলা থেকে অনেক ছিন্নমূল পরিবারের  সাথে রাঘবেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীও সপরিবার কোনভাবে এখানে চলে আসে।  তখন এদের মধ্যে যারা উপযুক্ত  তাদের  রেলের  কারখানায় খালাসির চাকরি দেয়ার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুশকিল হোল চাকরি প্রার্থীদের কারো কারো বয়স তখন প্রায় চল্লিশ হয়ে গেছে। সেই সময়কার কারখানার ম্যানেজার সেন সাহেব সোজা ফর্মুলা তৈরি করলেন- প্রার্থীদের মুখে শুনে এবং চেহারা দেখে বয়স তিনিই ঠিক করে দিলেন- আঠারো থেকে পঁচিশের মধ্যে। এভাবে বত্রিশ বছরের লম্বাচওড়া চেহারার রাঘব চৌধুরী রেলের খাতায় ‘তেইশ’ বছরের যুবক হয়ে গেল সেই নাইন্টিন ফর্টিএইটে। মানে এখন রেলের খাতায়  চৌধুরির বয়স চুয়ান্ন বছর হলেও আসল বয়স তেষট্টি।                 
      খালাসির চাকরি করলেও গৌরবর্ণ রূপবান রাঘব চৌধুরীকে সবাইতো বটেই এমনকি সেন সাহেবও যথেষ্ট খাতির করত  কারণ সে নাকি কোন এক বড় জমিদার বাড়ির ছেলে ছিল। শিক্ষাগত যোগ্যতার জায়গায় বেশীরভাগ প্রার্থীর ‘চতুর্থ শ্রেণী উত্তীর্ণ’ লেখা থাকলেও রাঘব চৌধুরিকে ‘নবম শ্রেণী উত্তীর্ণ’ বলে লেখা হয় সেন সাহেবের নির্দেশে। তবে সবাই এত সমাদর  করলেও ঘরসংসারের কাজেই হোক বা কারখানায় কাজেকর্মেই হোক- জমিদারবাবু’ কোনদিনই  আগ্রহ বা উদ্যোগ দেখাতে পারেনি। ফলে চাকরিতে বা সংসারে উন্নতি করা তার দ্বারা হয়ে উঠেনি। যা বেতন পেত সব ভালোমন্দ খাওয়ার পেছনেই খরচ করত।  মেয়েদের রূপের জোরে বিয়ে হলেও ছেলেদুটোর পড়াশোনা তেমন আর হোল কোথায়- বড় ছেলেতো বৌ বাচ্চা নিয়ে বাপের হোটেলেই থাকে।              
      এইসব ‘তালপুকুরে ঘটি ডোবে না’ কিসিমের জমিদারদের গল্প আবাল্য শুনে এসেছে সুনীলেশ। ওর মা-ই নাকি ওপার বাংলার এক জমিদারবাড়ির মেয়ে ছিল। এই নিয়ে সুনীলেশের পার্টি-করা বাবা সুযোগ পেলেই ছেলেমেয়েদের সামনেই রসিকতা করত স্ত্রীর সাথে। ‘তোরা গল্প শুনেছিস না এক রাজা একবার তরোয়াল কোমরে ঝুলিয়েও যুদ্ধে যেতে পারেনি কারণ সেই সময় তার জুতো পরিয়ে দেওয়ার ভৃত্য হাজির ছিল না- ফল যা হবার তাই হোল। লেখাপড়ায় অনুৎসাহী এক শ্রেণীর বিলাসী জমিদারনন্দনও ছিল ঠিক তাই- সদর্থে মাকাল ফল। দেশভাগ এদেরই সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। নাহলে আমার মতো সাধারণ সরকারি কর্মচারীর সাথে জমিদার বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়’- বাবা মা’র দিকে তাকিয়ে হাসে।                        
      ছেলে-মেয়েরাও বাবার কথায় আশকারা পেয়ে বিষয়টা বুঝে বা না বুঝেই মায়ের পেছনে লাগে। সুনীলেশের ছোটভাই পিন্টু মা’র কাছে মায়ের কি রকম এক জ্যাঠতুতো দিদি- ‘যার গায়ে, মুখে কাদা লেইপ্যা দিলেও পরীর মতো রূপ ঢাইক্যা রাখা যাইত না’-  তার বিয়ের অনেকবার শোনা গল্পটাই আবার শুনতে চায়। পিন্টু যে মশকরা করছে সেটা বুঝতে পেরেও মা আবার শুরু করত সেই কাহিনী, মনে হত মা’ই যেন আরো একবার বলতে পেরে খুশী হয়েছে।    
      মায়ের মুখে শুনে শুনে  ছেলে-মেয়েদের সবারই একদম মুখস্থ হয়ে গেছে-  মায়ের সেই পরীদিদিকে ছোটবেলায় বৈদ্যনাথ নামের  শ্যামলা গাত্রবর্ণের এক পরিচারক কোলে নিলে সবাই বলত- ‘দ্যাখ, দ্যাখ ঠিক যেন কাকের মুখে কমলা’। পরীদিদির ঠোঁটের ডানকোণে একটা কালো রঙের তিল ভগবান নিজের হাতে এঁকে দিয়েছিল। মায়ের পরীদিদি যখন জল খেত তখন গলা দিয়ে জল যে নামছে তা’ দেখা যেত- এতোটাই ফরসা গায়ের রঙ! পরীদিদির বিয়েতে বর এসেছিল হাতির পিঠে। খুব জাঁকজমক হয়েছিল- আত্মীয় অনাত্মীয়রা সব বলেছিল- ‘রাজার ঝির বিয়া, সোজা ব্যাপার নাকি’।       
       ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশের রায়টের সময় অন্য অনেক জমিদার বাড়ির মতো মায়ের পরীদিদির বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়িও আক্রান্ত হয়- যে ক’জন প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিল তারা কয়েকজন বিশ্বাসী কর্মচারীর সাহায্যে  প্রায় একবস্ত্রে চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে সীমান্তের এপারে চলে এসে এদিক সেদিক ছিটকে পড়েছে। অনেকের সাথেই পরে যোগাযোগ হলেও পরীদিদিদের কোন খবর পাওয়া যায়নি।  মা’র ধারণা পরীদিদির রূপের জন্য অন্য বিপদও কিছু ঘটে থাকতে পারে, আর যদি কোনভাবে এপারে এসে থাকে তবে হয়ত ভালো অবস্থায় নেই তাই কারও সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টা করেনি। ‘হাজার হইলেও রাজার ঝি তো’- মা স্বগতোক্তি করে। মায়ের কথা শুনে সুনীলেশের মনে হত আলো-আঁধারিতেও বহুদূর থেকে এক ঝলক দেখে মা তার  পরীদিদিকে এখনো ঠিক চিনে ফেলবে।         
       পরের দু’দিনও রাঘব চৌধুরী অনুপস্থিত থাকে। একটু বেলার দিকে মতিলাল চক্রবর্তী জানায় যে রাঘব চৌধুরীর এবারকার অ্যাডভেঞ্চার আদৌ সুখের হয়নি। ছেলে দলবল নিয়ে তার লোভী বাপকে যখন টাউন থেকে ধরে নিয়ে আসে তখনই বুড়োর হাল খারাপ। কিন্তু বুড়ো কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি হবেনা বলে গোঁ ধরে আছে- এদিকে অবস্থা মনে হয় খারাপের দিকেই যাচ্ছে।  ‘চলুন আজ বিকেলে একবার যাই, রাঘব চৌধুরীকে বলব- ফোরম্যান সাহেব পাঠিয়েছে, আপনাকে দেখলে আমার কথা অবিশ্বাস করবে না’- মতিলাল চক্রবর্তী প্রস্তাব দেয়। সুনীলেশ একটু দ্বিধায় পড়ে-  এভাবে কোন অধস্তন কর্মীর কোয়ার্টারে যাওয়ার ব্যাপারে সুপারভাইজরদের অলিখিত মানা আছে। কিন্তু মতিলালবাবুর প্রস্তাবটায় সোজাসুজি না করেই বা কিভাবে- বিষয়টার একটা মানবিক দিকও তো আছে! সুনীলেশ নিমরাজী হয়ে যায়।
       ‘নামে ডাকে চূড়াভানু ভাতে বাঁচে না’- ‘বাবু রাঘবেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর ঘরে ঢুকে সুনীলেশের ওর মায়ের বলা গ্রাম্য প্রবাদটা মনে পড়ে যায়। জমিদার বাড়ির বৈঠকখানাই বটে! একদম যেন কোন সাদাকালো বাংলা সিনেমায় দেখানো এক অভাবগ্রস্ত পরিবারের ঘরের চিত্র! ঘরে থাকা একমাত্র কাঠের চেয়ারটা সুনীলেশের দিকে এগিয়ে দেয় রাঘব চৌধুরীর ছেলে। ঘর জুড়ে থাকা চৌকিটাতেই বসে মতিলালবাবু। নাঃ, এখানে বেশীক্ষণ বসে থাকা যাবে না। সুনীলেশ মলিন বিছানায় শুয়ে থাকা রাঘব চৌধুরীকে তাদের এখনে আসার উদ্দেশ্য জানায়- ‘ফোরম্যান সাহেব বলে পাঠিয়েছে আপনাকে আজ এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তা’ নাহলে বুঝতেই পারছেন, ফোরম্যান সাহেবকে তো চেনেন- সুনীলেশ এখানেই কথা শেষ করে মতিলালবাবুকে বলে- চলুন, ওঠা যাক্‌। রাঘব চৌধুরী ক্ষীণ স্বরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে সন্মতি জানিয়ে মতিলালবাবুকে আরো একটু সময় বসতে বলে। ‘ঠিক আছে, বড়বাবু আপনি তা’হলে বসুন’- বলে সুনীলেশ একাই উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্থানোদ্যত হয়। কিন্তু…             
        সুনীলেশের বেরিয়ে যাওয়া হয় না- কাগজের মতো ফ্যাকাসে চেহারার, শীর্ণকায়া, প্রায় নিরাভরণ এক নারীমূর্তি ভেতরের ঘর থেকে এই ঘরে প্রবেশ করে- কিন্তু কিছুই বলে না, অস্থির দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখতে থাকে। রাঘব চৌধুরীর ছেলে একটু বিব্রত হয়ে বলে- আমার মা।  তারপর নিজের মাথায় কয়েকবার তর্জনী ঠুকে ইশারায় মায়ের মানসিক অসুস্থতার কথা বোঝায়।     
       সুনীলেশ অপলক চেয়ে থাকে মলিনবসনা প্রায়-বৃদ্ধার ভাঙ্গাচোরা, বিষাদমাখা কিন্তু ‘চেনাচেনা’ মুখটার দিকে- যেন অপ্রত্যাশিতভাবে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক হারিয়ে যাওয়া রূপলক্ষ্মীর ভগ্নপ্রায় দেউলের সামনে।  সুনীলেশ খুঁজে বেড়ায় সনাক্তকরণের চিহ্নমালা- সেই দুধে আলতা গায়ের রঙ, সেই ঘন মেঘের মতো কেশরাজি, সেই পান পাতার মত মুখাবয়ব, সেই মুক্তোঝরা হাসি, সেই পদ্মদীঘির মতো চোখ, সেই কৃষ্ণ গোলাপের পাপড়ির মত ভ্রু যুগল। কিন্তু মায়ের মুখে বহুবার শোনা মায়ের পরীদিদির রূপের বর্ণনার কিছুই যেন ঠিক ঠিক মেলে না এই রুগ্ন, প্রায়-বৃদ্ধার সাথে, শুধুমাত্র  ‘ঠোঁটের ডানকোণে ভগবানের নিজের হাতে আঁকা কালো রঙের তিলটা’ ছাড়া- যে বিশ্বস্ত সৌন্দর্য-চিহ্ন দেশভাগের ভয়ংকর আঘাত আর লাঞ্ছনা, কালের থাবা, আশাহীনতা আর দারিদ্রের নিত্য নিপীড়ন, নিকটজনের উদাসীনতা ও নিজের মানসিক অসুস্থতাও মায়ের পরীদিদির কাছ থেকে এখনো কেড়ে নিতে পারেনি।               
      মায়ের পরীদিদির ‘প্রত্নাবশেষ’ সনাক্তকরণে সুনীলেশের কোন অসুবিধাই আর হয় না।   
      

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত