| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: ভুলাইদার কীর্তি । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

                                     

ভুলাইদা না এলে আড্ডা জমে না। এক একটা কথা বলবেন সে কথার মাথামুন্ডু নেই। তা শুনতে যেমন অদ্ভুত, তেমনি হাস্যকর।  আড্ডায় যখন ভুলাইদা এসব কথা বলেন  তখন শুনতে হেভি লাগে। আমরা  চমকে চমকে উঠি।

 আমরা মানে  পুলকদা, জয়ব্রত ওরফে টিমদা। আর  আমি  সৌরিশ ওরফে পমপম।

পুলকদা ট্যুর কন্ডাক্ট করে। হিল্লীদিল্লী যায়।  টিমদা  ব্যবসা করে। আমি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করি। একটা ব্যাপারে আমাদের মিল আছে। রবিবার সন্ধ্যেবেলা সবাই পুলকদার  বাড়িতে আড্ডা দিতে আসি। সেদিন ভুলাইদার জন্য  অপেক্ষা করি।

কিন্তু আজ বড্ড দেরী করছেন ভুলাইদা। পুলকদা অনেকক্ষন ধরে ফোন ঘাঁটছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “ফোন করে দেখব নাকি?”

টিমদা বলল “উহু। ভুলাইদা ধরবেই না।“

তা ঠিক কথা। ভুলাইদা ফোন ধরার লোক নন। আমি বললাম,” আজ আসার কথা ভুলে যায় নি তো?”

পুলকদা বলল,” হু। ভুলতে পারে। সেবার ভুলেই তো মালদা চলে গেছিল। ওখানেই তো ওই কান্ডটা ঘটাল। বাপ রে! ভাবলেই গা শিরশির করে।চার-চারটে ডাকাতকে ধরা মুখের কথা নাকি?” টিমদা বলল, “ঘটনাটা সত্যি কিনা আমার সন্দেহ আছে!”

পুলকদা ওর দিকে তাকাল। তারপর উত্তেজিত স্বরে বলল, “তুমি কি বলতে চাইছ? ভুলাইদা মিথ্যে বলেছে? এমন কথা  ভাবতে পারলে?”

টিমদা তাড়াতাড়ি বলল, “আরে না। না। আমি তেমন কথা বলি নি।“

“আলবাত বলেছ।“

এই দুজনকে নিয়ে মহামুসকিল। ফাঁক পেলেই ঝগড়া করবে। পুলকদা ভুলাইদার অন্ধ ভক্ত। টিমদা সন্দেহবাতিক। আমি অবশ্য  কোনদিকে নই। ওদের  থামিয়ে দিয়ে বললাম, “ওসব কথা বাদ দাও। ভুলাইদা না এলে খুব মুসকিল। আগের দিন পুরো বলেন নি ভুলাইদা।

পুলকদা মাথা নেড়ে বলল, “হুম। ওইজন্যই অপেক্ষা করছি। সাতদিন ধরে শুধু ভাবছি শেষে ভুলাইদা কি করল!”

টিমদাও মাথা নাড়িয়ে  বলল,” হু। গল্পটা বেশ জমেছিল।“

পুলকদা চোখ পাকিয়ে বলল, “গল্প নয়। সত্যি ঘটনা।“

সত্যিমিথ্যে যাই হোক, এইবেলা সেদিনের ভুলাইদার অসমাপ্ত  গল্পটা থুড়ি সত্য ঘটনা  বলা যাক।  ভুলাইদা কি কাজ  করেন কে জানে! কিন্তু  সপ্তাহে মাসে তিনি এখানে ওখানে যান। সেবার  বিশেষ কাজের জন্য যেতে হয়েছিল বীরনগর বলে একটা মফস্বলে। একটা  নিরিবিলি জায়গায়  আস্তানা জুটেছিল। একতলার ঘরটা বড়। রান্নাবান্না করার সরঞ্জাম সব আছে। কিন্তু রাতে সমস্যায় পড়লেন। খাবার কথা মনে পড়তে  মাথায় হাত। রান্না করা যাবে, কিন্তু জিনিষপত্র কই?  রাত যা হয়েছে তাতে কোন দোকানও খোলা নেই!  কি করা যায় ভাবতে ভাবতে ভুলাইদা রান্নাঘরে এলেন। কৌটোগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন কিছু আছে কিনা? বিস্কুট-টিস্কুট যদি থাকে! দেখতে গিয়ে ভুলাইদা অবাক হয়ে গেলেন। সবকিছুই তো আছে। চাল ডাল, তেল, নুন। কে রেখেছে কবে রেখেছে ওসব আর মাথায় রইল না ভুলাইদার। মেঘলা মেঘলা ওয়েদার। তোফা খিঁচুড়ি করা যাবে।তাই করতে শুরু করলেন ভুলাইদা।

ঠিক সেসময়েই ভুলাইদাকে কে যেন বলে উঠল। “চারজন আছি। চাল ডাল বেশি করে নিন।“

ভুলাই্দা চারপাশে তাকালেন। কেউ নেই। তিনি যা বোঝার বুঝে গেলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা আছে। তিনি নিজের মতো কাজ করতে লাগলেন।

“কি হল? বললাম না। বেশি করে নিন”

 ভুলাইদা কোন কথাই বললেন না।

অন্যদিক কিছুক্ষন  চুপচাপ। তারপরেই ভুলাইদা দেখলেন ওর ব্যাগটা নিয়ে কারা যেন লাফালাফি খেলছে। জুতো জোড়া দেখা গেল টিউবলাইটের দুপাশে ঝুলছে। একটা প্যান্ট পাখার বেল্টে দুলতে শুরু করল। ভুলাইদা আর  মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না।  তিনি  বললেন, “সাহস থাকলে বাইরে আসুন। পরিচয় দিন। এমন গোলমাল পাকাচ্ছেন কেন?”

কেউ এল না। শুধু শোনা গেল একজনের কথা। সে বলল, “এটা আমাদের জায়গা। এখানে কেউ আসুক আমরা চাই না।“

“এমন একটা এদোঁ জায়গায় থাকতে কে চায়? আমি মোটেই থাকতে আসি নি।“

“না থাকুন। এখন তো রয়েছেন।  আমরা নেহাত ভদ্রলোক বলে কিছু বলছি না। নইলে আপনাকে তুলে ফেলে দিতে একসেকেন্ডও লাগবে না।“

“যা করছেন তাও কি ভদ্রতা? সামনে আসছেন না। জিনিষপত্র ফেলছেন? লজ্জা করছে না?”  ভুলাইদা মাথা গরম করে বলেছিলেন।

এইটুকু গল্পই  আমাদের শোনা তারপরেই আজ বাকিটুকু। এখন আমাদের খুবই চিন্তার ভুলাইদার  সঙ্গে চারজন অদৃশ্য লোকের ঝগড়ার পরিনতি কি হল? ভুলাইদা এখন দিব্যি আছেন ঠিক কথা। কিন্তু তিনি ওদের ম্যানেজ করেছিলেন কি করে?

পুলকদা হতাশস্বরে  বলল, “আজ আর আসবে না রে ভুলাইদা।“

কিন্তু আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন। টিমদা দরজা থেকেই ভুলাইদাকে দেখতে পেয়েছে। সে চিৎকার করে বলল, “এসে গেছে।এসে গেছে।“

আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভুলাইদা নীরবে ক্লাবে ঢুকলেন। তাঁর কাঁধে একটা বড় ব্যাগ। এটা তার সবসময়ের সঙ্গী।

বসতে না বসতেই টিমদা বলে উঠল, “ভুলাইদা গতদিনের গল্পটা বলুন”

পুলকদা ঠ্যালা দিয়ে বলল, “আহা। মানুষটা বসুক আগে।পমপম  চায়ের কথা বলে এসো।“

আমাকে উঠতে হল। পুলকদার  বাড়ির ভেতরে চায়ের কথা বলে এলাম। একটু পরে আমাদের সবার জন্যই  চা এসে গেল। চা খাওয়ার পর পুলকদা এবার  বলে উঠল।“ নিন এবার গল্পটা  শুরু করুন”

“কোনটা বল তো”?

এই রে! মহামুসকিল। ভুলাইদা  কিছুই মনে রাখেন না। আমি বললাম  “ওই যে বীরনগরে গেছিলেন না!”

“আর একটু বল।“

আবার বললাম। ভুলাইদা চোখ বন্ধ করে শুনলেন। আর বারবার বলতে লাগলেন, “আর একটু!“

গল্পটাই আবার নতুন করে ভুলাইদা শুনে ফেললেন। তারপর মিটিমিটি হেসে বললেন,” এইবার মনে পড়েছে। এই তো কদিন আগে আমাকে ওরা চিঠি দিল।“

“চিঠি? কারা চিঠি দিল?”

ভুলাইদা উত্তর দিলেন না। কথাটা শুনতেই পেলেন না যেন। আমরা এ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ভুলাইদা কিছু একটা যেন ভাবছেন। চোখটা বন্ধ তাঁর।

টিমদা হে হে করে বলল, “সে ছাড়ুন। সেদিন  কি করলেন ?”

“তা কি আর মনে আছে?  অনেকদিন আগের ঘটনা। তবে রাতে চমৎকার খাওয়াদাওয়া হয়েছিল। সরু চালের ভাত আর পাঁঠার মাংস।”

পুলকদা অবাক হয়ে বলল, “সেদিন যে খিঁচুড়ি বলেছিলেন!”

“সে তো বলেছিলাম। কিন্তু তা করি নি। রাতে মেনু পালটে দিয়েছিলাম। পাঁচজন মিলেই খাওয়াদাওয়া করলাম।“

আমি মিনমিন করে বললাম, “সেদিন তো খুব ঝগড়া হচ্ছিল। তারপর মিলমিশ হয়ে গেল?“

“হুম। হল।“

“কিভাবে হল? বলুন না ভুলাইদা।“

ইনিয়েবিনিয়ে অনেক বলার পর এবার ভুলাইদা নড়েচড়ে বসলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি বললেন,”বুঝলে।সে রাতে তো আমার সঙ্গে তো ওদের কথা কাটাকাটি লাগল। ওরা  চিৎকার করছে। হইচই করছে। এটা ছুঁড়ছে।ওটা ছুঁড়ছে। তার উপর ওদের চোখে দেখা যায় না। কিন্তু  জান তো, ওসবে  ভয় পাওয়ার ছেলে আমি  নই। চেয়ে চেয়ে দেখলাম ওদের কীর্তি। অনেকক্ষন পরে বললাম, “দেখুন। ভাই। অনেক হল। আপনারা বিশ্রাম নিন। আমি রান্না সারি। আজ  এখান থেকে  নড়ছি না।“

বলার পর সত্যি  আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর একজন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “সত্যি।আমাদের খাওয়াবেন না?”

আমি বললাম। “আপনারা নিজেরা রান্না করুন।“

“আগুনে বড় ভয় আমাদের। তাছাড়া রান্না করে খেতে গেলে অনেক হাঙ্গামা। এই জন্ম পেরিয়ে মানুষের মতো হতে হবে। সে কারণে খাওয়াই জোটে না।“

“সে তো বুঝলাম। কিন্তু খাবেন কি করে? আবার মনুষ্যজন্ম নেবেন?”

“না। না। কেউ খাবার দিলে খেতে কোন বাধা নেই!”

 “হুম। বুঝলাম।“

“তাই বলছিলাম যদি একটু চালডাল বেশী নেন।“

আমি  তখন মনে মনে অন্য কথা ভাবছি। ভুত হোক, আর মানুষ হোক অভুক্ত বলে কথা। তাদের ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু বিনা পয়সায় কাজ কোনদিন করি নি। আমি সেকথাই ওদের জানালাম। বললাম, “ঠিক আছে। যা খেতে চান তাই খাওয়াব। কিন্তু বিনা পয়সায় নয়। আমাকে টাকা দিতে হবে।“

আমার কথায় দিব্যি ওরা রাজি হয়ে গেল। আমি ভাবলাম ওরা যখন রাজিই হয়ে গেছে তখন ওদের শুধু খিচুড়ি খাওয়াব কেন?  মাংস নয় কেন?

টিমদা না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করল, “অত রাতে মাংস পেলেন কোত্থেকে?”

ভুলাইদা উড়িয়ে দিয়ে  বললেন, “ওদের বলতেই ওরা সবকিছু  এনে দিল। তারপর আমার রান্না শুরু করলাম।  রাঁধতে রাধতে   চারজনের নামধাম শুনে নিলাম। বীরনগরেরই বাসিন্দা। মারা যাবার পর চারজনে ফাঁকা বাড়িতে চলে এসেছে।“

পুলকদা বলল, “সে বাদ দিন। রান্না করার পর কি হল তা বলুন”

“মাংস খাওয়ার পর ওদের এত ভাল লাগল ওরা আমাকে ছাড়তে চাইছিল না। ওদের কথায় তিনচারদিন থেকে গেলাম। ভালমন্দ খাওয়ালাম।“

“বাহ। ইয়ে আপনাকে টাকা দিল?”

“অনেক। অনেক। এই যে তেমন কিছু করি না। ওই কারনেই তো!”

 সত্যিই, ভুলাইদা কিছু করেন না। অথচ রাজার হালে থাকেন। এতদিনে তার কারন বুঝলাম!

গল্প শেষ করার পর ভুলাইদা একটা আরামের নি”স্বাস ফেললেন। চেয়ারে মাথা হেলালেন। টিমদা অবশ্য এসব মোটেই বিশ্বাস করে নি। সে  ফুট কেটে জিজ্ঞেস করল, “ হু। তা বুঝলাম। ভুলাইদা। বেশ। বেশ।কিন্তু  আপনি কি যেন একটা চিঠির কথা বলছিলেন?”

ভুলাইদা  বললেন, “হ্যাঁ। মাঝে মাঝেই ওরা চিঠি দেয়। যেতে বলে।“

টিমদা বলল,” তাই?  আছে নাকি চিঠিটা”?

“ও! আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। দেখবে চিঠি?”

 ভুতের চিঠি বলে কথা। কার না দেখার ইচ্ছে হয়!  আমরা মাথা নাড়লাম।

“দেখাচ্ছি।“ বলে  ব্যাগ থেকে ভুলাইদা ব্যাগ থেকে একটা দুমড়েমুচড়ে যাওয়া পোষ্টকার্ড বার করলেন। আমরা তিনজনেই  হুমড়ি খেয়ে  দেখলাম। হলুদ রঙা পোষ্টকার্ডে  ক’টা ফুটকি আঁকা আছে! টিমদা মাথা  চুলকে  বলল, “কিছু বুঝতে পারছি না ভুলাইদা?  কি ভাষায় লেখা?”

“কি লেখা আছে তোমরা বুঝবে কি করে? ভুতের ভাষা। আমি পড়তে পারি। ওরা লিখেছে, ভুলাইবাবু অনেকদিন পাঁঠার মাংস খাই নি। আপনি একদিন এসে খাওয়ান।“

টিমদা এবার না থাকতে পেরে ফিক করে হেসে  বলল, “কি বলছেন দাদা? চিঠিতে শুধু হিজিবিজি দাগ আছে।“

পুলকদা তৎক্ষনাৎ খেপে উঠে  টিমদাকে বলল, “কে বলল হিজিবিজি লেখা?”

“না তো কি?”

পুলকদা  ফোঁস করে বলল, “তুমি কটা ভাষা জান? এই তো আমি পরিস্কার দেখছি ভুলাইদাকে ওরা আমন্ত্রণ করেছে। তুমি না পড়তে পারলে কি হবে?”

টিমদা মাথা নেড়ে বলছে, “বললেই হবে? ভুলাইদা বানাচ্ছে।“

“মোটেই না”

দুজনের আবার লেগে গেল।  দুজনের কথাকাটাকাটি অনেকক্ষন ধরে শোনার পর আমার মাথা ধরে গেল।   এবার থাকতে  না পেরে বললাম, “আরে  থামো। আমার একটা প্রস্তাব আছে। তা শোনো।“

“কি?”

“দ্যাখো। সত্যিমিথ্যে বোঝার একটাই রাস্তা আছে।আমরা কি কেউ জানতাম  ভুলাইদা পাঁঠার মাংস এত সুন্দর রাঁধেন!”

পুলকদারা মাথা নাড়িয়ে বলল, “না।না”

“ভুলাইদা আমাদের মাংস রান্না করে খাওয়াক। তাহলেই আমরা মেনে নেব।“

দুজনেই বিবাদ ভুলে আমার প্রস্তাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, “ঠিক।ঠিক।“

আমরা এখন ভুলাইদার দিকে চেয়ে রইলাম। একটু আগেই সব কথা তিনি শুনছিলেন।  কথা শোনার পর তিনি  চোখ বন্ধ করে দিলেন।  দিব্যি নাক ডাকতে শুরু করলেন। এখন তাকে ডাকাও যায় না!

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত