উৎসব সংখ্যা গল্প: মুখোশের অন্তরালে । দেবশ্রী ভট্টাচার্য
১)
বাবু মাস্ক নেবেন? মাত্র তিরিশ টাকা!
আরে লকডাউন চলছে, তুই রাস্তায় ঘুরে বেরাচ্ছিস! এক্ষুনি ভাগ নাহলে ফাটকে পুরে দেব।
সার্জেনের ধমক খেয়ে ছেলেটা দু–পা পিছিয়ে গেল। তবে চলে যাওয়ার লক্ষণ দেখা গেল না। কার অপেক্ষায় আছে কে জানে। প্রায় বারোটা বাজে। রাস্তাঘাটে লোক নেই। তাও হাতে ডজন খানেক মাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সার্জেন আবার এগিয়ে এল কীরে, গেলি না যে, বললাম না লক ডাউন শুরু হয়ে গেছে। কেউ আসবে না মাস্ক কিনতে। ভাগ, এখন এখান থেকে।
কেন বাবু আপনি আছেন তো!
আরিব্বাস, পোঁদ পাকা ছেলে সব কথা একেবারে ঠোঁটের ডগায়।
বয়স কত তোর!
পনেরো!
ছেলেটার দিকে তাকাল সার্জেন। অভিজ্ঞ চোখ বলে দিচ্ছে বয়স বারোর বেশি নয়। সব শেখানো আছে, মাস্টারমশাইরা বলে দিয়েছে পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে বলতে পনেরো। চৌদ্দর নীচে হলে চাইল্ড লেবার আইনে পড়ে যাবে তো।
কোথায় থাকিস!
বারাসাত!
চোখ কপালে উঠে গেল সার্জেনের।
বলিস কী রে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস জানিস! শ্যামবাজার! ট্রেন চলছে না বাস চলছে না, এলি কী করে এখানে!
ছেলেটা মাথা চুলকালো।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি বাবু, মাস্ক নেবেন বাবু। মাত্র তিরিশ টাকা।
ঘুরে ফিরে আবার তার শেখানো বুলি শুরু করল ছেলেটা।
দিয়ে দে দুটো।
কী মুশকিল, একটা বাচ্চা ছেলে মাস্ক নিয়ে বেচে বেরাচ্ছে। একটা দুটো না কিনলে কেমন যেন বুকের ভেতরটা চিন্চিন্ করে। সেই বারাসাত থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে।
সোজা বাড়ি যাবি কিন্তু!
হ্যাঁ বাবু একদম।
ষাট টাকা বুঝে নিয়ে হাঁটা দিল ছেলেটা। ইশ্ আবার বেচারাকে হেঁটে যেতে হবে এতটা রাস্তা।
এই দাঁড়া।
ছেলেটাকে আটকালেন সার্জেন। ডিউটি প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরবেন একটু পরেই। বিরাটি যাবেন বারাসাত যেতে হলে আরো খানিকটা যেতে হবে। পেট্রোলের দাম যা বাড়ছে। একবার চিন্তা করলেন। যাই হোক ম্যানেজ করে নেবে খন। আহারে এই রোদের মধ্যে ছেলেটা আবার হেঁটে হেঁটে ফিরবে! মুখখানা পুরো শুকিয়ে গেছে। বাইকটা একটু দূরে দাঁড় করানো ছিল। পিছনে কেরিয়ারে জলের বোতলটা উঁকি মারছে। সার্জেন সাহেব এগিয়ে গিয়ে বোতলটা বার করলেন। একটু থমকে ভাবলেন। ব্যাগে খুঁজলে বোধহয় একটা বিস্কুটের প্যাকেট পাওয়া গেলেও যেতে পারে। ব্যাগটা হাতড়ে বার করলেন একটা ছোট বিস্কুটের প্যাকেট। তারপর ছেলেটার কাছে এসে বললেন।
নে খা, একটু দাঁড়া আমি যাব বারাসাতের দিকে। তোকে ছেড়ে দেব।
ছেলেটা বোধহয় প্রথমতা ঘাবড়ে গেল। জীবনে প্রথম এরকম কথা শুনল। সার্জেন সাহেবের বেশ ভাল লাগল। ছেলেটার মুখে বড্ড সুন্দর হাসি ফুটেছে। পাশ দিয়ে একটা বাইক ছুটে পালাচ্ছিল। না মুখে মাস্ক আছে, না মাথায় হেলমেট আছে। সার্জেন সাহেব ছুটলেন বাইকটার পিছনে এই, এই দাঁড়া বলছি। একদম ফটকে পুরে দেব।
পাস আছে আমাদের!
কীসের পাস!
ই পাস আছে হোম ডেলিভারির।
একেবারে মাথায় লাঠির বাড়ি মারব! হারামজাদা মাস্ক আর হেলমেট না পরার পাস আছে নাকি!
কোনো উত্তর নেই।
বের কর। হাজার টাকা ফাইন।
লোকগুলো হাতে পায়ে ধরতে লাগল।
একদম নাটক করবি না। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কান ধরে ওঠ বোস করে ফেসবুকে ভাইরাল করে দেব।
স্যার হাজার হবে না স্যার। একটু কম করুন, কোভিড পেশেন্টের খাবার নিয়ে যাচ্ছি স্যার।
আরে কী মুশকিল, তাহলে তো আরো মাস্ক পরা উচিৎ।
বাবু মাস্ক নেবেন, মাত্র তিরিশ টাকা।
এই সবের মধ্যেও ছেলেটা কাজের কথা ভোলেনি। বিস্কুট, জল ফেলে দৌড়ে এসেছে মাস্কের পুঁটুলি হাতে। সার্জেন ওকে দেখে ঠোঁটের কোণে একটা ব্যাঙ্গের হাসি ফুটিয়ে বললেন।
ওই তো মাস্ক আছে। কেন ব্যাটারা দুটো করে। আমাকে সাতশ দিলেই হবে। আর কমাতে পারব না। সোজা রিপোর্ট করে দেব।
লোকগুলো একটু গাঁই গুই করে মেনে নিল অবশেষে। সাতশ টাকা হাতে ধরিয়ে ছেলেটার থেকে দুটো মাস্ক নিয়ে চলে গেল। সার্জেন সাহেব আর ছেলেটা হেসে উঠল। সার্জেন সাহেব এদিক ওদিক তাকালেন, না কেউ নেই। চুপচাপ সাতশ টাকা পকেটে পুরলেন। ছেলেটা বেশ লাকি বলতে হবে। পেট্রোলের দাম নিয়ে চিন্তা করছিল, ডবলের ডবল উঠে এল।
একটা এক্সট্রা হেলমেট সঙ্গেই রাখেন সার্জেন সাহেব। কখন কাকে লিফট দিতে হয়, বলা তো যায় না। অবশ্য ছেলেটার মাথায় বড় হল, ঢিলঢিলা হয়ে প্রায়ই চোখ ঢেকে যাচ্ছে। তা যাক কাজ চালানোর মতো তো একটা ব্যবস্থা করা গেল।
ভালো করে চেপে ধরবি।
বলতে হল না ছেলেটা একেবারে সার্জেন সাহেবের কোমর জড়িয়ে ধরল। মনে মনে হাসলেন সার্জেন সাহেব। সিনেমা – টিনেমায় দেখেছে বোধহয়। এভাবে নায়িকারা নায়কের কোমর জড়িয়ে ধরে।
স্কুলে পড়িস না!
বাইক চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করেন সার্জেন সাহেব।
স্কুল তো বন্ধ!
আবার একেবারে চটপট উত্তর মুখে।
ঠিক, স্কুল তো এক বছরের ওপর বন্ধ! ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি।
তাই সাপের পাঁচ পা দেখেছিস তাই না!
ছেলেটা মিটিমিটি হাসল। দেখতে না পেলেও মনে মনে আন্দাজ করলেন সার্জন সাহেব।
বাড়িতে কে কে আছে তোর!
উত্তর এল না, কী যেন ভাবতে লাগল।
কীরে , বাড়িতে কে কে আছে?
আবার প্রশ্ন করলেন সার্জেন।
দাদা!
ভুরুটা একটু কুঁচকে গেল সার্জেনের।
বাবা মা নেই?
কাকা আছে।
ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল বাইকটা। বেশিক্ষণ লাগল না। অন্যদিন শ্যামবাজার থেকে বারাসাত আসতে সময় লাগে অনেক। প্রত্যেকটা সিগন্যালে জ্যাম, নাগেরবাজারের ব্রীজের তলায় যেন মাছের বাজার। অনেকদিন ধরেই অবশ্য এসব বন্ধ, সবই শুনশান। জনমানবহীন।
বারাসাতের কোথায় যাবি রে?
ওই তো হ্যালা বটতলায় নামিয়ে দেবেন, চলে যাব।
সার্জেন সাহেব ভাবলেন, এতদূরই যখন এলেন, ছেলেটাকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিলেই ভাল হত। তারপর ভাবলেন, থাকগে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আজ আবার রাতে ডিউটি আছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে একটু ঘুম দিতে হবে।
একদম এদিক ওদিক ঘুরবি না। বাড়ি যাবি।
চোখ পাকিয়ে বেশ ধমকের সুরে বললেন সার্জেন সাহেব। ছেলেটাও একেবারে বাধ্য বালকের মতো মাথা নাড়ল। যদিও সার্জন সাহেব খুব ভাল করে জানেন এখন বাড়ি গেলেও বিকেলে আবার বেরিয়ে পড়বে। এদেরকে বলে কোনো লাভ নেই।
ছেলেটা রাস্তা পার হয়ে ডানদিকে একটা হলুদ রঙের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেল। সার্জেন সাহেব আবার বাইকে স্টার্ট দিলেন। বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।
জীবনে প্রথম এমন একটা কাজ করলেন তিনি। বাড়িতে মিসেস শুনলে হেসে কুটোপাটি খাবে। হয়ত বলবে – বাবা! তোমার ঘাড়ে আবার সমাজ সেবার ভূত করে চাপল! ধ্যুস এসব কথা কাউকে বলা যাবে না, সবাই খ্যাপাবে, বাড়িতে বউ, অফিসে বন্ধু, কলিগ– সবাই পিছনে লাগবে। তবে এরকম কাজ করতে মাঝে মাঝে বেশ ভাল লাগে। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বাইক কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিরাটি পৌঁছল। কাল আবার দেখা হবে নাকি ছেলেটার সঙ্গে– ধ্যুস্ কাল আবার কোন রাজা কোন পাটে বসবে। ছেলেটা আবার ভোর বেলায় হাঁটা শুরু করবে, কে জানে ওর ছোট্ট পা দুটো আবার কোথায় নিয়ে যাবে! কী সব আবোল তাবোল ভাবছেন সার্জেন সাহেব। সত্যি বোধহয় ভূত চেপেছে তার ঘাড়ে।
২)
হলুদ বাড়ির আড়ালে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটা। পুলিশ–টুলিশকে বিশ্বাস নেই। আবার হয়ত ঘুরে চলে আসবে। এদের আবার কোনো কিছুর ঠিক আছে নাকি! বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার রাস্তা পার হল ছেলেটা। তারপর সোজা চলতে লাগল ছেলেটা। পিছনে আবার একটা বাইকের আওয়াজ। এই মেরেছে, এটাই ভয় পাচ্ছিল সে, পুলিশটা আবার চলে এল নাকি! কিছু সন্দেহ করেছে নাকি! ধ্যুর বাবা, একে মন্দার বাজার তার ওপর যত্ত ঝামেলা ছেলেটা পা চালাল, বাইকের আওয়াজটা আরো কাছে চলে এল। পিছন থেকে একটা শক্ত পোক্ত হাত পড়ল তার কাঁধে। পিছনে তাকাতে ভয় পাচ্ছে ছেলেটা। মনে মনে কয়েকটা কথা সাজিয়ে নিল । আবার এক ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতে হবে তো!
কোথায় দৌড়াচ্ছিস! ওই মালটা চলে গেছে!
এতক্ষণে হাঁপ ছাড়ল ছেলেটা।
উফ্ তুমি, আমি ভাবলাম ওই পুলিশটা আবার ফিরে এসেছে।
তুই তো করে দিয়েছিস রে, শেষে পুলিশের পিছনে বসে তার কোমর জড়িয়ে মাল পাচার করছিস।
দুজনেই হেসে উঠল।
উফ্ কাকা তুমি হাসছ, আমার বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি যদি শুনতে পেতে!
বুকের মধ্যে যা খুশি হোক নাটকটা তো হেবি করেছিস। আমি তো হাঁ হয়ে দেখছিলাম।
কোথায় ছিলে তুমি, দেখতে পাইনি তো, কতক্ষণ ধরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পুলিশের হাতে পড়ে গেলাম। দশটার সময় মাল নিয়ে বড়দার গাড়িতে করে খিদিরপুর থেকে শ্যামবাজার এলাম। তারপর থেকে চক্কর কেটে যাচ্ছি।
আরে কেস ক্যাচাল হয়ে গিয়েছিল। লকডাউনের বাজার এদিকে পুলিশ ওদিকে পুলিশ। সব সামলে আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। এলাম যখন দেখি তুই পুলিশের কোলে বসে বিস্কুট খাচ্ছিস! কী মাল যে তৈরি হয়েছিস না। এরপর দেখছি বর্ডারে ট্রান্সফার করে দিতে হবে তোকে। শালা আজ সার্জেনকে চক্মা দিয়ে জল বিস্কুট খেলি পরশু দেখব মিলিটারিকে ঘোল খাইয়ে বিরিয়ানি সাঁটাবি।
আরে কাকা আর গ্যাস দিও না! নাও তোমার মালগুলো ধর, আমি পাতলা হই!
কেন রে, এত তাড়া কিসের! ও যখন একবার চলে গেছে তখন আর আসবে বলে মনে হয় না।
বলা যায় না বাবা, ওটা গেছে, অন্য কোনো মাল তো আসতে পারে।
বাইকে বসা লোকটি এদিক ওদিক দেখল। ভুল কিছু বলেনি লকডাউনের বাজার, পুলিশ তো যখন তখন আসছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারার দিন শেষ। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে কেটে পড়তে হবে।
চল দে মালগুলো বার কর।
ছেলেটা তার কাঁধের পুটুলিটা দিল লোকটার হাতে। লোকটা পুঁটুলিটা খুলে একটা মাস্ক বার করল।
সব ঠিকঠাক আছে তো!
ঠিক আছে না ভুল আছে আমি কী করে জানব। যা দিয়েছে বড়দা, সেটা তোমায় এনে দিয়েছি।
ঠিক আছে থাম তো, সব কথা একেবারে ফট্ ফট্ বলা চাই। কাজের সময় বেশি কথা ভাল লাগে না। লোকটি একটা মাস্ক নিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করল। শক্ত সেলাই ছিঁড়ল না। পকেট থেকে একটা ছোট ছুড়ি বার করল লোকটা। মাস্কের ধারদিয়ে আলতো করে ছুড়ি চালাতেই খুলে গেল সেলাই। ফাইভ লেয়ার মাস্ক। পাঁচটা ভাঁজে ছোট ছোট কাগজের প্যাকেট। একটা প্যাকেট বার করে খুলে খুলে গন্ধ শুঁকল লোকটা।
আরিব্বাস খাসা মাল!
আমার কমিশন কখন পাব।
আরে পাবি রে! আগে জায়গার জিনিস জায়গায় পাঠাই হাতে রোকরা আসুক। তারপর তো কমিশন। লোকটা আবার সব মাস্ক পুঁটুলিতে পুরে বাইকে, স্টার্ট দিল।
এবার কেটে পড়। রাতে দেখা হবে।
হুশ্ করে বাইকটা বেরিয়ে গেল।
ছেলেটা আবার হাঁটতে লাগল সোজা। আর কিছুদূর গেলেই কালুয়াদের বস্তি। কালুয়া কে জানে না কেউ, চোখেও দেখেনি তাকে কেউ তবু এর নাম কালুয়াদের বস্তি! ছেলেটা বস্তিতে ঢুকল। ঘিঞ্জি বস্তি। এখানে এলে যেন হাঁপ ছাড়া যায়। মুখে মাস্ক টাস্ক পড়তে হয় না। আগেও যেমন ছিল এখনো তেমন আছে বস্তিটা। বরং হইচই বোধহয় বেড়ে গেছে খানিকটা। আসলে কলকারখানা বন্ধ। দোকান–পাট বন্ধ, সবাই বসে আছে বাড়ি। বাড়ি বসে বসে সবার পেট গরম মাথা গরম হয়ে যায়। তাই থেকে থেকেই সবাই চেঁচামেচি করে। বউ –ঝিদের ঝগড়া ও বেড়ে গেছে। এ বাড়ি ও বাড়ি সব কাজ করে বেড়াত। সে সব পাট–ও চুকে গেছে। কাঁহাতক আর পুরনো সিরিয়ালের পুরনো এপিসোড দেখা যায়। ঝগড়া করেই পেট ভরাতে হয় অগত্যা। ক্লাব থেকে লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ও হো না না একটা ভাল নাম আছে , লঙ্গরখানা বললে লোকে পেটাবে । মান্তুদার কিচেন । মান্তু দা হলেন লোকাল কাউন্সিলার । সপ্তাহে তিনদিন ফ্রিতে খিচুড়ি আর ডিমের ডালনা খাওয়ায় । বাকি চারদিন কী হবে কে জানে ! ছেলেটার অবশ্য সে চিন্তা নেই । কাকা আর বড়দা রোজই ঠিক সময় খাবার এনে দিয়ে যায় । ভালোই হয়েছে আগে বরং হাত পুড়িয়ে খেতে হত । এখন বড়দা নিয়ে আসে । কোত্থেকে ম্যানেজ করে কে জানে! এদিক ওদিক এরকম কত ফ্রি কিচেন চলছে । দু একটা প্যাকেট হাপিস করা আর একটা ব্যাপার নাকি!
এতক্ষণে তো বড়দার চলে আসার কথা ! দেরি করছে কেন কে জানে ! আজ বোধহয় ভাল কোনো জায়গার খাবারের খোঁজ পেয়েছে । ধ্যুস আর ভাল লাগে না ছেলেটার, আজ কী কাণ্ডটাই না হল বড়দাকে সবটা না বললে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না যে ! উফ্ লোকটা এসে যখন সামনে দাঁড়াল , যা ভয় পেয়ে গিয়েছিল না সে ! শালা কিছুতেই ছাড়ে না জল খাওয়াচ্ছে , বিস্কুট খাওয়াচ্ছে । আবার বলে বাড়ি পৌঁছে দেবে । এমন আজব পুলিশ জন্মেও দেখেনি ছেলেটা । বড়দা তার মুখে এমন কথা শুনলেই মাথায় চাঁটি মেরে বলে
বড্ড পাকা হয়েছিস ! কতদিন জন্মেছিস রে! নাক টিপলে দুধ বের হয়!
তাই শুনে ছেলেটা আবার নিজের নাক টিপতে থাকে ।
কই রে দাদা বের হচ্ছে না তো কিছু !
বড়দা সেই শুনে দুম্ দুম্ করে পিঠের মধ্যে ক্যালাতে থাকে ।
কী মুশকিল এখনও আসছে না বড়দা ! ছেলেটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল । কেমন একটা চাপা শোরগোল শোনা যাচ্ছে । সে অবশ্য হতেই পারে । বস্তিতে শোরগোল হবে মারপিট হবে । সে আর নতুন কী ! ক্রমশই গণ্ডগোলটা এগিয়ে আসছে । ছেলেটা একটু ঘাবড়েই গেল । আওয়াজটা কেমন যেন অচেনা লাগছে ।
হঠাৎ পাশের বাড়ির লাটাইয়ের মা হাঁটুর ওপর ম্যাক্সি তুলে দৌড়ে দৌড়ে এল ।
ওরে , ছোটু পালা তাড়াতাড়ি । তোর দাদাকে পুলিশে ধরেছে । এদিকেই আসছে । এত্তবড় গাড়ি নিয়ে, তোকেও ধরবে। পালা তাড়াতাড়ি ।
ছেলেটা আবার ঘাবড়ে গেল, কোনদিক দিয়ে পালাবে সে ! পালিয়ে যাবেই বা কোথায় । কাকার আড্ডা সে চেনে না । স্কুল বন্ধ । মাঠ বন্ধ । কোথায় গিয়ে লোকাবে সে ! তবু তো পালাতে হবে । ছেলেটা পালাতে শুরু করল । এ ঘরের পাশ দিয়ে , ওঘরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে। পিছন থেকে শোরগোলটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে ।
৩)
সার্জেন সাহেব বাইকটা পার্ক করে ঢুকতে যাবেন ,এমন সময় দেখলেন প্রচুর লোক , দরকার সামনে ভিড় করে আছে সবাই । কাঁধে ক্যামেরা , হাতে মাইক । সাড়ে সর্বনাশ , মিডিয়ার লোক আবার সাত সকালে এখানে হাজির হল কেন কে জানে । কোথায় আবার কোন অত্যাচার করল কে জানে পুলিশ ! যত অত্যাচার তো পুলিশই করে । দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন করোনার জন্য কাজ বেড়ে গেছে । কাল প্রায় দুপুর অবধি ডিউটি ছিল , আবার রাতেও নাইট ডিউটি দিতে হয়েছে । মাথাটা ঝিমঝিম করছে , জ্বর আসছে নাকি কে জানে , তাহলে তো হয়ে গেল ,একেবারে মায়ের ভোগে । আজ বাড়ি যাওয়ার আগে একবার টেস্টটা করতে হবে ।
কী মুশকিল, দু মিনিট দাঁড়িয়েও তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । একটা ফাইল জমা দেওয়ার আছে হেড অফিসে । কোনো মতে ফাইলটা জমা দিতে পারলেই কাজ শেষ আজকের মতো । আবার কালকে আছে ডিউটি । আর যদি সত্যিই জ্বর আসে তাহলে তো ছুটিই ছুটি ।
সার্জেন সাহেব এগিয়ে গেলেন । পাশে দাঁড়ানো এক কনস্টেবলের দিকে ।
কী হয়েছে ভাই !
একটা দলকে পাকড়েছে কাল বড় বাবু ! আজ কোর্টে নিয়ে যাবে । তাই এত ভিড় !
যাক তাহলে ভাল । মারধোর খাওয়ার ভয় নেই । চাকরি তো নয়, যেন শাঁখের করাত । কাজ না করলে বলবে পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে আর কাজ করতে গিয়ে দু একজনকে ঠ্যাঙালে বলবে পুলিশ অত্যাচার করছে ।
যাক তাহলে ভাল ! কোত্থেকে ধরল ! কীসের দল ? তোলাবাজ !
না না আরো বড় , ড্রাগস পাচার করছিল । কাল সারাদিন তল্লাশি চলেছে । খিদিরপুর থেকে বড় দলটা ধরা পড়েছিল , তারপর ছুটকো ছাটকা বারাসাত , মধ্যমগ্রাম , বসিরহাট , আবার বোধহয় সোনারপুর থেকেও দু একটা ধরা পড়েছে ।
বাপরে এতো বিশাল বড় ব্যাপার ! তো মালগুলো কোথায় ! দেখা যাবে নাকি একবার !
হ্যাঁ হ্যাঁ ,কেন দেখা যাবে না ! সব কটাকে লাইন করে দাঁড় করানো হয়েছে । ছবি তোলা হচ্ছে । বাচ্চা বুড়ো অনেকগুলো আছে ।
তাইনাকি আবার বাচ্চাও আছে ?
হ্যাঁ আছে তো ! ভাল ধান্দা করেছিল সব । করোনার বাজারে মাস্কের ভেতরে মাল পাচার করছিল ।
সার্জেন সাহেব কেমন যেন থমকে গেলেন । কালকের ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল । বাচ্চা , মাস্ক – না না এসব কী ভাবছেন তিনি । সব ব্যাপারেই কি একটার সাথে আরেকটার যোগ থাকে নাকি! আর দাঁড়ালেন না তিনি , ভেতরে ঢুকলেন । ঠিকই বলেছিল কনস্টেবল , সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে । সার্জেন সাহেব কাকে যেন খুঁজতে লাগলেন লাইনের ভেতর । সবার মুখে বড় রুমাল বাঁধা । মুখ দেখার উপায় নেই , তবু কিছুটা তো আন্দাজ করা যাবে ।এক এক করে দেখতে লাগলেন , না নেই । কালকের ছেলেটা নেই । যাক্ নিশ্চিন্ত হলেন তিনি । হঠাৎ হঠাৎ কি সব শুনে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা ভাবতে বসে যান তিনি ।
এই চল দাঁড়িয়ে থাকলে পার পেয়ে যাবি নাকি ! সব কটাকে কোর্টে তুলতে হবে ! একটা ছেলে বোধহয় তখনও লক আপের মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে ছিল । তাকেই একজন কনস্টেবল ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে এসছে । তাড়াহুড়োতে মুখে গামছা বাঁধা হয়নি । একসাথে অনেকগুলো ফ্লাশ লাইট ঝলসে উঠল ওর ছোট্ট কচি মুখটার ওপর । বয়স কারোর বেশি নয় , এখনই হাট পাকিয়ে ফেলেছে এসব কাজে । এটা তো আজকের ব্রেকিং নিউজ । ছেলেটাকে দেখে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল সার্জেন সাহেবের । হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে । ছেলেটাও বোধহয় দেখতে পেয়েছে তাঁকে । একবারও মুখ তুলছে না । ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে ।
শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল । ওই ছেলেটার থেকে কেনা মাস্কটা পরেই তো ডিউটিতে এসেছিলেন। এটার মধ্যে কিছু নেই তো ! না না তা হবে না নিশ্চয়ই , আবার হতেও পারে । আজকাল মুখের ওপর মাস্কটা কেমন যেন চামড়ার মতো হয়ে গেছে । না থাকলেই যেন মনে হয় , কী একটা নেই । সেই যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মুখে এঁটে আসেন , আবার বাড়ি ফিরেই তবে খোলেন । মাঝে কয়েকবার জল খাওয়া ছাড়া আর খোলার কথা মনে হয় না । আজ প্রথমবার মনে হল মাস্কটা ভীষণভাবে চেপে বসেছে । দম আটকে আসছে । খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে , কিন্তু খুললে চলবেই বাঁ কী করে ! এখনো তো বেশ কিছুক্ষণ বাকি আছে । ফাইলটা বড় সাহেবের ঘরে রাখতে হবে । তারপর এতটা রাস্তা যেতে হবে ! মাস্কটা তো রাখতেই হবে মুখের ওপরে । নিয়ম যে , পুলিশ তো নিয়ম তো মানতেই হবে ।
আরে সার্জেন সাহেব যে কেমন আছেন ?
বড় সাহেবের ঘরে আসতেই প্রশ্নটা এল । আগে এ প্রশ্নের উত্তরে দেঁতো হাসি হাসলেই চলে যেত । এখন মুখের ওপর মুখোশের জন্য হাসিটা কোনো প্রশ্নের উত্তর হতে পারে না ।
ভাল স্যার ! কনগ্র্যাচুলেশন দারুণ কাজ করেছেন স্যার ! ভাবতে পারছেন ফাইভ লেয়ার মাস্কের মধ্যে পুরিয়া করে মাল সাপ্লাই করছে । ব্যাটাদের বুদ্ধি দেখলে না, আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় !
চুপ করে রইলেন সার্জন সাহেব । সত্যি অবাক হওয়ার মতো বিষয় বটে ।
একটু চোখ কান খুলে রাখবেন ! যা দিনকাল পড়েছে ।
কেন কী হয়েছে স্যার !
দত্তকে শো কজ করা হয়েছে । অবশ্য সবাই জানে ও বেচারার কোনো দোষ নেই । তবু নিয়মের খাতিরে তো শো কজ করতেই হবে ।
দত্ত খিদিরপুরের দিকের ত্র্যাফিক গার্ড । সবাই জানে , অনেকদিনের লোক । বেশ নীরিহ প্রকৃতির । বন্ধু মহলে বদনাম আছে , ভুল করে নাকি এই লাইনে চলে এসেছে ।
আরে অনেকদিন ধরে খবর ছিল ওই দিক দিয়ে মাল পাচার হয়। সামনে ডক তো,ইজি ব্যাপার! অর্ডার ছিল সব গাড়ি চেকিং করে ছাড়ার। একটা অ্যাম্বুলেন্স প্রায় প্রতিদিনই যাওয়া আসা করত ওই এলাকা দিয়ে। দত্ত অ্যাম্বুলেন্স বলে ছেড়ে দিত। সত্যি তো এই সিচুয়েশনে কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে, অ্যাম্বুলেন্স কে চেকিং করবে । ওই অ্যাম্বুলেন্সটাই ধরা পড়েছে , পাঁচশ কেজি কোকেন সমেত । এখন বুঝতে পেরেছ তো দত্তর কী হাল হবে ।
সার্জেন সাহেবের মুখের ওপর মাস্কটা যেন আরও চেপে বসে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মুখ আর মুখোশ চেনা দিন দিন যেন বড় কঠিন হয়ে পড়ছে।
কথাসাহিত্যিক