| 25 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: গল্প-লেনিন দা । ইন্দ্রজিৎ ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

 

অর্ক ভাবে- অন্ধকারের রঙ কি শুধুই কালো? সাদা, ধূ-ধূ শূন্যতাও তো এক ধরণের অন্ধকার! অর্ক এখন বসে থাকে, আর ভাবে ৷ ভাবে, আর বসে থাকে ৷ দিন-রাত ,সকাল-সন্ধ্যা,টানা লম্বা দুপুর, সব এখন তালগোল পেকে শুধুই অন্ধকারের চেহারা নিয়েছে! এই অন্ধকারের বুক চিরে তার মনের উঠোনে, তার মগজের দালানে এসে যে দাঁড়ায়, তার নাম বিজন দত্ত! এলাকার লোক বিজন দত্তর নাম দিয়েছে লেনিন দত্ত! সে এখন সকলের লেনিন দা! লেনিনদার সব কথা অর্ক এতদিন মাড়িয়ে চলত৷ ঠাট্টা তামাসায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের অস্ত্রে খান খান করে দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা দিত! ফিরেও তাকাত না! রাস্তায় আচমকা দেখা হলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে ঘুর পথে ঘুরে যেত! মাঝে মাঝে বাড়িতেও হানা দিত ৷ বাড়িতে শেখানো ছিলো, “লেনিন দা ডাকলে বলে দেবে, বাড়িতে নেই৷ ব্যাস৷ খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, কোথাকার হরিদাস পাল! ওর জ্ঞান হজম করতে হবে৷ যুক্তি-তক্কে অংশ নিতে হবে! যত সব আপদ”৷ অথচ আশ্চর্য! আজকের এই করোনা সংক্রামিত অতিমারীর আবহে,রাতের চেয়েও অন্ধকারে গুম মেরে থেকে অর্কর মাথায় এত দিন লেনিন দা যা বলেছে, বলতে চেয়েছে , সেই সব কথা গুলোই কুল-কুল স্রোতের মতো হাজার তরঙ্গ ডিঙিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে!

 “একজন ঠিক ৷ হাজার জন ভুল ৷ এক জনের ঠিক কথা হাজার জনের মিথ্যার চাপে পিষে থেঁতো হয়ে গেছে ! থেঁতলে যাওয়া রক্তাক্ত চেহারা নিয়ে সে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে! ইতিহাসের দিকে তাকা, এমন অনেক নজির চোখে পড়বে৷ আমরা তো চিরকালই ইতিহাস কানা! ইতিহাস থেকে শেখার ইচ্ছাই আমাদের নেই৷ কোনো মহৎ ভাবনা বা চিন্তা প্রথমে কোনো না কোনো ব্যক্তি মানুষের মধ্যেই তৈরি হয়, তারপর তা অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে” ৷ লেনিন দা একদিন কথা গুলো বলছিলো স্কুলের সামনে নিম গাছটার সামনে বসে ৷ অর্ক সেদিন-ই জানতে পেরেছিলো , স্কুলসার্ভিস পরীক্ষা এখন বিশ বাঁও জলে ৷ এবার সিভিক টিচার নিয়োগ হবে! স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাংস চামড়া সব ভ্যানিস হয়ে গেছে ৷ মৃত চেহারার কঙ্কালটা এখন দিনের আলোর মতো ঝক্ -ঝক্ করছে! প্রাইভেট কলেজের পেটে ১লাখ ৬০ হাজার ঢুকিয়ে অর্ক বি.এড ডিগ্রি কিনেছে দুবছর হলো! এত কিছুর পর কি না সিভিক টিচার হয়ে অপমানের কাঁকুড়ে অন্ন গিলতে হবে! ভাবা যায়!অর্কর মেজাজটা বড্ড খিঁচে ছিলো! বেশ জ্বালা ধরা গলায় লেনিন দা কে এক হাত নিল—

“পার্টি তোমাকে ছেঁটে দিলো কেন? তোমার সদস্য পদই বা কেড়ে নিলো কেন? এত বড় মাপের নেতা তুমি, অথচ পার্টি অফিসের টেবিল পোঁছার কাজেও তোমায় রাখা হলো না!”

অর্কর কথা গুলো লেনিন দা খুব আদর করে লুফে নিলো ! আর একটা বিড়ি ধরাল ৷ গদাই , কেলো , চঞ্চল সবাই অর্কর দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো ! বিড়ির ধোঁয়াটা হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে লেনিন দা বলল—

“সত্যি বলছি, এত ভালো একটা প্রশ্ন এর আগে আমাকে কেউ করেনি! দ্যাখ্ সাহস আর আত্মবিশ্বাস মানুষকে সমস্ত রকম চ্যালেঞ্জ আর বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করায়! তুই হাঁটু মুড়ে বসবি,নাকি শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে দাঁড়াবি, না এসব কিছু না করে যা সত্যি তাকে আঁকড়ে ধরে আদর্শে স্থির থেকে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবি, সেটা নির্ভর করছে তোর ব্যক্তিত্বের ওপর ৷ আমি আজও মতাদর্শগত সংগ্রামটাই চালাচ্ছি ৷”

অর্ক বলল, “আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু ঠিক মতো পরিস্কার হলো না।” 

লেনিন দা আর এক দান বিড়ি ধরিয়ে বলল,

“এর পেছনে কোনো গোল-গাল গপ্প নেই৷ যা আছে, সেটা মতাদর্শগত সংঘাত ৷ ‘হ্যাঁ অথবা ‘না’, এর মাঝামাঝি বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকা আমার স্বভাব নয় ৷ আমি সেলুনের চুলকাটা কাঁচি নই , বরং খাপ খোলা তলোয়ার !পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত বেনিয়াবৃত্তি করে , দুর্নীতিতে ডুবে থেকে কেউ যদি পান চিবোনোর থেকেও বেশী চিবিয়ে চিবিয়ে সর্বহারার তত্ত্ব শেখাতে আসে , আমি তাকে কলার চেপে পার্টি অফিসেই সকলের সামনে দু-গালে থাপ্পড় কষাই৷ আমার যে সব কমরেড ভাই আধপেটা খেয়েও রক্ত রাঙানো ঝান্ডা টাকে আজও তাদের আশ্রয় বলে বিশ্বাস করে, তাদের বিশ্বাসটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই রকম থাপ্পড় আমায় প্রায়ই মারতে হতো! যারা ভেতর থেকে পার্টিটাকে শেষ করে দিচ্ছিল, তাদের চিহ্নিত করা যতটা সহজ ছিলো, মোকাবিলা করাটা ঠিক ততটাই কঠিন ছিলো! যারা সমাজ বদলাতে এসে নিজেরাই উল্টো পথে বদলে যায়, তারা আর কমরেড থাকে না ; দলের ভেতরে তারাই সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হয়ে ওঠে! সবাই যখন বাইরে শত্রু খুঁজে বেড়াচ্ছিল , আমি তখন ঘরের শত্রু গুলোকে একটা একটা করে সামনে আনছিলাম! বাইরের শত্রু যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, ঘরের শত্রুর ইন্ধন ছাড়া কোনো শত্রুতার ইতিহাস-ই পূর্ণতা পায় না৷ প্রতিটি পরাজয়ের পেছনে তাই অন্তর্ঘাতের কোনো না কোনো ইতিহাস থাকে! আমাদের পলাশির যুদ্ধ থেকে শুরু করে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের পরাজয় কিংবা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ভেঙে পড়া, সব কিছুর পেছনে অন্তর্ঘাত সব চেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে ৷ শোন , মাটির সঙ্গে মিশে থাকতে পারলে যত বড়ই ঝড় আসুক , শিকড় ঠিক মাটি কাঁমড়ে বিপদ সামলে দেবে, বড় জোর দু-চারটে ডাল-পালা ভাঙবে ! মুখ থুবড়ে অন্ততঃ পড়তে হবে না ! তা বোলে কি আমার কোনো দোষ ছিলো না , নিশ্চই ছিলো ৷ যেখানে যে জায়গায় যে কথা বলা উচিত নয় , আমি ঠিক সেটাই করেছি ! চরমতম সত্যি কথাই বলেছি, কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করিনি ! এর ফলে শৃঙ্খলা নামক শিল্পটাকে রক্ষা করতে পারিনি ৷ আসলে সত্যকে সত্যের মতো করে প্রকাশ করলে শিল্পের মৃত্যু ঘটে; সত্যকে বানিয়ে তুললে তবেই শিল্প প্রাণ পায়! আমার কাছে শিল্প অপেক্ষা সত্য বড় ৷ অতএব শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পার্টি আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে।” 

লকডাউন মেনে অর্ক পুরোপুরি গৃহ বন্দি৷ অর্ক খবর পেয়েছে, লোক জন জড়ো করে লেনিন দা বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে দিন-রাত এক করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ৷ অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে ৷ পার্টি লেনিনদা কে বসিয়ে দিলে কি হবে , যে সব পার্টি কর্মী এক সময় লেনিনদার হাতে তৈরি , যুব নেতা থেকে ছাত্র নেতা,সবাই আজও লেনিনদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে ! এতে অবাক হবার কিছু নেই , কেননা! লেনিন দা নিজের আত্ম পরিচয়টা কথা ও কাজে প্রমাণ করতে পেরেছে ৷ যে দিন আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ বেশ কিছু লম্পট ছাত্র ও এলাকার দাগী দাদা-ভাইয়া দের হাতে মার খেল , সে দিন পুলিশী নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে ছাত্রদের নিয়ে থানা ঘেরাও করেছিলো লেনিনদা৷ আমি সে দিন টিউশান সেরে বাড়ি ফিরছিলাম৷ স্থানীয় বিধায়ক মস্তান লেলিয়ে দিয়ে লেনিনদা কে প্রশ্ন ছুঁড়ে ছিলো- “কে হে তুমি ! পার্টির ছাঁটাই মাল! থানা ঘেরাও করার তুমি কে হে”?

পঞ্চান্ন বছরের পেটা চেহারার টান টান শরীরের ছ-ফুট দু-ইঞ্চির যুবক লেনিন দা ভিড় ঠেলে বিধায়কের মুখোমুখি দাঁড়াল! নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে বিধায়কের কপালের ঘাম মুছে দিয়ে পাঞ্জাবির আলগা বোতাম গুল ঠিক ঠাক বসিয়ে দিতে দিতে বলল,

“আমি মানুষ, তাই আমি কমিউনিস্ট ৷ আমার নিজস্ব চিন্তা ও বিচার বুদ্ধি আছে, তাই আমি যুক্তিবাদী ,নাস্তিক, বিজ্ঞান মনষ্ক ৷ আমি মার্কসবাদী , যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মনষ্ক বলেই আমি বিপ্লবী ৷ আমার একটা সুবিশাল মন ও গভীর হৃদয় আছে, তাই আমি মানবতাবাদী৷ আমি মানবতাবাদী বলেই আমি সাম্যবাদী, আমি তাই সমাজতন্ত্রের প্রচারক ৷ যদি লড়াই করতে চান, তাহলে এত গুলো শক্তির সঙ্গে আপনাকে লড়তে হবে ৷ আর যদি পিছু হটতে চান, তাহলে এই শক্তিগুলো থেকে আপনাকে ও আপনাদের শিক্ষা নিতে হবে।” 

এটা মানতেই হবে, সেদিন লেনিনদার লাগাতার আন্দোলনের চাপেই আমাদের কলেজের অচলাবস্থা কেটে ছিলো ৷ যে দিন থেকে লকডাউনে আটকে পড়লাম, আর একটু একটু করে অন্ধকার এবং অবসাদ গ্রাস করল, ঠিক সেই সময় থেকেই লেনিনদা যে কেন মাথায় চেপে বসল কে জানে! আমার বাড়ির আবহ আর বাইরের ধান্ধার রাজনীতি আমাকে রাজনীতি বিমুখ করে তুলেছে৷ লেনিন দা রাজনীতিক বলেই তার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছি এতকাল! রাজনীতির ওপর অসহ্য রাগ আর সীমাহীন ক্রোধ নিয়ে বড় হয়েছি৷ বাবার মৃত্যু আমাকে আরও কোণঠাসা করেছে ৷ দু-দিদির বিয়ে দিতে গিয়েই বাবার জমানো টাকা সব শেষ৷ মায়ের ঐ সামান্য পেনশন, তাও মায়ের সারা মাসের ওষুধ খরচেই বেশীটা চলে যায় ! বুঝতেই পারছি , স্কুলে চাকরি পাবার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই! যেখানে অতি মহামারির এই ঘোর দুর্দিনে রেশন নিয়ে দুর্নীতি হয়, আক্রান্ত ও মৃত মানুষের তথ্য লোপাট করা হয়, যেখানে এই গ্রহণ লাগা অবস্থাতেও ভোটে জেতার জমি তৈরি করার জন্য এখনও কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপনে খরচ করা হয়, সেই পোড়া বন্ধ্যা জমিতে দাঁড়িয়ে যে সৎ ভাবে চাকরি পাব না, সেটা আমি তো দূরের কথা , অতি পাগলও বুঝে গেছে ! কিন্তু মা চোখ বুজলে কী খাবো? কীভাবে বাঁচব? ব্যবসা করার বুদ্ধি বা সামর্থ্য কোনটাই তো নেই! টিউশান করে না হয় নিজের ভাত-টুকু কোনো রকমে রোগরে রোগরে জোগাড় করব! কিন্তু , বিয়ে-সংসার, বাচ্ছা-কাচ্ছা? না, এ জম্মের মতো কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ লেনিনদা এ জন্যই আমাদের “জেনারেশন জিরো” বলত! তখন রাগ হতো৷ এখন ভাবছি লেনিনদাই ঠিক ৷

এত গুলো পরিযায়ী শ্রমিক ট্রেনের চাকায় পিষে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গেল! খবরটা দেখা থেকে মুখে খাবার তুলতে পারিনি! ভেতরে একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে ৷ আজ যদি লকডাউনের আগে পরিকল্পিত ভাবে লক্ষ লক্ষ পরযায়ী শ্রমিককে ঠিক মতো ঘরে ফেরনোর ব্যবস্থা করত, তাহলে এভাবে ওদের অকালে ঝরে যেতে হত না৷ লেনিনদাই ঠিক ৷ লেনিন দা একবার বলেছিলো,

“রাষ্ট্র এখন কর্পোরেট এজেন্ট হয়ে কাজ করছে৷ শ্রমিক কৃষকদের জন্য রাষ্ট্র কোনো রকম দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা নেবে না৷ কর্পোরেটদের হয়ে সওদা করাই রাষ্ট্রের কাজ৷ সব দিক থেকে সরকারের ভূমিকাকে আলগা করে দিয়ে বহুজাতিক কর্পোরেশনের জন্য বাজারের সব দরজা খুলে দেওয়াই রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ ৷ দেখিস্, এ ভাবে চললে আগামী দিন কর্পোরেট সংস্থা গুলো গোটা রাষ্ট্রটা, এরকম আরও অনেক রাষ্ট্রকে ওরা ইজারা নেবে৷ ইজারা ৷ লীজ নেবে ৷লীজ ৷ শ্রমিক, কৃষক থেকে শুরু করে তোর আমার মতো সাধারণ মানুষেরা হলুদ-শুকনো পাতার দ্রুত ঝরে পড়ব ৷ঠিক পথে লাগাতার জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন করা ছাড়া বাঁচার কোনো পথ নেই।”  একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেছিলাম,

“তোমাদের সেই এক কায়দা৷ আন্দোলন ! যত সব বোগাস ব্যাপার! ও সব আন্দোলন-ফান্দোলন করে ঘোড়ার ডিম কিস্যু হবে না।” 

“কে বলেছে কিস্যু হবে না? অনেক কিছু হয়েছে, অনেক কিছু হবেও৷ নিজের দেশের দিকে তাকা, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসটা দ্যাখ ৷ ভালোভাবে ইতিহাসটা পড় , বুঝতে পারবি , এখনও পর্যন্ত শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ মানুষ, যা কিছু অধিকার ভোগ করছে সব সব কিছু দীর্ঘ আন্দোলনের ফল৷ দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস৷ আন্দোলন এমন অকটা অস্ত্র যার প্রয়োজন কখনও ফুরোয় না! শুধু সঠিক ব্যবহার টা জানতে হয়৷ সঠিক উপায়ে জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন হলো সেই অস্ত্র, যা প্রয়োগ না করা পর্যন্ত মানব সভ্যতার মুক্তি নেই! ভিয়েত নামের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস জানিস্? কিউবার? রাশিয়ার? দক্ষিণ আফ্রিকার? বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ? পৃথিবীর কোন দেশকে বাদ দিবি ? নিজের দেশের বিভিন্ন গণআন্দোলনের ইতিহাস? শোন…”

না, আমার শোনার ইচ্ছা ছিলো না ৷ তর্ক বাড়াতে চাইনি ৷ কেননা তর্ক করার মতো ক্ষমতাই আমার নেই , তাই ৷ তাছাড়া লেনিনদার ইতিহাস জ্ঞান সমুদ্রের মতো৷ তার ওপর বিশ্লেষণ ক্ষমতা অসাধারণ! জানতাম,এই মানুষটার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে ৷ কিন্তু শেখার প্রয়োজন বোধ করিনি! কিন্তু আজ করছি? কিন্তু কেন করছি? আমি তো রাজনীতি কে এতকাল ঘৃণা করে এসেছি! কোনো রাজনৈতিক আলোচনায় মাথা ঘামাই নি ৷ দু-দু-বার ভোট পর্যন্ত দিতে যাই নি৷ অথচ আজ আমার মনে হচ্ছে , গোটা পৃথিবী আজ যে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে ডুবে আছে, এর পেছনে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর নেতিবাচক রাজনীতির ভূমিকা! কিন্তু এই সর্বনাশা রাজনীতি থেকে মুক্তির উপায় কী? আমি জানি, এ নিয়ে আমার হাতের সামনে কথা শোনা ও বলার মতো একটাই মানুষ আছে, সেটা অবশ্যই লেনিন দা ৷ অথচ একটা কথা ভেবে আমি বেশ অবাক হচ্ছি- লেনিন দা খুব ভালো ভাবেই জানে, আমি লেনিনদা কে পছন্দ করি না৷ তবুও গত সোমবার দুপুরে লেনিন দা ফোন করে মা আর আমার খবর নিলো ৷ মায়ের ওষুধ ঠিক মতো পাচ্ছি কিনা খোঁজ নিলো ৷ বার বার বলল, কোনো রকম অসুবিধা হলে অবশ্যই যেন লেনিন দার সঙ্গে যোগাযোগ করি৷ অথচ, এই বিপদের দিনে লেনিনদা নিজে কেমন আছে, সেটা জানতে চাওয়ার মতো ভদ্রতা বোধ আমি হারিয়ে ফেললাম! এটা ভাবলেই নিজেকেই নিজের লজ্জা লাগছে! এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, লেনিনদা ঠিকই বলেছিলো,

“পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সংস্কৃতির অন্যতম লক্ষ্য হলো, মানুষকে মানুষের থেকে, সমস্ত রকম সম্পর্ক থেকে, একেবারে শিকড় সমেত উপড়ে নিয়ে তাকে এক জঘন্য, অভদ্র একক ও একা মানুষে পরিণত করা৷ সেই মানুষের কোনো সমাজ থাকবে না! তার সামনে শুধু কর্পোরেট এজেন্ট হিসাবে রাষ্ট্র থাকবে৷ এই রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ব্যক্তিমানুষ লাগাম ছাড়া ব্যক্তি সুখ আর ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করবে! এই উদ্দাম-উন্মত্ত ভোগের পথে যে বা যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে ব্যক্তি তাকেই ঘোরতর শত্রু জ্ঞান করবে! রক্তের সম্পর্ক ক্রমশ পাতলা ও শিথিল হয়ে যাবে৷ এই একক মানুষ ফেসবুক পাড়ায় ভার্চুয়াল বন্ধু খুঁজবে, কিন্তু নিজের পাড়ার বন্ধুর খোঁজ রাখবে না! পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর সঙ্গে পাঁচিল তোলা নিয়ে বছরের পর বছর কোর্টে কেশ ঝুলে থাকবে, অথচ নিয়ম করে বছর বছর ফেসবুক পাড়ার ক্যালিফোর্নিয়া বা ইজরায়েলি বন্ধুকে বার্থ ডে গিফট পাঠাতে ভুলবে না।” 

কত বলব৷ লেনিন দার কথা বলে শেষ করা যাবে না! তবে লেনিনদা শুধু শুকনো কাঠ-কাঠ কথাই বলে না, কাজের কাজ করে দেখায় ৷ নিজের সংসার বউ-বাচ্ছা সবই আছে, তবুও মানুষের সঙ্গে মিশে মানুষের জন্য কাজ করার জন্য লেনিন দার মধ্যে কোনো খামতি নেই! না আর কোনো ভাবেই লেনিনদা কে এড়িয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না৷ লেনিনদার কথা কাজ সব কিছু আমার অস্তিত্বটাকে ধরে জোর ঝাঁকুনি দিচ্ছে! আমার কাঠামোয় ফাটল ধরছে ! ভিতটাও কেঁপে উঠছে! তবে কি আমি বদলে যাচ্ছি? তবে কি লেনিনদার রাজনীতিক ও মানবিক চেহারাটার প্রতি কোনো অমোঘ টান অনুভব করছি? আমারই অজান্তে আমারই ভাব জগতে নিঃশব্দে কোনো বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে?

লক ডাউনের মেয়াদ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে৷ মনে হচ্ছে সব কিছু স্বাভাবিক হতে আরও মাস পাঁচেক লাগবে ! কেরল চোখের সামনে নজির তৈরি করল ৷ চিন, ভিয়েতনাম, কিউবা দেখিয়ে দিল কীভাবে সরকারী প্রচেষ্টায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মহামারির মোকাবিলা করা যায়৷ এটা যে, গোরুর হাগা-মুত খাইয়ে, মোমবাতি জ্বেলে, কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে, আকাশে উড়ন্ত রথ থেকে পুষ্প বৃষ্টি ঝরিয়ে কিংবা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে জ্যামিতি এঁকে যে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে না, সেটা এদের বোঝায় কে! এ সব যত দেখছি , ততই ভেতরে ভেতরে ক্রোধের আগ্নেয় লাভা টগবগ করে ফুটছে! এক অদ্ভুত হতাশাও যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে! এ দিকে মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না৷ হাত-পা টা বেশ ভালোই ফুলেছে! শরীরে আরও রক্তের দরকার ৷ একমাসের বেশী কুলে শাক বাজারে পাচ্ছি না৷ ও গুলো ট্রেন পথে গ্রাম থেকে আসত৷ মায়ের ওটা নিয়মিত পথ্য ছিলো৷ আর তা ছাড়া বাজার তো সব বন্ধ৷ বাজার থেকেই সংক্রমণ ছড়াবার সম্ভাবনাটাই এখন বেশী ৷ মায়ের এখন ভালোমতো বিশ্রাম দরকার ৷ মায়ের সব কাজ এখন আমিই করছি ৷ রান্নাও ৷ কিছু ভালো লাগছে না! যে দিকেই তাকাচ্ছি, সেই দিকেই অন্ধকার দেখছি! যেন একটা বোবা কান্না দলা পাকিয়ে ভেতর থেকে উঠে আসছে! এ ভাবে আর কত দিন? ভেতরের শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে! না এ ভাবে চলতে পারে না ৷ লেনিনদাকে একটা ফোন করি ৷ ওর সঙ্গে কথা বললে মনে শক্তি পাব ৷ না, ফোনটা করেই ফেলি-

“হ্যাঁ, হ্যালো আমি অর্ক বলছি।” 

“বুঝতে পেরেছি৷ বল৷ কেমন আছিস? মাসিমার শরীর কেমন আছে? ওষুধ পেতে অসুবিধা হলে জানাস কিন্তু “৷

“জানাব ৷ তুমি কেমন আছো লেনিন দা?

“তোদের কতবার বলেছি ৷ লেনিনদা নাম টা ছাড় ৷ ওত বড় একজন মহামানবের নাম আমার পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছিস ! এটা ঠিক নয়।” 

“তুমি যেটা বলতে চাইছো বুঝতে পারছি৷ কিন্তু কি করব বলো? এই দেখো না এখন আমাদের সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংও অভ্যাস হয়ে গেছে।”

সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং কথাটায় আমার ঘোরতর আপত্তি আছে ৷ আমি এর ঘোর বিরোধী”৷ কেন? আপত্তি কেন?

“ওটা বুর্জোয়া আর সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের কথা৷ ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের রিপিটেশন ৷ কথাটা হওয়া উচিত ফিজিক্যাল ডিস্টেন্স ৷ সমাজিক দূরত্ব অভ্যাস করলে আমরা এই ঘোর দুর্দিনে সাহয্য দিয়ে, সাহায্য নিয়ে একে অন্যের পাশে দাঁড়ব কীভাবে?’’

“ঠিকই বলেছো ৷ এ দিকে এই রাজ্য প্রশাসন আর রাজ্যপালের কুয়ো তলার ঝগড়াটা আর টলারেট করা যাচ্ছে না ! তারপর রেশন দুর্নীতির কথাটা একবার ভাবো ৷’’

“দ্যাখ্, ভোট সর্বস্ব রাজনৈতিক দলের সামনে যখন কানো সুস্পষ্ট জনকল্যাণমুখি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি না থাকে তখন একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চায়! আর দুর্নীতি হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সব থেকে বড় ব্যাধি ৷ এরা একে অন্যের পরিপূরক।” 

“কীরকম?’’

“দ্যাখ্, পুঁজিবাদ এক চেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিভিন্ন কর্পোরেট কর্পোরেশন ও বহুজাতিক সংস্থা তৈরি করে ৷ এই সব কর্পোরেট লবি রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব তৈরির জন্য জনগণের নির্বাচিত জনপ্রিতিনিধিদের হাত করে ৷ তাদের দিয়ে সরকারী নিয়ম নীতি শিথিল করে ৷ বিলগ্নিকরণ থেকে বেসরকারীকরণ বাড়তে থাকে ৷ পুঁজির অবাধ চলন বাধা মুক্ত হয় ৷ এর বিনিময় মূল্য হিসাবে রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দল প্রচুর পরিমাণ অর্থ লাভ করে ৷ একেই বলে দুর্নীতি ৷ এই দুর্নীতিই আবার নানা চেহারায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে ৷’’

“তার মানে, রাজনৈতিক শ্রেণি দুর্নীতির চাপে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ! এটাই পুঁজিবাদের লক্ষ্য ৷ তাই তো?’’

“কথাটা হলো পুঁজিবাদী মতাদর্শই যে সব রাজনৈতিক দলের নিজস্ব মতাদর্শ , পুঁজিবাদ সেই সব দলকেই হাতিয়ার করে ৷ নিজস্ব মিডিয়াকে ব্যবহার কোরে তাদের কে তোল্লাই দেয় ৷ সরকারে আনার জন্য দেদার টাকা খরচ করে৷ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোকেও তারা সুচারু ভাবে ব্যবহার করে ৷ এ ভাবেই ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়!’’

“হ্যাঁ , বুঝতে পারছি ৷ এজন্যই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোর ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে ! কিন্তু এই অবস্থা থেকে বের হবার উপায় কী?’’

“উপায় অবশ্যই আছে ৷ কিন্তু কঠিন সে পথ!’’

“কেমন?’’

“পুঁজিবাদ এর আগেও সঙ্কটে পড়েছে ! আগামী দিনেও পড়বে ! পুঁজিবাদের চরিত্রের ভেতরই এর সঙ্কটের বীজ লুকিয়ে আছে!লাগাম হীন মুনাফা ভয়াবহ বৈষম্য ডেকে আনে ৷ অতিরিক্ত উৎপাদন বাজারের চাহিদা মিটিয়েও ডাঁই হয়ে পড়ে থাকে ৷ ঋণ খেলাপির পরিমাণ অস্বাভাবিক রকম বাড়তে থাকে ৷ এর ফলে পুঁজিবাদ মুখ থুবড়ে পড়ে ! এই অবস্থায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শই একমাত্র বিকল্প ৷’’

“আবার সমাজতন্ত্র?’’

“কেন নয়?’’

“সে তো রাশিয়া সহ গোটা পূর্ব ইউরোপে গত শতকের নয়ের দশকে চৌপাট হয়ে গেছে! আবার তার গুণগান গাওয়ার কোনো মানে হয়?’’

“হয় ৷ এর বিস্তর মানে হয়৷ পরাজয় বা পতন মানে বিলোপ নয় ৷ তুই যদি কঠিন অঙ্কের সমাধান করতে না পারিস, তা দোষটা কি অঙ্কের? শোন, পৃথিবীর অনেক দেশে সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা, অনুশীলন আজও চলছে৷ আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে ৷ এক নতুন বামপন্থা জেগে ওঠার পথে ৷’’

“নতুন বামপন্থা ! মানে ? তোমাদের মার্কসবাদ তাহলো পুরোনো হয়ে গেল?’’

মার্কসবাদ কখনও পুরোনো হয় না ! মার্কসবাদ কোনো আপ্ত বাক্য নয় ৷ এটা বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞান সম্মত ভাবেই এর প্রয়োগ সম্ভব ৷ পুঁজিবাদের মুনাফার দর্শন পৃথিবীতে কোনো শান্তি আনবে না ৷ সীমাহীন বৈষম্য বৃদ্ধি ছাড়া এর আর কোনো শক্তি নেই!” 

“তাহলে লেনিন দা, তুমি বলতে চাইছো করোনা মহামারি কাটিয়ে আমাদের সামনে সমাজতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প?’’

“আমি বলার কে! আমি বলতে চাইছি না৷ সমাজ বিজ্ঞান, রাজনৈতিক বিজ্ঞান, অর্থনৈতিক বিজ্ঞান , সকলে এক সঙ্গে বলছে, করোনা পরবর্তী দুনিয়া হবে এক নতুন দুনিয়া৷ আমেরিকা সহ গোটা পশ্চিমী দুনিয়ার ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকা ,বুঝতে পারবি লাগাম হীন মুনাফা পুঁজি কীভাবে ওদের ভেতরে ভেতরে দেউলিয়া করে দিয়েছে! একটা ফাঁপা চেহারা নিয়ে দুনিয়াগিরি করতে গিয়ে ওদের কি হাল হয়েছে দ্যাখ্?”

“কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বাঁধবে কীভাবে লেলিন দা?’’

“এটাই তো বামপন্থীদের পরীক্ষা! কঠিন চ্যালেঞ্জ! শুধু ভোট রাজনীতি দিয়ে এই পরীক্ষায় পাশ করা যাবে না” 

“তাহলে?’’ সংগঠিত, অসংগঠিত নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা কৃষক-শ্রমিক সহ সর্বহারা ও সাধারণ মধ্যবিত্ত যারা নানা ভাবে নানান বৈষম্যের শিকার তাদের সংঘবদ্ধ করে ধারাবাহিক ভাবে জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে ৷ এটা একটা সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া ! আপস হীন সংগ্রাম চালাতে পারলে দেরিতে হলেও মুক্তির পথ একটা বের হবে…”

ফোনে কথা বলতে বলতেই অর্কর কানে একটা চিৎকার-চ্যাঁচামেচির আওয়াজ এসে ঢোকে! অর্ক লাইন না কেটেই লেনিনদার সঙ্গে কথা থামিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে৷ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে কলতলার দিক থেকেই আওয়াজটা আসছে! পাশের বাড়ির জেঠিমা ডাকছে—

“অর্ক তাড়াতাড়ি আয় ৷ তোর মা কলতলায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে…”

“হ্যালো ৷ হ্যালো ৷ অর্ক…”

অর্ক ঘর থেকে কলতলার দিকে ছুটে আসতে আসতে-

“লেনিন দা বড় বিপদ হয়ে গেছে ! মা কলতলায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।” 

“কোনো চিন্তা করিস না , আমি যেভাবে হোক পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোর বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছি।” 

অর্ক গিয়ে দেখল মা কলতলায় চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে৷ সম্ভবত মাথার পেছনে আঘাত লেগেছে! রক্তে ভেসে যাচ্ছে কলতলা ৷ মুহূর্তের তৎপরতায় অর্ক মাকে তুলে এনে বিছানায় শোয়ালো৷ অর্কর শরীর রক্তে ভিজে গেল৷ অর্ক রক্ত বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কিছুতেই ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না! অর্ক একটা গভীর অসহায়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে৷ রক্ত থামাতে পারছে না৷ নিথর রক্তাক্ত মাকে বুকে টেনে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল অর্ক৷ হঠাৎ ডোর বেল বাজল৷ অর্ক ধড়ফড় করে মাকে সাবধানে রেখে ছুটে এসে দরজা খুলল ৷ লেনিনদা দাঁড়িয়ে ! অর্ক কাঁদতে কাঁদতে লেনিনদাকে জড়িয়ে ধরল! লেনিনদা অর্ক-র মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“চিন্তা করিস্ না ৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আমি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছি ৷ আর এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করলে হবে না।” 

হাসপাতালে বসে অর্ক ভাবল- “কই , পাশের বাড়ির জেঠিমা শুধু তাকে ডেকে দিয়েই খালাস্ ৷ বাড়িতে আসা তো দূরের কথা, মা-কে যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছে তখন একবার উঁকি পর্যন্ত মারল না! ওঃ! তাইতো! ভুলেই গেছি! ওনারা তো সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং বজায় রাখছেন! পলিটিক্যালি কারেক্ট!’’ লেনিনদা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে অর্ক-র সামনে এসে দাঁড়াল ৷ অর্ক-র কাঁধে হাত রাখল ৷

“ভাবিস্ না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তুই এখানে বোস ৷ আমাকে রক্ত আনতে ব্ল্যাড্ ব্যাঙ্কে যেতে হবে।” 

লেনিন দা ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল৷ অর্ক-র হাতে, জামায় তখনও মা-এর শরীরের টাটকা রক্ত লেগে রয়েছে! অর্ক চোখের সামনে রক্তমাখা হাতটা মেলে ধরল৷ রক্তের রঙ লাল, এটা তো আর অর্ক-র কাছে নতুন কিছু তো নয়! তবুও অর্ক এই রঙের মধ্যে কি যেন একটা খুঁজে পাচ্ছে! কী সেটা? অর্কও বোঝার চেষ্টা করছে! কী সেটা? অর্ক ভাবল লেনিন দা আসুক, জিজ্ঞাসা করবে৷ লেনিন দা নিশ্চই বলতে পারবে৷

 

 

 

 

One thought on “উৎসব সংখ্যা গল্প: গল্প-লেনিন দা । ইন্দ্রজিৎ ঘোষ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত