| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: সামাদের সঙ্গে একদিন । যুগান্তর মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

টোটো থেকে নেমে শতদল যে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালেনতার উঠোনে একটা মোরগ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মোরগটা লাল ঝুঁটি দুলিয়ে কককক শব্দ করে একঝলক দেখে নিল আগন্তুককে। তারপর আবার আগের মতোই উঠোন থেকে কিছুএকটা খুঁটে খেতে খেতে চলে গেল ঘরের পেছনদিকে। হয়তো অচেনা লোকটাকে পছন্দ হয়নিকিংবা অনেকদিন বাদে নতুন কোনও লোকের আবির্ভাবে বিরক্ত কিছুটা।

মোরগের চলেযাওয়া দেখতে দেখতেই শতদলের নজর পড়ল উঠোনের কোণে বাতাবি লেবু গাছের নীচে মাদুরের ওপর বসে আছেন এক বৃদ্ধ। শতদল ভালো করে খেয়াল করেনসামাদ ভাই শারীরিকভাবে অনেকটাই বদলে গেছেন। অথচ কী দারুণ শরীরের গঠন ছিলযেমন দীর্ঘ দেহতেমনই ছিল চওড়া বুক। ঋজু হয়ে হাঁটতেন লম্বা লম্বা পা ফেলে। সবসময়ই চোখে স্বপ্ন খেলা করে বেড়াত। সেই মানুষটাই এখন কেমন যেন বেঁকেচুরে গেছেনলোকটাকে এতটা খারাপ দেখতে হবেভাবেননি। প্রায় একুশবাইশ বছর বাদে সামাদের কাছে এলেন শতদল। শরীর ভেঙে গেলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি তাঁকে।

সামাদকে দেখে অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে যান শতদল। সামাদের চোখ তখন হাতের তালুর দিকে। কী ভাবছেন সামাদ ভাইএকজন যে তাঁর প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছেনসেদিকে খেয়াল নেই বৃদ্ধের। শতদলের কথা শুরু করার প্রস্তুতির সময়ই একটি সাইকেল দ্রুত ঢুকে এল উঠোনে। প্রায় লাফিয়ে নামল এক তরুণ। মাটির ঘরের দেওয়ালে সাইকেল হেলান দিয়ে রাখতে রাখতে সেই তরুণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলআপনেই কি শতদল মল্লিক?

সাদা পায়জামা আর নীল টিশার্ট পরা তরুণকে দেখেন শতদল। শরীরের গড়ন লম্বাটে। রোগা চেহারা। সামাদ ভাইয়ের কেউ হয় নাকিতিনিই যে শতদলমাথা নেড়ে সম্মতি জানান।

বুঝছি। আম্মু আপনের কথা বলছে। অনেক আগে নাকি গেছিলেন নানার কাছে। মুড়াগাছার বাড়িতে।

হ্যাঁ হ্যাঁগিয়েছিলাম। বেশ কয়েকবার। সেই বাড়িটা ভারী সুন্দর ছিল। ইটের দালান। টিনের চাল। অনেক বড় বাড়ি। আমি গেলে ওনার সঙ্গে কত গল্প হতছেলেটার কথা শুনে বুঝতে পারেন সে সামাদের নাতি। তাই গলা থেকে উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসে। কথা চালিয়ে যেতে ভালো লাগে তাঁর। ‘তুমি বোধহয় ওনার নাতি। ঠিক কিনা?’ কথা ভাসিয়ে দেন শতদল।

হ হ। ঠিকই। আবদুল সামাদ আমার নানাআমি দাদা ডাকি। আমার নাম রসিদ।

শতদলের মনে পড়ে যায়প্রথম যখন ফোন করেছিলেনএই নামটাই বলেছিল। ও যে নানাকে দাদা বলে ডাকেতাও জানিয়েছিল সেসময়। এরপর আরও কয়েকবার কথা হয়েছে রসিদের সঙ্গে।

কার সাক্ষাৎকার নিবেন ছারদাদার তো মাথারই ঠিক নাই!

মানেকী হয়েছে সামাদ ভাইয়ের?

মাথাটা এক্কেবারে গ্যাছে। সারাদিন চুপ মারি বসি থাকে। কারও সঙ্গেই কথাটথা কয় না। খাইতে দিলে খায়নাদিলে চায়ও না।

ফোনে এসব শুনেই দমে গিয়েছিলেন শতদল মল্লিক। সামাদ ভাই কথা বলেন নাখেতে দিলে খানতাহলে কি সাক্ষাৎকার নেওয়া যাবে নাহতাশা নিয়েই বলেছিলেনআমি যদি একবার দেখা করি ওনার সাথেমানে অনেকদিন সেভাবে যোগাযোগ নেই… তাই আর কিফোনের ওপার থেকে খুব যে উৎসাহ ছিল তাঁর আবেদনেতেমনটা নয়। তবে বারণও করেনি ছেলেটি।

লোক গবেষণা’ পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ দাস আবদুল সামাদের সাক্ষাৎকার নিতে বলেছিলেন। “পুতুলনাচের নেপথ্যশিল্পীদের কথা তেমন করে জানে না অনেকেই। পালার নামঅপেরার নাম হয়তো শুনেছে। অথচ আবদুল সামাদ পুতুলনাচের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। সামাদকে অনেকেই ভুলে গেছেন। পুতুলনাচই এখন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। তাই এইদিকটা নিয়ে কাজ করতে চাইছি।” বলেছিলেন সমীরণ। তাঁর দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেছিলেন শতদল। তখনই রসিদ এইসব কথা জানিয়েছিল।

ঐ যে বসি আছেন দাদা। চিনতে পারছেন?

ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেন শতদল। হুমপ্রথমে চিনতেই পারছিলাম না!

দাদা কাউরেই ঠিক চিনতি পারে না। আপনেরেও চিনতি পারবে কিনা কে জানে!

সমীরণ বলে দিয়েছেনএকান্ত যদি ইন্টারভিউ নানেওয়া যায়তাহলে অন্তত ওনাকে নিয়ে লিখতে। সেইমতো ফোনে জানিয়েও দিয়েছেনপুতুলনাচ শিল্পী আবদুল সামাদ সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নেবেন। এবারের পত্রিকার বিষয় ‘হারিয়ে যাওয়া পুতুলনাচ’। হঠাৎই তাঁর মনে পড়েআম্মুর কথা বলছিল রসিদ। তাকে কি দেখেছি কখনওতিনি প্রশ্ন করেনতোমার আম্মু কোথায়?

আম্মু কাজে গ্যাছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করে। চলি আসবে এখুনিআপনের আসার কথা জানে তোএখেনে এসে বসেন ছার।

রসিদের কথায় শতদল তাকিয়ে দেখেনঘরলাগোয়া কাঠের একটা বেঞ্চিতে বসতে বলছে সে। দুইদুই চারটে বাঁশের পায়ার ওপর তক্তা জুড়ে বেঞ্চ বানানো। বেঞ্চটা হাত দিয়ে ঝেড়ে নিয়ে রসিদ সেখানে বসেছে। ইশারায় তাঁকেও বসতে বলে পাশে। শতদল বসার বদলে আবদুল সামাদের কাছে উবু হয়ে বসেন।

কেমন আছেন সামাদ ভাই?

ভাবলেশহীন মুখে চোখ রাখলেন শতদলের দিকে। দেখলেন কিছুক্ষণ। বোঝা গেল চিনতে পারেননি তাঁকে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা এগিয়ে দিয়ে বলেনআমি শতদল মল্লিক। আপনার মুড়াগাছার বাড়িতে অনেকবার গিয়েছিলাম। সেই ভক্ত প্রহ্লাদ পালা দেখতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল। মনে পড়ছে না?

সামাদের কোনও ভাবান্তর হয় না। শতদলের মনে পড়লসিগারেট দিলে হাসিমুখে নিতেন সামাদ ভাই। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। বাঁহাতে সিগারেট ধরে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দুটো টোকা মেরেসিগারেট ঠোঁটে গুঁজেমুখ বাড়িয়ে দিতেন আগুনের জন্য। এখন ছুঁয়েও দেখলেন না। একবার মাত্র সিগারেটে চোখ রেখে মুখ সরিয়ে নিলেন নিজের হাতের তালুতেআগের মতোই।

আব্বু বিড়িসিগারেট ছাড়ি দেছেন। এগুলার কোনও চাহিদা নাই। আগে ভালোমন্দ রান্না হইলে দুপুরে খাওয়ার পরে পান মুখে দিতেন। এখন তাও দেন না। কী ছিলেন আব্বুকী হই গেলেন!

মাঝবয়সি এক মহিলা কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছেনখেয়াল করেননি শতদল। রসিদের ফোনেই জেনেছেনছেলেদের কাছে আব্বা বোঝা হয়ে উঠেছিলেন। সেইসময় মেয়ে তার কাছে এনে রেখেছে। তাহলে এই সেই মেয়ে!

আমার নাম জারিনা। আমি আপনেরে আব্বুর কাছে আসতে দেখছি অনেকবার। বাইরের লোকের সামনে আম্মু আসতে দিত না। তাই আমারে আপনে দেখেন নাই কুনুদিন। মুখে হাসির রেখা ঝুলিয়ে জানায় সে। অনেক দূর থিকা আসছেন। বসেন কাকাবাবু। আব্বুর তো কিছুই মনেটনে নাই। আপনে বরং ছেলের সাথে কথা কন। যদি কিছু জানার থাকে জেনে নেন। আর একজনরেও আসতে কইছি। এসে যাবে’খন। আমি চা করে আনি। কথাটা বলেই ঘরে ঢুকে যায় জারিনা।

দরমার বেড়ার দুটো ঘর পাশাপাশি। মাটির দেওয়াল। টালির চাল। ঘরে হয়তো বসতে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নেইতাই বাইরেই বসার বন্দোবস্ত করা আছে। ভাবেন শতদল।

সামাদ ভাইয়ের কবে থেকে এইরকম অবস্থা হলবেঞ্চে বসতে বসতে রসিদকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি।

কয় বচ্ছর ধরিই এইরকম। ছেলেরা দ্যাখল না দাদারে। তাই আমাদের কাছে এনে রাখছি।

মামারা বলার বদলে ছেলেরা বলল রসিদ। তার মানে মামাদের প্রতি রাগ বা অভিমান আছে ওর। শতদল সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেসব প্রসঙ্গে যেতে চাইলেন না। তুমি কী করোমানে কাজটাজ কিছু…

আমি একটা চালকলে কাজ করি। দোকানে এসি একজন কইলকে নাকি আমাগো বাড়ি আইবে বলি টোটোয় উঠছে। তখনই বুঝছি আপনে সত্যিই এসি পড়িছেন। মালিকরে বলি ছুটি করি চলি এলাম।

সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলেন শতদল। নৈহাটি থেকে ট্রেনে রানাঘাট স্টেশনে নেমেছেন। তারপর একেতাকে জিজ্ঞাসা করে এসেছেন ধানতলায়। তখনই কেউ দেখে রসিদকে বলেছে। নিশ্চিত হন শতদল।

আম্মু আগে কইতপুতুল নিয়া থাকা নাকি দাদার বাতিক। এখন আর রা কাড়ে না। জানায় রসিদ।

স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন শতদল। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলে যেতে থাকেনসামাদ ভাই পুতুলনাচ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। কত ভাবনাচিন্তা ছিলনতুন নতুন পালা লিখতেন। লেখা হয়ে গেলেই পোস্টকার্ডে জানাতেন তাঁর কাছে আসতে। সময় বের করে যখন পৌঁছতামততদিনে হয়তো আরও দুটো পালা লেখা হয়ে গেছে। সেসব পড়ে শোনাতেন। সংলাপ ছিল অত্যন্ত সাবলীল। আরএকটা ব্যাপার ছিল ওনার। কথার মধ্যে খুব সুন্দর ভাষা ব্যবহার করতেন। একদিন বলেছিলেন, ‘আমার বড় ছেলেটা খুব সুন্দর কথাবার্তা বলতে পারে। ওকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করে নেব শতবাবু। আমার যখন অনেক বয়স হয়ে যাবেযখন উত্থানশক্তিরহিত হয়ে পড়বতখন পুতুলনাচ ছেলেই বহন করে যাবে।’ সামাদ ভাইয়ের মুখে ওপার বাঙাল ভাষার টান কমই ছিল। একটানা কথাগুলো বলে রসিদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেনওনার ছেলেরা পুতুলনাচে আসেনিতাই না?

না নাওরা এসব পছন্দই করে না। আমার আব্বু পুতুলনাচ ভালোবাসত। আমারও খুব ভালো লাগে। কিন্তু মা চায় না আমি এইসব নিয়া থাকি।

কেনচায় না কেন?

মনে হয় আব্বু পুতুলনাচ করতে চাইত। চাষবাস করত না সেইভাবে। তাই…

প্রবল রোদের তেজের মধ্যে জমিতে চাষ করতে করতেই সামাদ ভাইয়ের জামাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। ফোনে জানিয়েছিল রসিদ। কথাটা মনে পড়ায় সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন।

একবার বীণাপাণি অপেরা বাংলাদেশের রাজশাহিতে গিয়েছিল পাপেট শো করতে। তখনই অপেরার মালিক রতন সরকারের সঙ্গে পরিচয় হয় সামাদের। স্থানীয় একটা ছোট দলে পুতুলনাচ দেখাতেন সামাদ। রতনবাবুর ডাকে সাড়া দিয়ে সব ছেড়েছুড়ে একাই চলে এসেছিলেন এপারে। প্রথমে ঘরভাড়া নিয়ে থাকতেন। তারপর জমি কিনেছেনঘরবাড়ি করেছেন। একসময় এখানেই সংসার গড়ে উঠেছে তাঁর। পড়াশোনা খুব বেশি শিখতে পারেননি। কিন্তু পুতুলনাচের ইতিহাস নিয়ে নানা লোকের সঙ্গে আলোচনা করতেন। কোনও এক অধ্যাপকের নাম বলতেন। এখন আর মনে পড়ে না শতদলের। সেই অধ্যাপকের থেকে শুনেছেন ভারতের শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক পুতুলনাচের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সামাদ ভাই তাই নিজের বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন অশোক। ভক্ত প্রহ্লাদরাজা হরিশ্চন্দ্রভিখারিনী মীরাভক্তের ডাকে ভগবান কাঁদেএইরকম নানা পালা লিখেছিলেন। অভিনয়ে গলা মেলাতেন। এই কারণে জাতিগতভাবেও কম হেনস্থা হতে হয়নি তাঁকে। প্রায় একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারেরও এই নিয়ে নানা আপত্তি ছিল। সবই সামাদ ভাইয়ের কাছে শোনা শতদলের।

রসিদ আরও কিছু কথা বলে চলেছে। তার অধিকাংশই শতদলের কানে পৌঁছয়নি। তিনি তখন অতীতে ডুবে গিয়েছিলেন। অনেকদিন আগে একবার বীণাপাণি অপেরা হালিশহরে বৈশাখী মেলায় গিয়েছিল পুতুলনাচ দেখাতে। আবদুল সামাদের সঙ্গে তখনই আলাপ হয় তাঁর। সেসময়ই পুতুলনাচের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয়েছিল। তারপর একসময় সেসবও কমে এসেছিল। একদিন নিজেই বলেছিলেন তাঁকে সামাদ ভাই বলে ডাকতে। তাঁর থেকে বয়সে বড় হলেও সামাদ ভাই বলতে খারাপ লাগত না শতদলের। আগে মেলা ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় মাঝে মাঝেই পুতুলনাচ হত। তারপর একসময় পুতুলনাচ শুধু মেলাতেই টিকে রইল। তাও বেশি লোকজন দেখত না। শতদলকে হতাশ সামাদ ভাই জানিয়েছিলেন।

তুমি পুতুলনাচের কৌশল জানোরসিদকে প্রশ্ন করেন শতদল।

দাদার থেকে কিছু কিছু শিখছিলাম। অনেক গান এখনও মনে আছে। উজ্জ্বল মুখে জানায় রসিদ।

আরে ধুরএসব শিখে কি প্যাটের ভাত হয়কে দ্যাখে এখন এইসবজারিনা চায়ের কাপ হাতে এসে দাঁড়ায়।

কী বলছ জারিনাএ হল গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। তোমার আব্বুর কাজ সম্পর্কে তুমি তো জানো!

জানি কাকাবাবু। আব্বু এই ছাড়া আর কিছু ভাবত না। কিন্তু ওনার তো নিজের দল ছিল না। সরকারবাবু ছিল মালিক।

জারিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই শতদল বলে চলেনসামাদ ভাইয়ের কাজ ছিল অসাধারণপুতুলগুলো জীবন্ত হয়ে উঠত ওনার হাতের কারসাজিতে। আর ছিল অভিনয়শুধু গলা দিয়ে ঐরকম অভিনয় আমি আর কারও কণ্ঠে শুনিনি। আহাজীবনে ভুলতে পারব না।

হঠাৎ জারিনার খেয়াল হল মাস্টার কাকা এখনও তো এলেন নাছেলের দিকে তাকিয়ে সে বলেযা তো রসিদমাস্টার কাকারে ডাকি নিয়া আয় তাড়াতাড়ি।

বেঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নেমে সাইকেল নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় রসিদ। শতদল সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেনমাস্টার কাকা কে?

আব্বুগো দলে বাঁশি বাজাইত। গান গাইত। আপনি দ্যাখলে চিনবেন।

হরিপদ?

ইস্টেশনের কাছেই হরিকাকার বাড়ি।

হরিপদ খুব ভালো মানুষ। সে ছিল দলের মূল গায়েন। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিল বলে ওকে সবাই মাস্টার ডাকত। শিক্ষকতার পাশাপাশি পুতুলনাচের দলে ভিড়ে গিয়েছিল সামাদ ভাইয়ের টানে। আমিও হরিকে মাস্টার বলেই ডাকতাম। পুরনো দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে শতদলের।

আমি ছোটবেলা থিকাই মাস্টার কাকা ডাকি ওনারে। হাসিমুখে জানায় জারিনা।

মাস্টার এলেই কথাবার্তা সেরে চলে যাব। বেশি বেলা করা যাবে না।

শতদলের কথায় বিস্মিত জারিনা বলে ওঠেকী যে কন কাকাবাবুতা হয় নিকিআপনে এখনই যেতি পারবেন না। গরিবের বাড়ি দুমুঠো খেয়ে তারপর যাবেন।

ইতস্তত করেও রাজি হলেন শতদল। তেমন কিছু জরুরি কাজ রাখেননি আজ। অবসর নিয়েছেন বহুদিন আগেই। কিশোরবেলার ‘রোগ’ মাথাচাড়া দিল তারপরই। তখন কবিতা লিখতেন। সম্প্রতি নানা পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধনিবন্ধ লেখেন। বাড়িতে এসব কারণে তাঁর ছাড় আছে। তাছাড়া সামাদ ভাই সম্পর্কে মাস্টার অনেক তথ্য দিতে পারবে। তাই থেকে যাওয়াই ঠিক করলেন তিনি। জারিনা রান্নার জোগাড়ে চলে গেল। শতদল গিয়ে বসলেন সামাদের পাশেমাদুরে।

()

বাবার সামনে ভাতের থালা এগিয়ে দিল মেয়ে জারিনা। এই গাছতলাতে বসেই নাকি প্রতিদিন খান। তাঁর প্রায় সারাদিনের ঠিকানাও এটাই। থালার দিকে চোখ পড়ায় একবার মেয়ের দিকেএকবার শতদল আর মাস্টারের দিকে তাকালেন তিনি। নিষ্প্রাণ সেই চাউনি। হাত বাড়িয়ে থালাটা একটু কাছে টেনে নিলেন। ভাত নাড়াচাড়া করছেন। মাঝে মাঝে মুখে তুলছেন। আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে ভাত।

আব্বু এইরকম করিই খায় এখন। যা খায় তার থে’ পড়ে বেশি। জারিনা ম্লান মুখে জানায়।

উঠোনে চাটাই পেতে খেতে দিয়েছে জারিনা। শতদল ও মাস্টার বসেছেন পাশাপাশি। স্নান সেরে রসিদও খেতে বসে গেল মাস্টারের পাশে। ভাতের সঙ্গে ডালনটেশাক আর লটে মাছের ঝাল। খেয়ে খুব তৃপ্তি পেলেন শতদল। হরিপদও প্রশংসা করলেন রান্নার। খাওয়ার পরে মাদুর পেতে বসলেন ছায়াঘেরা উঠোনে। পুতুলনাচবাজারের ঊর্ধ্বমুখী দরদামসামাজিক অবস্থান নিয়ে কথা হচ্ছিল। তবে পুতুলনাচই মাস্টারের মূল বিষয় যেন। এই নিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে বলে গেলেন।

আপনাকে কী বলব শতদাদাশ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে কৃষ্ণনাম করতেন আবদুল দাদাতা নিয়ে কম অশান্তি হয়নি। পরে সেই গান আমি গাইতাম। তখন থেকে আমি বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও গেয়েছি পালায়। ছুঁৎমার্গরা সব ধর্মেই আছে। অনুযোগের সুর হরিপদর গলায়। জানা কথাই শতদল আবার শুনলেন মন দিয়ে। কথায় কথায় মাস্টার জানালেনবড়ু চণ্ডীদাসও পুতুলনাচ পছন্দ করতেন। নানা সংস্কৃত সাহিত্যেও পুতুলনাচের কথা আছে। হরিপদর এই বিষয়ে জ্ঞান দেখে অবাক হন শতদল। নোটবইতে লিখে নিতে থাকেন জরুরি তথ্য। হরিপদ আসার পর থেকেই একের পর এক পুতুলনাচের কথা বলে চলেছেনশতদল তাই ব্যাগ থেকে বের করে নোটবইটা হাতের কাছে রেখেছেন। তাঁকে দেখে হরিপদর মুখ থেকে জলস্রোতের মতো পুতুলনাচের ইতিবৃত্ত বেরিয়ে আসছে যেন।

এতকিছু জানলে কোত্থেকে ভাইশতদল একমুখ হাসি ছড়িয়ে দেন।

মুখে হাসি ঝুলে পড়ে হরিপদরও। আবদুল দাদার পাল্লায় পড়েছিলামজানেন তো আপনিসুধীর স্যারের কাছ থেকে উনি অনেককিছু জানতে চাইতেন। জেনে আমাকে বলতেন। তারপর আমারও নেশা লেগে গেল। অনেক বইপত্র ঘাঁটতাম আর সেসব বলতাম আবদুল দাদাকে। কী যে আনন্দে কাটত শতদাদা!

দলটা ভাঙল কেন মাস্টারচোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করেন শতদল।

দল তো আছেটিমটিম করে চলে আর কিপুতুলনাচ দিয়ে ভোটের প্রচার করতে চাইছিল নানা দল। আবদুল দাদা গোঁ ধরে থাকলেনএসব করবেন না। লোকশিল্পের সঙ্গে রাজনীতি মেলাবেন না কিছুতেই। তাই দলে আর রাখল না সরকারবাবু।

হরিপদ আবার বলে যেতে থাকেন পুতুলনাচের নানা দিক। আফ্রিকার এক উপজাতি পুরোহিত সম্প্রদায় ভুডু ডল তৈরি করে। এরা এই পুতুল দিয়ে জাদুবিদ্যার মাধ্যমে শত্রুকে বশ করে বা আহত করে। শত্রুর মাথার চুল কিংবা নখ এনে পুতুলে আটকাতে হয়। তারপর ভুডু পুতুলের গায়ে পিন ফোটালে শত্রুরও ব্যথা লাগে। মেরেও ফেলা যায় শত্রুকে। ভারতের তান্ত্রিকরা বিশেষ তিথিতে পুতুল দিয়ে শত্রু খতম করে।

কিন্তু এসব তো নাচের পুতুল নয়সংশয় প্রকাশ করেন শতদল।

নাতা নয়। আমি পুতুলের ব্যবহার নিয়ে বলছি আর কিএগুলোও নাচের পুতুলের সূত্র। পুতুলনাচ যে প্রাচীনকালে ছিলতার প্রমাণ আছে।

পুতুলনাচ বিশ্বের নানা দেশেই আছেকী বলো মাস্টারশতদল প্রদীপের আগুন উসকে দেন।

আলবাত আছেমাস্টারের গলায় প্রত্যয় ফুটে ওঠে। চিনদেশের ছায়াপুতুল তো খুবই প্রাচীন। সাং রাজাদের আমলেও পুতুলনাচ হত। জাপানে বুনরাকু পুতুলনাচও বেশ বিখ্যাত। গিডায়ু টাকেমাতো আর মনজেমন চিকিমাৎসুর নাম শুনেছেন দাদাএনারা কিন্তু বিখ্যাত মানুষ। পুতুলনাচ দেখান। আমি ইউটিউবে দেখেছি এনাদের পুতুলনাচ।

হরিপদ যেন ঘোরের মধ্যে আছেন। তিনি বলে যেতে থাকেনতারপর ধরা যাক ভিয়েতনামের কথা। ইউটিউবে দেখবেন ওয়াং ক্লুইট নামে একটা নামকরা পুতুলনাচ আছে। চমৎকার সেই নাচ। থাইল্যান্ডের পুতুলনাচ হানক্রাবককোরিয়ার জগডু গাগসি। এইরকম নানা কিসিমের পুতুলনাচ আছে দেশে দেশে।

খাওয়াদাওয়ার পরে ঘণ্টাখানেক ছিলেন হরিপদ। তাঁকে চলে যেতেই হবে অন্য এক কাজে। তাঁর তাড়াহুড়ো দেখে জিজ্ঞাসা নাকরে পারলেন না শতদল। লাজুক মুখে হরিপদ কারণটা জানালেন। পটশিল্পী সুবল সামন্ত খুবই অসুস্থ। তাঁর পরিবার মহা আতান্তরে পড়েছে। নিজে বেশকিছু টাকা দিচ্ছেন। বাকিকিছু টাকা এরতার থেকে জোগাড় করেছেন। সেসবই তুলে দিতে যাবেন সুবল সামন্তের হাতে।

বাঁচামড়ার মাঝখানে আছে সুবলদাবুঝলেন শতদাদাওনার পরিবারের পাশে নাদাঁড়ালে হয়!

তা একথা বলতে তোমার এত দোনামোনা কেন গো মাস্টারএ তো ভালো কাজ!

কাজটা ভালো সন্দেহ নাই দাদাকিন্তু নিজে জড়িয়ে আছি যেনিজে মুখে সেকথা বলতে কুণ্ঠা হয়!

তা বেশ। বুঝেছি। তুমি বড্ড ভালো মানুষ গো মাস্টার। সামান্য দেওয়াটাই বেশিরভাগ মানুষ বড় করে দেখায়। আর তুমি এমন অসামান্য কাজেও লাজুক। তোমার দান হল অন্তরের দান। কথাগুলো বলে পার্স থেকে দুশো টাকা বাড়িয়ে দেন হরিপদর দিকে। এটাও রাখো। তোমার মহৎ কাজে সঙ্গ দিক আমার এটুকু…

আপনাকে এগিয়ে দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু আমার যে উপায় নেই দাদাবিকেলের মধ্যেই কাজ সারা নাহলে সমস্যা হয়। সন্ধ্যার পরে চোখে রাস্তাঘাট ঠিক ঠাহর হয় না আজকাল।

দুজনে ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর আদানপ্রদান করার পর হরিপদ বিদায় নেন। যতক্ষণনা তাঁর সাইকেল দৃষ্টিসীমার বাইরে যায়ততক্ষণ শতদল তাকিয়ে থাকেন সেদিকে। তারপর সামাদ যে মাদুরে বসে আছেনতার একপ্রান্তে গিয়ে বসেন। মাস্টার যেসব কথা বলে গেছেন আর তিনি নোটবইতে লিখে রেখেছেন যতটা সম্ভবসেসবে চোখ রেখে বলে যেতে থাকেন সামাদকে। নিশ্চুপ সামাদ ভাই তাঁর কথা শুনছেন কিনাবুঝতে পারছেন না শতদল। কিন্তু তাঁর বলে যেতে ভালো লাগছে। রসিদও বুঝতে পারে না কিছুই। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দাদা আর শতদল মল্লিকের দিকে। জারিনাও ঘরের কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে এসে দাঁড়ায় আব্বুর কাছে। মাঝে একবার নীরবে ঘুরে চলে গেছে সকালের সেই মোরগটাও।

অস্ট্রিয়াজার্মানিচেক রিপাবলিকপ্রাগআমেরিকাগ্রিসঅস্ট্রেলিয়ার পুতুলনাচ নিয়ে যাকিছু বলে গেছেন মাস্টারসেসব বলে যান শতদল। বলতে থাকেন ভারতের নানা রাজ্যের পুতুলনাচ বৃত্তান্ত। কেরালার পাভাকুঠু নাচআসামের পুতলানাচের কথা উঠে আসে শতদলের মুখে। ‘আমরা তো তারের পুতুলের নাচ দেখাতাম। মহারাষ্ট্রে এর নাম কালাসূত্রী বাহুল্য।’ বলেছিলেন হরিপদ। সেকথা উল্লেখ করে সামাদের দিকে তাকিয়ে দেখেন শতদলতাঁর মুখের রেখায় কোনও পরিবর্তন ঘটে না।

কাঁঠালগাছের ছায়ায় মাদুরে বসা শতদলের সামনে যখন পুতুলনাচের ভুবন দুলে উঠছেসেইসময় পুতুলনাচের শিল্পী আবদুল সামাদ সমস্ত জাগতিক অবস্থান থেকে যেন বহু দূরে। নির্বাক বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি একবারও শতদলের দিকে ঘোরেনি।

দুপুরে খানিক ঘুমায়া নেন আব্বু।’ বলেছিল জারিনা। আজ কিন্তু শোওয়ার জন্য যাননি সামাদ। জারিনা বললেও ওঠেননিবসেই থেকেছেন ঠায়।

শতদল ভাবছিলেনএবার ওঠা যাক। মাস্টার রানাঘাট লোকালের সময় জানিয়ে গেছে। আরও কিছুক্ষণ থেকে গেলেও অসুবিধা নেই। পরপর ট্রেন আছে।

আচমকা আবদুল সামাদ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘরে চলে গেলেন ধীরপায়ে। অবাক শতদল তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিস্ময় নিয়ে রসিদ আর জারিনাও দেখতে থাকে। সামাদের কারও দিকেই নজর নেই। যেমন ধীরপায়ে ঘরে গিয়েছিলেনসেভাবেই ঘর থেকে একটা পুরুষ পুতুল নিয়ে আসেন বুকে জড়িয়ে। পুতুলটার দুহাতমাথাহাঁটু আর পিঠ থেকে কালো লম্বা তার ঝুলছে। শতদল জানেনমাথার দুপাশ থেকে যে তার ঝুলতে দেখা যাচ্ছেসেগুলো আসলে কানের পিছনদিকে আটকানো। সামাদের ডানহাতে একটা লাঠি। এইরকম লাঠি দিয়ে দারুণ সুন্দর কায়দায় সামাদ ভাই পুতুলনাচ দেখাতেনমনে পড়ল শতদলের।

পুতুল ও লাঠি নিয়ে সামাদ আবার বসে পড়লেন মাদুরে। পাশে পুতুলটা নামিয়ে রেখে বিড়বিড় করে কিছুএকটা বলতে থাকেন তিনি। কিন্তু তাঁর কোনও কথা কারও কানে ধরা দেয় না। জারিনা খুব কাছে গিয়েও আব্বুর মুখের কোনও শব্দ আবিষ্কার করতে পারে না।

রসিদ ছুটে গিয়ে ঘর থেকে একটা বাঁশি নিয়ে আসে। কোনও অজানা সুর বাজাতে থাকে সে। সামাদ একবার ঘুরে দেখলেন এদিকে। তিনজনের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। একসময় তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল দুগাল বেয়ে। আবার পুতুলটা বুকের কাছে জড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন তাঁর ঘরে। টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন তাঁর নির্দিষ্ট জায়গায়শীতলপাটিতে। বাঁ হাত পুতুলটার ওপর রাখা।

সামাদ ভাই কি আবার ফিরবেন পুতুলনাচেআবার কি তাঁর হাতের জাদুতে নড়েচড়ে বেড়াবে পুতুলেরানাকি রসিদের হাতে তুলে দেবেন তাঁর জাদুলাঠিপ্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন শতদল।

ফেরার সময় তিনি দেখতে পান পথের ধারের সারি সারি গাছপালাআকাশইলেক্ট্রিকের তারদোকানের সাইনবোর্ড থেকে রাশি রাশি কালো তার ঝুলছে। কোন্ অদৃশ্য পুতুলের সঙ্গে তারগুলো বাঁধাসেই অন্বেষণে শতদলের পথ ভুল হয়ে যায়।

4 thoughts on “উৎসব সংখ্যা গল্প: সামাদের সঙ্গে একদিন । যুগান্তর মিত্র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত