Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

উৎসব সংখ্যা গল্প: শুভ পরিচয় । কল্যাণী রমা

Reading Time: 4 minutes
(১)

আবার অপেক্ষা করছি। কিসের এত অপেক্ষা আমার? এ কোথায় শুয়ে আছি? কোনও এক জলপ্রপাতে কি? কি জানি হয়ত আসলেই জলপ্রপাত! বামদিকের জানালা দিয়ে খুব অল্প আলো ঢুকছে ঘরে! জানালাগুলো সব সময় বামদিকে হয়! কে জানে হয়ত বামদিকে, ঘরেরও একটা হৃদয় থাকে।চোখ বন্ধ। কোনকিছুই খুব ভাল বুঝতে পারছি না। আসলে চোখ খুলে জলপ্রপাত দেখে ফেলব ঠিক অতটা সাহস নেই আমার।অপেক্ষা করছি। পায়ে পা পেঁচিয়ে খুব বেশী রকম চাচ্ছি একদম ভেসে যেতে। অনেক জলের ভিতর। থরথর করে কাঁপছে শরীর। আমার হাতের এবং পায়ের পাতাগুলো শাদা কঙ্কালের মত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট আর ভেজা নয়। গলা শুকিয়ে কাঠ।আর কিছুতেই কিছু সহ্য করতে পারছি না। কেন এত কষ্ট হচ্ছে? দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর অল্প অপেক্ষা করলে আমি জানি একদম ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়বে আমার পুরো কঙ্কাল শরীর। অমনই তো সবসময়। মানুষকে মুঠো করে যত জোরে চেপে ধরতে যাই, সে তো আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালুর মতই ঝরে পড়ে।
কনভেয়ার বেল্টের উপর দিয়ে যৌবনটা চলেছে…মনে হ’ল উপর থেকে গিলোটিন-এর ব্লেড নেমে আসবে এখনি – অসফলতার মত! কিন্তু যখন ভাবছি আর কিছুই হ’ল না, ঠিক তখন সমস্ত আমাকে ভাসিয়ে ভীষন জোরে শাদা জল উত্তর গোলার্দ্ধ থেকে দক্ষিন গোলার্দ্ধ পর্যন্ত নেমে আসল। অসম্ভব শাদা ওই কালো জল। কোনমতে দু’হাতে পাহাড় জড়িয়ে আমি নামতে থাকলাম। কোন পুরাতন বৌদ্ধ স্তুপের অসংখ্য সিঁড়ির পাপ বেয়ে বেয়ে। ছোট, ছোট বেগুনি ফুল ভাসছে জলের উপর। ফুলের নাম জানি না। এবং হঠাৎ দেখি জানালা দিয়ে অনেক আলো এসে এক লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। আসলে ওগুলো আলোর ধুলো। মিছিল করে একটু সুযোগ পেলেই একেবারে অস্তিত্বের ভিতর ঢুকে পড়ে। ভাঙ্গাচোরা ছোট, ছোট স্বপ্নের মত। শরীরটাকে ফেলে রেখে আকুল হয়ে কোনমতে বাইরে তাকিয়ে দেখি, ‘ওমা, একি! পাশের মরা রেডবাড গাছটা পেঁচিয়ে অনেক নীল রঙের মর্নিং গ্লোরি ফুটে আছে। কোন কুয়াশা নেই। ভোর হয়ে গেছে।’এদিকে নিজের দিকে তাকিয়ে সে তো আর এক কান্ড! আমি তো জেগেই আছি পুরো জীবন কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে। তবু কোন কারণ ছাড়াই অসম্ভব জোরে কেন যেন ঘড়ির এলার্ম বেজে উঠল। আহা রে, জীবনটাতে কারখানার মত কেবলই ঘন্টা বেজে চলেছে। পড়িমরি নামতে গেলাম বিছানা থেকে। কোথায় স্যান্ডেল কোথায় কি। হোঁচট খেয়ে পড়লাম। কোনমতে নিজের শরীর, মন সব সামলে রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিলাম। জলখাবার বানাতে হবে। বাচ্চা দু’টো্র স্কুলের লাঞ্চ। স্নো-প্যান্ট, স্নো-বুট, মিটেন, টুপি, ডাউন কোট – কিচ্ছু ভুল করা যাবে না। চারিদিকে এত বেশী শাদা বরফ জমে আছে! ওদের সোনালি চুল, নীল চোখ, আমারগুলোর কালো… লাল, নীল টুপি – বরফের উপর ওটুকুই তো রঙ।

(২)

কি অসম্ভব পাপহীন সকাল! প্রতিবন্ধী শিশুর মুখের মত।আমি ভাবলাম কি জানি হয়ত বরফ গলে গেছে। বাইরে ঘাসে পা ডুবিয়ে একটু হাঁটি। অনেক হলুদ রঙের ড্যানডিলাইন ফুটে আছে। শাদা, শাদা ক্লোভার। শিশিরে ভেজা পা নিয়ে কি করব ভাবছি, ঠিক তখন দেখি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলে তুমি। হঠাৎ। এমনও হয় নাকি? এবং এসেই কথা নেই বার্তা নেই, বলতে শুরু করে দিলে, ‘এমন বাচ্চা মেয়ের মত কাঁদছিস কেন রে, সোনামনি?’ আমি যে আসলে ঘরের দরজা বন্ধ করে সত্যিই ভীষণ রকম কাঁদছিলাম – তোমাকে কে যে সেই খবরটা দিল? অথচ এমন তো সকলেরই হয়। খুব ছেলেবেলায় স্বপ্ন থাকে। আর বড়বেলাতে -স্বপ্নের মরে যাওয়া। নতুন কোন গল্প তো নয়। বুকের কাছটা ব্যথা করে। গলার কাছটা ধরে আসে। বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করতে, করতে তারপর একসময় সবকিছু সয়ে যায়।

আমি হাঁটছি। একা। কেননা কাশফুলের ভিতর দিয়ে তোমার হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার মত ঠিক অতটা জায়গা নেই। জীবনের পথগুলো খুব চওড়া তো আর হয় না! তবু তুমি অকারণেই বলে চলেছ, ‘ছেলেবেলা ছাড়া আর কিছুই নেই আমাদের। একসাথে। তাই সেটুকু আর কিছুতেই ভোলা গেল না।কত বৃষ্টি হল তারপর – তবু!’ একবার শুধু দেখা হয়েছিলো। কি একটা অকাজে ব্যস্ত ছিলে তুমি। পাড়ার বন্ধুরা অপেক্ষা করছিলো, তোমারও যাবার তাড়া ছিল। কি জানি হয়ত কৃষ্ণচূড়ার খোদলে দোয়েলের বাসা খুঁজে পেয়েছিলে।বাসায় নতুন বাচ্চা, একটা না ফোটা ডিম। মা পাখিটা মারা গেছে। নতুন জীবনের নেশা মরণের থেকে সবসময়ই অনেক শক্তিশালী হয়।

এত দিন পর আবার তোমাকে দেখে ভীষণ হাসি পেল আমার। কি একটা চেহারা সত্যি! বড়,বড় চোখ। এলোমেলো চুল বাতাসে উড়ছে। শাদা স্যান্ডো গেঞ্জির কোচর ভরে শিউলি ফুল। হাফ প্যান্টটা হাঁটুর উপর। ধুলো ভর্তি খালি পা। দৌড়াচ্ছো। বাসাতে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। নয়ত ফুলগুলো শুকিয়ে যাবে। কি করবে অত্ত ফুল দিয়ে? ছেলেরা কি মালা গাঁথে, পুতুল খেলে, কিংবা রান্নাবাটি? কিন্তু তুমি আবার এমনই মেয়ে, মেয়ে ধরণের একটা ছেলে যে সব খেলে বসে আছ। দৌড়ে ফার্মগেটের কাছের ওই রেললাইনের কাছে যাচ্ছ। দশ পয়সা ছুঁড়ে দিয়েই ভোঁ দৌড়। আর ট্রেন চলে গেলেই জীবনের সব দশ পয়সাগুলো চ্যাপ্টা হয়ে গিয়ে রুপালি রাংতা। এক নম্বরের বোকা তুমি। কি করবে বলো তো ঐ সব ট্রেনের নীচে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া দশ পয়সাগুলো দিয়ে? ওই রাংতা দিয়েই কি মুকুট বানাবে নাকি আমার? সব বুঝি জমিয়ে রেখেছো – এই এত্ত দিন ধরে? হায় রে, কি ভাবে বোঝাই তোমায়, ছেলেদের এক্কেবারে ওমন হতে নেই। ছেলেদের পকেট ভর্তি থাকতে হয় ডাংগুলি, গুলতি, চকমকে তলোয়ার, এক কোপে যেন সব দৈত্য দানোদের মুন্ডু কেটে ধুন্ধুমার কান্ড বাধিঁয়ে দিতে পারে! তা না, গেঞ্জির কোচর ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়েছো। সারা ছেলেবেলা। পুরোটা জীবন।

এমন ছেলে দিয়ে কি করব আমি বলো তো?

একদম অকেজো।

(৩)

আমি হাঁটছি। কেবলই হাঁটছি। কেননা পথটা এমনই যে হাঁটলে ফুরাবে না। না হাঁটলেও ফুরাবে না।পৃথিবীটা সত্যি কত ছোট। তবু আমি যেখানে যেতে চাই, যাদের কাছে থাকতে চাই, সেই পথ ঈশ্বরের থেকেও অজানা। সেই পথ তাই কোনদিনই ফুরায় না।পথের পাশে শুধু পড়ে থাকে কিছু সবুজ রঙের ডোবা। শ্যাঁওলা পড়া জল। মরচে পড়া জল। মরুভূমির জল। সব না পাওয়া স্বপ্নের মত। যেন ওদের কোথাও যাওয়ার নেই। সবাই ওদের কেন যেন ভুলে গেছে। ওরা শুধু পড়ে থাকবার জন্য। জলে মরচে পড়ে নাকি জলই মরচে পড়ায়?

কিছু প্রশ্ন থাকে যার উত্তর হয় না। কিছু উত্তর থাকে যা মরলোকের মত শুধু ভাসতে থাকে। ঠিক ডোবাগুলোর জলের উপরে। এতটাই নীচে নেমে আসে যে মনে হয় হাতটা একটু বাড়ালেই হয়ত সব ছোঁয়া যাবে। তবু সব প্রশ্ন আর উত্তরগুলো ভুলে যাওয়া ছেলেবেলার গ্রামের পথে, শীত সন্ধ্যার ধোঁয়া হয়ে আজন্ম বেঁচে থাকে। কিছুই আর পাওয়া হয় না।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>