| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: সূর্যাস্তের দেশে । কণাদ বাগ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল নীতা।

বাবা বাবা দেখ, মা ফিরে এসেছে।

সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ীটার থেমে যাওয়া। মিস্টার দাসের ড্রাইভারের সিট থেকে দরজা খুলে ছিটকে বাইরে বেরোন। মুহুর্তের মধ্যে ডান দিকের পেছনের দরজা খুলে তার বছর ছয়েকের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। মিস্টার দাস মেয়েটার পিঠ চাপড়াচ্ছেন আর বলছেন না মা, না মা।

ডান কাঁধের ওপর দিয়ে মেয়েটার মুখ, সহেলি চা বাগানের চার্চের ম্যাড় ম্যাড়ে হলুদ সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোয় মেয়েটার বড় বড় চোখদুটো দেখা যায়। বাঁ হাতটা নীতার দিকে তুলে কি যেন বলছে মেয়েটা। মিস্টার দাস তাড়াতাড়ি রাস্তা ধরে চার্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্থির গাড়ীতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে নীতা এসব দেখে কি করবে ভেবে উঠতে না উঠতেই মিস্টার দাস মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফেরত এলেন। সোজা নীতার কাছে এসে মুখ নামিয়ে জানালা দিয়ে বললেন সরি ম্যাডাম কিছু মনে করবেন না। আপনি যদি পেছনের সিটে বসেন। হত চকিত নীতা বলল হ্যাঁ হ্যাঁ। মিস্টার দাস ততক্ষণে বাঁ হাত দিয়ে দরজা খুলে দিয়েছেন। নীতা বেরিয়ে এল। মিস্টার দাস মেয়েটাকে সামনের বাঁদিকের সিটে বসিয়ে বলেন বসো মা। তারপর নিজেই পেছনের দরজা খুলে নীতাকে বসতে বললেন। গাড়ী আবার চালু করার আগে সবকটা দরজাবন্ধ আছে কিনা ভাল করে দেখলেন। মেয়েটা পেছন ফিরে ফিরে কিরকম যেন অবাক চোখে নীতাকে দেখছে। বড্ড অস্বস্তি লাগছিল নীতার। গাড়ী চালু হবার সাথে সাথে অনর্গল কথা বলা শুরু হল মিস্টার দাসের। মা এই আন্টির নাম নীতা। নীতা মহাপাত্র। খুব বড় অফিসার। সবাই বলে বিডিও। বলো, গুড ইভনিং আন্টি। মেয়েটা কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। মিস্টার দাস বললেন বলো মা,বলো। মেয়েটা অস্ফুট স্বরে বলল গুড ইভনিং আন্টি। সহেলি চা বাগানের হাটতলা পেরলেই জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের শুরু। পাহাড় জঙ্গল চিরে বয়ে চলা চেলিন নদীর কোল ঘেঁসে ছোট্ট জনপদ ভুট্টাবাজার। সে জনপদে বেশ কয়েকটা সরকারী অফিস। বন, রেশম, সেচ, বিএলআরও আর বিডিও। অফিস লাগোয়া নীতার কোয়ার্টারের সামনে এসে গাড়ী দাঁড় করিয়ে স্টার্ট না থামিয়েই মিস্টার দাস বললেন, মা বলো- গুড নাইট আন্টি। মেয়েটা বলল, গুড নাইট আন্টি। নীতা গাড়ী থেকে নামতে না নামতেই মিস্টার দাস বললেন, চলি ম্যাডাম আজ রাত হয়ে গেছে, অন্য একদিন আসব, চা খেয়ে যাব আপনার বাড়ীতে। নীতা শুধু বলতে পেরেছিল আসবেন কিন্তু। থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্যা লিফট। উত্তর ভেসে এল আরে কি যে বলেন, চলি, গুড নাইট।

মেয়েটা কেন বলল, বাবা বাবা দেখ মা ফিরে এসেছে। তাহলে ওর মা কোথায়। কত দিন নেই ওর সাথে। কেন নেই। ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে কি। নীতার খেয়াল হল পুরো রাস্তাটা মিস্টার দাস এক হাতে গাড়ী চালালেন। ফাঁকা রাস্তায় মাঝে মধ্যে গিয়ার বদল করা ছাড়া বাঁ হাতে সব সময় ধরে ছিলেন মেয়েটা ডান হাত।

বনবস্তিতে ফুলঝাড়ু তৈরী করে এক সেলফ হেল্প গ্রুপের সাথে মিটিং করে ফেরার পথে নিলামগঞ্জ গেছিল নীতা। টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস কিনতে। নিলামগঞ্জ এ অঞ্চলের সব থেকে বর্ধিষ্ণু জনপদ। রেল স্টেশান, জাতীয় সড়ক। সুপারী আর চাপাতার নিলাম ঘর। চা কারখানা, চা বাগান বাবুদের ক্লাব। হাসপাতাল আর কনভেন্ট স্কুল। কেনাকাটি সেরে ফেরার সময় বেশ কয়েকবার স্টার্ট দেবার চেষ্টা করে না পেরে ড্রাইভার দাজু ঘোষনা করল, কি করি ম্যাডাম গাড়ী তো স্টার্টই হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না কি হল। তিরিশ বছরের পুরান সরকারী জিপ নিয়ে বিড়ম্বনা। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে এল। এখান থেকে ভুট্টাবাজার বিশ মাইল। জঙ্গল পাহাড়ের রাস্তা। হাতে চাঁদ পাবার মত মিস্টার দাসের গাড়ীতে লিফট পেয়েছিল নীতা। গাড়ীর ভেতরে চোখ পড়তে একটু অবাক হয়ে ছিল। পেছনের সিটে স্কুল ইউনির্ফম পরে ঘুমিয়ে রয়েছে বছর ছয়েকের একটা মেয়ে। মাথার কাছে রাখা ব্যাগে লেখা সির্জাস্‌ কনভেন্ট স্কুল। উঁকি দিচ্ছে জলের বোতল। পাশে ক্লিপ বোর্ডে লটকান আর্ট পেপারে চিরসুন্দর ছবি। পাহাড়, নদী, গাছ, সূর্য্য। শিশুর সরল আঁচড়ের ওপর কেমন যেন বিষন্নতার রং। কালচে লাল রঙে আঁকা সূর্য্যাস্তের ছবি। খুব সাবধানে দরজা খুলে সামনের বাঁদিকের সিটে নীতাকে বসতে বললেন মিস্টার দাস। ড্রাইভার দাজু বলল রাতটা নিলামগঞ্জে আত্মীয় বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে গাড়ী ঠিক করে ভুট্টাবাড়ী ফিরবে।

ভুট্টাবাড়ীর বিডিও হয়ে মাসখানেক হল এসেছে নীতা। বিশেষ কারও সাথেই পরিচয় হয় নি। স্বল্প পরিচিত বা অপরিচিতের থেকে লিফট নীতা আগে যে নেয় নি এমন নয়। তবে সন্ধ্যের পর জঙ্গলের রাস্তায় যেতে হবে। কেমন যেন মনে হচ্ছে কাজটা করা কি ঠিক হল। হাত দেখিয়ে গাড়ী থমিয়ে ড্রাইভার দাজু পরিচয় করিয়ে দিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক ফরেস্ট রেঞ্জার। সুঠাম চেহারা। বয়স মধ্য তিরিশ। গাড়ী ছাড়ার পর থেকে কোন কথা বলেন নি। গাড়ী চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে গলা উঁচু করে আয়নায় মেয়েটাকে দেখছিলেন। মেয়েটার কি শরীর খারাপ। জ্বর হয়েছে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল নীতার। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা এল। সহেলি চা বাগানের চার্চের আলো দেখা যায়। শনিবার শনিবার হাট বসে সহেলি চা বাগানে। আজ তো শনিবার। এতক্ষণে নিশ্চয়ই হাট ভেঁঙ্গে গেছে। সহেলি চা বাগান পেরিয়ে শুরু হবে জঙ্গল। এবার সত্যিই নীতার একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আর তারপরই সহেলি চা বাগানের চার্চের কাছে সেই শব্দগুলো, বাবা বাবা দেখ। এরপর মিস্টার দাসের অনর্গল কথা বলে যাওয়া। ঝড়ের বেগে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে একদন্ড অপেক্ষা না করে চলে যাওয়া।

বিছানায় শুয়ে শব্দগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল নীতা। বাবা বাবা দেখ, মা ফেরত এসেছে।

শব্দগুলো নাড়াচাড়া শুরু করল নীতাকে নিয়ে।

বোটানিতে MSc পড়তে ঢুকেই WBCSএ চান্স পাওয়া। সল্টলেক আর শালবনীতে ট্রেনিং। দার্জিলিং এ ডি এম অফিসে পোস্টিং। শিলিগুড়ী আর দার্জিলিংএ কাজ শেখা। চাকরির দু‘বছরের মাথায় ভুট্টাবাজারের বিডিও হয়ে আসা। পাহাড় চা বাগান নদী জঙ্গল বনবস্তি, দূর্গম এ জায়গায় একটা মেয়ের প্রথম পোস্টিং। সবাই বলেছিল পোস্টিং বদল করার জন্য দরবার করতে। নীতা করে নি। বাবা পৌঁছে দিয়ে বলেছিল সাবধানে থাকিস। জানালা দিয়ে নিয়ন আলোর ঝলক। পাহাড় টপকে পূর্নিমার চাঁদ উঠল। এত পরিষ্কার চাঁদের আলো এখানে, নীতার মনে হয় বই পড়া যাবে। চাঁদের সিলুয়েটে পাহাড় গাছ। দার্জিলিং, শিলিগুড়ি থাকতে অনেক পাহাড়ী জায়গা দেখেছে নীতা। মিরিক, কার্শিয়ং, কালিম্পং, লাভা, লোলেগাঁও। সরকারী কাজে। আর সপ্তাহান্তের ছুটিতে অভিষেকের সাথে। স্কুলে থাকতেই অভিষেকের সাথে পরিচয়। তারপর অভি পড়তে গেল যাদবপুরে। খুব ভাল ছাত্র ছিল অভি। ও যখন থার্ড ইয়ারে তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে নীতার চাকরি পাওয়া। কলেজের শেষ বছরে অভিষেক মাঝে মধ্যেই চলে আসত নীতার কাছে।

এরকমই এক পূর্নিমার রাতে শিলিগুড়ির কাছে দুধিয়ায়, বালাসন নদীর পাড়ে এক টুরিস্ট লজে নীতা অভিষেককে বলেছিল – আমাদের বিয়ে করতে হবে। অভিষেক হাসতে হাসতে বলেছিল– হ্যাঁ। সে তো করতেই হবে। নীতা বলেছিল, না অভি আমাদের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হবে। অভিষেক থমকে গিয়ে বলে – কেন? নীতা অভিষেকের দুটো হাত ধরে বলে আমি মা হতে চলেছি। অভিষেক ধপ করে বসে পড়েছিল বিছানায়। আমতা আমতা করে বলেছিল, কিন্তু এখন বিয়ে। কি করে সম্ভব। কাল বাদ পরশু আমার ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ। জানি না চাকরি পাব কিনা। পেলে কোথায় পাব। শান্ত গলায় নীতা বলেছিল – তাতে কি। আমি তো চাকরি করি। তোমায় ভাবতে হবে না তুমি নিশ্চিন্তে কেরিয়ার তৈরি করো। কোন অসুবিধা হবে না। ততক্ষণে অভিষেক অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে। বলতে থাকে – কিন্তু বেকার অবস্থায় বিয়ে করা, তাছাড়া যদি চাকরি নিয়ে বাইরে কোথাও যেতে হয়। মানে বিদেশে আর কি। বাড়িতে বলার ব্যাপারটাও আছে। এভাবে এত তাড়াতাড়ি। মানে আমরা একটু অন্য রকম ভাবে যদি চিন্তা করি…।

নীতা অভিষেকের চোখের দিকে তাকাল। স্কুলে বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিল নীতা। ওর মাথার মধ্যে কোর্টে বল বাউন্সের ডুপ ডুপ ডুপ ডুপ শব্দটা বাজতে লাগল। মন বলল এ পারবে না এ হেরে বসে আছে এ পালিয়ে যাচ্ছে। অভিষেক বলে চলে – না মানে আমরা আমাদের বিয়ে, আমাদের ফ্যামিলি, আর কিছুদিন, মানে আর কয়েকটা বছর পর, আমরা প্ল্যান করতে পারি। এবারে আমরা মানে, ডাক্তারের সাথে কথা বলে। মানে এসব তো এখন খুবই সেফ। মানে আমি বলছিলাম, কথাটা অভিষেকের মুখ থেকে স্ন্যাচ করে শান্ত গলায় নীতা বলল – ঠিক আছে আমি দেখছি। পরদিন অভিষেক কলকাতা চলে গেল। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ থেকে চাকরি। তেরো নদী পেরিয়ে দক্ষিণে। নীতা ঠিক করে ফেলেছিল ও মা হবে। তারপর দেখা যাবে। কোর্ট ছেড়ে চলে আসে নি কোন দিন।

শিলিগুড়িতে একদিন সকালে অসহ্য পেটের ব্যাথায় ঘুম ভাঁঙল। আঁতকে উঠে ছিল নীতা রক্ত রক্ত রক্ত। রক্ত আর থামেই না। দুপুরে পিং পং বলের মত একটা কালচে রক্তের ডেলা দেখল নীতা। কমে এল রক্ত পড়া, কমে গেল ব্যাথা। নিজেই গেছিল গাইনোকোলজিস্টের কাছে। ডাক্তার দিদি সব শুনে আলট্রা সাউন্ড করলেন। বললেন নেই। নীতা জানত নেই। সে রাতেই এক নার্সিংহোমে সাফসুতরো হয়েছিল নীতা। ঘুমের ওষুধের ঘোরে জানালা দিয়ে দেখেছিল পূর্ণিমার চাঁদ কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের ওপর। তেরো নদীর ওপারে খবরটা অভিষেককে দিয়েছিল নীতা। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস শুনেছিল। তখন ফোন আসত ঘন ঘন, ইমেল আসত লম্বা লম্বা। নীতা শুধু শুনত, কিছু বলত না। শুধু পড়ত কিছু লিখত না। ভৌগোলিক দূরত্ব  সাথে নীরবতা। অভিকে দোষ দেয় না নীতা। সবার দ্বারা সব কিছু হয় না। সবাই সব কিছু পারে না। আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকল শব্দ ঝাপসা হতে থাকল অক্ষর।

শেষ ইমেলটা এসেছিল ভুট্টাবাজারে পোস্টিং অর্ডার পাবার ঠিক আগে। তেরো নদী পেরিয়ে সাতসমুদ্দুরের ওপার থেকে। সঙ্গে একটা অ্যাটাচমেন্ট ছিল, ছবি। ঝাঁ চকচকে নতুন অফিসে সুসজ্জিত ঝকঝকে সহকর্মীদের মাঝে অভিষেক। লাগছিল বেশ। মনে দাগ না কাটা বিজ্ঞাপনের ছবি। আর শেষ ফোনটা এসেছিল কবে, ঠিক মনে পড়ে না। বাবার সাথে শিলিগুড়ি থেকে মালপত্র নিয়ে ভুট্টাবাড়ি আসার রাস্তায় ফোন থেকে সিম কার্ডটা খুলে ও তিস্তার জলে ফেলে দিয়ে নতুন সিমকার্ড ভরেছিল। বাবাকে নম্বরটা দিয়ে বলেছিল তোমায় দিলাম কাউকে দেবে না। শান্ত গলায় আবার বলেছিল কাউকে না। কলিং বেলের শব্দে চমক ভাঁঙল ভোর হয়ে গেছে নুরজাহান মাসি এল। মাসির যত হাত চলে তত মুখ। অনবরত কথা বলে যায়। রাতের খাবার পড়ে আছে দেখে খুব বকাবকি করল। আজ রবিবার অফিস যেতে হবে না।  মা-বাবার সাথে অনেক্ষণ কথা হল। বিকালের আলো থাকতে থাকতে ড্রাইভার দাজু এল গাড়ি সারিয়ে। নীতা বলল দাজু একটু ফরেস্ট বাংলোয় চলুন তো।

পাহাড়ের ঢালে ফরেস্ট বাংলো, লাগোয়া অফিস, অদূরে রেঞ্জার সাহেবের কোয়ার্টার। আসে পাশে ফরেস্ট গার্ডদের থাকার জায়গা। কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে হুটোপুটি করছে। ইতস্তত কয়েকজন মহিলা বিভিন্ন সাংসারিক কাজে ব্যস্ত। একটা ঝোরা এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে। যেন ঝুলনে সাজান খেলনা। ফরেস্ট অফিসের সামনে গাড়ী দাঁড় করাতেই এক মাঝ বয়সী লোক এসে প্রথমে নীতাকে পরে ড্রাইভার দাজুকে নমস্কার করল। ড্রাইভার দাজু বলল এ রেঞ্জার সাহেবের গাড়ি চালাত, এখন বসে বসে মাইনে খায়। লোকটা হেসে বলল কি করব বলুন সাহেব নিজে গাড়ি চালাতে এতো ভালবাসেন। লোকটা বলল সাহেবের সাথে দেখা করবেন। সাহেব তো অফিসেই আছেন। রবিবার দিনও সাহেব অফিসে আসেন। হ্যাঁ ছুটির দিন বিকালে সাহেব একবার করে অফিসে আসেন। কথা বার্তার মাঝে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন রেঞ্জার মিস্টার দাস। নীতাকে নমস্কার করে বললেন আরে আরে আসুন। অফিসে বসে নীতা বলল, গতকাল আপনার তাড়া ছিল ভাবলাম আজ এসে আপনাকে নেমতন্ন করে যাই। আপনার স্ত্রী বোধ হয় এখন এখানে নেই এলে একবার যাবেন সবাই মিলে আমার কোয়ার্টারে। একসাথে একটু চা খাব আমরা সকলে। আপনার মেয়ের নামটা জানা হয়নি। মিস্টার দাস বলেন, অনিতা। হেসে ফেলে নীতা।

তা ও কি করছে এখন?

মিস্টার দাস বললেন, সানসেট পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখছে।

নীতা সেটা কোথায়? মিস্টার দাস হাসেন।

আমার কোয়ার্টারের সামনে থেকেই খুব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়। দেখবেন চলুন।

কয়েক পা চলার পর নীতা কথাটা আর না বলে পারল না, আপনার স্ত্রী কি বাপের বাড়ি।

দাঁড়িয়ে পড়লেন মিস্টার দাস। সোজা তাকালেন নীতার চোখের দিকে। চমকে উঠল নীতা। স্পষ্ট স্বর ভেসে এল আমাদের অফিসিয়াল সেপারেশান হয়ে গেছে মাস তিনেক হল।

অনিতা জানে ওর মা দাদু দিদার কাছে গেছে। শিগগিরি চলে আসবে। আমি চাই না এক্ষুনি ও সব কিছু জানুক। তারপর চোখ নামিয়ে বললেন, বলতে তো একদিন হবেই। দেখি কখন বলা যায়। কিভাবে বলা যায়।

নীতা বলে ওঠে সরি।

আসলে কালকের ঘটনাটা। মিস্টার দাস বলেন, হ্যাঁ এখানে এখনও আমি কাউকে বলিনি। কানা ঘুসো অনেকে অনেক কথা বলে। নতুন এসেছেন তাই এখনও আপনার কানে যায় নি।  আপনাকে কেন জানি বলে ফেললাম।

চিন্তা করবেন না আমার কাছ থেকে কেউ জানবে না। 

চলুন সূর্য্যাস্ত দেখবেন। মিস্টার দাসের কোয়ার্টারের সামনে এক চিলতে জমির ওপর একটা চ্যাপ্টা পাথরে বসে অনিতা। নীচে চেলিন নদী। ওপারে ফাগুন পাহাড়। ওর সেই রক্তের ডেলার মত সূর্য্য, নদী পাহাড় জঙ্গল ছাপিয়ে শুধুই রক্ত রক্ত আর রক্ত।

পায়ের শব্দে অনিতা পেছন ফিরে তাকাল। নীতা বলল আমার নাম নীতা। মেয়েটা কেমন যেন ভয় পেয়ে বাবার পা জড়িয়ে ধরলো। মিস্টার দাস মেয়েটার বাঁ পাশে বসে বললেন মা আন্টিকে বসতে বলবে না। মেয়েটা মিস্টার দাসকে জড়িয়ে ধরে নীতার দিকে তাকাল।

মিস্টার দাস বললেন বসুন ম্যাডাম। অনিতার পাশে বসে নীতা বলল, তোমার বুঝি সূর্যাস্ত দেখতে খুব ভাল লাগে। মেয়েটা ভয়ে ভয়ে বলল, এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। নীতা বলল, তোমার আর কি ভাল লাগে। চকলেট খেতে ভাল লাগে। মেয়েটা বাবাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ল। না। তাহলে তোমার কি খেতে ভাল লাগে। ক্রিম বিস্কুট, চানাচুর, মোমো। মেয়েটা ফাগুন পাহাড়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, বাবা বলেছে- একদিন ওই পাহাড়ে নিয়ে যাবে। ওখান থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়। বাবা বলেছে, ওখানে খুব ভালো থুকপা পাওয়া যায়। দুই আধিকারীক ও এক শিশু ফাগুন পাহাড়ে সূর্যোদয় আর থুকপা নিয়ে আলোচনা শুরু করল।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত