| 27 নভেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: বাসন্তী অপেক্ষা । কৃষ্ণা রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

 

করোনা, করোনা  আর করোনা, ভাল্লাগেনা সারাদিন বাড়িতে… মা, ওমা!  পুজোর ড্রেস কিনতে কিন্তু এবার আমি দোকানে  যাবই। আগের বার  আমার একটা মোটে জামা  হয়েছছিল

বিকেল থেকে পুপাইটা  ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছে। ওর আর দোষ কি? বেচারা! সারাদিন অন লাইন ক্লাস  করে করে  হাঁপিয়ে উঠেছে।  কিন্তু যাব বললেই তো যাওয়া যায়না। সীমন্তী নিরুপায়। ঘরে রুগ্ন শ্বশুর। দিনরাতের আয়াটা পাঁচ দিন ধরে কামাই করছে রোজই বলে কাল আসছি।  অফিসে  এখন রোজ  যেতে হচ্ছেনা, এই রক্ষে। তা বলে বাড়ির কাজ কি কম?  পাশের ফ্ল্যাটের অজয়বাবু আবার তার মেয়ে পিউকে সীমন্তীর  জিম্মায় রেখে  সস্ত্রীক পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছেন। সীমন্তীর  শ্বশুরমশাই অনেকদিন অসুস্থ, বিছানা-বন্দী।  শাশুড়ি মারা গেছেন বছর সাতেক  আগে।   পিউ  মেয়েটি বেশ চঞ্চল। পুপাইএর  সঙ্গে তার বেজায় বন্ধুত্ব। এবারে নাকি তার আটটা ড্রেস হবে। সেই শুনে পুপাই আরো ক্ষেপে উঠেছে। সীমন্তী এত প্রশ্রয় দিতে চায়না ছেলেকে। যার বাবা নেই, তার অত বিলাসিতা হবে কেন? চার বছর আগে ক্যান্সারে ভুগে সঞ্জয় চলে গেছে।  সংসার চালাতে হয় টেনেটুনে । শ্বশুরের পেন্সান আর কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ডে পাওয়া  তার  কলেজে  ক্লার্কের চাকরি , এই দিয়ে অত বিলাসিতা করা যাবেনা। পিউর বাবা –মা দুজনেই ভাল চাকরি করেন। পুপাই অবশ্য এসব বোঝেনা, মাথাও ঘামায় না। অনেক ভেবে সীমন্তী ঠিক করেছে,   গোটা তিনেক পাজামা-পাঞ্জাবি  করাবে।  একটু বড় ঝুলের। বছর দুয়েক চলবে হয়তো। ছেলেটা ধাঁ ধাঁ করে লম্বা হচ্ছে।   পিউর বাবা –মা আজ দক্ষিণ কলকাতার এক নামি টেলারিং শপে  নাম লেখাতে গেছেন,  তারা ডিসাইনার ড্রেস কম খরচে ভালই করেন । ডিসাইনের খুঁটিনাটি লিখে ফর্ম ফিল আপ করে টাকা   অ্যাডভ্যান্স  করতে হয়। তাহলেও যে সব জামা হবে এমন গ্যারান্টি নেই। সেটা জানা যাবে এক সপ্তাহ বাদে। পিউর মা  মৌমিতা   মা বেশ আধুনিক, অন্তত পোষাক-পারিপাট্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। মেয়েকে নতুন ধরণের জামা পরানোটা তার একটা বিশেষ শখ, সীমন্তীর  মতে  অবশ্য অবশেসন। সে যাক, প্রতিবেশি হিসেবে মেয়েটাকে  কিছুক্ষন রাখতেই হবে, পুপাইও একটু সংগ পাচ্ছে।  মন্দ কি?  পিউ  বেশ কলকল করে কথা বলে, স্কুলের  দিদিমণিদের খুঁটিনাটি কী চমৎকার করে গল্প করে।   ওর মা  অবশ্য বলে ও কিন্তু খুব বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে, সব কথা ধরবেন না। সীমন্তী  বুঝতে পারে মেয়েটার একটা বিশাল কল্পনার জগত আছে। তা ভালই লাগে  ওর সঙ্গে আগডুম বাগডুম কিছুক্ষণ  গল্প করতে।  

রাত ন’টা নাগাদ পিউর মা –বাবা ফিরল।  খুশিতে উদ্ভাসিত মুখ।  সীমন্তী বোঝে  ভালই বাজার-হাট হয়েছে। । ওদের খুশিতে সীমন্তীর কী যে হল! সেও আবেগ তাড়িত হয়ে বলে ফেলল, , বা!   তাহলে এবারে পিউ সব ড্রেস আজ পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু  এর মধ্যে  আমারটা ধরা নেই তাই তো?… পিউ,  তোমার ভাল  ফিটিংস এর একটা জামা কিন্তু আমায় দু’এক দিনের মধ্যে দিও। মৌমিতা হাসল, আবার আপনি কেন? সঞ্জয়বাবু থাকতে দিয়েছেন, এখন কি আর… তাছাড়া ও তেমন ছোট তো নেই। এই তো এত হচ্ছে। পিউ মা-কে চোখ পাকিয়ে বলল,  সীমু-আন্টি  আমায় দেবে বলেছে,  নেবনা কেন?  সীমন্তীকে  সীমু-আন্টি  বলে ডাকতে পিউর মা-ই  শিখিয়েছে।  হাসি মুখে গুড নাইট বলে পিউ টা-টা করে চলে গেল। দরজা বন্ধ করতে  সীমন্তী ভাবে, মেয়েটাকে একটা বাসন্তীরঙা ফ্রক দেবে। যেমন সে নিজে পরতে চেয়েছিল  কতকাল আগে।সীমন্তীর  মেয়ে নেই, তাই এসব শখ মেটেনি। আপন মনে  হাসে, সে কি  এখন পিউকে দিয়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে চাইছে? না,  তাই বা  কেন? পিউটা খুব মায়া কাড়তে জানে।  রক্তের  সম্পর্কই  কি সব নাকি?

 

যাব যাব করে সাতদিন কেটে গেছে সীমন্তীর। পিউর  জামার মাপ নিয়েছে, কেনা হয়ে ওঠেনি। আসলে ভেবেছিল, এবারে সেও পিউর মায়ের মত একটা নিজের পছন্দের ডিজাইন দেওয়া  ফিটিংস জামা দর্জিকে দিয়ে বানাবে।  পাড়ার  বহু চেনা  সাবিত্রী  টেলারিঙে খোঁজ করল। সঞ্জয় বেঁচে থাকতে ওদের কাছে কত ব্লাউস বানিয়েছে।  ওরা দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, বৌদি একটু দেরি করে ফেলেছেন, আর তিন দিন আগে হলেও—

অগত্যা,  কলেজের  সামনে  ঝুমঝুমি আউট –ফিটে” ঢুঁ মারল সীমন্তী। রিসেপ্সনের অল্পবয়সী ছেলেটি   খুব খাতির করে অভ্যর্থনা জানিয়ে  প্রশ্ন করল, কটা ব্লাউজ? সালোয়ার কামিজ ক’টা সেট?  সীমন্তী মিন মিন করে, না ইয়ে, একটাই, একটা বাচ্ছা মেয়ের জামা, কথা দিয়ে ফেলেছি। ছেলেটি সৌজন্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে একই রকম গলায় বলল, স্যরি ম্যাডাম , আমার এবার বাল্ক অর্ডার ছাড়া  নিচ্ছিনা। বেটার নেক্সট টাইম। অফিস আর বাড়ির পথে আরো কয়েকটা দোকানে চেষ্টা করল। কোথাও কেউ রাজি নয়।  পরিচিত সহকর্মীদের কাছে সাজেসন চাইতে , সবাই এক বাক্যে বলল, সীমন্তী, ওসব প্ল্যান ছেড়ে মেয়েটাকে রেডিমেড জামা কিনে দিন। পুজোর আর তিন সপ্তাহ বাকি, কেউ নেবেনা অর্ডার,  তাছাড়া বাচ্ছাদের মরডান লুকের ফ্রক মানেই  প্রচুর ঘোটেলা কেস।  যেচে ঝামেলা নিচ্ছেন কেন?  দোকানে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ওর পছন্দ মত জামা কিনে দিন, কেস সল্ভড। 

কত সহজে সবাই সব কিছুর সমাধান করে দেয়। বাস্তব সম্মত  পরামর্শ ই হয়তো  দিচ্ছে। কিন্তু কী করে ওদের বলব, জামাটা শুধু পিউ  পরবেনা , পরবে  অনেক ঝাপসা ঝাপসা দিনের  পেছনে অপেক্ষায় থাকা,  আরেকটা ছোট্ট মেয়ে, যে জামাটা আজ অবধি তার পরা হয়ে ওঠেনি।

দিলীপদা এসেছে, দিলীপদা এসেছে। রোববারের সকালে খুশির ছটা। বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য পাড়ার সব বাড়ির  একতলার বারান্দার রেলিং ঘিরে মাঞ্জা দিচ্ছে  কাকুরা, বড়দাদারা। প্যানডেলের বাঁশ, ত্রিপল এই এল বলে। ভোর রাত থেকে বাঁশ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাবে, আর  কী ভালই না লাগত তখন। এর মধ্যে   বিশ্বকর্মা পুজোর  দুদিন আগেই দিলীলপদা এসে গেছে।   ছোট মেয়েরা সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।  মা কাকিমা, পিসি, জ্যাঠাইমা সবাই জড়ো হয়েছে। সীমন্তীদের মস্ত জয়েন্ট ফ্যামিলি। একটু সেকেলে ধাঁচের আবহাওয়া বাড়ির চারদিকে অহরহ  ছায়া ফেলত। খাওয়া, পরা সবই যুগের মাপে বড্ড পুরোনো গন্ধী। একই রকম  ছিট কাপড়ে সব বোনেদের জামা হোত।   সারাদিনে- রাতে মিলে বিয়াল্লিশ খানা পাত পড়ত। দিলীপদার কানে পেন্সিল, গলায় জড়ানো মাপ নেওয়ার লম্বা  ফিতে, হাতে ছোট্ট নোটবুক। তার মধ্যেই ঢুকে যাবে সীমন্তীদের প্রাণ ভোমরার খুঁটনাটি। ঘটি হাতা  ফ্রক না, মেগিয়া হাতা?  হাতা ছাড়া ফ্রক, লো কাট ফ্রক , ডিপ নেক কাট,  এক কাটের ফ্রক , গলার   কাছে ঘন ফ্রিল  দেওয়া ফ্রক… কত রকমারি বায়না। এর মধ্যে সদ্য বিয়ে হয়ে আসা কোন নতুন কাকিমা হালে দেখা  সিনেমার নায়িকার ছাঁদে  ফ্যাশনেবল জামার আবদার করছেন, রাগী মিত্র  জেঠিমা তার বড় মেয়ের জন্য গলা বন্ধ জামার হুকুম দিচ্ছেন। রাখালদা অবিচলিত, সবার সব বায়না টুকে রাখছেন। মুখ জোড়া হাসি। সব্বার সব জামা এসে যাবে, এই ধরুন,  মহালয়া থেকে ষষ্ঠী, না না, কথা এক্কেবারে পাক্কা।  কারুর ডেট তৃতীয়া তো, কারুর পঞ্চমী। কাকীমারা কে কেউ  রাগ রাগ গলায় সাবধান করেন, নিচ্ছ তো এক গাদা অর্ডার, পারবে কথা রাখতে?  প্রতিবার তো এক স্তোকবাক্য আওড়াও। বাচ্ছাগুলো হাঁ করে বসে থাকে। নবমী অব্দি পেরিয়ে যায়… নেহাত তোমার হাতের কাজ ভাল তাই… না হলে কি ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয়। গোলগাল মোটাসোটা দিলীপদার এসব কটু বাক্যে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হোতনা।  কান ছোঁয়া হাসি ছড়িয়ে  চলে  যেত, পেছন পেছন সীমন্তীরা সমস্বরে চেঁচাত, আমারটা আগে, কিংবা  আমার ঘ্টি হাতা ফ্রকটা কিন্তু ষষ্ঠীর দিনের জন্য। দিলীপদা, প্লিজ,  আমার অষ্টমীর জামায় লেস একটু বেশি লাগিও।  কাকিমারা  সামনা সামনি রাগ দেখালেও, দিলীপদা চলে যাওয়ার পর একবাক্যে বলতেন, এত সস্তায় এ তল্লাটে কে আর এমন দর্জি আছে? আমরাও না হয় একটু মানিয়ে নেব।

একেকবার এক একটা বাড়ির জামা  সব জামা আসত না। ষষ্ঠী, সপ্তমী, সব পেরিয়ে যায়, দিলীপদা সে বাড়ির পথ মাড়ায়না, রাস্তায় ধরা পড়লে হাসি মুখে বলত, আরে জামা রেডিতো, শুধু এই বোতামটা, কিংবা এই তো গলার হেম সেলাই দেওয়ার কাজ চলছে । তবে যাই ঘটুক , অষ্টমীতে অবশ্য সবার সব অর্ডার মাফিক জামা এসে  যেত। নবমীতে দোকান বন্ধ করে দিলীপদা বাঁকুড়ায় দেশের বাড়ি চলে যেত ।  তখন সীমন্তী   ক্লাস ফাইভ।  নতুন কাকার বিয়ে উপলক্ষে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে তার জন্য উজ্জ্বল বাসন্তী রঙের  একটা সিল্কের পিস পাঠিয়েছে।  মা , ফুল কাকিমা, নতুন কাকিমা সবাই অনেক গবেষণা করে দারুণ ডিজাইন দিয়েছে।দিলীপদা আশ্বাস দিয়েছে, চিন্তা নেই,  সীমু -মামণির জন্য এই জামাটা হবে আমার এবারের মাস্টার পিস।দিলীপদা  সব ছোটদের নামের  সঙ্গে  মামনি যোগ করে খুব স্নেহ ভরে ডাকতেন। সারা পাড়ার বন্ধুরা, সারা ক্লাশএর মেয়েরা সবাই জেনে গেল , সীমন্তীর এবার  একটা দারুণ জামা হচ্ছে।  ওটা একবার মাকে  লুকিয়ে  ষষ্ঠীর  দিন চুপি চুপি পরে নেবে , তারপর অষ্টমীর রাতে…  সবাই বলে তার  গায়ের রঙ ফরসা মাখনের মত, মুখখানা না কি ভারি টুলটুলে।  সীমন্তীদের বাড়ির পাশের গলির ছয় নম্বর বাড়ির নান্টুদা একদিন আমার গাল টিপে  বলেছে, সীমুরে তোকে বড় হলে যা দেখতে হবেনা! ওই জামাটা পরে  ওকে  ভাল করে দেখাতে হবে।দেখতে দেখতে  সবার বাড়ি জামা আসা শুরু হল। সীমন্তীর সেবারে মোটে দুটো জামা হবে,  একটা প্রতিবারের মত পিসিমার নিজের হাতে বানানো ফ্রক, যা দেখে বন্ধুরা মুখ ভেংচে বলতে, নাই ছিরি নাই ছাঁদ,  সীমির  জামা বরবাদ। অন্যটা বাবার দেওয়া। বাবার ওপর সারা সংসারের ভার, অতএব সবার ভাগ্যে যা বরাদ্দ, আমার জন্য তাই, একটি সুতির ঘটি হাতা ফ্রক। সীমন্তীর  মামার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়, কখনো জামা কাপড় দিতে পারেনা। এক মাত্র নতুন কাকা বছরে একবার দামি ফ্রক দেয়। সেবারে খুব হাকোবা চিকণের জামা উঠেছে।   কিন্তু বিয়ের পর  নতুন কাকার অবস্থা নাকি টানটান, নতুন শ্বশুর বাড়ির জন্য অনেক কিছু কিনতে হবে। অতএব, মায়ের যুক্তি ওইতো ওদের বাড়ি  থেকে পাঠানো সিল্কের পিসটাই তোর নতুন কাকার দেওয়া হল।   ঘটি ফ্রক মহালয়ার দিন বাড়িতে এসে গেল।  দিলীপদা, অন্যটা? দিলীপ্দার মুখে   স্বাভাবিক প্রসন্ন  হাসি, হবেরে মা, ভাল জামার খাটনি আছে। সবুর কর।  

সপ্তমী পেরিয়ে গেল, অষ্টমীর দুপুর পেরিয়ে  বিকেল মরে আসছে, সীমন্তীর ম্লান মুখ দেখে বাবা সবয়ং ফিল্ডে নামল। সন্ধি পুজো হয়ে গেল,  তখনো  সে ঘটি হাতায় আটকে। বাড়ির আর সবার অর্ডারি জামা এসে গেছে। শুধু তারতাই বাদ। বন্ধুদের কেউ কেউ সমবেদনা জানাল, পাবি , ঠিক পাবি, কাল পরবি। আজ সবাই পরেছে, কাল সবাই তোকে দেখবে। অনেক রাতে বাবা বাড়ি ফিরল বিরক্ত মুখে, মা-কে বল্ল, কী নাকি কাপড়  কাটাকাটিতে ভুল হয়েছে। এত ভজকট ডিজাইন দাও কেন?

মা ভিতু গলায় বলল, কাল তো নউমি, দিলীপ বাড়ি চলে যাবে।

বাবা আরো বিরক্ত,  তোমার মেয়ের সাধের জামা  খুব ভোরে এ বাড়িতে পৌঁছে তিনি নাকি ট্রেন ধরবেন। 

সারা রাত ঘুম এলোনা। ভোর হল, পাড়ার পুজোয় ঢাক বাজা শুরু হল। চান করে সবাই পুজোর ডালা নিয়ে মন্ডপের দিকে যাচ্ছে ।  বাজার যাওয়ার জন্য বাবাকে রেডি হতে দেখে সীমন্তী  অস্থির, বাবা তোমার সঙ্গে যাই…

দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিল সীমন্তী দিলীপদার দোকান খোলা,  নিশ্চিন্ত হয় সে, এবার জামাটা  ঠিক পাবে।   একটু কাছে আসতেই দেখতে পেল, দোকানের সামনে বহু লোকের জটলা। ভেতরে ডাঁই করা কাটা কাপড়ের স্তুপ। দিলীপদার দোকানের দুই কর্মচারী ক্যাশ বাক্স ভেঙে পালিয়ে গেছে।  দিলীপদা কপালে  হাত রেখে  মাথা নামিয়ে বসে আছে, আর দুরন্ত গালাগালির ফুলকিতে  ছোট্ট দোকান ঘরে ঘনঘন কথার  বাজ পড়ছে। বাবা বলল, ঠগ, জোচ্চর, ভণ্ড, বাচ্ছাদের ঠকাতে লজ্জা করে না? আরো কত কি কথা…  বাবার হাত ধরে নিঃশব্দে বাড়ি ফিরলা সীমন্তী। তার দশ বছরের জীবনে এত দুঃখ আর কখনো পায়নি। বাকি পুজোটা  কেটেছিল খাটে মুখ গুঁজে। নতুন কাকা হাকোবা চিকণের জামা কিনে দিতে চেয়েছিল। সে গাঢ় অভিমানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, চাই না এবারে কোন জামা, হলুদ সিল্কের জামা তো নয়ই, কোনদিনের জন্য নয়। কেঁদে কেঁদে গলায় ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।

ওঃ কত বেলা হয়ে গেছে! চারপাশ রোদে ভেসে যাচ্ছে। পুপাই চেঁচাচ্ছে, মা ওঠো। কত ঘুমোবে?  সকালে ঘুম ভাঙ্ল গলায় ব্যথা নিয়ে, আগের  রাতে ঝমঝমে বৃষ্টি পড়েছে। চোখ খুলতেই   রাতে দেখা সবপ্নের কথাটা মনে পড়ল সীমন্তীর? সঞ্জয়কে বলবে? না থাক, ওসব তার একার কথা।  পুপাই তাড়া লাগায়, আমার খিদে পেয়েছে। ওঠো না। তাইতো! সঞ্জয়  এখন কোথায়? বাস্তব টের পেতেই মুখটা বিস্বাদ লাগে।  ঠিক করল আজ একবার  অফিস ফেরত মায়ের কাছে যাবে। অনেক দিন যায়নি, পুজোর জামা–কাপড় কিনে একেবারে যাবে ভেবেছিল,  কিন্তু  ভেতরে ভেতরে  কোথায় যেন একটা ক্ষীণ আশা ঘুরপাক খাচ্ছে।    সেবারের পর দিলীপদার দোকানে  বাবা  আর তার জন্য জামা তৈরি করার অনুমতি দেন নি। তবে  বছরে দু তিনটে  জামা   হোত,  সেখানেই। মা লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবস্থা করে রাখত। দশ বছর ধরে অনেক কষ্ট করে দিলীপদা আবার ভাঙ্গা চোরা দোকানটা কোথায় যেন দাঁড় করিয়েছিল। ভাইপোরা তারপরে নাকি আরো বড় করেছে।  মা কি বলতে পারবে দোকানটা  এখন কোথায়?

দিলীপদা কি এখনো  বেঁচে আছে মা? ফোনে  প্রশ্ন করতেই মা বেজায় বিরক্ত। আমাকে বলে কয়ে সে কি বেঁচে আছে? নিজের শরীর নিয়ে মরছি, আদিখ্যেতা! হঠাৎ  টাপুর কথা মনে হল, সীমন্তীর ছোটবেলার বন্ধু, বিয়ে-থা করেনি, পুলিশে চাকরি করে, তার বাপের বাড়ির পাড়ায় থাকে। অফিস ফেরত টাপুর বাড়ি যেতেই ও হাঁ ।সীমন্তীর  আসার উদ্দেশ্য  শুনে কুলকুল করে হাসল, বুঝেছি, ব্লাউসের  কিসস্যা। চল, নিয়ে যাচ্ছি , তবে   লেট করেছিস সীমু। ওর ভাইপো গুলো হেভি খচড়া। পারমিসন দেবে কি? তবে কাটিঙ্গের কাজ ও বুড়ো এখনো নিজের হাতেই করে।

কত বছর… পঁচিশ নাকি আরো বেশি… এই দিলীপদাকে আমি  চিনি না। আলো ঝলমলে দোকানের শেষ প্রান্তে একটা  বেখাপ্পা মানুষ, রোগা খয়াটে পাথুরে  চেহারা, মুখ খানা নিস্পৃহ। জীবনের সব হাসি ওই মুখ থেকে  কেউ কি শুষে নিয়েছে?  চেয়ারে বসা অবস্থায় গম্ভীর গলায় বলল, কী হবে?

টাপু ভারিক্কি গলায় বলল, আমাদের পাড়ার সীমু, তোমার হাতের জামা পরে টরে বড় হয়েছে। তুমি না বোলো না কিন্তু। এক খানা দু খানা ব্লাউজ –ও তোমার হাতের ময়লা। পাথুরে মুখ আরো গম্ভীর, ব্লাউজ হয় না এখানে।না, ব্লাউজ না, একটা ফ্রক, বছর সাতেকের মেয়ের মাপে। নমুনা- মাপ সঙ্গে আছে। কাপড় কত্টা লাগবে? আমি  সীমু- মামণি দিলীপদা। চিনতে পারছ না?

হাতে মোবাইল ফোন নাচাতে নাচাতে  বুড়ো দিলীপদা হাসল, আমি কাপড় চিনি,  মাপ  নিই, কাস্টমার মনে  রাখা আমা্র কাজ নয়।  এ দোকানে ভাল কাপড়ের স্টক আছে, পছন্দ করুন , তারপর আসুন।

মজুরি কত  বলবে না ?

ডিজাইনের ওপর রেট হয়।

বাসন্তী রঙের সিল্কের কাপড় দেখাও, না হলেও গাঢ়  কমলা ,হলুদের অনেক গুলো শেডের হলেও চলবে ।  

গাঁঠরি থেকে বেরোল তিনখানা বাসন্তী রঙের সিল্কের থান। দেখুন।

খুব সহজেই রঙ পছন্দ হল সীমন্তীর। ঠিক সেই রকম না হলেও… অনেকটা কাছাকাছি।

এবারে ডিজাইন দেখাও।

দরকার নেই।  এতকাল বাদে যখন কষ্ট করে এসেছেন, যা চেয়েছিলে্ন তাই পাবেন। সাতদিন বাদে এসে নিয়ে যাবেন।  ঠিকানা,  হ্যাঁ, ফোন নাম্বারটাও রেখে যান ।

-সেকি? ডিজাইন না বললে…

– বলছি তো লাগবে না।

 আডভ্যান্স কিছু দিতে হবে দিলীপদা?

 নিশ্চয়ই।

কত?

বেশি না, কথার খেলাপের  সম্ভাবনায়  কিছু গরম  গরম কথা  আর…

-দিলীপদা!  

 জানি গো সীমু- মামণি, তোমার সেই বাসন্তী রঙের সিল্কের  জামাটা একদিন আমায় করে দিতেই হবে, এতো আমার জানাই ছিল, শুধু কবে সেটা জানতাম না… বিশ্বাস করো  এবার আর…

সীমন্তীকে যেতে হয়নি, যত্ন করে প্যাকেট বন্দী জামা পাঁচদিনের মাথায় তার ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল। ভেতরে ছোট্ট  চিরকুট, “সীমু- মামণি,  অদেখা, তোমার ভালবাসার ছোট্ট মানুষটির জন্য আমি যত্ন করেই জামাটা তৈরি করেছি, যেমন চেয়েছিলাম তোমার জন্য…  সেই  অনেক কাল আগে। আফশোষ একটাই আমি যে ভন্ড নই শুধু তোমার বাবা সেটা জেনে যেতে পারলেন না। এ জামার মজুরি হয় না, সেটা  দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষমতা তোমার আমার কারুর নেই। পারলে মাঝে মাঝে এসো, এখনো চোখে দেখতে পাই।

সীমন্তী ভাবেনি, জামাটা পিউ’র মায়েরও এত পছন্দ হবে। আর তার থেকেও বেশি পছন্দ হয়েছে ছোট্ট পিউর ।কল্পনায় দেখছে সে  সারা পুজোয়, সপ্তমী অষ্টমী নবমীতে পিউ  বাসন্তী প্রজাপতির মত ছুটে চলেছে  পাড়ার পুজো মন্ডপে। ও কে?  পিউ?  না ক্লাস ফাইভের সেই বোকা লাজুক  সীমন্তী?  নতুন কাকার শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া সেই বাসন্তী রঙা সিল্কের জামা  গায়ে আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে  

পিউর হাসিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে জীবনের অমল আনন্দ, আনন্দ ছাড়া জীবনের উৎসব হয় নাকি? সীমন্তী তার টানাটানির সংসারে  আজ  কী করে যেন অনেকটা  আনন্দ পেয়েছে। না, পুপাইয়ের জামা করার নাম করে দিলীপদাকে আবার বিরক্ত করতেই হবে। ভাল লাগার কিছু মজুরি তো ফিরিয়ে দিতেই হবে।  

টেলিভিশনে খবর হচ্ছে, দেশে করোনার প্রকোপ কমেছে। এবারে পুজোয় বাড়তি সতর্কতা থাকলেও বেশ কিছু কমিটি পুজো করার  অনুমোদন পেয়েছে।  পুপাই লাফালাফি করে, এবারে  আমার জামা হবে। সিল্কের জামা। এই রকম আলোর মত হলুদ রঙের।

আলোর মত হলুদ! কী সুন্দর বল্ল তার ছোট্ট ছেলেটা!

মা-কে  আজই বলতেই হবে,  জানো মা, পৃথিবীতে এখনো অনেক দিলীপদারা বেঁচে আছে, নিভৃতে বাঁশি বাজিয়ে আজো তারা ডাক দেয়, আর তাইতো জীবনে রুক্ষ দিনেও কত গোপন, মধুর্‌  বসন্ত দিনের আনন্দ-আভাস অনায়াসে  হাজির হয়ে যায়। দিলীপদা কথার খেলাপ করেনি।

বাবা শুধু এই সত্যিটা জেনে যেতে পারল না।

হয়তো এও আরেক সত্যি। জীবনে  বহু  সত্যি  অনেক পরে  বাড়তি মাধুর্য নিয়ে আমাদের  নাগালে আসে।

করোনা কাল  তাহলে সত্যি শেষ হয়ে আসছে। আকাশে এখন অনেক  হলুদ আলো ।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত