উৎসব সংখ্যা গল্প: নক্ষত্র নন্দীর উপন্যাস । কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
‘অমাবস্যা’ পত্রিকার সম্পাদক পরিতোষ পাকড়াশির চেম্বারে আজ গুরুত্বপূর্ণ মিটিঙ। আসন্ন শারদীয়া সংখ্যা উপলক্ষে এই মিটিঙে উপস্থিত পত্রিকার সহ–সম্পাদক হারাধন হালদার, কর্মসচিব মোহন মুখুজ্জে আর ডিটিপি–কম্পোজিটার বিপ্লব বসাক। এখনকার বেশ কিছু যশস্বী লেখক ও শিল্পীও যথারীতি হাজির। শুধু অপেক্ষা এখন একজনের জন্য। তিনি না এলে এ মিটিঙ শুরু হতে পারছে না।
এর মধ্যে দু রাউন্ড চা হয়ে গেছে। পাশের দোকানে ফিসফ্রাই অর্ডার দেওয়াই আছে, মিটিঙ শুরু হলেই তৎপর কানাই দৌড়ে যাবে । ওকে কোন কাজ দুবার বলতে হয় না। তাই ওর ওপরে পরিতোষের বিপুল ভরসা। কানাই হল এ অফিসের পি–থ্রি। পিওন–কাম–প্রহরী–কাম–পোস্টমাস্টার।
যদিও হাসি–ঠাট্টা গল্পগুজবে সময়টা ভালই কাটছিল, তবু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে সকলেই এখন বেশ খানিকটা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ফিচার–লিখিয়ে তারিণী তলাপাত্র।
তাঁর আবার সন্ধের পর খানিকটা আফিম না হলে চলে না। আজ এই দেরীর জন্য মৌতাতটা মাঠে মারা যাবে, এজন্য তিনি যথেষ্টই বিরক্ত। নাকটা চুলকোতে চুলকোতে বলেই ফেললেন, “দেখ হে পরিতোষ, তোমার এই নক্ষত্র নন্দী ছোকরাটি কিন্তু বড়োই বে–আক্কেলে। নাহয় লিখে একটু নামধামই করে ফেলেছে, তাই বলে এত দেমাক ? দুদিনের ছোকরার এত বাড়াবাড়ি তো ভাল নয় হে!”
সুতনু সমাদ্দার গপ্পো লেখে। বিশেষ করে কল্পবিজ্ঞান লেখায় তার ভালো হাত। শারদীয়া সংখ্যায় গল্প ছেড়ে উপন্যাস অবধি সে এখনও উঠতে পারেনি। এবারে পরিতোষকে জপিয়ে–টপিয়ে তার সদ্য লেখা ‘প্লুটোয় প্রোমোটারি’ উপন্যাসটা যদি ছাপাতে পারে, সেই আশাতেই সে এসেছে।
স্বাভাবিক কারণেই নক্ষত্রের সঙ্গে তার একটা ঈর্ষার সম্পর্ক । তাই সুযোগটা সে ছাড়ে না। একটু খোঁচা মেরেই বলে, “তা বললে হবে ? পরিতোষদার কোলের ছেলে না এলে মিটিঙ শুরু হবে কী করে?”
পরিতোষ খোঁচাটা গায়ে মাখেন না। কারণ তিনি জানেন, যে যাই বলুক, নক্ষত্র নন্দীর নামেই পত্রিকা আদ্ধেক কেটে যায়। শারদীয়ায় নক্ষত্রের একটা উপন্যাস পত্রিকার বিক্রী ডবল করে দেয়।
তাই মৃদু হেসে তিনি বলেন, “আহা, নক্ষত্র হয়তো কোন কাজে আটকে পড়েছে। আর একটু দেখাই যাক না। রাত তো বেশি হয়নি।”
যদিও পরিতোষ মুখে কথাটা বলেন, কিন্তু সকলের উসখুসুনি দেখে বুঝতে পারেন, কথাটা কারুরই খুব একটা মনঃপূত হয়নি। তাই ব্যালেন্স করার জন্য যোগ করেন, “তবে এত দেরী হচ্ছে যখন, তখন একটা খবর দিলেই পারতো। যাই হোক, আর মিনিট দশেক দেখা যাক, তার মধ্যেও না এলে আমরা মিটিঙ শুরু করে দেব, কী বলেন?”
সকলের মাথা ঘন ঘন নড়তে থাকে । হারাধন বলে ওঠেন, “সেই ভালো। ততক্ষণ পরিতোষ, তুমি বরং আর এক রাউন্ড চা বলে দাও । আর আমি মিটিঙের খসড়াটা করে ফেলি, কী বলো?”
পরিতোষ মাথা হেলিয়ে সায় দেন । তারপর হাঁক পাড়েন, “কানাই”!
নক্ষত্র নন্দী প্রায় নক্ষত্রের মতোই তীরবেগে কলেজ স্ট্রীটের দিকে যাচ্ছিল। হাতে সময় বড়ো কম। তার মধ্যেই প্রচুর কাজ করে ফেলতে হবে। ইতিমধ্যেই অনেকগুলো কাজ সারা হয়ে গেছে। কিন্তু আসল কাজটাই এখনও বাকি। অমাবস্যার দপ্তরে পৌঁছনো। সকাল থেকে যেভাবে চলছিল, সেইভাবে চললে হয়েও যেত, কিন্তু মাঝখান থেকে খবরটা এসেই সব গোলমাল করে দিল। সমস্ত রুটিন এলোমেলো পাকিয়ে গেল।
আজ কম দিন তো হল না নক্ষত্র লেখালেখি করছে! প্রায় বারো বছর। তার প্রথম বছর–দুই বাদ দিলে গত বছর দশেক ধরে সে একটু একটু করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। তার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে লেখা দেবার ব্যাপারে নক্ষত্রের পাংচুয়ালিটি। প্রত্যেকটা জায়গায় সে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই লেখা জমা দেয়। এ ব্যাপারে ছোটবড় সমস্ত পত্রিকার সম্পাদকের কাছে তার অশেষ সুনাম। বইয়ের প্রকাশকদের কাছেও। কারণ তার যে কোন বইয়ের প্রুফ সে দুদিনের মধ্যে দেখে দেবেই।
সুতরাং আজও নক্ষত্র তার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়। আর সেজন্যেই তার এমন ঝড়ের বেগে যাতায়াত।
বাড়িতে এতক্ষণ কী হচ্ছে কে জানে! কিন্তু এখন নক্ষত্র সেসব মাথায় আনতে চায় না। যে করে হোক কাজগুলো সারতে হবে।
এমনিতেই পুরোনো কিছু জরুরী হিসেবনিকেশ মেটাতে গিয়ে তার অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তার ওপর আবার বড়পিসীমাকে দেখতে গিয়ে আরও দেরী। পিসীমা অন্তিম শয্যায় । বারবার তার নাম ধরে বিড়বিড় করছিলেন। কাজেই একবার দেখতে যেতেই হল। সেইসঙ্গে পিসতুতো ভাইয়ের একটা চাকরীর খবরও দেবার ছিল। এইসব কাজ সেরে এখন সে তাই কলেজ স্ট্রীটে অমাবস্যার দপ্তরের দিকে চলেছে। এই কাজটা সারতে পারলেই … আঃ …
পরিতোষ পাকড়াশির চেম্বার ততক্ষণে সরগরম। আর নক্ষত্রের অপেক্ষায় থেকে লাভ নেই বুঝে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। তারিণী তলাপাত্রর গলা তুঙ্গে। পৃথিবীর বিখ্যাত সমস্ত হানাবাড়ি নিয়ে তাঁর নতুন নিবন্ধটি তিনি পড়ে শোনাচ্ছিলেন। সুতনুর চোখমুখ উদ্ভাসিত। তার প্রথম উপন্যাসের জিস্ট শুনে পরিতোষ পছন্দ করেছেন। ওদিকে উঠতি শিল্পী ভয়ঙ্কর ভড়ের সঙ্গে হারাধন আলোচনায় বসেছেন পত্রিকার অলঙ্করণ নিয়ে।
সবকিছু দেখেশুনে পরিতুষ্ট পরিতোষ সবে কানাইকে ডেকে ফিস ফ্রাইগুলো আনতে পাঠিয়েছেন, এমন সময় ঝড়ের বেগে ঘরের দরজায় নক্ষত্রের আবির্ভাব। যে যেখানে ছিল, নিমেষে চুপ। কাউকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নক্ষত্র বলে ওঠে, “স্যরি পরিতোষদা। আমার আসতে বেশ কিছুটা দেরী হয়ে গেল। এজন্য সবার কাছেই আমি ক্ষমা চাইছি। আসলে এমন কিছু আর্জেন্ট কাজ সেরে আসতে হল যে… যাই হোক, মিটিঙ তো দেখছি আপনারা শুরু করে দিয়েছেন। ভালই করেছেন । তা…”
এতক্ষণে পরিতোষ নড়েচড়ে বলে ওঠেন, “আরে নক্ষত্র, এসো এসো। দেরী হয়েছে তো কী হয়েছে। শেষ তো আর হয়ে যায়নি । বোসো, ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ো।”
নক্ষত্র বলে ওঠে, “না পরিতোষদা। ভেরি স্যরি। আজ আর আমার এক মুহূর্তও বসার সময় নেই । শুধু কথা দিয়েছিলাম, তাই আমার উপন্যাসটা এই রেখে গেলাম। আশা করি পাঠকদের খুব একটা অপছন্দ হবে না। আপনারা মিটিঙ চালিয়ে যান। আমি চলি। গুড বাই এভরিবডি।”
দরজার পাশের একটা টেবিলের ওপর পান্ডুলিপিটা রেখে আবার ঝড়ের মতই নক্ষত্র বেরিয়ে যায়। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
সম্বিৎ ফিরে পেতে পরিতোষ বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপর বলেন, “দাও তো সুতনু, পান্ডুলিপিটা একবার দেখি।”
সুতনু তার হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে পান্ডুলিপিটা নিয়ে আসে এবং পরিতোষের দিকে বাড়িয়ে দেয়। পরিতোষ পান্ডুলিপিটা উল্টেপাল্টে দেখেন। তারপর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠেন, “দেখ হে মোহন, হারাধন তুমিও দেখ, কী অভিনব সাবজেক্ট নিয়ে উপন্যাস লিখেছে নক্ষত্র! একেই বলে ওস্তাদের মার। উপন্যাসের নাম দেখেছ ! “অন্ধকারের গন্ধ”! বাপ্রে! ভাবা যায়? তোমরা কেউ ভাবতে পারো এমন নাম? এ তো উপন্যাসের নামেই পত্রিকা কেটে যাবে! তারপর এই নামে যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট পড়ে, তাহলে তো আর কথাই নেই । কী বল হে?”
হারাধন দুলে দুলে মাথা নাড়াতে থাকেন। সুতনুর মুখ পেঁচার মতো হয়ে যায়। আর তারিণীর ভুরু দুটো বেঁকে তিরিক্ষে আকার ধারণ করে। শুধু পরিতোষ পান্ডুলিপিতে মগ্ন। তাঁর মুখে প্রশান্তির ছায়া।
ঠিক এই পবিত্র মুহূর্তে পরিতোষের মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পরিতোষ কানটা লম্বা করে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরেন তাঁর টেবিলে রাখা ফোনের গায়ে। বন্ধু চক্রধর চক্কোত্তির গলা, “কী রে পরিতোষ, খবরটা শুনেছিস তো?”
নিমেষে সচকিত হয়ে ওঠেন পরিতোষ। কীসের খবর? কেমন একটা আশঙ্কা তাঁর মনকে ছেয়ে ফেলে। অজান্তেই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, “না তো! কী খবর রে?”
“আরে তোদের ওই লেখক ছেলেটা, কী যেন একটা বেমক্কা নাম … হ্যাঁ হ্যাঁ, নক্ষত্র নন্দী …”
“হ্যাঁ নক্ষত্র, কী হয়েছে?”
“আরে সে তো আজ সন্ধেতেই নতুন জন্ম নিয়ে নিয়েছে। আজই বিকেলে হঠাৎ খবর এল, আর তারপরেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল । কেন, তোরা কোন খবর পাস্ নি?”
পরিতোষ কানটি ছোট করে যথাস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তাঁর মুন্ডু ভোঁ ভোঁ করছে। শরীরটা লিকলিক করে কাঁপছে । এ কী ব্যাপার ? নক্ষত্র সেই সন্ধেবেলা মানুষ হয়ে জন্মে গেছে, মানে অন্তত ঘন্টা তিনেক আগে। তাহলে এইমাত্র কে এসে দেখা করে গেল তাঁর সঙ্গে ? কে এসে পান্ডুলিপি দিয়ে গেল তার উপন্যাসের? সে পান্ডুলিপি এই তো এখনও তাঁর হাতে, তাতে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রের হাতের লেখা। তাহলে?

কথাসাহিত্যিক
জন্ম ১৯৬৪। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অথচ শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতি নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা। তাই অসংখ্য ছোটবড় পত্রিকায় তাঁর বিভিন্ন ধরণের লেখা প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়ে চলা নাটক ও নৃত্যনাট্য রচনা ও সুরারোপের মাধ্যমেও বিচ্ছুরিত তাঁর প্রতিভা। লেখেন ছোটবড় সকলের জন্যই। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১, যার মধ্যে ‘দুর্দান্ত দশ’, ‘পাতায় পাতায় ভয়’, ‘ভূতের বৃন্দাবন’, ‘গুহা গোখরো গুপ্তধন’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি ইতোমধ্যেই পাঠকসমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত অপেরা-নাটক “আলাদিন” বেশ কয়েকবার মঞ্চস্থ হওয়া ছাড়াও হাওড়ার একটি নাট্য কর্মশালায় ব্যবহৃত হয়েছে। একসময় সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা “আলো অন্ধকার”। পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কার, যার মধ্যে ‘কিশোর ভারতী সাহিত্য পুরস্কার”, “সংশপ্তক পুরস্কার” প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।