| 23 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: সুখের আন্ধারশূলা । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

নাম লিখে পুনরায় মুছে ফেলতে ইচ্ছে হলো না। পেনসিলে লেখা। সহজে ইরেজ করা যায়। শিহাব ইচ্ছে করলেই হতো। তার কেন জানি অনাবশ্যক দর্শনতত্ত্ব মাথায় এলো। সেটি সেরকম কি না তলিয়ে দেখার মতো মন বা সময় নেই। নিয়তিতে যা একবার লেখা হয়ে যায়সহজে মোছে না। তার হাতের কোয়েশ্চনিয়ারে বাউনি বালাবাউনি বেওয়া হয়ে রইল।

মহিলার সিঁথি মোটা দাগে সিঁদুর রাঙানো। পরনে বৈধব্যের শুভ্র বেশ। চুলে পাক ধরেছে। চেহারায় পড়েছে বয়সের ভাঁজ। নাম যেমন হোকবাউনির মতো এই গ্রামে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। সে কলাগাছের মসৃণ কাণ্ডে বাঁহাতে হেলান দিয়ে মাথা দুলিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়। তার নাকে রুপোর নোলকময়লাটে ঝাপসাকথার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু দোল খায়।

বাবু ওইটাই হামার নিয়তিভগবানে অদিষ্টে যা লিখি পাঠে দিছে তা মুছিবার নাহায়। নাম ঠিকে আছে।’

তোমার ছয়টি সন্তানই তা হলে মারা গেছে?’

হয় বাবু আর ওইকোনা বাউ মুই পুষি নিছু।’

ওর নাম কীবয়স কত?’

নিধুয়ানিধুয়া রায় বর্মণ। বয়াস তোমহ্‌রা আন্দাজ করেন বাবু।’

শিহাব ভালো করে চোখ তোলে। চশমা তর্জনী দিয়ে নাকে চেপে বসায়। ছেলেটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে আধছেঁড়া হাফপ্যান্ট। জিপার নেই। ফাঁকা। খালি গা। বিশুষ্ক চোখ। হাতে কাঁচা আম। খাচ্ছে।

এই এদিকে আয় তোকী নাম তোরকথা বলতে পারিস?

শিহাব দুচোখে সস্নেহ আগ্রহ ফুটিয়ে তোলে। সেটি হয়তো কৃত্রিম নয়। বয়স কত হবে নিধুয়ারসাত বা সাড়ে সাত। অথচ চেহারার সলজ্জভাব কেমন পরিপক্ব মানুষের মতো করে তুলেছে। শিহাবের সতর্ক দৃষ্টিছেলেটি নির্ঘাত রাতকানা। তার সার্ভের টার্গেট পিপল। এদিকে এই রোগকে আন্ধারশূলা বলে। অন্য দুএকটি গ্রামে কুকুরিকানা। সে মনে মনে প্রশ্নগুলোর জন্য প্রস্তুত হয়। স্পর্শকাতর বিষয়। সাবধানে জিজ্ঞেস করতে হয় যাতে কারও মনে কোনো প্রশ্ন না জাগে। আঘাত না লাগে। আতঙ্ক না ছড়ায়। দেশে প্রতিবছর চল্লিশ হাজার শিশু রাতকানা রোগে অন্ধ হয়ে যায়। এই রোগের কারণ শুধুমাত্র ভিটামিন ‘এ’র অভাব। তার সার্ভের উদ্দেশ্য এলাকায় নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সঠিক উপাত্ত আর যৌক্তিকতা বের করে আনা। pre-assessment and rational for undertaking new project|সে প্রশ্নপত্রের কোডিং টেবলে লেখে। নামনিধুয়া রায় বর্মণ। বয়সসাত বছর ছয় মাস। পড়ালেখাকরে না। পেশাপ্রযোজ্য নয়।

তোমার খাওয়া খরচ কোত্থেকে আসেকী কাজ করো?’

ওই তো কৃষি কাজ করি।’

নিজের জমিকতটুকু জমি আছে?’

নিজের জমি থাকিলে এইংকা থাঁকো বাবুপরার জমিত জোন দিইদিনমজুরি খাটো।’

গ্রামের নাম দগচাই। বোচাগঞ্জ থানা কেন্দ্র থেকে মাইল কয়েকের পথ। রিকশাভ্যান চলে। জেলা বোর্ড সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে হাত তুলে ইশারা করলে লোকাল বাস থামেযদিও কোনো স্টপেজ নেই। তখন রিকশাচালক বলছিল, ‘বাস থামে গ্রামের মাথায়।’ শিহাব তেমন খেয়াল করেনি। ও নিয়ে ভাবনার তেমন কোনো কারণ নেই। তার গাঙচিল মন কখনো কখনো বাসে চেপে দূরবহুদূর চলে যেতে চায়। যেনবা এই জীবন থেকে অনেকদূর। এই কাজ ভালো লাগে না। বড় ঝামেলা। জীবনে তার কি করার কথা আর কী করছেতার বিশুষ্ক মন নিজের উপরই আদ্র হয়ে ওঠে।

দগচাই’এর দুটি প্রান্ত। পিচঢালা চিকন রাস্তার ওপার আর এপার। রাস্তাটি যমুনার মতো দুই প্রান্তের মধ্যখানে শুয়ে আছে। দূরত্বের সূচনা করেছে নাকি সেতুবন্ধন গড়েছে কে জানে। সে এখানে এসেছে সকাল এগারোটায়। সেসময় ঝলমলে রোদ ছিল। তারপর আকাশে হঠাৎ দ্রুত কালো মেঘ জড়ো হতে থাকে। বয়ে চলে ঝড়ো বাতাস। মনে হয় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। তবে তেমন কিছু হয় না। এপ্রিলের তপ্ত মাটি সামান্য ভেজে মাত্র। সে বিশাল এক আকাশমনি গাছের নিচে আধভেজা দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখে। আকাশ থেকে বড় বড় ফোঁটায় নেমে আসে শীতল বৃষ্টি। দূরের গাছপালা বাড়িঘর অস্বচ্ছঘোলাটে দেখায়। সেদিকে তাকিয়ে মন ভেসে যায় দূরবহুদূর। বৃষ্টি থেকে কাগজপত্র বাঁচানোর ব্যস্ততায় মনে খেদ আসে। এই জীবনঅস্তিত্ববেঁচে থাকা অহেতুক। অর্থহীন। তার নিজের গল্পছোট ছোট চাওয়াপাওয়া দুঃখহতাশা অজানা থেকে গেল। সে কিনা অন্যের ইতিহাস লিখে যায়। গ্রামের উত্তর প্রান্তের তিনটি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এখন চলছে চতুর্থ সাক্ষাৎকার। বাউনি বালার জীবন ইতিহাস।

বাউনির আহামরি রূপ ছিল না। ঠাকুরদার সংসারে বেড়ে ওঠা নিতান্তই সাধারণ গ্রাম্যবালা। শোনা কথা তাকে জন্ম দিয়ে নাকি মা মরেছে। বাবা তার কয়েকমাস পর। জ্যাঠাইমার বুকের দুধ খেয়ে আর তার লালনপালনে বড় হওয়া। সে বুড়ি এখনো বেঁচে আছে। একশ ছয় বছর বয়স। অদ্ভুত পরমায়ুএকটু বড় হতে হতে বাউনির পায়ে আলতা পড়ে। সিঁথিতে সিঁদুর ঘষে দেয়া হয়। দেখতে দেখতে তার পুতুলখেলার বয়স কীভাবে যে বাস্তব হয়ে উঠেছিলভাববার বা বুঝবার অবকাশ পায়নি। তারপর সেই স্বপ্ন দেখার রাত দুঃস্বপ্ন আর যন্ত্রণায় ভরে যায়। লোকটি সলিত রায় বর্মণ। ঝাঁকড়া চুলকৃষ্ণকায় মানুষলোহা পেটানো শরীর। শক্তিশালী কর্কশ। তাকে খামচে নিংড়ে নিজের ত্রিশ বছরের সুদআসল আদায় করে নেয়। তখন বাউনির বয়স কতমনে নেই। তিন চার মাস ধরে শুধু অমাবস্যাপূর্ণিমা গুনতে শিখেছে। তারপরও যন্ত্রণাকাতর রাত আবেগ আবেশে বিহ্বল হয়। যেভাবে অন্ধকার রাত দুলে ওঠেভোরের বাতাসে ঘরের চালে লাউলতার ডগায় সাদাফুল দোল খায়বাউনি কোন্‌ স্বপ্নে কী সুখে নিজের মনে ভেবে ভেবে আরক্ত হয় জানে না। বুঝতে পারে না। তারপর একদিন জেনে যায়সে এবার মা হবে। পৃথিবীর এই নিয়ম। তখন পশুর মতো মানুষটিকেও তার ভালো লাগে। প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে শেখে। সংসারের আস্বাদ একটু একটু করে বুঝে নিতে থাকে।

সে যত আবেগ আর মনোযোগ দিয়ে দুহাতে সংসার আঁকড়ে ধরেসলিত সম্পূর্ণ বিপরীত। এমন রহস্যময় মানুষ যার জীবনের অনেককিছু আড়ালে থেকে যায়। জ্যাঠাইমা যেদিন শোনে সলিত বিয়ের ছয় মাসের মাথায় উধাও হয়ে গেছেদীঘল আঙিনা জুড়ে খাঁখাঁ শূন্যতা নামে। চারিদিক হতে ভেসে আসা বিষাদ বাতাস ভারী করে তোলে সবকিছু। এসবের মধ্যে বাউনির একাকিনী দুঃসহ রাত কেটে যায়। সেদিন বেদনা লুকোবার কোনো জায়গা খুঁজে পায় না। কৈফিয়ত দেয়ার কিছু নেই। অদৃষ্টের লিখনসমাজ তো এভাবেই মেয়েদের জীবন লালন করে আসছে। একধরনের দাসত্ববাউনি কেঁদে বুক ভাসায় না। পাথর হয়েও যায় না। সব কষ্ট তার বুকের মধ্যে। চোখের দৃষ্টিতেও ভেসে ওঠে না। একমাস অপেক্ষার পর ঠাকুরদার কাছে ফিরে যায়। তারপর একদিন আকস্মিক শোনেনিষ্ঠুর লোকটি নাকি কোনো এক হরিসভায় আসর মাত করে আছে। জায়গার নাম জয়নন্দহাট। স্কুল ঘরে জায়গা নিয়েছে কীর্তনের দল। রাস্তার ওপারে বড় সামিয়ানার নিচে দিনরাত চলছে হরিনাম কীর্তন। বাউনি একদুপুরে কাউকে কিছু না জানিয়ে সেজেগুজে বাসে ওঠে। ঠোঁটে রক্তিমা। গালে পাউডারের প্রলেপ। সিঁথির সিঁদুর গনগনে দুপুরের মতো জ্বলজ্বল। গর্বিত মনের অন্তরালে ছটফট করছে সলাজ উন্মাদনা। কিশোরী মন যে কখন পরিপূর্ণ নারী হয়ে গেছে সে নিজেও বুঝতে পারে না।

বিদ্যুৎ চলে গেছে। উপজেলা চত্বরের একরকম পরিত্যক্ত ভবন ভূতুড়ে মনে হয়। শিহাব তেমন ক্ষুধার্ত না হয়েও সন্ধেরাতে বাজারের রেস্তোরাঁয় রাতের খাওয়া সেরে নিয়েছে। লোডশেডিং’এর অন্ধকারে আধকিলোমিটার ভাঙাচুরা রাস্তা যাওয়াআসা কষ্টকর। দুতিনদিন ধরে কনস্টিপেশন। খাবে কি খাবে না ভেবে ভেবে বেশি খেয়ে ফেলে। খেসারতঅস্বস্তিতে চোখমুখ ঘেমে নেয়ে ওঠে। চাটাইঘেরা রেস্তোরাঁর ভেতর গুমোট গরমে অসহ্য লাগে। সে কোনোমতো রাস্তা পেরিয়ে উপজেলা ভবনে এসে হাঁপাতে থাকে। হাঁসফাঁস ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চায়। অথচ অনেক কাজ। রাতের মধ্যে শেষ করতে হবে। সকালে নতুন কাজ। নতুন গ্রামনতুন মানুষনতুন সাক্ষাৎকার। সে মেঝেতে বিছানো কাথার উপর শুয়ে পড়ে। সারাদিন ইন্টারভিউ’র দশটি কোয়েশ্চনিয়ার কোডিং ফরমেটের সঙ্গে মেলাতে থাকে।

আটজনের টিম নিয়ে সার্ভে হচ্ছে। সে একজন ইন্টারভিউয়ার। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এপ্রিলের দগ্ধ প্রান্তর ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিন অন্তত দশজনের তথ্য সংগ্রহ করে। অপরিচিত এলাকার অজানা গ্রাম অচেনা মানুষজন। কোনোদিন এদিকে আসেনি। এখন তালিকাভুক্ত গ্রামগুলোয় যেতে হয়। সম্ভাব্য টার্গেট পিপলের দোরগোড়ায় ভিখিরির মতো ডাক দেয়। গ্রামের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা দৌড়ে কাছে আসে। তারা ‘ডাক্তার আসিছেডাক্তার’ বলে শোরগোল তোলে। শিহাব তখন নিজের প্রতি করুণ হাসি ছড়িয়ে দেয়। ডাক্তার বটেএই জগৎসংসারে চোখে যা দেখা যায়তার সব যে সত্য নয় কে জানেঅনেক মহৎ সত্য আবার দেখা যায় না। নেপথ্যে থেকে যায়। সে নিজেকে তেমনভাবে এক্সপোজ করতে পারেনি। হয়তো পারবেও না কোনোদিন। সে দরজা ছাড়িয়ে দৃষ্টি সামনে ছুড়ে দেয়। টীমের অন্য সকলে মাঠের শীতল ঘাসে বসে আড্ডা দেয়। কখনো কথা উচ্চশব্দ হাসির কলরোল বাতাসে ভেসে আসে। সে আপনমনে কাজ করে যায়। একসময় আলিফ হোসেন রুমে এসে তাকে বলে, –

কী করেন শিহাব ভাইএই খাটুনি যদি ছাত্রজীবনে করতেন তা হলে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়ে সার্ভেয়ার হতেন না। কি লাইফ!’

শিহাব তেমন মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। তবু জবাবে অস্ফুট কিছু ধ্বনি করে। কোডিং পয়েন্ট মেলানো বেশ ঝামেলার। নিবিষ্ট ছিল সেই হিসাবনিকাশে। তারপর সহসা বুঝতে পেরে চমকে ওঠে। সে আসলে সবকিছু দেরিতে বোঝে। গর্ধব জাতীয় মস্তিষ্ক। তার মন আবার অস্থিরচঞ্চল হয়ে পড়ে। কোয়েশ্চনিয়ারের নানান প্রশ্ন আর কোডিং ছকের দিকে তাকিয়ে উন্মনা হয়ে যায়।

বাবা কেমন আছেঅঞ্জলিছেলেগত সপ্তাহে ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটরের মাধ্যমে শ দুয়েক টাকা পাঠিয়েছে। সেই হাকিমভাই এখনো ফেরেননি। আগামীকাল আসবেন। ছেলের জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয়। ছয় মাস বয়সে নিউমোনিয়ায় ভুগে এখনো দুর্বল। তিন বছর হয়ে আসছে তবু একটুতে হাঁপিয়ে ওঠে। বড় ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি। টাকা কোথায়?

শিহাবের দৃষ্টি আচমকা ঝলসে ওঠে। বিদ্যুৎ এসে গেছে। কলিগেরা মাঠ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। কি এক কৌতুক বলতে বলতে হাসতে হাসতে রুমমেট দুজন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকে। লন্ঠন তখনো জ্বলছে। শিহাব মশারি ঝুলিয়ে বালিশে হেলান দিয়েছে। এবার দুচোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস ছেড়ে দেয়। ক্লান্তি আর ক্লান্তি। আলিফ হোসেন কি কারণে উৎফুল্ল কে জানেঘরে পা রেখে জিজ্ঞেস করে বসে, –

শিহাব ভাই ঘুমোলেন না কি?’

না ভাই খুব টায়ার্ড লাগছে।’

তা হলে তো ঘুম ভালো হবেঘুমান। সকালে উঠে আবার শুরু করবেন। আপনি তো ভাই ওয়াইজ ম্যান।’

মানে?’

মানে বুঝলেন নাEarly to bed early to rise, makes a man healthy, wealthy and wise|’

ঠাট্টা করছেনতাস খেলা জানি না তাই শুয়ে থাকি।’

না জানাই সবচেয়ে ভালো রুমমেট। লজ্জা দুঃখ থাকে না। আ রে ভাই আমরা হলাম এই শতাব্দীর ওয়েস্টেজ মাল। ডিগ্রি আছে কাজ নেই।’

আপনার তো ভাই জমিজমা আছে। আমি হলাম হ্যান্ড টু মাউথ। কাজ করে খেতে হয়।’

আপনি আমি গাধার মতো খেটে যাব। বিনিময়ে পাব কয়েকটি টাকা। আর সেই সাহেবেরা এসিরুমে বসে কোটি কোটি টাকা কামাবে। কারণ তাদের আছে বিদেশে পড়ালেখার উঁচু ডিগ্রি। রাজনৈতিক আশ্রয়। বিবিধ কোটা। তারা পলিসি মেকার এলিট মানুষ।মাঝে মধ্যে কি মনে হয় জানেনইচ্ছে হয় রেললাইন উপড়ে ফেলি। বোমা মেরে সবকিছু গুড়িয়ে দিই।’

শিহাব কিছু বলে না। ফ্রাসট্রেশন সবার মধ্যে আছে। কেউ গোপনে পোষে কেউ প্রকাশ করে। কারও শখ বা সুখকারও অসুখ। তার সবদিকে অসুখঅশান্তি। তার সুখ শান্তি হলো না। অন্ধ হোমারের মতো নাম না জানা নদীর কূলে কূলে যন্ত্রণায় হাঁটতে হাঁটতে দিন পেরিয়ে গেল। জলের মিষ্টি স্বাদ মিলল না। ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক আশা নিয়ে বেরিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল ভালো একটি চাকরি হবে। একেবারে খারাপ ছাত্র ছিল না। কিন্তু চোরের সমাজে সত্যবাদী হয়ে যত বিপত্তি। মনোমতো কাজ পাওয়া গেল না। অবশেষে খুঁজে খুঁজে চাকরি জুটল প্রকাশনা সংস্থায় প্রুফরিডারের। যার জীবনে ছোট ছোট স্বপ্নভঙ্গের হাজার ভুলঅসঙ্গতিসে শুরু করে বানান আর ব্যাকরণের ত্রুটি অনুসন্ধান। ণত্ব আর ষত্ব বিধান শিখতে গিয়ে বুঝে ফেলে তার মতো লোকের স্বপ্ন দেখা হলো দুঃস্বপ্নভয়াবহ অপরাধঅনধিকারের পাপ। সেও টিকল না। মাসের পর মাস কোনো বেতন নেই। অগত্যা ছেড়ে দিয়ে সাময়িক এই কাজ। একুশ দিনের এই কন্ট্রাক্ট অ্যাসাইনমেন্ট শেষে কী করবে কে জানেসামনে অন্ধকার কুহকী গহ্বর অপেক্ষা করছে।

টিমের সকলে তাস খেলা শুরু করেছে। ব্রীজ। সেইসঙ্গে চলছে কৌতুক। লঘুগুরু আদিরসাত্মক। উচ্চহাসির ধ্বনিপ্রতিধ্বনি মাঠের ঘাস কাঁপিয়ে দিগন্তে ভেসে যায়। শিহাব কোয়েশ্চনিয়ার গুছিয়ে প্যাকেট করে। বালিশের তলায় রেখে পাশ ফিরে শোয়। কৌতুকের দুএকটি কথা কানে এসে ধাক্কা মারে। না হেসে উপায় নেই। হাসি সংক্রামকঅথচ তার হাসি আসে না। সে হয়তো আনন্দবিহ্বল হতে ভুলে গেছে। কবে কখন কে জানেকখনো ইচ্ছে করে সেও খেলতে বসেকিন্তুএই খেলা বোঝে না। শেখার আগ্রহ নেই। সে কি তবে জীবন থেকে পলাতকপালিয়ে বেড়ায়এই অস্তিত্বের পলায়ন কিসের উপর অভিমানকার কাছ থেকে পলায়ননানান দার্শনিক প্রশ্নে ধীরে ধীরে মাথা গরম হয়ে উঠতে চায়। অবশেষে ইনসমনিয়া আশঙ্কা তাড়াতে জোরে সশব্দ হাই তোলে সে।

সন্ধে পেরিয়ে গেছে। পশ্চিম দিগন্তে জেগে উঠেছে কয়েকটি তারা। মিটমিট জ্বলছে। বাউনি বাস থেকে পিচকালো চিকন রাস্তায় নেমে প্রলম্বিত সুর শুনতে পায়। লাউডস্পিকারে হরিনাম ভেসে আসে। তার মন আবেশে ভরে ওঠে। বুকের মধ্যে শত প্রত্যাশার কম্পনদোলা। তার হরি তো সেই দানব লোকটি যে তাকে খামচে নিংড়ে সুখ দিয়েছে। ছোট্ট পাখির মতো বুকের মধ্যে লুকিয়ে ভালবাসা শিখিয়েছে। তার চিহ্ন বেড়ে উঠছে শরীরের অংশে। সে জেগে ওঠা তলপেটে অজানা স্পন্দন অনুভব করে। অচেনা উপলব্ধির অনাস্বাদিত সুর। তখন লোকটির মুখছবি ভেসে ওঠে। কানের লতি পর্যন্ত ঝুলে পড়া ঝাঁকড়া চুলরক্তিম চোখ আর শক্ত শরীর। তার অদ্ভুত অস্থিরতা। কোনোকিছু ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তৈরি। অমন রাক্ষুসে মানুষ যখন কীর্তন গেয়ে ওঠেঅদ্ভুত সৌম্য শান্ত লাগে। বাউনির বুক গরবে ভরে যায়। এই তার স্বামীযার কাছে নিজেকে সহস্রবার নিবেদন করেও মন তৃপ্ত হয় না। সেবার অপূর্ণতা থেকে যায়। সে এসব ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে। তখন কোনো সুর লাউডস্পিকার হয়ে বাতাসে ভেসে ভেসে দিগন্ত স্পর্শ করতে থাকে। বাউনির বুকে জেগে ওঠে কোনো প্রচ্ছন্ন অহম। এই কণ্ঠ যে তার চেনা। কখনো আবার ঘিরে ধরে অচেনা বিহ্বল আবেশ। সে নেহাতই খড়কুটোর মতো সাধারণ এক মেয়ে। তার দেবতা অনেক বড় মানুষঅনেক উঁচুতে আসন।

চাঁদের আলোয় সিঁথির সিঁদুর আর জমকালো গোলাপি শাড়ি ঝলসে ওঠে। সেদিন হাটের দিন নয়। হরিসভার কারণে জয়নন্দহাট মানুষজনে গমগম। রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় বসেছে মিষ্টির অস্থায়ী দোকান। চৌকি ফেলে কসমেটিক্স আর খেলনার স্টল। সেগুলো ঘিরে ঝলমলে বাতি। মানুষের ভিড়। সে এসবের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যায়। ঝুমঝুম বেজে ওঠে নূপুর। সেই ঝংকারে কোনো কোনো দৃষ্টি ঘুরে তাকালে সারাশরীর শিহরে ওঠে তার। আড়ষ্ট পাদুটো থমকে যেতে চায়। তারপর সেই হরিসভা। সে দেখে তার দেবতাসলিত রায় বর্মণ মঞ্চের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে। তাকে ঘিরে আরও কয়েকজন। কারও হাতে ঢোল। কেউ বাজাচ্ছে কাঁসরঘণ্টাহারমোনিয়াম। লোকটি প্রলম্বিত কোনো সুর কিংবা ধ্যানে নিমগ্ন। বাউনি সেই মুখছবিতে দৃষ্টি রেখে বসে থাকা মহিলাপুরুষ বাঁচিয়ে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সলিতের অর্ধনিমীলিত দৃষ্টি একপলক কি দেখে তাকেসেই কঠিন চেহারায় একটু কি ভাবান্তরবাউনির মনে পড়ে না। সেই সুর যেমন আবেগ ধরে রাখেসেখানে কোনো ছন্দপতন নেই।

বাউনি অনেক রাত অবধি সেখানে বসে থাকে। অন্য কেউ কেউ গায়। তার তেমন ভালো লাগে না। মনের মধ্যে অস্থির চাঞ্চল্য। সেখানে ঈশ্বর কীর্তনের ঠাঁই কোথায়হরিসভার লোকেরা তার পরিচয় জেনে অনেক সমীহ করে। ভালো জায়গায় বসার ব্যবস্থা হয়েছে। তারপরও সে স্বস্তি পায় না। মনের ঘড়ি টিকটিক করতে থাকে। কখন তার দেবতা অন্তত কাছে এগিয়ে আসবে। হাত ধরে কথা বলবে। জিজ্ঞেস করবে সে কেমন আছে ইত্যাদি। আর হাজার মানুষের ভিড়ে সে হবে গর্বিত। অথচ কিছুই হয়নি। সব ভাবনাকল্পনা ব্যর্থ করে দেয় শেষরাতের ডাক। সেও তখন অনেকের মতো গভীরভাবে ঝিমিয়ে পড়েছিল। আশপাশে কোনো কোনো মহিলা বেঘোর ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও নাকডাকার মিহি শব্দ। সে কারও ডাকে চোখ মেলে তাকায়। দেখে কীর্তনদলের উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী। অদ্ভুত সুন্দর। দুচোখে মোটা কাজলরেখা। কপালে চন্দনের টিপ। তার দিক থেকে নাম না জানা সৌরভ ভেসে আসে। সে তাকে ইশারায় উত্তর কোনের ঘরে যেতে বলে। বাউনি বুঝে ফেলে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ। তখন মনের মধ্যে অদ্ভুত উত্তেজনা কম্পনঢেউ তোলে। সমস্ত পথ যে ভাবনায় আন্দোলিত ছিল সেগুলো ডালপালা মেলে বিস্তৃত হয়। সে ভাবেএবার লোকটিকে হিড়হিড় করে বাড়ি টেনে নিয়ে যাবে। বিয়ে করেছে দায়িত্ব নেইসে কয়টি দিন কাছে থেকেছেএবার কোনো কথাই শুনবে না। হরিনাম করো আর যাই করো কাছে থাকতে হবে। বাড়ি যেতে হবে। সে নিজ হাতে রেধে খাওয়াবে। সে কেন সংসারের সুখ থেকে বঞ্চিত হয়বাউনি কত কথা ভেবে নেয়। একবুক ভাবনা আর সুখস্বপ্ন নিয়ে ঘরে ঢোকে। অথচ সব চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সে কাঁদতে পারেনি। তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। বারবার শুধু অজানা অচেনা বিধাতার কাছে পরম অভিমানে প্রশ্ন করতে চায়। সে কি তবে শুধু রক্ত মাংসের পুতুলতার জীবনের সেই আরাধ্য পুরুষসেও কি না ক্ষুধার্ত বাঘের মতো তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে ঝাপিয়ে পড়বেসে কি এর জন্যই প্রতীক্ষা করেছিলএজন্যই এতদূর এসেছে?

বাউনি ভোরবেলায় একরকম বিধ্বস্ত বেশে বাসে উঠে পড়ে। তার নিজের দোষ। পুরুষমানুষ বুঝি সেরকমনিজের ভাবনা অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার করে নেয়। বিশ্বাস করে সেটি তার। সলিত কি তাকে একটু ভালবাসতে পারে নাসে তো তাকে কাছে টেনে নিয়ে যাবার জন্য এসেছিল। একটু বুঝতে চাইল না। বাউনির দুচোখ ঝাপসা হতে হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে কপালে কুচি বরফের মতো জমে ওঠা স্বেদপুঞ্জ আঁচলে মুছে ফেলে। চুল ঠিক করে নেয়। সিঁথির সিঁদুর কি ঠিক আছেনেই। বুঝতে পারে ঠিক নেই। সে লুকোচাপা আর্তনাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার কৈশোরের স্বপ্নসাধ সব ব্যর্থ হয়ে গেছে। সে তখন অনন্ত অভিমানে নীরবে নিজের বুক চাপড়াতে থাকে। মানুষ যে অন্যের কারণেও দুঃখী হতে পারেমন সে কথা জেনেও মেনে নিতে চায় না।

বাউনি জয়নন্দহাট থেকে বাড়ি ফিরে সিনেমার নায়িকার মতো দুঃখেকষ্টে বালিশ আঁকড়ে কেঁদে উঠেছিলপুকুরে ডুবে ভোররাতের ধর্ষণক্লান্ত শরীর ধুয়ে মুছে পবিত্র হতে চেয়েছেসলিত তার স্বামী। তাকে না বুঝে জোর করেসেও তো ধর্ষণ। তার ইচ্ছেঅনিচ্ছের কোনো মূল্য নেইআর সেই পরমপূজ্য স্বামীর শ্লেষবাক্য? ‘মাগি তুই থাকিবা পারিছু না?’ বাউনি সেসময় খুব অনায়াসে সেই নিষিদ্ধ উচ্চারণ করে বসে আর আকাশ অসম্ভব পাণ্ডুর হয়ে যায়।

শিহাব দৃষ্টি নামিয়ে দ্রুত প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করে। ভাবনাগুলো তাড়াতাড়ি এড়িয়ে যেতে চায়। কারও জীবনের এত গভীরে যাওয়া হয়তো অশোভন। কারও মনকে ভারাক্রান্ত হতে দেয়া উচিত নয়। সে দুঃখ জাগাতে আসেনি। তারপরও দুচোখ বাষ্পাকুল হয়ে পড়ে। এমন রাক্ষসও নারীর ভালবাসা পায়। এতে সেই মানুষ নয়গর্বিত সেই নারী যে তাকে ভালবাসে।

সেই ভালবাসার টানেই হয়তো সলিত একদিন ফিরে আসে। ততদিন পুনর্ভবার গভীর জলে অনেক ঢেউ বয়ে গেছে। বাতাস লক্ষহাজার দোলা দিয়েছে কচিধানের ডগায়। কত পাখি কিচিরমিচির করে আঙিনার ডালিম গাছে নেচেছে। অথচ যে শিশু উঠোনজুড়ে খেলে বেড়াবেতার কোমরের ডোরে সাতফোঁটা পাথর আর ঘুঙুর বেজে উঠবার কথালোকটির উন্মুখতৃষ্ণার্ত দৃষ্টি তাকে খুঁজে পায় না। উদ্‌ভ্রান্ত কোমল দুচোখ আদিঅন্তের দীর্ঘশ্বাসে সন্ধের আকাশে ব্যর্থ বিলাপ এঁকে দেয়। তার পাথর চেহারার কর্কশ দৃষ্টি গলে পড়ে। নেশা কেটে গেছে। অথবা একদিন মানুষ ফিরে আসে নিজ বাসভূমে। প্রিয় মানুষ সন্তানের মায়া পিছুটান দেয়। সেই মুখ আর দেখা হয় না।

সলিত কাজে মন দেয়। মানুষের ঊষরনরম ক্ষেতে লাঙল ধরে। কাদায় নেমে রোপন করে চারা। নিজ কাঁধে বয়ে নিয়ে আসে সোনালি ধান। আঙিনা ভরে উঠে। বাউনির আর দুঃখ নেই। কোনো অভিযোগদাবি নেই। প্রাণের মানুষ তার ঘরে এসেছে। মনজুড়ে প্রশান্তির বাতাস। সে হেঁশেলে ধান সেদ্ধ করে। ঢেঁকিতে ধান ভানে। দুজনে ভাঁপওঠা সাদা ভাতে প্রাণ জুড়োয়। তার শরীরে আবার জেগে ওঠে প্রাণের স্পন্দন। স্বপ্নজাগরণে কথা বলতে বলতেজলছবি দেখতে দেখতে কেটে যায় নির্ঘুম রাত। অথচ সেই ফসল আর আঙিনায় নামে না। সোঁদা মাটির বুকে নকশা কেটে গভীরে রেখে আসতে হয়। একে একে কতবারবাউনি কী করে?

গ্রামের দক্ষিণ কোনায় জাগ্রত শিবমন্দির। প্রাচীন সেই মন্দিরের মেঝে ফুঁড়ে আকাশের দেবলোকে উঠে গেছে বটবৃক্ষ। বিশাল সবুজের আচ্ছাদন। বিস্তৃত শীতল ছায়া। তার অনেক উঁচু শাখায় দুচারটি মৌচাক। অনেক বড় আকার। মানুষজন ভয়ে ওঠে না। একদিন সেই দুঃসাহসী কাজ করে বসে লোকটি। মন যে আর মানে না। যে প্রত্যাশায় সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছেছুড়ে ফেলে দিয়েছে সকল নেশাবন্ধুবান্ধবসরগমতাকে যে চাই। সে মৌচাক ভেঙে নিচে নেমে আসে। পারিজাত মধুঅমৃত। সেই সুধা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চামচে চামচে মানুষের হাতে হাতে তুলে দেয়। মানুষের চেয়ে বড় ভগবান আর কে আছেতাদের আশীর্বাদ ভিক্ষে চাই। তার বিষাদগম্ভীর মুখছবি কোনো অজানা পুলকে রহস্য ধরে রাখে। সেখানে হয়তো নিশ্চিত আনন্দের সূক্ষ্ম ছায়ারেখা। এবার নিশ্চয়ই ঈশ্বর মুখ তুলে তাকাবে। কিন্তু

বাউনির দৃষ্টিতে বিষাদের মেঘ নামে। একে একে ছয়টি মৃত শিশুর মুখ ভেসে উঠল কি স্মৃতির মণিকোঠায়সে দুচোখ মুছে স্বগতোক্তি করে, –

হয় বাবু সেই দুঃখে মোর মানুষটা কুঠি চলি গেইল কাঁয় জানে। কাঁহো কয় ভারত গেইছেকাঁহো কয় কুঠি মরি পড়ি আছে। কিন্তুক মুই জানো ওঁয় আসিবিএকদিন ঠিক ফিরি আসিবি। আর এইটা মোর বাউ। এককোনা মোর বাউমোর নিধুয়া।’

শিহাব আমগাছের ছায়া ছায়া আলোতে বাঁশের মোড়ায় বসেছে। হাতে দশ বারো পৃষ্ঠার খাতার মতো কোয়েশ্চনিয়ার। লিড পেনসিল। বাউনি সংকোচহীন কথা বলে যায়। কোয়েশ্চনিয়ারের সঙ্গে যার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। অন্য একটি প্রশ্ন করলে ওই প্রসঙ্গ এড়ানো যায়। সে তেমনকিছু করে না। একজন নারীর এতদিনের চাপা দুঃখকথা কিংবা ব্যর্থবিলাপ আজ কোন্‌ বিশ্বাস বা সুখে বেরিয়ে আসে কে জানেসে তাতে বাধা দেয় না। শিহাব আন্তরিকতার সঙ্গে সেই গল্প শোনে। প্রতিটি মানুষ একেকটি গল্প। কোনোটি কথিত কোনোটি অজানা। সেসব গল্প মূল্যবানজীবনের মতো দামি। সে শুধোয়, –

তোমার নিধুয়া বর্মণের রাতকানামানে আন্ধারশূলা আছে নাকিবুঝতে পেরেছ কখনো?’

তা তো কবার পারো না বাবুতয় মাসখানেক ধরি দেখঁ ছইল সাঁঝ লাগিলে খালি কান্দে আর এটাউটা হাস্‌তায়। হয় বাবু ওটাই হইচে। সারিবে তো বাবু?’

সেরে যাবে চিন্তা করো না।’

ওষুধ দেবেন না বাবু?’

না আমার কাছে ওষুধ নেই। আমি লিখে নিয়ে গেলাম। ওষুধ দিতে অন্য মানুষ আসবে। তবে এরমধ্যে পুঁইশাক মিষ্টিকুমড়া শাকসবজি ছোটমাছ এসব খাওয়াতে থাকো। সেরে যাবে। কোনো ভয় নেই।’

শিহাব সচেতনতা বিকাশের জানা বিদ্যে ঝেড়ে দেয়। তারপর উঠে পড়ে। নিধুয়ার ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে সামনে এগোয়। এখন অন্যকোনো একজনের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। সে প্রলম্বিত চিকন রাস্তার মধ্যখানে এসে শেষবারের মতো পেছন ফিরে গ্রামটি দেখে নেয়। তখনো ভাবনায় বাউনি বালার গল্প রিপ্লে হতে থাকে। শিহাব দেখে ধুলোমাখা নিধুয়াকে কোলে তুলে পরম স্নেহে দুগাল চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে এক মা। নারীর এই মাতৃরূপ কখনো ম্লান হওয়ার নয়। এখানেই জীবনের সকল সার্থকতা!

মধ্যরাতে শিহাবের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম হয়তো নয়গভীর তন্দ্রাঘোর। অস্থিরতায় আচ্ছন্ন মানুষ ঘুমোতে পারে না। সে উঠে বসে। আশপাশে নিথর নিস্তব্ধ নীরবতা। দূর হতে শুধু জল পড়ার শব্দ। টুপ্‌টুপ্‌টুপ্‌দুটি রুম পেরিয়ে বাথরুম। সেখানে কোনো এক লুজ ট্যাপ থেকে পানি পড়ছে। সেই শব্দতরঙ্গ বিরক্তির মতো বুকের মধ্যে জাগিয়ে দেয় উদ্‌বেলঅস্বস্তি। তার খারাপ লাগতে শুরু করে। কী করবে সেভেবে ভেবে কূল পায় না। অবশেষে ছায়াঘন অন্ধকারে মন বিহ্বল দীর্ঘশ্বাস ফেলে চমকে ওঠে। হাতড়ে হাতড়ে আস্তে দরজা খোলে। বাইরে আবছা আলোর রহস্যময় পৃথিবী। সে সম্মোহিতের মতো ধীরপায়ে মাঠের মধ্যখানে এসে দাঁড়ায়। পায়ের নিচে শিশিরভেজা ঘাস। আকাশে শুক্লপক্ষের সপ্তমী চাঁদ। অজানা নিশীথ গন্তব্যে হারিয়ে যাওয়া দীর্ঘ ছায়াপথ উন্মন দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে পড়ে।

কতক্ষণ কে জানেতার মন অসম্ভব ব্যাকুল হয়। অঞ্জলির করুণ দুটি চোখ ভেসে ওঠে। ছেলের মুখ। বারান্দার আলোআঁধারি কোনায় বৃদ্ধ বাবার অসহায় সেই বসে থাকা দৃশ্য স্পষ্ট হতে থাকে। আধভাঙা টেবিলের উপর দুহাত রেখে কাউকে শনাক্ত করার উদ্‌ভ্রান্ত চেষ্টা। নিশ্চুপ নির্বাক চাহনি। সে কি জীবনের সকল আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণতা নাকি মায়া কাটিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষাবাবার সাধ ছিলশিহাব ভালো চাকরি করবে। সংসারে এনে দেবে সচ্ছলতার স্বস্তি। যা তার নিজের জীবনে হয় নাইছেলের মধ্যে বাস্তব দেখতে পাবে। কিছু হলো না। সকল চেষ্টার পরিণতি শুধু দীর্ঘশ্বাস। নিয়ম করে চলতে শেখা সহজ মানুষের এইটুকু প্রাপ্তি। এই সমাজ যে অনিয়মের নিয়মে চলছে বুঝতে পারেনি সে। মেনে নিতে শেখেনি। এমন বোকা মানুষের এখানে কোনো স্থান নেই। আকাশে তাকিয়ে এই সকল ভাবতে ভাবতে তার ক্লান্ত দুচোখ বন্ধ হয়ে যায়। নেমে আসে অন্ধকার গহ্বর। বুক থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস নিস্তরঙ্গ বাতাসে ঢেউ হয়ে ভেসে যায়। বাবার জন্য কিছুই করতে পারল না সে। অক্ষম হতভাগা সন্তান।

সে ক্রমশ অব্যক্ত যন্ত্রণা আর অস্থিরতায় ডুবে যেতে থাকে। ইচ্ছে করে সকল কাজ ফেলে ছুটে যায় কোনো অজানা দূর গন্তব্যে। সে এই সমাজে সোনার চামচ আর রুপোর বাটি হাতে জন্ম নেয়নি। যোগ্যতার পরিচয় দিতে গিয়ে বারবার প্রহসনের শিকার হয়ে চলেছে। নিজের দোষে নয়সমাজ সংসারের শঠতা ও দুর্নীতির কাছে বারবার পরাজয়। তার সামান্যতম বেঁচে থাকাএকটু আনন্দময় সুখ রাতকানা হয়ে কোনো অলীক আশায় অন্ধকারে অবলম্বন হাতড়ে চলে। সে ভেঙে পড়া মানুষের মতো ভেজা ঘাসে শুয়ে পড়ে। দৃষ্টির সামনে সবটুকু জুড়ে অনন্ত মহাশূন্য এসে দাঁড়ায়। এর মধ্যে কোথায় ঈশ্বরতার বিচিত্র এই সৃষ্টির কোনো অর্থ আছে কিশুধু অবধারিত মৃত্যুর সীমারেখায় খণ্ডিত প্রত্যাশার ছোট ছোট স্বপ্নজালকারও দুঃখ আর কারও আনন্দময় জীবনের তথ্যায়নসে অঞ্জলি সন্তান আর বাবার জন্য নস্টালজিক হয়ে পড়ে। দুচোখে বারবার ভেসে ওঠে বাবার করুণ আদ্র চেহারা। বুকের গহিনে অস্থিরতার ডালাপালা ছড়িয়ে যায়। সে কিছু করতে পারছে না। সে অসহায় বোকা এক মানুষ। সমাজে তার কোনো মূল্য নেইঅপাঙ্‌ক্তেয় অস্তিত্ব মাত্র। মহাশূন্যের কুলকিনারাহীন সময়দিগন্তে সে একা।

একদম একাকা!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত