Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,puja 2021 bangla golpo naahar trina

উৎসব সংখ্যা গল্প: স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট । নাহার তৃণা

Reading Time: 4 minutes

 

আমি এ যুগের হরিপদ কেরানী। আমার গ্রামের ঠিকানা আপনারা জানবেন না। কিন্তু আমার শহরের ঠিকানা আপনারা চেনেন। শহরে নিন্মবিত্তদের জন্য তৈরি অগুনতি খুপড়ির একটিতে আমি থাকি। একা থাকি না, সাথে মা থাকে, বউ থাকে, সন্তান থাকে, ছোটো দুই ভাই থাকে। বাবা বেঁচে থাকলে তিনিও থাকতেন। সুমনের ‘দশফুট বাই দশ ফুট’ গানটি শুনেছেন?  ছাত্রজীবনে শুনেছিলাম। এখন আমি সেই দশ ফুট বাই দশফুট ঘরে থাকি। সবাইকে নিয়ে। বিশ্বাস হয় না? না হবারই কথা। কারণ আপনারা এরকম জীবন দেখেননি।

আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেছি ইতিহাসে। পাশ করে চাকরি পেয়ে গেছি তিন মাসেই। তার আগে টিউশানি করে সংসার চালাতাম। তখন বেড়ার একটা বস্তি ঘরে থাকতাম। চাকরি পেয়ে উন্নত বাসায় চলে আসি। হ্যাঁ আগের চেয়ে খুব উন্নত এই বাসা। ঝড় বৃষ্টি বাদলায় না ঘুমিয়ে চৌকির উপর বসে থাকতে হবে না আর। একটা পাঁচতলা দালানের তিন তলায় দশ ফুট বাই দশফুট একটা ঘর। সাথে লাগোয়া রান্নাঘর আর বাথরুম। গ্যাসের লাইন আছে। সপ্তাহে তিন দিন পানি আসে লাইনে। আর কি চাই। ভাড়াও নেহায়েত খারাপ না। ৩৫০০ টাকা। আর একশো টাকা দিলে ডিশের লাইনও দেবে। কিন্তু আমার টিভি নেই, ডিশ কি করবো। যখন চাকরিতে ঢুকি তখন ৮০০০ টাকা বেতন। দুবছরে বেতন বেড়ে ১০০০০ ছুঁই ছুঁই করছে।

যখন ভার্সিটিতে ঢুকি তখন স্বপ্নে দশ হাজার টাকার একটা চাকরি ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। বাস্তবে বছরে ১০% হারে মুদ্রাস্ফীতি যোগ হলেও স্বপ্নে তার কোনো ছাপ পড়েনি। আমার স্বপ্ন সফল হতে তাই কোনো অসুবিধা হয়নি। আমি যখন স্বপ্ন দেখছিলাম তখন বাবার দোকানটা ছিলো, দোকানের আয়ে সংসার চলতো ফুরফুর করে। আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতাম দশ হাজার টাকার একটা স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্নে ছিলাম কেবল আমি আর সুনন্দা। আমাদের দুজনের একটা সংসার, ফুটফুটে একটা বাচ্চা।

কি অবাক কাণ্ড দেখুন, আমার সেই স্বপ্নটা কেমন হুবহু পূরণ হয়ে গেলো! শুধু একটা পার্থক্য। তিন বছর আগে হুট করে বাবা মারা গেলে আমার স্বপ্নের সংসারে ঢুকে গেলো মা আর দুইভাইও। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের মধ্যে ছিলো ছাপ্পান্নো হাজার টাকার একটা ঋণের বোঝা। সাড়ে তিন বছরের টিউশনির জমানো টাকা থেকে বোঝাটা হালকা করেছি। ফলে যখন চাকরিতে ঢুকি তখন ঋণমুক্ত।

চাকরির এক বছরের মাথায় সুনন্দাকে বিয়ে করতে হলো। ভাবছেন সুনন্দাকে কেন বিয়ে করতে হলো এরকম চাপাচাপি সংসারে? উপায় কি বলুন, না করলে তো সে চলে যেতো অন্য ঘরে। “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো….”..বলে কাঁদলে কোনো লাভ হতো না তখন। 

সে যাই হোক, আমি কেবল চাকরিটা আছে বলেই সন্তুষ্ট। সুনন্দা, ছোট্ট বাবু, মা, দুই ছোটো ভাই, এদেরকে নিয়ে একটা ছাদ দেয়া ঘরে বাস করতে পারছি এতেই সুখী। আমি যেখানে কাজ করি সেটা বাসা থেকে দুই মাইল দূরে। রিকশায় গেলে বিশ টাকা, বাসে গেলে পাঁচ টাকা। আমি হেঁটেই যাই। ঝড় বাদলার দিনে একটু অসুবিধে হয়। তবু ভেবে সুখী হই দুই কায়দায়। রিকশায় না গিয়ে বাঁচলো মাসে পাঁচশো টাকা। বাসে না গিয়ে বাঁচলো দেড়শো টাকা। ভাবছেন অভিনব সুখপন্থা? আসলে পাঁচশো টাকায় মায়ের ওষুধের খরচ উঠে যায়, দেড়শো টাকায় মাসে একবার রুই মাছ কিংবা মাংস খেতে পারে পরিবার। সুনন্দা যদি কোনো চাকরিতে ঢুকতো সংসারে এতটা টানাটানির অবস্হা হয়ত থাকতো না। কিন্তু সংসারের সবাই একই রকম নয়; সুনন্দা কেবল গুছিয়ে সংসার করতে চায়। এইটুকুই ওর চাওয়া। বেচারিকে কেন সেই সুখ থেকে বঞ্চিত করি।

আমরা সাধারণত নিরামিষভোজী। মাছ মাংস তেমন ছুঁই না। শাক, ভাত, ডাল- এই তিনে চলে যায়। শরীরের জন্য তেল ক্ষতিকর, তাই আমরা তেল খুব একটা কিনি না। চিনি খেলে মায়ের সুগার বাড়ে, তাই চিনিও মোটামুটি বাদ। আমরা চা নাস্তা করি না। তবে মেহমান আসলে একটু বিপদে পড়ে যাই, তাই আমি কাউকে বাসায় আসতে বলি না। বাবুর জন্মের পর বিপদে পড়েছি খানিক। খরচপাতি বেড়ে গেছে। সুনন্দা ট্যা ট্যা করে বাবুর জন্য দুধ কেনা দরকার, বাইরের খাবার না খেলে শরীর বাড়বে না। আমি চুপ করে থাকি। করার কিসসু নাই। আমার বাজেটে বাড়তি সুযোগ আছে কি? হিসেবটা দেখুন- দৈনিক তিন বেলা খাবার পেছনে দেড়শো টাকা লাগে, পুরো মাসে সাড়ে চার হাজার। খাওয়া ঘর ভাড়া বাদ দিলে বাকী থাকে দুই হাজার। দুই ভাইয়ের স্কুলের খরচ আটশো টাকা। বইখাতা পেন্সিল কলম বাবদ আরো দুশো। মায়ের ওষুধপত্র, বাথরুমের সাবান, টুথপেস্ট এসবে লাগে আরো চার পাঁচশো টাকা। দশ হাজার টাকার হিসেবটা তো প্রায় খতম, আর বাড়তি কোথায় পাই। বাবুটাকে আমাদের তিন পদে অভ্যস্ত করতে বলি।

তবে হ্যাঁ কেউ যদি অবিবেচকের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন বিপদ। তেমন বিপদ মাত্র একবার ঘটেছিল গত বছর। ধার করে এরকম বিপদ সামাল দেয়া যায়, কিন্তু তেমন ধার শোধ করতে অপেক্ষা করতে হয় বছরের ঈদ বোনাসের সময় পর্যন্ত। হ্যাঁ ঈদের সময়টা খুব আনন্দের। ওই একটা দিন আমরা নিরামিষভোজী থেকে বেরিয়ে আসি। জামা কাপড়ে ব্যয় কমিয়ে একদিন একটু ভালো খাই। অতিথি সেবা করি। ওই্ একদিনের পোলাওয়ের স্বাদ আমাদের নস্টালজিক করে দেয়। বাবার আমলে আমরা মাসে দুয়েকবার এমন খেতে পারতাম।

এই দেখেন কেবল খাওয়াদাওয়া নিয়েই আছি। বাসস্থানের দিকে নজর দেয়া হলো না এখনো। চলুন বাসস্থানের গল্প করি। আগেই বলেছি দশফুট বাই দশফুট। বাবা মারা যাবার পর আমরা যখন বস্তিতে চলে যাই তখন একটা চৌকি বাদে আর সব আসবাব বিক্রি করে দিয়েছিলাম। জায়গা নেই রাখবো কোথায়? বস্তি ছেড়ে এখানে আসার সময় চৌকিটাও বেচে দিয়েছি দুইশো টাকায়। চৌকি থাকলে বরং এখানে শোবার অসুবিধা। এখন মাদুরের উপর কাঁথা বিছিয়ে তার উপর বিছানার চাদর পেতে পাশাপাশি দুটো বিছানা তৈরি করি রাতে শোবার আগে। এক বিছানায় আমি সুনন্দা আর বাবু। অন্য বিছানায় মা আর দুই ভাই। আমরা ম্যানেজ করে নিয়েছি। করতেই হয়। অসুবিধা হয়নি।

এই দালানে মোট ৫৫টি খুপড়ি ঘর। বড়লোকেরা এরকম জিনিসকে বলে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। শখ করে কিনে বিদেশে এমনকি কক্সবাজারের সৈকতে। আমাদের এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসি নেই। টিভি, ফ্রিজ নেই। এমনকি খোলা জানালার আকাশও নেই তবে বৈদ্যুতিক আলো আর ফ্যানের বাতাস আছে। তবু এখানে আমি সুখী। কেননা সুনন্দা আমাকে অভিযোগ করে না। মা আমাকে অভিযোগ করে না, ভাইয়েরা অভিযোগ করে না। ওরা জানে আমি সীমাবদ্ধ। প্রবল প্রবল সীমাবদ্ধতা আমার হাত পায়ে সমস্ত শরীরে। ওরা তাই দিনের পর দিন একই রঙের শাক ভাত আর ডাল খেয়ে কাটিয়ে দেয়। বাবুটা মাত্র ছ’মাস, সে এখনো বোঝে না দুনিয়ার হালচাল। তার চোখে হয়তো গোটা দুনিয়াটাই আলোবাতাসহীন একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট।

আমি যেখানে কলম পিষি, সেখানে দুপুরে খাবার মেলে। এক সাথে কয়েকশো মানুষের খাবার রান্না হয়। ভাত আর ডাল যত খুশি খাও, সবজি মাছ মাংস ডিম যে কোনো একটা এক বাটি করে। আমার সামনে যখন মাছ মাংসের বাটি আসে, ইচ্ছে করে ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে মাছ বা মাংসের টুকরোটা কাগজে মুড়ে ঘরে নিয়ে যাই। কিন্তু আমার আশেপাশে যারা বসে তাদের সবাই স্বচ্ছল ঘরের সন্তান। তাদের পাশে বসে এই কাজ করা যায় না। ওরা কেউ জানে না আমি কেমন জীবন কাটাই। আমার মুখোশকেই সত্যি মনে করে ওরা। জানি ওরাও দশ হাজার টাকাই বেতন পায়, কিন্তু ওই টাকার উপর ছ জনের একটা পরিবার নির্ভর করে না।

আমি খুব টানাটানি সংসারী? কথা সত্যি। তবে আমার দশ হাজার টাকাকে কখনো কখনো যখন বেশি টানটান মনে হয় তখন আমি আরেকটু নীচের দিকে তাকাই। নীচের ফ্লোরে রঙিন জামা পরা মেয়েগুলো মাসে চার পাঁচ হাজার টাকার বেশি পায় না। তবু ওদেরকে কোনো কোনো সময় আমার চেয়েও বেশি হাসতে দেখি। ওই হাসির পেছনেও কি কষ্টের নহর? জানি না। ওদের কষ্টের কথা ভেবে সমবেদনার বদলে বরং সুখী হয়ে উঠি আবার।

সন্ধ্যে ছটার পরে কাজ থাকলে একটা ছোটো বিস্কুটের প্যাকেট আর একটা কলা দেয় আমাদের। এই দুটো জিনিস পকেটে করে বাড়ি নিয়ে আসতে কষ্ট হয় না আর। কলাটা মাকে দেই, মা অর্ধেক দেয় সুনন্দাকে, বিস্কুট সবাই একটা করে খাই। তখন আমরা সবাই খুব হাসি এক সাথে হাসি, যেন আমরা আসলেই সুখী নগরীর বাসিন্দা।

এই পাঁচ তলা দালানের ছাদের উপর দিয়ে হু হু বয়ে যাওয়া বাতাসে বিনে পয়সার সুখ। কোনো কোনো রাতে ছাদে উঠে সেই সুখ স্পর্শ করি। সুখের আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলি অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভুলে। প্রতিদিন একটা পুরোনো ঘ্রাণের নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠি এই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে।

One thought on “উৎসব সংখ্যা গল্প: স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট । নাহার তৃণা

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>