| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: লকডাউনে ভাটিরদেশের নরেন । নিরঞ্জন মন্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিদেশ-বিভুইয়ে এমন বিপদে পড়ড়ে হবে কোন দিন ভাবতে পারেনি নরেন। সুন্দরবন  এলাকা থেকে  বউ-ছেলে নিয়ে তামিলনাড়ুতে কাজ করতে এসেছে। গেঞ্জিরখানায় ওরা দুজনে কাজ পেয়েছে।সপ্তায় সপ্তায় মালিক টাকা দেয়।মালিকের দেওয়া ছোটঘরে থাকে। সরকার হঠাৎ করে গাড়ি ঘোড়া বন্ধ করে লকডাউন ঘোষনা করেছে। খবর এসেছে করোনা ভাইরাস মারাত্বক ছোয়াছে রোগ।দিল্লী, বোম্বাই কলিকতা সব জায়গায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।সরকার থেকে কলকারখানা অফিস কাছারি, গাড়ি ট্রেন সব বন্ধ করেছে।নরেন শুনেছে এই রোগটা নাকি চীন থেকে বিলেত আমেরিকা হয়ে এদেশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। হরেন ওদের গ্রামের নিতাইকে ফোন করে।নিতাই চেন্নাইতে কাজ করে,ওকে সব খবরাখবর দেয়।

   লকডাউনের আজ এক সপ্তাহ হল। নরেনের মালিক আর মাহিনে দিতে পারছে না।বিনা ভাড়ায় ঘরে আর থাকতে দিতে চাইছে না।নিতাই ফোন করে বলে ‘নরেন আজ বেরিয়ে পড়, না হলি ঝামেলায় পড়বি।আমাগো ওদিকির লোকজন সকুলি বারিয়ে পুড়েছ।তুগো সঙ্গে চেন্নাইতে দেখা হবে’।নরেন বউ ছেলে নিয়ে  পিকয়াপ  ভ্যানে চেন্নাইতে এসে নিতাইদের সঙ্গে দেখা করে।এবার ওরা একসঙ্গে রেল লাইন ধরে হাটতে থাকে।নরেনের বাড়ি সুন্দরবনের সাতজেলিয়ার কাঁকমারি গ্রামে গাঁড়াল নদীর  ধারে । মা নেই, বাবা গত বছর জঙ্গলে মধু ভাঙতে বাঘের কবলে পড়েছিল।কবছর আগে আয়লার প্রবল ঝড় আর জলোচ্ছাসে নদীবাঁধ ভেঙে নোনা জলে ঘর বাড়ি সব ভেসে   গিয়েছিল।সেইধাক্কা আজও ওরা কাটিয়ে উঠতে পারে নি।মাটিতে নুনের ভাগ বেড়ে যাওয়ায় ধান আর ভাল হয় না।গরমের সময় জমিতে আগে লঙ্কা তরমুজ,কুমড়োর চাষ হত,এখন নোনতা মাটিতে ওসবের আর চাষ হয় না।নরেন নিতাইদের তাই কাজের খোজে বাহিরে বেরুতে হয়। এভাবে সুন্দরবনের অভাবী মানুষ দিল্লী, চেন্নাই মুম্বাই সব জায়গায় কাজের সন্ধানে যেতে হচ্ছে।        

  পথ আর ফুরাতে চায় না।দুদিন হয়ে গেল। নরেনের বউ সবিতা বলে, ‘আর কত হাটতি হবে? পায়ের জুতোটাও তো ছিড়ে গেল।পায় ঠোলা কাইটে উঠতেছ, এর পর রক্ত বারাবে। ছাবালটা তো আর হাটতি পারতেছ না,আট বছরের ছাবাল তুমি আর কত সময় কোলে করে হাটবে?’ 

ওদের সঙ্গী নিতাই বলে ‘আমার চাকা লাগানো ব্যাগের উপর তোমার ছাইলেডা বসাও,তোমার ভারী ব্যাগটা আমারে দেও, তুমি ছাইলের নে ব্যাগটা টেনে টেনে আগিয়ে যাও’।ট্রেন লাইন ও পাশের রাস্তা দিয়ে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক হেটে চলেছে। খবর এসেছে মালগাড়ির ধাক্কায় বেশ কয়েকজন শ্রমিক মারা গেছে।চারিদিকে একটা আতঙ্কের পরিবেশ। ছেলেটা আর বাক্সের উপর বসতে পারছে না। নরেন এবার ছেলে ঘাড়ে তুলে হাটতে থাকে।

 ওদের টাকাও ফুরিয়ে আসছে।রাস্তার পাশের দোকানে রুটি তরকারি আধপেটা খাইয়ে ওদের পথ চলতে হচ্ছে।তৃতীয় দিনে হাওড়ায় পৌছে পরদিন অনেক কষ্টে গদখালির খেয়া ঘাটে পৌছে দেখে লকডাউনে খেয়া বন্ধ। মাঝিকে হাতে পায়ে ধরে,ওরা অতি কষ্টে বাড়ি পৌছায়।করোনার সংক্রামণের ভয়ে ওদেরকে বেশ কদিন স্কুলবাড়িতে থাকতে হয়।               

 নরেন ভেবেছিল গ্রামে এসে কাজ পাবে, কারন চলে আসার সময় লকডাউনের জন্য কারখানার মালিক টাকা দিতে পারে নি।মাঠে এবার গরমের চাষ হয়নি,লকডাউনে অন্য কাজ ও বন্ধ।নরেন আর ভাবতে পারছে না, দোকানে ধার কর্জ করে কতদিন চলবে। এর  মধ্যে আর এক বিপদ এসে হাজির হয়।কদিন ধরে আকাশটা মেঘলা,উল্টোপাল্টা হাওয়া দিচ্ছে। আজ সকালে নিতাই ও পঞ্চায়েতের লোক এসেছিল।

ওরা বলল, ‘খবর হুয়েছ, সাগরে ‘আম্ফান’ নামের ঝড় আসছে, আমাগ এলাকায় খুব ক্ষতি হবে।তোমাগ সকুলির এক্ষুনি ফ্লাডসেন্টারে যাতি হবে’।নরেন এ এলাকার ঝড়ের গতি প্রকৃতি জানে।

ওর বউ সবিতা বলে ‘দ্যাবতার গতিক ভাল না, সারাদিন আকলা মেঘলা কুরতেছ, হাবা ও জোরে জোরে হচ্ছে।আয়লার মতন নোনাজলে টেপা মাছের মতন ভাসতি না হয়।চল, তাড়াতাড় ওদিকি টাইনে গে উঠি’।

নিতাইএর সঙ্গে ওরাও পরিবারের সবাইকে নিয়ে ফ্লাডসেন্টারে চলে আসে।দুপুরের পরের থেকে ঝড়ের তেজ আরও বাড়তে থাকে।গাঙে ভাটা লেগে আবার জোয়ার আসে।জড়ের তান্ডবে নদীবাঁধ ভাঙে, নোনাজলে, বাড়িঘর ভেঙে সব একাকার হয়ে গেল। নরেনের বসবাসের খোড়ো দোচালা ঘর ও উলটে গেল। নরেন ভাবতেই পারিনি একটা বিপদ থেকে আর একটা চরম বিপদের মধ্যে পড়তে হবে। ঝড়ের পরে সরকারি ও বাহিরের লোকজনের সাহায্যে কাপড়চোপড় শুকনো খাবার ত্রিফল,ওষুধপত্র এসব ওরা পেয়েছিল।থাকার ঘরটা অনেক কষ্টে খাড়া করে ত্রিপল দে ঢাকতি   পেরেছিল।সরকারী রেশনে আর কতদিন চলে? জঙ্গলে মধু ভাঙার সময় ও এসে গেল, তবু লকডাউনে বনের পাশ বন্ধ। বনে যাবার হুকুম নেই। এত বিপদের মধ্যে পেটের ভাতের যোগাড় কিভাবে হবে নরেন ভেবে পায় না। নিতাইয়ের ও একই অবস্থা।আজ বিকেলে নরেন গাড়াল গাঙের জেটিঘাটে নিতাই আর পুবপাড়ার হারানকে ডেকেছিল।                                                                                 

         নরেন বলে, ‘আর কতদিন উপোষ কাপোষে এরাম কুরে মরবো? কাঁকড়ার ভাল দাম আছে, চল বেপাশে কদিনির জন্নি বাদায় কাঁকড়া মারতি যাই’।        ‘   ‘নরেনদা, বাদার ভাবগতিক তো ভাল না।মাল খুব গরম।লকডাউনির মধ্যি গত মাসে কাঁকড়া মারতি,আর মধু কাটতি গে মোল্লাখালি, সাতজেলের চরঘেরি, কুমিরমারির মিদ্দেরগো ঘিরি, আর বালির মোট পাঁচজন বনে পুড়েছ।লকডাউনি বনে বোধ হয় হরিণ শোর কুমে যাছে, এজন্নি বড়মিঞা মানুষ ধরতেছ। আবার খবর আসটেছ, বাদায় নামার সবিল দেচ্ছে না, তার আগে নৌকেরতে নাকি লোক ধুরে নেচ্ছে, আবার কোন জাগায় মুন্ডুটা বড়শেয়াল নে যাচ্ছে,দলের লোকেরা বনকরার ধড় নে বাড়ি আসটি হচ্ছে।এবার তোমরা কি করবা,ঠিক কর’। নিতাইয়ের কথায় হারান উত্তর দেয়,

‘বনের কামাই আনতি গিলি বড়মিঞার ভয় করলি চলবে? প্যাটে দুটো দে জানটা  তো বাঁচাতি হবে। খটিদার বাবুলাল টাকা দাদনদে কাঁকড়া মারতি যাবার কথা বুলে লোক পাঠিয়েছে।অনিল বাছাড় নৌকোনে আমাগ সঙ্গে যাবার কথা বুলেছে’।

আবার নরেন বলে, ‘প্যাটে গামছা বাইধে আর কদিন থাকপো? চল মা বনবিবির নাম কুরে কাঁকড়া মারতি যাই আমাক সঙ্গে বাউলে গুনিন নি, দয়ার মা বনবিবি আমাগো ভরসা’।

সবাই নরেনের কথায় রাজি হয়।বাড়িতে আসলে সবিতা সব শুনে বলে ‘বনে পড়া এত লোকের কথা সব জেনে শুনে তবু  বাদায় যাবা?আমাগ কি রাস্তায় বসাবা?’ বউয়ের কথায় নরেন উত্তর খুজে পায় না।পরে বলে ‘এই লকডাউনি কার কাছে হাত পাতবো? কেরা আমাক দুটো নুন ভাত যোগাবে? আমাক মত দুখী মানষির জেবনের কি দাম আছে?’

আজ সকাল থেকে রোদের তেজটা বেশী, মেঘশুন্য আকাশ, গাঁড়াল গাঙের ওপারে ঘন সবুজ বাদাবন।সারা পৃথিবী জুড়ে মারণ করোনা ভাইরাসের কালো ছায়া, তবু  আদিগন্ত এই প্রকৃতির রাজ্যে কোথাও তার চিহ্ন চোখে পড়ে না।আজ কৃষ্ণা    দ্বাদশীর ভরা জোয়ারে জল গাংভেড়ির গোড়ায় এসে গেছে। অনিল বাছাড়ের নৌকা ঘাটে লাগান হয়েছে। নরেন, নিতাই, হারান , আনিল সবাই নৌকায় উঠেছে।নৌকোর গলুই মাথায় সিঁন্দুর মাখিয়ে লাল কাঁচা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। প্রদীপ জ্বালিয়ে ধূপ ধরিয়ে মা বনবিবির নামে হাজোত দেওয়া হয়েছে।কাঁকড়া ধরার দোনে আজ্জে মাছের চার বেঁধে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।দুফুট বাঁশের কঞ্চির মাথায় সরু দড়িতে চার বেঁধে কাঁকড়া ধরার থোপা, সব সাজিয়ে নৌকোয় রাখা আছে। নরেন  অনিলকে বলে ‘ মাঝি, ভাটি লাগলি নৌকো ছাড়তি হবে।আমরা বাঘনার কাছে ঝিলের জঙ্গলের  চিলমারীর খালের দিকি যাব’।

গাংভেড়ির ধারে নরেন নিমাই নিতাই এর বউরা সব ভিড় করে।নিতাই এর বউ সবিতা কে বলে,‘এই লকডাউনি বাদায় খুব লোক পুড়তেছ,হরেন বউ ওর ফোনে বনে লোক পড়া ছবি দেখিয়েছে।মোল্লাখালির রবিরামের লাশ বনেরতে নে আইসে কলাবাগানে পুড়িয়ে দেছে।ওরা বেপাশে বনে গেলো।জানাজানি হলি বন  অফিসির লোকেরা কেস দ্যাবে, এজন্নি ওরামাভায় লাশ পুড়িয়েছে ।সব লোক বলা বলি কুরতেছ,  বড়শেয়াল  বনে আর নাবতি দেচ্ছে না, নৌকেরতে বনের লোক ধুরে নেচ্ছে’।সবিতার এসব খবর শুনে,চোখের জল গড়িয়ে পড়ে,আর বলে,  ‘প্যাটের জ্বালায় তো যাতি হচ্ছে। আমাক মা বনবিবি ভরসা,মার দয়া হলি বাঁইচে  ফিরে আসপে,না হলি কপালে যা থাকে তাই হবে’।

ভাটার টান বেড়ে যায়।নরে্নের মাঝি অনিল নৌকা ছেড়ে দেয়। কোটালের স্রোতের প্রবল টানে নৌকা এগিয়ে যায়। পেটের টানে সুন্দরবনের এসব দলিত অবহেলিত জেলে মৌলে কাঁকড়ামারারা করোনার মারণ সন্ত্রাসের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর এক  বিপদের দিকে এগিয়ে যায়।

          

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত