| 13 নভেম্বর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা: গল্প: সম্পর্ক । নভেরা হোসেন

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

ধানমন্ডি লেকের পারটা দিন দিন লোকে লোকারণ্য হয়ে যাচ্ছে , পুরান ঢাকার কিছু এলাকা যেমন লোকে গিজগিজ করে , পা ফেলার জায়গা থাকেনা তেমন । রোজ সকালে এখানে হাঁটতে আসি খুব ভোরে, অফিসে পৌঁছাতে হয় নয়টার মধ্যে । ঘুম থেকে উঠতে হয় ছয়টায়। এক ঘন্টা হেঁটে এসে গোসল সেরে নাস্তা , উবার ডাকা এসব করতে হয় । কখনো সাড়ে নয়টা বেজে যায়। পুনম সারাক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসবা। অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে আসবা, কোনো টালটি -বাল্টি চলবে না , কোনো বন্ধু -ফন্ধু এসব চলবে না , যা করেছো বিয়ের আগে করেছো , এখন সেসব দিন ভুলে যাও। আর তোমার যেমন স্বভাব খালি মেয়েপ্রীতি , এসব বাদ দাও ।

আমি যে সারাদিন ওই চিন্তায় বিভোর থাকিনা এটা পুনম কিছুতেই বুঝতে চায় না। ওর ধারণা অফিসে বসে আমি সারাদিন অনলাইন চ্যাট করি না হলে লাঞ্চ আওয়ারে এক্স -গার্ল – ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করি। এটা যে খুব বেশি অসম্ভব তা নয় , আমার প্রাক্তন কাজলের বাসা অফিসের কাছেই । প্রথম প্রথম কাজল মেসেঞ্জারে দেখা করার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে , আমিই ওকে এভয়েড করেছি , বলেছি অফিসে কাজের চাপ , তাছাড়া এখন আমরা যদি আবার দেখা করতে শুরু করি তাহলে সেটা আমাদেরকে আবার কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে । কাজল আর আমার সম্পর্কটা হয়েছিল খুব ঝোঁকের মাথায় , তখন মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে শহীদ মিনারের পাশে এনএক্স ভবনে । অঙ্কশাস্ত্রে পড়লেও আমার আগ্রহ ছিল লিটারেচারের প্রতি । প্রায়ই কলা ভবনে যেতাম , আড্ডা দিতাম ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদের সাথে । কাজল জার্ণালিজমে পড়তো ক্লাসের ফাঁকে আসতো হাকিম চত্বরে । ইংরেজির মামুন ছিল দারুন স্মার্ট , মামুনের সাথে কাজলের খুব বন্ধুত্ব । কাজল ছেলেদের সাথে মিশতো খুব সাবলীলভাবে । তখনকের সময়ের ছেলে – মেয়েদের মেলা মেশায় একটু দূরত্ব ছিল । বন্ধুত্ব হলেও দূরত্ব বজায় থাকতো । কাজল ছিল ব্যতিক্রম । টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত মেয়েদের মতো জীবন যাপন করতো না , চিন্তা ভাবনাতেও ছিল অগ্রসর , আধুনিক সাহিত্য ছিল ওর সঙ্গী , স্মোক করতো , ঘুরতো অনেক রাত অব্দি । ওর কোনো বিশেষ বন্ধু ছিল বলে মনে হতো না । তখন খুব জার্মান কালচারাল সেন্টার আর এলিয়াস ফ্রাসিসে গিয়ে ছবি দেখতো অনেকেই । আমিও যেতাম মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে । ওখানেই কাজলের সাথে প্রথম আলাপ , কফি রঙের একটা পাঞ্জাবি আর জিন্স পড়া ছিল , খুব অ্যাডভান্সড । কিন্তু কেমন একটা বিষন্নতা ঘিরে ছিল ওর চোখ জুড়ে ।
বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো উচ্ছসিত ভঙ্গিতে আবার মাঝে মাঝে চুপ । দূরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছিল । ইংরেজির মামুন কাজলের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো । কাজল একটু হেসে ঘাড় নাড়লো , তারপর আবার দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলো । আমি একটু যেচেই জানতে চাইলাম , কাজল আপনি কি ইংলিশ এর ছাত্রী ? না জার্নালিজম, কাজল এতক্ষনে আমার দিকে একটু মনোযোগ দিলো।
আর আপনি ?
আমি অঙ্কশাস্ত্র
শুনে কাজল কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো । আমি বললাম কেন ম্যাথের ছাত্র সিনেমা টিনেমা দেখে না নাকি।
মুচকি হেসে কাজল বললো , না ম্যাথে আমার দারুন এলার্জি । সব সময় ম্যাথকে এড়িয়ে চলেছি ।
এরপর কাজলের সাথে বহু কথা চলতে লাগলো । কাজলের ভালো লাগা , মন্দ লাগা , ওর স্বপ্ন সব একটু একটু করে আমার স্বপ্নের অংশীদার হয়ে উঠলো । এভাবে কয়েক বছর চললো । কাজল আর আমি একদিন না দেখা করে থাকতে পারতাম না । কাজল চমৎকার সব কবিতা লিখতো , ওর লেখার হাতটা দারুন ,একদম ফরাসি বোহেমিয়ান কবিদের মতো । বহুদিন আমরা শুধু কবিতা পড়ে কাটিয়ে দিতাম , ওই সময় ওর একটা বইও বেরিয়ে গেছে , এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করে ফেলেছিলো সেই সময় । কিন্তু সেই সময় একটা এক্সিডেন্ট ঘটলো , কাজলের মা স্ট্রোক করলো । ওকে খুলনার বাড়িতে ডেকে পাঠানো হলো । কিভাবে কি হলো জানি না , খুলনা যাওয়ার পর কাজলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না । হঠাৎ রাস্তায় কাজলের মামাতো ভাইয়ের সাথে দেখা । ছেলেটি বললো খুলনা যাওয়ার পর কোনো এক ডাক্তার ছেলের সাথে ওর আকদ হয়েছে । কাজলের মা অসুস্থ অবস্থায় মেয়েকে ডেকে নিয়ে এ বিয়ের আয়োজন করেন। কাজল পরে ঢাকায় এসে আমার সাথে দেখা করে বলে , ও যাওয়ার আগেই বাড়িতে সব ব্যবস্থা করা ছিল , ওর কথা কেউ শুনছিলো না , কাজল ওর বড়ো বোনকে আমার কথা বলে কিন্তু এরকম একজন ফুল টাইম বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা ওরা চিন্তাও করতে পারে না । কাজল যখন ঢাকায় এসে আমাকে ওর বিয়ের কথা বললো তখন ওকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল । এতদিনকার চেনা কাজল যেন মুহূর্তে বদলে গেছে । আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলো না । ওর কাছে পারিবারিক মূল্যবোধ এত বড়ো আমার কল্পনাও ছিল না । ও কেন নিজের মতামতটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলো না আমার বোধগম্য নয় । একটা খবর পর্যন্ত জানালো না । আমি জানলে ওর বাড়িতে গিয়ে কথা বলতাম যাই হোক এরপর বহু বছর প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছি । বায়িং হাউসে চাকরি নিয়ে চুপচাপ দিন পার করেছি । কাজলের ব্যবহার আমাকে বিমূঢ় করে তুলেছিল । দিন রাত সিগারেট খেতাম , ড্রিংকসও করতাম প্রচুর, একটু বেপরোয়া জীবন যাপন করতে লাগলাম । কাজল মাঝে মাঝে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো । আমি এভয়েড করতাম কারণ কাজল ছিল আমার কাছে একটা নেশার মতো । ওকে যত পান করতাম ততই তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠতাম । এটা এমন নয় যে শুধু শারীরিক , কাজলের সাথে কথা বলতে দারুন আকর্ষণ বোধ করতাম , ওর প্রতিটা ভঙ্গির একটা বাঙময় রূপ ছিল । এটা আর কোথাও পাওয়া যাবে না । নিজের মনের মধ্যে হাহাকারের পাহাড় জমে উঠছিলো । একটা মানুষ অবলীলায় আরেকটা মানুষকে ছেড়ে চলে যেতে পারে , দিনের পর দিন বছরের পর বছর একই চিন্তা , একই অনুভূতি শেয়ার করে হঠাৎই আতশবাজির মতো মিলিয়ে যেতে পারে এটা ভাবা যায় না । যাই হোক এসব নিয়ে এখন আর ভাবতে চাই না । পাস্ট ইজ পাস্ট এন্ড পাস্ট ফরএভার । কিছুদিন ধরে অফিসার কাজে ভীষণ ব্যস্ত , ছোটাছুটি করতে হচ্ছিলো । এর মধ্যে হঠাৎ একদিন মেসেঞ্জারে খুব বিষন্ন অবয়বের একজনের মেসেজ পেলাম । মেয়েটি চল্লিশোর্ধ চোখের নিচে কালি, ইনসমনিয়ার ছাপ । একদম অচেনা ।
– শুভেচ্ছা , কেমন আছেন ?
– ভালো , আপনি ?
– তেমন একটা না ।
– কেন কি হয়েছে ? এভাবেই কথার শুরু ..
সুতপা রোজ ঠিক দুপুর তিনটার দিকে মেসেন্জারে আসে , ওই সময় আমিও অনেকটা ফ্রি থাকি ।
– সুতপা আপনাকে সব সময় এতো ক্লান্ত লাগে কেন ?
– ক্লান্ত লাগে ? রাতে আমার ঘুম হয় না , রাতের পর রাত জানালা দিয়ে কালো আকাশ দেখি ।
– কোনো ওষুধ খান না ?
– হুম খাই , তবে খেলেও অনেকসময় কাজ করে না , তখন বই পড়ি , গান শুনি । বাথটাবে শুয়ে থাকি সাবানের ফেনার ভেতর ।
– কেন আপনার হাসব্যান্ড কোথায় ?
– ওতো বেশিরভাগ দিনই বাসায় থাকে না , হয় বিজনেসের কাজে দেশের বাইরে নাহলে ঢাকার বাইরে । এমনকি ঢাকায় থাকলেও গার্ল ফ্রেন্ডদের নিয়ে সোনারগাঁ বা অন্য কোথাও ..
– আচ্ছা তখন আপনি এভাবে বাথটাবে পানির মধ্যে শুয়ে থাকেন ?
– হুম , আমি খুব লোনলি , একাকিত্ব ঘোচাতে প্রচুর ড্রিঙ্কস করি , একমাত্র এই বিষয়টা আমাকে কিছু সময়ের জন্য সমস্ত ডিপ্রেশন , না পাওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে ।
-কিন্তু তাতে কি লোনলিনেস কাটে ?
-কাটে কিনা জানি না কিন্তু কিছু সময়ের জন্য নিজেকে অনেক হালকা লাগে, ভারমুক্ত লাগে ।
-আপনার কোনো বন্ধু -বান্ধব নাই ? যারা আপনাকে সময় দিতে পারে বা আপনার সন্তান ?
-আমার কোনো ইস্যু নাই । আমরা কোনো চাইল্ড এডপ্ট করি নাই । আমার ইচ্ছা ছিল বাট শফিক চায় না । ওর ধারণা অন্যের সন্তান কখনো নিজের হবে না । আর প্রপার্টি নিয়ে ঝামেলা হবে ।
– ও আচ্ছা বুঝলাম । আর বন্ধু -বান্ধব তারাও কি সব আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে ?
– না তা যায় নি । কিন্তু কি জানেন বিপ্লব একসময় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষও অচেনা হয়ে যায় । সবাই যার যার পেরিফেরিতে চক্রাকারে ঘুরছে । একজন বন্ধুর লোনলিনেসকে ধারণ করার মতো মেন্টাল স্টেটাস খুব কম জনেরই থাকে । ইউনিভার্সিটির বন্ধু করবী আমাকে অনেক ভালো বুঝতে পারে , ওর সাথে শেয়ারিংটা দারুন কিন্তু এখন ও কানাডায় সেটেল করেছে , বছরে একবার আসে । কথা হয় মেসেন্জারে নিয়মিত বাট .
– হুম কিন্তু কোনো ছেলে বন্ধু নাই আপনার ? যে আপনাকে সময় দিতে পারে, কথা বলতে পারে , আপনিতো বেশিরভাগ সময় একই থাকেন ।
– না এখন তেমন কেউ নেই । এক সময় ছিল । বিয়ের পর পর যখন শফিকের লাইফ স্টাইল ঠিক বুঝতে পারছিলাম না প্রায়ই আমাদের কাঁঠালবাগানের বাড়িতে যেতাম । শফিক তখন স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্তে ।
যাই হোক তবুও চলছিল একটু একটু করে ।
এভাবে মেসেঞ্জারে সুতপার সাথে কথা চলছিল , শুইয়ে সুতো গাঁথার মতো পরস্পর জড়িয়ে পড়ছিলাম , কেউ যেন কাউকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়তে পারছিলাম না । সুতপা একটু একটু করে তার ইচ্ছার কথা বলতে শুরু করলো । প্রখর রোদে সমুদ্র স্নান দুজনে এক সঙ্গে , যেন একটাই শরীর , সুতপার হাতের মধ্যে আমার হাত , পায়ে পা , ঠোঁটে ঠোঁট , একটু একটু করে পান করছি সুতপার বাদামি ঠোঁট , জিভের মধ্যে জিভ , অগাথ সমুদ্রে মন্থন , একটু একটু করে জেগে উঠছি , যেন বহু বছরের ঘুমন্ত ড্রাগন জাগছে , সুতপা ওর চুম্বক টানে আমাকে ঘোরগ্রস্ত করে তুললো । অফিসে যতক্ষন থাকি , কথা বলতে থাকি । কখনো সে আমাকে গভীর অরণ্যে নিয়ে যায় , কখনো সমুদ্রের গভীর তলদেশে , একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে কতটা ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করতে পারে তা সুতপার সাথে পরিচয় না হলে জানতে পারতাম না , সুতপার রাত জাগা চোখের ভেতর একটা অজানার হাতছানি যেন সে এখানকার কেউ না কখনো তাকে জিপসি মেয়ে মনে হয় যে নিজের খেয়াল খুশি মতো পাহাড়ে ঘুরছে , কখনো মৌনব্রত পালনকারী এক সন্ত । ও নিজেকে ফুলের পাপড়ির মতো আমার কাছে মেলে ধরেছে কিন্তু এ ফুল আমার অচেনা , ভয় হতো হয়তো এই ফুলের গন্ধ নিতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো নয়তো পরিচিত গন্ডি থেকে ছিটকে পরে যাবো মহাশূন্যতায় । অফিস ছুটির পর নানা কফি শপে দেখা হতে লাগলো তারপর একদিন সুতপা তার বাড়িতে নিয়ে গেলো । সুন্দর ছিমছাম ফ্ল্যাট । উত্তরা লেক ভিউ রোডে । সারাবাড়িতে একটা অচেনা ফুলের গন্ধ । সুতপা চা বানিয়ে খাওয়ালো ।
– তুমি এখন আর কিছু খাবে ?
– না ।
– কেন অফিস থেকে আসছো ক্ষুধা পায় নি ?
-না ।
-আমার পেয়েছে । দুপুরে ঠিকমতো লাঞ্চ করি নি , চলো পাস্তা রান্না করি । সুতপার কিচেনে গেলাম , একটু এলোমেলো কিন্তু ওর রান্না পাস্তা অসাধারণ , দুজনে গ্রোগ্রাসে খেলাম । সুতপা ওর বেডরুমে আমাকে নিয়ে গেলো , ধবধবে সাদা বিছানা , জানালায় নীল পর্দা , বিছানায় পর্দার শেড পড়েছে । ফ্রিজ থেকে ওয়াইন নিয়ে এলো সুতপা । দুজনে একটু একটু করে পান করতে লাগলাম । দুজনের মোবাইল সুইচড অফ , সারা পৃথিবী থেকে আলাদা । বাথরুমে বিশাল বাথটাব । বাথটাবে লিকুইড সোপ দিয়ে শুভ্র ফেনা তৈরী করলো সুতপা, তারপর দুজনে সেই বাথটাবে অবগাহন , হাতে ওয়াইনের গ্লাস । দুজনে উন্মাদ হয়ে উঠলাম , পস্পরকে পান করতে লাগলাম । সুতপার জমাট স্তনে আমার ঠোঁট , সুতপা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো , যেন এক আদিম ভাস্কর্য। সুতপা আমাকে বাস্তব পৃথিবী থেকে ভিন্ন এক পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো । এই পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো বিশাল বিশাল বৃক্ষ , নিশাচরের ঘুরে বেড়াচ্ছে গভীর অরণ্যে , সেখানে সুতপা আর আমি উড়ন্ত সসারে করে পরিভ্রমণ করছি । উপর থেকে দেখা পৃথিবীকে অনেক ছোট আর মিনিয়েচারের মতো লাগছে । ওর সাথে সম্পর্কটা সাধারণ প্রেমকে ছাড়িয়ে অন্য এক মাত্রায় চলে গেলো যা বন্ধুত্ব -প্রেম আর পারস্পরিক বিনিময়ের এক যৌথতা । প্রথাগত সম্পর্কের বাইরে এক ভিন্ন ধরণের অবয়ব ।
মানুষ যখন বাস্তবে থেকে তার বাইরে ঘুরে বেড়ায় সেটা অন্যেরা অনেকটাই বুঝতে পারে । পুনম আমার আচরণে অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করলো , বার বার জানতে চাইলো কি হয়েছে ?
অফিসে কোনো সমস্যা বা অন্য কোথাও ? আমি হু না টাইপ উত্তর দিয়ে পুনমকে থামাতে চাইতাম । দিন দিন এমন হলো পুনমের বিষয়ে সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম । বিশেষ করে আমার বিষয়ে ওর অধিক কৌতূহল বিরক্ত করে তুললো । অফিস শেষে বেশিরভাগ দিন সুতপার সাথে কাটাতে লাগলাম । সুতপার হাসবেন্ডের অনুপস্থিতিতে ওর বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম । পুনম ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলো , বন্ধু -বান্ধব , আত্মীয় -স্বজনদের কাছে অভিযোগ জানাতে লাগলো এবং যতক্ষণ ওর সাথে থাকতাম পাগল করে তুলতো, এক বিন্দু শান্তি ছিল না , যতক্ষন সুতপার সাথে থাকতাম ততক্ষন সব আনন্দ , ভালোলাগা ..
একদিন পুনম ছুরি নিয়ে নিজের গলায় ধরে বললো আমি যদি না বলি সব কথা সে আত্মহত্যা করবে , নিরুপায় হয়ে তাকে বললাম । একজন কেউ আমার জীবনে এসেছে , তাকে বাদ দেয়া সম্ভব না কিন্তু পুনমের জীবনকে আমি বিপদগ্রস্ত করতে চাই না , আমরা যেমন আছি তেমন থাকবো , তাকে ছেড়ে যাবো না। আমার কথা শুনে পুনম ঘরের দরজা বন্ধ করে রইলো সারা রাত, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে অফিসে গেলাম , সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে , মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা । সুতপার মেসেজের কোনো উত্তর দিলাম না , ওর ফোন কেটে দিতে লাগলাম । এসব করে নিজের প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রনা হতে লাগলো । এভাবে কয়েকদিন কাটালাম , ঘরে ফিরে চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে থাকতাম , টেলিভিশন চলছে , রিমোট নিয়ে অনবরত চ্যানেল বদলাচ্ছি , কিছুই দেখছিনা , পুনম বেড রুম থেকে বের হচ্ছে না , বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে পুনমকে অনেক ডাকাডাকি করলাম , পুনম অগ্নিমূর্তি নিয়ে সামনে এসে যা ইচ্ছা বলে আবার বেড রুমে চলে যাচ্ছে ….
রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে অফিসে চলে যেতাম খুব সকালে , নিজেকে সময় দিতে চাইলাম , বাস্তবের পৃথিবী কি , কেমন বুঝতে চাইলাম , এমনকি সুতপাকে ভুলে থাকার জন্য কাজলের সাথে কথা বলা শুরু করলাম । কাজলের সাথে দেখা করলাম অফিসের পাশে এক রেস্তোরায় । কাজল কেমন বদলে গেছে। ওর চৌকষ মেধাবী বোহেমিয়ান রূপটি আর নেই কেমন যেন বদলে গেছে, খুব অচেনা লাগছিলো, চেহারায় চোখে মুখে একটা বিলাসিতার ছাপ, পোশাক -আশাক বদলে গেছে, অনেক অলংকৃত । কাজল বললো ,বিপ্লব তোমার ওয়াইফকেতো আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে না । আমি বললাম তাতে কি তোমার কি ভালো লাগতো ?
-কেন লাগবে না । তোমার পার্টনারকে আমি খুব কাছ থেকে দেখতে চাই সে তোমাকে কেমন ভালো রেখেছে বুঝতে চাই । আমিতো ভেবেছিলাম আমার জন্য তুমি আজীবন ব্যাচেলার হয়ে থাকবে . হা হা হা …এই তোমার প্রেম ? আমি না হয় নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছি , তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি , কিন্তু তুমিতো দেবদাস হয়ে বসে থাকোনি .. হা হা হা ..
– এসব কথা থাক তুমি কেমন আছো বলো
-আমি খুব ভালো আছি আমার হাসব্যান্ড আমাকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে । আগে ভাবতাম টাকা পয়সার কোনো মূল্য নাই , কিন্তু এখন বুঝতে পারি ওটাই আসল, আমার সব কমফোর্টের ব্যবস্থা করেছে জামিল । ওই সময়ে মায়ের চাপে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার ডিসিশনটা ভুল ছিল না….
– হুম তোমার চাকরি কেমন চলছে ?
– ভালো , গত মাসে থাইল্যান্ডে এ গেলাম অফিসের কাজে।
– বাহ্ , শুনে খুব ভালো লাগলো , আমি চাই তুমি তোমার মতো করে বাঁচো , তোমার যে একটা চমৎকার মন ছিল , ক্রিয়েটিভ একটা জগৎ ছিল তাকে তুমি যত্ন করো ….
– ধুর ওসব এখন আর পোষায় না , মাল্টি -ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে , সংসার সামলে , বাচ্চাকে সময় দিয়ে এখন আর অন্য কোনো বিষয়ে আমার মনোযোগ নাই , ইনফ্যাক্ট সাহিত্য -টাহিত্য এখন আর আমার ভালোও লাগে না , সস্তা প্যানপ্যানানি মনে হয় । ট্রাশ মাল ।
– সে কি , কেন?
– কেন আবার আই হেট মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট , সাহিত্য , আর্ট -কালচার এসব ওরাই করে বেশি । তারচেয়ে শপিং মলে ঘুরে বেড়াতে , শপিং করতে ভালো লাগে , কোনো রিসোর্টে গিয়ে সময় কাটাতে ভালো লাগে , ইফ ইউ হ্যাভ মানি ইউ ক্যান বাই এনিথিং , ইভেন লাভ , পুরো দুনিয়া তোমার পিছন পিছন ঘুরবে , ইউ ডোন্ট নিড টু রিড পোয়েট্রি ফর ইমাজিনেশন , দে কাম ইজিলি..
– হুম বুঝলাম , তুমি অনেক চেঞ্জ করেছো । কিন্তু এই তুমিটাই কি আসল তুমি তুমি ?
– আসল তুমি ? সেটা আবার কি ? এমন কিছু আছে নাকি ? এসবতো গত শতকের চিন্তা -ভাবনা, তোমার এসব এখনো আছে ? আজব বায়িং হাউসে চাকরি করে আর ওয়াইফ এর পায়ে তেল মালিশ করে মাথায় সব বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট গিজগিজ করছে .. রিডিকুলাস ..
– হুম করছে , তাতে তোমার কি ?
– আমার আবার কি , আই ডোন্ট লাইক ইট এট অল …
কাজলের সাথে দেখা হওয়ার পর মন বেশ অস্থির হয়ে উঠলো , যাকে ভালোবাসতাম , চাইতাম , কামনা করতাম , সে যেন আর নেই , কোথাও নেই । সে অনুভূতিও নেই , তীব্র একটা অর্থহীনতা গ্রাস করলো , আর কোনো দিন কাজলের সাথে দেখা হোক চাই না .. ও ভালো থাকুক , অথবা খারাপ থাকুক , যা ইচ্ছা তাই হোক আর জানতে চাই না , মস্তিস্ক থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে তুলে ফেলতে চাই সব স্মৃতি। ভালো লাগা , খারাপ লাগা .. না তার হয়তো দরকার হবে না , সময়ই তা নিজের মতো করে বদলে দেবে ….
অফিস করতেও ভালো লাগছিলো না , অসহনীয় এক অবস্থা , ঠিক করলাম রাঙামাটি যাবো । পুনমকে বললাম অফিসের কাজে চিটাগং যাচ্ছি । সে এখন আর আমাকে এক বিন্দু বিশ্বাস করে না , বললো যাও প্রেমিকাকে নিয়ে কক্সেস বাজারে গিয়ে হানিমুন করে আসো ..
সুতপা হাজার বার আমাকে ফোন করেছে . মেসেজ দিয়েছে, কোনো উত্তর দেই নি নিজেকে স্টুপিড মনে হচ্ছে, কি করছি এসব? ওকে এমন কষ্ট দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না, নিজের সাথে ওকে জড়িয়ে এখন এড়াতে চাইছি কিন্তু কেমন যেন জড়ভড়ত লাগছে। পুনমের আর্তচিৎকার , সুতপার প্রেম সব আমাকে ভারসাম্যহীন করে দিয়েছে , নিজের মতো করে কিছু ভাবতে পারছি না, আমার মধ্যে দৈত্ব সত্তা কাজ করছে । চাইছি পুনমের জায়গায় পুনম থাকুক , সুতপার জায়গায় সুতপা, সবাই আলাদা। দুজনের সাথে সম্পর্ক আলাদা , কিন্তু এটা সত্যি পুনমের সাথে আমার জীবন ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে , হাঁপিয়ে উঠেছি , এখন মনে হচ্ছে চিন্তা -ভাবনা না করে পুনমেরে সাথে থাকার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। ওই সময় কাজলের জন্য ভয়ঙ্কর মনোবেদনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য হঠাৎই কলিগের বোনকে বিয়ে করে ফেললাম , তেমন ভালো করে কথাও বলি নি দুজন । কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই দুজনের এতো বেশি ভিন্নতা আর টেস্টের পার্থক্য এক সাথে থাকাটা দায় হয়ে উঠেছে , পুনম নিজেও সেটা বোঝে , কিন্তু আমি ছাড়া আর কিছু ভাবার মতো অবস্থায় সে নাই । সুতপা আমার সেই শূন্যতাটা পূরণ করছে । কাজলকে না পাওয়ার হাহাকার সুতপার মধ্যে দিয়ে কিছুটা রিপ্লেসমেন্ট হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে হুটহাট সব সিদ্ধান্ত নেয়াটা কাল হয়ে উঠেছে, পুনমকে না জেনেই ওর সাথে সম্পর্কিত হয়েছি , এখন তাল মেলাতে পারছি না। আর সুতপার বিষয়টা সমস্ত শরীর -মনকে আচ্ছন্ন করেছে , ওকে হারাতে চাই না । এতদিন যোগাযোগ না করায় নিশ্চই কষ্ট পাচ্ছে . সুতপার জন্য একটা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে বুকে। তবু ওকে ফোন করলাম না। রাঙামাটি পৌঁছে দো- চোয়ানি কিনে আনলাম চাকমাদের এক আস্তানা থেকে । টানা সাত দিন ওখানে থাকলাম , মোবাইল , মেসেঞ্জার সব বন্ধ । অফিসে জানিয়ে দিয়েছি ব্যক্তিগত প্রয়াজনে সাত দিনের লিভ। বস একটা কড়া মেইল দিয়েছে তার উত্তর দেই নাই । এই কদিন সব বন্ধ করে রেখেছি । এই চাকরিটাও ভালো লাগছে না চেঞ্জ করবো, জীবনে কখনো কখনো সব বদলে ফেলার প্রয়াজন হয়, নিজেকেও পরিবর্তন করা দরকার হয়ে পরে। যদিও তা সম্ভব হয় খুব কম । রাঙামাটিতে পর্যটনের মোটেলে দুজন সুদানিজের সাথে পরিচয় হলো, ওদের সাথে কাপ্তাই লেক ঘুরলাম , চাকমা রাজাদের বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে শুধু পানির মধ্যে একটা উঁচু থামের মতো দেখা যাচ্ছে । এখানে একদিন জনপদ ছিল , রাজ্য ছিল , রাজা ছিল , রানী ছিল আজ সব কালের কালের গর্ভে । মানুষের জীবনও এমন সব জমজমাট থাকে , প্রাণ থাকে , প্রাণের স্পন্দন থাকে , হাসি -আনন্দ -বেদনা …. এক সময় সব কোথায় হারিয়ে যায় , আবার নতুন করে তাকে সব তৈরী করে নিতে হয় , খুঁজে নিতে হয় । সুদানিজ ছেলে দুটো চরস খেয়ে ওদের ভাষায় গান শোনালো তার অর্থ হচ্ছে –
সময় তুমি বয়ে যাও
কখনো ফিরে আসো না
আমি ঠিক তোমার মতো
কখনো পেছনে ফিরি না
সময় তুমি বয়ে যাও
কখনো ফিরে আসো না
আমি ঠিক তোমার মতো ….
পরিব্রাজক
কখনো পেছনে ফিরি না

 

 

বেশ ভালো লাগলো ওদের গান , ওদের চিন্তা -ভাবনা , একসাথে ঢাকায় ফিরলাম । যাত্রাবাড়ি এসে মোবাইলের সুইচ অন করলাম । টিং টিং শব্দ এলার্ট , মেসেন্জার এক সাথে সব বাজতে শুরু করলো , সুতপা একটা লম্বা চিঠি লিখেছে…..
বিপ্লব
কেমন আছো তুমি ? গত কয়দিন তোমাকে হাজার বার ফোন করেছি , মেসেজ দিয়েছি , এমনকি তোমার অফিসে গিয়েছিলাম । তুমি ঢাকায় নাই , চিটাগংয়ে, কিন্তু আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করলে কেন ? আমি কিছু বুঝতে পারছি না , তোমাকে অনেক মিস করছি , যন্ত্রনা হচ্ছে, ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে বাট আই থিঙ্ক ইউ আর ডুইং দিস থিং উইশিংলি , সো ডোন্ট ওয়ান্ট তো বদার ইউ , নিশ্চই এর কোনো কারণ আছে , তোমার নিজের মতো সময় কাটাও , জানি এই অল্প সময়ে আমরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি । হয়তো এই বিষয়টা তোমার জন্য অনেক অন্যরকম , আমি নিজেও খুব অদ্ভুত সময় কাটাচ্ছি । এতো বছর পর হঠাৎ করেই জীবন যেন গিরগিটির মতো রং বদল করলো। একটা কেমন সবুজ আর কালোর মিশ্রণ , জলরঙে আঁকা, জল ঢেলে দিলে মিলিয়ে যাবে .ওয়াশ আউট . আমি একে কোনো ভাষা দিয়ে বুঝতে পারছি না , ভাষার অতীত , এটাইতো অনুভূতি । হয়তো লিখতে পারলে দারুন কিছু লিখতাম । কিছুদিনের জন্য টরেন্টো যাচ্ছি ছোট বোনের ওখানে । তুমি ভালো থেকো , তোমাকে ভালোবাসি তাই হারাবার কিছু নাই । তোমাকে আমার নিজের মধ্যে পেয়েছি , আমার ভালো বন্ধু , সহযাত্রী .. দেখা হবে ফিরে আসার পর , আদর ।
সুতপা
সুতপার চিঠিটা পড়ার পর মনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো এক মুহূর্তে , তাইতো আমি কেন এতো অস্থির হচ্ছি ? নিজে যা অনুভব করছি তাতো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না , তা একান্তই নিজের । নিজের মধ্যেইতো বেঁচে থাকার অর্থ প্রোথিত , আর চারপাশের সবাই তার অনুষঙ্গ ।
বাস থেকে নেমে উবার নিয়ে বাসায় আসলাম , পুনম ঘুমিয়ে ছিল , এতো রাতে আমাকে দেখে অবাক হলো , ওভেনে খাবার গরম করে দিলো , ভাত খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলাম । যেন কত কাল ঘুমাই নি , সব ক্লান্তি চেপে ধরেছে , সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমালাম , জানালা খুলে দিতেই হঠাৎ এক রাশ কড়া রোদ এসে চোখে পড়ছে যেন অনেকগুলো সার্চ লাইট একসাথে খুঁজছে আমাকে …

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত