Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,puja 2021 bangla golpo parijata banerjee

উৎসব সংখ্যা গল্প: স্থলপদ্ম জাত । পারিজাত ব্যানার্জী

Reading Time: 4 minutes

রাত শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। সংযুক্তা উঠে বসে বিছানার গদিটা সামান্য আঁকড়ে ধরে। সমিধ এখনও অকাতরে ঘুমোচ্ছে বালিশে মুখ গুঁজে। কাল কত রাত্রে ফিরেছে কে জানে? সংযুক্তা ঘুমিয়ে পরেছিল নিশ্চয়ই  ততক্ষণে, তাই আর তাকে ডাকেনি সমিধ। সত্যিই, অনেক ভাগ্য করে বোধহয় পাওয়া যায় এমন জীবনসঙ্গী।

বাড়ি থেকে দেখাশোনা করেই বিয়ে। মনে মনে তাই সামান্য ভয়ই ছিল সংযুক্তার স্বামীভাগ্য নিয়ে। এই দু’বছরের তাদের নিতান্ত অগোছালো সংসারে পাশাপাশি একসাথে কাঁধে কাঁধ ঘষে থাকতে থাকতে অবশ্য বুঝেছে সে এতদিনে, তার সংশয় নিতান্ত অমূলক। 

সমিধের চুলগুলো হালকা এলোমেলো করে দেয় সংযুক্তা আপনমনে। বিছানায় পরলেই আজও মানুষটার পঁয়ত্রিশ বছরের শরীরটা কেমন একরত্তি ছোট্ট এক শিশুর আকারে পাল্টে যায় যেন অচেতনে। বড় মায়া হয় তখন তার অসহায় মুখের দিকে তাকালে- মনে হয়, জাদুমন্ত্র পড়ে এক্ষুণি সব ঠিক করে দেয় সে এক নিমেষে! নিজের স্ফীত পেটে হাত রাখে সংযুক্তা, চোখের পাতা ভিজে ওঠে তার অচিরেই -অন্তত যদি কিছু ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতাও থাকত তার নিজের হাতে!

সব যেন ছবির মতো পরপর সেজে উঠতে থাকে তার চোখের সামনে! বিয়ে করে পুণের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে শুরু হয় তাদের সংসার। সব জড়তা সরতে সরতে একসময় দুটো মানুষ কিভাবে যে অভিন্নহৃদয় হয়ে ওঠে, তা বোধহয় কেবল ঈশ্বরই জানেন! কোনো আলাদা উচ্ছাস না থাকলেও রোজ রাতে একসাথে রান্না করা, বাড়ির ভাগ করে নেওয়া বাদবাকি কাজগুলো সাড়ার মধ্যেও যেন জমতে থাকে তাদের একটু একটু ভালোবাসা— ঠিকই তো, নাহলে আর ভালো ‘বাসা’ কিকরে হয়ে উঠত তাদের দু-কামড়ার এই আপাত সাধারণ বাড়ি!

তারপর, এই তো যেন সেদিনেরই ঘটনা,বড় রাস্তার  ধারের ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের সামনের চায়ের দোকানে দুজনে হাত ধরাধরি করে বসেছিল অন্য হাতে রিপোর্টগুলো ধরে। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে উঠতে পারেনি। গভীর ভাবে ধরে থাকা হাতদুটো কেবল কাঁপছিল উত্তেজনায়। তারা যে আর স্বামী স্ত্রী রইল না শুধু — তাদের ভালোবাসার সামান্য অণুকণা যে প্রস্ফুটিত হতে চলেছে এই বিশ্ব চরাচরব্যাপী আলোকছটায় উদ্ভাসিত হয়ে – এই খুশীকে একে অপরের সাথে ভাগ করে নেওয়ার ওইটুকুই যা ছিল সময়।

ভীষণভাবে আজকের সকালটার অপেক্ষায় ছিল ওরা দুজনে এতদিন ধরে। কত জল্পনা কল্পনা চলেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন— শুধু এই মুহূর্তকটা বাঁচার জন্য। বাড়ির সামান্য এক চিলতে বারান্দায় কত গাছ বসিয়েছে সংযুক্তা এ ক’ মাসে— অপেক্ষায় বসে থেকেছে তরতাজা ফুল ফোটবার। তারপর যখন সামান্য কুঁড়ি ডানা মেলে উন্মুক্ত করেছে তার প্রাণোবন্ত পাপড়ির ছটা, উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে চলে গেছে সে সমিধের কাঁধের সুখস্পর্শের খোঁজে— “আমাদের সন্তানও অমন জীবন্ত হবে সমিধ? অমন উচ্ছল, একরত্তি! সারা ঘর জুড়ে দাপাদাপি করে বেড়াবে দুষ্টুটা পা টেনে টেনে হামাগুড়ি কেটে? আর—”

সমিধ হাসতে হাসতে ওর কপালে ঠোঁট বুলিয়ে দিয়েছে আদররেখা ছোঁয়া পরিভাষায়। “ব্যস ব্যস! ওরে বাবা! এবার তো কলেজ পাশ করিয়ে চাকরি পাইয়ে দেবে তুমি দেখছি! আগে ওকে প্রাণভরে নিশ্বাস তো নিতে দাও ওর মায়ের নিশ্চিন্ত বুকে! আগে তো প্রথম মুহূর্তটা বাঁচতে হবে— নিতে হবে ওকে আগলে ধরার সমস্ত আস্বাদ, তাই না সঞ্জু! আচ্ছা, তখন কেমন গন্ধ বেরোবে বলো দেখি ওর গা দিয়ে? বেবি পাউডারের, নাকি দুধ দুধ?”

সলজ্জ হেসেছে সংযুক্তা। “আমাদের দুজনের আদর ভালোবাসার গন্ধ নিয়েই জন্মাবে ও, দেখে নিও!”

পাশের ছোট্ট  ঘরটা ঘিরেই পারদ বেড়েছে অপেক্ষার। দেওয়ালে পরেছে নতুন রঙের প্রলেপ — ছাদে চকমকি তারা নক্ষত্র, আলো নিভলেই যা জ্বলে ওঠে মিষ্টি সুরের মূর্চ্ছনায়। সারা দুপুর ঘর অন্ধকার করে ওখানেই গা এলিয়ে পরে থেকেছে সংযুক্তা দিনের পর দিন – কখন কোন তারা খসে পরে তার আঁচলে, সেই প্রতীক্ষায়!

রান্নাঘর থেকে একরকম ছুটিই দিয়ে দিয়েছিল তাকে সমিধ এই কদিনের জন্য। নিজেই কিসব বই আর ইণ্টার্নেট ঘেঁটে ভার নিয়ে নিয়েছিল নানারকম উপাদেয় কিন্তু পুষ্টিকর রান্না করার। প্রথম তিনমাস যখন ভোরের দিকে খুব গা গোলাতো বলে পিঠে বালিশ দিয়ে বসে থাকত সংযুক্তা, তখনও তার পাশে ‘অফিসের কাজ আছে’ ভানে ল্যাপটপ খুলে জেগে থেকেছে সমিধ নিরন্তর! কাছাকাছি আত্মীয়স্বজন না থাকায় সাধ হবে না? উঁহু, স্ত্রীয়ের কোনো ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখতে সমিধ অপারগ। নয় মাসে পাড়ার সব মহিলাদের তাই নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে এনে সাধের আয়োজন করা থেকে তার মন ভালো রাখতে নিত্যনতুন বই,ডিভিডি, পোস্টার নিয়ে আসা— হবু বাবা হিসাবে কোথাও সত্যিই কোনো খামতি রেখেছিল সে, বলা দায়!

তবু, অঘটনটা ঘটে গেল কয়েক সপ্তাহ আগে।আজকাল তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ে সংযুক্তা।সেদিনকে কেন কে জানে, ঘুমই আসছিলনা তার একদম। পেটে অজান্তেই হাত চাপা দিয়ে আত্মরক্ষার ভঙ্গিমায় চলে গিয়েছিল তার শরীর। তবে কি- তবে কি —

শেষমেশ মায়ের মনের আশঙ্কাই সত্যি হবে এতটা দুরাশা করেনি সে। হঠাৎ মাঝরাত্রে ভীষণ মোচড় দিয়ে উঠল যখন সংযুক্তার সমস্ত শিরা উপশিরা, সমিধকে আলাদা করে ডাকতে হয়নি আর। তার আগেই গোঁ গোঁ আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, অত রাতেই ডাক্তারকে কল দেওয়া, স্যালাইন, রক্ত — একে একে চলতে থাকে সব ওঠানামা।

ডাক্তার চৌধুরী গাইনোকলজিস্ট হিসাবে পুণেতে যথেষ্ট নামকরা। তাঁকেই সংযুক্তার কেস রেফার করে দেয় হাসপাতাল।সমস্ত রিপোর্ট দেখে বেশ চিন্তিত ভাবেই বলেন তিনি সমিধকে ডেকে, “বাচ্চার পোজিশন যেকোনো  ভাবেই হোক, ঘুরে গেছে। বেকায়দায় ওর মস্তিষ্কের গঠনও কিছুটা তাই অস্বাভাবিক — বা বলা যেতে পারে, অপরিণত। ডাক্তারী পরিভাষায় বলতে গেলে শিশুটি অ্যানেনসেফ্যালির শিকার। আমি দুঃখিত, কিন্তু এ অবস্থায় খুব বেশি আশা দেওয়া আমার পক্ষে অন্তত আর সম্ভব না।”

সমিধের কি গলা কেঁপে গিয়েছিল তখন সামান্য? সন্তানের জন্য তো সেও খুব কম অপেক্ষা করেনি, তাই না?তবু ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে তবে স্থির ভাবেই সে জানতে চেয়েছিল “সবই কি শেষ তাহলে আপাতত? সংযুক্তা ঠিক থাকবে তো?”

আশ্বাসের হাত তার কাঁধে রেখেছিলেন প্রৌঢ় ডাক্তার— “যেমন ডেট আছে, সেদিনই ডেলিভারী হবে মিঃ সেন। তবে আপনাদের শিশু তো ঈশ্বরপ্রোদত্ত— খুব বেশিক্ষণ তাকে আগলাতে পারবনা আমরা, এই যা।”

হাসে সমিধ। “তাই বা কম কি? অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

বাড়ি আসার পথে তার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসেছিল সংযুক্তা। এক হেরে যাওয়া মায়ের গল্প লেখা হতে চলেছে তার জীবনপটে – এর থেকে আর দুরূহ কিছুই যেন ছিলনা তার সেসময়। সমিধ সেদিনও কি অনাবিল ক্ষমতায় যে সামলেছিল তাকে, এখনও ভাবতে অবাক লাগে ভীষণ। “কি আছে, আমাদের ভালোবাসার ফুলও তো ফুটছে! ডাক্তার কথা দিয়েছেন, দেখো! হোক না তা কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক মিনিটের জন্যই, তবু তো আমাদের কোলে আসবে ও, বলো! দেখোনা, তোমার গাছে হওয়া স্থলপদ্মগুলোরও কত কম আয়ু! প্রভাতে যে জন্মায়, দুপুর গড়াতেই কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে! তবু তার মধ্যেই সাদা পাপড়ির কোণায় কোণায় কেমন গোলাপী আভা ছড়ায় বলোতো ও? আহা, ওইটুকুই নাহয় রইল ওর জীবনও! ও যে দেবশিশু – কি বলো! নানা সঞ্জু, তুমি কাঁদবে না! তার চেয়ে ভাবো ওই কিছু মুহূর্তে কিকরে আস্ত জীবনের সব আয়োজনকে বন্দী করা যায়, পরে যাতে পিছনে তাকালে মনে হয়, ‘নাঃ, আমরাই ওর যথার্থ বাবা মা হতে পেরেছিলাম নির্দ্বিধায়!’ ওই সময়টুকু আমাদের কোল আলো করে থাকবে আমাদের ভালোবাসার ফসল — ভাবলেই কেমন শিহরণ হচ্ছে না, বলো?”

সংযুক্তা হাত রাখে তার পেটের উপর।চোখ দিয়ে তার একফোঁটা জল যেন কোন আবেগতাড়িত হয়ে চলকে ওঠে।ঠোঁটে যদিও খেলে যায় এক অপার্থিব হাসি। ঠিকই তো, আর কয়েক মুহূর্ত এরই তো শুধু অপেক্ষা তারপরের কিছু মুহূর্তমধ্যে সারাজীবনটাকে ফ্রেমবন্দী করার! এখন যে আর কষ্টের বাণে আমল দিলে চলবে না কিছুতেই! সমিধকে আলতোভাবে ডাক দেয় সে। “কিগো, উঠবে না?”

ঠিক তখনই কাঁচের জানালা ভেদ করে ঘরে এসে পরে চিরন্তন নিষ্পাপ রৌদ্রালোকিত কিরণের প্রথম বিচ্ছুরণ!

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>