| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: নৈশ ঠেক । পার্থসারথি গুহ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

রোজ সকালে উঠে সেই এক মুখ দেখে দেখে বোর হচ্ছিল পল্টন। সমাদ্দার বাড়ির নয়ণের মণি ইন্দ্রজিত ওরফে পল্টন এমনিতে তুখোড় আড্ডাবাজ। সকালে উঠে একবার নাড়ুদার দোকানে চা খেতে না এলে ওর পটি ক্লিয়ার হয় না। সেই পল্টনেরই এখন আর মোড়ের মাথায় যেতে ইচ্ছে করছে না। নাড়ুদার দোকানের চা’টা মিস করছে বটে। কিন্তু একঘেয়ে আড্ডাটা আর নিতে পারছে না।পাড়ার মোড়ের আড্ডায় নতুনত্ব খোঁজার চেষ্টা বৃথা। সেটা ভালই বোঝে পল্টন। তবে সেই আড্ডাটাও ঠিক ওর সমস্যা নয়।এমনিতেই পল্টন সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সেভাবে মিশতে পারে না। পড়াশুনার বাইরে তাই স্কুলের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক নেই। এ নিয়ে স্কুল থেকে বহুবার বাড়িতে নালিশ হয়েছে।

“ছেলেকে একটু বোঝান। যেন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ঠিকমতো মেলামেশা করে। সবাই কী সুন্দর হইহল্লা করে, টিফিন ভাগাভাগি করে খায়। আর ইন্দ্রজিত কেমন একা একা বসে থাকে। “

পল্টন যখন ক্লাসে থ্রিতে পড়ে তখন ওর মা’কে ডেকে অনুযোগ করেছিলেন মহুয়া মিস। ওদের ক্লাস টিচার এই মহুয়া ম্যাডাম।পল্টনের পড়াশুনা নিয়ে কোনওদিন কোনও রিপোর্ট ছিল না। তবে ওর এই একা থাকার স্বভাবটা বড্ড বেমানান ঠেকত টিচারদের। তাই মাঝেমধ্যে ওর বাবা, মা’কে ডেকে একান্তে বোঝানোর পালা চলত। পল্টনের এই স্বভাবটা বাবা, মায়ের থোরি ভাল লাগে? কিন্তু একমাত্র ছেলে। তাই সেভাবে কিছু বলতে পারেন না। বাবা তাও মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, “কী রে পল্টন অমন চুপচাপ বসে আছিস কেন? যা না পাড়ার ক্লাবে একটু ক্যারম ট্যারম খেল।”

“আমার ওই ক্লাবে ঠিক পোষায় না।” কাটা কাটা জবাব দেয় পল্টন। ব্যস, এরপর আর কী কিছু বলা যায়?

মা আবার বাবাকে বোঝান।” দেখো ছেলে বড় হচ্ছে। এমন কিছু বলো টোলো না যাতে বাবুর গোঁসা হয়। “

সবেধন নীলমণিকে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা সত্যিই সম্ভব নয় তাঁদের পক্ষে। তা বলে পল্টনের বন্ধুরা তো আর ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। অসমবয়সী হলেও বন্ধু তো বটেই। বেশ কয়েকদিনে নাড়ুর ঠেকে ওকে না দেখতে পেয়ে দল বেঁধে সটান পল্টনদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন উৎপল চক্রবর্তী, কালিদাস ঘোষ, অমিত সরকার, সুভাষ হালদার’রা।

“কী ব্যাপার পল্টন কুমার? ঠেকে যাওয়াই ছেড়ে দিলে যে বড়?” উৎপল চক্রবর্তী রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। এখনও একটা টিচার মার্কা ভাবগতিক লেগেই থাকে ওঁর কথায়।

“আমাদের কী অন্যায় জানতে পারি? ” উৎপলের কথা শেষ হতে না হতেই কালিদাস ঘোষ ব্যাটন তুলে নিয়েছিলেন মুখে।

অমিত সরকার, সুভাষ হালদার’রাও অনেক কিছু বললেন।

কিন্তু সব কথাই কেমন যেন মাথার ওপর দিতে চলে যেতে থাকল। মুখে একটা হাল্কা হাসি ঝুলিয়ে ওপরভদ্র‍তা সারল পল্টন।তার সঙ্গে অবশ্য মায়ের অতিথি আপ্যায়নে মুখরোচক টা সহযোগে চায়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়।

নানাভাবে ইনিয়েবিনিয়ের পরেও পল্টন ওদের কিছুতেই বোঝাতে পারল না সম্পূর্ণ একটা নতুন আস্বাদন খুঁজছে ও। এমন একটা ঠেক যা কখনই পুরনো হয় না। সবসময় যেন নতুন রক্তের আমদানি ঘটছে। কিন্তু এমন ঠেক তো আর হাতের মোয়া নয় যে চাইলাম আর পেয়ে গেলাম। তাছাড়া এপাড়ায় নাড়ুদার দোকান ছাড়া আর তো চায়ের ঠেক বলতে বঙ্কাদার দোকান। সেখানে অবশ্য এ পাড়ার ছেলে ছোকরাগুলোই ভিড় জমায়। যাদের সঙ্গ আবার পল্টনের মোটেই পছন্দ নয়।

এই তো কিছুদিন আগে একদিন বঙ্কাদার দোকানে চা খেতে ঢুকেছিল পল্টন। ওকে দেখে তাদের সে কী টিপ্পনি।

“তুই তো বুড়ো ভামগুলোর টিমের পাবলিক। কী মনে করে এ দোকানে?”এমনকি বঙ্কাদা পর্যন্ত কটাক্ষ করতে ছাড়ে নি।

কোনওরকমে চায়ের গ্লাসটা পল্টনের হাতে ধরিয়ে তার বুলি ফুটেছিল, ” দেখো দাদাবাবু আমি কিন্তু তোমাদের ওই নাড়ুদার মতো বুড়োটে চা খাওয়াতে পারব না। তাবলে আবার নিন্দা কোরোনি যেন। “

ওর বয়েই গেছে বঙ্কাদার চায়ের নিন্দা করতে। তবে হ্যাঁ, রোজ রোজ নাড়ুদার হাতের চা খাওয়ার পর বঙ্কাদার চা’টা কিন্তু বেশ লাগছিল। এর থেকেই আরও নিশ্চিত হয়েছিল, ঠেকটা পালটাতে পারলে মনের রুচিটাও জম্পেশ হবে। অভিনবত্ব আনতে মর্নিং ওয়াকের বদলে হালে নাইটওয়াক চালু করেছে পল্টন। আগে ভোর ভোর উঠে লেকে চলে যেত। এখন ডিনার সেরে রাত দশটা নাগাদ পাড়ার মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করছে। সাড়ে দশটার মধ্যেই ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।

মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “লোকে তো সকালেই হাঁটতে যায় জানি। তুই আবার রাতে বেরচ্ছিস যে?”

“ওয়াক আ মাইল আফটার আ ডিনার। ” ইংরেজি প্রবাদবাক্য আউড়ে মা’কে থামিয়েছে পল্টন।

এই হাঁটতে গিয়েই একদিন দেখা হয়ে গেল নাড়ুদার সঙ্গে।

নাড়ুদার দোকান বন্ধ করতে করতে রাত প্রায় দশটা বাজে। তারপর রোজ স্নান করা ওর অভ্যেস। সেসব সেরে ওর খেয়েদেয়ে শুতে বেশ রাত হয়।

সেই নাড়ুদাকে পুকুরপাড়ের কাছটায় দেখে খানিকটা চমকে গিয়েছিল পল্টন। আদৌ নাড়ুদা তো? নাকি অন্য কেউ?

নাড়ুদাই ওর ভুল ভাঙাল।

“আরে পল্টনবাবু তোমার সঙ্গে আলাদা করে দুদণ্ড কথা বলতেই তো এদিকপানে এলাম। সবাই বলল, তুমি নাইট ওয়াক করছ আজকাল। “

“সেসব ঠিক আছে। কিন্তু কথা তো দোকানেও বলা যেত? ” পল্টনের কথায় অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট ।

“সে সৌভাগ্য কী আমার বরাতে আছে? তুমি তো আসাই বন্ধ করে দিয়েছো। তাছাড়া দোকানে কেউ না কেউ থাকেই। তাই ভাবলাম ফাঁকায় পেলে তবেই বলব। ” নাড়ুর কথায় কেমন যেন রহস্যের সুর। কী এমন কথা যেটা দোকানে বা অন্য কোথাও বলা যায় না। পুকুরপাড়ে এত রাতে এসে বলতে হচ্ছে। সত্যি বলতে কী পল্টনের সন্দেহ যাচ্ছিল না কিছুতেই। এও ভাবছিল নাড়ুদা তো খুব সরলসিধা মানুষ। প্রসঙ্গ পালটাতে পল্টন অন্য কথায় গেল।

“এই তো সেদিন উৎপলদা, কালিদারা সব এসেছিলেন। তুমি শোনো নি। “

“তা আর শুনবো নি। তুমি দোকানে আসছ না দেখে বাবুদের কী মন খারাপ। নিজেদের মধ্যে শলা করেই তো গেল সব। আমাকেও টানাটানি করছিল। তা আমি বললুম দোকানে এখন কাস্টমার ফেলে যাই কী করে? ” নাড়ু বোঝাল ও সবই জানে।পরক্ষণেই পল্টনের একদম কাছে ঘেষে এসে নাড়ু বলল,
“তবে তোমার মন খারাপ কি আর ওনারা দূর করতে পারবেন। ওনাদের সেই খেমতা কোথায়। “

“আমার মন খারাপ তোমাকে কে বলল? ” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল পল্টন। নাড়ুর থেকে একটু তফাতেও গেল ও। কেন জানি না এই নির্জন জায়গায় নাড়ুর উপস্থিতি ভাল লাগছিল না।

“আমার দোকানে চা খায় যারা তাদের মনমর্জি আমি বেশ বুঝতে পারি গো। আর তুমি তো আবার ভিআইপি কাস্টমার। ” নাড়ু যেন পরিস্থিতি হাল্কা করতেই একথা বলে।

“আমি আবার কীসের ভিআইপি? ” পল্টন কাঁধ ঝাঁকায়।

“অবশ্যই ভিআইপি। বয়সে ছোট হলে কী হবে? তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলে এ তল্লাটে খুবই কম। সেকি আর আমি জানি নে।” নাড়ুর কথা যেন আজ আর ফুরোতেই চাইছে না। নাড়ুদা কী নেশাভাঙ করল নাকী? কোনওদিন তো এতো বকবক করে না।

“পল্টনবাবু আমি কোনও নেশাটেশা করিনি গো। দোকানে বসে সব কথা তো বলা যায় না। তাই আজ প্রাণখুলে একটু কপচাচ্ছি।” ওর মনের ভাব আঁচ করেই যেন নাড়ু তার এই বকবকানির পক্ষে সাফাই দিতে চাইল।

নাড়ুর কথায় এবার কেমন যেন স্বস্তি পেল পল্টন। কেন জানি মনে হল মনখুলে ওকে সব বলা যায়। সেই বিশ্বাস থেকেই পল্টন বলল, ” নাড়ুদা রোজ সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় ভাল লাগে না গো। তোমার দোকানে এলে সেই উৎপলদা, কালিদাদের চর্বিতচর্বন চলতে থাকে। কিন্তু অন্য কোথাও যে বসব তারও তো জো নেই। তুমি তো জানোই আমি আবার সবার সঙ্গে ঠিক মিশতে পারি না। “

“ও এই কথা। সেটা তো আগে বলতে হয়। আমার দোকানেই তোমাকে এক্কেবারে অন্য ইস্টাইলের আড্ডা দেখাব। হরফ করে বলতে পারি এমন আড্ডা তুমি কখনও দেখো নি, এমনকি আগামীদিনেও দেখবে না। “নাড়ুদা যেন হঠাৎ মুশকিল আসান হয়ে উঠল। যথারীতি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েছিল পল্টন, “তোমার দোকানে আবার অন্য স্টাইলের আড্ডা কী করে হবে? সবাই তো তোমার দোকানের গায়ে বুড়োদের ঠেক – এর লেবেল সাঁটিয়ে দিয়েছে। সেই তো একই সব প্লেয়ার। আর বস্তাপচা সব টপিক। “

“তুমি দেখতে চাও কিনা আগে বলো? ” নাড়ুদা এবার সরাসরি উত্তর চেয়েছে।

“তা আর বলতে। খুব চাই। কিন্তু আড্ডাটা হতে হবে আড্ডার মতো। নতুন বোতলে পুরনো মদ ভরো না আবার। “

“আজ অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। আগামিকাল রাত বারোটার সময় আমার দোকানে চলে এসো। আড্ডা কাকে বলে দেখাব তখন।” রহস্যের লাটাই হাতে তখন দেদার সূতো ছেড়ে চলেছে নাড়ুদা। রাতের পায়চারি সেরে বাড়ি ফেরে সাড়ে দশটার মধ্যেই। কিন্তু নাড়ুদার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই চিন্তা করবে। মোবাইলটাও আনতে ভুলে গিয়েছে। দ্রুতপদে বাড়ির দিকে এগোয় পল্টন।

সে রাতে অদ্ভূত এক স্বপ্ন দেখে পল্টন। একটা অত্যন্ত নির্জন স্থানে ওরা বসে আছে। ওরা মানে উৎপল,কালিদাস, অমিত,সুভাষকে স্পষ্ট দেখতে পায় পল্টন। নিজেকে দেখতে না পেলেও স্পষ্ট নিজের গলা শুনতে পায়।
“নাড়ুদা আমাদের পাঁচটা লাল চা দাও তো।”

পরক্ষণেই দেখা যায় একটা বিশালাকার অশ্বত্থ গাছের কোটর থেকে চায়ের কেটলি নিয়ে বেরিয়ে আসছে নাড়ু।

মাঝরাতে ধড়ফড় করে উঠে বসে পল্টন। নেহাত আলাদা ঘরে শোয়। নাহলে বেকার বেকার মা,বাবারাও ব্যতিব্যস্ত হতেন। সারা গা ঘামে পুরো জবজব করছে। সেসব মুছে পাশে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে বেশ শান্ত লাগে। নিমেষেই তলিয়ে যায় ঘুমের দেশে।

পরেরদিন একটু কলেজ স্ট্রিট যাওয়ার ছিল। সকাল সকাল ভাত টাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে পল্টন। এমনিতে ওর পড়াশুনা নিয়ে কেউ কোনওদিন অভিযোগ করতে পারে না। আগামী দিনে পল্টনের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে। তবে মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট না করতে পারলে সব বেকার। এসবের জন্যই প্রচুর বই কম্বাইন করে পড়তে হয়। তারই একটা লম্বা লিস্ট নিয়ে কলেজ স্ট্রিটে অভিযান চালায় পল্টন। সত্যি বলতে কী বইটই কেনার ফাঁকে আগের দিনের কথা পুরো মাথা থেকেই উড়ে গিয়েছিল। বই কেনার ফাঁকে দেখা হয় এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। আগে ওদের পাড়াতেই থাকত। এখন থাকে পুনেতে। ওর বাবা সেখানে বদলি হয়েছে। দুদিনের জন্য এসেছে। কফি হাউজে দুই বন্ধু মিলে কফি স্ন্যাক্স সহযোগে জমিয়ে আড্ডা মারে।

“জানিস পুনে শহরটা বেশ ভূতূরে। রাস্তাঘাটে কখন যে তেনাদের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যাবে বুঝতেও পারবি না। ” পল্টনের বন্ধু সরোজ নাগ রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেয় ওর মনে।

“বলিস কী রে? একবার তো তাহলে যেতেই হচ্ছে।” পল্টন উৎসাহ দেখায়।

“এনি টাইম। পরীক্ষার পরেই চলে আয় না।” সরোজ বন্ধুকে আহবান জানায়।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে। ফেরার সময়ে মোড়ের মাথায় নাড়ুদার দোকানে চোখ যায়। তখনও সিনিয়রদের ব্রিগেড এসে পৌঁছায় নি। নাড়ুদার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। কৌতুহলী দৃষ্টি মেলে নাড়ুদা।

যেন বলতে চাইছে, ” মনে আছে তো? “

বাড়িতে কাউকে সেকথা তো বুঝতে দেওয়া যাবে না। অতো রাতে বেরনো তো খুব স্বাভাবিক নয়। একটাই শান্তি সদরের ডুপ্লিকেট চাবি ওর কব্জায়। রাতে নতুন বইপত্র নাড়াচাড়া করার বাহানায় আর হাঁটতে বেরলো না পল্টন।

ঠিক বারোটা পাঁচ নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল পল্টন। নাড়ুদা বলেছিল বারোটার মধ্যে যেতে। একটু দেরি হয়ে গেল। মোড়ের মাথাটা যেন বেশি অন্ধকার লাগছে। তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। বড় লাইটটা যে জ্বলছে না। তবে পাড়ার কুকুরগুলো অন্যসময় পাড়া মাথায় করে। আজ তাদেরও কোনও সাড়াশব্দ নেই। ঠকঠক করা মাত্রই মুখ বাড়াল নাড়ুদা।

“আরে আসো আসো। তোমারই তো অপেক্ষা হচ্ছে। সবাই তো এসে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। “

নাড়ুদার দোকানে ছোট্ট একটা নাইট বালব জ্বলছে। তার আবছা আলোয় পল্টন দেখল ভিতরের পাতা বেঞ্চিতে দুজন মানুষ বসে আছেন। এ পাড়ায় তাদের কোনওদিন দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। একজন খুব লম্বা আর একজন ততোটাই বেঁটে। এ আর কী নতুনত্ব দেখাচ্ছে নাড়ুদা। সেই তো আড্ডার জন্য দুজন নতুন প্লেয়ার জোগাড় করেছে। বিরক্ত হচ্ছিল পল্টন। ওর এই অস্বস্তির কথা বুঝেই দেখা গেল আসরে নেমেছে নাড়ুদা।

“এঁরা হলেন বিনোদবাবু ও প্রমোদবাবু। ভীষণ ভাল শ্রোতা। আজ আমি একটা গল্প শোনাচ্ছি। পল্টন দাদাবাবুরও আশা করি ভাল লাগবে।” এতদিন এই দোকানে আসছে। নাড়ুদাকে সেভাবে কোনওদিন কিছু বলতে দেখে নি। সবসময় শ্রোতার ভূমিকা থাকে। একটা, দুটো নয়। নাড়ুদার ঝুলি থেকে সেদিন অনেকগুলো রোমহষর্ক গল্প বেরিয়ে এল। নাড়ুদার ছোটবেলাকার গা ছমছমে ভূতুরে অভিজ্ঞতার কথা শুনতে বেশ লাগছিল সকলেরই। মেঠো বাচনভঙ্গিতে বেশ জমিয়েও দিল নাড়ুদা। একঘেয়েমি কাটল পল্টনেরও।

শেষপর্যন্ত এই নৈশ আসর যখন ভাঙল তখন রাত প্রায় দুটো। অতো রাতেও সকলের জন্য স্পেশ্যাল চা বানাল নাড়ু। পরেরদিন স্বাভাবিকভাবেই একটু বেলা করে উঠল পল্টন। উঠেই তড়িঘড়ি ছুটে গেল নাড়ুদার দোকানে। কিন্তু নাড়ুদার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ দেখে বেশ অবাক হল। দেখা হল উৎপল চক্রবর্তীর সঙ্গে।

“কী ব্যাপার উৎপলদা? নাড়ুদার দোকান বন্ধ যে? “

“আর বোলো না। কাল রাত নটা নাগাদ খবর এল নাড়ুর যমজ ভাই হারু আর ওর দুই বন্ধু লরি চাপা পড়ে মারা গিয়েছে।
কালিদাসের গাড়িটা নিয়ে ওরা তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল। অমিত, সুভাষও গেছে। “

“কী বলছেন দাদা? তাহলে কাদের দেখলাম আমি? ” পল্টন নিজের বিস্ময় চাপতে পারল না কিছুতেই।

“কাদের দেখলে মানে? ” কৌতুহলী হলেন উৎপল।

“ও কিছু না। “

এরপর আর কীই বা বলার থাকে। পল্টনের এইসময় খুব মনে পড়ছিল ওর বন্ধু সরোজের কথা। আত্মারা নাকি নানা বেশে চলে আসছে ওদের পুনে শহরে। তবে কী নাড়ুদার যমজ ভাইয়ের আত্মা এসেছিল আগের রাতে? সঙ্গে ওই লম্বা ও বেঁটে লোকটা।তাহলে দুদিন আগে পুকুরপাড়ে এই নৈশ ঠেকের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল যে সেকি নাড়ুদা না ওর যমজভাই হারু? এটা কিছুতেই পরিস্কার হল না পল্টনের কাছে।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত