উৎসব সংখ্যা গল্প: পংক্তিরা যখন মুছে যায় । রাজীব কুমার ঘোষ
ফোনটা আমার ধরার কথা নয়। এখন রাত দু’টো কুড়ি। রাতে আমার ফোন সাইলেন্ট মোডে থাকে। রাতে যদি ফোন আসে তাহলে তারা নম্বর ছেড়ে যায়। সকালে যদি সেই নম্বরের পাশে সেভ করা নাম ফুটে ওঠে তাহলে রিং ব্যাক করি। আর কোনো নাম না ফুটলে উপেক্ষা করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর খবর পাই। তবে এখন আর কেউ রাত বিরেতে ফোন করে মরার খবর দেয় না, হয় সকালে দেয় অথবা মেসেজ করে ছেড়ে দেয়।
ফোনটা আমি ধরতে পারলাম কারণ আজ আমার রাত পাহারার পালা। আমার পাহারায় ব্যাঘাত হবে না। বাবা সামনে বসেই কাগজ পড়ছে আর মাঝে মাঝে ডান হাত তুলে মাথায় ঠেকাচ্ছে। আমাকে শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে ফাঁকতালে উঠে না পড়ে।
কিশোর ফোন করেছে। কিশোর এত রাতে কখনো ফোন করেনি। করার কথাও নয়। যদিও ও জানে আমাকে মাঝে মাঝে রাত পাহারা দিতে হয়, আর এই লকডাউনে রাত পাহারাটা আমার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঁচটায় মা উঠে পড়ে। আমি ঘুমোতে যাই। দশটা নাগাদ উঠি। স্কুল বন্ধ, ক্লাসের বালাই নেই। আবার দুপুরে মা একটু ঘুমিয়ে নেয়, আমি তখন আবার পাহারা দিই।
আজ হঠাৎ কিশোর এত রাতে ফোন করেছে কেন কে জানে। ওর মায়ের কিছু হল নাকি! আমাদের দু’বাড়ি পরেই ওদের বাড়ি। কিশোরের মা একা থাকেন। কিশোর থাকে দক্ষিনেশ্বরে বালাজি না কী একটা নামের রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে। ঝট করে বাড়িতে আসা যাবে বলে নাকি ওখানে ফ্ল্যাট কিনেছিল। যদিও কোভিড পরিস্থিতি শুরু হবার পর এই দেড় বছরে এখানে একবারও আসেনি। প্রথম প্রথম বলত, মায়ের একটু খেয়াল রাখিস। সেই বলাটা অনেক আগেই থেমে গেছে। আমি অবশ্য যেতে আসতে খবর নিই। অনেক সময় এটা ওটা এনেও দিই। তাহলে কি কাকিমার কিছু হয়েছে, কাকিমা ওকে ফোন করেছেন আর এখন ও আমায় ফোন করছে। আমি ফোনটা ধরলাম।
“জাগতে রহো। বাপকে পাহারা দিচ্ছিস?”
“জানিস তো।”একটা নীরবতা তার পর যে কথাটা কিশোর বলল তার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। কিশোর বলল, “চল সেই স্কুলের মতন আমরা গান গাই, তুই শুরু কর।”
স্কুল ছাড়ার পর অন্তত দু’যুগ কেটে গেছে, কোনোদিন কিশোর গানের কথা তোলেনি। এমনকি মাঝে মাঝে বন্ধুদের গেট টুগেদারে সবাই যখন আমাদের ধরেছে গান করার জন্য তখনও ও এড়িয়ে গেছে। স্কুলে আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে ডাকা হত ‘কিশোর কুমার’ বলে। কিশোরের কিশোর আর আমার পদবী কুমার মিলিয়ে। যদিও প্রধান কারণ আমরা কিশোরের গান গাইতাম। কিশোর কুমারের বহু শোনা, কম শোনা প্রায় সব গানই কিশোরের কন্ঠস্থ ছিল। ওই গাইত আমার ভূমিকাটা ছিল অল্প এবং অদ্ভুত। আসলে আমাদের কিশোরের গান শুরু করাটা ছিল একেবারে আলাদা রকম, যার জন্য আমাদের উঁচু ক্লাসের দাদারাও চিনত এমনকি অন্য স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরাও। আমাদের এই মফস্সলটা তো তখন বহরে একটু একটু বাড়ছে বটে কিন্তু উচ্চতায় বেড়ে যাওয়া তখনও শুরু হয়নি। শুরু হয়নি ফ্ল্যাটেদের আকাশ দখলের প্রতিযোগিতা। রাস্তায় বেরোলেই চেনা মুখেদের দেখা পাওয়া যেত। ফলে কোনো কিছু উল্লেখযোগ্য হলে, অন্যরকম হলে সেই খবর সবার কাছেই চলে যেত। আর আমরা আর আমাদের গাওয়া কিশোরে গান ছিল সেই অন্যরকমের তালিকায়।
আমরা কিশোর কুমারের গান প্রথম লাইন দিয়ে শুরু করতাম না। প্রথমে আমি গানের দ্বিতীয় লাইনটা শুরু করতাম, তারপর কিশোর গাইত প্রথম লাইনটা, তারপর গান, গানের মতোই গড়িয়ে যেত। শুধু যখনই প্রথম আর দ্বিতীয় পংক্তি গানের মাঝে ফিরে আসত সেই দ্বিতীয় পংক্তিটা আমি গাইতাম। তখন ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল, এখন অবশ্য ইউ টিউবে শুনেছি রিমিক্স গাওয়ার সময় অনেকে এইভাবে শুরু করে। আমাদের ছোটোবেলায় গান শোনা বলতে রেডিও, কারো বাড়ি থেকে ভেসে আসা রেকর্ড প্লেয়ার আর পরে টেপে ক্যাসেট বাজানো। আরো পরে ছোট্ট সাদা কালো টিভি। সিনেমা যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
“কী রে! কী হল? শুরু কর।”
আমার সন্দেহ হল কিশোর বোধহয় প্রকৃতিস্থ নেই। গলাটাও যেন টলছে।
“কী হয়েছে বল তো? হঠাৎ করে এত বছর পরে তাও আবার এত রাতে?”
“তুই জেগে আছিস, আমি জেগে আছি। আমি ফাঁকা আছি, তুই ফাঁকা আছিস। তুই নিশ্চয়ই রাতে পড়াশুনো করছিস না?”
“কে বলল তোকে আমি পড়ছি না? আমি রোজ রাতে পড়াশুনা করি।” কিশোর একটু থমকে গেল, বলল, “কী পড়িস?”
আমি সামনে টেবিলে রাখা খোলা ফাইলটার পাতা ওল্টালাম, বললাম, “একই পড়া দশ বছর ধরে পড়ে যাচ্ছি মাঝে মাঝে চ্যাপ্টার যোগ হয়। শুনবি একটু আমার রাতের পড়াশোনা?”
“বল।”
আমি বলতে শুরু করলাম যদিও ফাইলের দিকে না তাকিয়ে। বার বার দেখে দেখে লাইনগুলো আমার মুখস্থ হয়ে গেছে, “পারকিনসন ডিজিজ ডিমেনশিয়া, টাইপ টু ডায়াবেটিস, ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি, হাইপারটেনশন, হাইপোথাইরয়ডিসম…”
কিশোর চাপা গলায় বলে উঠল, “বন্ধ কর।” আমি বলেই চললাম, “…ফর লাস্ট কাপল্ অফ ইয়ারস্ হি হ্যাজ ডেভেলপড্ স্টিরিওটাইপ হোয়্যার হি কিপস্ অন টাচিং রাইট সাইড অফ্ হেড উইথ হিজ রাইট হ্যান্ড। আপন রিডিউসিং দ্য ডোপেনজিল হি ওরসেন…”
কিশোর প্রায় আর্তনাদ করছে, “থাম। তুই থাম।” আমি কেন জানি না থামতে পারছি না, বলেই চলেছি, “প্রেজেন্ট মেডিসিন — সিনডোপা ওয়ান হান্ড্রেড টেন, কুইটিপিন টোয়েন্টি ফাইভ এম জি, ডোনেপ টেন এম জি, অ্যাংজিট, ক্লোপিভাস, নেক্সপ্রো আর ডি, রোসুফিট এফ, জিমার, ভোলিবো, এলট্রক্সিন, নাইট্রোকনটিন, টেলমা…”
ফোনের ওপ্রান্তে কিশোর চুপ। আমি বললাম, “এগুলোই আমার এখন গান। গাইতে বলছিলিস না। ”কিশোর বলল, “কাকু এখন কেমন?”
“জেনে কী করবি? আমি বলেই বা কী করব? সত্যিই জানতে চাস?”
“না চাই না। বলিস না।”
“তুই বরং বল এত বছর পরে হঠাৎ গান গাইতে বলছিস কেন?”
“বললে তুই বিশ্বাস করবি না।”
“বলে ফেল। আমরা যে বয়সে ক্ষতবিক্ষত দাঁড়িয়ে আছি সেখানে বিশ্বাস অবিশ্বাস আর ম্যাটার করে না। আরোগ্যবিহীন ক্ষতস্থানের বিশ্বাস অবিশ্বাস বোধ থাকে না, শুধু জ্বালা থাকে, যন্ত্রণা থাকে। বলে ফেল।”
বাবা এইসময় আমার দিকে একবার চাইল, কিছু বলল না আবার কাগজ দেখতে লাগল। যদিও কাগজটা আদৌ পড়ছে কিনা সন্দেহ আছে আমার।
“আমি কিশোরের সব গানের প্রথম পংক্তি, ফার্স্ট লাইন ভুলে গেছি।”
“মানে?”
“একটা গানেরও প্রথম লাইন আমার মনে পড়ছে না রে। না বাংলা না হিন্দি।”
বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে ডায়লগ মারলেও, এবার আমার কী রকম যেন লাগছে। কী বলছে কিশোর ও কিশোরের সব গানের প্রথম পংক্তি ভুলে গেছে। কী করে এটা সম্ভব! লোকে সাধারণত প্রথম দু’চারটে লাইনই তো মনে রাখে, গায়। কিশোরের তো সব মুখস্থ ছিল! তাছাড়া কিশোর কুমারের গান এখনো রম রম করে সব জায়গায় বাজে, রিমেক হয়, রিমিক্স হয়। এফ এম জগতের ভাষায় কলকাতাকে বলা হয় রেট্রো শহর, এখানের মানুষ সবচেয়ে বেশি পুরনো গান শুনতে চায়। ধাক্কাটা সামলে আমি বললাম, “তুই কি বলতে চাইছিস তুই গানগুলো ভুলে গেছিস? গান ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক, অনেকেই ভুলে যায়, তাছাড়া তুই তো আর গাইতিস না।”
“তুই বুঝতে পারছিস না। গান আমি ভুলিনি। যে কোনো গানের সব লাইন আমার মনে আছে, সব; কেবল প্রথম লাইনগুলো আর মনে নেই। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কী অদ্ভুত? এক মাস হল ব্যাপারটা হয়েছে। কাউকে বলিনি, কাকে আর বলব।”
“ঠিক আছে ভুলে গেছিস। আবার শুনে নিলেই তো হয়। এত উত্তেজিত হবার কী আছে?”
কিশোর এবার খুব থেমে থেমে বলল, “আমার কাছে কিশোরের যত গানের সিডি, হার্ড ড্রাইভে স্টোর করা গান আছে সব বাজিয়ে দেখেছি কোথাও প্রথম পংক্তি থেকে গান শুরু হচ্ছে না, এমনকি প্রথম পংক্তি গানের মধ্যেও আর ফিরে আসছে না। আমার মোবাইলে ইউ টিউব আর যত গানের অ্যাপ আছে কোথাও প্রথম পংক্তি নেই। আমি টিভিতে গানের চ্যানেল খুলেও দেখেছি, প্রথম পংক্তি ছাড়া গানগুলো হচ্ছে। আমার সেভ করা গানের ফাইলের নামেও প্রথম লাইন নেই।”
আমার এবার সন্দেহটা তীব্র হল, কিশোর মাতাল হয়ে গেছে বা কোনো ড্রাগ নিয়েছে। পুরোপুরি অবাস্তব একটা কথা বলছে। আমি ঠিক করলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা শেষ করে ফোন রেখে দিতে হবে। কোনো মানে হয় না একটা মাতালের বা নেশাখোরের পাল্লায় পড়ে সময় বরবাদ করা। তারপর আবার ভাবলাম, করারই বা কী আছে আমার এই রাতে। তবুও কিশোর ফোন করল বলে আজ একটু অন্যরকম হল। না হলে প্রতি রাত পাহারাতেই অনেক কাজ নিয়ে বসি, শেষে দেখি সেই মেডিক্যাল রিপোর্টগুলোর লাইনে বহুবার পড়া লাইনগুলো, শব্দগুলো, অক্ষরগুলো দেখেই চলেছি। হয়ত ভাবছি একদিন লাইনগুলো বদলে যাবে। এক রাতে দেখব পংক্তিগুলো অন্যরকম কথা বলছে আর বাবা গল্প করছে আমার সঙ্গে, আমাদের পরিবারটা আবার ঝলমল করছে আনন্দে। বৌ আর মেয়ে ভয়ে সরে থাকছে না বাবার কাছ থেকে, কখন বাবা কী করে বসবে, মেরে বসবে সেই ভয়ে।
কিশোরকে কী বলব বুঝতে পারছি না। অন্বেষা জানে কিনা প্রশ্ন করে লাভ নেই। অন্বেষার কথা উঠলেই চুপ মেরে যায়। একটা চিন্তা ঝলক দিয়ে উঠল। আমি কথা চালিয়ে যাবার জন্য বললাম, “আমি ধরে নিলাম তোর কথাটা সত্যি, তাহলে আমাকে বল তুই কী করে বুঝছিস যে প্রথম পংক্তিটা বাদ পড়ছে? তুই তো ভুলে গেছিস, আর তুই তো আর শুনতেও পাচ্ছিসনা প্রথম পংক্তিটা। তাহলে তোর পক্ষে দ্বিতীয় পংক্তিটাকেই প্রথম ধরা উচিত?”
“মিলছে না তো। সুরে মিলছে না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি বাদ পড়েছে। আর ভেতর থেকে বুঝতে পারছি আমি ভুলে গেছি। সেই জন্যই তো তোকে আজ মরীয়া হয়ে ফোন করলাম। আমরা আগে যেরকম গাইতাম, সেইরকম তুই দ্বিতীয় পংক্তিটা গা, দেখি আমার প্রথম পংক্তি মনে পড়ে কিনা।”
আমি বুঝলাম যন্ত্রেরা যেহেতু প্রথম পংক্তি গাইছে না তাই কিশোর মানুষের দ্বারস্থ হয়েছে। পুরোটাই কিশোরের হ্যালুসিনেশন। বাবাকেই তো দেখছি, এমন এমন কথা বলে, কাজ করে বোঝাই যায় আমাদের জগতের বাইরে বাবার মনে আরেকটা জগৎ রয়েছে আর ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল এখন সেই জগতটাও বোধহয় ফ্রাগমেন্টেড, খন্ড বিখন্ড।
বললাম, “ঠিক আছে গাইছি আমি, যেমন গাইতাম দ্বিতীয় পংক্তি।”
কিশোর চুপ, অপেক্ষা করে আছে আর আমি ভেবে চলেছি কী গাইব, খুব কমন একটা গান গাই যাতে ওর মনে পড়ে। আমি জানি ওর ঠিকই মনে পড়বে। আমি শুরু করলাম, “চলে গেছে দিন তবু আলো রয়ে গেছে…”
আমার পংক্তি শেষ ও পাশে নিস্তব্ধতা। কিশোর কি সত্যিই ভুলে গেছে গানের প্রথম পংক্তি! আমি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম, মোবাইলে টাওয়ার দেখাচ্ছে না, সিগন্যাল নেই। এটা কি সমাপতন? হয়ত স্বাভাবিক ঘটনা, মাঝে মাঝে এখানে তো সিগন্যাল চলে যায়, এখন হয়ত সেই ঘটনাই ঘটেছে। আমি খানিক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম সিগন্যাল কিন্তু ফিরে আসল না।
গান গাওয়ার সময় বাবা তাকিয়েছিল। এখন আবার ফিরে গেছে কাগজে। আমি জানি আমি একটু এদিক ওদিক গেলেই বাবা উঠে পড়বে, তারপর কী করবে কোথায় যাবে কোনো ঠিক নেই। বাবার শরীরটাই আছে, মন পুরো ঘেঁটে গেছে, কম্পিউটারের ভাষায় বললে হার্ড ড্রাইভ বরবাদ, পোগ্রামগুলো সব জায়গায় জায়গায় ফাইল হারিয়ে অকেজো। দশ বছর ধরে এই চলছে। কখন রাস্তায় বেরিয়ে যাবে, গেছেও। কখন তেড়ে যাবে, যায়ও। কখন পড়ে যাবে, সেও গেছে অনেকবার। কিছুই ঠিক নেই। এখন আবার আমরা যে সময় ঘুমাই, বিশ্রাম করি সেই সময়েই বাবা অ্যাকটিভ হয়ে ওঠে, রাতে — দুপুরে। আর আমাদের যখন কাজের সময় তখন বাবা ঘুমায়। দিনের পর দিন এখন এই চলছে। মাঝে মাঝেই খুব ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে। সবাইকে মারতে যায়। বন্ধু বান্ধবকে আর বাড়িতে ডাকি না। আমরা কোথাও বাইরে যেতে পারিনা, ঘুরতে যাওয়া তো দূরের কথা। বাবাকে মায়ের হেফাজতে রেখে মাঝে মাঝে বেরোই আমরা কিন্তু বেশিক্ষণ না। ভয় করে ফিরে হয়ত দেখব কিছু ঘটে গেছে, খুব খারাপ কিছু।
বাইরে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। তাহলে নিম্নচাপের জন্য মোবাইল সিগন্যাল কেটে গেছে নিশ্চয়ই। প্রবল বৃষ্টি পড়ছে। আমি আর বাবা জেগে আছি, বসে আছি এক ঘরে। বাবার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, আমি জানি আপনি আমার বাবা, আপনি কি জানেন আমি আপনার ছেলে?
বাবার মাথাটা এবার ঢুলে আসছে। বাবা এবার সোফাতে বসেই ঘুমিয়ে পড়বে। বাবা এখন আমায় ভয় পায়, যেদিন থেকে বাবাকে বাধ্য হয়ে মারা শুরু করলাম, সেদিন থেকেই বাবা আমাকে ভয় পায়। সেদিন আমি না মেরে ছাড়ালে বাবা হয়ত মাকে মেরেই ফেলত। ধীরে ধীরে আমি আবিষ্কার করলাম যে মানুষের সঙ্গে ভাষা দিয়েও যোগাযোগ করা যায় না সেই মানুষও মারের ভাষা বোঝে, আঘাতের অপমান বোঝে।
আরো জোরে হাওয়া বইছে। বারান্দার একটা জানলা খোলা আছে। আমি বন্ধ করার জন্য উঠে বারান্দায় আসলাম। জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রবল বৃষ্টির ছাঁট আমাকে ভিজিয়ে দিল, তবু আমি জানলা বন্ধ করলাম না। দেখতে থাকলাম বাইরে হাওয়া আর বৃষ্টির তান্ডব। কতদিন পর আমি গাইলাম। আবার আমি গাইতে শুরু করলাম, এবারে প্রথম থেকেই “সে যেন আমার পাশে আজো বসে আছে … কোনো তারা নেই আজ আকাশের গায়/আলেয়ার আলো এসে আলো দিয়ে যায়”।
কিশোর আজকেও ওর মায়ের কথা তুলল না। আমার কাছে মায়ের খবর নেওয়া তো কবেই ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি আমি যদি কিশোর হতে পারতাম। আবার এও ভাবি কিশোর হয়ত ভাবে যদি ও আমি হতে পারত। কিশোর আসলে ঠিক কী ভুলে যাচ্ছে? গানের প্রথম পংক্তিগুলো নাকি জীবনের প্রথম পংক্তি?
গাইতে গাইতে আমি আটকে গেলাম। শেষ পংক্তিটা মনে পড়ছে না। তাহলে আমি কি ভুলে যাচ্ছি শেষ পংক্তিগুলো? বৃষ্টির ঠান্ডাতেই বোধহয় কেঁপে উঠলাম। জানলাটা বন্ধ করলাম। গায়ের জামা ভিজে গেছে। সারা মুখে জল, মাথাও ভিজেছে। আমি হেসে উঠলাম। কিশোর নেশার ঘোরে আমাকেও জড়িয়ে নিয়েছিল প্রায়। শেষ লাইন ভুলে যেতেই পারি। অন্য সময় হলে ভাবতাম না। আজ ভাবছি কারন কিশোর ওর ভুলে যাওয়ার ভাবনাটা আমাকে অবচেতনে সংক্রামিত করে দিয়েছে। গামছা দিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে মনে হল, সত্যিই কি তাই? এমন নয় তো যে আমি শেষ লাইনগুলো সত্যিই ভুলে গেছি!
আমি ঘরে ঢুকলাম। বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। টেবিলে রেখে দেওয়া মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলে উঠল। আমি হাতে নিয়ে দেখলাম সিগন্যাল ফিরে এসেছে। আমি অস্থির হাতে কিশোরের নম্বরটা রিসিভিং কল লিস্টে বার করার চেষ্টা করছি, আমার হাত কাঁপছে। আমার জানা দরকার কিশোর কি আমার গাওয়ার পর প্রথম পংক্তিটা গাইতে পেরেছিল? আমি কল করলাম, রিং হয়ে চলেছে। কিশোর যখন গাইবে তখন ওর গান থেকে শেষ পংক্তিটা কি আমি ফিরে পাব? আমার কি ফিরে পাওয়া উচিত?
কিশোরের নম্বরে এক খাপছাড়া কলার টিউন বেজেই চলেছে, “ভিজে যাওয়া বরষার হাওয়া…”
বাইরের তীব্র হাওয়ার আর বৃষ্টির শব্দে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠছে কলার টিউনের এই সুর। আমি হাতের মুঠোয় আরো শক্ত করে চেপে ধরলাম মোবাইলটা।

জন্ম ১৯৭৭, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা চুঁচুড়া, হুগলি, চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘সাইন্যাপস্ পত্রিকা’। আছে বেশ কিছু কবিতার বই ‘৩৫৮ বড়বাজার’, ‘চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হস্পিটাল’, ‘বিরাশি মাইল’, ‘অপূর্ব্ব কবিতাগুচ্ছ’ ও আরো কয়েকটি। এখনো পর্যন্ত গল্প সংকলন দুটি ‘ঘর ও দরজার গল্প’ (২০১৬) ও ‘অনেক জলের শব্দ’ (২০১৮)। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল ‘সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’, ‘শুভঙ্কর বলে কেউ নেই’। পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশযাপন পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো। উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি চন্দননগর গল্পমেলা কর্তৃক ‘অনাদি স্মারক সম্মান ২০১৯’।