| 4 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: শরবতের দাগ । রাজকুমার শেখ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

নিশির সঙ্গে জুমেরের অনেক দিন দেখা নেই। জুমের অনেক বার মোবাইলে ধরবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিশিকে পায়নি। আজকাল ও বদলে গেছে। কিন্তু কেন ও বদলে গেল? জুমের অনেক ভেবেছে। কিন্তু কোনটা সুরাহা খুঁজে পায়নি। আসলে কেউ নিজেকে আড়াল করে রাখলে তো কারো কিছু করার নেই। নিশি বাদসা নগরে থাকে। জুমেরের পাশের গ্রাম। অবশ্য এখন আর পাড়া গাঁ বলা যাবে না। সব খানেই টুম্পা ঝড়। কবে যেন মনের অজান্তেই ঢুকে পড়েছে এ সব। জুমের বড়ই অবাক হয়। জীবন বুঝি এভাবেই বদলে যায়।

জুমের আজ সকাল সকাল এসেছে। যদি নিশি এ পথে আসে। ও একটা কদম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে বড় বোকা বোকা লাগছে। রাস্তা চলতি মানুষজন ওকে দেখছে। জুমেরের কিছু করার নেই। নিশিকে ফোনে না পেলে ও কী করবে? সেই যে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেল আর দেখা নেই। এমন সময় একটা পাথরের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। ধুলোতে জুমেরের মুখটা ঢেকে গেল। ওর বুকের বাতাস যেন আটকে আসে। তবু ও দাঁড়িয়ে থাকল। বেলা হয়ে আসে। ও কেন এমন করছে? একটি মেয়ের জন্য এমন পাগলামি করা কি ঠিক হচ্ছে?  ও নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু মন মানছে না। সে এখানেই থাকবে। মনের সঙ্গে জুমের পেড়ে উঠতে পারছে না। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কদম গাছটাও যেন ওকে দেখে বিরক্ত। কি রকম ছেলেরে বাবা! একটি মেয়েকে দেখবার জন্য পাগল সেজে দাঁড়িয়ে আছে।

ওর বেশ খিদে পেয়েছে। কাছেভিতে কোনো দোকান নেই। পিপাসাও পেয়েছে। ফাগুন মাসের আজ শেষ তারিখ। এর মধ্যেই রোদের তাপ বাড়ছে। গাছে গাছে শিমুল ফুল। রেললাইনের ধারে দু একটি গাছ। বেশ লাগছে। কেমন লাল হয়ে ফুটে আছে। নিশি পছন্দ করে শিমুল ফুল। এ ফুলের গন্ধ না থাকলেও রুপ আছে। চোখ জুড়িয়ে যায়। জুমের দাঁড়িয়ে আছে। ওর পা ধরে এসেছে। কোমরও ব্যথা করছে। ওর কী দরকার ছিল? সামন্য একটি মেয়ের জন্য এ ভাবে আসা?কথা গুলো ও মনে মনে বিড়বিড় করে। না- এবার ও চলে যাবে। নিশি কি ওর হয়ে যাবে? ও কি এই দাঁড়িয়ে থাকা ব্যথার মর্ম বুঝবে? শুধু শুধু। দূর! আর কি পারা যায়? ও কদম গাছটার কাছ থেকে সরে আসে। জুমের ওর জীবনে এমন  বোকামির কাজ করেনি। ও বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। ভাগ্যিস নিশি দেখে ফেলেনি। ও তাহলে লজ্জায় মরে যেত। জুমের রেল লাইনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। শিমুল ফুল গুলো ঝরে পড়ছে। গোটা ঘাস জমিন জুড়ে আজ লাল হয়েছে। যেন লাল চাদর বিছানো। জুমের হাত দিয়ে একটি শিমুল ফুল তুলে নিল। যেন ও নিশির একটি আঙুল ধরল। ওর মনে কেমন একটা শিহরণ অনুভব করল। এর নাম কি ভালোবাসা?  ও জানে না।

দুই

আজ ওকে বলেছে নিশি আসবে। জুমের আজও সকাল সকাল বের হয়েছে। তার আজ সকালে টিফিন খাওয়া হয়নি। নিশি যেন ওকে ডেকে নিয়ে এসেছে। কতদিন ও নিশিকে দেখেনি। ওর মনটা আকুলিবিকুলি করছে। জুমের আবার রেল লাইনের দিকে এগিয়ে চলে। এ সময় কোনো লোকজন থাকে না এদিকটায়। শিমুল গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। বাতাসে আমের বোলের গন্ধ। কাছেই কোথাও আম গাছ আছে। জুমের বুক ভরে বাতাস নেয়। নিশি কেন আসে না? ওর বেলা বয়ে যায়। নিশির কোনো খবর নেই। জুমের পাগলের মতো এদিক ওদিক চায়। কিন্তু নিশির কোথাও দেখা নেই। শিমুল ফুলের মতো ও রাঙা। তবে কি ফুলের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে? জুমের একটা শিমুল ফুল হাতে তুলে নেয়। ফুলের ভেতর নিশিকে খুঁজতে থাকে। দূরে কোথায় আম বাগান থেকে একটা কোকিল ডাকল। ওই ডাকটা কি ওর বুকে ডেকে উঠলো?  জুমের বুকে হাত বোলায়। তার নিশি কেন আসে না? ওর কেমন কান্না পেয়ে যায়। ওর মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল। ওর মাথার ভেতরে শুধুই নিশি। ও ফোন বের করে কাকে যেন অনর্গল কথা বলছে। জুমের আজ ওকে দেখা না করে যাবে না।

অনেক বেলা হয়ে গেল। খিদে পেয়েছে। এখানে তেমন কোনো দোকান নেই। জুমের এখন কি করবে ভেবে পায় না। ওর মনের সব খানে নিশি। ফাঁকা রেল লাইনের ওপর ও বসে পড়ে।ট্রেন গেলেও ও আজ উঠবে না। ফাগুনের বাতাস লেগে শিমুল ফুল ঝরে পড়ছে। লাল হয়ে আছে গোটা জায়গাটা। জুমের শুয়ে পড়ল ফুলের চাদরে। ওর ওপরে শিমুল ফুল খসে খসে পড়ছে। এক সময় ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। ওর আজ খুব ঘুম আসছে। ওর ঘুমের ভেতর নিশি আসে। জুমের ওকে গল্প শোনায়। নিশি হাসে না। কেমন যেন চুপচাপ। জুমের ওকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল। নিশিকে ও কিছুতেই ধরতে পারছে না। জুমের বার বার চেষ্টা করে। কিন্তু নিশি ধরা দেয় না। ফাগুন বাতাসে ও যেন উড়ে গেল। জুমের ঘুমের মধ্যে কাঁদতে থাকে।

তিন

বাপ, ওঠ। এখানে কেউ শুয়ে থাকে?
জুমেরের মা ওকে ডাকে। জুমের চোখ মেলে খোলা আকাশ দেখছে। সূর্যটা ডুবো ডুবো হয়ে এসেছে। দূরে একটা পাখি ডাকছে। জুমের সে ডাক শোনে। ওর মন খারাপ। না- সে আজ এখান থেকে উঠবে না।  শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবে। পাখিদের গান শুনবে। পাখিদের সাথে গল্প করবে। ঘাসের বিছানায় শোবে। আর নিশিকে ও ফোন করবে। কথা বলবে। নিশি কেন আসে না?
বাপ, বাড়ি চল।
মা।
বল?
আমি নিশিকে এখানে আসতে বলেছি। ও এসে যদি না পায় আমাকে।
এ কথা শুনে ওর মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পাখিটি এখনো ডাকছে। ফাগুনের শেষ বেলাতে কেমন এক মায়াবি রং লেগেছে।
মা, নিশি আসবে না?
না। সে কি আছে বেঁচে?
মা,  তুমি মিথ্যে বলছো। আমি ওকে ফোনে রোজ কথা বলি।
ওর মা এ কথা শুনে কাঁদতে থাকে। জুমের  ফোন বের করে দেখায়।
এই দেখো মা, আমাকে কল দিয়েছিল।
ভাঙা ফোনটার দিকে ওর মা তাকিয়ে থাকে। চোখের জলে ভেসে যায় বুক। জুমের শুয়ে থাকে শিমুল ফুলের বিছানায়। তার বুকের ভেতর ডেকে ওঠে নিশি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত