ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: রূপান্তর । সঙ্ঘমিত্রা রায়
“ও হামিদ চাচা যাইবা নাকি আমাগো লগে !”
“হ যামু ।“
“নৌকা কই তোর সুন্দরী কলাগাছের ভেলা লইয়া আইলি নদীতে জল খুব বেশী না, আমাগো হগলরে লক্ষ্মীন্দরের মতন ভাসাইবি নাকি ,না ডুবাইয়া মারবি !”
“ডুইবা মরবা না চাচা সুন্দরী তা হইতে দিব না। নৌকা খান অনেক জায়গা ফাইটা গেছে জল ঢুইকা যায় সারাইতে হইব হের লাইগা ভেলাখান বানাইয়া লইলাম। নদী তো পার হইতে হইব না হইলে সুজন, ময়না ইস্কুলে যাইব কেমনে। চিন্তা নাই আমি দুই পাড়ে দড়ি বাইন্দা লইছি ওইটায় ধইরা ধইরা ভেলা খান পাড় কইরা নিমু ।“
“হু দড়ি খান দেইখা শক্তই মনে হইতাছে তুই বানাইছস নাকি! তয় বাঁশ দিয়া ভেলা বানাইলে হইত আমাগোর বাঁশবাগানে আর কিছু না থাকুক বাঁশের তো অভাব নাই!“
“হ চাচা আমরাও মা রে কইছি বাঁশ দিয়া ভেলা বানাইতে। কলাগাছের ভেলা দুইদিনে পইচা যাইব!“ – সুজন বলল।
“দেখ সুন্দরী তুই আমারে চাচা কস তোর পুলা,মাইয়াও আমারে চাচা কয়।“
“ওগোরে নিয়া আর পারি না চাচা ! এই তোরা হামিদ চাচারে দাদু কইতে পারিস না।”
“তুই বাচ্চা গুলানরে লেখাপড়া শিখানের লাইগা এত কষ্ট করছ সুন্দরী আর তো কেউ লেখাপড়া করে না। ছোট ছোট বাচ্চারা মাঠে ঘাটে ঘুইরা বেড়ায় আর একটু বড় হইলেই পেটের দায়ে কামে বাইর হইতে হয়।“
“কি আর করা যাইব চাচা। তয় আমার মনে হয় একদিন বাঁশ বাগানের অন্য বাচ্চারাও লেখাপড়া শিখব।“
“তোর কথা যেন ঠিক হয় সুন্দরী!”
সুন্দরী পাটনি নাম সুন্দরী হলেও সুন্দরের ছিটে ফোটা নেই। কুচকুচে কালো গায়ের রং, রুক্ষ, চেহারা শরীরের চামড়া, পা দুটো লিকলিকে অনেক জায়গায় ফাটা, লাল চুলগুলো উঁচু করে একটা খোঁপা বাধা থাকে। কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা আর লাল চুলে চওড়া সিঁদুর আর শাঁখা পলা হাতে। একখানা সস্তার ছাপার শাড়ি, রং পোড়া লাল ব্লাউজ আর তার দিয়ে বাঁধা চটি পড়ে প্রতিদিন স্কুল শুরুর অনেক আগে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে স্কুলে ছোটে সুন্দরী। সুন্দরীর বয়স পচিশ বছর কিন্তু দেখে মনে হয় পয়ত্রিশ বছর বা তারও বেশী! তবে সবকিছুর পরেও সুন্দরীর মুখে একটা তেজ রয়েছে সে প্রতি মুহূর্তেই যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকে।
মাতলা নদীর পাড়ের বাঁশবাগান গ্রাম খুবই অনুন্নত। হামিদ আলি সুন্দরীর প্রতিবেশী বুড়ো। আধুনিকতা, শিক্ষার আলো এই গ্রামে এখনও এসে পৌছায়নি। এরা এখনও সেই পুরানো যুগেই পড়ে আছে। গ্রামের বেশীর ভাগই পাটনি সমাজের মানুষ কয়েক পরিবার মুসলমান জেলে পরিবার রয়েছে। জনসংখ্যাও খুব বেশী নয়,বাড়ি গুলো বেশ দূরে দূরে। দুচারজন আছে যাদের সামান্য জমিজমা আছে তারাই এখানকার ধনী ব্যক্তি। বাকীদের আয় খুব কম রোজগারের জন্য এরা বাইরে যায় কেউ কাজ পায় আর কেউ এমনি ঘুরে ফিরে আবার গ্রামে চলে আসে। অনাহারে, অর্ধাহারে কাটে তাদের দিন। গ্রামের প্রায় সব লোকই দেখতে সুন্দরীর মতো একই ছাঁচে গড়া। অস্থি, চর্মসার কতগুলো কালো প্রাণী ওখানে যেন ঘুরে বেড়ায়। আশেপাশের অন্যগ্রামের লোকেরা তাদের বিদ্রূপ করে বলে‘ বাঁশবাগানের ভূত,পেত্নীর দল‘।
বাঁশ বাগানের লোকেরা একসময় কেউ কেউ মাছ ধরত, কেউ মাঝি ছিল আর কেউ কেউ বাঁশ দিয়ে ডালা, কুলা, চালুনি, পলো, খালুই এসব তৈরি করে আশেপাশের বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। এসব কারণেই এখানে বাঁশ এত বেশী আর জায়গাটার নাম বাঁশবাগান। কিন্তু এখন ওদের জীবিকা সবই অচল। বাঁশের তৈরি জিনিষ আগের মতো বিক্রি হয় না কেউ কেউ অন্যের জমি চাষ করে তবে তাকে অর্ধেক ফসল বা কখনও তিনভাগই জমির মালিককে দিয়ে দিতে হয়।
সুন্দরী বাঁশবাগানের মেয়ে আর এই গাঁয়েই বিয়ে হয় মগন পাটনির সঙ্গে। তাদের দুটো জমজ দুটো ছেলে মেয়ে সুজন আর ময়না। দুটোর বয়স আট বছর বাঁশবাগানে কোন স্কুল নেই একটা ভাঙ্গা স্কুল ঘর আছে সেখানে গাঁজা খোরেরা আড্ডা বসায় তার আশেপাশে গরু ,ছাগল চড়ে বেড়ায়। ছাত্র ,মাষ্টার কিছুই নেই তবে পাশের গ্রামের দুজন শিক্ষক নাকি এই স্কুলে চাকরী করে তাদের কাছে ছাত্রের নাম ধাম সবই আছে কিন্তু তাদের কেউ কখনও চোখে দেখেনি। সুন্দরী, মগনের খুব ইচ্ছা তাদের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে কিন্তু স্কুল অনেক দূরে প্রায় দশ কিলোমিটার। আগে এখানকার মানুষ নৌকায় চলাচল করত কিন্তু এখন বেশ দূরে মাতলা নদীতে ব্রিজ হয়ে গেছে সবাই ওদিকে চলাচল করে। তাই মাঝিদের নৌকাও আর চলে না। ওই রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতে গেলে প্রায় ছয় কিলোমিটার সে যেন একশ বছর আগে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো। এত দূরে পায়ে হেঁটে বাচ্চা দুটো যায় কি করে সুন্দরী শেষে রাস্তা আবিষ্কার করল। ওদের একটা ভাঙ্গা নৌকা আছে সেটা দিয়ে সে নিজেই এই পথে নদী পার হয়ে স্কুলের পথে ছুটে ওদিকে নদী পার হয়ে দু কিলোমিটার দূরে স্কুল। এখন নৌকা একেবারে ভেঙ্গে গেছে তাই সুন্দরী কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে নদী পার হয়। দুপারে শক্ত দড়ি বেঁধে তাতে ধরে সে পার হয় । যাবার সময় কাউকে পেলে উঠিয়ে নেয়।
সুন্দরী মিরপুর গ্রামের মেম্বার, স্কুলের হেড টিচারের হাতে পায়ে ধরে স্কুলের সহ– রাঁধুনির কাজ পেয়েছে তাই বাচ্চাগুলোকে আর একা যেতে হয় না সে তাদের সঙ্গে যায়।
সুন্দরীর পরিবারে সাতজন লোক। সুন্দরী, মগন, ময়না, সুজন, তার শ্বশুর মিহির, শাশুড়ি অবলা আর অল্প বয়সী নিঃসন্তান বিধবা ননদ অনিতা। মগন, মিহির মজুরী খাটে মাঝে মাঝে ভাঙ্গা নৌকা নিয়ে নদীতে মাছ ধরে, কক্ষনও মাটি কাটার কাজ, পাথর ভাঙ্গার কাজ করে আর রাতে বাড়ীতে বসে ডালা, কুলা, পাখা, টুকরি এসব তৈরি করে তবে এতে ঘরের মেয়েরাও তাদের সাহায্য করে। কিন্তু এত কিছু করেও কোনমতে সবার দুবেলা কোন মতে খাবার জুটে। সুন্দরী দিনরাত ভাবে কিভাবে পরিবারের লোকেদের ভালো রাখবে, বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখাবে সেই চিন্তায় থাকে। ঘরের আশেপাশে যতটুকু জায়গা আছে তাতে সব্জি চাষ করে, ভোরবেলা উঠে সংসারের সব কাজ সেরে ছেলে মেয়েদের নিয়ে ছুটে স্কুলে। যাবার সময় বাঁশের তৈরি জিনিষ কিছু নিয়ে যায় যদি কিছু বিক্রি হয়। বিক্রি মোটামুটি হয় তবে সুন্দরী দাম ঠিকঠাক পায় না অর্ধেক দামে তাকে বিক্রি করতে হয়।
সুন্দরীর বাচ্চাদের স্কুল যে গ্রামে তার নাম মিরপুর। মাতলা নদী পেরিয়ে মাঝখানে আরেকটা গ্রাম রয়েছে জেলেপাড়া ওখানে জেলেরাই বেশী থাকে ওটাও বাঁশবাগানের মতোই অনুন্নত। সুন্দরী নদী পেরিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরে মিরপুরে চলে যায়। মিরপুরে ব্রাহ্মন, কায়স্থ এদেরই বাস। ওখানে প্রাইমারী স্কুলের পাশেই হাইস্কুল আশেপাশের দুই তিন গ্রামে আর হাইস্কুল নেই। সুন্দরী স্বপ্ন দেখে তার ছেলে মেয়েরা প্রাইমারী স্কুল পাশ করে তারপর হাইস্কুলে পড়বে তার জন্য তাকে যত পরিশ্রম করতে হয় সে করবে।
মিরপুর বেশ উন্নত গ্রাম ওখানকার অনেকেই পড়াশোনায় অনেক দূর এগিয়েছে কেউ কেউ কলেজে পড়ছে, কেউ কেউ আবার ভালো সরকারী চাকরীও করছে। তারা বাঁশবাগান, জেলেপাড়ার লোকেদের তারা নিচু নজরে দেখে। এই দুই গ্রামের অনেকেই মিরপুরে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বাঁশবাগান, জেলেপাড়ায় যেমন কোন স্কুল নেই, তেমনি কোন বাজারও নেই। সব মিরপুরে রয়েছে তাই তাদের কিছু বিক্রি করতে মিরপুরে যেতে হয় আর সেই কারনে অনেক সময় তারা শাক সব্জি, মাছ, বাঁশের তৈরি জিনিষের কখনও ন্যায্য দাম পায় না। ওদের যদি কম দামে না দেয় তাহলে ওদের জিনিষপত্র ফেলে আসতে হবে। এ রকম চলে আসছে অনেকদিন ধরে।
সুন্দরী অনেক কষ্টে সহ রাঁধুনির কাজ পেয়েছে ঠিক কিন্তু ওখানেও তাকে রান্না ছুঁতে দেয় না কারন সে নিচু জাতির। গ্রামের মেম্বার রসময় চক্রবর্তী আর স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রনব দত্ত দুজনেই ভালো মানুষ। তারা সুন্দরীকে কাজটা দিয়ে দেওয়ার পর অনেকে তার উপর চটে যায়। সবাই মিলে বিচার বসান সুন্দরীকে ডাকা হয়। মিরপুরের বয়স্ক ব্যক্তি অলোকেশ ভট্টাচার্য বললেন, ”নিচু জাতির মেয়ে মানুষটা রান্না ছুবে আর সেই রান্না আমাদের বাড়ীর ছেলে মেয়েরা খাবে এত বড় অনাচার করলে তুমি রসময়। ওকে রান্নার কাজ থেকে সরিয়ে দাও।“
অলোকেশ বাবুর কথায় সবাই এক বাক্যে সায় দেয় । রসময় বাবু বললেন, “গরীব মানুষ এসে অনুরোধ করল তাই দিয়ে দিলাম এখন কি করে ছাড়াই বলত দাদা ।“
সুন্দরী কিছু বলে না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তার কান্নায় কষ্ট হয় রসময় বাবু আর প্রনব বাবুর। শেষে তারা আলোচনা করে বললেন, “ঠিক আছে ওকে যখন কাজ দেওয়া হয়েছে থাক। তবে সুন্দরী রান্না ছুবে না বাকী কাজ করবে। এতে তোমাদের অসুবিধা নেই তো!“
ওদের মধ্যে একটু কানাঘুষো চলল। তারপর অলোকেশ বাবু বললেন,
“রান্না না ছুলে আমাদের অসুবিধা নেই। ঠিক আছে সুন্দরী অন্য কাজ করুক আসলে নিচু জাতির লোকেরা তো আমাদের বাড়িতে ঝি, চাকরের কাজই করে।“
তাদের কথা মতো সুন্দরী রান্নাঘর পরিষ্কার, বাসন, ধোঁয়া, চাল, ডাল, সব্জি ধুয়ে দেওয়া, বাচ্চাদের খাবারের জায়গা পরিষ্কার করা এসব কাজ করে রান্না ছোয় না। শত অবজ্ঞা, অবহেলার মধ্যেও তার চোখে স্বপ্ন ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষ করা।
দুই
মিরপুর প্রাইমারী স্কুলে নূতন একজন দিদিমণি এসেছেন মেদিনীপুরে বাড়ি। তার নাম নবমিতা বসাক। আগে স্কুলে তিনজন শিক্ষিকা, প্রনব বাবু ছিলেন নবমিতাকে নিয়ে পাঁচজন হল। প্রণব বাবু ছাড়া বাকী সবাই সুন্দরীকে নিয়ে নাক ছিটকান তাদের বাড়ি মিরপুরের আশেপাশেই । কিন্তু ছাব্বিশ বছর বয়সী নবমিতা বেশ উদার আর আধুনিক চিন্তা ভাবনা সম্পন্ন। সে একটা এন,জি,ওর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করে। নবমিতা স্কুলে এসেই দেখে সুন্দরীর প্রতি এত বৈষম্য তার ভালো লাগে না আজকের যুগেও এত জাতিভেদ প্রথা দিদিমণিদের কাছে সে এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল কিন্তু তারা তার কথা কানেই তুলেননি। শেষে একদিন প্রনব বাবুর কাছে জানতে চাইল, “স্যার আমরা কি এখনও একশ বছর আগে পড়ে আছি এই স্কুলে এত বৈষম্য কেন! সুন্দরী খাবার ছুবে না তার ছেলেমেয়েরা আলাদা বসে খাবে।“
“আমি সবই বুঝি নবমিতা কিন্তু কিছু করার নেই। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে আমাকে চাকরী ছেড়ে চলে যেতে হবে এখান থেকে।“
নবমিতা এ নিয়ে আর কাউকে কিছু বলতে যায় না সে জানে যাদের মধ্যে এত বৈষম্য তাদের শুধরানো এত সহজ নয়। সুন্দরীকে ভালো লাগে নবমিতার। তার ছেলে মেয়ে দুটো পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো তাদের ভালোবাসে নবমিতা আর একটু সময় পেলে সুন্দরীর সঙ্গে এটা ওটা গল্প করে নবমিতা। সুন্দরীর খুব ভালো লাগে নূতন দিদিমণিকে বাকী দিদিমণিরা তো তার সঙ্গে কথাই বলেন না।
সুন্দরীর ইচ্ছে হল নূতন দিদিমণিকে কিছু দেয়। নবমিতা মিরপুরে একজনের বাড়ি ভাড়া থাকে ওখানে কারেন্টের খুব সমস্যা রাতে গরমে খুব কষ্ট হয় তার। সুন্দরী নবমিতার জন্য দুটো বাঁশের পাখা তৈরি করে আনল আরও কয়েকটা পাখা আনল স্কুলের অন্য দিদিমণিদের জন্য। বাকীরা নাক ছিটকালেও নবমিতা বলল,”বাঃ সুন্দরী কি সুন্দর তোমার হাতের কাজ। আর কি কি বানাতে পার?”
“ডালা,কুলা, টুকরি, ফুলের সাজি এইসব পারি দিদিমণি। আমাগো বাঁশবাগানের হগলেই তা পারে।“
“তোমাদের বানানো জিনিষপত্র ভালো দামে বিক্রি হয় তাই না!“
‘’না দিদিমণি দাম আমরা পাই না আগে মোটামুটি ভালো পাওয়া যাইত কিন্তু এখন অর্ধেক দামেই বেচতে হয় না হইলে কেউ কিনতেই চায় না।‘’
“কোথায় কোথায় যাও তোমাদের বানানো জিনিষপত্র নিয়ে?“
“আশেপাশের গেরামের হাটে।“
“বাঁশগুলো কি কিনে আনতে হয়?”
“না দিদিমণি আমাগোর বাঁশবাগানে আর কিছু না থাকলেও বাঁশের অভাব নেই। মুলি, ডলু, পেঁচা, মিরতিঙ্গা সব বাঁশ আছে আমাগোর গেরামে।“
“বুঝেছি তোমাদের এই বাঁশ শিল্পকে রূপান্তর করতে হবে।“
“হেইডা কি দিদিমণি?”
“মানে তোমাদের এই ডালা, কুলার বাইরে এসে অন্য কিছু তৈরি করতে হবে। এখন আমাদের দেশের নানা জায়গায় প্লাস্টিক,পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করে বাঁশের তৈরি জিনিষপত্র ব্যবহার করছে তোমরা তো সবাই বাঁশের কাজ জান সেই কাজকে একটু নূতন ভাবে করতে হবে যাতে তোমাদের বানানো জিনিষ পত্রের চাহিদা বাড়ে একটা শিল্পকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিও না।“
“ একটু বুঝাইয়া কন দিদিমণি ! “
নবমিতা তার মোবাইল বের করে বাঁশের তৈরি নানা ধরনের জিনিষ দেখাতে লাগল। ঘর সাজানোর নানা জিনিসপত্র, বাঁশের তৈরি ডিবি, বোতল, ট্রে, ডিজাইনার মোড়া, মাদুর, সোফা, টেবিল আরও কত কি। সুন্দরী খুব মন দিয়ে দেখল জিনিস গুলো। নবমিতা বলল,” এসব জিনিস বানাতে পারবে তো এসবের বেশ চাহিদা আছে।“
‘’মনে হয় পারুম দিদিমণি কিন্তু এই গুলান বিক্রি করুম কই।‘’
‘’তোমরা আগে তৈরি কর দেখি কেমন পার বিক্রির ব্যবস্থা আমি করে দেব।“
সুন্দরীর মাথায় পোকা ঢুকে যায়। তাকে কিছু করতেই হবে এত দারিদ্রতা আর ভালো লাগে না তাদের গ্রামে বাঁশের অভাব নেই এসব কাজে লাগাতে হবে।
এরপর দুদিন স্কুল বন্ধ ছিল সুন্দরী বাড়ি এসে সব কাজ সেরে বাঁশ কেটে এনে কয়েকটা ঘর সাজানোর জিনিষ, মাদুর, ট্রে, সাজি, জলের বোতল বানাল। অবলা বলল,“ একি কি বানাছ বউ এইসব দিয়া কি হইব।“
‘’মা আমাগোর ইস্কুলে নূতন এক দিদিমণি আইছেন। তিনি কইছেন বাঁশ দিয়া নূতন কিছু বানাইতে হের লাইগা বানাইলাম কাইল তারে নিয়া দেখাইমু।‘’
‘’কষ্ট কইরা এইসব বানাইয়া কি হইব এইসব কেউ কিনব না আর আমাগো কষ্ট কমব না।‘’
সুন্দরী আর কথা বাড়ায় না তার বানানো জিনিষগুলো নিয়ে যায়। নবমিতা জিনিষগুলো দেখে বলে, “বাঃ সুন্দরী তোমার ট্যালেন্ট আছে বলতে হবে একবার দেখেই কি সুন্দর করে তৈরি করে ফেলেছে। সবচেয়ে ভালো হয়েছে বাঁশের তৈরি জলের বোতল গুলো তুমি এ রকম আরও জিনিষ তৈরি কর আমি সব বিক্রির ব্যবস্থা করে দেব। বাঁশ শিল্প আমাদের দেশের অনেক পুরাতন শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এগুলোকে হারিয়ে যেতে দিলে চলবে না। যেমন ধর কাঁথা সেলাইয়ের কাজ এখন শুধু কাঁথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তারও রূপান্তর ঘটেছে শাড়ি, বেডকভার, চুড়িদার সবকিছুতে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ হচ্ছে এবং দেশে বিদেশে এগিয়ে তার প্রচুর চাহিদা। আমি চাই তোমাদের বাঁশ, বেতের তৈরি জিনিষের চাহিদাও দেশে বিদেশে বাড়ুক। তাতে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষেরা এগিয়ে যাবে আর শিল্পটাও বাঁচবে।“
‘’হ দিদিমণি আপনের কথা আমার খুব মনে ধরছে। আপনে আমারে শুধু একটু বুঝাইয়া দিয়েন আমি নূতন নূতন বাঁশের জিনিষ তৈরি করুম।“
সেই শুরু সুন্দরী আরও কিছু বাঁশের জিনিষ তৈরি করে এনে নবমিতাকে দেয়। নবমিতা তার এন, জি,ওর উপর ওগুলো বিক্রির দায়িত্ব দেয়। সুন্দরীর বানানো জিনিষ তারা কলকাতায় নিয়ে যায় আর চট করে সব বিক্রি হয়ে যায় এবং তারা ভালো দাম পায়। নবমিতা সব টাকা সুন্দরীর হাতে তুলে দেয়। টাকা পেয়ে খুব খুশী সুন্দরীর পরিবারের লোকজন। এরপর পুরো পরিবার মিলে সুন্দরীকে সাহায্য করতে থাকে তারা নানা ধরনের জিনিষ তৈরি করতে থাকে। বুঝা যায় এসব জিনিষের চাহিদা বেশ আছে।
বাঁশ বাগানের লোকের বাঁশ, বেত দিয়ে নানা ধরনের কাজ করার দক্ষতা আছে কিন্তু তারা সেই পুরানো ডালা, কুলা, চালনির মধ্যেই পড়ে আছে। তাদের প্রতিভা,কাঁচা মাল সবই আছে কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি সময়ের সাথে সাথে চাহিদার পরিবর্তন হয় সেই সঙ্গে শিল্পের রূপান্তর হয়। সুন্দরী অনেকদিন থেকেই মনে মনে চাইছিল কিছু নূতন করার কিন্তু কি করবে, কিভাবে করবে সেটা বুঝতে পারছিল না। নবমিতা দিদিমণির ছোট একটা স্পুলিঙ্গ তার মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার মাথায় নিজে থেকেই নানা আইডিয়া আসতে থাকে আর তার পরিবারের সবাই তার শিল্প কর্মে তাকে সাহায্য করতে থাকে।
সুন্দরীর পরিবারের কেউ এক দণ্ড সময় নষ্ট করতে চায় না। তার অবলা,অনিতা দিনের বেলা সংসারের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ সেরে বাঁশ কেটে আনে, বেত তৈরি করে ছোট বড় বেত তৈরি করে। চট করে তো আর কিছু বানানো যায় না তার কিছু প্রাথমিক অধ্যায় আছে। সন্ধ্যার পর সবাই মিলে বসে তারা ডিজাইনার মোড়া, বেতের চেয়ার, ঘর সাজানোর নানা ধরনের শো পিস, ব্যাগ, খেলনা,পুতল,ঝুড়ি, জলের বোতল তৈরি করতে থাকে। সুন্দরীর ভাইও রাতে এসে তাদের সঙ্গে কাজ করে। কিছু কিছু জিনিষে রং করতে হয় তাও তারা করে। একেক জন একেকটা আইডিয়া বের করে সুন্দরী সবাইকে সাহস যোগায় আর নিজেও কাজ করে। একটা মশাল জ্বালিয়ে সবাই উঠোনে বসে কাজ করে ময়না, সুজন একপাশে বসে পড়াশোনা করে। ওদের বানানো জিনিষ বিক্রির দায়িত্ব নিয়েছে এন, জি, ওর লোকেরা। আস্তে আস্তে তাদের তৈরি জিনিষের চাহিদা বাড়তে থাকে।
তিন
সুন্দরীর পরিবারের একটু উন্নতি দেখে বাঁশ বাগানের অনেকে দেখতে আসে। তারাও চায় সুন্দরীর পরিবারের মতো কাজ করতে। অবলা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,” আমাগো উন্নতি দেইখা তোমরা হিংসায় জিলা মরতাছ। যাও যাও এইসব কাম তোমরা পারবা না।“
‘’কেন পারুম না বাঁশের কাম তো আমরা হগলেই জানি।“
“তোমরা যা জান হেইডা তা না এইগুলান অন্যরকম কাম।‘’
সুন্দরী কথা গুলো শুনে তার মনে হয় সবাই তাদের মতোই। তারাও কাজ করতে পারবে তাদের কাজে যদি আরও অনেকেই যোগ দেয় তাহলে তারা আরও নূতন কিছু করতে পারব আর তাতে বিক্রি বাড়বে তাতে বাঁশবাগানের উন্নতি হবে। কিন্তু শাশুড়ির মুখের উপর কিছু বলেনি। স্কুলে গিয়ে নবমিতা দিদিমণিকে বলল,“ দিদিমণি আমাগো গেরামের আরও অনেকেই বাঁশের কাম করতে চায়।“
‘’বেশ তো করুক না সবাই মিলে করলে তোমাদের শিল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আমি একদিন তোমাদের গ্রামে যাব ভাবছি সবাইকে এই শিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝাব।‘’
‘’খুব ভালো কথা দিদিমণি আপনে চলেন একদিন আমাদের গেরামে। সকলরে বুঝাইয়া দিয়েন তারাও গরীব একটু রোজগার ভালো হইলে হগলের উন্নতি হইব।“
“সুন্দরী তুমি যে সবার কথা ভাবলে দেখে খুব ভালো লাগল।“
নবমিতা একদিন বাঁশ বাগানে এল। অনেককে ডেকে এনে বাঁশ শিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝাল, কিভাবে কাজ কড়তে হবে তাও বুঝিয়ে দিল। তার কথা শুনে অনেকেই উৎসাহিত হল তারা ও বাঁশের কাজ করতে চায়। নবমিতা একটা কমিটি গঠন করে দিল এবং সুন্দরীকে সেই কমিটির সভানেত্রী করে দিল।
ব্যস শুরু হয়ে গেল কাজ। বাঁশ বাগানের মহিলা, বাড়িতে বসে থাকা বুড়ো বুড়িরা, মেয়েরা বাঁশের নানা ধরনের কাজ করতে শুরু করে দিল। এতে হিন্দু ,মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোক আছে। সুন্দরী সবাইকে আইডিয়া দেয় কোন বাঁশ দিয়ে কি বানাতে হবে তা সেই ঠিক করে তার মাথা থেকে নিত্য নূতন আইডিয়া আসতে থাকে । কেউ কেউ নিজেও নানা আইডিয়া বের করে তারা বাঁশ, বেত দিয়ে মাদুর, ব্যাগ, সোফা, চেয়ার, টেবিল, জলের বোতল, গ্লাস, ট্রে, নানা ধরনের ঘর সাজানোর জিনিস, টেবিল ল্যাম্প, ঝুড়ি, কৌটা, ফুলের সাজি তৈরি করতে থাকে। আস্তে আস্তে তাদের শিল্পের চাহিদা সারা দেশে বাড়তে থাকে। সুন্দরী বাঁশ গাছের গোঁড়া দিয়ে নানা ধরনের মূর্তি, ঠাকুরের মুখ বানাতে থাকে এটা পুরো তার আইডিয়া। তাদের বানানো জলের বোতল, গ্লাস, এসবের খুব চাহিদা রয়েছে। এখন এন,জি,ও ছাড়াও তারা বিভিন্ন মেলায় যায়, হস্ত শিল্প প্রদর্শনীতে যায়। ভালো বিক্রি হয় আর কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে তারা।
সময় চলে যায় কেটে গেছে ছয় বছর। সুন্দরীর পরিবার সহ বাঁশ বাগানের অনেকেই আর্থিক দিকে উন্নত হয়েছে সেই সঙ্গে অনুন্নত গ্রাম বাঁশবাগানের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের শিল্পের কদর এখন নানা জায়গায়। ময়না,সুজন মন দিয়ে লেখাপড়া করছে, তাদের দেখে আরও অনেকেই স্কুলে ভর্তি হয়েছে লেখাপড়া করছে। হামিদ আলি বলে‘ সুন্দরী তোর কথাই ঠিক হইল বাঁশবাগানের বাচ্চারা এখন ইস্কুলে যাইতাছে।‘ সুন্দরীর বাড়ীতে পাকা ঘর তৈরি হয়েছে তার মতো আরও অনেকেই সুন্দর ঘর তৈরি হয়েছে। সুন্দরীকে রাজ্য সরকারের হস্তশিল্প বিভাগে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সুন্দরীর পদক্ষেপ আর নবমিতা দিদিমণির সহায়তায় পিছিয়ে পড়া বাঁশ বাগান অনেক এগিয়ে গেছে। সুন্দরী ও তাদের বাঁশ শিল্প নিয়ে খবরের কাগজে অনেক লেখালেখি হয়। অনেকের কাছেই সুন্দরী কাজ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাঁশ শিল্পের রূপান্তর বাঁচিয়ে দিয়েছে বাঁশ বাগানের লোকেদের । সুন্দরীকে জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে তাদের বানানো জিনিস আস্তে আস্তে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। বিদেশেও বাঁশের তৈরি জিনিসের অনেক চাহিদা।
এখন আর পাশের গ্রামের লোকেরা বাঁশবাগানের লোকেদের“ বাঁশ বাগানের ভূত, পেত্নীর দল“ বলে না একটু সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। অর্থ, আর কাজের সুনাম তাদের সামাজিক অবস্থান বদলে দিয়েছে!”