| 17 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: আরোগ্য লতা। শাহনাজ মুন্নী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

‘সব রোগের সাথে আরোগ্য থাকে, সব অসুখের সাথেই থাকে উপশম। যখনই দেশে কোন নতুন রোগ আসে, তখন জানবা সঙ্গে তার ওষুধও আসছে ’ আমার নানী ছফুরা খাতুন বলতেন, ‘ঘরের আশে পাশে জলা-জঙ্গলে আনাচে কানাচে মন দিয়া খোঁজ করবা, দেখবা কোন না কোন জায়গায় একটা নতুন ধরনের লতা-পাতা বা অচেনা গাছের চারা জাইগা উঠছে, বুঝবা ওইটাই সেই আরোগ্য লতা, রোগের ওষুধ। পশুপক্ষীরা ওই দাওয়াই চিনে, শুধু আমরাই তারে অবহেলা করি, দেখলেও চিনতে পারি না, আসলে চিনবার মতো চোখ থাকতে হয়, আর কিছু না।’

নানীর ছিল বিড়ালাক্ষি, ধূসর সবুজে মেলানো উজ্জ্বল চোখের মণি, ত্বক ছিল দুধ হলুদে মেশানো কাঁচা সোনার মতো শ্বেত হরিদ্রা বর্ণ, জলপ্রপাতের মতো লালচে ধরনের ঢেউ খেলানো চুল ছিল তার মাথায়। একবার নটেকাঁটা আর লজ্জাবতীর শিকড় বেটে টানা তিন দিন তার রস খাইয়েছিলেন আমাকে, অতিরিক্ত শ্বেতস্রাব নিরাময়ের জন্য, পথ্য দিয়েছিলেন মেথিগুড়া, শুকনা ধনে আর পাকা বিচি কলা।

লক ডাউনের লম্বা একঘেয়ে দিনগুলিতে আমার নানীর কথা খুব মনে পড়ে। অফিসে যেতে হয় না বলে আমাদের সকাল বিকাল দিন রাত্রি এখন সমান হয়ে গেছে। এমনকি মাস, বার, সপ্তাহের হিসাবও গেছে গুলিয়ে। ইমরান বলে, সারা দিন ঘুমাতে ঘুমাতে আমাদের স্বভাব চরিত্র নাকি দিন দিন প্যাঁচার মতো হয়ে যাচ্ছে।

আমি হেসে বলি, ‘চলো তবে, সারারাত জেগে জেগে ইঁদুর ধরি দুজন মিলে। ঘরের সব ইঁদুর তো শেষ, এবার দেখছি বাইরে যেতে হবে প্রান্তরের মেঠো ইঁদুর ধরতে।’

‘ইদুর প্লেগ বহন করে, জানো না? ইঁদুরের গল্প বাদ দেও, ছফুরা খাতুনের কথা বলো! মৃত্যুকে না হয় কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকি! ’

ছফুরা খাতুনের কথা মনে পড়লেই, মনে হয় একটা নিঝুম গ্রামের সন্ধ্যায় গভীর জল-জংলার মধ্যে সারা শরীর ছেড়ে দিয়ে ভাসতেছি। কানের কাছে একটানা বেজে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকা আর বর্ষার ব্যাঙের মিলিত কোরাস। চোখের সামনে অজ¯্র জোনাকী পোকা আলোক বিন্দু জ্বালিয়ে ইতস্তত উড়াউড়ি করছে। একটা শান্ত সমাহিত আনন্দ বিরাজ করছে জগৎ জুড়ে। কাজের অবসরে ঘরের দাওয়ায় বসে ছরতা দিয়ে কুচি কুচি করে সুপারি কুচাতেন নানী, নয়তো হামানদিস্তায় টুক টুক ছন্দময় শব্দ তুলে শুকনা ত্রিফলা গুড়া করতেন। আর মন ভাল থাকলে বিড়াল চোখে কৌতুকের ঝিলিক ফুটিয়ে নিজের বিয়ের গল্প করতেন ছফুরা খাতুন।

‘প্রথমবার আমার বিয়া হয় ভাটি এলাকায়, কমলনগরে, এগার বছর বয়সে, ডাকাইতের ঘরে। পরিচয় গোপন কইরা বিয়ার সম্মন্ধ করছিলো তারা। বিরাট বিরাট দাও, কিরীচ, এক নলা বন্দুক আর বারুদভরা তাজা গুলি সেই বাড়িতেই প্রথম দেখি আমি।’ ছফুরা খাতুন কুট কুট কইরা হাসতো।

‘পরে না, আমার বাপ ভয়েরা সত্য জানতে পাইরা এক কাপড়ে শ্বশুরবাড়ি থেইক্যা নিয়া যায়।’

‘তোমার নানা তবে তার দ্বিতীয় স্বামী!’

‘না। বলতে পারো তৃতীয় স্বামী।

ছফুরা খাতুনের দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় এক কবিরাজ পরিবারে। নানা রকম ভেষজ উদ্ভিদের তীব্র বুনো গন্ধে মউ মউ করা সেই বাড়ি। সাত গ্রাম জুড়ে খ্যাতি ছিল ছফুরা খাতুনের শ্বশুর ময়নাল হেকিমের। সবাই বলতো, হেকিম সাব নাকি গাছ-গাছড়ার মনের ভাষা বুঝেন, নরম সুরে, ফিস ফিস করে কথা বলেন, জঙ্গলের গাছ-পালার সাথে। মুখে হালকা দাড়ি ছোটখাটো মানুষটা পুত্রবধূকে আদর করে ছোট করে কাটা যষ্ঠিমধু চিবুতে দিতেন, গাছ আর মাটিকে সম্মান করার কথা বলতেন। বলতেন, এই মাটি আকাশ অরণ্য জলে সবার অধিকার। প্রকৃতিতে বৈষম্য নাই গো মা জননী।

‘শুনেন আম্মাজান, এই গাছটারে চিন্যা রাখেন, এর শিকড় খাইলে রক্ত আমাশয় চিরতরে দূর হবে। এই যে দেখতেছেন স্বর্ণলতা, লজ্জ্বাবতী, শিমুল মূল, তুলসি, মুরছালিন, রামকলা এসবেরই আলাদা আলাদা গুণ আছে। সেই গুণের কদর করতে হবে। এই যে মানুষ গাছের উপরে পেশাপ করে, এইটা একদমই ঠিক না আর অকারণে গাছের পাতা ছিড়া’ও অপরাধ।’

ময়নাল হেকিমের স্বপ্ন ছিল পুত্র জয়নাল আবেদীনকে শহরের কলেজে পড়া-শোনা করিয়ে বড় ডাক্তার বানাবেন, কিন্তু উদাসি জয়নাল সেই স্বপ্নের ভার গ্রহণে নিদারুণ অক্ষমতা প্রকাশ করে একদিন গৃহ ত্যাগ করে নিরুদ্দেশের পথ ধরল। পাঁচ বছরেও যখন সে পেছনে ফেলে আসা সুন্দরী স্ত্রী আর মমতাময় পরিবারের টানে বাড়িমুখো হলো না, তখন অন্যপূর্বা ছফুরা খাতুনকে আবারো মলিন মুখে ফিরতে হলো বাপের বাড়ি।

‘ভেরী স্যাড।’ ইমরান তার মোবাইল স্ক্রীণে চোখ রেখে মন্তব্য করে।

আমি গল্প বন্ধ করে এক চিলতে ব্যালকনিতে যাই, দেখি সকালটা ধীরে ধীরে রং পাল্টে দুপুরের চেহারা ধরেছে, নিচে, ফাঁকা রাস্তায় কয়েকটা অভুক্ত বেওয়ারিশ কুকুর নিজেদের মধ্যে জটলা করছে। মাঝে মাঝে রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া মুখে মুখবন্ধ আঁটা, নাক মুখ ঢাকা সন্ত্রস্ত মানুষগুলিকে কেমন যেন অন্য গ্রহের প্রাণী বলে ভুল হয়। শুকনো মুখের রিকশাচালক তার বাহনটি নিয়ে প্যাসেঞ্জারের খোঁজে দ্রুত বেল বাজিয়ে চলে যায়। এক ঘোর সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কাল শুরু হয়েছে যেন! বার বার নিজের হাতের দিকে তাকাই, কে জানে এই হাতেই হয়তো ঘাপটি মেরে বসে আছে মৃত্যু দূত।

খানিক পরেই ইমরান এসে দাঁড়ায় আমার পেছনে। ফোনটা হাত থেকে সরিয়ে ব্যলকনির গ্রিল ধরে খুব উদাসি গলায় বললো, ‘মাঝে মাঝে মৃত্যুকে খুব কাছাকাছি মনে হয় জানো, মনে হয় দরজা খুললেই বুঝি বাঘের মত ঝাঁপ দিয়ে পড়বে ঘাড়ের উপর, যেনো পাশের ঘরেই ওৎ পেতে বসে আছে মৃত্যু।’

ইমরানের চোখে একই সাথে ভয় আর বিষন্নতার ছায়া।

‘দেখো মরতে তো হবেই, আজ বা কাল, মুক্তি তো নাই। মরলে ছফুরা খাতুনের মত সাহসী মৃত্যুই ভাল।’ আমি গ্রিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ইমরানের বিপর্যস্ত চোখের দিকে তাকাই। ‘দুপুরবেলা গোসল করে পরিস্কার সাদা কাপড় পড়লেন, পিতলের সুরমাদানি থেকে চোখে সুরমা লাগালেন, সারা বিকাল গল্প গুজব করলেন, সুস্থ সবল নিরোগ মানুষ রাতে ঘুমাতে গেলেন, সকালে আর সেই ঘুম ভাঙলো না।’

‘তোমাকে আজকে ছফুরা খাতুনে পেয়েছে’ ইমরান ম্লান হাসে।

কোন অতীত থেকে আমার নাকে এসে ধাক্কা দিতে থাকে ছফুরা খাতুনের গায়ে লেপ্টে থাকা সুগন্ধি আতরের ঘ্রাণ, স্মৃতি আর স্বপ্ন একাকার হয়ে যায়। ইমরান আমাকে হারিয়ে যাওয়া গল্পের ছিন্ন সূত্র ধরিয়ে দেয়,

‘তুিম যে বলছিলা ছফুরা খাতুন আবার ফিরে এল বাপের বাড়ি, পিতৃগৃহবাসিনী হতে..’

‘হ্যাঁ, স্বামী না থাকলে যুবতী মেয়ে আর কতদিন একা একা থাকতে পারে স্বামীর ঘরে, গ্রামাঞ্চলে একরকম বদনামই রটে গেল ছফুরা’র, দুই দুইবার শ্বশুর বাড়ি গিয়েও যে নারী ঘর পায় না, বা সংসার করতে পারে না, সে যে পোড়াকপালি হতভাগি, তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’

‘তারপর বিয়ে হলো তোমার নানার সাথে?

‘হলো। দোজবরে বিয়ে। চার সন্তান জন্ম দিয়ে আমার আপন নানী মারা গেছিলেন সূতিকা রোগে। অপয়া ছফুরা খাতুন এলেন সেই ভাঙা সংসার জোড়া লাগাতে। তার গর্ভে কোন সন্তান হয়নি। সারা জীবন আপন সন্তানের মত শর্তহীন ভালবাসায় সতীনের পুত্র কন্যা লালন পালন করেছেন উনি। ’

‘ছফুরা খাতুনের মায়ের নাম ছিল হাজেরা খাতুন, তার মায়ের নাম অজিফা বিবি, অজিফার মায়ের নাম গঙ্গা দাসী, গঙ্গার মায়ের নাম ছিল জগদ্দাত্রি আর জগদ্দাত্রির মায়ের নাম আন্নাকালি।’

‘ধূর! এটা কেমনে হয়? নাম আর জাত ধর্মে তো মিলে না!’

ইমরানের মন্তব্যে আমি মাথা নাড়ি, ‘কেমনে হয় জানি না, নানীকে তো কোনদিন জিগ্যেস করি নাই। উনি যা বলতেন, তাই চোখ বুঁেজ বিশ্বাস করতাম।’

মনে আছে হেমন্তের কুয়াশামাখা শীত শীত সকাল বেলা শিবপাশা গ্রামের মিয়া বাড়ির উঠানে ছফুরা খাতুনের পদ্ম ফুলের পাপড়ির মতো নরম পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতো ছানা পোনাসহ কয়েকটা লাল কালো রঙের মা মুরগী। একটা ঝুঁটি দোলানো কেশর ফোলানো দোঁআশলা অহংকারি মোরগ ঘাড় উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে লম্বা ঠ্যাং ফেলে সামান্য দূরে দূরে এদিক ওদিক ঘুরতো। সবুজ চোখের ছাইরঙা একটা হুলো ছফুরা খাতুনের কোলের নরম আদর পাবার আশায় সারাক্ষণ প্রত্যাশা ভরা জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে থাকতো তার দিকে। অভিমানি সুরে ডাকত মিঁয়াও মিঁয়াও, মানে আমাকে কোলে নেও, কোলে নেও। আর আকাশে নানীর মাথার উপর ডানা মেলে চক্কর দিতো তার পোষা এক ঝাঁক কবুতর।’

‘আহা! কবুতরের পাখায় যদি গা ছেড়ে উড়তে পারতাম! এমন দমবন্ধ অসহ্য দিন। মাসের পর মাস মৃত্যু ভয় নিয়ে টিকে থাকা! কি ভয়াবহ বন্দি দশা! প্রতি মুহুর্তে মনে হয় মৃত্যু এসে নিঃশব্দে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। ’

বন্ধ ঘরে ইমরান পিঞ্জিরায় বন্দি শুকের মতো ছটফট করে, ডানা ঝাপটায়।

জানালা দিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশের দিকে তাকায়া থাকতে থাকতে আমার মনে হয় এই সময় ছফুরা খাতুন থাকলে হয়তো বলতেন, ‘এই অবস্থটারে মাইনা নেও, ভাই। ভাবো, এই মৃত্যুময় অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাঁইচা থাকার একটা নীরব সৌন্দর্য আছে, গাছের দিকে তাকাও, দেখো তার কোনো তাড়া হুড়া নাই, ছটফটানি নাই, ভয় ডর নাই। জীবনে যা আসবে তারেই গ্রহণ করবা শান্ত চিত্তে, যদি তা মৃত্যু হয়, যদি তা আনন্দ হয়, যদি তুমি ব্যধিত হও, যদি তুমি পীড়িত হও, কি করবা? যার উপর নিয়ন্ত্রণ নাই তোমার, তারে নিয়ন্ত্রণের বৃথা চেষ্টা কইরো না। নিয়ন্ত্রণ ছাইড়া দিবা, জগতের সকল ভালবাসা তোমার পায়ের কাছে লুটাপুটি খাইব।’

একঘেয়েমি কাটাতে মুক্ত বাতাসের সন্ধানে মাঝে মাঝে মধ্য রাতে আমরা আমাদের সীমিত ছাদে চাঁদের আলোয় হাঁটতে যাই। রাতের আকাশে পাখা ঝাপটে ভয় ধরিয়ে উড়ে যায় একটা বাদুর। চারপাশের জমাট নীরবতা ভেঙে ইমরান হঠাৎ মুখে হাত চাপা দিয়ে খুক খুক করে কাশে, নাক মুখ ঢেকে সশব্দে হাঁচি দেয় দুয়েকটা। সন্দেহ আর আতংকে বুক কেঁপে উঠলে একটু দূরে সরে যাই আমি, ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হইল তোমার? জ্বর নাই তো?’

‘উহু !’

‘গলাব্যথা? গরম পানি দিবো? গার্গল করবা?’

ইমরান উত্তর না দিয়ে হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে ‘ আচ্ছা! ধরো, যদি ছফুরা খাতুনের ওই কথাটা সত্যি হয়, তবে তো এরই মধ্যে ঔষধের সেই অলৌকিক গাছ পৃথিবীতে চলে এসেছে, তাই না?’

আবছা আলোতে ওর চোখে মুখে দেখি বিদ্যুৎ চমকের মতো আশা লতার উজ্জ্বলতা। এতে জল ঢেলে দিতে মায়া লাগে তবু সত্যটাই বলি,

‘আসছে হয়তো। কিন্তু ইমরান এই হাইব্রিড শহরে তো তারে পাবা না। এইখানে মাটিই নাই, কংক্রিটের জঞ্জালে গাছ জন্মাবে কোথায়, কিভাবে?’

ইমরান একটু থেমে বলে, ‘টবগুলোতে দেখো না, নতুন কোনো চারা উঠছে কিনা..’

চাঁদের ম্লান আলোয় আমি দেখি, আসলে আমরা দুজনেই দেখি, ছাদের কোণা কাঞ্চিতে উপেক্ষা আর অবহেলায় পড়ে থাকা মাটির টবগুলোকে। সেগুলোর কোনটা শুকনো খরখরে মাটি বুকে কাৎ হয়ে পড়ে আছে, কোনটাতে আগাছার জঞ্জাল, কোনটিতে এখনো আধমরা হয়ে টিকে আছে নয়ন তারা, জবা ফুল বা মেহেদি পাতার শুকনা ডাল। অনেক দিন আগে কেউ হয়তো সখ করে গাছগুলো লাগিয়েছিল। এখন ওরা আপাংক্তেয়, কেউ ওদের যত্ন নেয় না, মাটি বদলায় না, পানিও দেয় না। দেখি ড্রাম কেটে বানানো একটা বড় টবে কুঁকড়ে যাওয়া হলুদ পাতা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে শুকনা জিরজিরে একটা পেঁপে গাছ।

ছফুরা খাতুনের উঠানের কোণে তার হাতে লাগানো সতেজ স্বাস্থ্যবতী পেপে গাছটার কথা মনে পড়ে আমার। ঝাঁক বেঁধে গাঢ় সবুজ ছোট ছোট পেপে ধরতো গাছটাতে। কখনোই গাছের সব ফল পাড়তেন না নানী, বলতেন, ‘কিছু রাইখ্যা দেও বনের পাখ পাখালির জইন্য, এইটা ওদের প্রাপ্য।’

প্রায়ই দেখতাম টিয়া পাখি নিভৃতে এসে ঠুকরে খাচ্ছে গাছে ঝুলে থাকা সেই পাকা পেপে। প্রতি বেলা খাইতে বসার আগে নিজের পাত থেকে একমুঠ ভাত নিয়া উনি ছড়ায়া দিতেন রান্নাঘরের পিছনে ঝোপে-ঝাড়ে, জঙ্গলে, মাটিতে,

‘মাটিতে খামাখা কেন ভাত ছিটাও নানু? পিঁপড়ার জন্য? ’

‘খালি পিঁপড়া নাগো, বুবু, এই ভুমিতে, মৃত্তিকায় কত শত সহস্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ ঘুইরা বেড়ায় যাদের খালি চোখে তুমি দেখতে পাও না, এই খাওন তো ছিটাই তাদের জন্য.. ’ ছফুরা খাতুন মুগ্ধতা ছড়িয়ে বলতেন।

ইমরান ছাদের চারিদিকে তাকিয়ে একটু উত্তেজিত কন্ঠে বলে, ‘আচ্ছা, এই গাছগুলিকে বাঁচাতে পারি না আমরা? ধরো, যদি প্রতিদিন সকাল বিকাল পানি দেই ..’

‘যদি মরা গাছে ফুল ফোটাই, নিরাময় ফুল..’ আমি তাল দিয়ে বলি ।

ইমরান ম্লান হাসে, বলে, ‘হ্যাঁ, তখন হয়তো এসব টবের কোণাতেই জন্ম নেবে আরোগ্য লতা, কি বলো?’

ভ্যাক্সিন যুগে ভেষজের প্রতি ইমরানের অগাধ আস্থা দেখে অবাক হই। পরদিন জোরেশোরে সমস্ত প্রতিভা উজাড় করে আমাদের গার্ডেনিং মিশন শুরু হয়ে যায়। দুজন মিলে আগাছা পরিস্কার করি, জৈব সারের সাথে ডিমের খোসা গুড়া করে মাটিতে দেই, গাছের গোড়ায় ব্যবহার করা চা পাতা ফেলি আর রোজ বালতি ভর্তি করে পানি ঢালি। যেন কেমন একটা ঘোরের ভেতর চলে যাই আমরা। এই ছোট ছোট টবগুলিতে যেন একেকটা স্বপ্ন চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে, মন দিয়ে তাদের যত্ন করলেই সেই যত্নের ফসল ফলবে, ধূসরতা সরিয়ে ঝলমলে সবুজ আভায় আলোকিত হয়ে উঠবে ছাদ।

‘বুঝছো, ঠিক করছি, পরজনমে কৃষক হবো, কাদা জলে মাখামাখি হয়ে ধুমায়া চাষাবাদ করব, দেখবা নগর ছাইড়া গ্রামে থাকব, ফসলবিশ্বাসী একটা সরল সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাব।’

ইমরান আহ্লাদিত কন্ঠে ঘোষণা করে। বাতাসে গাছের পাতা দোলে। সেই দোদুল্যমান সবুজে ঠিকরে পড়া সূর্যাস্তের অস্তমিত আলোতে তাকে বেশ সুখী আর পরিতৃপ্ত দেখায়।

এই আবেগ সাময়িক আমি জানি, গলায় টাই ঝোলানো উদীয়মান মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ ইমরান, যে কিনা সারাক্ষণ একে ওকে টপকে উপরে ওঠার উত্তেজনাময় সিঁড়ি খোঁজায় ব্যস্ত, সেই ইমরান খালি পায়ে লুঙ্গি কাছা মেরে মাথায় গামছা বেঁধে ক্ষেত নিড়ানী দিচ্ছে, চোখ বুজে সেই দৃশ্য কল্পনা করতে চেষ্টা করি আমি। কিন্তু কোন স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে না বরং চারপাশ কেমন ঘোলাটে লাগে। পরশু দিন অফিস থেকে ফোন করেছিল, নতুন প্রজেক্ট না আসা পর্যন্ত আমাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবৈতনিক ছুটি দেয়া হয়েছে। তারপর থেকেই প্রচন্ড একটা ক্লান্তি, একটা গভীর অবসাদ আমার উপর ভয়াবহভাবে চেপে বসেছে, বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না। হাতে পায়ে জোর পাই না। বুকে পিঠে কেমন চাপধরা একটা ব্যাথা। মাছের মতো মুখ খুলে হা করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেই।

ছফুরা খাতুন মাথার কাছে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকারে তসবিহ দানার মতো মৃদু আলোর জ্যোতি ঠিকরে পড়ে তার গা থেকে, নাকে এসে ধাক্কা দেয় কামিনীগন্ধা আতরের ঝিম ধরানো তীব্র ঘ্রাণ,

‘কি হইছে তোমার, বুবু ? খারাপ লাগতেছে?’

‘বুকের উপর ভীষণ চাপ.. যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে, খুব খুব কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে।’

ছফুরা খাতুন ছোটবেলার মতো দুই হাতে আমাকে ধরে উপুড় করে চিংড়ি মাছের মতো কুঁকড়ে যাওয়া ভঙ্গীতে শুইয়ে দেয়। তারপর তার নরম হাতে পিঠে ছোট ছোট মৃদু চাপড় দিতে থাকে। কষ্টটা কিছু কমে আমার। দরজার বাইরে থেকে ইমরান সা›তনার ভঙ্গীতে বলে,

‘চিন্তা করো না, আরোগ্য লতা ঠিক খুঁজে পাবো, ছাদের বাগানে এতদিনে নিশ্চয়ই সেই লতা জন্মাইছে, তাই না? কি মনে হয় তোমার?’

আমি ডুবে যাওয়া মানুষের মতো শ্বাস টানতে টানতে ছফুরা খাতুনের অনিন্দ্য কোমল মুখের দিকে তাকাই,

‘ও কবিরাজ বাড়ির বউ, ও ভালো মানুষের ঝি, বলো না আমারে আরোগ্য লতা কি দুনিয়াতে আসছে?’

মাথার কাছে বসে ছফুরা খাতুন তার পান খাওয়া লাল ঠোট উল্টায়, ‘হ্যাঁহ্! আসলেই বা কি হবে, বুবু ?’

‘কেনো? সেই আশ্চর্য লতায় মানুষর অসুখ ভালো হবে…’ আমি লোনা সমুদ্রে খাবি খেতে খেতে অস্ফুট উচ্চারণে বলি।

বনপাহাড়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার মত হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যান ছফুরা খাতুন। তার আলোময় মুখে ঘন কালো ছায়া পড়ে।

‘শোনো গো বুবু, মানষের মনে যখন অবিশ্বাস থাকে, যখন লোভ, হিংসা, ঘৃণা আর বিদ্বেষের চরা পইড়া যায়, তখন এই ওষুধ যে আর কার্যকর হয় না। হয়তো সত্যিই কোথায়ও ঔষধি গাছটা জন্মাইছে, কিন্ত তোমাদের চোখে যদি চাতুরী আর ভন্ডামির পর্দা পইড়া যায়, তখন তোমরা কি তাকে দেখতে পাবা? সততার স্বচ্ছতা ছাড়া ওই লতারে দেখলেও তো চিনতে পারবা না …’

আগুনে মোম যেমন গলে যায় তেমনি করে ছফুরা খাতুনের ফর্সা সুন্দর চেহারা আমার চোখের সামনে গলে গলে পড়তে থাকে। আমি চিৎকার করে ইমরানকে ডাকি। বন্ধ দরজার ওপার থেকে কেউ আসে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত