ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: তক্ষকের খোঁজে । শ্যাম পুলক
ক
মেয়েটি বললো, সে তক্ষকটি দেখেছে। মেঘের গর্জনের প্রতি সতর্ক থেকে সেটা ইটের খয়েরি দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিলো। তক্ষকটি বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল, কিন্তু একবারও তার দিকে তাকায়নি। ‘তক্ষকটি একবারও আমার দিকে তাকায়নি’। একসময় বিরাট আকারের ধূসর খয়েরি রঙের তক্ষকটি দেয়ালের ওপর থেকে নিচে নেমে আসা পাইপের পাশে—সবচেয়ে উপরের তলার কাছে জন্মানো বটবৃক্ষের আড়ালে হারিয়ে গেলো। তারপর সে অনেক খুঁজেছে, কিন্তু খুঁজে পায়নি। ‘আর একটি বারের জন্যও আমি ওটাকে দেখিনি।’
এরপর প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছিলো। ‘বিষণ্ণ একঘেয়েমি ও মৃত্যুকে আমার এক–ই মনে হয়।’ মেয়েটি বলেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় কোমর পর্যন্ত পানি। বৃষ্টি ভারি হওয়া শুরু করলেই মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। মানুষ বৃষ্টিতে ভিজতে মেতে উঠেছে। মেয়েটিও তার বাসা থেকে বের হয়েছে। ‘আমিও বৃষ্টিতে ভিজবো বলে বাসা থেকে বের হয়েছি।’
আমি যখন মেয়েটিকে দেখেছি, তখন সে বৃষ্টিতে ভিজছে। আর তখন আমার অর্ধেক জলে ডোবা শরীরে কয়েকটা জোঁক এসে রক্ত চুষতে শুরু করেছে, আমি একটা একটা করে জোঁক শরীর থেকে ছুটাচ্ছি, আর দূরে ছুঁড়ে মারছি। একসময় যখন সবকটি জোঁক ছুঁড়ে মারতে পেরেছি, তখন মেয়েটিকে আর দেখতে পাইনি। কিন্তু যখন আমি বাসায় ফিরছি, তখন হঠাৎ খেয়াল করি, মেয়েটি এক বারান্দায় দাঁড়িয়ে রঙিন কাপড়ে আঘাত করে করে তার চুল শুকাচ্ছে। প্রথমে আমি একবার তাকিয়েই সেই বাড়ি পেড়িয়ে অনেক দূর চলে আসি। কিন্তু হঠাৎ আবার ফিরে যাই। ফিরে গিয়ে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে যখন হাসি দেয়, তখন কাছে গিয়ে কথা বলা শুরু করি।
না, আমি কোনোদিন তক্ষকটি দেখিনি। ‘না, আমি কোনোদিন তক্ষকটি দেখিনি’, আমি তাকে বললাম। সে খুব উত্তেজিতভাবে সেটার সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে লাগলো। সেটা যে বিকট বিরাট, কতোটা বিকট, আর কতোটা বিরাট? চোখদুটি রক্তাক্ত। কিন্তু তখন সেটা মুহুর্তেই তার রূপ বদলায়নি। খয়েরি(কিন্তু মাঝে মাঝে সাদাটে) দেয়ালে তার পুরো অস্তিত্ত্ব শক্ত পায়ে আঁকড়ে ধরে সবুজ পাতার আড়ালে হারিয়ে যায়। আকাশ ধূসর—কোথাও গভীর কালো। বিজলীর রেখা মুহুর্তের মাঝে ব্যবধান তৈরি করছে। তার মধ্যেই সেটি হারিয়ে গেলো। এবং তার হাসির ঔজ্বলতায় তাকিয়ে আমি সহজেই বলে দিলাম, আমি তার জন্য তক্ষকটি খুঁজে বের করবো। ‘কোথায় গিয়ে আর সেটা লুকোবে?’ অবশ্যই তার বিরাটত্ব তাকে সহজে লুকাতে দেবে না—মেয়েটি বললো। ‘তবে হয়তো দেয়ালের বটগাছটিই কেবল আড়াল নয়।’
খ
আমরা তখন আড়াল ব্যাখ্যা করেছি। তবে আমি যখন বাসায় পৌছেছি, অনুসন্ধানে মনোযোগ দিয়েছি। গোধূলির আলোয় বিল্ডিঙয়ের ইটের রং রক্তিম হয়েছে, বটবৃক্ষের পাতা গাঢ় রঙ পায়—ছায়া আরও আড়াল নির্মাণ করে। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকার চলে আসে। তখন আমি বসে বসে অনুসন্ধানের একটা রেখাচিত্র আঁকি। কোথা থেকে কোথায় গেলে ঠিক তক্ষককে পাওয়া যেতে পারে—কিন্তু মেয়েটির ব্যাখ্যায় সেটি একটা নির্দিষ্ট আড়ালেই পড়ে থাকে। পরে আমি সেটার বিরাটত্ব মাপার চেষ্টা করেছি। যেখানে সেটি সহজেই বটের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে পেরেছে। গাছটি বিল্ডিঙয়ের ইটের ফাঁকে জন্মেছে। মেয়েটির ব্যাখ্যায় গাছটির আকারের ওপর তক্ষকটির আকার নির্ভর করে। কিন্তু সূত্র হিসেবে তা কতোটা স্পষ্ট হতে পারছে? তাছাড়া গাছটির আকারের ওপর তার নির্মিত আকার কতোটা নির্ভরশীল?
আমি মনে করি আকার বাড়তে থাকলে আড়াল বাড়ে, কিন্তু আড়ালের বিস্তার কেবল তার ওপর নির্ভর করে না। দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে?—পরদিন মেয়েটি এই প্রশ্ন করে। ‘সূর্যের ওপর নির্ভর করে?’
মেয়েটি তার পরিবারের লোকদের এমন বিকট তক্ষক দেখার কথা বলেছে। কিন্তু কেউ সেটার এমন বিকটত্বের ব্যাপার বিশ্বাস করেনি। তবে সে তাদের কাছ থেকে তক্ষকের ব্যাপারে কিছু বিষয় জেনেছে। ‘শোন, তক্ষক হলো অবিশ্বাসী, নাস্তিক’, মা বলেছে। বোন বলেছে, সে মোটেই তক্ষক দেখেনি, নিশ্চয়ই কাঁকলাস দেখেছে। কিন্তু কতোটা বিরাট আকারের তক্ষক সে দেখেছে?—তার দেখা বিরাটত্ব একটা তামাশার জন্ম দিয়েছে। ‘এটা কি নিছক তার ভিতরকার ফ্যান্টাসি নয়?’ সবাই এটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টায় মেতে থেকেছে।
কিন্তু মেয়েটি নিশ্চিত জানে, সে বিরাট তক্ষকটিকে বটবৃক্ষের আড়ালে লুকাতে দেখেছে, এবং সেটাই তার একমাত্র আড়াল নয়। কিন্তু সেটা কি আসলেই অবিশ্বাসী নাস্তিক? মেয়েটি প্রশ্ন করেছে। ‘তক্ষকটি কেমন অবিশ্বাসী? সেটা কি কেবল মিথ্যায় আড়াল করে? নাকি তার লাম্পট্যও স্পষ্ট?’
সেটা কথিত ভণ্ড, প্রতারকও। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি না, সেটা কথা দিয়েছিলো কিনা, বা কী কথা দিয়েছিলো। সেখানে হয়তো তার রূপ বদলের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। ‘হয়তো তার গভীর তৃষ্ণা যেটা তার ডাকের তীক্ষ্ণতায় ভেসে বেড়ায়, তার সূত্র ধরে তক্ষক অবিশ্বাসী—তৃষ্ণার এক মহামারি রূপ প্রকাশ ঘটায়।’ মেয়েটি প্রশ্ন করেছে, আমি সেটাকে অনুসন্ধান করেছি কিনা, আর খুঁজলেও কোথায় কোথায় খুঁজেছি। ‘একবার কি বটগাছের আড়ালে খুঁজে দেখেছেন?’
তাকে আমি অবশ্য বলিনি, যতোই আড়াল উন্মুক্ত করি, কিছু আড়াল তবু থেকে যায়। সব আড়াল কখনই সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয় না। কিন্তু আমি খুঁজেছি। আড়ালের সূত্র ধরে গ্রাফ করতে চেয়েছি। তখন যে ছোট ছোট খোপ তৈরি হয়েছে, সেসব খোপে এক এক করে অনেক সময় ধরে আমি আমার স্থিরদৃষ্টি পেতে রেখেছি। কিন্তু বিকট তক্ষক তার রক্তিম চোখ নিয়ে হাজির হয়নি। সেটার ধূসর খয়েরি লেজ কতোটা লম্বা তা আমি কল্পনা পর্যন্ত করতে পারি না।
‘আমি চেয়েছি, তার উত্তেজিত উদ্বিগ্ন চাহনি নিয়ে তক্ষকটি হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাক। হয়তো আমার দিকে তাকাবে না। হয়তো দেখতে চাইবে, তার লেজট কতো দূর পর্যন্ত প্রসারিত।’ মেয়েটি বলে, এই বিকট বিরাটাকার তক্ষকটি তার অস্তিত্ত্বের কতো দূর পর্যন্ত প্রসারিত সে তার হিসাবে ভাবতে পারে না। মাত্র দুই দিনেই কতোটা বিরাটত্ব তৈরি করেছে? ‘তার আশ্চর্যজনক হঠাৎ ক্ষণিক উপস্থিতি ও আড়াল আমাকে কতোটা তার অস্তিত্বে টেনেছে? এবং সেটা কেনো?’
আমার কাছে এসবের ব্যাখ্যা নেই। আমার মধ্যে হঠাৎ এমন কিছু খেলা করছে, যা সম্পর্কে আমার ধারণা অস্পষ্ট। কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবিত হবার অবসর আমি নিজেকে দেই না। নিছক নির্লিপ্ততায় ছেড়ে দেই। মেয়েটির উত্তেজিত উপস্থিতি ও তার আবেশে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি। তবে কথা দেই আরও সতর্ক ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমি তক্ষকটির অনুসন্ধান করবো।
গ
তক্ষকের এক বিপন্ন অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। তবে সেটাকে যদি খুঁজে পাই, তার বিপন্ন অবিশ্বাসী চোখে আমি কতোটা সময় ধরে তাকিয়ে থাকতে পারবো? তবে মেয়েটির দৃষ্টিতে সেটির উদ্বিগ্ন রক্তিম চোখের বিচলিত চাহনি ছিলো। যে দৃষ্টি মুহুর্তের জন্যও তার দিকে এসে স্থির হয়নি। মেয়েটির ধারণা, সে দৃষ্টি কিছু একটা খুঁজেছে। কিন্তু কী খুঁজেছে? মুহুর্তেই আড়াল উদ্ভাবিত হওয়ায় মেয়েটি তা বুঝতে পারেনি। সে অবশ্য নিশ্চিত নয়, কতোটা সময়ে সে তা বুঝতে পারতো।
সকাল হলে পুরো দেয়ালে আলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্যাকেট নিক্ষেপ করে বসে বসে পাহারা দেয়া শুরু করি। আলোর সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্যাকেটগুলো ফাঁদ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আমি পুর্বে যেমন কোনোভাবেই সম্পূর্ণ আড়াল উন্মুক্ত করতে পারিনি, এখানেও ছায়ার পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে না।
আর আড়াল যেহেতু একটা নয়, প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন বলে মেয়েটি বিশ্বাস করতে শুরু করে। ফলে মেয়েটির মতো আমিও কেবল সেই কাঁচা খয়েরি ইটের বটগাছের আড়ালেই তক্ষকটিকে খুঁজি না। অন্য সব রঙিন বিল্ডিং এর দেয়ালেও খুঁজি। যার মধ্যে কিছু কিছু বিল্ডিং আরও বেশি উঁচু। কয়েকটা বাড়িতে রঙ করা হয়নি। কয়েকটা দালানের ওয়াল পুরানো স্যাঁতসেঁতে, শৈবালও জন্মেছে। সিমেন্টের প্রলেপ ফেটে গেছে। রঙ মলিন হয়ে গেছে। কালচে রঙ ধারণ করেছে। আমি সবদিকের বিল্ডিঙে চোখ রাখি। কিন্তু কোথাও সেই বিকট তক্ষকটিকে দেখি না।
আমি রাস্তা ধরে হাঁটি। রোদের তীব্রতা বাড়লে ছায়ার গাঢ়ত্ব বাড়ার কথা ছিলো। বিল্ডিঙের দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠা পাইপ বেয়ে দৃষ্টি উপরে উঠতে উঠতে আকাশ পর্যন্ত পৌছে। দৃষ্টির শূন্যতা তখন এলোমেলো হয়। একসময় আমি আর কিছুই দেখতে পাই না। মাথা ঘুরতে থাকে। তৃষ্ণা পায়। তবে আমি হাঁটতে থাকি। আমাদের গলি থেকে ভিন্ন গলিতে যাই। শূন্য রাস্তা প্রসারিত হয়। শূন্য রাস্তার কোণে দেয়ালে ছায়ায় হেলান দিয়ে আমি একা দাঁড়াই। কিন্তু তক্ষকের দেখা মেলে না। কিন্তু তখন হঠাৎ আমার মধ্যে এক ধরণের ভীতি কাজ করে। আমি চোখ বুজে ফেলি। মনে হতে থাকে তক্ষকটি পাশের পাইপ বেয়ে তড়তড় করে উপরে উঠে গেলো। কিন্তু আমি যখন চোখ মেলে উপরে দেয়ালে তাকাই আবার আমার দৃষ্টি শূন্য হয়ে যায়। ফলে তক্ষকের বিকটত্ব আমার সামনে ভেসে ওঠে না। নিজেকে আমার অন্ধ মনে হয়। আমার অস্তিত্ব ফাঁকা শূন্য মনে হয়। শূন্য দৃষ্টিতে স্থির জড়তায় শূন্যে তাকিয়ে থাকি।
কিন্তু না, আমি তক্ষকটিকে খুঁজে পাইনি—যখন আবার হাঁটতে শুরু করি, সেই ধারণা স্পষ্ট হতে খুব বেশি সময় লাগে না। ফলে আমি আবার খুঁজতে থাকি। কিন্তু দুপুর শেষে যখন বাসায় ফিরি তখন সবকিছু এলোমেলো লাগে। তখন মেয়েটির দৃষ্টি আমার চোখে এসে পড়ে। তাতে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু ক্ষণকালেই আবার সবকিছুই কেমন এলোমেলো লাগে। তৃষ্ণায় গলা শুঁকিয়ে গেছে। আমি কী চাই তা মেয়েটির হাসির ভাষ্যে অস্পষ্ট। কিন্তু মেয়েটির উত্তেজিত ভঙ্গি—আমাকে তক্ষকটি খুঁজে পেতে হবে। বিকট তক্ষকটির অস্তিত্ত্ব প্রমাণ তার এমন কিছু হয়ে উঠেছে, যার সাথে এমনকি তার পুরো অস্তিত্ব জড়িত। উত্তরের বাঁশঝাড় মাড়িয়ে ঝড় উদ্ভাবিত শীতল বাতাস আসে। একটা শব্দ আমার কানে বাজতে থাকে। আমি দেয়ালের কোণে মুখ গুঁজে দিয়ে দাঁড়াই। মেয়েটি তার ভেজা চুল ঝাড়ছে। ঘাড়ে বিন্দু বিন্দু জল চিক চিক করছে। তখন হঠাৎ সবকিছু আবার এলোমেলো হয়ে যায়। মনে হয় মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে কিছু খুঁজছে। যা আমার খুঁজে পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমি তা পাইনি। তবু আমি চাইনি সে দৃষ্টি সরিয়ে নিক। যদিও প্রতি মুহুর্তে ভীতিকর অস্বস্তি বাড়তে থাকে। কিন্তু সে নিশ্চয় সেই বিকট তক্ষকের রক্তাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে, যেটা একবারও তার দিকে ফিরে তাকায়নি। ফলে তার সেই তাকিয়ে থাকা অর্থহীন শূন্য দৃষ্টির রূপ নিয়েছে। সে আসলে কিছু পায়নি। যেটা সে আমার চোখে দেখতে চাচ্ছে। কারণ আমি কথা দিয়েছি তাকে তক্ষকটি খুঁজে দেবো। কিন্তু আমি সেটাকে দেখতে পাইনি। ফলে সে হঠাৎ চোখ সরিয়ে নেয়। আমি দেয়াল থেকে সরে একটি চেয়ারে বসে পড়ি।
ঘ
বিকালে মেয়েটির সাথে দেখা হয়। তখন আমরা ছাদে যাই। আমি তাকে বলি তক্ষকটি আমি খুঁজে পাইনি। আমি অনেক খুঁজেও যে পাইনি তাতে সে আশাহত না। সে কেবল এটায় নিশ্চিত নয়, সে তক্ষকটি দেখেছিলো, এমনকি খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যেও স্থির। সে এটা নিয়ে কিছুটা বিরক্ত কেনো, এখনও আমি ছাদগুলোতে খুঁজিনি। ছাদে গেলে শহরকে সবসময়েই অন্যরকম লাগে। তখন ভিন্নতা আরও বহু ভিন্নতার জন্ম দেয়। এজন্যই বেশিরভাগ বাড়ির মালিক তাদের ভাড়াটেদের ছাদে যেতে দেয় না। তবে আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কথা ছিলো, এক ছাদে খুঁজে না পেলে অন্য ছাদে যাবো। কিন্তু আমরা তাদের বিল্ডিঙের ছাদ থেকেই নামিনি। মেয়েটি চারদিকে যতো বিল্ডিঙ দেখা যায়, সবগুলোর দেয়ালেই তাকিয়ে থেকেছে। সবচেয়ে বেশি তাকিয়েছে বট গাছটির দিকে।
অবশ্য সে খুব বিরক্ত। প্রথমে পরিবারে লোকজন কেবল অবিশ্বাসী নাস্তিক তক্ষক নিয়ে তার সাথে হাসি ঠাট্টা করলেও, দুইদিন যেতেই তারা অনেক সিরিয়াস হয়ে গেছে। ‘কেনো যেন এখন আর ঠাট্টার নেই। কেবল পাগলাটে ছিটগ্রস্থই নয়, সবার কাছে কেমন নোংরা লাগছে। তবে কেউই সরাসারি তা প্রকাশ করছে না। তবে তারা এখন কেবল ভীত–ই নয়, বিরক্তও।’ আমি অবশ্য তাকে বুঝাতে যাইনি এমন একটি অদ্ভুত বিষয় নিয়ে কয়েকদিন মেতে থাকার মতো বালিকা সে হয়তো আর নেই। আমার এই ব্যাখ্যা তাকে যতোটা বিরক্ত করতো, সে আরও বেশি বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে। কারণ তার মায়ের আচরণ তাকে সবচেয়ে অস্বস্তিতে ভুগিয়েছে। বলতে গেলে তার মায়ের ভয়। মায়ের ব্যাপারটা এমন যে, তুমি তো অনেক আগেই ঐ সময়টা পাড় করে এসেছো। ‘তবে কেনো, এমন একটা অদ্ভুত বিষয় নিয়ে আমি হিস্টারিক হয়ে উঠেছি। যা বিরক্তিকর বাতিকের জন্ম দিয়েছে, যাতে আমি প্রলাপ বকছি’
আমরা যে অন্য কোনো ছাদে যেতে পারিনি, তার কারণ এই–ই অবস্থা, যেখানে উত্তেজিত আলোচনা ও বিরক্তি উপস্থিত ছিলো। একসময় কেবল সেই ভয় ও তার নোংরা প্রকাশ–ই কেবল উপস্থিত ছিলো, এবং আমরা এক সময় তক্ষকের খোঁজ নেয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অবশ্য আমরা যে তক্ষকটিকে খুঁজে পাচ্ছি না, এর কারণ অবশ্য তার সেই অবিশ্বাসী নাস্তিক রূপ–ই, যা শেষে প্রতারক ভণ্ডে প্রসারিত হয়েছে। আর পরে যে কথিত পারিবারিক আলোচনায় অশ্লীল রূপ পেয়েছে, তার ভিন্ন কারণ। ‘আপনাকে এটা খুঁজে বের করতেই হবে।’ মেয়েটি উত্তেজিতভাবে বলতে থেকেছে। ‘আমি সবাইকে বলেছি, তাদেরকে প্রমাণ করে দেখাবো, তক্ষকটি আমি দেখেছি। তা সেটা যতোই বিলুপ্তপ্রায় হোক না কেনো। কালকে, আপনার সাথে আমিও খুঁজতে বের হবো।’
তার উত্তেজিতভাবে কথা বলার ভঙ্গি, প্যাশোনেট চাহনি আমাকে চোখ সরাতে দেয় না। তবে সে আমার চোখে তাকিয়েও সেটা লক্ষ করে না। অন্ধকার হয়ে আসতে থাকলে চোখ আশ্চর্যরকমভাবে জ্বলতে থাকে। তাতে ভাবাবেগও বিষণ্নতায় রূপ নেয়। কারণ তখন এমন নয় আর কিছুই দেখতে পাই না, অদৌ এমন এক বাস্তবতা রূপ পায় যাতে মেয়েটির বিষাদমাখা বিষণ্ন মুহুর্ত ভেসে উঠতে থাকে। কিন্তু বাস্তবতাকে সবচেয়ে বিষণ্ন করে তোলে এটা যে, নির্মাণ মুহুর্তে বিষণ্নতায়ও আমি নিশ্চিত হতে পারি না। আমার মনে হতে থাকে এক অদ্ভুত বিকার আমাদের প্রতারিত করতে উন্মুখ, অথবা এক সরল বিকার আমাদের প্রতিনিয়ত প্রতারিত করছে—মেয়েটিকে, আমাকে—সবাইকে। ফলে আমরা একসময় তেমন এক অস্পষ্ট বাস্তবতা থেকে বিদায় নেই। যা আমাদের ঠিক কিছুই ব্যাখ্যা করে না। এমনকি তক্ষকের বিকটত্ব বা উপস্থিতি—অস্তিত্ত্বও না।
ঙ
রাত বাড়তে থাকলে আমি একা হতে থাকি। সন্ধ্যার বিচ্ছেদের সময় আমি জোর দিয়ে বলেছি, আমরা অবশ্যই তক্ষকটিকে খুঁজে পাবো। কিন্তু জানি না কোন সূত্র ধরে সেই পর্যন্ত পৌছা সম্ভব। কিন্তু আমি প্রতি মুহুর্তে আরও গভীরভাবে তার মধ্যে ডুবতে থাকি। কিন্তু আমার ডুবে যাওয়া মেয়েটি দেখতে পায় না। এবং রাত গভীর হতে থাকলে আমার মনে হতে থাকে, আসলে আমি ঠিক তক্ষকটিকে খুঁজছি না। আমি নিছক কয়েকদিন ধরে সেটাকে খোঁজার ভান করছি। নয়তো আমি কীভাবে এমন বিকট অস্তিত্ত্বের তক্ষকের অস্তিত্ত্বে বিশাস করতে পারি?
হয়তো আমি নিছক মেয়েটির উত্তেজিত ভঙ্গি, প্যাশনেট আবেগে তাড়িত। অথবা আমার বিশ্বাসের সাথে এসবের কোনো গুরুত্বই নেই। আমি নিছক হয়তো সেই মুহুর্ত দ্বারা তাড়িত যখন তাকে প্রথম দেখেছিলাম, যখন তৃষ্ণার্ত জোঁক তার রক্ত পানে আমাকে অবিভূত করে রেখেছিলো। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মুহুর্ত—যা ভীতির স্রোত প্রবাহিত করেছিলো—যা একসময় তার অস্তিত্ত্ব থেকে বের হয়ে এসেছে—যা আর শেষপর্যন্ত তার অস্তিত্ত্বে নেই—যেটা বর্তমান তা হলো কেবল মুহুর্ত—যা আর প্রসারিত হতে পারে না—বন্দিত্ব বরণ করেছে। এটা কি এমন আমার নিজস্ব বন্দিত্বের ব্যাপারেও আমার কিছু করার নেই? আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে? এমন নয় কেবল আমি বুঝছি না, কী, কেনো, কীভাবে, আমার নির্মাণের ভঙ্গিও প্রতারিত হচ্ছে। ফলে মেয়েটির প্রতি আবেগও আমাকে প্রতারিত করে। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাই। আবার অন্ধকারে ফিরি। কক্কক্ আওয়াজ ভেসে আসে। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই। আবার অন্ধকারে ফিরি। আবার যখন শব্দটা শুনতে পাই, তখন বুঝতে পারি—শব্দটা ঠিক ভেসে বেড়ানো নয়। স্থিরদৃষ্টিতে আমি নিজের চোখে তাকাতে পারি না। মেয়েটি তাকায়। সে কি এর রক্তাক্ততা অনুভব করেছে? শব্দটা বাড়তে থাকে। কিন্তু ভেসে ভেসে আমার কাছে আসে না। একটা ভীতির স্রোত আমার মধ্যে প্রবাহিত হয়। আমার অনুশোচনা হতে থাকে—কেনো আমি লাইট বন্ধ করেছি। কিন্তু এখন গিয়ে আলো জ্বালানো আমার সম্ভব না। আমি দেয়ালের সাথে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকি। দেয়ালে আমার ঠিক পাশে নখের আঁচর কাটার শব্দ আমার কানে আসে। আমি দেয়ালকে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখি। কিন্তু না, আমি তো ঠিক দেয়াল বেয়ে উপরে উঠছি না! জানালার শিক ধরে উপরে ওঠা যায়। তারপর পা ছড়িয়ে স্থবিরতার লক্ষণ অনুভব করা যায়। কিন্তু কিছু একটা ঠিকই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠছে—আবার নিচে নামছে। শব্দটা আমি শুনতে পাচ্ছি—কিন্তু ভেসে বেড়াচ্ছে না। বদ্ধ ঘরে বন্দিত্ববরণ করে আছে। আমার এমন কিছু করার নেই, যাতে সেই তীক্ষ্ণ চিৎকারকে মুক্তি দিতে পারি। আমি এমনকি দেয়াল ছেড়ে খাটে ঝাঁপ দিতেও পারি না।
তবে মেয়েটির চিন্তা কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। তার প্রেম বা আবেগ আছে—আমার প্রেম বা আবেগের অস্তিত্ব আছে। ধীরে ধীরে এমন কিছু আমাকে ঘিরে ধরে যার সহজ ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। এমন এক আবেগ আমাকে জড়িয়ে ফেলে যার সম্পর্কে সঠিক অনুভূতি বা প্রকাশ আমার জানা নেই। এক বিপন্ন ক্ষয় আছে, যার ক্ষয় সম্পর্কে কেবল ধারণা ছিলো। কিন্তু এখন তা এমন নয় আমাকে তাড়িত করছে, আমিই উদ্ভাবন করছি। আমি এমন কিছু উদ্ভাবন করছি, যার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। এক উন্মাদ ব্যাধিগ্রস্থ অবস্থা যা কেবল প্রচলিত অর্থে চাপিয়ে দেয়া। যেখানে যেটুক স্পষ্ট হয়, তা কেবল ভান, কৃত্রিমতা। যার ভিতরকার শক্তিই কেবল মেয়েটিকে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সেও আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার চোখ আমার চোখে পড়লে কেবল অন্ধত্বই স্পষ্ট হয়। অথবা এমন তৃষ্ণা যা তার কাছেও ব্যাখা পায় না, মুক্ত হয় না—জড়িয়ে ফেলে—তাড়িত করে, কিন্তু তক্ষক আসলে তার দিকে তাকায়নি। তার অবিশ্বাসী রক্তাক্ত চোখে মেয়েটি তাকিয়েছে, যখন আমার চোখে তাকায় এবং যা খোঁজে তা তৃষ্ণার সাথে সম্পর্কিত—বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পায় না। একইসাথে আমি যেহেতু তক্ষকটির চোখে তাকাইনি—কারণ আমার অন্ধত্ব, আমার ফাঁকা শূন্যতা—সব অন্ধকার গহ্বরে মিলিয়ে যায়। কেবল সেই অতল গহ্বরই বাস্তবতা হয়ে ওঠে। আর কিছু একটা শব্দ করে করে আমার পাশে দিয়ে দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠে আর নিচে নামে—নিচে নামে আর ওপরে ওঠে।
চ
সকাল সকাল আমরা তক্ষকটি খুঁজতে বের হলাম। প্রথমে আমরা বিল্ডিঙ এর দেয়ালে তাকাতে তাকাতে হাঁটতে থাকলাম। তারপর যখন অনেক সময়েও আমরা সেটাকে খুঁজে পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখলাম না, তখন মেয়েটি রাস্তার মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, তারা কোনো বিকট আকারের তক্ষক দেখেছে কিনা। সব উত্তরদাতাই প্রথমে আমার দিকে তাকালো, তারপর অদ্ভুত হাসি দিয়ে মেয়েটিকে উত্তর দিলো। না, কেউ বিরাটাকার তক্ষকটি দেখেনি। কিন্তু কেউ কেউ লজ্জিত হচ্ছে, কেউ কেউ ভীত হচ্ছো, কেউ কেউ বিরক্ত হচ্ছে, কেউ কেউ প্রথমে উৎসাহিত হচ্ছে, তারপর রেগে যাচ্ছে—শেষে তক্ষকটির মৃত্যু কামনা করছে। সে কেবল নিশ্চিত–ই নয়, সেটি অবিশ্বাসী, সেটি যেনো তার সাথেও প্রতারণা করেছে। কিন্তু না সে আসলে বিকট বিরাটাকার—মেয়েটির বর্ণনার তক্ষকটি দেখেনি। তবে তার মতো অনেকেই খুব সতর্ক। তারা জানে, তক্ষক দেখলেই মেরে ফেলতে হয়।
মেয়েটি যখন প্রশ্ন করছে, তখন অনেকেই মন খুলে উত্তর দিতে পারছে না। তখন তারা আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। দুই একজন আমার কাছে এসেও কথা বলতে থাকে। তখন তারা মেয়েটিকে পাগলাটে ছিটগ্রস্থ বলতেও দ্বিধা করে না। আমি অবশ্য এ নিয়ে তাদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেই না। এমন কিছু বলতে চেষ্টা করি যাতে তারা আমাদের এড়িয়ে চলে যাবে, বা যাতে তারা কিছুটা সন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবে। তারা চলে গেলে মেয়েটিকে আমার ব্যাখ্যা করতে হয়, তারা কী বলেছে—আর আমিই বা তাদের এত কী ব্যাখ্যা করলাম। তখন অবশ্যই আমি তাকে মিথ্যা বলতে দ্বিধা করিনি। তবে সে বিরক্ত। তার ধারণা, সে মানুষকে একটা প্রশ্ন করছে, আর তারা অন্য প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। তাছাড়া তারা যা বলছে, তাও ঠিক বলছে না—অন্য কিছু বলছে। সে আমার ওপরও এটা নিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠলো যে, আমিও তার কাছে অনেক কিছু লুকাচ্ছি। তাছাড়া এটাও তার কাছে ব্যাখ্যাতীত ও বিরক্তিকর—কেনো সবাই তক্ষকটিকে মেরে ফেলতে উদগ্রীব—যেখানে কেউ এখন পর্যন্ত সেটাকে দেখেইনি।
তখন আমি এটা বলতে চেষ্টা করেছি, কেবল তার বিকট বিরাটাকার তক্ষক না, যেকোনো তক্ষকই কেনো এমন বিপন্ন। কেবল তাদের অবিশ্বাসী নাস্তিকতা বা বহুরূপী রূপ–ই তাতে দ্বায়ী নয়—আরও এমন অনেক কিছু আছে যাতে মানুষ তার কাছে বিক্ষিপ্ত আচরণ করছে। তখন মেয়েটি আমাকে বুঝাতে চেয়েছে, কেনো তার মা তাকে নিয়ে এতো চিন্তিত। সেখানে মায়ের হেঁয়ালি তার কাছে খামখেয়ালি মনে হচ্ছে। তিনিও যা বলছেন, তা বলতে চাচ্ছেন না। ‘একসময় আমি মনে করতাম আমরা অনেক ঘনিষ্ঠ, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ব্যবধান অনেক বেশি। একসময় মনে করতাম, আমরা যেকোনো কিছু একে অন্যকে বলে ফেলতে পারি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমাদের প্রকাশের ভাষা সবসময়ই সীমিত। কেবল মায়ের ক্ষেত্রে না, আমিও অনেক কিছু তাকে বলতে আর সাহস পাচ্ছি না।’ তবে তার মায়ের ভয় কেবল পাগলাটে বিষণ্নতা না, এক বিপন্ন হিস্টারিক মেলানকোলিক এক্সাইল যাতে তিনি তার মেয়েকে হারিয়ে ফেলতে চাচ্ছেন না। কিন্তু মেয়েটি ততো গভীরে যাবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। সে কেবল তার প্যাশোনেট সূত্র ধরে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। অথবা রক্তিম চোখ, বিজলীর রেখা এবং তারপর বিকট আওয়াজে বজ্রপাত—সে অবশ্য তার দেখা বিকট তক্ষকের সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানে না। আর এসব প্রকাশের ফলে সে যখন অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া–উত্তর পাচ্ছে, তা কোনো ভাবেই যে পথের দিশা দিচ্ছে না, সে পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারছে না। যে বিস্তৃত ব্যাখ্যা তার কাছে প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে তার মনে যা উদয় হয়েছিলো, তার ওপর চেপে বসছে। ফলে দমবন্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সে একসময় দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি কাছে গেলে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকায়। পুর্বে আমার দিকে তাকালেও, এ দৃষ্টি অন্য রকম—ব্যাখ্যাতীত। একইসাথে এমন কোনো অর্থ দান করে যা পূর্বের সব ব্যাখ্যা ও অর্থ ধূলিসাৎ করে দেয়। তবে পরে মনে হতে থাকে—সেই ব্যাখ্যা, সেই অর্থও আমার দ্বারা চাপিয়ে দেয়া ছিলো।
ছ
আমরা যে সারাদিন খুঁজেও বিকট বিরাটাকার তক্ষকটি খুঁজে পাইনি, এটাই হয়তো সবচেয়ে অর্থপূর্ণ ব্যাপার। খুঁজতে খুঁজতে মুমূর্ষু খালের পাড়ে গেলাম—দেখলেই অভিশপ্ত মনে হয়। মেয়েটি বললো, সে ক্লান্ত, কিন্তু হাঁটা থামালো না। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, এবং অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম। কিন্তু এই অস্বস্তির সাথে মেয়েটির কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি ক্ষণকালের জন্য তার অস্তিত্ত্ব পর্যন্ত আমার কাছে গুরুত্ব হারালো। এক বিপন্ন নির্লিপ্ততা আমাকে ঘিরে ধরলো, যা আমাকে নড়তে দিলো না। সেই নির্লিপ্ত স্থবিরতায় আমি মেয়েটিকে হারিয়ে ফেললাম।
কিন্তু একসময় অনেকটা সময় বিক্ষিপ্ত ছুটাছুটির পর যখন আবার মেয়েটির পাশে গিয়ে হাঁটতে লাগলাম, তখন কি এটা বলা সম্ভব আমি তক্ষকটি খুঁজে পেয়েছি? কিন্তু ঘোর কাটিয়ে যখন মেয়েটির দিকে তাকালাম, তখন তা স্পষ্টভাবেই সত্য নয়। তবে মেয়েটি আমাকে এ প্রশ্ন পর্যন্ত করলো না, আমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো সে এটা লক্ষ্যই করেনি, আমি পাশে হাঁটছি না। তবে তার এমন হারিয়ে যাওয়ার সাথে আমার হারিয়ে যাওয়ার মিল বা পার্থক্য কেমন তা সম্পর্কে আমার ধারণাই নেই। সে হয়তো তার তক্ষকের ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি আমার অস্বস্তিতে স্থবির হয়ে গিয়েছিলাম। তখন খালের ওপরের কালভার্টের দিকে তাকিয়েছি। তারপর অন্ধকারাচ্ছন্ন গহ্বরের দিকে চোখে পড়েছে। ‘এটা যেকোনোভাবেই সত্য যে, তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। এমনকি তোমার ভবঘুরে অবস্থাও এমন যা ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত না। তুমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছো না। ফাঁকা শূন্যতায় ডুবে যাচ্ছো।’ ব্রিজের স্যাঁতস্যাঁতে ওয়াল বেয়ে ভিতরে ঢুকে যাওয়া এই প্রথম নয়। আমার অন্ধত্ব—অসম্ভব ব্যাখ্যাহীনতা কেবল শূন্যতার বশবর্তী হয়ে এগোয় না। কিন্তু তক্ষকটি গহ্বর থেকে ফিরে এসে আমার চোখে তাকায় না। তার রক্তিম চোখ দুইটি আমার চোখে পড়ে না। কিন্তু মেয়েটি বিদায় নেয়ার সময় বলতে চায়, তক্ষকটি হয়তো তার চোখে তাকিয়েছিলো। কিন্তু সে যখন সেটির চোখে তাকিয়েছে, তখন হয়তো সেটি চোখ সরিয়ে নিয়েছে। ফলে একে অন্যের চোখে চোখ পড়েনি। ‘হয়তো অনেক উত্তেজিত ছিলো। ভীতও। হয়তো তার অবিশ্বাসী বিপন্ন অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে তারও ভয় ছিলো। এজন্যই হয়তো আড়াল তার জন্য এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো।’
আমি চেয়েছি সে বিদায় না নিক। আমি চেয়েছি, আমরা কোথাও গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। ক্ষুধা লাগলেও খাওয়া তখন তেমন গুরুত্ব পায় না, সামনাসামনি বসে থাকা যতোটা গুরুত্ব পায়। কিন্তু মেয়েটির বিদায় নেয়া ছাড়া উপায় নেই। সে হতাশ। তাকে এখন তার সেই হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য একা থাকতে হবে। যদিও বাসায় গেলে তার পরিবারের লোকজন প্রশ্ন করবে, অদ্ভুতভাবে তাকাবে, কিন্তু একবার তার রুমে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিতে পারলেই শান্তি। ধীরে ধীরে এই ধ্বংসাত্মক হতাশা যা, তার সকল আশা, এমনকি তক্ষকের অস্তিত্ত্ব পর্যন্ত ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে, তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে। যখন সে ধীরে ধীরে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাবে, পরদিন আবার নতুন উদ্যমে খুঁজতে বের হবে। তবে বিদায়ের সময় সে বলেছে, বিকালে সে আবার বের হবে। ‘আবার ছাদে খুঁজবো। আজ উঁচু কোনো ছাদে উঠবো যেখান থেকে অন্য সব ছাদও স্পষ্ট দেখা যায়।’
আর আমি যখন বাসায় পৌছে আমার রূমে বন্দি হই, আমার হতাশা কি আরও বাড়তে থাকে? যাপিত জীবনের দ্বন্দ্ব আরও নিশ্চিতভাবে ফুটে ওঠে?—এটা নিশ্চিত আমার দ্বারা আর কিছু সম্ভব না। না আমি কিছু করে উঠেছি। আমার বন্দিত্বও বন্দিত্ব না। ‘শুনো, যখন কোনো প্রাণি বিপন্ন তখন বিলুপ্তিই একমাত্র সত্য।’ ‘শুনো, ভালোবাসা সে পায় যে প্রতারিত হতে পারে, কারণ ভালোবাসাও এক ধরণের প্রতারণা।’ তখন ফাঁকা শূন্যতা আরও গভীর রূপ পায়। আমি তার ভিতরে ঢুকতে পারি না। জানালার লোহার শিকগুলো সরে যায়। আঙুল থেকে বের হওয়া বাড়তি নখগুলো ধারালো ও শক্তিশালী মনে হয়। হাতের তালুকে আঠালো মনে হয়, যা বারবার দেয়ালে আটকে যায়। কিন্তু একসময় আঠার পরিবর্তে আঙুলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আঙুলগুলো হাড়হীন—চুলের মতো—কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী—দেয়াল বেয়ে উপরে ওঠে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার হতাশাই কেবল বাড়তে থাকে। না, আমার কিছু করার নেই। কিছু করা সম্ভব না। এক স্থবিরতা দানা বাঁধে যা আমাকে স্থির হতে দেয় না। বারবার পেছনে তাকাই, আড়াল খুঁজি—‘তোমার অবিশ্বাসী নাস্তিক বিপন্নতা নিয়ে তুমি আর কোথায় লুকাবে?’ ফলে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর বাতিক হয়ে যায়। ভয় রক্তের গভীরে উত্তেজিতভাবে প্রবাহিত। ‘এবং তুমি হিসাব করো, কেউ কিছু করতে চায়, আবার কেউ কেউ কিছুই করতে চায় না—যেখানে তোমার দ্বারা কিছুই করা সম্ভব না।’ আমি কীভাবে বুঝাবো, আমি কিছুই করতে চাই না? ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে বটগাছের আড়ালে লুকানো যায়। কিন্তু যখন আড়াল খুঁজে পাই তখন এ ভাবতে থাকি মেয়েটি তক্ষককে রঙ বদলাতে দেখেনি। কিন্তু তক্ষক রঙ বদলায়। ওরা আড়াল নির্মাণের জন্য রঙ বদলায়। সেটাই কি ওদের বিলুপ্তিকে আরও গতি দিয়েছে?
খেতে বসলে আমার অস্বস্তি বাড়তে থাকে। মনে হয় বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্রতীরে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছি। আমার বমি পায়। খাবার ফেলে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসে না। শরীরের মধ্যে যন্ত্রণা হতে থাকে। শরীর মোচড়ায়। মেয়েটিকে মনে পড়ে। মেয়েটিকে ভাবতে থাকি। তার উত্তেজিত চাহনি ও প্যাশনেট স্বপ্ন যাপন আমাকে টিকিয়ে রাখে। আমি খাটে পড়ে থাকতে পারি। ভাবতে থাকি কিছুক্ষণ পরেই আবার তার সাথে দেখা হবে। আড়ালের নির্মাণে বিলুপ্তিই কেবল সত্য। আমি বারবার ঘাড় ঘুরিয়েই তাকে দেখতে চাই। দেখতেই চাই, সে তার অসম্ভব আবেগ উত্তেজনা নিয়ে তক্ষকটি খুঁজছে।
জ
তক্ষকটির অস্তিত্ত্ব প্রমাণ হয়তো সেটার মৃত্যুর মতো। ‘আমি যদি তক্ষকটির অস্তিত্ত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হই তা–ই সেটার বিলুপ্তি ডেকে আনবে?’ মেয়েটির প্রশ্নে আমি সতর্কতা অবলম্বন করি। অন্য ছাদ গুলোতে হয়তো মানুষও দেখতে পাই, কিন্তু তক্ষকটি না। মেয়েটি বিল্ডিং এর কেয়াটেকারকে রাজি করিয়েছে—কী বলে তা আমি জানি না—কিন্তু লোকটি আমাদের কিছুক্ষণ ছাদে থাকার অনুমতি দিয়েছে। মেয়েটির পিতা বলেছেন, এমন বিরাট তক্ষক যদি আসলেই থাকতো, তবে এলাকার অন্য কেউ না কেউ সেটাকে দেখতো, এবং এতোদিনে মেরেও ফেলতো—হয়তো সেটা এতদিনে মৃতও। ‘এমন একটা প্রাণির পিছনে কেনো সময় নষ্ট করছো, যেটার অস্তিত্ত্ব মানেই বিলুপ্তির লক্ষণ, মৃত্যুর চিহ্ন?’
মেয়েটি পিতাকে বুঝাতে চেয়েছে। তার সমস্ত আবেগ দিয়ে বুঝাতে চেয়েছে। কেনো তাকে তক্ষকটি খুঁজে পেতে হবে, বা কীভাবে তার কাছে তক্ষকটির অস্তিত্ত্ব এতোটা স্পষ্ট। ‘কিন্তু কেনো তার আড়ালে আড়ালে বেঁচে থাকা সম্ভব না? পালিয়ে বেড়ানোই তার জন্য সবচেয়ে সত্য হবে কেনো? বিপন্ন বলে?’
ছাদের এক কোণায় গিয়ে মেয়েটি চুল ছেড়ে দিয়েছে। তার মাথার চুল বাতাসে উড়ছে। সে অন্যমনস্কভাবে চোখের ওপরে চলে আসা চুল সরায়। আমি তার দিকে এগিয়ে যাই, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাই। তার হাত ধরতে গিয়ে আবার পেছনে তাকাই। তার হাত ধরে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা সে এড়িয়ে যায়, আর আমি পেছনে ফিরে তাকাতে যাই। সে আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে না। সে আমার পদক্ষেপ অনুসরণ করে না। পিতার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ না, তার আবেগ যৌনতা সমন্ধনীয় কিনা, কিন্তু পিতার চাপিয়ে দেয়ার ভাব স্পষ্ট। ‘তিনি এটা বলতে চান না, আমি যা করছি তা করতে পারি না, কিন্তু তাতে কিছুই করা হয়ে উঠবে না। তিনি এমনকি এটাকে ছেলেখেলাও বলছেন না, কিন্তু এখানে কেবল ক্ষমতা বন্টন অস্পষ্ট। তিনি জানেন, তক্ষকটির বিলুপ্তি নিশ্চিত। কিন্তু তিনি চান না সেখানে আমার কোনো হাত থাকুক।’
‘তুমি তক্ষকের লম্বা লেজটি দেখেছিলে?’
আমার প্রশ্নে মেয়েটি বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু আমি তার আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সাথে সাথেই যখন ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে গেলাম, তখন সে হঠাৎ হেসে ফেললো। ‘এতোদিনেও আপনি বিশ্বাস করেননি আমি তক্ষকটি দেখেছি?’
কিন্তু আমি প্রশ্নে নয়, তার হাসির ঢেউয়ে ডুবে যেতে থাকি। নিজেকে তার আরও কাছে এগিয়ে নিয়েও পেছনে তাকাতে যাই। বিকট কিছু একটা বাতাসে ঝাপটা মারে। কক্কক্ আওয়াজ পাই। কিন্তু আবার যখন সামনে ফিরি এবং ঘাড় ঘুরাতে যাই আমাদের একে অন্যের মাথায় আঘাত লাগে। মেয়েটি মাথার বাম দিকে হাত চেপে ধরে বসে পড়ে। কিন্তু আমি আবার মাথা ঘুরাই—শরীর মোচড়ায়—অস্বস্তি নিয়ে তার দিকে তাকাই। কিন্তু মেয়েটি হাসছে। কিন্তু আমি হাসতে পারি না। জোর করে দৃষ্টি তার ওপর বিদ্ধ রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘাড় মোচড়াতে থাকি। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। পা দুটি পর্যন্ত আমাকে দাঁড়াতে দেয় না। একসময় মেয়েটি হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায়। তার একটি হাত আমার কাঁধে রাখে। তার গলা কাঁধ রক্তিমাভ হয়ে উঠেছে। কামড় দিলেই রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হবে। কিন্তু এ তো সত্য নয়—আমিও রক্তবর্ণ হয়ে উঠবো! কিন্তু আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। ঘাড় মোচড়াতে মোচড়াতে তাকে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরি। কিন্তু তারপর পেছন ফিরে তাকাতে যাই—অস্তিত্ত্ব কতোটা দূরে প্রসারিত? মেয়েটি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে দ্বিধা করে। মেঘের গুর্জন শুনা যায়। আকাশ কাঁপিয়ে বিজলী চমকায়। আমার মনে পড়ে আমি ঝাঁপ দেবো। কিন্তু তাকে আঁকড়ে ধরে রাখি। ঘাড় ঘুরাতে যাই—কিন্তু তার গলার খাঁজে মুখ গুঁজে দেই। কিন্তু পা দুটি প্রতারণা করে। একসময় মেয়েটি রেলিং এ গিয়ে ধাক্কা খায়। তখন সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু যখন দেখে আমি ছাড়ছি না, তখন হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। আমি তার দিকে তাকাতে চেষ্টা করি। শরীর আলগা হলে ঘাড় ঘুরাতে বাধ্য হই—তারপর ফিরে তার মুখে তাকাই। তখন হঠাৎ বাজ পড়ে। পা এগোলে ঝাঁপ দিতে যাই। মেয়েটি হাত আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে। ‘কী করছেন?’
কিন্তু আমি জানি না, কী করছি। বৃষ্টি তখনও পড়ছে না। তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমরা বসে পড়ি। মেয়েটি আমার দিকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি চুপ থাকি। শরীর তখন কাঁপছে। একসময় বলে উঠি, তক্ষকটিকে তো কোথাও পেলে না। আর কোথায় খুঁজবে?
ঝ
যখন বাসায় ফিরেছি তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয়েছে—মাতৃত্বের ক্রন্দন হয়তো নয়—কিন্তু মা ঠিক কোন আশায় কান্না লুকাবেন? মেয়েটি যখন বিদায় নিয়েছে, তখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। আকাশে তখন চিৎকার আছে—বিদ্যুতের ঝলকানি আছে। মেয়েটি তক্ষক সন্ধানের কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা না বলেই বিদায় নিয়েছে। উঁচু বিল্ডিং এর কেয়ারটেকারের সাথে ফেরার সময় যখন আবার দেখা হয়েছে, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসি হেসেছেন। মনে হয়েছে তিনি আমাকে কিছু বলতে চান, কিন্তু আমি তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে এসেছি। তবে আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটির পাগলামি অনেকের কাছেই ধরা পড়ছে। কিন্তু মেয়েটি ধীর স্থির—তার লক্ষ্য থেকে একবিন্দু নড়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না। তারপরও সে বিদায়ের সময় আজ আর সেসব সে স্পষ্ট করেনি।
বৃষ্টি এমনভাবে ঝরছে—বন্ধনহীন, কিন্তু মাতৃত্বের ক্রন্দন বন্ধনকেই প্রকাশ করতে চায়। আমি ঘরের আলো নিভিয়ে দেই। যখন আমি খাটের এক কোণে গিয়ে বসি, তখন তার জন্য আমার অনুশোচনা হতে থাকে। তবে অনুশোচনার ভাষা অনেক বেশি কৃত্রিম লাগে, এবং গঠণগতভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এগোয়। তবে বিজলীর আলো বারবার এসে অন্ধকারে ধাক্কা খাচ্ছে। তারপর বজ্র পড়ার শব্দ নিস্তব্ধতায় আঘাত করে। তবে নিস্তব্ধতা নাই রাজার রাজ্যের জিনিস—কেবল কৃত্রিম–ই না, অসংজ্ঞায়িত। এবং বজ্রপাতের শব্দে যখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, তখন মেয়েটির চোখদুইটি আমার চোখে এসে পড়ে। তার চাহনি আমাকে এমনভাবে বিদ্ধ করে, মনে হয় না সে আমাকে দেখছে, এবং তার সেই উত্তেজিত আতঙ্কিত চাহনি ভেসে ওঠে, যে চোখদুটি তক্ষকের বুঝতে পারি। সেখানে সে তক্ষকের চোখে তাকিয়ে থাকে—আমি তক্ষকের চোখে তাকিয়ে থাকি। আমরা তক্ষকের চোখে তাকিয়ে থাকি। এবং এমন এক জড়তা আমাকে ভর করে, আমি সেই বাস্তবতা থেকে বের হতে পারি না। আমি জানি এই নির্লিপ্ত স্থবিরতা কৃত্রিম। কিন্তু তা এক ফাঁকা গহ্বর তৈরি করে, যেখানে অস্তিত্ত্ব বিলীন হয়ে যায়। তবে তাতেও এক দ্বন্দ্ব কাজ করে। যা মেয়েটির চাহনি বা ভাবাবেগের সাপেক্ষ্যে আবিষ্কৃত হয়। মেয়েটি তক্ষকের দিকে তাকায়। তক্ষকটি ঠিক তার চোখে তাকায় না। মেয়েটি তক্ষকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু হয়তো একসময় তক্ষকটি মেয়েটির চোখে তাকিয়েছে। তার দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যা অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হতে থাকে। কিন্তু সেখানে কি আমি বলতে চাইবো, তাতে গহ্বর তার বিন্যাস পায়? ফাঁকা শূন্যতা প্রসারিত হতে হতে জীবনতাত্ত্বিক বিন্যাস প্রাণ পায়?
তারপর একসময় বৃষ্টি এমনভাবে ঝরতে থাকে, নিস্তব্ধতা আরও জীবন্ত, কিন্তু অসংজ্ঞায়িত হয়। মেয়েটিকে বলতে গিয়ে থেমে যাই, এখন ঘুমিয়ে গেলে বেশ হতো। কিন্তু তার চোখদুটি আরও প্রাণহীন লাগে—কিন্তু তা কীসের সাপেক্ষ্যে? চোখ দুটিতে কোন অর্জন বা ব্যর্থতা লিপিবদ্ধ হয়েছে? সে তক্ষকটি দেখেছে। তার রক্তিম চোখে চোখ পড়েছে। এবং তারপর বাজ পড়ার সাথে সাথে তক্ষকটি আড়াল খুঁজে পায়। কিন্তু সেটি কি আড়াল খুঁজছিলো? কতো যুগ কাল ধরে আড়াল খুঁজছিলো? এবং তার আড়াল খুঁজে পাওয়ার সাথে কী বাজ পড়ার শব্দের সম্পর্ক আছে?
কিন্তু মেয়েটি আর তক্ষকটিক খুঁজে পায়নি। রাত কতোটা গভীর আমার ধারণা ঠিক নেই, কিন্তু আমার ইচ্ছে হতে থাকে তক্ষকটিকে খুঁজতে ছাদে যাই। বজ্রপাতের ডাক নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর রূপ দেয়। আমার মনে হয়, ওটা আমাকে তুমুল আগ্রহ নিয়ে ডাকছে। এবং আমি এখন ছাদে গেলেই তক্ষকটির রক্তিম বিকট রূপ দেখতে পাবো।
দ্বিধাহীনভাবে আমার পা দুটি চলতে থাকে। অন্ধকার হাতড়ে শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে গিয়ে দরোজা খুলি। একটি বিরক্তিকর আলো এসে চোখে লাগে। যখন পেছনে তাকাই তখন বুঝি না অন্ধকার কতোটা দূর প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু আমি তুমুল উত্তেজনায় সিঁড়ি বাইতে থাকি। যখন ছাদে উঠি তখন বৃষ্টি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। মেঘের ডাক হঠাৎ বিকট সংগীতের রূপ নিয়েছে। আর অন্ধকারকে টুকরো টুকরো মনে হয়েছে। ডালিম কুমার তার অন্ধত্ব ও তলোয়ার দিয়ে কেটে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলেছে। আমার মনে হতে থাকে এখনি তক্ষকটি রক্তিম বিকটত্ব নির্মাণ করে আমার সামনে ভেসে উঠবে। কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে আমার চোখ ঝলসে যায়। এবং ছাদের এক ধারে গিয়ে নিচে না পরে রেলিং এ বারি খেয়ে পড়ে যাই। বেশ পানি জমেছে। প্রায় অর্ধেক শরীর ডোবা অবস্থা নিয়ে আমি পড়ে থাকি। চোখে মুখে বৃষ্টির ফোটার আঘাত আমাকে যেন কাটতে থাকে। কিন্তু আমি অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকি। মনে হতে থাকে কেবল ছায়া না, অন্ধকারও আমার ছায়া হয়ে উঠেছে। ফলে অস্তিত্ত্বের বিকটত্ব স্পষ্ট হতে থাকে। একসময় আমি আবার ছাদের খাঁদে নিজেকে বাড়িয়ে দেই। তখন সেঁওলায় পা পিছলে পড়লেও খাঁদে পড়ি না, ছাদের জলমগ্নতায়–ই পড়ে থাকি। ঘাড় ঘুরাতে কষ্ট হয়। সক্ষম হলে অন্ধকারের আঁকড়ে ধরার বিকট অস্তিত্ত্ব আরও প্রসারিত—খাঁদ বা ফাঁকা শূন্যতার দিকে প্রসারিত হয়। কিন্তু আমি সেই খাঁদে নিজেকে নিক্ষেপ করতে পারি না। সেঁওলা জলে হাবুডুবু খাই। কিন্তু তাও তাত্ত্বিক অর্থে। যা সবকিছুকে আরও উন্মুক্ত নির্লিপ্ত গহ্বরে ভাসিয়ে রাখে। ডুবতে দেয় না। আমাকে ডুবতে দেয় না।
ঞ
পরদিন সকালে যখন মেয়েটির সাথে দেখা হয় তখন হঠাৎ সে আমার হাত স্পর্শ করেই আঁতকে ওঠে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সে আমাকে জোর করে বাসায় নিয়ে আসে। আমি তাকে বুঝাতে যাচ্ছিলাম, এ আসলে তেমন কিছু না। ‘আপনি খেয়াল করেছেন, আপনার চোখ কী রকম লাল হয়ে ওঠেছে?’ এ আমি তাকে বলতে যাইনি রাতভর ছাদে গিয়ে বৃষ্টির জলে পড়ে থেকেছি। যদিও আমি নিশ্চিত জানি না, কখন আমি বাসায় ফিরেছি। যখন ঘুম ভেঙেছে, খেয়াল করেছি তখনও ভেজা কাপড়ে খাটে পড়ে আছি। হয়তো ভোর রাতে আমি বাসায় ফিরেছি। কিন্তু কীভাবে ফিরেছি কিছু মনে পড়েনি। হাতে পায়ে ও কপালে আঘাতের চিহ্ন আছে। দুই কনুইতেই ক্ষত আছে। সেটা স্পষ্টই মনে আছে ছাদে আমি কয়েকবার পড়ে গিয়েছিলাম। শেষ যা মনে আছে তা হলো, বিকট অসম্ভব চিৎকারের মুহুর্ত।
বাসায় এসে সে কিছুক্ষণ আমার পাশে বসে রইলো। আমি ঔষধ খেয়ে শুয়ে থাকতে বাধ্য হলাম। সে যখন আমার চোখে তাকালো, রক্তিম চোখ দুইটি বুজতে পারলাম না। আমাদের নিঃশ্বাস ভারি হতে থাকলো—একে অন্যের গায়ে বাড়ি খেলো। কিন্তু তার চোখ দুইটি কি আমার চোখেই তাকিয়ে আছে? আমার তখনও মনে হতে থাকে, সে কিছু খুঁজছে। কিন্তু সে আরও কাছে এগিয়ে আসলে আমার উত্তপ্ত শরীরের উষ্ণতা তার শরীরে প্রবাহিত হয়। আমি তাকে প্রশ্ন করতে গিয়েও করলাম না, সে কোনো শব্দ শুনছে কিনা। শব্দটা আমি উপলব্ধি করতে থাকি। কিন্তু সঙ্গমের এক চরম মুহুর্তে সে হঠাৎ স্থির শান্ত হয়ে যায়। তার শরীর শান্ত শীতল হয়ে উঠেছে। তখন সে তক্ষকটির কথা তোলে। ‘আমি হয়তো বুঝছি, কেনো তক্ষকটি খুঁজে পাচ্ছি না।’ ‘কেনো?’ প্রশ্ন করতে না চেয়েও করে বসি। মনে হতে থাকে আমার শরীরও শীতল হয়ে গেছে। ঘেমে ভিজে গেছে। মেয়েটি প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সে নিজেকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমি আমার শীতল উদ্ভ্রান্ত অস্তিত্ত্ব নিয়ে পড়ে থাকি।
বিকেলে মেয়েটি আবার আসে। তখন আমি ঘুম থেকে উঠে, গোছল করে ডিমের অমলেট খাচ্ছি। শুধু ডিমের গন্ধ না, পাউরুটির গন্ধটাও বিরক্তিকর লাগছে। মেয়েটি কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখলো। ক্ষণকাল কিছু একটা ভাবলো। কিন্তু কিছু বললো না। আমার দিকে না তাকিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলো। ‘হয়তো আমার পরিবারের কেউ–ই ভুল না, আমি হয়তো আসলেই পাগল হয়ে গেছি।’ সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগলো। ‘আমার উন্মত্ততা তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে।’ এ পর্যন্ত বলে সে চুপ করে রইলো। ক্ষণকাল পর আমার দিকে তাকালো। ‘আমরা কি একে অন্যের প্রতি আসক্ত? আর তুমি যেহেতু তক্ষকটির অস্তিত্ত্ব বিশ্বাস–ই করো না, তখন কেনো আমার সাথে এভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছিলে? কী চাও তুমি আমার কাছে?—যৌনতা? যেটায় তুমি আমাকে তাড়িত করছো। আমাকে ভালোবাসো? কিন্তু কেনো? কীভাবে?’
আমি কি এই ব্যাখ্যা দিতে যাবো, এখানে দেখার মুহুর্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেভাবে তার সাপেক্ষ্যে তক্ষকটির দেখার মুহুর্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। জোঁকগুলোর রক্তপূর্ণ সুডৌল অবস্থা ও রক্তিম স্বপ্ন। কিন্তু আমার মধ্যে অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। মনে হতে থাকে অন্য সব কিছুর সাপেক্ষ্যে আমার অবস্থা অস্বস্তিপূর্ণ। ফলে যেমন মানুষের সামনে গেলে নিজেকে আমার বিন্দুমাত্র সহ্য হয় না। কিন্তু প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তর ভিন্ন কিছুর সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু আমি কি এটা বলতে যাবো, আমরা একে অন্যের প্রতি এমন আসক্ত হয়ে পড়েছি কেনো, বা আমাদের ভালোবাসা বা প্রেম, তার সাথে আমাদের আসলে কোনো সম্পর্ক নেই। এবং আমি মেয়েটির কাছে কী চাই?
একসময় আমি তাকে বললাম, আমি তাকে ভালোবাসি। প্রথম যেদিন তাকে দেখেছি, সেই মুহুর্ত থেকেই আমার মনে হয়েছে, তাকে ছাড়া আমার আর চলবে না। তাকে ছাড়া আমার আর বাঁচা সম্ভব না। কিন্তু যৌনতা? তা সম্পর্কে কি তাকে কিছু বলা সম্ভব? আমরা কি এটা বুঝতে পারছি না, সেই শক্তিটা সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই? তবে প্রেম আমাদের সেটাকে গ্রহন করতে শেখাচ্ছে, বুঝতে শেখাচ্ছে। অথবা প্রেমের সাপেক্ষ্যে আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি। তখন হয়তো অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছু লুকিয়ে পড়ছে।
‘তুমি এমনভাবে ভালোবাসার কথা কেনো বলছো? আর কিছু বলার নাই, তাই? ভালোবাসার কথা বলার সময় তোমার এক নির্লিপ্ত ভঙ্গি আছে। আমি জানি না, আমরা এখন কী করবো?’ মেয়েটি কথা বলতে বলতে আমার ঘাড়ে হাত রাখে। তার অভিযোগ আমাকে হয়তো মিথ্যুক প্রতিপন্ন করে না, কিন্তু আমি কৃত্রিমতা ধরে রাখি। আমি বলতে থাকি, আমি তার কাছে কী চাই। বলতে থাকি, সেটা পাওয়া আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কি এমন নয়, তার ওপর আমার অস্তিত্ত্ব নির্ভর করছে?
তবে যা সহজে ব্যাখ্যা করা যায়, তা হয়তো সহজ নয়। তাকে সহজেই প্রতারণায় কৃত্রিম করা যায়। সেখানে সহজেই নির্লিপ্ততা প্রবাহিত হয়। তবে সবকিছুকে বিষণ্ন করুণ করে তোলে। মেয়েটি হয়তো এটা বুঝতে পারে। সে বলে না, কিন্তু বুঝতে পারে। যেমন আমি বলি, কিন্তু বলি না, যা তাকে করুণ করে তোলে, যেটা সে বুঝতে পারে। অবশ্য আমি হাল ছেড়ে দেই না। আমি কি এটা বুঝাতে চাইবো না, আমি তাকে ধরে রাখতে চাই? কিন্তু আমি স্পষ্টভাবেই তাকে ধরে রাখতে চাই।
ট
সন্ধ্যার আগমুহুর্তে মেঘের ডাক শুনতে পাই। আমরা তখন চুপচাপ বসে ছিলাম। আমাদের মধ্যে এক নিস্তব্ধতা চেপে বসেছিলো—মেঘের গর্জন যা সম্পর্কে আমাদের জানান দিয়ে যায়। মেয়েটি তখন বলে ওঠে, তাকে ফিরতে হবে। ঘরের আলো তখনও জ্বলেনি। বিজলীর আলো মেয়েটির মুখে এসে পড়তে পারতো। তখন হয়তো ধূসর আলোয় ঝাপসা হয়ে ওঠা মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেতাম। কিন্তু সে দরোজার দিকে পা বাড়ায়। পেছনে তাকিয়ে হালকা হাসি দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু আলো তার মুখে চমকায় না। আমি টের পাই, এমন কিছু যা আমাকে অস্বস্তিতে ডুবিয়ে রাখে। চেয়ারে বসা থেকে দাঁড়িয়ে দরোজা পর্যন্ত পৌছাতে পারি না। মেয়েটি বিদায় নেয়।
চলে যাওয়ার পরও আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে পারি না। অথর্বের মতো নিশ্চুপ বসে থাকি। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসে। তখন বিজলীর ঝলকানি অন্ধকারে বাড়ি খায়। বজ্রপাতের শব্দ বাড়তে থাকে। এবং একসময় প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। মনে হয়, সবকিছু যেন প্রচলিত নিয়মে চলছে। টের পাই, সময় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এবং আমার স্থবিরতা ভাঙে না। তবে মেঘের গর্জন বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই বিকট শব্দ ভেদ করে বৃষ্টির শব্দ আসে। একসময় মেয়েটি অন্ধকার ভেদ করে চোখে তাকায়। মনে হয় না, সে কিছু খুঁজছে। কিন্তু ক্ষণকালের মধ্যেই তক্ষকটির বিকট রক্তিম চোখ দুটি ভেসে ওঠে। যে চোখদুটি আমি কোনোদিন দেখিনি। কিন্তু সে দেখেছে—যে চোখদুটি হয়তো তার চোখে একসময় তাকিয়েছিলো। কিন্তু আমরা এখন স্পষ্টভাবেই সেই বিকট রক্তিক চোখ দুটিতে তাকিয়ে থাকি। এবং তখন বিজলীর ঝলকানি, বিকট বজ্রপাত, বৃষ্টির শব্দ নির্লিপ্ততায় ভেসে যায়—আর অনুভব করি না।
যখন হঠাৎ আমি চেয়ার থেকে পড়ে যাই, বিকট আওয়াজে বজ্র পড়ে। তখন আমি জানালার কাছে যাই। ভেজা শিক ধরে দাঁড়াই। বেয়ে উপরে উঠে যাই। একসময় শিকগুলো সরে গেলে ভেজা ইটের দেয়ালে হাত আটকে যায়। বটগাছকে আমি ঠিক নিশ্চিত আড়াল মানি না। দ্রুত আমি নিজেকে ছাদে আবিষ্কার করি। এবং পিছলে পড়ে সেঁওলা জলে হাবুডুবু খাই। আমি মনে করতে পারি, শৈশবে এতোটা বেশি পরিমাণ বজ্রপাত ছিলো না। যদিও বৃষ্টির সাথে সাথে সেটা কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু আমার মনে হয় বাড়তে থাকে। কিন্তু আমি জানি আমি খাঁদ খুঁজছি। কিন্তু নিজেকে আমি তাতে নিক্ষেপ করতে পারি না। কারণ ঝাঁপ দিতে গিয়েও আমি পেছনে ফিরি। তখন কেবল আমি উলটে পড়ি। তখন নিশ্চিতভাবে আমার কাছেও ভানটা স্পষ্ট হয়। কিন্তু সহজে মেনে নেয়া সম্ভব না বলেই আমি আবার উঠে দাঁড়াই। রেলিং এ গিয়ে ধাক্কা খাই। আবার পড়ে গেলে আবার উঠে দাঁড়াই। এবং যখন খাঁদে পড়েও যাই তখনও রেলিং ধরে ঝুলে থাকি। কোনভাবেই নিজের হাত ছাড়াতে পারি না। একসময় ছাদের জলে উলটে পড়ি। কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। কিন্তু এভাবে কি আমার তৃষ্ণা মেটে?
একসময় আবার স্থবিরতা পেয়ে বসে। নড়ার শক্তি থাকে না। কাদাজলে পড়ে থাকি। বৃষ্টির ফোটা আমাকে কাটতে থাকে। বজ্রপাতের বিকট আওয়াজও আমাকে ঠিক জাগিয়ে তুলতে পারে না। বিজলীর রেখা বৃষ্টিজলে খেলা করে। আমাকে আর টেনে তুলতে পারে না। আমার অসম্ভব অতৃপ্ত তৃষ্ণাও আমাকে আর খাঁদের কিনারে নিতে পারে না। তখন সেখানে যখন আমি মৃতের মতো পড়ে থাকি, তখন মেয়েটি চোখ মেলে আমার দিকে তাকায়। কিন্তু সে তক্ষকের রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন আমিও সেটার রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকি। আমরা তক্ষকটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। অন্ধকার ও বৃষ্টির পতন ভেদ করে আমরা তক্ষকটির রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু তখনও সন্ধ্যা হয়নি। তখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। বিজলীর ঝলকানির পর, তখন সবে বজ্রপাতের বিকট আওয়াজ ভেসে উঠেছে। ঠিক তখন আতঙ্কগ্রস্থ চোখদুটি বিক্ষিপ্তভাবে এদিকসেদিক তাকায়। মেয়েটি সেই চাহনিকে স্থিরভাবে এঁকে নিয়েছে।
ঠ
সকালে বের হওয়ার কথা থাকলেও বের হতে পারি না। মেয়েটি যখন আসে, তখনও আমি খাটে পড়ে ছিলাম। ভেজা কাপড় শরীরেই প্রায় শুঁকিয়েছে। এবং শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমার চোখ পুড়ছে—চোখ মেলে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পোষাকে ময়লা, সেঁওলার দাগ, শরীরে মাটি–ময়লার ছড়াছড়ি কীভাবে মেয়েটির চোখ এড়িয়েছে, তা আমি ভাবতেই পারছি না। সে আমার কপালে হাত দিয়ে বেশ বিরক্ত নিয়ে কথা বলতে লাগলো। প্রশ্ন করতে লাগলো, কীভাবে, কেনো প্রতিদিন এমন জ্বর আসছে। তারপর হঠাৎ চোখে মুখে কপালে ভেজা কাপড়ের স্পর্শ দিতে লাগলো। একটা ভ্যাঁপসা গন্ধ আমি পেতে থাকি। কিন্তু মেয়েটি তা নিয়ে কিছু বলে না। একসময় জিজ্ঞাসা করে, কী খাবে?
আমি জানি, মেডিসিন নিলে জ্বর বেশি সময় থাকবে না। কিন্তু তার আগে কিছু খেতে হবে। একসময় সে ডিমের অমলেট ও পাউরুটি খেতে দিলো, কেবল তা–ই কিচেনে ছিলো। খাবার দেখতেই আমার কাছে বিশ্রী লাগলো। কিন্তু আমি খেতে লাগলাম। ভ্যাঁপসা গন্ধের দাপটে খাবারকে স্বাদগন্ধহীন লাগছে। হঠাৎ একসময় প্রশ্ন করলাম, আমরা কি বাইরে যাবো?
সে হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু সে বিরক্ত। আমি বালিশে হেলান দিলে, সে পাশে এসে বসলো। ঔষধ এগিয়ে দিলো। ঔষধ খেলে সে আবার আমার কপালে হাত রাখলো। তারপর প্রশ্ন করলো, রাতে তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আর তোমার এমন জঞ্জাল অবস্থা কেনো?
আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। নাহ, তার কাছে এসব এড়িয়ে যায়নি। একইসাথে অস্বস্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে এবার বেশ অধৈর্যের সাথে বলে উঠলো, তুমি এমন করছো কেন?
‘কেমন করছি?’ আমাকে ঠিক উত্তর দিতে হলো না। সে আমাকে শোচনীয়তার বিন্যাসে আবিষ্কার করলো, আর তার আর কিছুই করার থাকলো না। এবং তার দৃষ্টিতে আমরা নিজেদের করুণ উপহাস উপহার দিলাম। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই একে প্রেম বলে ভুল করতে পারছি না। হঠাৎ আবার বিশ্রী রকমের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার উপরে উত্তাল ঢেউ খেলে যাচ্ছে। অথবা ক্ষণকালেই আমি রক্তিম অমবস্যার উন্মোচন করছি।
দুপুর হয়ে গেলেও সে চলে গেলো না। বললো, আমি তার পরিবারের কাছে এখন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছি। তাদের ভাবনা হলো, আমি নিশ্চিতভাবেই তাকে ঝামেলায় ফেলবো। তাছাড়া তার আমার বাসায় চলে আসাও কেউ ভালো চোখে দেখছে না। তাদের ভাবনা এটা নিয়ে কেবল তাদের–ই কথা শুনতে হবে। ‘তাছাড়া আপনার একাকিত্ব নিঃসঙ্গ অবস্থা কেউ ভালো চোখে দেখছে না। মায়ের কথা হলো, আপনাকে দেখলেই তার ভয় লাগে। যদিও কোথায় সে আপনাকে দেখেছে তা আমি জানি না।’ হয়তো কয়েকদিন ধরেই তিনি আমাদের দেখছিলেন। হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের রাস্তায় একসাথে হাঁটতে দেখেছেন।
তবে পরে মেয়েটি নিজেই আমার সম্পর্কে তাকে বলেছে। তাতে অবশ্য তার ভয় আরও বেড়েছে। ‘তার মনে হয়েছে, আপনার চোখ সবসময়েই লাল থাকে।’ মেয়েটি হঠাৎ উত্তেজিতভাবে বলতে লাগলো। সে আসলে বুঝছে না, আমি তার জীবনে কোন ভয়ংকর ব্যাপার ঘটাবো। কিন্তু বলেই সে থেমে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে জানে না, আমরা ঠিক কী করছি। আবার সে থেমে গেলো। চুপচাপ আমার ওপর হেলান দিয়ে বসে রইলো। জ্বর পড়ে গেছে। আমি তাকে বলতে পারছি না, আমার এখন গোছলটা করে ফেলা উচিৎ। তাছাড়া আমি ভাবতে পারছি না, আমি তাকে আবার কী বলবো। আবার কি গভীর ভালোবাসার কথা বলবো? তাকে কি বলবো, তাকে ছাড়া আমার চলবেই না। আমি তাকে আজীবন ভালোবাসবো। এবং এটা কোনোভাবেই মানতে চাইবো না, সে আমাকে ছেড়ে চলে যাক। নাহ, আমার দ্বারা তাকে এটা বলা সম্ভব না, আমি তাকে ভালোবাসি না। কিন্তু আমি কি তাকে ভালোবাসি না? কিন্তু সবই কেবল অর্থপূর্ণ ভয় ও অনিশ্চয়তা। সে আবার আমার দিকে তাকায়। তারপর বিরক্তি নিয়ে সরে যায়।
হয়তো ভ্যাঁপসা গন্ধটা আর ভালো লাগছে না। কিন্তু সে সম্পর্কে কিছু বলে না। চুপচাপ দরোজার কাছে যায়, এবং বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
তবে আমি উঠি না। ইচ্ছে হলেও উঠি না। গোছলের ইচ্ছে জাগলেও, গোছলে যাই না। এবং একসময় মনে হয়, আবার জ্বর এসেছে। এবং আমি দেয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকি।
ড
বিকেলে আবার মেয়েটি আসলে আমার ঘুম ভাঙে। তাকে বসিয়ে রেখেই আমি গোছলে যাই। বের হয়ে দেখি খাবার তৈরি। ঘরও কিছুটা গুছানো। যদিও পূর্বে আমি নিজেই ঘরটা গুছিয়ে রাখতাম। কিন্তু কবে থেকে ঠিক আমার গুছানো অবস্থা সহ্য হয় না? আমার ঠিক মনে নেই। মেয়েটি আমার অস্বস্তি লক্ষ করে। বিরক্ত না হয়ে হেসে ওঠে। তখন আবার মেঘের গর্জন শুরু হয়। খেতে খেতে আমি বাইরে যাবার কথা বলি। কিন্তু তক্ষকের কথা মাথায় আসলেও বলি না। সেও বলে না। তবে তাকে বাইরে যাবার প্রতি তেমন আগ্রহী মনে হলো না। সে জানালো তাকে বাসায় ফিরতে হবে। আমি এ নিয়ে তেমন উত্তেজিত না হলেও তাকে থেকে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম। সে হাসলো। কিছু বললো না। আমার মনে হতে লাগলো, সে আমাকে বুঝতে শুরু করেছে। ফলে আমি এবার আরও আবেগ নিয়ে বললাম। জানালাম, আবার হয়তো জ্বর আসছে। সে বললো, আমি যেনো মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি তো অনেক ঘুমিয়েছি। সেটা নিয়েও তর্কে জড়ালাম। কিন্তু সে তাতে আগ্রহ দেখালো না। বলে উঠলো, আবার হয়তো বৃষ্টি শুরু হবে। সন্ধ্যাবেলা তারও ভেজা ঠিক হবে না। আমি আবারও একইভাবে বললাম, থেকেই গেলে। এবার সে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ সরিয়ে নিলে সে হেসে উঠলো। ‘তুমি কী চাও বলো তো?’ কথা বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়ালো। আমি তার হাত ধরলে অবশ্য সে হাত ছাড়িয়ে নিলো না। ছেড়ে দেবার অপেক্ষায় থাকলো। তখন বজ্রপাতের প্রচণ্ড আওয়াজে তার হাত আমি ছেড়ে দিলাম। সে ক্ষণকাল আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। হয়তো আমার অসহায়তা অবলোকন করলো। তারপর কপালে হাত রেখে জানালো, জ্বর নেই। আমি তার হাতটি ধরে আমার মুখ ঢাকতে চাইলাম। কিন্তু সে তার হাত আমার মুখে স্থির রাখলো না। তারপর হঠাৎ বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
আমি ছুটে দরোজা পর্যন্ত গেলাম। সে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে গেলো। কিন্তু রুম থেকে বের হলাম না। দেয়ালে হেলান দিয়ে সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম, কেনো আমরা কতোদূর যেতে পারি। এবং আমি—এই বিপন্ন আমি বিষণ্নতায় ভর দিয়ে কী এবং কেনো পেতে পারি? কতক্ষণ চলে গেলো জানি না, একসময় পায়ের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো। কেউ দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে। শব্দটা আমার বুকে আঘাত করতে লাগলো। এবং একসময় মেয়েটি উঠে এসে দৌড়ে আমার বুকে ঝাঁপ দিলো।
একসময় আমরা যখন নগ্ন অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছি, তখন সে বলে উঠলো, ‘আপনার বুকের হাড় গোনা যায়।’ আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম। না, মোটেই গোনা যায় না। তবে পরে আমি বললাম, তোমার পিঠের হাড়গুলো আমার প্রিয়। তারপর তার যোনির ভাঁজ এমনভাবে চেয়ে আছে যেন এমন কিছু ধরে রেখেছে যা তাকে নিয়ে উপহাসের হাসি হাসছে। আমি তাকে তা বলতে যাই না। কিন্তু সে কী ভাবছে তা আমি জানি না। সে কি কেবল আমার বুকের হাড়–ই গোনছে? ‘তুমি কি কেবল আমার বুকের হাড়–ই গোনছো? কী ভাবছো তুমি? তুমি জানো তোমার কাঁধে রক্ত লেগে আছে?’
‘আচ্ছা, আমরা কেনো একে অন্যের রক্ত পান করছি না?’ মেয়েটি বলে উঠলো। অবশ্য এ ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। তবে কি আমরা কেবল অমৃতের সন্ধান না, নিশ্চয়তার সন্ধানও খুঁজেছি? ‘আমার কীসের রক্ত পান করবো, হাতের না কাঁধের?’
আমি তাকে বুঝাতে চেয়েছি, হয়তো কাঁধের রক্ত বেশি সঠিক হবে। একে অন্যের কাঁধে কামড় দিয়ে পড়ে থাকা। তবে হাতের রগ কেটে একে অন্যের রক্ত মিশিয়ে পানের যে রিচুয়াল তাও করা যেতে পারে। তাতেই হয়তো প্রেমের বন্ধন অমরত্ব পায়। তবে ঘাড়ে কামড় দিয়ে পড়ে থেকে রক্তিম হয়ে উঠতে থাকা মিথের রূপ পেতে পারে। আমরা কি সেই আদিম রাক্ষসজাতি নই? আমরা কি সে নিষাদ দ্রাবিড় নই হরিণ মন্থণের শোক বুঝে রক্তে রক্তিম হই?
ফলে একসময় আমরা একে অন্যের ঘাড়ে কামড় দেই। কিন্তু রক্তে রক্তিম হই না। যন্ত্রণার চিৎকার আমাদের মাতিয়ে রাখে। আমরা কি রূপ বদলাবো না? একসময় যখন রক্ত বুকের ভাঁজ হয়ে নাভির গর্তে পড়ে মেয়েটি জ্ঞান হারায়। তখন আমি আরোহণে সীমাবদ্ধতা খুঁজি। বুঝতে চেষ্টা করি কতোটা সময় ধরে অমরত্ব ধরে রাখা যায়। আমার ঘাড়ের রক্ত ফোঁটার ফোঁটায় তার কাঁপতে থাকা নাভির পাশে পড়ে। গর্ত পূর্ণ হলে স্রোত যোনির খাঁদের দিকে ধাবিত হয়। আমি চিৎকার করে বলি, যা যা ধাবিত হয়, তা সব আমি ভালোবাসি।
আমার চিৎকারে তার জ্ঞান ফিরে আসে। সে আমাকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমি তা হতে দেই না। আমি ভাবতে থাকি রক্তের মিলন প্রেমের মিলনে পূর্ণতা পাক। এবং যখন আমি জ্ঞান হারাই তখন সে আমাকে সরিয়ে দেয়। যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন সে তার রক্ত মুছে ফেলছে। আমার শরীরে আর রক্ত নেই। কাঁধে ব্যান্ডেজ করা। আমি উঠে তার কাঁধে ব্যান্ডেজ করে দেই। তারপর শুয়ে শুয়ে মেয়েটির বিদায় নেয়া দেখি। ‘মেডিসিন খেয়ে নিও। রাতে আর কোথাও যেও না।’
কিন্তু পরদিন সকালে যখন আমার চোখে সকালের রোদ পড়ে নিজেকে ছাদে আবিষ্কার করি। নড়ার শক্তি নেই। ছাদে কিছুটা পানি আছে, যা রক্তাক্ত। আমি ভাবতে পারি না কী করবো। বা কখন কীভাবে আমি এখানে এসেছি? রোদ বাড়তে থাকে, আমি ভাবতে থাকি। ভাবনা বহু দিকে প্রসারিত হয়। আমি ভাবতে পারি না, কোথায় কোথায় আমি যাবো। এবং কীভাবে যাবো। কিন্তু আমি নিশ্চিত আমি যাবো।
ঢ
হয়তো মেয়েটি সকালে বাসায় এসেছিলো। হয়তো দেখেছে দরোজা খোলা। হয়তো দুপুরে আবার এসেছে। কিন্তু দুপুর নাগাত মনে হতে থাকে এলাকায় বেশ হট্টগোল চলছে। আমি তখন উঠে বসার চেষ্টা করি। সক্ষম হলে দেয়ালে হেলান দেই। বুঝার চেষ্টা করি এতো গণ্ডগোল কীসের। মনে হতে থাকে এলাকার সব মানুষ বাইরে চলে এসেছে। অনেকটা সময় পর আমার মনে হতে থাকে, তারা হয়তো বিকট তক্ষকটি খুঁজে পেয়েছে। অথবা এবার অনেকেই সেই বিকট অবিশ্বাসী প্রতারক তক্ষকটিকে দেখেছে। এবং এবার তারা লাঠসোটা নিয়ে সেই বিপন্ন নাস্তিক তক্ষকটিকে মারার জন্য এসেছে। এখন হয়তো মেয়েটির সাথে দেখা হলেই সবচেয়ে ভালোভাবে তক্ষকটি সম্পর্কে জানা যেতো। কিন্তু তার দ্বারা কী অদৌ এখন বাসায় নামা সম্ভব? কিন্তু মেয়েটিই বা কেনো খুঁজতে ছাদে আসছে না?
মেয়েটির ওপর বিরক্ত লাগতে লাগতে আবার গণ্ডগোল বাড়ে। কেউ একজন চিৎকার করছে। অবিশ্বাসী তক্ষকটিকে কোনোভাবেই ছেড়ে দেয়া হবে না। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, তারা এখনও তক্ষকটি খুঁজে পায়নি। তবে যে যে সেটাকে দেখেছে, সবাই বর্ণনা দিচ্ছে। তবে আমি কারও বর্ণনাই ঠিক শুনতে পাচ্ছি না। হয়তো মেয়েটিও সেখানে আছে। সেও খুঁজছে। হয়তো তার পরিবারের লোকজনও আছে। যারা বিপন্ন তক্ষকটির মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে।
আমার শরীর জ্বরে কাঁপতে থাকে—রোদে পুড়ছে। হঠাৎ আবার জ্ঞান হারাই। এবং যখন জ্ঞান ফিরে তখন মনে হয়, তখন আর ততোটা গণ্ডগোল নেই। তখন মেয়েটির প্রতি অভিযোগ বাড়তে থাকে। কী চেয়েছে সে? নিজের প্রতি অভিযোগ বাড়তে থাকে। কী চেয়েছি আমি? তারপর রক্তিম চোখ দুইটি আমার সামনে স্পষ্ট হয়—ভেসে ওঠে—জ্বলজ্বল করে—বিপন্ন নির্লিপ্ত—আদিম রক্তিম সরলতা উপহার দেয়—প্রেমের সুযোগ নিয়ে উপহাস উপহার দেয়—প্রতারক পূর্ণতা পায়। আবার আমি রেলিঙে হেলান দেয়ার চেষ্টা করি। তখন হয়তো মানুষের চিৎকার বাড়ে। তখন মনে হয়, মেয়েটি আসবে। সে নিশ্চিত এখানে খুঁজে পাবে—আমাকে খুঁজে পাবে। পরক্ষণেই মনে হয়, সে হয়তো আবার তক্ষকটি খুঁজে পাবায় মেতে উঠেছে। সে হয়তো আজ একবারের জন্যও বাসায় আসেনি। আমি দাঁড়িয়ে দেখতে চাচ্ছি, উত্তাল জনগণের ঢেউয়ে সেও আছে কিনা। তা পারি না। তবে বুঝতে পারি মানুষের সংখ্যা আবার বাড়ছে—গণ্ডগোল আবার বাড়ছে—চিৎকার বাড়ছে—অট্টহাসি ও গল্প বাড়ছে।
আমি বুঝতে পারি কিছুদিন ধরেই মানুষ এটা নিয়ে মেতে উঠেছিল। মেয়েটি যে বিষয়টা নিয়ে সবাইকে প্রশ্ন করেছিলো, তা হয়তো অনেকের মনেই দাগ কেটেছিলো। ফলে হয়তো তারা নিজের অজান্তেই তক্ষকটি খোঁজা শুরু করে দিয়ছিলো। তাতে অনেকেই হয়তো সেটাকে আড়ালে লুকাতে দেখেছে। তবে হয়তো তারা কেউই পূর্ণভাবে সেটাকে দেখেনি। এবং সেটার আড়ালও তারা ঠিক চিনে নিতে পারেনি। ফলে এলাকার সব মানুষ সারাদিন খুঁজেও তারা আজ এখনও সেটাকে পায়নি। তবে তারা লক্ষ্যে স্থির। অবিশ্বাসী নাস্তিক প্রতারক তক্ষকটি না মারা পর্যন্ত তারা কেউ ফিরবে না। তবে কেউ কেউ হয়তো দুপুরের খাবার খেতে ফিরেছিলো। অনেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়েই খাবার খেয়েছে। এবং একসময় আবার তুমুল গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। তখন বিকেলের গাঢ় হলুদ আলো নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মনে হলো, তারা হয়তো তক্ষকটির আড়াল খুঁজে পেয়েছে। এখন কেবল তক্ষকটিকে খুঁজে পাওয়া বাকি। তা পেতেও বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ কালো হয়ে আসে। বিদ্যুতের ঝলকানির উচ্চারণে মেঘের গর্জন শুরু হয়। আর সবাই তক্ষকটির আড়ালে দৃষ্টি স্থির করে রাখে। আমি ধীরে ধীরে রেলিং ধরে উঠে দাঁড়াই। মানুষের দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখতে পাই। আরও কয়েকটা ছাদে মানুষ দাঁড়িয়ে আড়ালের ওপর দৃষ্টি রাখছে। আমার মধ্যে এক ধরণের অদ্ভুত শক্তি ভর করেছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে বটগাছটির কাছে যাই। মেয়েটিকে দেখতে পাই। সবার মতো সেও আড়ালে তার দৃষ্টি স্থির রেখেছে। তখন আমি আড়ালের দিকে গা এলিয়ে পড়ি। বিকট অবিশ্বাসী তক্ষকটি বের হচ্ছে। সেটাকে উন্মাদের মতো লাগে। তার রক্তিম চোখ দুটি আমার চোখে পড়ে। আমি ভড়কে যাই—গা এলিয়ে পড়ে। মানুষ চিৎকার করে উঠেছে। তারাও যেন তক্ষকটিকে দেখতে পায়। তাদের লাঠিসোটা, ইটপাটকেল, তীর বর্শা নিয়ে প্রস্তত হয়। আরও কিছুটা নিশ্চিত হতে পারলেই তারা নিক্ষেপ করবে। ক্ষণকাল যায়। তারপর হঠাৎ গাছকে নির্দেশ করে বিকট আওয়াজে বজ্র পড়ে। গাছটি ভেঙে চূড়ে দলা পাকিয়ে নিচে পড়ে। এবং সাথে বিকট নাস্তিক তক্ষকটি পড়ে। মানুষ সেটার বিরাটত্ব বিকট অবস্থা দেখে তাদের অস্ত্র নিক্ষেপ করতে ভুলে যায়। তবে পড়ার পর যখন তারা এগিয়ে আসতে সাহস সঞ্চয় করে, ততোক্ষণে প্রতারক তক্ষকটি মরে গেছে। মানুষ বলতে থাকে অবিশ্বাসী নাস্তিকের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। ভণ্ড প্রতারকের প্রতি এটাই ঈশ্বরের শাস্তি। ‘নইলে কি আর ঠাডা পড়ে মরে!’ বজ্রপাতে মরায় অবশ্য তাদের হাত থেকে তক্ষকটি বেঁচে গেছে।
ভিড় ঠেলে একসময় মেয়েটি এগিয়ে আসে। চোখদুটি আর রক্তিম নেই। ক্ষণকালেই ফ্যাঁকাসে ধূসর হয়ে উঠেছে। মেয়েটি সে চোখে তাকিয়ে থাকতে পারে না। হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁতে গেলে সবাই তাকে রুখে দেয়। ‘এমন বিকট তক্ষক নিশ্চয় বিষাক্ত!’—চিৎকার শুনতে পায়। সে তখন ভিড় ঠেলে বের হয়ে যায়। তখন বৃষ্টি শুরু হলে মানুষ চলে যেতে থাকে। মেয়েটি তার কাঙ্ক্ষিত তক্ষকটি খুঁজে পেয়েছে। মানুষ তাদের অভিশপ্ত প্রতারক তক্ষককে খুঁজে পেয়েছে। এবং সেটি এখন মৃত। তবে তাদের হাতে খুনের রক্ত লাগেনি। আল্লাহ অবিশ্বাসীকে শাস্তি দিয়েছে। ঈশ্বর প্রতারককে শান্তি দিয়েছে।
একসময় সেখানে আর কেউ থাকে না। বৃষ্টির পতন ভেদ করে বিজলীর ঝলকানি, বিকট আওয়াজে বজ্রপাত, তুমুল বর্ষণ—মৃত বিলুপ্ত তক্ষকের অস্তিত্ত্ব জুড়ে এই থাকে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে নিরন্তর এসব চলতে থাকে।
