| 23 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: নিশীথিনীর ডাক । সোমজা দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

ভেজা চুল পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল অনামিকা। শুভাশিসবাবু আড় চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার পানীয়ের গ্লাসে মন দিলেন। সহকর্মী রূপেশের কাছে এই বন-বাংলোটির হদিশ পেয়েছিলেন অনেকদিন আগেই। কিন্তু তালেগোলে আর আসা হয়ে ওঠে নি। তাই অনামিকা যখন শহর থেকে দূরে কোনও জঙ্গলে বেড়াতে আসতে চাইল, হয়তো সেখানে লোক জানাজানি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই, শুভাশিসবাবুর মনে পড়ে গিয়েছিল এই বাংলোটার কথা।

অনামিকা শুভাশিসবাবুর ছাত্রী, তাঁর গাইডেন্সে পিএইচডি করছে। মেয়েটা ভীষণ উচ্চাকাঙ্খী। তার চেয়েও বড় কথা শরীর সম্বন্ধীয় কোন বাজে ট্যাবু নেই। বাপের বয়সী প্রফেসরের সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে কোনও দ্বিধা তার মধ্যে দেখেননি শুভাশিসবাবু। বাঙালি মেয়েরা স্বভাবতই ছিঁচকাদুনে ভীতু। জাল ফেলে এদের তুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, যদিও শুভাশিসবাবু এই খেলায় পুরনো খেলোয়ার। কিভাবে সাংসারিক অশান্তি, মুখরা স্ত্রী, প্রেমহীন শুষ্ক জীবনের কাহিনি মাপা ডোজে মিশিয়ে, সেটা কাঁপা কাঁপা গলায়, দু’ফোঁটা চোখের জলের সাথে টার্গেটের কাঁধে আলতো করে মাথা ছুঁইয়ে পরিবেশন করতে হয়, তা শুভাশিসবাবুর বিলক্ষণ জানা। অতি বড় রক্ষণশীল মেয়েরাও এই ওষুধে কাবু হয়েছে অনেকবার। বড়জোর বেশি ঢ্যাটা মেয়েদের খেলিয়ে তুলতে একটু বেশি সময় লেগেছে, এই যা। কিন্তু কখনও হারেন নি সুশোভন বাবু।

অনামিকা চৌধুরী মেয়েটা অন্যরকম। প্রথমদিকে অনামিকার দিকে শুভাশিসবাবু কোনও আকর্ষণবোধ করেননি। শুভাশিসবাবু নিজে কালো হলেও কালো মেয়ে তার নাপছন্দ। আগের শিকারেরা সকলেই ছিল যথেষ্ট সুন্দরী। সুন্দরী ছাড়া শুভাশিসবাবুর নেশা জমে না। বিয়ের আগে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, প্রকৃত সুন্দরী ছাড়া যোগাযোগ নিষ্প্রয়োজন। সৌন্দর্যের সব লক্ষণ মিলিয়ে সুমনা বউ হয়ে এসেছিল, আক্ষরিক অর্থেই সে প্রকৃত সুন্দরী। মৌ-লোভী সুশোভন সরকার প্রায় টানা বছর দুয়েক মজে ছিলেন সুমনাতে। দুই বছরের মাথায় দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হল সুমনা। সুশোভনবাবুরও আকর্ষণের সুতো আলগা হতে শুরু করল।

নিজের প্রকৃতির জন্য সুশোভনবাবুর কোনও অপরাধবোধ নেই। পরিবারের প্রতি দায়িত্বপালনে কোনদিন তাঁর সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটেনি। ছেলেমেয়েদের বা সুমনার প্রতি কখনও অনাদর করেননি। এই তো কদিন আগেই হইহই করে পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করলেন। সুমনাও তো কম খুশি ছিল না। বাপের বাড়ি, বান্ধবীদের কাছে তারও মুখ উজ্জ্বল হল। সুশোভনবাবুর ধারণা তার সমস্ত বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপারে সুমনা জানে। কিন্তু সে বড় শান্ত মেয়ে। গলা তুলে কথা বলা তার স্বভাব নয়। কোনদিন নিজে থেকে কিছু জানতে চায়নি সে, সুশোভনবাবুও স্বস্তি বোধ করেছেন। কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।

গ্লাসটা শেষ করে অনামিকার পাশে এসে দাঁড়ালেন সুশোভন। অনামিকা ড্রিংক করে না। যাদের সাথে এত বছর যাবৎ সুশোভনবাবুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, অনামিকা তাদের চেয়ে আলাদা, চেহারায়, স্বভাবেও। মাত্র দুই মাস আগে মেয়েটা এসেছিল তার কাছে। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের চেয়ে লম্বা, কটা চোখ, ছিপছিপে চেহারা, গায়ের রঙ বেশ কালো। সুন্দরী না হলেই সুশ্রী বলা যায়, চেহারায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ। কিন্তু সুশোভনবাবুকে আকর্ষণ করেছিল অনামিকার ব্যক্তিত্ব। খাপখোলা তরোয়ালের মত মেয়ে।

“তুমি গান জান অনামিকা?” জিজ্ঞাসা করলেন সুশোভনবাবু। অনামিকা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। সুশোভনবাবু বললেন, “সুমনা খুব ভাল গাইত। এখন আর গায় না যদিও।”

গভীর জঙ্গলের ভিতরে এই বাংলোটা। কম্পাউন্ডের চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। নীচের চলায় কেয়ার টেকার মনিউর থাকে। মনিউর লোকটাকে বিশেষ পছন্দ হয়নি সুশোভনবাবুর। লোকটা কেমন যেন! অনামিকাকে দেখে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, তারপর মুখ টিপে হাসল। ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি তাঁর। কিন্তু এখন মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই বাংলোর দেখাশোনা থেকে অতিথি সৎকার সব মনিউরের দায়িত্ব। একজন বয়স্ক মহিলা রান্নাবান্নার জন্য আছে বটে, সে রান্না সেরে দিয়ে সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে ছটার মধ্যেই বাড়ি চলে যায়, আবার সকালে আসে।

“বেড়াতে যাবেন?” জিজ্ঞাসা করল অনামিকা।
“এখন? বাইরে?” সুশোভনবাবুর বিস্মিত প্রশ্ন, “রাতের জঙ্গল নিরাপদ নয়, অনামিকা। হিংস্র জানোয়ার থাকতে পারে।”

অনামিকা মৃদু শব্দ করে হাসল। তারপর বলল, “ভয়ঙ্কর বলেই তো সুন্দর। সেই সুন্দর দেখতেই তো আসা।”

“তোমার ভয় করে না?” অনামিকার কোমরে হাত রেখে নিজের দিকে আকর্ষণ করে মৃদুস্বরে বললেন সুশোভনবাবু। এইমাত্র স্নান করে বেরিয়েছে অনামিকা। চিবুকে কণ্ঠার হাড়ে জলের বিন্দু চিকচিক করছে। ওর গা থেকে উগ্র ঝাঁঝালো একটা বুনোফুলের মতন গন্ধ বেরোচ্ছে, বোধ হয় সাবানের। অনামিকা সংক্ষেপে উত্তর দিল, “না”।

সুশোভনবাবু এবার অনামিকাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার ভেজা চুলে মুখ ডোবালেন। কালো ত্বকেও যে এমন নেশা থাকে, অনামিকাকে এভবে না পেলে সেটা অজানাই থেকে যেত। অনামিকার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে তাকে ঘরের দরজার দিকে মৃদু ধাক্কা দিলেন সুশোভন বাবু। কিন্তু অনামিকা যেন হঠাৎই ছিটকে উঠে সুশোভনবাবুর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দৃঢ়স্বরে বলল, “এসব পরে হবে। এখন চলুন তো, একটু বাইরে ঘুরে আসি।”

সুশোভনবাবু স্পষ্টতই বিরক্ত। এভাবে মুড নষ্ট হয়ে গেলে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে? তবুও ধৈর্য্য বজায় রেখে নরম গলায় বললেন, “শুনলে না মনিউর কী বলল তখন? রাতে কম্পাউন্ডের বাইরে না বেরোতে বলল না? তোমার সামনেই তো বলল।”

খিকখিল করে হেসে উঠল অনামিকা। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে সুশোভনবাবুর চোখে চোখ রেখে হিসহিসে গলায় বলল, “আপনি বুঝি খুব বাধ্য মানুষ? সবার সব কথা মেনে চলেন?”

সুশোভনবাবুর নেশাটা বেশ চড়ে গেছে। এতক্ষন ধরে মেয়েটার বেয়াদবি সহ্য করছেন। এবার আর সহ্য হল না। দুই আঙ্গুলে অনামিকার গালদুটো সজোরে চেপে ধরলেন, বললেন ‘বেশি কথা বলো না’।

মেয়ে তো নয়, যেন কালকেউটে। ভয় পায়নি সে একফোঁটাও। এই অবস্থাতেও হাসছে। হাতের আঙুল তুলে সুশোভনবাবুর কপালে থেকে নাকে বুলিয়ে ঠোঁটের উপর এসে আলতো করে ছুলো, বলল, “আহ সুশোভন, বাইরে তাকিয়ে দেখো, কী সুন্দর রাত! এমন রাতে বন্ধ ঘরেই যদি কাটাবে, তবে জঙ্গলে বেড়াতে আসার মানে কী? খোলা আকাশের তলায় প্রকৃতির মাঝে আদিম মানব মানবীর মত মিলব আমরা। এমন রাত বারবার আসে না। প্লিজ সোনা, বন্ধ ঘরের ভিতর এই রাত নষ্ট করতে নেই।”

“সোনা”, “তুমি”, সুশোভনবাবুর নেশা ঘনিয়ে আসে। অনামিকাকে সজোরে শরীরের সাথে চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেন তিনি। দীর্ঘ চুম্বন শেষ অনামিকার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন। গেটের কাছে পৌঁছে দেখলেন, গেটে চেন দিয়ে তালা লাগানো। অনামিকার দিকে তাকিয়ে কাঁধ নাচালেন তিনি।

অনামিকা হেসে তার হাত ধরে টানল। ব্যাপারটা কী? যাচ্ছে কোথায় মেয়েটা তাকে টেনে নিয়ে? এসে পৌঁছলেন বাংলোর পেছন দিকে। একটা ছোট গেট আছে এদিকে। বিস্মিত চোখে অনামিকার দিকে তাকালেন সুশোভনবাবু। অনামিকা হেসে বলল, “বিকেলে যখন আপনি দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন ঘরে, তখন বেরিয়ে দেখে গিয়েছি।”

সুশোভনবাবু অনামিকার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে হেসে বললেন, “তুমিটাই তো বেশ ছিল। আবার আপনি কেন?”

গেটটা হাত দিয়ে ঠেলতে প্রথমে খুলল না। অনেকদিন ব্যবহার হয় না বোধ হয়। গেটের গায়ে জংলী লতা গুল্মের ঝোপ গজিয়েছে। বারকয়েক ঠেলাঠেলির পরে ক্যাঁচ করে শব্দ হয়ে গেটটা কিছুটা ফাঁক হল। অনামিকা এবার সুশোভনবাবুর হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। বাংলোর নিচের চলায় আউটহাউজের দরজার ফুটো দিয়ে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ তাদের দেখছে, টেরও পেলেন না সুশোভনবাবু। চোখদুটির মালিক তাদের দিকে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ দৃষ্টি যায়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটিয়াতে ফিরে এল। আজ রক্তচাঁদের রাত। এমন রাত বহুবছর পর পর আসে।

আকাশে রূপোর থালার মতো চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। জঙ্গলে গাছগাছালির প্রাচীর ভেদ করে চাঁদের আলো মাটি অব্দি পৌঁছায় না। গাছের পাতায় পাতায় চাঁদের আলো থৈ থৈ করছে, যেন আলোর বন্যা। যতদূর চোখ যায়, কুয়াশার চাদর মিহিন মসলিনের মতন কোমল মায়া বিস্তার করেছে গোটা জঙ্গল জুড়ে। গাছের নীচে আলো আঁধারির খেলা। পায়ের পাশ দিয়ে ছুটে পালাল দলছুট ইঁদুর বা খরগোশ। তাদের এই নিভৃত নৈশ সাম্রাজ্যে মানুষের উপস্থিতিতে তারা স্পষ্টতই অখুশি।

সুশোভনবাবুর কেমন গা ছমছম কর উঠল। অথচ অনামিকার কোনও হেলদোল নেই। মেয়েটার কথায় নেচে এই মধ্যরাতে জঙ্গলে বেরোনো ঠিক হয়নি। মাথায় ছিট নেই তো মেয়েটার? কতটুকুই বা চেনেন তিনি অনামিকাকে! কাজের বাইরে কতটুকুই বা কথা হয়েছে? বাকিদের মতন ওকে বাগে আনতে টোপ গেলাতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি। সহজেই রাজি হয়েছে, নাটক করার দরকার পড়েনি। অনামিকা নিজেই বুঝে নিয়েছে সুশোভনবাবু কী চান। শুধু একটাই শর্ত ছিল। দূরে কোথাও যেতে হবে। জঙ্গলের আইডিয়াটাও ওরই ছিল। নইলে এতদিন তো ছোটখাটো হোটেল, লজ, খুব বেশি হলে ডায়মন্ড হারবারের চেয়ে দূরে কখনও অভিসারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। বরং মেয়েগুলোরই তাড়া থাকতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার।

অন্ধকারে চোখ কিছুটা সয়ে এসেছে। মাটিতে বিছানো শুকনো ঝরা পাতায় পা পড়ে খচমচ শব্দ হচ্ছে। দূরে কোথায় কী যেন একটা নাম না জানা, রাত জাগা পাখি অদ্ভুত ‘কিটকিট’ শব্দ করে টানা ডেকে যাচ্ছে। মনিউরের কাছে দুপুরেই শুনেছেন, এই চিলাপাতার জঙ্গলে বাঘ সিংহ নেই। বড় জানোয়ার বলতে চিতা, গন্ডার আছে। হাতি তো আছেই। বছরের এই সময় বিষধর সাপেরও অভাব না থাকারই কথা। অনামিকার সত্যিই ভয়ডর নেই। হালকা পা ফেলে একাই এগিয়ে যাচ্ছে ও সুশোভনকে পিছনে ফেলে, যেন এ জায়গা ওর কতই চেনা। একটা শুকনো গাছের ভাঙা গুড়িতে হোঁচট খেয়ে প্রায় ছিটকে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলেন সুশোভন বাবু। মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল ‘আহ্’ বলে। অনামিকা এবার পিছু ফিরে চাইল। সুশোভনবাবু বললেন, “চল অনামিকা, এবার ফেরা যাক। আমার এখানে ঠিক ভালো ঠেকছে না।”

অনামিকা সুশোভনবাবুর গায়ের কাছে ঘেষে এল। তারপর কানের কাছে মুখ রেখে আদুরে বেড়ালের মত আহ্লাদী গলায় বলল, “প্লিজ সোনা, আর একটু এগোই চল। আমার এখানে ভীষণ ভীষণ ভালো লাগছে বিশ্বাস করো। তোমার জন্য আমি এত দূরে এলাম, তুমি আমার জন্য এটুকু করতে পারবে না? ইউ লেজি ওল্ড ম্যান!” বলে সুশোভনবাবুর গালে আলতো করে টোকা দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসল অনামিকা। চাঁদের আলোতে ওর দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল। কালো মেয়েদের দাঁত কি বেশি উজ্জ্বল হয়?

‘ওল্ড ম্যান’ শব্দদুটি শ্রবণেন্দ্রিয়ে জ্বলন্ত শলাকার মত বিধল সুশোভনবাবুর। এই চুয়ান্ন বছর বয়সেও তার স্বাস্থ্য যেকোনো যুবকের হিংসের কারণ হতে পারে। সকালে রোজ প্রায় চার কিলোমিটার হাঁটেন তিনি। এই বয়সেও কোমরের চারপাশে এক বিন্দু মেদ জমতে দেননি। স্মোক করেন না। মদ্যপান করলেও সেটা মেপে করেন, তাও কখনও সখনও। যেমন আজকের রাতটা বিশেষ। যদিও অনামিকার সান্নিধ্যই যথেষ্ট নেশা ধরায়, তবু এমন রাতে কয়েক পাত্র মদ যেন রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়।

কিন্তু আর তো অপেক্ষা সহ্য হয় না। তিনি নাকি ‘ওল্ড ম্যান’, মনে মনে হাসেন সুশোভনবাবু। আজ রাতে অনামিকাকে দেখিয়ে দেবেন তিনি, যৌবন কাকে বলে। বয়সের সাথে যৌবনের কোনও সম্পর্ক নেই। সুশোভনবাবু মনের দিক থেকে চিরযুবক। অনামিকা পালকের মত হালকা পায়ে নাচের ভঙ্গিতে হাঁটছে, গুনগুন করে কী একটা সুর ভাঁজছে যেন। অচেনা সুর, কানে চেনা ঠেকে না। তবে এই রাতের অরণ্য, এই রহস্যময় প্রকৃতির সাথে বেশ মিশে গেছে সুরটা।

হঠাৎ সুশোভনবাবুর মনে হল, কিছুক্ষণ আগেই বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনামিকা বলছিল ও গান গাইতে জানে না। অথচ এখন কেমন দিব্যি গাইছে, গলায় সুরও আছে যথেষ্টই। তার মানে তখন মিথ্যে বলেছিল, লজ্জা পেয়েছিল বোধ হয়। কিন্তু এবার সুশোভবাবুর সত্যিই হাফ ধরছে। অনেকটা চলেও এসেছে তাঁরা। এখানে অরণ্য অনেকটাই গভীর। হাঁটতে গিয়ে গাছে গাছে পা বাঁধছে। এখানে অন্ধকারও অনেক গভীর। এক হাত দূরেও কিছু ঠাহর হচ্ছে না। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ ডাকের শব্দ মস্তিষ্কের ভিতর প্রতিধ্বনিত হয়ে শব্দের তীব্রতা বেড়ে চলেছে যেন।

সুশোভনবাবু গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন, “অনামিকা, চলো এবার ফেরা যাক। আর এগোনো ঠিক হবে না। অলরেডি অনেকটা চলে এসেছি আমরা।”

অনামিকা কোনও উত্তর দিল না। চেয়েও দেখল না পিছনের দিকে। শোনে নি কি? কিন্তু না শোনার তো কথা নয়। এই নিস্তব্ধ অরণ্যে সামান্য শব্দও যেখানে শ্রুতিগোচর হয়, সেখানে এত জোরে ডাকার পরেও অনামিকা শুনতে পাবে না, তা কী করে হয়?

সুশোভনবাবু আবার ডাকলেন। অনামিকা এবারেও উত্তর দিল না। সুশোভনবাবুর এবার যথেষ্ট বিরক্তি বোধ হচ্ছে। অনামিকার কথায় নেচে এভাবে অন্ধকার জঙ্গলে বেরিয়ে আসাটা খুন বড় মূর্খামি হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এবার বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে। অনামিকার না হয় বয়স কম, তার অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু সুশোভনবাবু তার কথায় নাচলেন কী বলে? তাঁর তো এখন আর সেই বয়স নেই যাতে প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে অবিমিষ্যকারিতা করে বসবেন। আর সত্যি বলতে কি, সুশোভন সরকার কোনদিনই কারও প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন বলে তাঁর মনে পড়ে না। ততটা দুর্বলচিত্তের মানুষও তিনি নন।

অনামিকার সাথেও সম্পর্কের সমীকরণটা খুব পরিষ্কার। সেটা অনামিকাও জানে। সব জেনেবুঝেই আজ সে সুশোভনবাবুর সাথে এই বন বাংলোয় এসেছে। সম্পর্কটা উভয় তরফেই শুধুই লেনদেনের।

“অনামিকা, দাঁড়াও প্লিজ”, আবার ডাকলেন সুশোভনবাবু, “আমি আর হাঁটতে পারছি না”।

কিন্তু কোথায় অনামিকা? নিকষ কালো আঁধারের মাঝে সুশোভনবাবু একা দাঁড়িয়ে আছেন। চারিদিকে সার সার শাল, পিয়াল, অশ্বত্থ, জারুল, অর্জুনেরা হাত ধরাধরি করে দুর্ভেদ্য প্রাচীর সৃষ্টি করেছে ; নিজের হাত পা গুলোও ঠিকঠাক ঠাহর হচ্ছে না। যেন কোন অলৌকিক প্রেতপুরীতে একক আগন্তুক আজ সুশোভনবাবু। যেন এই নির্জন অরণ্যের প্রতিটি পশুপাখি, ধুলিকণা অতন্দ্র প্রহরীর মত আড়াল থেকে তাঁর উপর নজর রাখছে। তিনি যেন বিনা অনুমতিতে তাদের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছেন।

“অনামিকা…!” কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলেন সুশোভনবাবু। অরণ্যের নৈঃশব্দে তাঁর কণ্ঠস্বর ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। আবার অনামিকার নাম ধরে ডাকলেন তিনি। ডাকটা খানিকটা আর্তনাদের মতন শোনাল। কটা রাতচড়া পাখি ডানায় ঝটপট শব্দ করে উড়ে গেল। কাছেই কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠল। প্রায় সাথে সাথেই প্রত্যুত্তরে এক ঝাঁক শেয়াল একসাথে অরণ্যের স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ডেকে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিল।

দাঁড়িয়ে পড়লেন সুশোভনবাবু। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলেন। এই নিঃশ্ছিদ্র অন্ধকারে ফেরার পথ ঠাহর পাওয়া সম্ভব নয়। যতদুর চোখ যায় শুধুই দুর্গম অরণ্যানি। তার মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছেন সুশোভনবাবু। শরীরে আর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই তাঁর, আর এক পাও এগোনোর ক্ষমতা নেই। কেন এলেন তিনি এখানে? কেন অনামিকার অযৌক্তিক প্রস্তাবে সায় দিলেন? আর অনামিকাই বা কোথায় গেল? কোনও বিপদে পড়েনি তো মেয়েটা? সুশোভনবাবুর সামনে সামনেই তো হাঁটছিল সে, তাহলে কোথায় গেল এখন? জবাব কেন দিচ্ছে না! কী আশ্চর্য!

অনামিকার কিছু বিপদ হলে সকলকে কী জবাব দেবেন তিনি? কেউ তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। ভেবে দেখতে গেলে অনামিকা সম্পর্কে কিছুই জানেন না তিনি। এমনকি ওর বাড়িতে কে কে আছে, বাড়ি কোথায় তাও জানেন না। অনামিকার কিছু হয়ে গেলে থানা পুলিস হবে নিশ্চিত। একসাথে কাটা দুজনের টিকিট, মনিউর সবাই সাক্ষী দেবে তাঁরা একসঙ্গে এখানে এসেছেন, এক ঘরে থেকেছেন। সুমনা যদি বা অভিমানে নীরব থাকে, কিন্তু তাঁর সন্তানেরা কি অত সহজে মেনে নেবে? কোনদিন ক্ষমা করবে তাকে? বাড়িতে বলে এসেছেন নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে সেমিনারের জন্য শিলিগুড়ি যাচ্ছেন। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ হবে না কিছু। এগোতেই হবে যেভাবেই হোক। একটা টর্চ জাতীয় কিছু সঙ্গে থাকলে ভাল হত, এই অন্ধকারে এগোতে সুবিধে হত।

হঠাৎ মনে পড়ল পকেটে মোবাইল ফোনটা আছে। সেটা বার করে দেখলেন সামান্যই ব্যাটারি অবশিষ্ট আছে। যা হোক, আপাতত সেটা দিয়ে কিছুক্ষণ অন্তত কাজ চলবে। অনামিকা সম্ভবত এগিয়ে গেছে অনেকটা। ওর বয়স কম, উৎসাহ বেশি, শারীরিক সক্ষমতাও বেশি সুশোভনবাবুর চেয়ে। তা বলে এতটা বাচ্চাও তো নয় যে এরকম দারিত্বজ্ঞানহীন আচরণ করবে।

সুশোভনবাবু এইমুহূর্তে অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করছেন। মোবাইলের ম্লান আলোয় আশেপাশের গাছপালা সরিয়ে এগোতে শুরু করলেন সুশোভনবাবু। এখন সত্যিই ভয় করছে তাঁর। পিছনে ফেরার পথ বন্ধ, এদিকে সামনে কতদূর এগোনো যাবে, আদৌ কোথায় পৌঁছবেন জানেন না তিনি। এই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে কোথায় খুঁজবেন তিনি অনামিকাকে? গাছগুলি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তার পথ রোধ করছে বারবার।

মিনিট দশেক এভাবে এগোনোর পর অরণ্য যেন কিছুটা পাতলা হয়ে এল। বিগত দশ মিনিটে বোধ হচ্ছে সুশোভনবাবু আলোকবর্ষ পথ অতিক্রম করে এসেছেন। ক্লান্তিতে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন জবাব দিচ্ছে। হাতে পায়ে শরীরের নানা জায়গায় কেটে ছড়ে গেছে। একটু দাঁড়ালেন তিনি, জোরে জোরে শ্বাস নিলেন। সামনে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ম্লান আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে পা টেনে এগোলেন সুশোভনবাবু। কিছুটা এগোতেই দেখা গেল অরণ্যের মাঝ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে স্বচ্ছতোয়া এক ছোট নদী। চাঁদের রাতে নদীর চর জুড়ে আলোর খেলা। প্রকৃতিদেবী যেন নিপুন শিল্পীর মতন আলো ছায়ার তুলি বুলিয়েছেন নদীতট ও পার্শ্ববর্তী অরণ্য জুড়ে। সম্ভবত জঙ্গলের পশুরা এখানে জল খেতে আসে। অন্যসময় হলে হয়তো সুশোভনবাবু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন। কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে মুগ্ধতার কোনও অবকাশ নেই। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তাঁর।

অনামিকা কোথায় গেল। এখানেও তো নেই। পায়ে পায়ে আরেকটু এগোলেন তিনি। নদীর চড়ে রঙচঙে কিছু পড়ে থাকতে দেখে এগোলেন পা টিপে টিপে। মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে চিনতে পারলেন জিনিসটা, তার শিরদাড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। এ তো অনামিকার শাড়ি, এটাই তো পরেছিল ও। আশেপাশে দৃষ্টি বোলাতেই ব্লাউজ পেটিকোট অন্তর্বাস ছড়ানো ছিটোনো অবস্থায় চোখে পড়ল।

সুশোভনবাবুর অধরপ্রান্তে এবার মৃদু হাসির রেখা খেলে গেল। মেয়েটা আজ দুষ্টুমি করার মেজাজে আছে। কিন্তু আজ সত্যিই ওকে বকতেই হবে। এই রাতের জঙ্গলে সুশোভনবাবুকে রীতিমত ভয় পাইয়ে দিয়েছিল অনামিকা। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, পরিবেশটা ভীষণ রোমান্টিক। কিন্তু অনামিকা আবার কোথায় লুকোলো? বড্ড দুষ্টু মেয়েটা। এই কারণেই এইসব অল্পবয়সি মেয়েদের এত পছন্দ করেন সুশোভনবাবু। এরা হল ঝলমলে প্রজাপতির মত, জীবনীশক্তিতে ভরপুর। এদের সান্নিধ্যে সুশোভনবাবুও নিজের মধ্যে সেই ফেলে আসা তারুণ্য ফিরে পান।

“অনামিকা, অনামিকা…”, নরম গলায় ডাকলেন সুশোভনবাবু। এতক্ষণে চোখে পড়ল নদীর ধারে কোনও একটি প্রাণী উঁবু হয়ে জল খাচ্ছে। একটু ভয় পেলেন সুশোভনবাবু এবার। প্রাণীটা খুব বেশী দূরে নয়, অন্ধকারে যদিও বোঝা যাচ্ছে না কোন প্রাণী এটি। অনামিকা আবার কোথায় লুকোলো। এতটা অ্যাডভেঞ্চারও ভালো লাগছে না। একটু বেশি বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবারে। “অনামিকা…”, আবার ডাকলেন তিনি। তার কণ্ঠস্বর শুনে প্রাণীটা মুখ তুলে তাকালো তার দিকে। সুশোভনবাবু দুই পা পিছিয়ে গেলেন। উফফ্‌, অনামিকা কোথায় গেল! প্রাণীটা সুশোভনবাবুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জলপান বন্ধ করে। চারিদিকের আলো ধীরে ধীরে যান ম্লান হয়ে আসছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলেন সুশোভনবাবু। চাঁদের রংটা কেমন যেন বদলে গেছে। অস্বাভাবিক লাল দেখাচ্ছে চাঁদটাকে। যেন চাঁদের গায়ে কেউ রক্ত লেপে দিয়েছে। সেই রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। চারপাশের প্রকৃতি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

প্রাণীটা এবার মেরুদন্ড সোজা করে দুই পায়ে উঠে দাঁড়ালো। “অনামিকা”, সুশোভনবাবুর গলা থেকে বিহ্বল স্বর বেরিয়ে এল। হ্যাঁ, অনামিকাই তো। দূর থেকে যদিও মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু স্পষ্ট এক মানবীর অবয়ব, বিবসনা নগ্নিকা নারী।

“উফফ্‌ অনামিকা, খুব জ্বালিয়েছ আজ তুমি আমায়”, বলে হাসিমুখে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে এগোলেন সুশোভনবাবু। কিন্তু অনামিকা অমন ঝুঁকে দুলে দুলে হাটছে কেন? ব্যথা পেয়েছে নাকি কোনভাবে? যা ঘন জঙ্গল, তার উপরে এত অন্ধকার, আঘাত পাওয়া বিচিত্র নয়। এইজন্য বাংলো ছেড়ে এতরাতে বাইরে বেরোতে চান নি তিনি। অনামিকা দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎই। তারপর আকাশে চাঁদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে নদীর চরায় বসে পড়ল উবু হয়ে। তারপর অদ্ভুতভাবে হামাগুড়ি দিয়ে সুশোভন বাবুর দিকে এগোতে লাগল। অনামিকার এমন আচরণের কোনও অর্থ খুঁজে পেলেন না সুশোভনবাবু। দ্রুত পায়ে এগোলেন অনামিকার দিকে। “কী হল তোমার, অনামিকা? এভাবে কেন হাঁটছ?” ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন সুশোভনবাবু। অনামিকা স্থির হয়ে বসে আছে। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। পূণিমা চাঁদ এখন পুরোপুরি রক্তলাল। চরাচরে সেই রক্তের হোলিখেলা। শ্যামাঙ্গী অনামিকার শরীরেও সেই লালের গাঢ় ছায়া। হঠাতই নিজের শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি টের পেলেন সুশোভনবাবু। অনামিকা বসে বসে অদ্ভুতভাবে দুলছে। নিচু হয়ে অনামিকার পিঠে হাত রাখলেন সুশোভনবাবু। মাথা তুলে তাকাল অনামিকা। ছিটকে সরে গেলেন সুশোভনবাবু। সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল তার। এ তিনি কী দেখছেন?

অনামিকার চোখদুটি টকটকে লাল। ঠোঁট ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত। সূঁচোলো কান, নরম গাঢ় বাদামি রোমে ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে অনামিকার সর্বাঙ্গ। উফফ্‌, কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য! অনামিকা মুখ উঁচু করে চাঁদের দিকে তাকাল একবার, ঠিক পরমুহূর্তে তার ভয়ঙ্কর গর্জনে কেঁপে উঠল সমগ্র অরণ্য। নেকড়ে মানবীর চিৎকারে যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল নিশীথ রাতের বনানী। মাথার উপরে পাক খেয়ে উড়তে শুরু করল শয়ে শয়ে চিল শকুনের দল। তাদের ডানার ঝাপটায় নদীর চরে উঠল ধুলোর ঝড়।

প্রাণ ভয়ে দৌঁড়োতে শুরু করলেন প্রফেসর সুশোভন সরকার। পালাতে হবে, যেভাবেই হোক পালাতে হবে তাকে। অন্ধকারে ঘন অরণ্যের পথে দিক্‌বিদিক্‌ জ্ঞান শূণ্য হয়ে ছুটতে লাগলেন তিনি। যে অতীতকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছিলেন তিনি, আজ যেন তা এসে দাঁড়িয়েছে তারই সামনে। সেই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল কোন সেই বিস্মৃত অতীতে লন্ডনে তার সেই সময়ের প্রেয়সী রেনির কথা। অদ্ভুত ছিল মেয়েটা, যত অদ্ভুত বিষয়ে তার ছিল যত আগ্রহ। নেকড়ে মানুষ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছিল ও। বন্য পশুদের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা। তার দাবী ছিল, পশুদের ভাষা নাকি সে বুঝতে পারে।

সুশোভনবাবু যদিও হেসে উড়িয়ে দিতেন সেসব কথা। কিন্তু বেশিদিন তার প্রলাপ ওড়ানো গেল না। একদিন জানাল, সে সুশোভনের সন্তানের মা হতে যাচ্ছে। সুশোভনবাবু ততদিনে দেশের ফেরার প্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন। দেশে বাবা তার ছেলেকে বাঁধার জন্য ‘প্রকৃত সুন্দরী’ সুমনাকে বেছেছেন ছেলের জন্য। কিন্তু রেনি বড় জেদি মেয়ে, ধরে পড়ল সুশোভনবাবুর সাথে সেও ভারতে আসবে। কোন উপায় ছিল না সুশোভনবাবুর হাতে। একদিন গভীর রাতে জঙ্গলে শ্যুটিংয়ে গিয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু হল রেনির। সারা গায়ে নেকড়ের আঁচড়ের চিহ্ন। পুলিসি জেরার সুশোভনবাবু বলেছিলেন নেকড়ে মানব নিয়ে গবেষণাধর্মী ডকুমেন্টারি বানাতে গিয়ে জঙ্গলে নেকড়েদের ডেরায় ঢুকে গিয়েছিল রেনি। তদন্ত সেখানেই থেমে গেছিল। পরিচিত সকলে খুব অবাক হয়েছিল রেনির মৃত্যুতে। জঙ্গলের নেকড়েদের সঙ্গে ভারি ভাব ছিল রেনির। সেই নেকড়েদের হাতে তার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি কেউই।

শুধু একটা ব্যাপারে খুঁতখুতানি রয়ে গেছিল সুশোভনবাবুর মনে। পোস্ট মর্টেমে রেনির দেহে গর্ভধরণের কোন চিহ্ন ছিল না। কিন্তু তার প্রেগনেন্সি পজিটিভ রিপোর্ট সুশোভন বাবু নিজে দেখেছিলেন। এর পরে দেশে ফিরে আসেন তিনি। সময়ের সাথে সাথে স্মৃতির উপর বিস্মরণের পলি জমে। জীবন বয়ে চলে চেনা খাতে।

আজ আবার এতদিন পরে অতীত তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পালাতে হবেই তাকে। কিন্তু কীভাবে? চাঁদের আলো মুছে গিয়ে বিশ্বচরাচর রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। মনে পড়ল, রেনি বলত রক্তচাঁদের রাতে নেকড়ে মানুষের রূপান্তর হয়। সেই রাতে মানুষের রক্ত পান না করা অব্দি তার রূপান্তর সম্পূর্ন হয় না।

সুশোভনবাবু ছুটছেন, ঠিক এভাবেই রেনি একদিন পালানোর চেষ্টা করেছিল তার কৃত্রিমভাবে বানানো নেকড়ের থাবার থেকে। অনুরোধ করেছিল, হাত জোড় করে নিজের ও গর্ভস্থ সন্তানের প্রাণভিক্ষা করেছিল সেদিন সে।

চারপাশ থেকে গাছগুলি যেন এগিয়ে এসে ঘিরে ধরেছে সুশোভনবাবুকে। পালাবার আর কোনও পথ নেই। হোচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি। আকুল স্বরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। মাথার উপর তারস্বরে ডেকে চলেছে পাখিগুলো, পাক খাচ্ছে গোল করে। দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। পায়ের শিরায় টান পড়েছে ভীষণ। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তাঁর আর। কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কান্না জড়ানো আর্তনাদ ছাড়া আর কিছু বেরোলো না তাঁর গলা থেকে। ঠিক তাঁর সামনে অন্ধকারের মধ্যে জ্বলছে দুটো আগুনের গোলার মত চোখ। আবার একটা প্রবল গর্জনে শিহরিত হল অরণ্য। ঠিক তার পর মুহূর্তে মনুষ্যকণ্ঠের একটা অন্তিম আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর সব স্থির। নির্জন অরণ্যে ফিরে এল নৈশ স্তব্ধতা। অভিসারে গিয়ে একজন মানুষ যদি জঙ্গলে হারিয়ে যায়, কেই বা কতদিন তা মনে রাখে?

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত