| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: পাখির নীড়ের থেকে খড়  ।  শ্রাবণী দাশগুপ্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

(এক)

দু-দিনের অফিশিয়াল ইন্সপেকশনে এসেছি, গেস্ট-হাউসে রাতটা থেকে কাল ফেরা।

প্রায় পঁচিশবছর আগে এখানে থাকতাম, ছিলাম প্রায় চারবছর। ছোট ছোটো স্মৃতির কৌটো খুলছে—জায়গাটা প্রায় অবিকল আছে দেখছি। যদিও খালি জমিতে আধুনিক ফ্ল্যাট, কমপ্লেক্স, মাল্টিপ্লেক্স গজিয়েছে। ওভারব্রিজ, হোটেল-মোটেল বেড়েছে সংখ্যায়, শহর-তলিতে আমূল পরিবর্তন নেই। সে-ই ঢিলেঢালা গন্ধ! পুরোনো ধাঁচার চাকচিক্যহীন অনতিপ্রশস্ত রাস্তায়, বস্তিন-বাজারে, ঘাঁটি স্টোর্সে, কোর্ট-মোড়ে, হীরাপুরে, কারখানার গেটে, সাহেবি আমলের বন্ধ বেকারিতে, কম্পানি টাউনশিপে, ইভলিন লজে— অতীতের মরচে লেগে আছে!

আঁখিকে বলেছিলাম, চলো। এলো না।  

(দুই)

মোটর-বাইক স্টার্ট নিলে আমি পক্ষীরাজের পিঠে-চড়া রাজপুত্তুর!

মেন-রোড থেকে বাঁ-দিকে টার্ন নিয়ে ঢালুতে নেমে আমার বাসার পাড়ার রাস্তা— প্রাইভেট এরিয়া। বি-শিফটের দিনগুলোয় দু-পাশে মুদীর দোকান ক-খানা, সবেধন নীলমণি মিষ্টিমহল, হোমিও-হল, খাতাবইয়ের দোকান, চশমার দোকান, ঘেঁষ-ঘেঁষ বাড়ি, সব নিঝুম। দু-একটা বাড়িতে আলো জ্বলে, হয়তো পরীক্ষার্থী বা পড়ুয়া আছে। সরু গলিতে পড়ে আরেকটা ছোটো টার্ন- ধাঁ করে লোহার গেটে এসে দাঁড়াই। চৌহদ্দি ঘুটঘুটে। ওপরতলায় বাড়িওয়ালার বারান্দার আলো জ্বলে ওঠে। গেটের ঠিক মুখে কাঠগোলাপ গাছদুটোর পাতায় সবুজ ফ্রেমওয়ালা ঘষা কাচের জানালানির্গত আলো পড়ে। বাকি গাছগুলোর মাথায় কালো আকাশ ঝোলে, চামচিকে দোল খায়, পাখির ছানারা পাশ ফেরে। ঝোপঝাড়ে পোকা-মাকড় সতর্ক হয়ে ওঠে। ল্যাম্পপোস্টের হলদে বাল্ব থেকে ম্যাড়ম্যাড়ে আলো। পাহারাওয়ালা লাঠি ঠোকে, মাথা নেড়ে জানায় আমাকে চেনে। বাড়িওয়ালার বছর তেরো-চোদ্দর বাচ্চা চাকর বোঁচা ধুপধাপ করে নেমে বাইরের গেটের তালা খুলে ঘুমচোখ ডলে বলে,

-কত রাত করো কাকু!

সারাদিনের ঘেমোগন্ধ, ক্লান্ত নিরুপায় মাথা হেলাই। আমার সোনালি বাঁশের কঞ্চির মতো নবোঢ়া তরুণী বউ আঁখি একঘুম মেরে ফোলাচোখে উঠে এসে বারান্দার গ্রিলের তালা খোলে। হাই তুলে বলে,

-এসো।

বাড়িটা একটু উঁচুতে। খাড়া স্লোপ দিয়ে বাইক তুলতে জুত পাইনা। অনিচ্ছুক মুখে বোঁচা ঠেলে দেয়। গ্রিলে ফের গোদা তালা লাগাই। পশ্চিমবাংলা-বিহার বর্ডারের এ-অঞ্চল তত নিরাপদ নয়। চুরি-ছিনতাই, রাহাজানি, দুষ্কর্মের লোমহর্ষক গল্প শুনি। কাছে-পিঠে খনি অঞ্চল, অন্য রাজ্যের উটকো ব্যবসায়ী— এ-শহরে বরাবরই বিশ্বায়নের বাতাস।

স্নান করে, খেয়ে বিছানায় যেতে দিনের তারিখ বদলে যায়। বউয়ের গায়ের গন্ধ শুঁকে আরো একঘন্টা।

সস্ত্রীক থাকার জন্যে দু-কামরার বাড়ি খুঁজেছিলাম। সমরদা আমার সিনীয়ার কলীগ, প্রচুর সাহায্য করেছে। পৈতৃকসূত্রে এখানকার ছেলে। শংসা দিয়েছে, এ-পাড়াটা নির্ঝঞ্ঝাট, নিরাপদ। উত্তম মালমশলায় সলিড দোতলাখানা বানিয়েছে আমাদের বাড়িওয়ালা শ্যামলাল দাস। পেশা সঠিক জানিনা, অনেকরকম শুনি। মালকড়ি আছে, টের পাই। গেটে ঢুকতেই কাঠগোলাপ গাছটার পাশে আতা, পেয়ারা, বাতাবি, একটু দূরে বেল। দোতলার বৃহৎ অংশটা নিজেদের, পাশের ছোট্ট অংশে ভাড়া। কোনো ব্যাচেলর থাকে। নীচটা সমান দু-ভাগ। একদিকের ভাড়াটে আমরা, ওদিকে অন্য পরিবার। দরজা আলাদা। আমি একলষেঁড়ে— মিশতে পারি না। বউ আমার উলটো, টুং-টাং সারাদিন। তাই যতটা পারি ওকে ভয় দেখিয়ে কারখানায় যাই যাতে হুটহাট বেরিয়ে না পড়ে। আমাদের দিকের জমিতে বাড়িওয়ালার কিচেন-গার্ডেন, ওধারে ফুলবাগান। উঠোনে কুঁয়ো, জল পাম্প করে ওভার-হেড ট্যাঙ্কে চড়ে। ওখানে দাঁড়িয়ে বালতি তুলে জল ঢেলে চান করে বোঁচা। মাথা বেয়ে, বোজা চোখ বেয়ে কাচের সরু লাঠির মতো ঠাণ্ডা জল বেয়ে পড়ে। 

হুঁশিয়ার লোক শ্যামলালবাবু। গ্রীষ্মকালে যখন জলটল শুকিয়ে অন্য বাড়িতে হাহাকার, রাতে মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তার কলে পাইপ লাগিয়ে কুঁয়ো ভরে রাখে। আসলে নিজেরাই যে থাকে ওপরতলায়! প্রতিমাবৌদি তিন বালক-বালিকার মা— কালো-কোলো, শাঁখা-পলা, সোনার মোটা চুড়ি-হার। দুপুরের রোদে চকচকে ষষ্ঠী ঠাকুরাণী সক্কালবেলা বোঁচাকে নিয়ে বাগান তদারকিতে নামে। আমাদের তখন মাঝরাত। এ-শিফট বা জেনারেল শিফট থাকলে ততক্ষণে আমি বেরিয়ে গেছি।

আঁখি আচার-চাটা আহ্লাদীমুখে বলে,

-প্রতিমাবৌদি কী ভালো গো! একা থাকি বলে কতবার খোঁজ নেয়। জানো তো আগে শুধু একতলা ছিল। তখন ওরা এদিকটায় থাকত। ওপাশটা ভাড়া দিত। পরে না, কত কষ্ট করে দোতলা তোলে।

প্রায়ই দেখি পাতের পাশে সুস্বাদু পদ—প্রতিমাবৌদি পাঠিয়ে দিয়েছে। সে নিজে রান্না ভালো পারে না। চোখ কুঁচকে বিরক্তভাবে বলি,

-রোজ-রোজ এসব কী? বেশী গলে যেয়ো না আবার।

আমরা আসার মাসতিনেকের মধ্যে আমাদের লাগোয়া বাসায় ভাড়াটেদের কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে গেল। বয়সে খানিক বড়ো দীপেশদা, বৌদি আর বছরছয়ের ছেলে। মেলামেশা তেমন হয়নি, আলগা আলাপ। উঠে যাওয়ার আগে একদিন খেতে বললাম। আঁখি যা পারে হাবিজাবি রাঁধল। দীপেশদা বলল,

-শ্যামবাবু লোকটা প্রচণ্ড ঘাঘু, শুধু পাই-পয়সা চেনে। প্রথম একটাবছর কিচ্ছু বলবে না। লাস্ট দু-মাস যা করছিল আমাদের সাথে! ওদের বাচ্চা চাকরটা, একদম বিশ্বাস করবেন না। আস্তো শয়তান, সাঙ্ঘাতিক স্পাই। এক-দেড় বছর পরপর ভাড়াটের মতো ওদের চাকরও চেঞ্জ হয়।

আমার চোখ কপালে। দীপেশদা আর ভাঙে না, বুঝে-সুঝে মেলামেশা করতে বলে। বউকে সাবধান করি, সে পাত্তাও দেয় না। ওর জন্যে ভয় পাই, অতি সরল আর বোকা। অথচ হুট করে অফিসের লীজে-নেওয়া বাড়ি বদলানোর অনেক হ্যাপা। তড়িঘড়ি যাবো বা কোথায়? ভাবি, কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে এলে দেখা যাবে।

আমি একা। বউ মাসেকের জন্য গেছে কলকাতা। দমদমে বাপের বাড়ি, আমার বাবা-মা লেক টাউনে। রাত্তিরে হোটেল থেকে খেয়ে ফিরে শোওয়ার ঘরে কাত হই। কাঠের জানালার সবুজ কপাট খুলে দিই। উঁচু সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনি। একদিন দেখি প্রতিমাবৌদি বোঁচাকে নিয়ে এসে ঘন্টি বাজাল,

-ও ঠাকুরপো, দরোজা খোলো দিকি একবারটি!

হাতের স্টিলের বড়ো বাটি থেকে ভুরভুর সুগন্ধ। গেট খুলে সরে দাঁড়ালে চেনা মেঝেতে পা ফেলে গটগটিয়ে গিয়ে আমাদের এক খামচা টেবিলে বাটি রেখে হাতের উল্টোপিঠে ঘোমটা টেনে সহজ হেসে বলে,

-এঁচোড়-ঘন্টো, সকড়ি কিন্তু। ও-বাটি ধুও না, রেকে দিয়ো। বোঁচা কালে’সে নিয়ে যাবে’খন। নাও, গেট দাও।

মাথা নাড়ি, বাধ্য ছেলের মতো তালা লাগাই। এরপর প্রায়দিন আসে মাছের ডালনা, কাঁচকলার কোপ্তা, মোচাঘন্ট। বারণ করে লাভ হয় নি। বামুন খাওয়ালে নাকি পুণ্যি হয়। তবে সেটা দু-তরফেই হোক, বারণ করি কেন? অফিস থেকে রোজ আঁখিদের বাড়িতে ফোন করি। বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে অভিমান করে,

-এই বেলা? দেখো, আবার প্রেম করে বোসো না।

পাশের বাড়িতে ভাড়াটে এসেছে। তিনজন লোক— সম্ভবত মা, ছেলে, মেয়ে। একদিন বাইক নিয়ে বেরোতে গিয়ে গেটে মহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি মধুর ভদ্রতা করলেন,

-যান, আপনার বেশী জরুরি।

-না, না ঠিক আছে।

বাইকের গর্জন তুলে বেরিয়ে গেলাম। প্রাচীন দেওয়ালে দামী ফ্রেমে কাচ-বাঁধানো অয়েল-পেইন্টিং-এর মতো চেহারা মনে বসে গেল। দু-তিন দিন পরে ফের দেখা—জেনারেল শিফট থেকে ফিরছি। হাসলাম, উনিও ফিরিয়ে দিলেন। আমার ময়লা, তালঢ্যাঙা চেহারাটা আপাদমস্তক জরিপ করে বললেন,

-ভালো?

-হ্যাঁ ভালো।

-সময় পেলে আসুন একদিন। পাশাপাশি আছি- চেনা-পরিচয়, কথাবার্তা হবে।

-যাবো মাসিমা। মিসেস এখন কলকাতায়, ফিরুক।

-ও, ম্যারেড? বাঃ।

স্বরে যেন ঈষৎ বিরক্তি—মাসিমা বললাম বলে?

যথেচ্ছ দুধ-চিনি ঢেলে কড়া-চা বানিয়ে আসার পথে শম্ভুর দোকান থেকে কিনে-আনা তেল চুপচুপে আলুর চপ সহযোগে সাঁটালাম। কে জানে কেন, সন্ধ্যের সাক্ষাৎটি মাথায় ঘুরছে। আনুমানিক মা-দের বয়স। কুয়াশাবৃত জয়চণ্ডী পাহাড়ের মতো জমাট শরীরে বিবর্ণ মার্বেলের রঙ। যথেষ্ট আধুনিক, লেবুরঙ শাড়ি পরেছিলেন, লাল জামা। কাঁধে চামড়ার থলে। আমার মুখের দিকে সরাসরি তাকালেন, দৃষ্টিতে অতল সুড়ঙ্গ। গা শিরশির করছিল। কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর ছিল? মনে পড়ছে না। উত্তরসাঁঝে হিজিবিজি আধা স্বপ্ন-ঘোর-ঘোর ঘুমে চোখ বুজে আসে। মাঝরাতে ঘুম পাতলা হয়ে এলে বিছানা হাতড়ে আঁখিকে খুঁজি। তন্দ্রায় একেকদিন ওপাশ থেকে মাঝের দেওয়ালের চূন-বালি ভেদ করে তীক্ষ্ণ উত্তর-প্রত্যুত্তর ভেসে আসে। কী কথা হচ্ছে, কান শুনতে চায়। মগজ বলে—ধুস ঘুমিয়ে পড়, কাল ডিউটি।

বৃহস্পতিবার আঁখিকে ফোন করলাম। রোববার ওকে নিয়ে আসার কথা। মিসক্যারেজ হয়ে গেছে, ফোনে কাঁদছিল। আমি আর কী বোঝাব? শাশুড়ি অনুরোধ করলেন,

–এখন হপ্তাদুই থাকুক। শরীর একটু সারলে নিয়ে যেয়ো।

মনটা থ্যাঁতলানো কলার মতো হয়ে আছে। একরত্তি টিভিটা চালিয়ে বসেছিলাম, দেখছিলাম না। প্রতিমাবৌদি হাসিমুখে তরকারির বাটি নিয়ে এল। কালো চকচকে কপালে পুজোর তেল-মাখা সিঁদুর, কাপড়ে ফুল-চন্দনের গন্ধ। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না, ফ্রিজে তুলে দেব। মুখ দেখে জানতে চাইল কী ব্যাপার, কাটিয়ে দিলাম। নিঝুম বাগান থেকে আসা পাখপাখালির একঘেয়ে ডাক। মেঘ-ফাটা পূর্ণিমা, কাঠকুটো মেঘ সরিয়ে চাঁদ মুখ বের করেছে। আলোকচূর্ণমাখা গাছের পাতারা বাতাসে খেলে ছুঁয়ে দেয় পরস্পরকে। আশপাশ থেকে স্তব্ধতাভেদী শাঁখের সরু-মোটা সুর। পেছনের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কাঠের দরজায় টোকা দিল কেউ! ওদিকটা আমি খুলি না। সকালে আঁখি খোলে, কাজের মাসি খোলে। কাপড় মেলে দেয় উঠোনে। সতর্কভাবে জানতে চাইলাম,

-কে?

-খুলুন একটু। আমি—, সুমিত্রা, পাশের বাড়ির।

-আসছি…!

সাবধানে যাই—অন্ধকার, অচেনা। আলো জ্বেলে কাঠের দরজা খুলি। জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে অতিরিক্ত কালো মাথা। দরজা খুলে অপ্রস্তুতভাবে ডাকি,

-মাসিমা? আসুন! কোনো প্রব্লেম হয়েছে নাকি?

-না না। এমনি এলাম, কিছু মনে করবেন না যেন। কোথায় রাখি?

হাতে কাচের বাটি সুন্দর কাপড়ে ঢাকা। সসঙ্কোচে একহারা টেবিল দেখাই। নামিয়ে রেখে হাসেন,

-পুতুলের সংসার, বুঝতে পারছি।

সাজানো দাঁতের পাটি। বেগুনী শাড়ি, হাতকাটা সবুজ ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে সুডৌল পুষ্ট গৌরবাহু। চুলের বেনী বুকের ঠিক মাঝখানে। চোখে কাজল, ঠোঁটে রঙ। ওভাবে তাকানো অনুচিত, চোখ সরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। উনি বলেন,

-বারের পুজো করি, প্রসাদ দিয়ে গেলাম। লুচি আর হালুয়া করেছিলাম, খাবেন। আসি?

খাবো না ভেবেও খেতে বসলাম। মনে হল, আজ ভোজ। বিষণ্ণ বাসার মনমরা বাতাসে সরু-সরু সুবাসী ফুল।

দেড়-মাসে আঁখি বড়ো হয়ে গেছে। আবদার করে না, গাল ফোলায় না। বাইকে বসলে জাপটে ধরে না। বেরোতে চায়ই না বাড়ি থেকে। ওর কষ্ট আমি ছুঁতে পারি না। চা খেতে-খেতে সহজ গলায় বললাম,

-পাশের বাড়িতে আলাপ করতে যাবে?

ডাগর চোখজোড়া আমার মুখে ফেলে হাসল। আলস্যমাখা গলায় বলল,

-গেলেই হয়।

সেদিন মর্নিং-শিফট ছিল। সন্ধ্যেবেলা আঁখি একটু সেজেছে, হলুদ শাড়ির আলোয় ঢাকা পড়েছে বিষাদ। বাগান পেরিয়ে ওধারে গিয়ে কলিংবেল বাজালাম, খুলল না। আবার বাজালাম, সাড়া নেই। ওদের জানালার ফাঁক ধরে ভেতরের আলো বাইরে পড়ছে। অগত্যা ধাপিতে পা রেখেছি ফিরব বলে, দরজা খুলে কেউ রুক্ষভাবে ডাকল,

-হ্যালো! কাকে চান?

একটি মেয়ের শিলিউট। আলো পেছনে বলে মুখ দেখতে পাচ্ছি না। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম,

-আমরা পাশে থাকি।

-হ্যাঁ বলুন, কী দরকার?

আঁখি পেছন থেকে আমার জামাটা খামচে টানছে। আমি বলি,

-মাসিমা মানে সুমিত্রাদেবী আমাদের—বলেছেন—আসতে!

-ও-কে ফাইন! প্লিজ ওয়েট ফর আ হোয়াইল।

কনভেন্টেড ইংরাজি উচ্চারণ। আঁখি দমে গেছে, ত্রস্ত হরিণাক্ষী। ফিসফিস করে বলে,

-বাড়ি চলো।

বলতে বলতে দরজায় সুমিত্রা, এঁরও মুখ বোঝা যাচ্ছে না। নিরস গলায় বলেন,

-ও, আপনারা?

ন যযৌ ন তস্থৌ দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করি! উনি শীতলভাবে ডাকেন,

-আসুন ভেতরে আসুন।

ভাবছি ফিরে যাই, কিন্তু পায়ে-পায়ে ঢুকেই পড়ি। সুমিত্রার আলুথালু চেহারা বেশ চোখে লাগছে। উস্কোখুস্কো মাথা। রঙচটা ঢোলা জামা পরা, ওরকম কাফতান-টাফতান আঁখি ঘরে পরে। মা বা শাশুড়ি পরেছেন, কল্পনায় আনতে পারি না। দেওয়াল ঘেঁষে সরু তক্তপোশ, গোটাদুই চেয়ার, টিভি স্ট্যাণ্ডের ওপরে। সমস্তর ওপরে জামা-কাপড়, ব্যাগ, অন্তর্বাস, আরো হাবিজাবি ছড়ানো। বসার জায়গা নেই!

‘বসুন, বসুন’ বলে উনি লজ্জিত, ব্যস্তভাবে সব সাপটে দলামোচা করে ছিন্ন ডালপাতার মতো সরিয়ে নিয়ে ভেতরে গেলেন। তীব্র, চাপা কথা কাটাকাটির শব্দ পেলাম। আঁখি ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে চাইল। হঠাৎ সেই মেয়েটি তিরবেগে বাইরে বেরিয়ে গেল। সুমিত্রা পেছন পেছন এলেন। সবিনয়ে বললাম,

-অসময়ে এসে পড়েছি, আপনারা ব্যস্ত আছেন। আজ যাই, পরে আরেকদিন আসব।

-না না, গেস্ট আপনারা। এই আপনার স্ত্রী? পাখির মতো সরল চোখ! কী নাম গো তোমার?

আনমনা স্বরে উষ্ণতা নেই। প্রসাধনহীন চোখে, কপালে, নাকের পাশে, বয়সের রিফুর সুতো স্পষ্ট ফুটে মুখটি করুণ দেখাচ্ছে।      

    

আঁখি সমে ফিরছে। আমাদের ছোট্ট বাসা স্বাভাবিক, কলমুখর। সুমিত্রা-মাসিমার সঙ্গে ওর বেশ ভাব হয়েছে। আমাকে শোনায় সুমিত্রা-মাসিমার স্ট্রাগলের গল্প। স্বামীবিয়োগের কথা, নিউ-টাউনের শ্বশুরবাড়ির বাস ছেড়ে উঠে আসার কথা। আমি কান দিই না। আসলে আজকাল কারখানার কাজের পরে পড়াশোনা করছি। ভালো প্রাইভেট কম্পানিতে পেলে চলে যাবো। শান্তি থাকলেও, ভবিষ্যৎ এখানে বিশেষ আশাপ্রদ নয়। আঁখি বিরক্ত হয়, কাগজপত্র সরিয়ে দিয়ে বলে,

-কী সারাদিন পড়তে থাকো? এমনি তো একটা বোবার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, এখন সে কালাও হয়ে গ্যাছে!

হেসে ফেলি,

-আচ্ছা বলো— তোমার তো বৌদি আর মাসিমার গল্প।

-জানো, নীলাক্ষী মানে মাসিমার মেয়ে না, ভীষণ পাজি ঝগড়ুটে। চাকরি করে বলে খুব ডাঁট! আমার সামনেই ট্যাঁক-ট্যাঁক করে মায়ের সঙ্গে কথা বলে। মাসিমা একটু দুঃখ করছিলেন। ছেলেটাও সুবিধের নয়, তাকানোটা একদম বাজে! আছে দেখলে আমি ছুতো করে পালিয়ে আসি। আর—জানো তো, এটা কাউকে বোলবে না কিন্তু!

আমি সন্দিগ্ধভাবে আঁখির দিকে চেয়ে কড়া গলায় বলি,

-কী?

-ওর মানে নীলাক্ষীর লাভার না, ওদের বাড়িতে সবসময়ে আসে, রাত্তিরে থেকে যায় কতদিন।

-এসব বলেছে নাকি?

-ধুৎ, ওরা বলে যে কাজিন। ছেলেটা আবার নাকি খ্রিস্টান! ভাবতে পারো?

-হতেই পারে। এখানে অনেক খ্রিশ্চান আছে।  

-ও, আমি জানিনা! দু-জনে কট-কট করে ইংরেজিতে গল্প করে। লোরেটোতে পড়ত তো, ভাবে আমি বাংলা মিডিয়াম বলে বুঝবো না। কিন্তু আমি গ্র্যাজুয়েট আর নীলাক্ষী শুধু বারো-ক্লাস পাশ করেছে। আমার চেয়ে দু-বছরের জুনিয়ার। আই-এস-সির পরে ওর বাবা মারা যেতে আর কলেজে যাওয়া হয়নি।

আমার প্রচণ্ড রাগ হয় আঁখির ওপরে। একটা কথা না বলে স্তব্ধ থাকি। হাঁড়ির খবর চালাচালি চলছে? এত অবুঝ? কোথায় বিপদ ওত পেতে আছে নির্বান্ধব শহরে, জানি না। কম্পানির কোয়ার্টাস পেলে চলে যেতাম। আমার উষ্মা বোঝে আঁখি। ক-দিন নীরব থাকে, ওসব গল্প করে না। উপযাচক হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করি,

-তোমার মাসিমার খবর কী?

-ওদের সঙ্গে আর মিশছি না।

যথেষ্ট অবাক হই। কথা না বলে মেয়েটা থাকতে পারে না। আমার চেয়ে বছর ছয়ের ছোটো। ম্যাচিওরিটিও বেশ কম। জানতে চাই, কী ব্যাপার? গোঁজ হয়ে বলে,

-ফালতু ফ্যামিলি! এত চালবাজ না, ভাবতে পারবে না। খালি বড়ো-বড়ো কথা। সারাক্ষণ নিজেদের জাহির করে। একদিন বুড়ি বলে কিনা, তোমরা মাসিমাকে কী ভাবো? সে তোমাদের মতো ব্যাকডেটেড নয়!

-বুড়ি!? হা হা হা!

-হেসো না। এদিকে বাড়ির ভেতরটা যদি দ্যাখো—ওয়াক্‌! নোংরা আর অগোছ—যার যখন খুশি যাচ্ছে-আসছে। রান্নাবান্নাও ওইরকম। ঘরে খায়, না বাইরে খায় ঠিক নেই। মাসিমাও নাকি চাকরি করছে। কী চাকরি কে জানে?

বুঝলাম অপমানিত হয়েছে, একপক্ষে ভালো। পরিবারটি আমাদের চেনা পরিমণ্ডলের চেয়ে আলাদা সে-দিন আঁচ করছিলাম। ওকে ক্ষ্যাপানোর উদ্দেশ্যে গম্ভীর হয়ে বলি,

-তুমি এখন বেশ ভালো রাঁধছ। মাঝে-মাঝে দিয়ে এলে পারো।

আঁখির বমি হচ্ছে প্রায়ই। ডাক্তার দেখিয়েছি, উনি প্রথম থেকে সাবধানে থাকতে বলেছেন। কিছুদিন পেরোলে কলকাতায় রেখে আসব। আমাদের ভাড়ার মেয়াদ ফুরিয়ে এল। বাড়িওয়ালার হাবভাব দীপেশদার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বোঁচাকে ছাড়িয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা। সে নাকি পালিয়ে যাবে বলে টাকা চুরি করে কোন দোকানদারের কাছে জমা রাখছিল। মন্টু বলে নতুন ছেলে আরো ছোটো। উঁচু স্লোপ দিয়ে বাইক তুলতে কষ্ট হয় বলে শ্যামলালবাবু শুরুতে সমাধান দিয়েছিল, বোঁচা ঠেলে দেবে। মন্টুকে অর্ধেকদিন পাঠায় না। পাঠালেও আমার সুবিধে হয় না। ঠেলে তুলতে যথেষ্ট জোর লাগে, বুকে ব্যথা করে।

ইতিমধ্যে দিল্লীতে একটা কম্পানিতে ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছি। আশা করছি, পেয়ে যাব। আঁখিকে তিনদিন ইভলিন-লজে এক সিনীয়ার দাদার বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম। বারণ করেছি বলে আজকাল বাড়ির বাইরে কম বেরোয়। অনেক সময়ে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রতিমা বৌদির সঙ্গে গল্প করতে দেখি। প্রতিমা বৌদির ব্যবহারে অবশ্য হেরফের লক্ষ করিনি। রান্নার জন্যে একজন বয়স্কা মহিলা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে জোগাড় করে দিয়েছে। রাতে খেতে বসে আঁখি বলে,

-তোমাকে বললে তুমি রেগে যাবে, তাই বলি না।

-রেগে যাবো কিসে?

-জানো রান্নার মাসী বলছিল পাশের মাসিমার স্বভাবচরিত্র ভালো না।

-উফ্‌ ছাড়ো তো। ওদের কুৎসা করার বাতিক থাকে।     

-না-গো, প্রতিমাবৌদি সেদিন বলছিল যত তাড়াতাড়ি পারে ওদের তুলে দেবে। অন্য পার্টির সঙ্গে কথা চলছে।

-হঠাৎ?

-প্রতিমাবৌদি নিজে একদিন মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল। মাসিমার নাকি গালে, গলায়, বুকের কাছে আঁচড়ের দাগ, ঠোঁটের পাশটা ফোলামতো, আমাকে বলছিল। আমিও বলে দিলাম নীলাক্ষীর ব্যাপারটা, ঠিক জানত না।    

দুম করে মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে গেল আমার। থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জমানো বরফস্বরে কেটে-কেটে বললাম,

-সমস্ত ব্যাপারে তোমাকে কথা বলতে হবে? কার কেমন জীবন তুমি জানো?

আমার আচরণে থতোমতো খেয়ে গেল বেচারি। খেয়ে উঠে প্রচণ্ড তোড়ে বমি করে ফেলল। ভাতের শেষ দানাটাও বেরিয়ে গেল। চোখে জল এসে পড়েছে ওর। হাঁফাচ্ছিল, ঘরে নিয়ে জল খাইয়ে শুইয়ে দিলাম। ম্লান মুখ, নিভে-আসা চোখ দেখে আমার অনুতাপ হচ্ছিল—পাগলী একটা। ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ভাবলাম, এই অবস্থায় এসব জটিল পরিবেশ থেকে ওকে সরিয়ে নেওয়া দরকার। এসপ্তাহের শেষে ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেব। আমার চোখ বুজে এলো, কানে আসছে দেওয়ালের ওপাশের অস্ফুট আশ্লেষের ধ্বন্যাত্মক শব্দ। এই ঘরে কারা শোয়? আঁখি ঘুমোয় নি, আমার বুকে সেঁটে গিয়ে ফিসফিস করে কীসব বলছে। আমার শোনার ইচ্ছে নেই। ঘুমের মসৃণ মেঘে সাঁতার কাটছি।

দিনসাতেক পরে বাড়িওয়ালা রাতের দিকে ওপরতলায় ডেকে পাঠাল, দরকার আছে। মোটাসোটা মানুষ, কুচকুচে গায়ের রঙ, চকচকে কলপ-কেশ। বুকখোলা ফতুয়ার ভেতর দিয়ে গলার কণ্ঠি আর সোনার মোটা হার। দু-হাত মিলিয়ে আট-দশটা পাথর-বসানো আংটি। ঘরটা বেশ বড়ো, খোলামেলা, পরিষ্কার। আলোবাতাস ঢোকে। আগে দু-চারবার যে আসিনি, তা নয়। প্রতিমাবৌদি ঘোমটা মাথায় চা-বিস্কিট দিয়ে গেল। শ্যামলালবাবুর আওয়াজ ভাঙা, খরখরে। বসে আছি দেখে বলল,

-চা-টা খান। আজে-বাজে দোকানের নয়, ভালো জায়গা থেকে আনাই।

-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলুন কী ব্যাপার?   

-আপনার স্ত্রী?

-শরীর ভালো নেই। ওর বাবা এসে নিয়ে গেছেন পরশু।

-ক-দিন পরে গেলে ভালো হত। জিজ্ঞেস করার ছিল।

আমি নিজের দূরদর্শিতায় নিজেকে ধন্যবাদ দিই, ভাগ্যিস—। শ্যামলালবাবুর প্রশ্নে ঘোর কাটে,

-শুনুন, ওনাকে নিয়ে আসুন গ্যে দু-দিনের জন্যে। খুব দরকার।

-অসম্ভব! মাথা খারাপ নাকি? ডাক্তার টানা বেড-রেস্ট বলেছেন। প্রথমবারটা, শুনেছেন হয়ত—।

দায়িত্বপূর্ণ স্বামীর মতো বলি। শ্যামলালের কৃষ্ণবদন থমথম করে। গলার কাছটা ওঠে নামে, কথা গিলে নিচ্ছে মনে হয়। মিনিটখানেক পরে কর্কশভাবে বলে,

-শান্তনুবাবু, আমি সাফ কথার মানুষ। কন্ট্রাক্ট-এ এবারে ভাড়া বাড়ানোর কথা। আপনি কতটা পারবেন?

-কম্পানি লীজ যতটুকু বাড়ছে, ওইটুকু পারব।

-দিনকাল যা পড়ল, এই এরিয়ায় অত্তো কমে ওবাড়ি আর ভাড়া দেওয়া যাচ্ছে না। আমি ডবল পাচ্ছি।

-একেবারে ডবল?

ব্যঙ্গটা মনে হল সোজাসুজি বিঁধল। দম নিয়ে বলে,

-বাজার যাচিয়ে এসে বলবেন মোশাই। নেহাৎ আপনারা সজ্জন, আর আমার পরিবারের সঙ্গে আপনাদের স্নেহের সম্পর্ক—তিনিও বলছিল, তাই।

-আমার জন্যে সেটা অনেক বেশী দাদা। চিন্তা করবেন না—উঠে যাবো। মাসখানেক আছে তো।

-অ। অন্য কোথাও শস্তা পাচ্চেন? আমাকে বললে, দেখে দেব’খনে।

-থ্যাঙ্ক ইউ।

উঠতে যাচ্ছিলাম, সজোরে গলা ঝাড়লেন শ্যামলাল,

-আচ্ছা, আপনার পাশের মহিলার বিষয়ে কী জানেন? আপনার পরিবার যেতেন-টেতেন দেখেছি।

কান-মাথা ভোঁভোঁ করে উঠল। আঁখির ওপরে আরো একবার ক্ষেপে গেলাম। তুমুল রাগটা এখানেই ঝেড়ে দিলাম,

-কী! না কিচ্ছু জানি না। শ্যামলালবাবু আমরা আপনার ভাড়াটে, ওরাও তাই। দু-চারদিন আমার বউ ওদের বাড়ি গেছে, ব্যাস। কারো স্পাইগিরি করা আমাদের কাজ নয়! আসছি।

(এক)

গ্রুপ ডিনার ছিল, শুতে অনেক রাত হয়েছিল। ভোরে ঘুম ভেঙে জানালায় দাঁড়িয়ে আছি। সযত্নলালিত নতুন রূপে সাজানো গেস্ট হাউস ঝকঝক করছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে ব্রিফকেস নিয়ে নীচে নামি। পোর্টিকোতে গাড়ি অপেক্ষায়। অরূপ অম্লান হাসিমুখে বলে,

-গুড মর্নিং স্যার। আসুন, ব্রেকফাস্ট করেছেন?

গাড়িতে উঠে বসি। ফিরে যাচ্ছি কলকাতা। কাল একটা পারিবারিক কাজ সেরে পরশু দিল্লী। চারপাক ঘুরলে বাঁ-দিকে গলির মুখটা। বলব অরূপকে? শুধু মোড় ঘুরলেই—! থাক, পা দিয়ে পোকা মারার মতো টিপে মারার চেষ্টা করলাম ইচ্ছেকে। মরল না, গলির মুখটায় বিরাট ছায়াবয়ব ধরে হাত নাড়তেই লাগল যতদূর দেখা যায়।   

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত