Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,puja 2021 bangla golpo subhodip hazra

উৎসব সংখ্যা গল্প: এক রিক্সাওয়ালা ও রবীন্দ্রনাথ । শুভদীপ হাজরা

Reading Time: 4 minutes

  ।। ১ ।।

এই এলাকায় যে ক’জন রিকশাওয়ালা আছে তাদের মধ্যে বিকাশ একজন। মাঝারি হাইট, শ্যমবর্ন রঙ আর খুব শান্ত প্রকৃতির। বর্তমানে টোটোর যুগেও কেউ কেউ বিকাশের রিক্সায় চাপে। তার প্রধান কারণ বিকাশের মিষ্ট স্বভাব। আজ রিকশা নিয়ে একাই বসে আছে সে। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো আজ তো পঁচিশে বৈশাখ ! প্রতি বছর ধুমধাম করে না হলেও ছোট করেও বাড়িতে গুরুদেবের জন্মদিন পালন করে। তার পরিবার বলতে তার স্ত্রী আর দশ বছরের মেয়ে। বিকাশ বেশি ক্লাস অবধি পড়তে পারেনি। তবু যতদিন স্কুলে সে পড়েছে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে বড় দাদা-দিদিদের নাচ গান দেখেছে। খুব সুন্দর অনুষ্ঠান হত। তারপর অনুষ্ঠানের শেষে সব ছেলেমেয়েদের একটা করে বাপুজি কেক দেওয়া হত। সেটাই ছিল খুব আনন্দের। সেই থেকেই বিকাশের মনে আজও রবীন্দ্রনাথ বিরাজমান। তার খুব ইচ্ছা ছিল বড় স্কুলে পড়ার। কিন্তু বাবার আর্থিক সমস্যার জন্য তা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়াও বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। তাই স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যায়। বিকাশ আঙুলে ধরা আধ খাওয়া বিড়িটা মাটিতে ফেলে রিকশাটা নিয়ে বাজারের দিকে এগোলো।
                  
                        ।। ২ ।।     

বাজারের ভিতর একটা মালার দোকানের সামনে রিকশাটা দাঁড় করালো। প্রচন্ড ভিড় দোকানটায়। বিকাশ ভুলে গেছিল রবীন্দ্রনাথ তো শুধু তার একার নয় সবারই। তাই সবাই আজকে জন্মদিন পালন করবে। ভিড়টা হালকা হতেই বিকাশ এগিয়ে গেল দোকানের দিকে। দোকানদার বিকাশকে জিজ্ঞেস করল- ”কি নেবেন দাদা?”
বিকাশ বলল- ”একটা ভালো দেখে রজনীগন্ধার মালা দিন।”
দোকানদার একটা রজনীগন্ধার মালা প্যাকেটে ভরে এগিয়ে দিয়ে বলল- ”এই নিন মালা। তিরিশ টাকা দিন।”
বিকাশ হাতে কুড়ি টাকার নোটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল-“কুড়ি টাকায় হবে না? একটু দেখুন না।”
দোকানদার একবার ভালো করে বিকাশকে দেখল। একটু মায়া হলো তাকে দেখে। সে বিকাশকে বলল- “ঠিক আছে আপনি তাই দিন।”
বিকাশ টাকাটা দিতে গিয়ে খেয়াল করল একটি টুকটুকে লাল গোলাপ। সে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল – ” দাদা ওই একটা গোলাপ দিন না আমার মেয়ে খুব ভালোবাসে।”
দোকানদার বলল- “এই নিন। এটার জন্য আপনাকে টাকা দিতে হবে না।”
বিকাশ গোলাপ হাতে নিয়ে বলল- “দাদা ওই একটা চকচকে কাগজ লাগিয়ে দিন না গোলাপটাই। বেশ সুন্দর দেখায়।”
দোকানদার গোলাপের ডগায় সিলভার রঙের কাগজ লাগিয়ে দিলো। বিকাশ গোলাপটা পকেটে ভরে আর মালাটা রিকশার হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। মনটা আজ বেশ খুশি খুশি লাগছে তার।

                           ।। ৩ ।।

রেলস্টেশনের ধারে এই ছোট্ট বাড়িতে তিনজনের সংসার। বিকাশ, তার স্ত্রী আর তার মেয়ে। বিকাশ খুব কষ্ট করেই সংসারটা চালায়। তাদের পরিবারে কখনো কোনো দুঃখ – কষ্ট নেই। সারা বছর তারা আনন্দে থাকে। বিকাশ তার রিকশাটা নিয়ে ঢুকল। বিকাশের মেয়ে তাকে দেখতে পেয়ে বাড়ির বাইরে এসে বিকাশের সামনে দাঁড়াল। বিকাশ তার পকেট থেকে গোলাপটা বের করে বলল- “এই দেখ তোর জন্য কি এনেছি। তোর গোলাপ খুব পছন্দের আমি জানি। “বিকাশের মেয়ের চোখটা ছলছল করে উঠল। সে বাবার হাতটা টানতে টানতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল- “দেখবে এসো বাবা, আমি আর মা কেমন সাজিয়েছি বাড়িটা।”
বিকাশ বাড়ির দরজায় ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। একটা টুলের উপর রবীন্দ্রনাথের ছবি। রবীন্দ্রনাথের কপালে চন্দনের টিপ। আর টুলের নীচে সুন্দর করে আল্পনা দেওয়া। তার মেয়ে বলে উঠল- “বাবা আল্পনাটা কেমন হয়েছে ? আমি দিয়েছি।” বিকাশ তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল- “খুব সুন্দর হয়েছে মা।”

রবীন্দ্রনাথের এই ছবিটার একটা ইতিহাস আছে। কয়েক বছর আগে বিকাশ রিকশা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একটা ডাস্টবিনে এই ছবিটা কুড়িয়ে পাই। সেই মুহূর্তে রিকশা থেকে নেমে ছবিটা থেকে ধূলো বালি মুছে একটা ছবি বাঁধাইয়ের দোকানে দিয়ে আসে এবং নিজের সামর্থের কথা জানিয়ে সেই অনুযায়ী টাকা দিয়ে নিয়ে আসে। তখন থেকেই প্রতি বছর এই ছবিটা দিয়েই জন্মদিন পালন করে।  বিকাশ প্যাকেট থেকে মালাটা বের করে নিজের হাতে পড়িয়ে দিলো। বিকাশের মেয়ে তার বাবাকে বলল- “বাবা একটা গান করো না।” মেয়ের এই আবদারে একটু থতমত খেয়ে গেল বিকাশ। স্কুলে নাচ-গান দেখার পর তারও ইচ্ছা হয়েছিল গান শেখার। কিন্তু যে পরিবারে দুমুঠো ভাত জোগাড় হয় না ঠিক মত সেখানে গান শেখা অসম্ভব ব্যাপার। তাই সেটা আর হয়নি। তবুও বিকাশ শুধু একটা গানই জানে’ আমারও পরানও যাহা চাই।’ সেটাই গাইল। মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল- “বাহ কি সুন্দর গাইলে তুমি।” বিকাশ মেয়ের থুতনিটা ধরে বলল- “তোর মত অত সুন্দর নয়। ” বিকাশের স্ত্রী তাকে এবং মেয়েকে বাটিতে করে পায়েস দিলো। বিকাশ মন ভরে খেলো। কারণ এই একটা দিনই সে মন ভরে পায়েস খেতে পাই। এইভাবেই কাটল তাদের সকালটা।
 
                           ।। ৪ ।।

বিকাশের মেয়ে যে স্কুলে পরে সেই স্কুলে  সন্ধ্যেবেলায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হচ্ছে। বিকাশের মেয়েকে বলেছে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার জন্য। একটা হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে। বিকাশও গেছে তার স্ত্রী ও মেয়ের সাথে। বিকাশের মেয়ের গান একবারে শেষে। প্রথমে উদ্বোধনী সঙ্গীত, তারপর শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইদের বক্তৃতা, এরপর কয়েকজনের কবিতা , তারপর গান। অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রত্যেক ছেলেমেয়ে খুব সুন্দর রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করলো। হাততালিতে ভরে গেল। এবার স্টেজে উঠলো বিকাশের মেয়ে। বিকাশের স্ত্রী তার কানের কাছে মুখ এনে বলল –  ” কি সুন্দর লাগছে বলো ? ” সত্যিই তাই। কেউ ধরতে পারবে না যে ও বিকাশের মেয়ে। কিন্তু বিকাশের কানে এখন কোনো শব্দই ঢুকছে না। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে একটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন যেটা পূরণ হয়নি। কিন্তু আজ হয়েছে। কারণ বিকাশ অর্থের অভাবে যে স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি, তার মেয়ে আজ সেই স্কুলেরই ছাত্রী। শুধু ছাত্রীই নয় ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট এবং গানের গলাও খুব সুন্দর। অজান্তেই বিকাশের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। বিকাশ অনুভব করল হাতের উপর একটি কোমল হাত। তার স্ত্রীর। দুজন দুজনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। স্টেজে তখন তাদের মেয়ে গাইছে –
  ” আমি তোমারও বিরহে রহিব বিলীন
     তোমাতে করিব বাস।
    দীর্ঘ দিবস , দীর্ঘ রজনী
     দীর্ঘ বরষমাস।। “

আকাশে তখন পূর্ণচাঁদ উঠেছে। বিকাশ আর তার স্ত্রী তাদের মেয়ের গান শুনছে। আর একজন তাদের এই সুন্দর দৃশ্য দেখে মিটিমিটি হাসছেন। তিনি হলেন স্টেজে রাখা রবীন্দ্রনাথের ছবিটা। গুরুদেবের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসার ফলে বিকাশ আজ পূরণ করতে পেরেছে তার অনেকদিনের স্বপ্ন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>