ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: চেনা অচেনা । সুমনা সাহা
হিমাদ্রির গভীর চিন্তায় ছেদ পড়ে। কাচের সুইং ডোর ঠেলে ঘরে ঢোকে অবনী কাকা। অবনী তালুকদার, বাবার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ম্যানেজার। হিমাদ্রির সপ্রশ্ন নীরব চাহনীর উত্তরে চাপা গলায় জানায়, ‘এসেছে!’ হিমাদ্রি চঞ্চল হয়ে ওঠে, ‘কোথায়? বসিয়েছেন?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। পাঠিয়ে দেব আপনার ঘরে?” দ্রুত মাথা নাড়ে হিমাদ্রি, “না না, আমার কাছে পাঠানোর দরকার নেই। ওর নামে যে চেকটা রাখা আছে, সেটা দিয়ে দিন।” অবনী চলে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই আবার ডাকে হিমাদ্রি, “কাকা শুনুন, মেয়েটাকে চা–কফি–শরবত অফার করা হয় যেন, দেখবেন, ওর যেন কোন অসম্মান না হয়!” অবনীর ভাবলেশহীন শান্ত মুখে আরও খানিকটা শান্তি নেমে আসে। “আজ্ঞে, বলা হয়েছে, উনি কিছুই খেতে চান না!”
অবনী চলে গেলে হিমাদ্রি সব কটা মনিটর স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে মেয়েটাকে আবিষ্কার করে। খুব সাধারণ একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে এসেছে। চেহারা বেশ আকর্ষণীয়, তবে চোখের নীচে কালি আর শুকনো মুখ তার ভিতরের দুশ্চিন্তা ও কষ্টের আভাস দিচ্ছে। বহু কষ্টে এর হদিশ পাওয়া গেছে। কিছুতেই আসতে রাজি হয়নি। অনেক অনুরোধে তাকে এই টাকাটা নিতে আসতে সম্মত করানো গেছে। তার জন্য ফাঁদতে হয়েছে অনেক আষাঢ়ে গল্প। সব ব্যবস্থাপনার কৃতিত্ব অবনী কাকারই, কিন্তু মেয়েটাকে দেখার প্রবল ইচ্ছে ছিল হিমাদ্রির। কেবল টাকা দিয়ে সাহায্য করবার ইচ্ছে থাকলে তো সে অনায়াসেই করতে পারত। মানিঅর্ডার করে চেক পাঠিয়ে দিতে পারত, কিম্বা অফিসের কাউকে দিয়ে ওর বাড়িতেই টাকা পাঠিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তাহলে আড়াল থেকে ওকে চিনে নেওয়া যেত না। তার এই কৌতুহলের সংবাদ অফিসের কারো কাছে প্রকাশ করে ফেলতেও সে চায় না, এমনকি অবনী কাকাও নয়, যদিও হিমাদ্রির ধারণা, অবনী কাকা হয়তো এমন অনেক কিছুই জানে, যেটা তার অজানা।
ব্যাঙ্গালোর থেকে বিসিএ ও এমসিএ করার পর বাবাই তাকে এমবিএ করতে আমেরিকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন, ভবিষ্যতে যাতে তার হাতে অফিস আরও বড় হয়, সে–কথা ভেবেই। যদিও বাবার সম্পত্তিতে পুত্রকন্যার সমান অধিকার, বাবা চেয়েছিলেন বড় মেয়েও তার অফিসের হাল ধরুক, কিন্তু দিদি মৃদুলার এদিকে একেবারেই মন গেল না। জামাইবাবুও খুব সাদাসিধা মানুষ। কলেজেই দুজনের ভালবাসা। একসঙ্গে এম এ করেছে, তারপর পিএইচডি–ও একই গাইড–এর কাছে। তারপর বাড়ির মত নিয়েই বিয়ে ও বর্তমানে দুজনেই কলেজে অধ্যাপনারত। ফলে হিমাদ্রির উপরেই বাবার অফিসের দায় বর্তেছে এবং সে–ও সানন্দেই তা গ্রহণ করেছে। দিদির উল্টোপথের মানুষ সে। প্রেম ভালবাসা থেকে শত হস্ত দূরে। চা–সিগারেট বা অন্য কোনও নেশা তার নেই। তবে গান শুনতে ভালবাসে। বরাবর বাবা–মা যা চেয়েছেন, তার অমত সে কখনও করেনি। ছাব্বিশ বছরের যুবক হিমাদ্রির মানসিক ম্যাচিওরিটি সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। বাবা তার উপর অনেকখানি নির্ভর করতেন। মা–ও সব ব্যাপারে দিদির বদলে হিমাদ্রির পরামর্শই নেন। আমেরিকায় একটি দিনও সে বাজে নষ্ট করেনি। বাবার পরিশ্রমের টাকায় বিদেশে পড়তে এসে ফুর্তি করবে, এমন ছেলে সে নয়। তাই মন দিয়ে পড়াশুনাটাই করেছে। সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী বছর তার কোর্স সম্পূর্ণ করে দেশে ফেরবার কথা। কিন্তু সব কিছু পরিকল্পনামাফিক চলে না। তাই একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মা–র ফোন আসে, “হিমু রে! শীগগির চলে আয়, তোর বাবা তো আইসিইউ–তে, আর বাঁচবেন না হয়তো, না এলে শেষ সময়ে দেখতে পাবি না!” কোনরকমে কথাকটি বলে মা একটানা কেঁদে চলে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল হিমাদ্রি, তারপর ধীরে ধীরে শান্ত করে মা–কে, “কেঁদো না মা! সবাইকে তো একদিন যেতে হবেই। আমি আসছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তুমি শান্ত হও। আমি এসে সব সামলে নেব!” হিমাদ্রির শান্ত কণ্ঠস্বরে ছবির সদ্য বৈধব্যের শোক কিঞ্চিৎ প্রশমিত হয়।
দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে ফ্লাইট টিকিট বুক করে হিমাদ্রি আমেরিকা থেকে যখন এসে পৌঁছায়, নীলাদ্রিবাবুকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। কোনও পজিটিভ রেসপন্স নেই। বছর দশেক আগে থেকেই হার্টের প্রব্লেম শুরু হয়েছিল। ডাক্তারবাবুরা হিমাদ্রির অপেক্ষাতেই ছিলেন। সে যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। মায়ের সান্ত্বনার জন্য হিমাদ্রি ভেন্টিলেশনে আরও কিছুদিন বাবার শরীরটা রেখে দেয়। তিন–চারদিন ধরে রোজ দু’বেলা মা গিয়ে নাকে নল ঢোকানো বাবার নিঃসাড় দেহের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে আর মনে মনে প্রস্তুত হয়। পাঁচদিনের দিন নিজেই ছেলেকে ডেকে বলে, “তোর বাবাকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ কি? ওনাকে যেতে দে শান্তিতে। ওসব নল–ফল খুলে ফেলতে বল ডাক্তারবাবুকে!” দাহ হয়ে যাওয়ার পর শ্রাদ্ধশান্তির পর্ব। ঠাকুরমশাই এসে ফর্দ দিয়ে গেলেন। কার্ড ছাপাতে দেওয়া হল। দিদি–জামাইবাবু কলেজে ছুটি নিয়ে এসে রয়েছে। জামাইবাবুকে সঙ্গে নিয়ে হিমাদ্রি বাবার পুরনো বন্ধু ও আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করে এল। কাল সকালে বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। ভোরে উঠে গঙ্গার ঘাটে যেতে হবে। কিছু ফরমালিটি আছে। আজ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভাল হত। কিন্তু ক্লান্তিতে শরীর অবশ হলেও হিমাদ্রির মন সজাগ। ঘুমের লেশও নেই চোখে। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সে ভাবছিল কোথাও কিছু বাকি রয়ে গেল কি না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত চিন্তাটা তার মাথায় এল। বাবাকে হাসপাতালে কে নিয়ে এসেছিল? দীর্ঘকালের নিয়ম মত বাবা অফিস থেকে বের হন সন্ধ্যা ছটার সময়। তারপর যান দেশবন্ধু লাইব্রেরিতে। রাত নটা পর্যন্ত বই পড়েন। বাবার বহুদিনের পুরনো নেশা। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে জগুর দোকানের সুগন্ধি জর্দা পান খান। তারপর দশটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছান। এমনটাই জেনে এসেছে তাদের ছেলেবেলা থেকে। কিন্তু হাসপাতালের রেকর্ড বুকে রেজিস্টার করা আছে রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাবাকে এডমিট করানো হয়েছে, রেজিস্টারে সমর নন্দী নামে কারো সই আছে। রিলেশন উইথ পেশেন্ট–এ লেখা আছে পরিচিত। সে সময় টেনশনে মাথার ঠিক ছিল না। হিমাদ্রি ভেবেছিল পরে ওই ভদ্রলোকের খোঁজ নিয়ে ওনাকে ধন্যবাদ জানাবে। প্রয়োজন বুঝে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কিছু টাকাপয়সাও দেবে। কিন্তু এতসব কাজেকর্মে সেটা একেবারেই খেয়াল ছিল না। এমনকি স্মরণ থাকলে ওনাকে বাবার শ্রাদ্ধবাসরে নিমন্ত্রণ করলেও কর্তব্য করা হত। নানারকম চিন্তা করতে করতে খেয়াল হয় যে ডাক্তারবাবুর কাছে ভদ্রলোকের ফোন নম্বর চেয়েছিল। উনি বলেছিলেন, ঐ সময়ে অন–ডিউটি নার্স যিনি ছিলেন, তার কাছে ফোন নম্বর রয়েছে। সেই নার্স দিদিকে ডাকিয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল। উনি বলেছিলেন রিসেপশনে আছে, পরে দিয়ে দেবেন। পরে আর হিমাদ্রির খেয়াল ছিল না। হিমাদ্রি ক্লান্ত শরীরেই উঠে বসে। ফেলে রাখলে আবার ভুলে যাব। এখন যখন মনে পড়েছে, রিসেপশনে একবার ফোন করে দেখা যাক। যদিও রাত হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে ফোন করতে রাত–বিরেত বাধা নেই। কর্তব্যের তাড়নায় ডায়াল ঘোরায় হিমাদ্রি। ওপ্রান্তের তরুণী কণ্ঠস্বর যান্ত্রিক ভঙ্গিতে জানতে চায়, কিভাবে সে সাহায্য করতে পারে। পেশেন্টের নাম ও এডমিশন ডেট বলে অপেক্ষা করে হিমাদ্রি। যান্ত্রিক সুর ভাসে একটানা অনেকক্ষণ। অবশেষে ওপ্রান্ত দুঃখ প্রকাশ করে জানায়, পেশেন্ট মৃত। হিমাদ্রি বলে, “হ্যাঁ, আমি ওনার ছেলে। আমি জানতে চাই, বাবাকে ওইদিন কে হাসপাতালে এডমিট করেছিলেন। আমি আউট অব স্টেশন ছিলাম। তাই আমি ওই ব্যক্তিকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।” মেয়েটি তবুও বলতে চায় না। “আমাদের নিষেধ আছে” ইত্যাদি বলে এড়িয়ে যেতে চায়। অবশেষে অনেক অনুনয়–বিনয়ের পরে ‘সমর নন্দী’ নামক ব্যক্তির ফোন নম্বর পায় সে। কৌতুহলে ওই নম্বরে ফোন করতে ট্রু কলার দেখায় ‘পরী মিত্র’। আর তারপর থেকেই নম্বরটা ‘নট রিচেবল’ হয়ে যায়। হিমাদ্রির কৌতুহল আরও বেড়ে যায়। পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ রহস্যজনক। তাহলে কি বাবার মৃত্যুর মধ্যে অন্য কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে? বাবার অসুস্থতা কি স্বাভাবিক ছিল না? এই পরী মিত্র বা সমর নন্দীকে খুঁজে বের করতেই হবে।
বুধবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পরের রোববার নিকট আত্মীয় ও বাবার পুরনো বন্ধুদের ‘মৎস্যমুখ’-এর নিমন্ত্রণ। বাঙালী পরিবারে এটি আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। মৎস্যপ্রিয় বঙ্গসন্তান প্রিয়বিয়োগে ১৪ দিন হবিষ্যান্ন ও নিরামিষ আহার করে ঐ দিন আত্মীয়-পরিজন সহ আবার আগের মত মাছ ও আমিষ খেতে আরম্ভ করে, তাই ওই দিনটিকে নিয়মভঙ্গও বলা হয়। খাওয়াদাওয়ার পর সকলে একত্র হয়। পারিবারিক একটা ছোট স্মরণসভার আয়োজন করেছিল হিমাদ্রি। সকলেই বাবা সম্পর্কে নানা জানা-অজানা স্মৃতিচারণ করে। কেবল মা-ই কিছু বলতে চায় না। অনেকবার পীড়াপীড়িতে মা নীরবে চোখের জল মুছতে থাকে। বাড়ি আজ ফাঁকা হয়ে গেল। কলেজের ছুটির মেয়াদ শেষ, তাই দিদি-জামাইবাবুও ফিরে গেছে। রাত্রে হিমাদ্রি মায়ের ঘরে আসে। মা শোবার তোড়জোড় করছিলেন, ওকে দেখে বলেন, “কিছু বলবি?”
“মা, তোমার কাছে একটু থাকি,” হিমাদ্রি এসে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে, “আচ্ছা মা, বাবা সম্বন্ধে তোমার কোন অভিযোগ নেই? তুমি আজ কিছুই তো বললে না!”
মা শূন্য চোখে চেয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট স্বরে বলেন, “তুই তোর বাবার স্বভাব পেয়েছিস। সেই কর্তব্যবোধ, সবার কথা ভাবা…!”
“মা?”
“বল।”
“মা, আমার কাছে এখন কিছু লুকোবার চেষ্টা কোর না।”
“কেন রে একথা বলছিস?”
“না এমনি। তুমি সুখী ছিলে মা?”
“সুখ?” মা একটু চিন্তা করেন। তারপর বলেন, “দেখ, বিয়েটা একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। একটা মানুষের সঙ্গে থেকে কেবল শারীরিক বা মানসিক সুখ পেলাম, সেটুকুই সব নয়। সন্তানকে বড় করে তোলা, নানা ঝড়ঝাপটায় দুজনে দুজনের পাশে থাকা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলকে নিয়ে মানিয়ে চলা এমন কত সব ব্যাপার থাকে!”
“তবুও মা, বাবাকে স্বামী হিসেবে তুমি কত নম্বর দেবে? মানে, আমি বলতে চাইছি, শেষ পর্যন্ত বাবা কি তোমার প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত ছিলেন?”
“আমি তো ওনাকে কখনও অবিশ্বাস করার মত কিছুই করতে দেখিনি। তবে দৈহিক সম্বন্ধের কথা যদি জানতে চাস, তোকে এখন বলতে দ্বিধা নেই, তোর পাঁচ বছর বয়সের পর থেকে আমরা ভাইবোনের মত বা দুই পুরনো বন্ধুর মতই থেকেছি। আমার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল, আর উনিও নিজে থেকে কিছু চাইতেন না। সেদিক থেকে ধরলে, শেষ ২০/২২ বছর আমাদের মধ্যে দৈহিক সম্বন্ধ ছিল না। কিন্তু এতসব তুই আজ কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
“এমনি মা। তুমি আজ কিছু বললে না তো। তাই আমি তোমার মনের খবর বের করার চেষ্টা করছিলাম,” হিমাদ্রি মায়ের পায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। ছবিদেবী অন্যমনস্ক ভাবে বলেন, “কি জানিস হিমু, একসঙ্গে ঘর করেও কি একটা মানুষকে সম্পূর্ণ চেনা হয়? সেই একসিডেন্টটার কথা মনে পড়ে তোর?”
“হ্যাঁ মনে থাকবে না কেন? বিরাট একসিডেন্ট হয়েছিল। বাবা পায়ে চোট পেয়ে কতদিন হাসপাতালে ছিলেন। ভাল করে হাঁটতে পারতেন না অনেকদিন। আমি তখন বিসিএ পড়ছি। ওই নতুন ড্রাইভার হাসপাতালে মারা গিয়েছিল। বাবা খুব টেনশনে ছিলেন বেশ কিছুদিন, পরে উকিলকে টাকাপয়সা দিয়ে কিভাবে সব ম্যানেজ করেছিলেন, আমদের সব বলেননি।”
ছবি একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর খুব নিচু স্বরে, যেন স্বগতোক্তির মত বললেন, “তারপর থেকেই তোর বাবা আরেকরকম হয়ে গেলেন। খুব চুপচাপ থাকতেন, ঘরে কথাই বলতেন না তেমন। অফিসের পর লাইব্রেরি গিয়ে বই পড়া ধরলেন। সেই রাত করে ফিরতেন, একটু কিছু মুখে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়তেন। আসলে মানুষটার প্রাণে মায়াদয়া খুব বেশি তো! একটা মানুষের প্রাণ চলে গেল সেটা বোধহয় খুব প্রাণে বেজেছিল!”
সকালে অবনী কাকা ফোন করলেন, “তুমি কি আজ অফিসে আসবে?”
“না আজ যাব না। খুব টায়ার্ড। একটা দিন বিশ্রাম করব ভাবছি, তোমরা একটু চালিয়ে নাও না কাকা। আমি কাল যাব। কেন কিছু হয়েছে?”
অপর প্রান্তে নীরবতা। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে অবনী বলে, “খোঁজ পাওয়া গেছে!”
হিমাদ্রি বলে, “গ্রেট! কাল আসতে বলে দাও।”
শ্রাদ্ধের আগের রাত্রেই অবনী কাকাকে হাসপাতাল থেকে জোগাড় করা ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছিল। ওই ফোন নম্বরের অধিকারী যেই হোন না কেন, তিনি যেন বাবার অফিসে এসে একবার দেখা করেন, মৃত শ্রীমান নীলাদ্রি বসু–র অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে তিনি যেন সামান্য কিছু অর্থ উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন, পরলোকগত আত্মার শান্তির জন্যেও যেন তিনি এটুকু অন্তত করেন। যাইহোক, এই ‘অন্তিম ইচ্ছা’-র সম্মানার্থে হোক বা অর্থের প্রয়োজনেই হোক, আড়ালে থাকা মানুষ সামনে এলেন এবং হিমাদ্রির নির্দেশেই হিমাদ্রিকে আড়ালে রেখে অবনী কাকা পরী মিত্র–র হাতে মোটা অঙ্কের চেক তুলে দিলেন। সব নিয়ম পালনের পর প্রায় ২০ দিন পরে হিমাদ্রি অফিসে এসেছে। ওর নির্দেশ অনুসারে চেক দেওয়ার সময় মেয়েটিকে নিজের ঠিকানা লিখতে বলা হয়েছিল। হিমাদ্রি জানত যে ঠিকানা সঠিক দেবে না সে। সে ওই ঠিকানায় অফিসের লোক পাঠিয়ে যাচাই করে নিয়েছে, যথারীতি ঠিকানাটি ভুয়ো। মেয়েটা নিজেকে যতই আড়াল করবার চেষ্টা করছে, হিমাদ্রির কৌতুহল ততই বেড়ে চলেছে। ও এখন অপেক্ষায় আছে, মেয়েটা কবে চেকটা ভাঙাতে দেবে। মেইল নোটিফিকেশন এলেই ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অনুরোধ করে ঠিকানা বের করে ফেলবে।
আজ একমাস হয়ে গেল হিমাদ্রি রোজ অফিস থেকে বেরিয়ে পরীকে ফলো করে। ফড়িয়াপুকুরে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকে মেয়েটা। কতই বা বয়স হবে? মনে হয় দিদি মৃদুলার বয়সী কি একটু ছোটই হবে। ওর সঙ্গে আর কে বা কারা থাকে বা থাকে না, সেসমস্ত কিছুই জানা নেই। অফিসের পর ও নিজের নতুন হুন্ডাই গাড়ি অফিসে রেখে বাবার পুরনো এমবাসাডরটা চালিয়ে সোজা চলে আসে ফড়িয়াপুকুর। খানিকটা দূরে গলির বাইরে অপেক্ষা করে। গাড়ির মধ্যেই পোশাক পালটে একটা সাধারণ টিশার্ট পড়ে নেয়। সন্ধ্যা ছটা নাগাদ পরী ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে খানিকটা হেঁটে মোড়ের অটো স্ট্যান্ড থেকে অটোয় ওঠে। মানিকতলা মোড়ে নেমে আবার হাঁটা দেয়। ঢুকে যায় একটা গলির মধ্যে। হিমাদ্রি অন্ধকারে আড়ালে থেকে দূর থেকে লক্ষ্য করে দেখেছে, গলির ভিতরে একটা কোচিং সেন্টারে টিউশন পড়ায় মেয়েটা। তারপর নটা নাগাদ বেরিয়ে আসে। আবার অটো ধরে নিজের ফ্ল্যাটে ফেরে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। কোন কোন দিন ও মানিকতলা মোড়ে টুকটাক বাজার করে। এ ক’দিন ছায়ার মত অনুসরণ করতে করতে পরীর উপর একটা মায়া পড়ে গেছে হিমাদ্রির। মেয়েটার মধ্যে একটা মায়াময় সৌন্দর্য আছে। গোটা শরীরে লাবণ্য উপছে পড়ছে। অনেকবার ভেবেছে, সামনে গিয়ে আলাপ করবে। কিন্তু সঙ্কোচ হয়েছে। রোজই ভাবে, কোনও একটা সুযোগে যদি আলাপ করা যেত! হয়তো বাবার সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই। রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখে সাহায্যের মানসিকতাতেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। ঝুটঝামেলার ভয়ে পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছে। কিন্তু কোথায় দেশবন্ধু লাইব্রেরি আর কোথায় মানিকতলা কিম্বা ফড়িয়াপুকুর! বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে লাইব্রেরির কর্মচারীরা কেউ না কেউ এ্যাম্বুলেন্স ডাকবে, হাসপাতালে পৌঁছে দেবে—সেটাই স্বাভাবিক। এই মেয়েটাকে তো কখনোই লাইব্রেরি যেতে দেখি না। তাহলে সেদিন এই মেয়েটা সিনে এল কোত্থেকে? এইসব প্রশ্নগুলো ভাবায় হিমাদ্রিকে।
অবশেষে একদিন সুযোগ এসে গেল। অন্যান্য দিনের মতই পরী কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে অটো ধরল। যথারীতি হিমাদ্রি খানিকটা দূরত্ব রেখে পিছনে আসছিল গাড়ি নিয়ে। গলির মোড়ে নেমে পরী হাঁটা দিয়েছে। হিমাদ্রিও গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎই ব্যাপারটা ঘটল। ঝপ করে আলো নিভে গিয়ে চারদিক নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেল। একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার, তারপরেই ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে উঠল আর হিমাদ্রি দেখল পরী মাটিতে পড়ে কাঁতড়াচ্ছে। লেদার শ্যু গাড়িতে খুলে শস্তার চপ্পল পায়ে গলিয়ে নিয়ে হিমাদ্রি গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এল পরীর কাছে। “কি হল আপনার? আসুন, উঠে আসুন, আমার হাত ধরুন!” পরীর মুখ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছে, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ও পড়ে গেল। হিমাদ্রি এক পলকে পরীকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “সঙ্কোচ করবেন না, আপনার বাড়ি কোনটা বলুন, আমি দিয়ে আসছি।” অস্বস্তিতে আড়ষ্ট ভাবে পরী নিরুপায় হয়ে হিমাদ্রিকে দেখিয়ে দিল ওর ফ্ল্যাট। পরী যথেষ্ট হালকা হলেও ওকে কোলে করে তিনতলার উপর উঠে হিমাদ্রির দম আটকে আসছে, কোনরকমে হাফাতে হাফাতে বলল, “চাবিটা দিন।” পরী ওর কাঁধ থেকে ঝুলে থাকা ব্যাগ হাতড়ে চাবি বের করে দিল হিমাদ্রির হাতে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে হিমাদ্রি লাইটের সুইচ খুঁজে জ্বাললো। বহু পুরনো ছোট ফ্ল্যাট। আসবাবপত্রও বহুদিন মেরামত হয়নি। রংচটা একটা সোফার উপর পরীকে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে বলল, “কি হল বলুন তো?” এতক্ষণে পরীর কণ্ঠস্বর শোনার সৌভাগ্য হল হিমাদ্রির। নরম সুরেলা কণ্ঠে আস্তে আস্তে পরী বলল, “এ পাড়ায় আজকাল খুব ছিনতাই হচ্ছে। দেখলেন না? ওরা ইচ্ছে করে গলির আলো নিভিয়ে দিল? আমার গলার চেনটা…” বলতে বলতে পরী চোখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল। হিমাদ্রি দেখল, পরীর গলার একপাশে কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। ও বলল, “যা গেছে গেছে, কাল থানায় ডায়রি করবেন। কিন্তু এখন আপনার গলায় এন্টিসেপটিক লাগাতে হবে। উঠতে পারবেন না তো! কোথায় ফার্স্টএইড আছে বলুন, আমি এনে দিচ্ছি।” পরী কেমন একটা ভয় আর অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর আগের মতই সুরেলা কণ্ঠে বলে, “আপনি কে? চিনি না জানি না, এত করছেন!” হিমাদ্রি একটু জোর দিয়েই বলে, “ভয় নেই। আমি চোরছ্যাঁচড় নই। আপনি আমাকে চেনেন না, ঠিকই। আমি কিন্তু আপনাকে চিনি!” পরীর চোখে বিস্ময় দেখে হিমাদ্রি আবার বলে, “আমি তো মালিকের গাড়ি ভাড়া খাটাই, এই তো কাছেই পেট্রল পাম্পে আমার গাড়ি রাখতে আসি, আপনাকে প্রায়ই দেখি মানিকতলা মোড়ে অটো থেকে নামতে।” পরী বলে, “ও, তাই বলুন!” “এবার বলুন তো তুলো ডেটল এসব আছে?” পরী হাসে। ঘরের কম পাওয়ারের বাল্ব ম্লান হয়ে যায় সে হাসিতে। হিমাদ্রি চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। এই মেয়েটা এমন এক সৌন্দর্যের অধিকারিণী যা ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে গোলাপের পাপড়ির মত। হঠাৎ পরী যেন সতর্ক হয়ে ওঠে, “ডেটল ফেটল লাগবে না। আর নেইও ওসব। আমি একটু বিশ্রাম করব। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাত হয়েছে। আপনি বরং এখন আসুন। কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব?” হিমাদ্রি বোঝে। অস্বস্তি হয় তারও। তবুও জোর করেই বলে, “আপনার তো পা মচকেছে। উঠতে কষ্ট হবে। আমি এখনই চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে বলুন, যদি কিছু প্রয়োজন হয়, আমি কিনে দিয়ে যাচ্ছি। আপনার সত্যি এখন দুয়েক দিন ঘরে থাকাই ভাল।” পরী যেন একটু নরম হয়, বলে, “ঠিক আছে, আমার ফ্রিজে দুধ আছে, পাউরুটিও আছে বোধহয়। আজ আর কিছু লাগবে না। বরং কালকে দিনের বেলা একবার আসবেন, যদি এদিকে গাড়ি নিয়ে আসা হয়, তবেই অবশ্য।” হিমাদ্রি কথাটা লুফে নেয়, “হ্যাঁ, এদিকেই তো গাড়িটা থাকে। আমাকে গাড়ি নিতে আর জমা করতে আসতেই হয়। সে আমি আসব ‘খন। কিন্তু ঘরে আর কে আছেন?” পরী বলে, “আমার হাজব্যান্ড আছেন না? উনি এসে পড়বেন এখনই। আপনি এখন আসুন।” হিমাদ্রি বুঝতে পারে, এরপর আর জোর করা যায় না। ও দরজার কাছে গিয়ে বলে, “চিন্তা থেকে গেল। সাবধানে থাকবেন। আমার ফোন নম্বর দিয়ে যাচ্ছি, কোন দরকার পড়লে ডাকতে দ্বিধা করবেন না প্লিজ!” একটা কাগজে ফোন নম্বর লিখে ও পরীর হাতে দেয়। তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেয়। পরদিন অফিসের কাজের চাপে ও পরীর কাছে যেতে পারে না। সারাদিন সারারাত পরীর মুখটা মন থেকে সরাতেও পারে না। মনকে বোঝায়, “মেয়েটা তো বলল, ওর স্বামী আছে!” কিন্তু মন ওকথা মানে না। তার পরদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। পুরনো টিশার্ট আর কমদামী চপ্পল পড়ে পরীর দরজায় কড়া নাড়ে। ভর সন্ধ্যাবেলা, ঘরের ভিতরে আলো জ্বলছে না, হিমাদ্রির বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। মেয়েটা কেমন আছে কে জানে! তিন চার বার কড়া নাড়ার পর ঘরের ভিতর থেকে ক্ষীণ সাড়া পাওয়া যায়। একটা চাদর গায়ে দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পরী এসে দরজা খুলে দেয়। হিমাদ্রি ঢুকতেই অবসন্ন শরীরটা ওর গায়ে ঢলে পড়ে। হিমাদ্রি পরীকে ধরে ফেলে। জ্বরে ওর গা পুড়ে যাচ্ছে, গলার ক্ষত ফুলে উঠেছে, হালকা পুঁজও হয়েছে। হিমাদ্রির বুকটা মায়ায় টনটন করে। ওর কর্তব্যনিষ্ঠা বরাবরই প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রেও নিজের কর্তব্য স্থির করতে দেরি হয় না। পালকের মত হালকা পরীর শরীরটা কোলে তুলে নিয়ে আসে পাশের শোবার ঘরে। দুজনের বিছানা পাতা রয়েছে। বালিশ চাদর সব অগোছালো। হিমাদ্রি নিজেই হাত দিয়ে টেনেটুনে একটু পরিচ্ছন্ন করে নেয়। অগোছালো কোনকিছু ওর পছন্দ নয়। মেয়েটার স্বামী কি করে? চাকরিসূত্রে দূরে থাকেন বুঝি? কোনদিনই তো দেখা পাওয়া গেল না। এই অসুস্থ স্ত্রীকে রেখেও কি ওনাকে অফিসে যেতে হল? ড্রেসিং টেবল–এর উপর কতগুলো হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি রয়েছে। হিমাদ্রির হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নেই। ও শিশিগুলো নাড়াচাড়া করে দেখে, রাসটক্স, ব্রায়োনিয়া, নাক্স ভমিকা আর লেডাম মাদার। কিছু না ভেবেই ও একটু ট্যিসু পেপার লেডামে ভিজিয়ে পরীর গলার ক্ষতের উপর চেপে দেয়। আচ্ছন্ন পরী কেঁপে ওঠে, বোধহয় জ্বালা করছে। হিমাদ্রি চলে যায় রান্নাঘরে। ফ্রিজ খুলে দ্যাখে চার পিস পাউরুটি, দুটো ডিম আর একটু জ্বাল দেওয়া দুধ রয়েছে একটা ছোট সসপ্যানে। এটা কেমন সংসার রে বাবা? অবাক হয় হিমাদ্রি। ওর মনে হয় পরীর স্বামী মানুষটা হয়তো ঘরসংসারের ব্যাপারে উদাসীন। হয়তো বাজার টাজার পরীই করে। দুদিন বেরোতে পারেনি বলে ঘরের স্টক শেষ। যাই হোক, হিমাদ্রি আপাতত একটু দুধ গরম করে শোবার ঘরে আসে, যদি পরীকে গরম দুধ একটু খাওয়ানো যায়। দুটো দিন হয়তো কিছুই খায়নি বেচারী!
হিমাদ্রি দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকে দ্যাখে পরী চোখ মেলেছে। ওর বুকের ভিতর কেমন করে ওঠে। পরী ওর নাম কি না, সেও জানা নেই। আজ নিয়ে মাত্র দুদিনের চেনা। অথচ মনে হচ্ছে যেন ওর সঙ্গে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক! হিমাদ্রি এগিয়ে এসে বলে, “একটু দুধ গরম করেছি, এটুকু খেয়ে নিন।” পরী বিছানায় ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে দুধের কাপটা হাতে নিয়ে ফেকাশে হাসে। বলে “আপনি না থাকলে কি যে হত?” হিমাদ্রি বলবার চেষ্টা করে, “কেন আপনার স্বামী?” বলতে পারে না, কথাটা গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে যায়। পরীর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে খেয়াল করেনি হিমাদ্রি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মেয়েটা বলে, “উনি আর নেই। আপনাকে আমি মিথ্যে বলেছিলাম!” হিমাদ্রির চোখ যায় বিছানার উলটো দিকের দেওয়ালে। বিশাল একটা ফ্রেমে বাঁধানো বাবার ফটো। কাঁচাপাকা চুল তার সুদর্শন বাবা রোমান্টিক হাসি ভরা মুখে পরীর মাথা বুকে চেপে তাকিয়ে আছে। চশমার কালো ফ্রেমের ওপারে বাবার উজ্জ্বল গভীর দৃষ্টি সরাসরি হিমাদ্রির চোখে চোখ বিঁধিয়ে জিজ্ঞেস করছে, “কি দেখতে এলি হিমু?” হিমাদ্রি বুকের মধ্যে বিশ্রী একটা চাপ অনুভব করে। তাদের বংশে হার্টের রোগ। ফ্যাসফেসে গলায় ফটো দেখিয়ে বলে, “উনি কে? আপনার বাবা?” পরীর কান্না উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, “উনি আমার স্বামী। মানুষটা বাপের বয়সী ছিলেন বটে, কিন্তু কী যে ভালবাসতেন! আমায় বুকে আগলে রাখতেন। বিরাট বড় মানুষ উনি। ওনার গাড়ি একসিডেন্ট করে। গাড়ি আমার স্বামী চালাচ্ছিল। ড্রাইভিং শিখেছিল, লাইসেন্স পায়নি। উনিই দয়া করে কাজ দিয়েছিলেন, লাইসেন্সও করিয়ে দেবেন বলেছিলেন। নিয়তি কে খণ্ডাবে? ওনার কোন দোষ নেই। আমার স্বামীর আয়ু ছিল না। আমি রাক্ষুসী। আমাকে যে ভালবাসবে সেই মরবে। ওনার বৌ ছেলেমেয়ে আছে। তবু কোন কথা শুনলেন না। এই অভাগিনীকে বিয়ে করলেন। রোজ আসতেন এখানে। অফিসের পর। খাবার নিয়ে আসতেন। এই বিছানার উপর কোলে থালা নিয়ে বসে খেতেন। আর আমাকেও খাওয়াতেন। কী যে ভালবাসতেন। যতক্ষণ থাকতেন, আমায় আদরে ভালবাসায় ভরিয়ে দিতেন। আমার দুর্ভাগ্য। অমন মানুষটা আমার কপালে সইল না! উনি চলে যেতে ভাবছিলাম ডুবে মরি। কি করি? ওনার চিহ্ন আমার ভিতরে বাড়ছে! মরতে পারলাম না। টিউশনি নিয়েছি। ঐ সময়টা ভুলে থাকার জন্য। ওনার দেওয়া সোনার চেনটা ছিনতাই হয়ে গেল। আপনি কথা দিন ঘুণাক্ষরেও এসমস্ত কাউকে বলবেন না! আমার দেবতার গায়ে যেন কলঙ্ক না লাগে!
হিমাদ্রির চোখের সামনেটা ঝাপসা বোধ হয়। উঠে দাঁড়ায় সে, যন্ত্রমানবের মত বাইরে আসে। বিকেল থেকে আকাশ মেঘে থম থম করছিল। অসহ্য গুমোট গরম ছিল সারাদিন। এখন বৃষ্টি শুরু হল। বগল ছেঁড়া টিশার্ট আর শস্তা চপ্পল পড়ে বৃষ্টির মধ্যে পথে নেমে আসে হিমাদ্রি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। নেশা বই পড়া। এই নেশা, দুটি স্কুলে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও নানা স্থানে ভ্রমণের সূত্রেই সাহিত্যের নানা অঙ্গনে লেখালিখির চেষ্টা। বিভিন্ন মুদ্রিত পত্রিকা (উদ্বোধন, নিবোধত, সানন্দা, আনন্দবাজার পত্রিকা রবিবাসরীয়) ও ওয়েবজিন-এ (অপার বাংলা, ও কলকাতা, শব্দের মিছিল, জয়ঢাক, ইচ্ছামতী) প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ও ভ্রমণ-কাহিনী লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করতেও ভালবাসেন। প্রকাশিত আটটি অনুবাদ গ্রন্থ, দুটি গল্পের বই ও একটি প্রবন্ধের বই, আরও দুটি প্রকাশিতব্য।
Manasi Ganguli says:
খুব সুন্দর গল্প