ইরাবতী উৎসব সংখ্যার গল্প: আত্মজা । সুস্মিতা সাহা
কিরে মনা,কোথায় গেলি? এই হয়েছে আমার সকালে এক জ্বালা। মেয়ে কোথায় কোন চুলোয় বসে আছে কে জানে?” সরমা হাঁক দেন জোরে জোরে।
‘হুমম্ ,…’
”আচ্ছা আচ্ছা এটা কে রে? ও বাবা আবার
বস্তা দিয়ে মুখ ঢেকেছে। আরে তুই কাচা পর্দা টা নিয়েছিস কেন রে?”
নাহ্ ধরা পড়ে গেছে কুমকুম, আর লুকোনো যাবে না তো। মায়ের কড়া চোখ রেখে ভয়ে একটা কোণের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় সে।
‘হয়েছে আর অতো ভয় পেতে হবে না, নাও এবার মুখ হাত ধুয়ে এসো দিকি নি , দুটি খেয়ে উদ্ধার করো।’ মায়ের রাগের আড়ালে হাসির সামান্য ঝিলিক বুঝতে পেরে মা’র কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে দেয় কুমকুম।
‘ ওমা এই এতো বড়ো মেয়ে আটে পা দিলি, সে খেয়াল আছে তোর?এখনো মা’র আদর খাওয়া চাই?” কি সুন্দর গন্ধ মা’র হলুদের ছোপ লাগা আঁচলের, মনটা শান্ত হয়ে যায় নিমেষে।
শোবার ঘর থেকে মা ও মেয়ের রঙ্গ দেখে মিটিমিটি হাসি ফুটে ওঠে গম্ভীর প্রকৃতি বাবা’র মুখে। মা ভক্ত মেয়ে, বড়ো শান্ত, সবসময় যেন কল্পনার জগতে ভাসছে।
ইউটোপিয়ান ওয়ার্ল্ড – কিন্তু জীবন যে বড়ো কঠিন। তিনি সৌভাগ্যবশতঃ ভালো একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করে চলেছেন আজ প্রায় বারো বছর হল। লেট ম্যারেজ বলে মেয়ের বয়স মাত্র আট।মেয়ের মা’ও কম বয়সী।
তিনজনের ছোট সংসার -এসো জন বসো জন- অবশ্য ভালোই। তবে সরমা, তার স্ত্রী এমনিতে খুব মিশুকে স্বভাবের মানুষ। জোরে জোরে হাসতে ও গল্প করতে তার জুড়ি মেলা ভার। শুধু মাঝে মাঝে কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশের পানে। তখন আর থই পান না তিনি। আর জোর বকা খায় ছোট্ট মেয়েটা। এতো কষ্ট হয় – কিন্তু কার জন্য কষ্ট! মেয়ে তো একেবারে মা ঘেঁষা বরাবরের।
ক’দিন ধরেই চোখে একটু যেন ঝাপসা ঝাপসা দেখছেন সরমা। ওষুধ ও ডাক্তার সবই তো হাতের কাছেই – মেয়ে সব ব্যবস্থা করে রাখে মাসের প্রথমেই। সারা দিন রাতের কাজের মেয়ে আছে- ড্রাইভার ফোন করে ডাকলেই হাজির। সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে সাজানো গোছানো সংসার সরমা’র। ফুল ফোটে কতো সামনের এক টুকরো জমিতে। স্বামীর ছবিতে মালা পরাতে পরাতে মনটা চলে যায় অতীতের কোন দিনে। চিল চিৎকারে বাড়ি ফাটিয়ে তুলছেন সরমা আর মেয়েটা ঠকঠক করে ভয়ে কাঁপছে। কি দোষ করেছে সে?না, তিনবার চামচ ধোবার বদলে দুবার ধুয়ে দেখাচ্ছে যে কোন ময়লা নেই। ‘ আমি বলছি তো ময়লা আছে আছে আছে।আমি বলেছি যখন তিনবার তখন তিনবার।”
‘কিন্তু মা,এগুলো তো সব নিরামিষ চামচ,শুধু তো তোমার নিরামিষ রান্না ঘরের চামচ!’
”আবার মুখে মুখে কথা! দেবো গায়ে গরম জল ঢেলে।
যত্ত সব অজাত কুজাত, আমার রান্না ঘরের জাত ধর্ম কিচ্ছু আস্ত রাখবে না।”
তিনি গজরাতে গজরাতে কোমরে কাপড় বের দিয়ে সব ধোয়া বাসন আবার ধুতে থাকেন, জামাকাপড় ছাদের থেকে আনার সময়ে কি এক অদ্ভুত ডিঙ্গি পেড়ে নেমে আসেন সিঁড়ি বেয়ে, সব ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে- আর বাবা মানুষটি বসে বসে ভাবতে থাকেন যে কি ভুল হয়েছিল তার? কি দিতে পারেন নি যার জন্য তার এমন উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত স্ত্রী এমন বাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠলো!
‘কি সুন্দর গো মাসিমা তোমার নাইটিটা, একেবারে মাপসই করে কাটা যাতে হোঁচট খেয়ে পড়ে না যাও।রঙটিও বেশ।’ নাইটি ভাঁজ করতে করতে বলে গৌরী। গৌরী হল রাধানগরের মেয়ে- সরমা’র সবসময়ের কাজের মেয়ে। ‘সত্যি গো ভাগ্য করে মেয়ে পেয়েছো তুমি’।
চড়াক করে মাথাটা যায় গরম হয়ে – সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেয়ের এতো প্রশংসা করে কেন? কে বলেছে মিমি’কে তার জন্য ভাবতে। থাক না বাবা নিজের শ্বশুর বাড়িতে।
দিব্যি তো চাকরি করছিস বিশ্ববিদ্যালয়ে, টুকটুকে ছেলেটাকে সামলে সুমলে আছিস ভালোই। কবিতা গল্প লিখে বেশ নাম হয়েছে।
মা মা করে আদিখ্যেতা যত।
”অঙ্কে একাত্তর! তাই আবার হাসতে হাসতে আসছিস স্কুল থেকে! একশো পেতে পারলি না? আমার অঙ্কে কতো ভালো মাথা ছিল। সুদ্ধু তিন বছর বয়সে বাবা মারা গেলেন আর মাকে নিয়ে জেঠা জেঠির সংসারে পড়তে হোলো তাই কি না নিউট্রিশন নিয়ে পড়লাম। তাও তো চাকরি ঠিকই পেয়েছিলাম, কিন্তু না সংসার ধর্ম বড়ো ধর্ম , ব্যাস জুতে গেলাম সংসারের ঘানি টানতে। ” ছেলে’কে অঙ্ক কষাতে কষাতে এক নিমেষে কোন ছোটবেলার অঙ্কে একাত্তরের গল্পটি মনে পড়ে গেল মিমি ওরফে সুদক্ষিণা’র।
মা’র এই চেঁচামেচি তে শুধু ভয় পেয়ে যেত সুদক্ষিণা কিন্তু বুঝতে পারতো না মানুষটার ভিতরের টানাপোড়েনের কারণ গুলো। দশ বছর বয়স হতে হতেই মিমি বুঝে গেছিল যে মা’কে নিয়ে বেশ কয়েক জন পড়শী ও আত্মীয় হাসিঠাট্টা করে – বাতিকগ্রস্ত বলে। তাতে খুব কষ্ট হতো তার আর আরো আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরতো মা’কে। কিন্তু মা যেন তার এই কোমল অনুভূতির মূল্য দিতে চাইতো না। তবু – তবু আজো সে মা অন্ত প্রাণ।
সরমা’র স্বামী সুবিমল বাবুর আজ খুব মনে পড়ছে নিজের মায়ের নিত্য ভোগ রান্নার কথা – নিরামিষ আমিষ রান্না ঘরের ভাগাভাগির এক আয়োজন করতে করতে নববধূকে বেশ হ্যাপা সামলাতে হতো। বিবাহবার্ষিকী পালন করতে পারেন নি সেভাবে। তবে রাতে দুটি ছোট্ট বেল ফুলের মালা হাতে অপেক্ষা করেছিলেন সরমা’র জন্য। আর একটু মিষ্টি -এই তো সেকালের শিক্ষকের সাধ্যি। তবে সরমা খুব খুশি হয়েছিল স্কুলের চাকরিটা পেয়ে। কিন্তু তখন ঘরে এসেছে মিমি, এছাড়া তার রক্ষণশীল মানসিকতায় দুজনের দু প্রান্তে চাকরি ঠিক মনে হয় নি। তাই সব সুদ্ধু চলে গেলেন শহরতলির এক ছোট্ট বাড়িতে। ধীরে ধীরে বইপত্র ও ঈশ্বর আরাধনায় মন দিলেন তিনি – আর সরমা মাছ নিরামিষের দুটি রান্নাঘর ও নানান ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো। আবার এই সরমা’ই ছোট বাচ্চাদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটক করিয়েছে। মিমি’কে গানে নাচে পারদর্শী করে তোলা তো ওর আগ্রহেই।
”ও মাসিমা আসেন আসেন, অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল যে। ওমা ঐ তো আমাদের দিদি, কি সুন্দর লাগছে দিদি ‘কে নীল রঙের শাড়িতে। খুব মানিয়েছে।” শাড়ি! একটা ভালো শাড়ি কোন দিন কিনতে পেরেছে সরমা। ননদের সঙ্গে এক রকমের শাড়ি কিনতো সে, মেয়ের একটু বুদ্ধি হতেই টরটরিয়ে বাবা’কে বলতো-” ও বাবা, মা কে একটা সুন্দর সিল্ক কাপড় কিনে দাও না গো”। ”আরে না না , এই মাসে আর লাগবে না।”
সরমা মেয়েকে ধমকে দিতেন। তার ভাগ্নে বৌমা’র কতো সিল্কের শাড়ি ছিল – হ্যাঁ তেইশটা। এখনো মনে আছে। মাঝে মাঝে চোখটা করকর করে উঠতো এসব দেখে, বরাবর ছেলের শখ ছিল তার, ছোট জায়ের দুটি ছেলে, দাদার ছেলে, সবারই ছেলে অথচ তার হোলো কিনা একখানা নাক বোঁচা গাল ফুলো মেয়ে। এই মেয়েকে বিয়ে দিতে ওর বাবার কি নাকানিচোবানি। তাও তো সে বিয়েতে! এমনকি যে চাকরির জন্য সরমা এতোটা পরিশ্রম করতো – স্বামীর খেয়াল খুশি মতো সব ছেড়ে চলে আসতে হোলো এই মফস্বলে। আর সন্তান জন্ম নিয়ে তো!
”রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে এই বই লেখার ইচ্ছে বলুন পরিকল্পনা বলুন – সব আমার মায়ের জন্য। মায়ের হাত ধরেই তো আমার রবীন্দ্রনাথ ‘কে চেনা।” ঘরের নীল আলোটা জ্বেলে দিয়ে গৌরী বোধহয় রান্না ঘরের কাজ সারছে। সরমা’র মন ভরে আছে আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যে। কি সুন্দর করে কথাগুলো বলছিল তার মেয়েটা। কেমন মানিয়েছে শাড়িটাতে। মেয়ে তার বড্ড ভালো – বাবা’কে হারিয়ে মা’কে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে মেয়ে। হ্যাঁ মেয়ে আজ মা হয়েছে, ছোট্ট ছেলে নিয়ে খুব লড়াই করছে ঐটুকুনি মেয়েটা।
ভালো থাকুক ওরা- আর সরমা মাথা গরম করবে না।
‘বাঁজা বাঁজা’ – সকলের খোঁটা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল সরমা – সুবিমল বাবুর জোরাজুরিতেই একরকম মিমি’কে অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছিলেন তারা।
”ছেলে তো সবাই চায় সরমা, আমরা বরং এই ছোট্ট মেয়েটি’কে নিয়ে যাই বাড়িতে।”
কবে থেকে যে এমন জটিল মনের মানুষ হয়ে উঠেছিল সরমা কে জান! সবার উপর জমে থাকা রাগ উপচে পড়ে মিমি’র উপরে।
মিমি ওর পুরস্কারের সব টাকা তুলে দিলো আজ ঐ অনাথ আশ্রমের শিশুদের জন্য। সবাইকে নিয়ে গান ধরলো ” এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় …”। কবে জানলো মেয়েটা কে জানে!
আত্মজা যে আত্মার কাছেই থাকে বরাবর।
অধ্যাপিকা , বাংলা বিভাগ
বিদ্যাসাগর মেট্রোপলিটন কলেজ কলকাতা।
প্রধানত প্রবন্ধ লেখেন, গল্প ও কবিতাও মাঝে মাঝে।
প্রকাশিত বই: হেঁসেলের কথকতা