Categories
ইরাবতী উৎসব সংখ্যা: অভিজিৎ বিশ্বাস’র কবিতা
আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
সিম্ফনি
গানও তো ছবি আঁকে শূন্য ক্যানভাসে
একটু একটু করে সিঁধিয়ে যায় বুকের গহনে
সেখান থেকে মস্তিষ্কে ক্রমান্বয়ে
কখনো কোমল কখনো তীক্ষ্ণ তরঙ্গপ্রবাহে
দেশ-কাল-ভাষার বেড়া ভেঙে শোণিতস্রোতে
#
রামধনুর সপ্তবর্ণের মতো এক আশ্চর্য সম্মিলনে,
ষড়জে ঋষভে গান্ধারে ঐশ্বরিক অবগাহনে
মধ্যমে পঞ্চমে ধৈবতে নিষাদে, এক সপ্তাশ্ব রথে
সুরগুলি ওঠে ও নামে, দৃষ্টিসীমার বাইরে
মনকেমনের যাত্রাপথে বৃত্তসীমা ভেঙে
অপার্থিব এক বি-নির্মাণে
#
কখনো নিটোল এক বিন্দু অশ্রু মন্দ্র বিষাদে
কখনো দূরনদীর ছায়াপথে নির্জন এককের গানে
ভুবনজোড়া এই যে আসনখানি, কখনো শিরা ওঠা
ফাটা হাতে খিন্ন শরীরে, সারা বিশ্বের মেহনতি প্রাণে
স্বরগ্রামের সাত সুরে কাঁটাতারহীন প্রত্যয়ে,
চলো, সুরেতে মেলাই সুর, কণ্ঠ ছাড়ি জোরে
#
বিষণ্ণ স্বাধীনতা পার হয়ে মুক্তির গানে
ধূমায়িত আগ্নেয়গিরির অযুত বিস্ফোরণে
We shall overcome-এর রক্তিম শপথে
Let us sing…sing together
জলছবি
বৃষ্টি তো দূর অস্ত, আসলে কোনদিন আমরা
মেঘই হতে পারিনি
এখন আমাদের কান্না ফোঁটাগুলির মধ্যে দূরত্ব বিস্তর
অথচ দ্যাখো, তাদের পাশাপাশি বাঁধব বলে
জমিয়ে রেখেছিলাম কত কিছুই
ডায়েরির ভাঁজে রেখে দেওয়া শুকনো গোলাপ
হলুদ পাতায় লেখা ডাকবাক্সের চিঠি
ব্যাগ ভর্তি বেশ কিছু বজ্র বিদ্যুৎ, তালিকাটা কম নয় মোটেই
সময়ের সাথে সাথে সবই এখন উদ্বায়ী হয়ে গেছে
পড়ে আছে কিছু টুকরোটাকরা নুড়ি-পাথর
সে’সব ছাড়াও দিব্যি জীবন চলে যায়
মেঘে মেঘে বেলাও হল অনেক, তবু এখনো আষাঢ় এলেই
তেইশ বছরের সেই আপাদমস্তক ভেজা তরুণটির মতো
একটা পর্দা ঘেরা রিকশার জন্য বড্ড মন কেমন করে
নামহীন এক দ্বীপের কথা
তুমি তো আমার কেউ নও তবু দূরে গেলে বড়ো বাজে,
এইভাবেই শুরু শেষতম ভালোবাসা অক্ষর,
যে কথা হয়নি বলা রুনুঝুনু তারই শব্দ, বুকের ভিতর |
#
যেটুকু প্রাপ্য ছিল, আদর কিংবা সোহাগ,
ছিনিয়ে আনব বলে যতখানি সাহসী হই, দেখি
প্রতিরোধের তোয়াক্কা না করে এক উদ্ধত শানানো চুরি
ক্রমশ ঢুকে পড়ছে গভীর, যতই হোক না রক্তপাত
গোপন সিন্দুকে চকমকি পাথর, ঠোকরালে জ্বলে ওঠে আগুন |
#
সরল রৈখিক সম্পর্ক যে এসব নয়, সে’সব পাগলেও বোঝে |
তবু সাহসী হবার ছলে কিছু অন্যমনস্ক আঁকিবুকি, ক্যানভাসে
অনভ্যস্ত তুলির আঁচড়, তারই মধ্যে ফুটে ওঠে এক ছবি, রঙহীন,
সাদা ও কালোর মধ্যবর্তী অস্পষ্টতায় ঘেরা |
#
বিপদসীমার লাল ফিতেটা এগিয়ে আসতে থাকে ক্রমশ,
বুঝি, এবার তাহলে ফেরার সময় হলো | পড়ে থাকল
কিছু সযত্নলালিত হলুদ অক্ষর, জীবননদীর সঙ্গমে
নির্জন এক দ্বীপ, ভাঁটার টানে আবার হয়তো ভেসে উঠবে
কখনো, আজও সে দ্বীপের নাম দেয় নি কেউ।
অমোঘ
দু’হাতের তালুর মাঝে ঘুরে যাচ্ছে লাটাই,
প্রাণপণে জড়িয়ে নিচ্ছে সুতো তীব্র আকুলতায়
কেটে যাওয়া ঘুড়ি ভেসে চলেছে দিগন্তে,
দূর, দূর, অনেক দূর, ধরাছোঁয়ার বাইরে…
#
এখন স্পর্শ বারণ | নিঃসাড় দেহেও অণুজীবের
আনাগোনা, পুত্র হারিয়েছে মুখাগ্নির অধিকার,
সাজানো চিতায় ঝরে পড়ে দুফোঁটা অশ্রুজল
আগুনের তীব্র তাপে শব্দহীন সেই অশ্রুফোঁটা
#
বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে, কেটে যাওয়া
সেই ঘুড়িটির কাছে, ঘুমন্ত মায়ের মতো দ্বীপ হতে
দ্বীপান্তরে অনন্ত এক যাত্রাপথে, গহন রাতের
নীরব কথকতায় দীর্ধমেয়াদি সঙ্গ দেবে ব’লে…
পরিক্রমা
অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে লিখে রাখছি ক্লান্তি
ক্লান্তি লুকিয়ে এগিয়ে চলি শুনশান গলির পথ
পথের শেষে জেগে আছে প্রাসাদোপম বাড়ি
বাড়ির মাঝে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে অ-সুখ
অসুখের উৎস খুঁজি পেরিয়ে আসা স্মৃতিদের ভিড়
ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাই সঙ্গে জাগে ত্রয়োদশী চাঁদ
চাঁদের গায়ে আজও সেই কবেকার কলঙ্কের দাগ
দাগটুকু নিয়ে নির্ঘুম রাতে অপেক্ষায় থাকা অন্তহীন
অন্তহীন প্রহর শেষে খুঁজে ফিরি আরোগ্যের সাঁকো
সাঁকোটুকু আলগা বড় কম্পনে কেঁপে ওঠে ঘর-বাহির
বাহিরের আবরণে ঢাকা পড়ে গতজন্মের বিষাদ
বিষাদেই লিখে রাখি এজন্মের শেষ অতৃপ্ত চুম্বন
চুম্বনের স্বাদটুকু নিয়েই রচিত হয় মায়াবী সিম্ফনি
সিম্ফনির মতো সুর ওঠে ও নামে আশ্চর্য মায়াজাল
মায়াজাল ছিন্ন করে শেষতম শ্রোতাটি বাড়ায় তার হাত
হাতটি বেহিসাবী প্রসারিত হয় অনন্ত নক্ষত্রের দিকে
দিক ভুলে হারিয়ে যায় পায়ের তলার মাটি, সর্বংসহা
সর্বংসহা সে, জানে প্রায়শ্চিত্ত শেষে একদিন ফিরবেই
ফিরবেই সেই একাকী মানুষ যাবতীয় পরিক্রমা শেষে
শেষটুকু রচনা করবে বলে সে খুঁজে চলে আপনার ঘর