ইরাবতী উৎসব সংখ্যা: কবিতাগুচ্ছ । সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
ইলামবাজারের রাস্তায়
পথ , পথ বেয়ে মিশে যায় পথে , অলস অজগরের মত পড়ে থাকা ন্যাশনাল হাইওয়ের দু-পাশে বৃষ্টিবসন্তের সবুজ-হলুদ ধানক্ষেত , দূরবর্তী কাকতাড়ুয়ার মাথা দোলে হাওয়ায়। পরিত্যক্ত , ভাঙা একতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে ছায়া , দরজা হুটহাট করে খোলা – সেই কবে কারা এসেছিল, সেই কবে কারা চলে গেছে যেমন যাবার , আসা -যাওয়ার মাঝে পড়ে আছে সময়ের ছেঁড়াখোঁড়া জামা। ইলামবাজারের রাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি নেমে যায় , হাওয়াবৃষ্টিতে তোলপাড় গাছেদের মাথায় মেঘছেঁড়া ম্লান আলো যেন ২০০৭-এর ফাল্গুনমুখ। দু-ধারে ঘন জঙ্গলে কীসের শিহরণ , সরসর শব্দ যেন অদৃশ্য পিয়ানোয় হারানো আঙুল। ছুটে চলা গাড়ি কী যে খোঁজে ভেজা, রাঙা ধুলোয়, কোথা থেকে উড়ে আসে আকাশি ওড়না-লিরিক , থেমে যায় গাড়ি , রাস্তা পেরোতে থাকে ছায়া। এই থমকে দাঁড়ানো সাদাকালো ফ্রিজ-শট ইলামবাজারের মায়াপথে প্রাচীন শালগাছে ফ্রেম হয়ে ঝুলে আছে হাজার বছর। এ রকম মার্চ মাসে , কার কাছে যাবো ? গাছেরা তোলপাড় , বৃষ্টিবিকেলগুলো তারাপথে স্থির হয়ে আছে ….

আলো
কে যেন চলে গেছে, তার যাওয়াটুকু পড়ে আছে হাওয়ায়
শহরে বিদ্যুৎ, মেঘ , কবিতার উড়ে যাওয়া পাতা
কে যেন চলে গেছে, তার থাকাটুকু মনে রেখে গাছ
তোলপাড় হতে হতে কান্না লুকোয়
গাড়ি ফেরে বাড়ি তবু বাড়ি তো জোনাকি
আমাদের আমরাই ভুলে যাবো নাকি
বহুতলে আজ আবার কে কাকে কাঁদালো
রাস্তায় ঝরে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো আলো …

এইসব জুলাইসন্ধে
আলোফোঁটা হয়ে ঝরে পড়া এইসব জুলাইসন্ধে
দু-একটা অস্পষ্ট ফোনকল , ঝাপসা চায়ের দোকান
কেউ আসার কথা ছিল ?
গাড়িবারান্দার নীচে বছরগুলো ভিজে চলে অবিরাম
জোনাকি-ট্রামের হাওয়া , শুনশান ময়দান এলাকা
মনে পড়া ভালো
আরও ভালো মনে করে ভুলে যাওয়া , নিয়মমাফিক …

প্রতিধ্বনির দিনে
এমনও তো হতে পারে , আনমনা ফাল্গুনে
কেউ এসেছিল, বাগানের ঘাসে তার চিঠি পড়ে আছে
এমনও তো হতে পারে, পুরোনো কাঠের সিঁড়ি
উঠে গেছে ধুলোপড়া ছবিদের দেশে
কেউ এসেছিল, বারান্দায় হেসেছিল সাদাকালো রোদের টি- পট
হাওয়া এসে খুলেছিল দরজা , দূর থেকে অভিমান এঁকেছিল ছায়া
প্রতিধ্বনির দিনে বহু পথ পেরিয়ে যে এসেছিল
আলোময়ী ফিরবেনা , এই কথা জেনে
এলোমেলো ফাল্গুনে ফিরে চলে গেছে …

আফগানিস্তান, ২০২১
দেশ , ভিটেমাটির গন্ধ, নাড়ির টান ফেলে
উড়ন্ত মার্কিন এয়ার ফোর্সের বিমানের পেছনে দৌড়োচ্ছে আফগান যুবক
এয়ারপ্লেনের ডানা থেকে নীচে পড়ে যেতে কি
প্যারা-গ্লাইডিংয়ের মতো রোমাঞ্চ হয় , কমরেড ?
আমেরিকা ২০ বছর ধরে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে
নিজের কারুবাসনা সামলাতে না পেরে , তুলে নিয়েছে হাত
লোকে বলে আফগান আর্মি ডলার গুনে হেরে গেছে যেমন যাবার
সোভিয়েত বলে কিছু নেই
ইয়োরোপ চুপ
চীন , কান্দাহার পর্বতের নীচ থেকে তুলে আনতে চাইছে এল ডোরাডো
পাকিস্তান মুচকি মুচকি হাসছে
ভারত ব্ল্যাক কফি খাবে না দার্জিলিং টি
বুঝতে পারছেনা
যে আফগান ছেলেটি ক্রিকেটার হতে চেয়েছিল
যে আফগান মেয়েটি বোরখা ছুঁড়ে ফেলে হতে চেয়েছিল এয়ার হোস্টেস –
তাদের কী হবে ?
কাবুল এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দিচ্ছে উদ্ধার-বিমান
রাস্তায় পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হচ্ছে স্কুলে যাওয়া বালিকাকে
যে মহিলা হিজাব নামিয়েছিল, তার আজ জঙ্গী-শিবিরে যৌথ-বিবাহ
বালুচিস্তানের ছোট দোকানে আচমকা হ্যান্ড-গ্রেনেড
বাতাসে মৃত্যুগন্ধ
রাষ্ট্রসংঘ একের পর এক মিটিং ডাকছে বা ডাকছেনা
তবু আফগানিস্তান , তুমি এক আজীবন ধার না ফেরত পাওয়া কাবুলিওয়ালা
আর আমরা , নপুংসক দু’ পেয়ে প্রতিবাদী –
কবিতা লিখছি , যেমন লেখার।

কবি