| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা কবিতা: জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় । জাকির জাফরান

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
 
 
 
 
বেহালার ব্যথা এল, দোচালা ধানের ঘরে এসে
প্রজননের সংকেত রেখে গেল দুইটি জোনাকি।
দীর্ঘ হতে হতে দুই খণ্ড মেঘ মিশেছে হাওরে—
এখান থেকেই গল্প শুরু হোক সেই দুহিতার,
যার হাতে আমি তুলে দিয়েছি সকল হৃৎপিণ্ড,
দিয়েছি উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণ আর জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়।
পৃথিবীর প্রথম সেই জ্যোৎস্নাকান্তি যারা দেখেছিল,
তোমার হাতেই আমি স্বপ্নপোড়া তাদের করোটি
তুলে দেবো, তুমি আজ গোত্রপ্রধান তাদের, বলো, 
কে ছিল প্রথম নারী খোঁপায় যে গুঁজেছিল ফুল!
দিঘিজলে স্মিত মুখ দেখে নিজেকে সে ভেবেছিল
অনন্তবিহারী আসমান—তার চরণে সালাম।
শরীর নিয়তি নয় নারী, জাগো, চোখ তুলে দেখ—
বাউরি বাতাস বয় হৃৎপিণ্ডে, বয় প্রত্নস্মৃতি। 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
অমাবস্যার প্রথম রাতে মায়াবী পিদিম জ্বলে
কোন বটগাছে, বিটিছানাদের কণ্ঠ শোনা যায়
কোন পুষ্করিণীর পানিতে, তুমি বলো তো ডাহুক!
আশ্বিনের শুক্লা শুরু হলে, সহস্র মাইলব্যাপী
আতপ চালের শুভ্র গুঁড়ি দেখ উড়ছে আকাশে,
আর কার বিটিছানা দূর্বাঘাসের মাথায় বসে
তারা গোনে ছায়াপথে! শিশিরের শালীনতা মেখে,
আসমান জমিন একাট্টা-করা তোমার নিনাদ
কারা শোনে গোল হয়ে বসে! জোয়ালের ক্ষতে জ্বলা
নিযুত নক্ষত্র দেখে দেখে আজ জেগে থাকে কারা!
আমি তো তাদেরই লোক। তাদের মাথায় দেবো বলে
সোনালু ধানের শিষ ছিঁড়ে আজ বানাই মুকুট,
পায়ের পঙ্কজ ধোব বলে আনি স্বর্গের শরাব।
আমি দলিতের তল্পিবাহক, শুনছ হে ডাহুক? 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
কৃষি-বিধুনিত একদিন। একদিন চোখ বুজে
বোনের ছায়ায়। একদিন সজনী গাছের তলে।
মার্বেল গড়ানো দিনে ঠোঁট পেতেছিল শসাক্ষেত।
দিকচিহ্নহীন কিছু মনছবি। কিছু ছেঁড়া চিঠি।
হলুদ খামের মধ্যে কান্না। একদিন সন্ধ্যাবেলা।
ঠাকুমার ঝুলিতে মায়ের ঐ মায়াস্ত্র হাসি নাকি!
সাতটি অক্ষরে লেখা বুঝি এক বেহালা-দুপুর।
বাবার আঙুল ধরে পথে পথে খলিল মিয়ার
লাল চোখ একদিন। আর আচমকা একদিন
রুদ্র ও জীবনানন্দ। আকাশের প্রতি ফুটে-থাকা
অনিদ্রাকুসুম। অতঃপর একদিন সত্যি সত্যি।
পথে পথে চর্যা কুড়াতে কুড়াতে দেখি সামনেই
কান্নার কৈলাস। দেখি কবি হতে চলেছে বালক।
হাতে ফুল। হাতে অস্ত্র। সন্ত্রাস নীলিম স্তব্ধতায়।
 
 
 
 
 
 
জল খাবো, ওগো তুমি ঠোঁটে করে নিয়ে আসো জল।
বেহুলার বুক থেকে, সাবিত্রীর শিলা-ব্রত থেকে
নিয়ে আসো জল। একেকটি পূর্ণিমার পর নাকি
মৃত্যু হয় প্রতিটি কবির, তারপর আসে এক
অচেনা ভ্রমর, ফুঁকে দেয় প্রাণ, বেঁচে ওঠে কবি।
আবার সে সারারাত পিষ্ট হয় চাঁদের চাকায়।
হিজল গাছের নিচে জেগে থেকে, স্বপ্ন দেখে কবি
আর কাকিলা মাছের দল বঙ্গ অববাহিকায়— 
যে-ভূমিতে বাঘ ও হরিণ একই ঘাটে জল খায়।
বাঘ আর হরিণের অসমাপ্ত প্ররোচনা থেকে
ঠোঁটে করে নিয়ে আসো জল। প্রথম চুম্বনে আহা
কী করে যে ঢুকে গেল হাওরের ঘ্রাণ, জেনেছ কি?
জ্যোৎস্নারাতে কত ধানকল হাহাকার করে ওঠে!
তোমার কোমরে কত মেঠোপথ দুলে দুলে ওঠে!
প্রথম মিলনে মৃত্যু থাকে, কভু জানে না প্রেমিক।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
গোপন কান্নার এক ঘর থেকে দেখা গেল চাঁদ,
গোত্রমাতা বসে আছে দেখি জ্যোৎস্নাকুঞ্জের ভিতর।
দিবাস্বপ্নে যত তারা জেগে থাকে ছুঁয়ে দেখবার,
শূন্যে শূন্যে তত দুঃখ, তত কবিগান বুকে নিয়ে
রাত্রিগুলো ছুঁতে চায় কুপি-জ্বলা নিখিল আকাশ।
তবে সেই স্বপ্নচূড়া কতদূর! প্রাণের পদ্মিনী,
তোমার চোখের অস্তসূর্যগুলো আর কতদূর!
তুমি স্মৃতিশিহরিত বীজতলা—যখন তোমার 
কেবলি পড়ছে মনে আদম-হাওয়ার আকিঞ্চন;
পাঁজরের হাড় থেকে বের হয়ে উড়ছে ভ্রমর!
যদি দেখ পৃথিবীর প্রথম বৃক্ষের তল থেকে
জলমহালের চাঁদ দেখছে প্রথম সেই ব্যর্থ
অভিলাষী বিজন মানুষ, তবে কম্পিত বেদনায়
তখনো কি শোনা যাবে এ তাঁতপল্লির কলরোল?
 
 
 
 
 
 
 
গায়ে যদি মাখা যেত আমলকি বনের সবুজ!
স্বর্ণনিদ্রা থেকে জেগে, শোনো, তোমার শরীর থেকে
গড়িয়ে গড়িয়ে নামা আমলকি খাই আজ রাতে।
জেনেছি শিকারকালে বাঘ এক আদিম রহস্যে
লিপ্ত হয় হরিণের সাথে। নিদ্রিত নারীর পাশে
বিষাদের দাঁত নিয়ে জেগে আছে অগ্নি যে-পুরুষ,
হেলেঞ্চার রসে ডুবে আছে তার অনাঘ্রাত হাত।
ধানের আড়ালে, রাতে, চুমুকেই নবান্ন ভাবে সে,
চন্দ্রিমাট্রামের নিচে পিষ্ট হতে সেও তো ছুটে যায়
সুপারিবাগানে। নারীর মুখই তার পানশালা—
কখনও যেখান থেকে ফেরে না কোনোই চন্দ্রালোক।
অনাদৃত নাভিমূলে দেখ ঝিঙে ফুলের উচ্ছ্বাস—
ছায়াবতী, করতলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে এক
দুরন্ত পায়রা, তাকে নখ দিয়ে কৃষিতে জাগাও।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
দাউদ, তোমার এ-সুরের ইন্দ্রজালে পানি থেকে
মাছেরা উন্মাদ হয়ে উঠে এল ডাঙায়, আর এক
ক্ষুধার্ত সিংহের পিঠে চড়ে এল হরিণ শাবক।
পাখিদের হাহাকারে আমি সেই বাঁশি শুনি আজো;
দেখি শুক্লা-দ্বাদশী চাঁদের নিচে তসবিহ পড়ে
বৃক্ষ ও পাথর, শিলাখণ্ড শূন্যে দুলে ওঠে যেন।
হে দাউদ, চন্দ্রমৃত্তিকার খাদে পড়ে গেল দেখ
প্রেমিকার-স্তন-খেয়ে-অন্ধ-হওয়া মাতাল মানুষ,
বাউল-বিচ্ছেদে যেন ডাল থেকে খসে গেল পাতা।
এই চন্দ্রদীপালিতে পাঠ করো বনলতা সেন,
এই গৌর গীতাঞ্জলী কিংবা সান্দ্র সোনালি কাবিন,
মুরলীতে তোলো তুমি গন্ধরাজ বাঙ্গাল-জীবন
বালিকার শেমিজে লুকানো ব্যর্থ চিঠি গাও শুনি—
পাটক্ষেতে পড়ে থাকা চুমুগুলো উড়ুক আকাশে।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত