ইরাবতী উৎসব সংখ্যা: গোলাম কিবরিয়া পিনু’র কবিতা
আকাশপ্রান্ত নিয়ে বাঁচা
সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ
তাকে আবারও সুড়ঙ্গে ঢোকানো হচ্ছে কেন?
গুহা থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ
তাকে আবারও গুহার ভেতর ঢোকানো হচ্ছে কেন?
খোপ থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ
তাকে আবারও খোপে খোপে ঢোকানো হচ্ছে কেন?
পোড়াবাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ
তাকে আবারও পোড়াবাড়ির ভেতর ঢোকানো হচ্ছে কেন?
দাঁতলাগা অবস্থা থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ
তাকে আবারও দাঁতলাগা পরিবেশে ঢোকানো হচ্ছে কেন?
গণ্ডকূপের শব্দহীনতা থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষ
তাকে আবারও শব্দহীনতার ভেতর ঢোকানো হচ্ছে কেন?
মিথ্যে হয়ে যাবে-
এতদিনের সূর্যালোক নিয়ে বাঁচা,
মিথ্যে হয়ে যাবে–
এতদিনের আকাশপ্রান্ত নিয়ে বাঁচা,
মিথ্যে হয়ে যাবে–
এতদিনের ঘনবীথি নিয়ে বাঁচা,
মিথ্যে হয়ে যাবে–
এতদিনের কল্লোলিনী নিয়ে বাঁচা,
মিথ্যে হয়ে যাবে–
এতদিনের ঝুলনপূর্ণিমা নিয়ে বাঁচা,
মিথ্যে হয়ে যাবে–
এতদিনের নবীনতা নিয়ে বাঁচা,
মিথ্যে হয়ে যাবে–
এতদিনের প্রাণশক্তি নিয়ে বাঁচা,
মিথ্যে হয়ে যাবে–
এতদিনের বোধভাষ্যি নিয়ে বাঁচা!
আমরা তো বেঁচেছি অবলুপ্তি থেকে
দুর্বিপাক ও মহাপ্রলয়ে পড়ার পরও!
আমরা তো বেঁচেছি মৃত্যুশয্যা থেকে
অন্তিমদশায় মর্গে থাকার পরও!
আমরা তো বেঁচেছি ভৌতিকতা থেকে
জ্ঞানশূন্য পাথুরে মাটিতে পরিণত হওয়ার পরও!
আমরা কি ছেড়ে দেব মানুষখেকোর কাছে
আমাদের শিশু-সন্তানদের?
আমরা কি ছেড়ে দেব অন্ধ-টাট্টুঘোড়ার কাছে
আমাদের মাঠ ও প্রান্তর?
আমরা কি ছেড়ে দেব বুনোকুকুরের কাছে
আমাদের কুঞ্জবন?
আমরা কি ছেড়ে দেব শুঁয়োপোকার কাছে
আমাদের বীজ ও বীজতলা?
আমরা কি ছেড়ে দেব কাঠপিঁপড়ের কাছে
আমাদের মাথার মগজ?
হৃদয়গ্রন্থি
নদীকে বলেছি–‘নদী বড় হও’
নদী বলে–‘আমি জল ছাড়া বড় হই না
যত জল তত বড়’
মানুষ কি একা বড় হয়?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে–নদী আরও বলে
জলছাড়া আমি অবলুপ্ত হই
বাতিলও হই
বিনাশও হই
কুলরক্ষা হয় না।
কালগ্রাসে পড়ে কালসমুদ্রে হারিয়ে যায় কত নদী!
তালপুকুর ও খালবিলও জল দিয়েছে–
আমি প্রফুল্ল হয়েছি,
ঝরনার জল পেয়ে ঝরঝরে
আকাশভাঙা বৃষ্টির জলে চনমনে
প্লাবনের জলে তাজা
ভূগর্ভস্থ জলে টলটলে।
জলই উচ্চতা বাড়ায়–জলই গভীরতা বাড়ায়!
একটা পোড়োবাড়ি থেকে জলগ্রন্থি খুলে
যেন প্রসারিত হয়েছিলাম-
তারপর মরুপথে
গিরিপথে
বনের ভেতর দিয়ে
জলের সাহচর্যে কুণ্ঠাহীনভাবে আমি প্রবহমান।
জলের কপটতা নেই-জলের কুম্ভীরাশ্রু নেই!
আমি শুধু এইটুকু জানি–
জলের উদারতায় উদারপ্রকৃতি হয়ে উঠি
ঊর্মিমুখর হয়ে উঠি
কল্লোলিত হয়ে উঠি
হৃদয়গ্রন্থি খুলে ধরেছি আমিও!
নিন্দার আদিহাট
কত ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রয়েছে
শত্রু আমার! কত রং জামার!
ছলচাতুরি ও কারসাজিতে
চলেছে তাহারা–কত রকমের কারাভানে
ভণিতা ও ভানে!
গোলাপজলে ধুয়েছে মুখ
কী মার্জিত আচার!
আচার পেলেই মুখে তুলে নিয়ে
খাবার টেবিলে করে কুপোকাৎ! কী জাত!
সম্মুখে কী নান্দিপাঠ!
পেছনেই নিন্দার আদিহাট!
অন্তর্বাস
জীবন অনেক সময়ে রূঢ় হয়ে ওঠে, আশীর্বাদ কোনো
কাজে লাগে না, প্রতিশ্রুতিতেও বিশ্বাস থাকে না,
বিজ্ঞাপনগুলো অক্ষরহীন হয়ে পড়ে, লাগে টাকা ও
পয়সা, এমন রিয়েলিটি অর্থবহ হয়ে ওঠে, মূল্যবান হয়ে
ওঠে; শেষতক জীবনের অর্থ পালটে যায়-গিরগিটির
রঙ পাল্টানোর মতন! মাথার উপর থাকা মাতব্বরও
কোনো কাজে লাগে না, তখন জীবনও বলে-জামাটা
পাল্টাও, অন্তর্বাসও!
নির্যাস
সব ধরনের সুগন্ধির চেয়ে-এখন টাকার
গন্ধ মানুষের প্রিয়! টাকাতে যে সুগন্ধ আছে.
তা আর কোথাও নেই! সুগন্ধ যা দিয়ে তৈরি
হয়, ধরো-গোলাপের নির্যাস, সেই
নির্যাসের চেয়েও অতিমাত্রায় পাগলকরা
নির্যাস টাকায়, যা গভীর আসক্তির কারণ
হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে হৃদবিকল হওযার
কথা জানার পরও-ভয়াবহ রকম আসক্তিতে
আমরা অনেকে পাগলপ্রায়! পাগল হলেও
পাগলাগারদে থাকতে হচ্ছে না, সে-কারণে
তা আরও ভয়াবহ!

মূলত কবি। প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখাও লিখে থাকেন। গবেষণামূলক কাজেও যুক্ত। গোলাম কিবরিয়া পিনু-এর জন্ম ১৬ চৈত্র ১৩৬২ : ৩০মার্চ ১৯৫৬ গাইবান্ধায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা : স্নাতক সম্মান (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) এবং স্নাতকোত্তর; পিএইচ.ডি. ।
১৯৮৩ থেকে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। লিখছেন তিন দশকের অধিককাল। এর মধ্যে কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলে ২৭টি গ্রন্থ বের হয়েছে–বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে।
শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর-সহ অন্যান্য সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর রয়েছে ভূমিকা। বর্তমানে বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য ও এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ-এর সদস্য। এখনো ক’টি সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, বলিভিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন।
ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ পর্যন্ত একটি আর্ন্তজাতিক মিডিয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড’-এর সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন। এর আগে এফপিএবিতে ফোকাল পয়েন্ট ও বিভাগীয় প্রধান (এডভোকেসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া এফপিএবি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সুখী পরিবার’-এর সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগতভাবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, কলামলেখা, সম্পাদনা ও এডভোকেসি বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সাথেও যুক্ত থেকেছেন।
উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
· এখন সাইরেন বাজানোর সময়
· সোনামুখ স্বাধীনতা
· সূর্য পুড়ে গেল
· কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরে
· আমরা জোংরাখোটা
· ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত
· ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি
· ফুসলানো অন্ধকার
· উদরপূর্তিতে নদীও মরে যাচ্ছে
· নিরঙ্কুশ ভালোবাসা বলে কিছু নেই
· ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো
উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থ
· বাংলা কথাসাহিত্য : নির্বাচিত মুসলিম নারী লেখক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
· সমকালীন কবিতা ও বোধের দিগন্ত
· উনিশ-বিশ শতকের নারী লেখক ও আত্মশক্তির বিকাশ
পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে
· সৌহার্দ্য’৭০ সম্মাননা, কোলকাতা, ২০০৩
· অনিরুদ্ধ’ ৮০ সম্মাননা, কোলকাতা, ২০০৩
· দীপালোক বিজয় দিবস সম্মাননা পদক
· লোকসখা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, কোলকাতা কর্তৃক লোকসখা সম্মাননা
· উইমেন ডেলিভার আমেরিকা-এর ফেলোশিপ
· এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার
· বগুড়া লেখক চক্র সম্মাননা
· কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার (ভারত)
· চাড়ু–নীড়ম ইনস্টিটিউট পুরস্কার