| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা উপন্যাস: বেহুলার বাসর । প্রশান্ত মৃধা

আনুমানিক পঠনকাল: 74 মিনিট

অতীতের বর্তমান


গ্রামের প্রবীণরা অনিশ্চিত। গৃহকর্তার চোখে শঙ্কা!
বড়ো সাধ করে তিন দিনের রয়ানি গান মানত করেছে দীনেশ। হবে তো সে গান? বৃষ্টি না জানি সব পন্ড করে দেয়। পুব পাড়াকে দুই ভাগ করে বলেশ্বরের দিকে বয়ে যাওয়া খালটায় আজও প্রায় গলা-তলানো জল। মাছধরার দুয়োর পেতেছে যারা, তাদের প্রায় গলা-জলে নেমে তা তুলতে হয়েছে। সাধারণ বছরের এই সময়ে খালে এত জল থাকে না। এবার মাঘের শেষ আর ফাল্গুনের পয়লা-পয়লি খুব বৃষ্টি হয়েছে। তবে, ফাগুনের দিন পাঁচেক থেকে আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। দীনেশের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বয়েসিদের পুরবে মনষ্কাম।

শুক্লা পক্ষের এই কদিন সন্ধ্যায় আকাশে সিকি থেকে আধাআধি থেকে প্রায় গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। কাল দ্বাদশীর চাঁদের দিকে তাকিয়ে দীনেশের ছোটোভাইর বউ লক্ষ্মীর পাঁচালির পয়লা দুটো লাইন আওড়েছিল। পূর্ণিমা সামনের বৃহস্পতিবার। প্রত্যেক বিস্যুদ অর্থাৎ গুরুবারে এই নতুন বউ পাঁচালি পড়ে। দোল পূর্ণিমা নিশি নির্মল আকাশ, ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস।

দিব্যেন্দুর অমন ধর্মকর্মে মতিঅলা বউ হওয়ায় দীনেশ খুশি। মেয়েটিকে পাত্রী হিসেবে সেই পছন্দ করেছিল।
ওদিকে ভাসুর দীনেশ তিন দিনের রয়ানি গান মানত করায় তিথি ততটা খুশি না। সেটি অবশ্য একেবারেই ভিন্ন কারণে। তিথির আপত্তি রয়ানি গান নিয়ে নয়, আপত্তি যদি কিছু থাকে তা ওই গানের গায়িকা আভারানিকে নিয়ে। নিজের দেওর দিবাকর আর তাদের সমবয়েসিদের বলতে শুনেছে, আভার রয়ানি গানের আর শুনি কী, দেখি তো আভারে। আভারানি সম্পর্কে তিথি আগে থেকেই কিছু জানে। তার সম্পর্কে চলতি খানিক গল্পগাছাও তার কানে এসেছে। তবু শ্বাশুড়ির ইচ্ছা, তার বড়োছেলের এই মানসিকের গান যেন সে বেঁচে থাকতে শুনে যেতে পারে।

এমন নির্মল আকাশ আর মলয় বাতাসময় ফাগুনে, আভারানি এই গ্রামে রয়ানি গান গাইতে আসছে এটা কিন্তু সংবাদ হিসেবে দারুণ! দীনেশের বউ সুভদ্রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করে। তার পক্ষে কৃষাণ কি ঠিকে লোক লাগিয়ে উঠোনে রয়ানি গানের মন্ডপ বানানোর তদারকি করা সম্ভব নয়। সেই মন্ডপের উত্তর দিকে আলগা একচালায় বড়োসড়ো এক চোখ কানা মনসা প্রতিমা বসানো হবেÑ এ ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া সে আর কী করতে পারে?

দীনেশ অবাক হয় ও ভাবে, তিথি শুধু ধর্মপ্রাণই নয়, কাজেরও। দিবাকর ভাবে, বউদির যদি আভার গানে এতই আপত্তি তাহলে ওই একচালার উপরে টিনের ছাউনি, নীচে সারাটা উঠোন নিকানো আর উলটো দিকে চারটা চিকন কলাগাছ দিয়ে দক্ষিণে মুখ প্রতিমা বসানোর জায়গা বানানোয় এত তদারক করে কেন? দিবাকর মনে মনে সেখানে আভাকে গাইতে দেখে। আভার গানে হারমোনিয়াম বাজায় অধিরাজ! আহা, অধিরাজের কী ভাগ্য! তাদের যেখানে আভাকে নিয়ে আনন্দ, তিথির সেখানেই আপত্তি! তিথি সেকথা ঠাড়ে ঠাড়ে ফোনে দিব্যেন্দুকে বলেওছে। আসলে তিথি বুঝতে চেয়েছে দিব্যেন্দুর আগ্রহ কেমন? বাড়িতে তিন দিনের রয়ানি গানের মানত, এর ভিতরে দিব্যেন্দু অবশ্যই বাড়ি আসবে। কিন্তু আসর আগ্রহ কি তিথি না আভাকে দেখা।যদিও এ সবই ভিতরের গোমর! গ্রামবাসীর মতন তিথিও পরিষ্কার আকাশ দেখে। এতদিনের মানসিক, এবার কাজটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে হয়। গানের দলের মানুষদের কোথায় থাকতে দেওয়া হবে তা নিয়ে ভাসুর ও জা-র সঙ্গে পরামর্শ করেছে সে। খালের ওপার দীনেশের তালুই বাড়ি। সে বাড়িতে থাকবে কজন। বাকিরা এই বাড়িতে। হয়ে যাবে। এর ভিতরে তিথি একবার গলা নামিয়ে জা সুভদ্রার কাছে জানতে চেয়েছে, ‘ওদি, আভা থাকবে কোথায়?’

সুভদ্রা হেসে তিথির দিকে তাকিয়ে বলেছে, এ নিয়ে তাকে চিন্তা করতে হবে না। আভা যেখানেই থাকুক, অত উতলা হওয়ার কিছু নেই। তাকে পাহারা দেওয়ার মানুষ মজুত আছে। অধিরাজ কী বলিষ্ট পুরুষ! অধিরাজকে অবশ্য দেখেনি তিথি। কথায় বোঝা গেল, সুভদ্রা দেখেছে। তাদের কথার ভিতরে যে ইঙ্গিত, তা বুঝে দীনেশের অনুপস্থিতিতে দুই জা এক চোট হেসেওছে। গ্রামের মানুষজন আভাকে দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সেকথাও তারা আলোচনা করে। সে আলোচনার ফলাফলও এই আভাকে তাদের ওভাবে দেখেই যেতে হবে। আভা চলবে আভার মতন। কাউরে পাত্তা দেওয়ার মানুষ সে না। তাহলে প্রকৃতিসহ সর্বত্রই, এ বাড়িতে রয়ানি গানের আয়োজনে মোটামুটি ত্রুটি নেই। আভার আগমনও বাধাহীন। তাহলে, পনেরোই ফাল্গুন সন্ধ্যারাতে দীনেশ কম্পাউন্ডার ওরফে কোয়াক ডাক্তার-বাড়ির আঙিনায় তিন দিনের রয়ানি গানের আসর বসবে।


তাই-ই হয়। প্রথম রজনিতে চাঁদখানা একবারে চকচকে। আকাশ পরিষ্কার। অধিরাজ হারমোনিয়ামে সুর তোলে। গোবিন্দ খোলে তোলে বোল। গোবিন্দর গ্রামসম্পর্কে ভাইপো উজ্জ্বল করতাল (চাকি) বাজায়। আভার মূল দোহার সন্ধ্যা। সন্ধ্যা থামলে কখনও কখনও বাকিটুকু টেনে তোলে শুক্লা। দলের কর্তা হিসেবে কাহিনির পরাম্পরা রক্ষা করে প্রবীণ চিনুবাবু। আজকাল তার গলা নীচু আর স্বর তেমন আর স্পষ্ট নয়। তবে এখনও তার উচ্চারণ কাটা কাটা, বলার ভঙ্গি মুগ্ধকর। দলের সঙ্গে জড়ানো আরও দুই-একজন আছে। তারাও কথা কয় প্রয়োজনে। আয়োজন সত্যি ত্রুটিহীন।

যদিও এসব নিয়ে গ্রামের একদলের প্রায় কিছুই যায় আসে না। আসরে উপস্থিত বয়েসিরা যতই আভার গানে মনোযোগ দিক, অল্পবয়েসিরা কিছুক্ষণের জন্যে আসে, একটু শোনে, আবার উঠে যায়। খালের ওপারে চায়ের দোকানের সঙ্গে একচালা ক্লাবঘর থেকে এই আসর পর্যন্ত সবখানেই, কখনও উঁচু গলায় কখনও নীচু গলায় তাদের আলাপের বিষয় আভা আর অধিরাজ। কখনও অধিরাজও নয়। শুধুই আভা! কোনও ফাঁকে তাদের আলোচনার আদি রসাত্মক সুর আভা অধিজরাকে পাশ কেটে গোবিন্দ আর শুক্লার দিকেও ধায়। সেদিকে গেলে অবশ্য অনেকের জন্যে স্বস্তির! কারণ এই দুজনের গল্পটা নতুন। সেখানে নাকি গোবিন্দর উদাসীনতা আছে, আছে সন্ধ্যার চাতুরি। আভা আর অধিরাজের গল্পে সে-সব কিছুই নেই। আর সে কাহিনিও পুরোনো। জমে প্রায় ক্ষীর। তবু যে পুরোনো হয় না, তার কারণ আভারানি গ্রাম কি ইউনিয়ন কি এই উপজেলার সবচেয়ে ভালো রয়ানি গায়িকা। সাক্ষাৎ মা মনসার বর আছে তার উপর। সঙ্গে তার গায়কী, শরীরী ভঙ্গি ও চেহারা; আর সবচেয়ে মুখোরোচক অধিরাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক।

বৈদ্যবাড়ির মেজবউ তিথি হয়তো তাই আভাকে কোনওভাবে পছন্দ করেনি। দেওর দিবাকরকে সে চোখে চোখে রাখে। স্বামী দিব্যেন্দু কাল আসার পরে, কী বলবে তাও ভেবেছে। বলবে, আজ দুপুরে খাওয়ার সময় আভা তাকে অধিরাজের পাতে মাছের কোন টুকরাটা দিতে বলেছে। কথাটা সে একবার দিবাকরকেও বলেছে। যদিও একথা তিথির মানতে আপত্তি নেই, আভা গায় অসাধারণ। এই এলাকা থেকে দুই থানা পশ্চিম দিকের মেয়ে তিনি। এই গ্রামে যাকে বলে, পশ্চিমা। তার বাপের বাড়ির দেশে এই রয়ানি গান প্রায় নেই। আজই প্রথম সে শুনেছে। তবে তা নাকি একেবারেই শুরুর অংশ। গান আজ আর এগোবে না। আকাশ হঠাৎ মেঘে ছেয়েছে। চাঁদ তো নেই-ই, ফাঁকে ফোকরে তারাও দেখা যাচ্ছে না। এর কোনও আলামত কিন্তু সন্ধ্যা রাতে পাওয়া যায়নি। সন্ধ্যারাতে পিছনের পুকুরের ঘাটে গিয়ে সে যখন দিব্যেন্দুর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছিল, তখনও আকাশ পরিষ্কার। আজ একাদশী গেল। অমন সুন্দর ঝকমকে চাঁদ দেখে তিথির মন উদাস। দিব্যেন্দু বলেছে কাল আসবে। আসতে আসতে সন্ধ্যা।

ওই সময়ে গোবিন্দ পয়লা খোলে চাটি দিয়েছিল। শুনে তিথি দিব্যেন্দুকে জানিয়েছে, এখনই মনে হয় আসরে নামবে। আর কথা বলতে পারবে না। তারপর কোত্থেকে যে কী হল! এই ঘণ্টা দেড়েক, এর ভিতরে একটু কুলকুলানি ঠান্ডা বাতাস। একটু পরে দু-ফোঁটা বৃষ্টি। গান দেখতে-শুনতে আসা আশেপাশের মানুষজন চলে গেল, দূর থেকে আসা আত্মীয়স্বজনে বাড়িভরতি। মাথার উপরে সামিয়ানা। বৃষ্টি বাড়লে আটকাবে না। কলাগাছে ঘেরা মন্ডপের উপর টিন। হারমোনিয়াম কি খোলে বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা নেই। আসর তবে জমলই না, বরং ভাঙল। গোবিন্দ আর উজ্জ্বল খোল-করতাল রেখে দাসু-বাসুর সাজ নিয়েছিল। তাদের অভিনয়ও আজ আর দেখা হল না কারও। আজকের মতো রয়ানি গানের আসর শেষ। পরদিন সন্ধ্যার আগে আগে তিথি হঠাৎ তার দেওর দিবাকরকে বলে, ‘কী! সারাদিন তো আভারে বাতাস দিয়ে ঘাটাইয়ে দেলা, এখন এট্টু কচুয়ার দিক যাও।

কচুয়া থানা সদর। দিবাকর তিথির কথার ঠেসটা বুঝতে পারে, যদিও বউদির চোখে হাসি ছাড়া কোনও রহস্য লুকানো নেই। সে জানতে চায়, ‘কেন? কী জন্যি?’ ‘এই-যে ওনারে যেন কিছু কই নিই! এই জন্যিই তো কই আভার গায়ে বাতাস দিতি দিতি সব ভুইলে গেইচো’ যদিও দিবাকর মোটেই আভাকে নিয়ে পড়ে থাকেনি। এসবে সে নেই। আভা এ বাড়িতে ঘুমিয়েছে ঠিকই। সেখানে অধিরাজ ছিল না। সে ছিল ওপারের তাদের তালুইবাড়ি। তিথির ওই ঠ্যাস-মারা কথাটা যে কথার কথা, তাও সে জানে। বাতাসচলতি কথায় বউদি তাকে খেপাচ্ছে, তাও বুঝতে পারে। তিনদিনের রয়ানি গানের একদিন গেল বৃষ্টিতে। আজ আভা ফাঁকি দেবে নিশ্চিত। কাহিনি তাড়াতাড়ি আগে বাড়বে। আভাসহ অন্যদের গানের ফাঁকে কর্তামশাই চিনুবাবুর ঘন ঘন আবির্ভাব ঘটবে কাহিনি এগিয়ে নিয়ে যেতে। এ সবই দিবাকরের জানা আছে। যদি আজও বৃষ্টি হয়! তা হলে কালকে শেষ বিকাল কি সন্ধ্যাসন্ধি শুরু করতে হবে। এজন্যে একটু মনমরা হয়ে আছে দীনেশ।
এর ভিতরে আভাকে নিয়ে তিথির দিবাকরকে ঠ্যাস দিয়ে কথার বিরতি নেই।
দিবাকর তিথির কাছে জানতে চায়, ‘কও, কী জন্যি হঠাৎ কচুয়া যা’তি হবে?’
‘কাইলকে তুমি নিজেই কইলে ওই মোবাইলটা নিয়ে যাবা’
‘ও, তোমার ফেসবুক চলে না, সেই জন্যি?’
‘হইচে। যাও, তোমার দাদা কইচে নিয়ে যা’তি’
‘কও না, ফেসবুক চালাবা?’
‘হ, ছবি তুলতি পারতিচি না। আপলোড দেব। ভাইডি-বুন্ডিগো পাঠাব। ওরা তো জানে না রয়ানি গান কী জিনিস?’
‘ও। তোমাগে ওদিক তো এই গান নেই-’
‘না। আমি কলেজে থাকতি শুনিচি। তয় ভালো কইরে দেখলাম ক’তি গেলি কাইলকে প্রথম।’
‘তা তোমার ভাই পড়ে ভার্সিটিতে, তার কোন দায় পড়িচে ওই রয়ানি গানের ছবি দেখার?’
‘ও কতা কওয়ার দরকার নেই। যাও দিন (যাও তো)। ততক্ষণে তোমার দাদাও কচুয়া চইলে আসপেনে, তহোন দুই ভাই মিলে চইলে আইসো-

তিথির মোবাইল সারিয়ে দিবাকর যখন দিব্যেন্দুকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছয়, ততক্ষণে দ্বিতীয় দিনের আসরও শেষ। তারা বড়ো রাস্তা থেকেই আর খোলের বোল শোনেনি। পথচলতি মানুষজনকে দেখে দিবাকরের মনে হয়েছে তারা ফিরে যাচ্ছে। অন্ধকারে একজন মোটরবাইকে দিবাকরকে বলেওছে, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি যা।’ বৃষ্টিভেজা ইটলাছা রাস্তায় মোটর বাইক ধীরে চলছিল। গতি আরও কমিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দিবাকর জানতে চায়, ‘হইচে কী?’
‘লোকটি জানায়, ‘অধিরাজ কাইত।’
‘কাইত মানে?’
‘যাইয়ে দেক’
এই রাস্তায় বাইকের গতি বাড়ানোর উপায় নেই। দিন হলে তাও চেষ্টা করা যেত। আর মাত্র শ-খানেক হাত পরেই খালের ওপারে দিবাকরদের বাড়ির সীমানা। সেদিকে আর-একটু এগোলেই দিবাকর বোঝে, সত্যি সব বড়ো শুনসান। কচুয়া যাবার সময়ে ছিল উলটো, লোকের স্বরে গমগম করছিল।
দিব্যেন্দু দিবাকরের কাছে জানতে চায়, ‘হইল কী, ও দেবা?’
‘বুজদিছি না, মেজদা!’
রয়ানি গানের দ্বিতীয় দিন এই সময়ে আসর থাকবে জমজমাট। লখিন্দরের সঙ্গে বেহুলাসুন্দরীর বিয়ের পাকা কথা হবে। তার আগে চাঁদ সওদাগরের একে একে সাতখানা নাও ডুববে। এ সবের ফাঁকে আভা সংগতকার দোহারদের নিয়ে আসরে কত পদের ইয়ার্কি করবে। বছর দুই আগে তার দিদির শ্বশুরবাড়ির গ্রামে আভার রয়ানিতে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে দিব্যেন্দু ভাবে। আর তাদের বাড়ির গানে আভাকে নিয়ে তিথি তার সঙ্গে খানিক ইয়ার্কি করতেও বাকি রাখেনি। খালের এপাড়ে ক্লাবঘরের সামনে দিবাকর মোটর সাইকেল দাঁড় করাতে করাতে একজনকে ডাকে, ‘এ নিখিল, কী হইচে?’

নিখিল ক্যারম খেলায় ব্যস্ত। এমনকি সে যেন দিবাকরের ডাক কি কথা শোনেওনি। দিবাকর আবার ডাকে। দিব্যেন্দু সাঁকো পার হয়ে বাড়ির দিকে এগোয়। দিবাকর ভাবে, নিখিলকে ডেকে শোনার চেয়ে বাড়ি যাওয়া ভালো। তবু কী ভেবে সে এই জ্ঞাতি ভাইপোকে আবার ডাকে‘ এ নিখিল, তোর কানে কী ঢুকিচে? ডাকতিচি শুনতিচিস না?’
নিখিল ক্লাবের একচালা থেকে বের হয়ে সামনে আসে, ‘ও কা, ও কা, হইচে কী ওই অধিরাজ হারমোনিয়াম বাজাতি বাজাতি হাত পা ছড়াইয়ে পইড়ে গেইচেÑ’
‘কখন?’
‘এই ঘণ্টাখানেক হবে’
দিবাকর মোবাইলটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে হাতে নিয়ে সময় দেখে। না, এর ভিতরে বাড়ি থেকে কেউ ফোনও তো করেনি।

এই ঘটনায় গ্রামকে গ্রামব্যাপি লোকবিশ্বাসের ধারণা যেন খানিকটা উলটে যায়। খানিক শুধু নয়, হয়তো আরও বেশি! আভারানি রয়ানি গায় সত্যি অসাধারণ! তা গায় বটে, তবু কেন যেন শিবের কুমারী মেনকা অর্থাৎ শ্রীশ্রী মনসা দেবী নিশ্চিত তার প্রতি অপ্রসন্ন। নইলে তার মতো গায়েনের দলে বারবার অমন বিপর্যয় ঘটে কেন? প্রবীণরা হিসাব করে। হিসাব মেলে না। আশেপাশে দুই-দশ গ্রাম কি ইউনিয়ন, ইউনিয়ন উজিয়ে থানা, তারপর পরিসর আরও বাড়ায়। দুই-চার থানা, কি নদীর ওপারে আরও দুই-তিন থানায় আভার চেয়ে ভালো রয়ানি আর কে গায়? তারা মনে করে, আগে ছিল কুসুম! কুসুমের দলের বুড়োকর্তা পুলিন সাহা, দারুণ কাহিনি রয়ান করত! কুসুমের গানের কথা তারা ভোলে কী করে। যারা শুনেছে আজও সেই গানের সুর তাল আর ছন্দের কথা মনে করতে পারে। কুসুম ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পরে এই আভাই।

আভা যখন ওই কুসুমের দলের সংগতকার, কখনও পুলিন সাহার এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কাহিনির সূত্র ধরে, আর কুসুম সেই ফাঁকে পান মুখে দিয়ে আসরে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করত, সেই দৃশ্য কি ভোলা যায়! তখন আর একজন বড়ো গায়েন ছিল, তার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। যাদের বয়েস ষাট ছাড়িয়েছে তারা বিষ্ণুপ্রিয়াকে মনে করতে পারে। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার দোষ ছিল একটাই হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। কোথায় যেত আজও কেউ জানে না। গানের বায়না নিয়েছে, গৃহকর্তা আসরের আয়োজন করছে, গ্রামে গ্রামে লোক দিয়ে খবর পাঠিয়ে আত্মীয়স্বজনকে জানিয়েছে, অথচ গানের দিন সেই বিষ্ণুপ্রিয়ারই খোঁজ নেই। আভারানির রয়ানি গানে হাতেখড়ি অল্প হলেও ওই বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে। ফলে, বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে যায় হাতেখাড়ি তার পক্ষে একদিন কুসুমকে ছাড়িয়ে যাওয়া যেন স্বাভাবিক। কিন্তু কেন যেন আবার দশা ছাড়ায় না। কেন? হিসাব মেলে না। মনসা অপ্রসন্ন। নাকি শীতলা বিরাগ, নাকি বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপ? আভার বাপ বিশ্বেশ্বরর মলঙ্গিকে বিষ্ণুপ্রিয়া ধর্মভাই ডেকেছিল। টুকটাক ঝাঁড়ফুঁক জানত বিশ্বেশ্বর। সে বাবদ মাঝে মধ্যে ওঝাগিরিও করত।

একবার নদীর ওপারে জুচখোলা গ্রামে এক সাপে-কাটা রোগীকে ঝাড়তে যায় বিশ্বেশ্বর। সেখানেই বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে তার পরিচয়। ওই বাড়িতে তখন সাতদিনের রয়ানি গানের আসর পেতেছে বিষ্ণুপ্রিয়া। সেই গানের তিন দিনের মাথায় ওই বাড়িতে অমন ঘটনা। বিষ্ণুপ্রিয়ার গানের ইজ্জত বলে আর কিছু ছিল না। যে বাড়িতে রয়ানি গানের আসর, সেই গৃহকর্তার বড়োছেলেকেই কিনা মা আস্তিকমুণির বংশ এইভাবে দংশে! তাও আবার এমন শুকনার সময়ে।

নদীর এপার ওপার তখন খুবই জানাশোনা খবর যে, বিশ্বেশ্বর ওঝার ঝাড়লে সাপে-কাটা রোগী উঠে বসে। এদিনই তাই হয়েছিল। সেই গোধূলির পরে শুরু হবে চার দিনের গান। রোগী উঠে বসেছে। বিশ্বেশ্বর মলঙ্গি চলে আসবে। চিকিৎসা বাবদ সে কিছু নেয় না। এই সময়ে বিষ্ণুপ্রিয়া বিশ্বেশ্বরের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার শাড়ির আঁচল গলায় প্যাঁচানো। অর্থাৎ এমন গলবস্ত্ররূপ শ্রদ্ধারই নিদর্শন। বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখে জল। দলের লোকজন পিছনে তার। এমনকি সবার পিছনে দলকর্তা বঙ্কুবাবুও আছে। বিষ্ণুপ্রিয়া প্রথমে করজোর করে বিশ্বেশ্বরের সামনে দাঁড়ায়। এরপর সে কিছু বুঝে ওঠার আগে বিষ্ণুপ্রিয়া তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। সজল চোখে বিষ্ণুপ্রিয়া বলতে থাকে, ‘দাদা, আপনি সাক্ষাৎ শিব ঠাকুর। স্বয়ং মহাদেব। মা মেনকারও জনক। আজ আমার সম্মান বাঁচালেন। আপনার এই বুনডা কোনও দিন আপনেরে ভোলবে না।’ বিষ্ণুপ্রিয়া তো লক্ষ্মীর অপর নাম। তার মুখে সে শ্রীছাঁদ কিছু আছে তবে গলার স্বর খুব সুরেলা। আর কথাও বলে সে খুব গুছিয়ে। যতটুকু সাধ্য তার সে অনুযায়ী শুদ্ধ শব্দে। কোন গাঁয়ে বাড়িঘর কথায় তা প্রায় ধরাই পড়ে না যেন। বিশ্বেশ্বর মলঙ্গির তো প্রায় কিছুই জানা ছিল না। না, বিষ্ণুপ্রিয়াকে, না এই বাড়িতে রয়ানি গানের আসর চলছে, সে জানত না। একহারা দীর্ঘদেহী মানুষ। পরনে ধুতি, পরিষ্কার কিন্তু সাদা রং একটু ফ্যাকাশে একটা হাতঅলা গেঞ্জি গায়ে।

বিষ্ণুপ্রিয়ার এমন আচরণে বিশ্বেশ্বর প্রায় ভ্যাবাচেকা খায়। দীর্ঘ শরীর নুইয়ে সে অতি কষ্টে বিষ্ণুপ্রিয়াকে টেনে তোলে। ছোটোখাটো গড়নের বিষ্ণুপ্রিয়া তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘আপনার পায়ে আমারে ঠাঁই দিয়েন, দাদা। আমি আপনার ছোটোবোন।’ বিশ্বেশ্বর মথুয়াপন্থী। গতবার ঢঙ্কা পিটিয়ে সিঙ্গা ফুঁকিয়ে দল নিয়ে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি গেছে। এবার হয়তো যাবে না। আবার শেষ মুহূর্তে যেতেও পারে। তবে জীবনে পরিত্রাণের জন্যে ওই হরিচাঁদ আর গুরুচাঁদের ধ্যান ছাড়া আর কোনও পন্থার প্রতি টান কি দায় নেই তার। তবে রয়ানি গান সম্পর্কে তার ভালোই ধারণা আছে। তা থাকা স্বাভাবিক। বিষ্ণুপ্রিয়া খুবই ভালো গায় ওই গান, সে খবর সে জানে। এর বেশি যা জানে, বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি এই গ্রামেরই মালিপাটনের দিকে। বাল্যবিধবা। এখন স্বামী কি লাঙ্গল যাই বলো সে ওই দলকর্তা। আজকাল নাকি শাঁখাও পরে। যদিও এই সবই উড়ো খবর। বিষ্ণুপ্রিয়ার মতন গায়িকাকে নিয়ে শতেক কথা চলা খুবই স্বাভাবিক। সেই কথার একটু আধটু এভাবে সেভাবে ভেসে আসে। সেইসমস্ত কথা শুনে মনে রাখার মানুষ বিশ্বেশ্বর নয়।

এখন বিষ্ণুপ্রিয়া তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরে আছে, বিশ্বেশ্বরের তাই হয়তো মনে পড়েছে। কিন্তুসবার সামনে এইভাবে জড়িয়ে ধরা- স্বভাবে উদাসী বিশ্বেশ্বর একটু বিব্রত হয়। গোধূলির ম্লান আলোয় উঠানে জড়ো হওয়া মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বেশ্বরকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে বিষ্ণুপ্রিয়ার দলকর্তা বঙ্কুবিহারী হালদার। বিষ্ণুপ্রিয় পিঠে হাত রেখে বিশ্বেশ্বরের উদ্দেশ্যে বলে, ‘নামেরও কি মিল আপনাদের। বিশ্বেশ্বরের বুন বিষ্ণুপ্রিয়া।

বিশ্বেশ্বরকে ছেড়ে দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বিষ্ণুপ্রিয়া হাসে। চকচকে দাঁতেও হাসি ছড়িয়ে সে মাথা নাড়ায়। বঙ্কুবিহারীর প্রস্তাব তার পছন্দ হয়েছে। বিশ্বেশ্বরের বিহ্বলতা কাটে বটে। তবে সে যে প্রায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে সেখানে সচলতা আসে না। এর ফাঁকে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রস্তাব করে, ‘আজকে আপনার এই বোনটার গান না শুইনে যা’তি পারবেন না।’ বিশ্বেশ্বর সত্যি দোটানায় পড়ে। এমন বোন পাতানো বিষয়টাই তার পছন্দের না। আর এই যে রয়ানি গান, এ তো তার কাছে এক ঘ্যানোর ঘ্যানোর? ভর সন্ধ্যা থেকে দুই রাত্তির ’পর পর্যন্ত হাত নেড়ে নেড়ে এক মনসার গান। বিজয় গুপ্তের কোন কালে লেখা এক বই। একজন গায় আর পিছনে এক কি দুই জন তাল দেয়। এর চেয়ে তার কাছে মথুয়াসংগীত অনেক ভালো। চাইকি পড়ো হরিচাঁদের জীবনী। ওদিকে চৈতন্যভাগবৎও পড়া যায়, সেখানেও কিছু সার আছে। আর তা যদি না হয়, কবে কোন হাট নাকি সদর থেকে কিনেছিল একখানা গাছ-গাছড়ার নাম-ধাম-গুণ নিয়ে বই। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে হারিকেনের আলোয় তাও পড়া যায়। তার কিছুই না। গান। তাও কেউ কেউ সাত দিনের পাতায়। এ বাড়িতে সাতদিনের। একদিনে কিছুই এগোবে না। চাঁদ বেনে বেহুলা লখাই মা মনসা ইন্দ্রের রাজসভা সারাটা জীবন এই শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে। আর কত? তবু, বিষ্ণুপ্রিয়ার অমন বোনের আকুতিভরা চাহনিতে বিশ্বেশ্বর রাজি হয়। এরপর বিষ্ণুপ্রিয়া যখন কথায় কথায় বিশ্বেশ্বরের বাড়িঘরের খোঁজ নেয় তখন সে এক ফাঁকে বলে, ‘মেয়েটা আজ পথ চেয়ে বসে থাকবে। হাট থেকে চুলের ফিতা নিতে বলেছিল।’ খুব স্বাভাবিক কৌতুহলে বিষ্ণুপ্রিয়া জানতে চায়, মেয়ে কত বড়ো। ইস্কুলে যায়? দেখতে কেমন? বিশ্বেশ্বরের লগত পেলে ও মেয়েও উঁচু-লম্বা হবে।

বিশ্বেশ্বর একটু যেন সংকোচেই জানিয়েছিল, দেখতে শুনতে মেয়ে তার লক্ষ্মীমন্ত হবে। কিন্তু সরস্বতী ওরে দেখে না, কপাল খারাপ। পড়াশোনায় মন নেই মেয়ের। তবে যা শোনে তাই মনে রাখতে পারে। এমনকি কথায় কথায় বিশ্বেশ্বর জানিয়েছিল, এই যে শাস্ত্র কি মন্ত্র এ যদি একবার শোনে, পরে গড়গড় করে বলে দেয়। কথাটা নীচু গলায় বলেছিল বিশ্বেশ্বর। কারণ, এমন মনে থাকার গুণ থাকলে সেই মেয়ে ইস্কুলের পড়া কেন মনে রাখতে পারে না? বিষ্ণুপ্রিয়া সান্ত¦না দেয়। সেও অবাক হয়েছে। নামও জানতে চায়। এই প্রথম আভার কথা শুনেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। আর, এদিকে বিশ্বেশ্বর এতদিন অন্য জায়গায় মন দিয়ে রয়ানি গান শুনুক কি নাই শুনুক, এই রাতে সে বিষ্ণুপ্রিয়ার গান খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। সদ্য তাকে দাদা ডেকেছে বিষ্ণুপ্রিয়া, বিশ্বেশ্বর পেয়েছে নতুন বোন, হয়তো সেই জন্যে বিশ্বেশ্বর খুব মনোযোগ দিয়েছিল। আর, বিষ্ণুপ্রিয়া গেয়েছেও প্রাণঢেলে! বিশ্বেশ্বরের কল্পনার চেয়ে সুন্দর। সে দেখতে দেখতে ভেবেছে, কী যে সুন্দর গায়! কিন্তু এই বাড়িতে সাতদিনের পালার চার দিনের দিন কতটুকুই-বা গেয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। তবু, ওই অংশের গানটুকু বিশ্বেশ্বরের মনে থাকে। চাঁদ সওদাগরের দুরবস্থা, চাঁদ আর লক্ষ্মীন্দরের পরিচয়ের বর্ণনা যেভাবে দিয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। এত কালের শোনা ও জানা কাহিনি। তবু এই জায়গাটুকু যেন সে নিজের সঙ্গে নিয়ে সে ফেরে।

পরদিন বাড়ি এসে বিশ্বেশ্বর আভা আর বউ অহল্যাকে বিষ্ণুপ্রিয়ার কথা বলে। অহল্যা জানায়, আগেই সে শুনেছে তার রয়ানি গান এই গ্রামের হালদার বাড়িতে গেয়েছিল। বিশ্বেশ্বর তখন ওড়াকান্দি। সেই গানের আসরে ছোট্ট আভাও ছিল। তারাও বলে, বিষ্ণুপ্রিয়া সত্যি সুন্দর রয়ানি গায়। অহল্যা একথা মনে করা মাত্র, তাদের অবাক করে আভা বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই গানের আসরের একটা ধুয়ো আভা শোনায়: ‘জয় ভবানী গো মা, মুই তোর চরণে করিলাম সার।’ বিশ্বেশ্বর ও অহল্যার চোখ বড়ো হয়। তখন অতটুকু মেয়ে আভা। সেই কবে শুনেছে সে গান। আজও দেখি মনে আছে। অহল্যার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল বিশ্বেশ্বর। আভা গাইল একেবারে যেন বিষ্ণুপ্রিয়ার গলায়? বিস্মিত বিশ্বেশ্বর বলেছিল, ‘তোর গলা দেহি একেবারে বিষ্ণুপ্রিয়ার মতন! কবে শিকলি তুই এ গান!’
‘শেখলাম কোতায়। আমি খালি শুনচি’
‘হুঁ। কাইলকে বিষ্ণুপ্রিয়া গানের মাঝে একেবারে যেরাম ধুয়ো দেল, তুইও সেইরাম গাইলি’
‘ওই বিডির নাম বিষ্ণুপ্রিয়া নাকি?’ আভা বিষ্ণুপ্রিয়ার নাম জানত না, অথবা নাম জানাটা তার কাছে কোনও বিষয়ই ছিল না।
‘ওই বিডি কচ্ছিস কেন?’ বিশ্বেশ্বর আভার ওই সম্বোধনে গলায় আপত্তি নিয়ে বলেছিল, ‘তোর পিসি হয়, মা’
শুনে, অহল্যা পাশ থেকে প্রায় ফোঁস করে উঠেছে, ‘হইচে। যারে তারে আর মাইয়েরে দিয়ে পিসি-পুসি ডাইকাইয়ে না!’
‘কেন? পিসি ডাকলি হইচে কী?’
বিশ্বেশ্বরের চোখে তখন গতকালের ম্লান গোধূলি আলোয় দেখা বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই সজল টলটল চোখ! কী অপরিসীম আকুতিতে তাকে দাদা ডেকেছে। সেই মুহূর্ত থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া তার ছোটোবোন। এই সম্পর্কে মাঝখানে কোনও কেন-কিন্তু পায়নি বিশ্বেশ্বর। আজ সকালে আসার সময়ে সে বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলে এসেছে, এদিকে এসে যেন আসে তার বাড়িতে। তাদের মেয়েটাকে যেন দেখে যায়। বিষ্ণুপ্রিয়াও তাকে কথা দিয়েছে, আসবে। সঙ্গে আর্শীবাদ জানাতে ভোলেনি, যে মেয়ে দেখতে লক্ষ্মীমন্ত, সরস্বতী মাথায় নেই কে বলেছে? যদি যা শোনে তাই মনে রাখতে পারে, তা সরস্বতীরই কৃপা। এখন মা মনসা যদি বর দেয়, তাহলে, তাহলে এই মেয়ে একদিন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। তিনজনই মহাদেব শিবের কুমারী। লক্ষ্মী সরস্বতী আর মেনকা। দাদার আমার নামও বিশ্বেশ্বর। তাও তো মহাদেবরই নাম। যখন এই বলেছে বিষ্ণুপ্রিয়া, বিশ্বেশ্বর শুনেছে আর ভেবেছে, ভাবতে সে বাধ্য হয়েছে, গান গাইতে গাইতে কত সুন্দর পদ বানায় বিষ্ণুপ্রিয়া। গানের মাঝখানে এক জায়গার তাল রেখে কত সহজে এক জায়গার সুর টেনে অন্য জায়গায় নেয়, ফাঁকে প্রয়োজনে কথা বসায়। সেই মেয়ে এমন কথা তো জানবেই। এইমাত্র তাকে মহাদেব আর তার আভাকে আর্শীবাদ দিয়ে একই সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী আর মনসা সবই বানিয়ে ছাড়ল কত সহজে! তখন বিশ্বেশ্বর খুব নরম চোখে সহজ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখের দিকে। এখন অহল্যা যাই বলুক, বড়ো দরদ দিয়ে কথাগুলো বলেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। আভা যেন একদম আপন ভাইঝি। তা না হলে গলায় কারও অত টান থাকে? আবার দেখো, ওর নামখানাও বিষ্ণুপ্রিয়া, সে তো লক্ষ্মীরই নাম! ভাবতে ভাবতে সে বিষ্ণুপ্রিয়ার গলায়, দাদা ডাকটাই শোনে! কিন্তু সেই ডাকটা এখন মুহূর্তে এইভাবে অহল্যা উলটে দিলে, বিশ্বেশ্বরের মতন ওঝাই-বা এখন যায় কোথায়? কালই বড়ো শিকদারবাড়ির সাপে কাটা ছেলেটাকে ঝেড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এল, জুচখোলার তখন তার কেরামতিতে মনসার রয়ানি গানের গায়েন যদি তাকে ধর্মভাই ডাকে, সেই কথা মেয়ের সামনে এইভাবে উড়িয়ে দিতে হবে? বিশ্বেশ্বর অহল্যার দিকে চকিতে ফিরে জানতে চেয়েছিল, ‘কেন, হইচে কী? কী ভালো গায়!’
‘গাক্। ওই বিষ্ণুপ্রিয়ার কোনও ঘর-দুয়ারের ঠিক আছে? আজকে এই জায়গায় তো কালকে ওই জায়গায়। আইজকে এর সাতে তো কাইলকে ওর সাথে! জানি না ওর চাইল চরিত্তি?’
‘শুনিচি বাল্যবিধবা’
‘কেন দেখোনি হাতে শাঁখা? এহোন ওই দলের কর্তা বানাইছে দক্ষিণের এক গোঁসাইরেÑ’
একথা জেনেছে বিশ্বেশ্বর। আগেও কিছু জানত। কিন্তু তবু যেন মনে হয়, অহল্যার মতন অতটা তলের খবর জানে না। অহল্যার বলার ধরনে সে তার মুখের দিকে চেয়েছিল। আভা তখন তাদের কাছেই। তাই বিশ্বেশ্বর আর কথা বাড়ায়নি। গলা নামিয়ে অহস্যা বলেছিল, ‘মাইয়ের সামনে এর চেয়ে বেশি আর কিছু কব নানে’ হয়তো সেদিন দুজনার মাঝখানে ভবিতব্য মুচকি হেসেছিল। হয়তো, একদিন এই বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে নাড়া বাঁধবে আভা। অথবা বাঁধবে না। রয়ানি গান গাইবে! কে জানে, হয়তো ওই মুহূর্তেই তা স্থির হয়েছিল!

এরপর বলেশ্বরে অনেক জল গড়িয়েছে। গড়ানো সে জলের ধারা কমেছে, নদীও শুকিয়ে গেছে। এত দিনে নদীর এপার ওপার বলতে আর প্রায় কিছুই নেই। ভাসার হাটখোলার একটু উত্তর থেকে কচুয়া সদরের আগে পুবে মলঙ্গির চর আর পশ্চিমে শপথকাঠি পর্যন্ত প্রায় মাইল তিনেক জায়গা এক প্রমত্ত বলেশ্বর আজ আর কোনওভাবেই নদের চেহারায় নেই। দেখতে সে একেবারে খাল। কোথাও আর ক্ষীণ পগার কি নালা! বলেশ^রের এই অংশটুকু একেবারে অর্ধবৃত্তাকার, আধা গোল। টান টান ধনুকের ছিলা। উত্তরে একটি খাল কেটে নদীর প্রবাহ কালিগঙ্গা হয়ে পুব দিকের বড়ো নদী কচায় বইয়ে দেওয়ায় এই অংশটুকু শুকিয়ে গেছে। ফলে এখন এপারে ভাসা ওপারে মাটিভাঙা, একইভাবে এপারে কুচিবগা কি বৈরাগীর হাট ওপারে জুচখোলা কি মলঙ্গিভাঙা নদীর এই এপার ওপারের হিসাব আজ আর করে না। বৈরাগীর হাট এখন ছোটোখাটো বাজার। নদীর তীর ধরে সবজি খেত। সরু একটি পগারের ওপারে মলঙ্গির চরজুড়ে কলাগাছের ভিটা। নদীর এমন বদলে স্বাভাবিকভাবে দুপাশের মানুষের জীবন বদলেছে। তারও আগে বদলেছে পেশা। এপার ওপারের নৌকানির্ভর আদান প্রদান এখন পায়ে হাঁটা। যদিও একজন অন্যের পরিচয়ে এপারে লোক ওপারের মানুষ শব্দ দুটো ব্যবহার করে। এমনকি গালমন্দের প্রয়োজনে একথা বলে, ওরে ওপারের মানুষ, ওগে সাতে বুদ্ধিতে পারবা নানে। ভালো কি মন্দ যে কোনও বুদ্ধিতে পারুক কি না-ই পারুক এর ভিতরেই বহুকাল ধরে চলে আসা বৈষয়িক ও বাণিজ্যিক কারবার আর বৈবাহিক সম্পর্ক সমানে চলমান। সে অবস্থা আজও একই। যেমন অহল্যা যা-ই বলুক, মেয়ে আভার সামনে বলুক কি নাই বলুক, অথবা পরেই বলুক, বিষ্ণুপ্রিয়ার দলে আভার ভেরাই ছিল সহজ। নদীর পুব ক‚লের পাশাপাশি গ্রামের মানুষ তারা। কিন্তু সেই আভাই একদিন রয়ানি গানে ভিড়ে গেল, তার বাপের ধর্মবোন বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে নয়, কুসুমের সঙ্গে। ভাবনারও অতীত একথা। কুসুম পশ্চিম ক‚লের তালেশ্বরের মেয়ে। যদিও এই তল্লাটে সেই সবচেয়ে ভালো রয়ানি গায়। কিন্তু তালেশ্বর আর মলঙ্গিডাঙা তো একেবারে কাছে নয়। মলঙ্গিদের বড়ো চর হেঁটে কচুয়া সদর বরাবর নদী পাড়ি দিয়ে উত্তর পশ্চিমে তারপরও সোয়া মাইল পথ। সদরের কাছে ভৈরব বেয়ে জল আসায় নদীটা এখানে খানিকটা পুরনো চেহারায় দক্ষিণে নেমে গেছে। কিন্তু উত্তর দিকে এগোলেই ওই খাল কি পগার।

মলঙ্গির চরের পরে উত্তরের প্রথম গ্রাম জুচখোলা। বিষ্ণুপ্রিয়া সে গ্রামের। কিন্ত ভাগ্যেরই হয়তো ফের, পাশের গ্রামের বিশেশ্বরের মেয়ে তার দোহার হল না। এ নিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া শুরুতেই থেকে ভিতরে ভিতরে গজরেছে। ভিতরের সে গজরানি আর গুমরানি অন্তরে ছাইচাপা হয়ে ছিলও বহুকাল। যতই বিশেশ্বরকে দাদা ডাকো আর আভাকে স্নেহ করো নিজের মেয়ের মতো, পর আসলেই কখনও আপনার হয় না। এমনকি বিষ্ণুপ্রিয়া এও ভেবেছে, ওই সব মথুয়া কি পরম বৈষ্ণবের ভেকধারী মানুষজন যতই মা মনসার নাম নিয়ে ওঝাগিরি করুক না কেন, তাদের আসলেই রয়ানি গান বলো মা আস্তিকমুণির প্রতি নিবেদন বলো ওসবে বিশ্বাস নেই। এনিয়ে দ্বন্দ্ব আর কোনওভাবেই এপার ওপারের নয়। একেবারে পাশাপাশি গ্রামের। নদীর পুব দিকের। ফলে, বিষ্ণুপ্রিয়ার বিশ্বেশ্বরের প্রতি অমন রাগ হওয়া খুব স্বাভাবিক।

সেই জুচখোলা গ্রামে দুজনের পরিচয়ের পরে সময়ে সুযোগে বিষ্ণুপ্রিয়া তো বিশ্বেশ্বরের বাড়িতে কমদিন আসেনি। তখন অবশ্য বিষ্ণুপ্রিয়ার জানা ছিল না, ওদিকে বিশেশ্বর ওঝার কোনও মন্তরও তাকে জানায়নি যে তার মেয়ে একদিন বিজয় গুপ্ত মহাশয়ের সাক্ষাৎ চেলা হবে।
তবে, বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে আশা কিছু ছিল। শত হলেও বিশেশ্বর সঙ্গে ধর্মভাই পাতিয়েছে, মেয়েটি তাকে আপন করে পিসিমা ডাকে। সেও সাড়া নেয়। এই তল্লাটে কি দেশে আজ আর বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাইরা কেউ নেই। দেশ স্বাধীনের পরে এই বিধবা বোনটাকে রেখে তার ছোটদা দেশ ছেড়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া শুনেছে, ওপারে ওই দেশে গেলে মানুষের দয়ামায়া কমে যায়। তার ভাইদেরও কমেছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার কমেনি। কাঁপা অক্ষরে পাঠশালায় শেখা পাতালেখার বিদ্যায় আজও তাদের চিঠি লেখে। দাদাদের দেখতে যায়। যায় আসলে ছোটদাকে দেখতে, বর্ডার পার হলেই তার বাড়ি। সে-ই বিষ্ণুপ্রিয়াকে বাপের ভিটায় বাতি দেওয়ার জন্যে রেখে গেছে। আজও তা বিষ্ণুপ্রিয়ার মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু সাক্ষাৎ সামনে তো আর ছোটদা নেই। হয়তো সেই জন্যেই, ধর্মভাই হোক, হোক তা পাতানো, দাদা বলে ডাকার মতন বিষ্ণুপ্রিয়ার সামনে তো ওই বিশেশ্বর। প্রায় পাশাপাশি গ্রাম। বর্ষাকাদার দিনে বায়না থাকে না, তখন নৌকায়, শুকনোর সময়েও বায়না না থাকলে হেঁটে বিষ্ণুপ্রিয়া বিশেশ্বরকে দাদা ডাকতে যায়। আর সঙ্গে থাকে আভাকে দেখার টান।

প্রথম যেদিন বিষ্ণুপ্রিয়া শুনেছিল, আভা তাকে তার মামাবাড়ির গ্রামে রয়ানি গ্রামের আসরে দেখেছে, আর সেই একবারের দেখায় বিষ্ণুপ্রিয়ার দেওয়া ধুয়োটা প্রায় একইভাবে দিতে পারেÑ সেদিন থেকে বুকের একেবারে মাঝখানে টান টের পায়। যদি এই মেয়ে আসত তার দলে। এমন সংকতকার তার ভাইর মেয়ে। যা হাজার খুঁজলেও মেলে না, তা এই যে তার সামনে! একে একেবারে পড়ে পাওয়া মানিক। সাত রাজার ধন। সেই বুড়ির গল্পের মতো যে গোবরে মোহর পেয়েছিল! বিষ্ণুপ্রিয়াও পেয়েছে মা মেনকার কৃপায়। আকুল ভাবনা বহুদূর গড়ায়। একদিন তাহলে দলটা এই মেয়ের হাতে দিয়ে দুই চোখ যেদিকে যায়, চলে যাওয়া যেত!
এই দুই চোখ যেদিকে যাওয়াটাই বিষ্ণুপ্রিয়ার আসল সমস্যা। সত্যি, কাউকে কিছু না-জানিয়ে কোথায় কোথায় চলে যায় বিষ্ণুপ্রিয়া। যা জানার জানে হয়তো ওই বঙ্কু হালদার, বিষ্ণুপ্রিয়ার গোঁসাই। কিন্তু তার মুখও থাকে কলুপ আঁটা। ইশারায়ও সে কিছুই দেখায় না।

বিষ্ণুপ্রিয়ার এই হঠাৎ উধাও হওয়ার বিষয়টা যারা জানে তারা বঙ্কু হালদারের ইশারা ছাড়া অনুমানে বলে, বিষ্ণুপ্রিয়া যায় তো পশ্চিমে। তা ভালো কথা পশ্চিমে কোথায় যায়? এই থানা ছাড়িয়ে একটু উত্তর পশ্চিমেÑ বৈটপুর ভদ্দরপাড়া, উত্তর মুখে খাল পার হয়ে সুলতানপুর ধরে এগোলে তারপর আর রয়ানি গানের চল আছে? জানে সেখানকার মানুষ সাত কি তিন কি এক দিন সন্ধ্যায় মা মনসার প্রতিমার সামনে গাওয়া যায় এমন গান, যা বিজয় গুপ্তের লেখা মনসামঙ্গল? হয়তো ভদ্দরলোকরা বিজয় গুপ্তের নাম, আর মনসামঙ্গল কি পদ্মাপুরাণ জানতে পারে, ওইসব কেতা-কায়দার কথা পড়াশোনায় ভালো ভালো অক্ষরে লেখা থাকে। কিন্তু এমনিতে সেখানের মানুষের মানত করার কোনও চল নেই। ওদিকে পিরোজপুর ঝালকাঠি দক্ষিণে মোড়েলগঞ্জ শরণখোলায় দিকে যদি যেত, কিংবা শ্রীরামকাঠি থেকে বরিশালমুখী লঞ্চে উঠত তাহলে নাহয় ভাবত বিষ্ণুপ্রিয়া সেখানে গান গাইতে গেছে। তা যে যায়নি আর প্রমাণ তো বঙ্কু হালদার। বিষ্ণুপ্রিয়া পশ্চিমে পা বাড়াল তো তার বঙ্কু গোঁসাই দক্ষিণে মোড়েলগঞ্জ বরাবর চলল ব্যাগ বোঁচকা গুছিয়ে। তাহলে, বিষ্ণুপ্রিয়া পশ্চিমে যায়। খুলনা-যশোর হয়ে ইন্ডিয়া। সবাই তা বুঝে গেছে। কখনও বায়নাপত্তর নিয়ে উধাও। তাই যেন সে চাইছিল, একেবারে মনের ভিতর দিয়ে চাইছিল, আভাকে যদি গড়েপিঠে নিতে পারত। কিন্তু তখনও আভা ছোটো, তাই সে কথা বলি বলি করে বলেনি। টুকটাক নাড়াবাঁধা যাকে বলে, সেই শিক্ষা আভা বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছেই পেয়েছিল। তাছাড়া, বিষ্ণুপ্রিয়ার অমন অন্তরের কথা অন্তরে থাকার আর একটা কারণও ছিল। সে-কথা সে কাউকে বলতও না। জানত অহল্যা বউদিদির বিশেশ্বর দাদার সঙ্গে ভালোমন্দ দুটো কথা কওয়ার উপায় আছে? বিষ্ণুপ্রিয়া বুঝত, আসলে অহল্যা তাকে দেখতে পারে না। এই যে দরকারে অদরকারে কি শুধু আভার মুখখানা দেখতে এই দিকে আসে বিষ্ণুপ্রিয়া, কখনও অহল্যা তার সঙ্গে ভালোমন্দ কয়ডা কথা কয়? সেই ভাইবোন পাতানোর পরে যতবার এসেছে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রত্যেকবারই বিষয়টা খেয়াল করেছে। কিন্তু কিসের কী? অহল্যার চাহনির কোনও পরিবর্তন দেখেনি। ওদিকে ভাইবোনহীন বিষ্ণুপ্রিয়ার অন্তরে বিশে^শ^রের প্রতি বড়দার টান। আর আরও গভীর চোরাটান আভার জন্যে। পিসিমা ডাক শুনলে তার পরান জুড়ায়। কিন্তু অহল্যা বউদিদি একেবারেই উলটো। বিষ্ণুপ্রিয়া জানে, কেন বাঁকাচোখে চায় অহল্যা। হয়তো তলে তলে তাও বিশেশ্বররেরও সায় আছে। যদি সায় নাও থাকে, অহল্যার ওই চাহনিতে একটু হলেও কোঁচকায় বিশেশ্বর।

ওই চাহনির মূলে বঙ্কু হালদারের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়ার সম্পর্ক। কিন্তু তাতে বিষ্ণুপ্রিয়ার করার কী আছে? বাল্যবিধবা। ভাইদের সংসারে বউদিদের চোখের আড়ে বড়ো হয়েছে। সে জানে একলা থাকার কত সমস্যা। তখন গ্রাম বলো আর ইউনিয়ন বলো কেউ তারে দেখতে আসেনি। তাছাড়া, এমন বয়স্থা বিধবার দিকে বউ-ঝিদের চোখের ঠারও তার ভালো জানা আছে। সেই ঠারের কারণ বিষ্ণুপ্রিয়ার আশেপাশে কিলবিল করা পুরুষ! এই গানের দল নিয়ে জগতের এই যে এত জায়গায় সে চড়ে বেড়ায়, আর সে কি বোঝে না কার কী চোখের ভাষা! ওই পুরুষ মহিলারা নিজেদের ভিতরে যত রাজ্যেরই বদমাইশি করুক, বিধবারে কারও সাথে একটু ঘুরতে দেখলে কি আড়ালে আবডালে একটু কথা কইতে দেখলেই তাদের চোখ আকাশে ওঠে।

বিষ্ণুপ্রিয়া কীভাবে রয়ানি গানের গায়িকা হলে, সে কথা আজ আর কারও স্মরণ নেই। সে তখন অবশ্য বলত, আসলে সে দক্ষিণের ভুবনমোহিনীর সংগতকার। গুনে হিসাব করে দেখলে, সেও তো অনেককাল আগের কথা। বাংলাদেশ তখনও হয়নি। পাকিস্তানি জামানা। বড়ো বাবুরা দেশ ছেড়ে গেছে। তখন, মাটিভাঙা থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া মোড়লগঞ্জ সদরের একটু উত্তরে হোগলাবুনিয়ায় গিয়েছিল। সেটা তার খুড়তো বোনের শ^শুরবাড়ি। সে বাড়িতে তখন মানসিক রয়ানি গানের আসর। তিনদিনের।

বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে থাকবে, সে ছিল খরখরে শুকনোর দিন। কিন্তু ওই দক্ষিণের আকাশে সেদিন ঘন কালো মেঘে ছাওয়া। প্রবল বৃষ্টির আশঙ্কা সবার চোখে-মুখে। কিন্তু একটু বাতাস চালাল, আর বৃষ্টি হয়নি, একটু পরেই আকাশ পরিষ্কার। সেই প্রথম তার মনে হয়েছিল, বাতাসে একটু নোনা গন্ধ!
এছাড়া বিষ্ণুপ্রিয়ার আরও একটা কথা মনে থাকে। সেদিন সেই বাড়িতে সে লক্ষ্মীন্দরকে দংশন’ আর ‘লক্ষ্মীন্দরের বিলাপ’ এই দুই অংশে সংগত দিয়েছিল অনায়াসে। কীভাবে পেয়েছে সে, সে কথা স্মরণ করে আজও বিস্মিত হয়! এর আগে নিজগ্রাম আর বছরখানেকের শ্বশুরবাড়ি দুই জায়গাতেই রয়ানি গান আগে পরে শুনেছে সে। তাও যে খুব মন দিয়ে তা বলা যাবে না। তবে বিজয় গুপ্তের ওই বইখানা দেখতে কেমন সে সুযোগও হয়নি। শুধু শুনে শুনে কত পদ বিষ্ণুপ্রিয়ার অজ্ঞাতেই যেন মুখস্থ। এটা ঠিক, অনেকেই তার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করত। সেকথা শুনলে একটু হতাশ স্বরে বিষ্ণুপ্রিয়া এ-ও বলত, গরিবের মেয়ে, পড়ালেখা আর বাল্যশিক্ষার বেশি এগোতে পারেনি, তাহলে আর ওই স্মৃতিশক্তির দাম থাকল কী? তবে শুধু গরিবি নয়, পাঠশালার পরে আর লেখাপড়ার তেমন সুযোগ হয়নি ছিলও না বিষ্ণুপ্রিয়ার।

গ্রামের অনেকে অবশ্য মনে করে, বিষ্ণুপ্রিয়ার রয়ানি গান মনে থাকার পিছনের কারণ একটাই, তার স্বামীকে সাপে কেটেছিল! তারপর থেকে মনসামঙ্গল তার কণ্ঠে এমনি জায়গা করে নিয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া অন্তরে বেহুলা। অমন মানুষের গলায় এক বারেই পদ্মাপুরাণের পদ জায়গা পায়। যদিও বিষ্ণুপ্রিয়া সেকথা ভাবে না। অন্যদের মতো অনুমান করে নিয়েছে, হুঁ, মা অস্তিকমুণি দংশিছে তার প্রাণের লখাই-রুপী যতীনকে। যদিও নিশ্চিত করে সেকথা কেউ জানাতে পারেনি।

যতীন মাটিভাঙা থেকে শ্রীরামকাঠি সদরে গিয়েছিল ধানের নৌকায়। সেখানে চাল কলের আড়তের পিছনে একচালা ঘরে তাকে মরা পাওয়া যায়। সঙ্গে যারা ছিল, তাদের ধারণা সাপে কেটেছে। এর বেশি কিছুই জানতে পারেনি। এই ধানের নৌকায়ই যতীন মরা ফিরে এসেছিল। সে সময়ে কোথায় আর কী খোঁজ খবর করে। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাপ-ভাইদের-বা কী সাধ্য, কী ক্ষমতা কোথায় কেন জামাইকে ওভাবে পাওয়া গেল তার দেন-দরবার করে, থানা পুলিশ কোর্ট কাছারিতে যায়। তা যতই যতীন হোক বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রাণের লখাই, ওই বয়েসে কয়দিনই-বা দেখেছে স্বামীকে। যতীন তার কাছে প্রায় কল্পনায়। স্মৃতিশক্তি এক জায়গায় করেও বিষ্ণুপ্রিয়া যতীনের স্মৃতিকে আসলে বেহুলার লখিন্দর ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। হয়তো সেই কল্পনা থেকে, যেভাবে সে মনে মনে বেহুলা হয়ে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছে যতীনকে তাই তাকে মনে করায় লক্ষ্মীন্দরের দংশন’ আর ‘লক্ষ্মীন্দরের বিলাপ’। সেখানে যতীন লখাই হয়ে গাঙুড়ে ভাসে না, ভাসে বলেশ্বরের জলে। জলের সে ধারা নামে বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখ বেয়ে। আর যেন সে অজান্তেই পদ্মাপুরাণের ওই পদগুলো আওড়ায়। হয়তো, বিষ্ণুপ্রিয়ার ক্ষেত্রে তা-ই হয়। ভুবনমোহিনীর মতো বড়ো রয়ানি গায়িকার আসরে বিষ্ণুপ্রিয়া গলায় আঁচল পেঁচিয়ে অমন সংগত দিয়েছিল। একথা অবশ্য আজও অনেকে স্মরণ করতে পারে। বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই খুড়োতো বোন এই বুড়ো বয়েসে বছর দশেক আগে আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছিল। সে বাড়িতে সেদিনের মতো গান সঙ্গে হলে ভুবনমোহিনী উঠানের এক কোনে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুপ্রিয়াকে কাছে ডেকে বলেছিল, ‘তোমার নাম কী গো, মা?’ তারপর জানতে চেয়েছিল, ‘বাড়ি কোথায়?’ সঙ্গে এই বাড়ির ‘গৃহকর্তা তার কী হয়?’ ইত্যাদি এরপর আরও কাছে ডেকে ভুবনমোহিনী আরও জানতে চেয়েছিল, ‘এমন সুন্দর গান, এইভাবে পদ মনে রাখা, এ তুমি কোথায় শিখেছ?’ বিষ্ণুপ্রিয়া বলতে চেয়েছিল, শিখিয়েছে তার কপালে। তার মনে হয়, সেই বেহুলা! কিন্তু বলেনি। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভেজা সজল চোখ ভুবনমোহিনীর কাছে খুব আপন। তাকে ওই পদ দুটো গাইতে দেওয়া যেন মনের কথা বলতে দেওয়া।

একটু বাদে বিষ্ণুপ্রিয়ার সব কথা শুনে ভুবনমোহিনী তাকে বলেছিল, ‘মা, একলা মানুষ তুমি। যদি মন চায় আসতে পারো আমার সাথে, মা মেনকার গান সবার কাছে ছড়াইয়া দেতে। এই দলের দুয়ার তোমার জন্যে খোলা। একদিন তুমি বড়ো রয়ানি গায়েন হবা।’

এই সময়ে পাশাপাশি আর একটি ঘটনাও ঘটেছিল। ভুবনমোহিনী যখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে এইসব কথা বলছিল, তখন তাদের কাছেই দাঁড়িয়েছিল এক যুবক। সে ভুবনমোহিনী কিছু বলার জন্যে দাঁড়ানো। চোখের দৃষ্টিতে বোঝা যায়, বিষ্ণুপ্রিয়ার সংগত শুনে সেও মুগ্ধ। বিষ্ণুপ্রিয়া তাকে সেভাবে খেয়াল করেনি। হয়তো লক্ষ্মীন্দর আবেগে তখনও জড়ানো সে। বিষ্ণুপ্রিয়া অর্থ লক্ষ্মী, তাকে জড়িয়ে আছে লক্ষ্মীন্দর। ও সময়ে সেই যুবক একটু পরে ভুবনমোহিনীকে ‘বড়ো মাগো?’ বলে ডেকেছে। ভুবনমোহিনী উত্তর দেয়নি। যুবক সরে গেছে তাদের কাছ থেকে। আর পরে বিষ্ণুপ্রিয়া জেনেছে, ওই যুবক ভুবনমোহিনীর দেওরপো।

এই যুবকই আজকের বঙ্কু হালদার, অর্থাৎ বঙ্কুবিহারী হালদার। ওই বিষ্ণুপ্রিয়ার তাকে প্রথম দেখা। যদিও সেদিন আলাপ পরিচয় হয়নি। হওয়ার সুযোগও তো ছিল না। পরদিন ভোর ভোর জোয়ারের গোনে উত্তরের টাবুড়ে নাও ধরে বাড়ির অন্যদের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াও চলে এসেছিল। ওই একবার দেখায় বিষ্ণুপ্রিয়ার কেন, এইদিকের কারণই স্মরণ থাকার কথা নয়, কে বঙ্কু হালদার আর তাদের আগে আদৌ দেখা হয়েছিল কি না। একাত্তর সালে এদেশের থাকা একমাত্র ভাই, ছোটদার সঙ্গে আবার মোড়েলগঞ্জে গিয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। ওখান থেকে যদি পারে ভারতের দিকে যাবে। তখন বাগেরহাট আর পিরোজপুর সেনাবাহিনী এসেছে। মাঝখানের থানা সদরের নদীর উলটো পাড়ের গ্রামের থাকা নিরাপদ নয়। তার চেয়ে এই নদী ধরে দক্ষিণে মোড়েলগঞ্জের দিকে যাওয়া সুবিধার। বিষ্ণুপ্রিয়ার ছোটদা, তার বউ ছেলেমেয়ে আর হোগলাবুনিয়ার খুড়োতো বোনসহ সবাই চলে গিয়েছিল মঠবাড়িয়ার সাংকিভাঙায়। জায়গাটা নিরাপদ। খুড়োতো বোনের স্বামীর পরিচিত কেউ কেউ আছে সেখানে। আরও অনেকেই এসেছে। তবে, তাদের মতো পশ্চিম থেকে এই পুব দিক আসেনি, বরং পুব থেকে এদিকে এসেছে। তখন বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে হয়েছিল, তার হয়তো ভুলই করেছে। তাদের গন্তব্য পশ্চিম, আরও পুবমুখো হওয়ায় হয়তো কখনওই আর ভারতের দিকে যাওয়া হবে না।

এই সময়ে, যে বাড়িত তারা আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়া বঙ্কুকে দেখে। এটা বঙ্কুর মামাবাড়ির গ্রাম। এখানে এসে আপাতত আশ্রয় নিয়েছে। তারাও যদি সুযোগ পায়, তাহলে ভারতে যাবে। তাদের গ্রামের অনেকেই গেছে। আর যদি সে সুযোগ না পায়, শোনে বাগেরহাট-খুলনার পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে, তাহলে যাবে নদীর পশ্চিম পাড়ে। সেখানে থেকে যাবে মোড়েলগঞ্জেরও নীচে দক্ষিণে শরণখোলার রায়েন্দায়, একেবারে সুন্দরবনের কোলে। সেখানে নিশ্চয়ই খান সেনারা আসবে না।

সেই যুদ্ধদিনে, সবার মুখে চোখ সব সময়েই থমথমানি। তার ভিতরে বিষ্ণুপ্রিয়া বরং উলটো। সে একটু ভাবলেশহীন। কখনও কখনও তার মুখে হাসি বিষয়টা বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ির লোকজনের জানা। স্বামী-সন্তানহীন বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে জীবন অতি তুচ্ছ জিনিস। আশাহীন মানুষ সে, আজ এমন সংকটে মুখখানা ভাতের হাঁড়ির তলার মতো কালো করে রেখে কী লাভ! যা হবার হবে। ভগবান আজ এনেছে এখানে, কাল কোথায় নেবে তা সে-ই জানে। ফলে, বিষ্ণুপ্রিয়ার অমন আচরণে বঙ্কুও অবাক হয়নি। শুধু এই সেই কিনা নিশ্চিত হয়ে নিতে এক ফাঁকে জানতে চেয়েছিল, বাঁধালে সেই রয়ানি গানের আসরে যাকে দেখেছিল তার জেঠিমার সঙ্গে সংগত করতে, সে সে-ই কি না?

বঙ্কুর এই জিজ্ঞাসায় বিষ্ণুপ্রিয়া অবাক হয়েছিল। তার ওই যে-না সংগত তা আবার কেউ মনে রাখে! বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো অসহায় মানুষের তা মনে হওয়া স্বাভাবিক। ক্ষণে ক্ষণে তাই মনে হয়। কিন্তু বঙ্কু তাকে চিনেছে, ওই একবারের দেখার মনে রেখেছে, বিষ্ণুপ্রিয়া এই মুহূর্তে তার সংগতের কথা ভুলে তাকে মনে রাখায় বহু বহু দিন বাদে, অথবা এই প্রথম নিজেকে ফিরে পায়।
বিষ্ণুপ্রিয়া জানতে চেয়েছিল, ভুবনমোহিনী এখন কোথায়? কেমন আছে।
বঙ্কু বলেছে, সেও এখানে আছে। ক্ষয়রোগে একেবারে কাহিল। তাকে নিয়েই তাদের এখন যত চিন্তা। একটানা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। অল্পে কাহিল হয়ে পরে। একটু কুঁজো দিয়ে গেছে।
সত্যি তাই। একটু পরে ভুবনমোহিনীকে দেখে বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখ থেকে কথা সরে না। এ কাকে দেখছে? এই আট নয় বছরে একজন ভালো স্বাস্থ্যের মানুষের শরীরের এই দশা হয়?
উলটো দিকে ভুবনমোহিনীর একটু জড়ানো কথায় জানায়, বিষ্ণুপ্রিয়া এখন আরও ডাঙর। দেখতে কী সুন্দর হয়েছে মুখখানা।

ভুবনমোহিনীর এইসমস্ত বলতে বলতে খেয়াল ছিল না, সে একজন বিধবার রূপের প্রশংসা করছে। ভুবনমোহিনীত বিধবা, তার ছেলেমেয়েরা সব বড়ো। একজন সঙ্গেই আছে। কলেজে পড়ে। সে ছেলে বলেছে, যুদ্ধে যাবে। ভুবনমোহিনী যেতে দিতে চায়নি। তবে বঙ্কু বলেছে, কোনদিন চলে যায় তার ঠিক নেই। ওর মতিগতি ভিন্ন। গ্রামে কারও সাথে মেলে না। বিএম কলেজে কাদের সঙ্গে মেশে, ধর্মে কর্মেও কোনও মতি নেই। এইসব গানকেও বলে লোকাচার। এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।

ওদিকে বঙ্কু তবে কেন আছে এখানে? সে তো জোয়ান মানুষ। জেঠাতো ভাইটার যুদ্ধে যাবার কারণ যদি সে বুঝে থাকে, তাহলে সে কেন যাবে না? দিন দুয়েকের ভিতরে সে কথাও জানতে পারে বিষ্ণুপ্রিয়া। বঙ্কুর যুদ্ধে না যাওয়ার কারণ ভুবনমোহিনী। সে অনেকদিন আগে। বঙ্কু তখন ছোটো। পাতলা পায়খানা আর বমিতে তার পরান প্রায় ঠোঁটের আগায়। বঙ্কুর বাপ-মা তাকে ঘর থেকে বারান্দায় জায়গা দিয়েছে। ছেলের তাদের বাঁচন নেই। মানত করেছে মা শীলতার কাছে। ফিনকি দেওয়া দাস্ত! এতটুকু বাচ্চার অমন দশা আগে কেউ দেখেনি, হয়তা শুনেছে। তাই বলে এমন দশা! তারা এই সন্তান দিয়ে দিয়েছে মা শীতলার নামে।
কিন্তু এত কিছুর ভিতরে ভুবনমোহিনী একবারও বঙ্কুর কাছ ছাড়া হয়নি। চোখ কোঠরে ঢুকে-যাওয়া, মুখ শুকিয়ে পাংশুটে দেওয়া ছেলেকে প্রায় বুকে আগলে সারাটা বাড়ির বসে থেকেছে পাশে। ভুবনমোহিনী তখন প্রায় ঘোষণা দিয়ে বলেছিল, ‘এই ছেলের আমি মা মনসার নামে উৎসর্গ করলাম। সেই কানিবুড়ি বাঁচাবে বুকের ধনকে।’ ভুবনমোহিনী আর জানিয়েছিল, এরপর এই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামকে গ্রাম রয়ানি গান গাইবে সে। হারাতে দেবে না। বাঁচলে এই ছেলে তার।
তারপর থেকে তাই। ভুবনমোহিনীর সন্তান এই বঙ্কু। তার ভাষায়, মা মনসা শুনেছে তার ডাক। সেই অসীম কৃপাময়ী দেবাদি দেবের কুমারীই বাঁচিয়েছে তাকে। তবে এরপরও বঙ্কুর ডাকটা সেই বড়োমাই রয়ে গেছে। আবাল্য সে ডাকের কোনও পরিবর্তন হয়নি।
অমন রোগগ্রস্ত ভুবনমোহিনীকে রেখে বঙ্কু তবে যুদ্ধ যায় কী করে। বঙ্কু জানে, ভুবনমোহিনীর ছোটোছেলেকে যুদ্ধ যাওয়ার অনুমতি দেবে না। তবুও সে যাবে। তাহলে বঙ্কু কী করে যায় তার বড়োমাকে একলা ফেলে!
এরপর বঙ্কু সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়ার বাকি পরিচয়ে ভুবনমোহিনীর কিছু ভূমিকা আছে। সেই সানকিভাঙা থেকে নদী পার হয়ে তারা চলে গিয়েছিল আরও দক্ষিণে, শরণখোলার রায়েন্দায়। কদিন বাদে ভুবনমোহিনীর ছোটোছেলে সত্যি উধাও। সে সুন্দরবনের গহীনে যাচ্ছে বলে গিয়েছিল। পরে বঙ্কু শুনেছে, সেখানে একদল মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তখন ভুবনমোহিনীকে দেখার জন্যে থাকে একমাত্র বঙ্কুই। ভুবনমোহিনী শরীর অনাহার অনিদ্রায় আগের চেয়েও ভেঙে পড়েছে। এর ভিতরেও এই এলাকার অনেকেই তাকে রয়ানি গায়িকা হিসেবে চিনতে পারে। তবে সে গান গাইতে কেউ আবদার অবশ্য করে না। সে সুযোগও তো নেই। এবার এ গ্রামে মানুষ শ্রাবণে মনসা পুজোই দিতে পারেনি বলতে গেলে। যা দিয়েছে, কোনওমতে শুধু ঘট স্থাপনই সারা। পাঁঠা বলি হয়নি কোথাও। যাদের মানসিক বা মানত ছিল তারাও ওই আয়োজন বাদ দিয়েছে। সবার মনে শঙ্কা।

এর ভিতরে ভাবলেশহীন শুধু দুজন। ভুবনমোহিনী আর বিষ্ণুপ্রিয়া। রয়ানির সুর না ভেঁজে ভুবনমোহিনী তো থাকতে পারে না। সে গুনগুনায়। বঙ্কুকে কাহিনির সূত্র ধরিয়ে দিতে অনুরোধ করে। বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলে তার সঙ্গে সংগত দিতে। বিষ্ণুপ্রিয়া দেয়ও। এই করে অমন অনিশ্চিত পরিবেশে অস্থির সময়ে ভুবনমোহিনী আনন্দে থাকে। আর ভাবলেশহীন বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্য করে, ক্ষয়ে যাওয়া ভুবনমোহিনীর গলায় তখনও কী ধার! কী অদ্ভুত গায়কী। যদিও সেই আগের সেই ভুবনমোহিনীর আজ আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। কাহিনীর সূত্র হারায়। বঙ্কুও তো সূত্রধর হিসেবে তেমন পাকা হয়ে ওঠেনি, তবু যেটুকু যা পারে। বিষ্ণুপ্রিয়াও যতটুকু জানে তাতেও সব সময় ধরিয়ে দিত পারে না কথার লব্জ! তবু লোক জমে। মানুষের এমন ঘোরতর দুর্দিনে, নদীতে ভেসে আসা লাশের মাঝখানেও এই গান সেই গহীন জঙ্গলময় গ্রামকে কোনও কোনও সন্ধ্যায় একটুক্ষণের জন্যে হলেও প্রাণ ভরিয়ে তোলে! না-থাক তখন তাদের সামনে মা মনসার এক চোখ কানা মূর্তি কি ঠিলা অথবা এমনকি কোনও পট!

এ সময়ে এক সন্ধ্যায় রাতে ভুবনমোহিনী বিষ্ণুপ্রিয়াকে গলা নামিয়ে কোমল স্বরে আবদার করে বলেছিল, ‘ওমা, আমি দুই চোখ বোজলে তুমি নিবি আমার দলের দায়িত্ব? ক’ ও মা’
সেই ঘোরঘুট্টি অন্ধকার অমাবশ্যার সন্ধ্যাটার কথা মনে থাকবে বিষ্ণুপ্রিয়ার। একটু আগে আধাখেচড়া করে গাওয়া রয়ানির পালা শেষ হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে ছিল ভুবনমোহিনীর দিকে। শরীর তো আর নেই। শুধু হাড়মাংস। কণ্ঠার হাড় জাগানো। সব সময়েই প্রায় পড়ে যায় যায়। এখন জীবন এমন অনিশ্চিত। কোথায় কখন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। এর ভিতরেও এই বুড়ির রয়ানি গাওয়ার হাউস গেল না। নাকি এই গান গাওয়া মানেই বঙ্কুর বেঁচে থাকা। তলে তলে এমন কোনও মনোবাঞ্ছা আছে নাকি বুড়ির?
বিষ্ণুপ্রিয়া অপলক চেয়ে দেখেছিল। কাকে দেখছে সে? এ কোন ভুবনমোহিনী? এখন বিষ্ণুপ্রিয়া তারে কী বলবে? সে তো এই গানের কিছুই জানে না। গ্রাম-গ্রামান্তরে শুনে শুনে যা দুই এক কলি গাইতে শিখেছে সেই যোগ্যতায় ভুবনমোহিনীর সঙ্গে সংগত দিয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া ভেবেছিল সে থাকে ভাইয়ের কাছে। ওইটুকু যার মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেই মানুষকে মনোমোনিহীর মতন মানুষ নিতে বলছে একটা রয়ানি গানের দায়িত্ব! ওদিকে ভুবনমোহিনীর দলের আজ এখন এখানে আছেটা কী? সঙ্গে তার এই এক ভাসুরপো! বুড়ির মাথা ঠিক আছে তো?
এই কয়দিনে ভুবনমোহিনীও বিষ্ণুপ্রিয়াকে ভুল চেনেনি। আর বিষ্ণুপ্রিয়াও তাকে তুমি করে মাসি ডাকে। দুজনের সম্পর্কও তো বেশ গাঢ়। ফলে, বিষ্ণুপ্রিয়ার ভুবনমোহিনীকে কিছুই বলার ছিল না। অমন প্রস্তাবে তার দশা প্রায় ভেবাচেকা খাওয়ার। বিষ্ণুপ্রিয়া বিহŸল চোখে বঙ্কুর দিকে তাকিয়েছিল। যেন বঙ্কু এখন পারলে এখান থেকে ভুবনমোহিনীকে সরিয়ে নিয়ে যাক। নয়তো সে ওই একই কথা বারবার বলবে।
বঙ্কু তা করে না। বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখের বিহŸলতা সে পড়তে পারে না। আজ যতই কাবু শরীরে হোক, হোক প্রায় মাজাভাঙা, এতদিন দলচালানো ভুবনমোহিনী নিশ্চয়ই কোনও হিসেব করে বিষ্ণুপ্রিয়ার এই প্রস্তাব দিয়েছে।
ওদিকে বিষ্ণুপ্রিয়ার উলটো গোঁ। তাকে দিয়ে দল চালানো? জীবনে কোনওদিন মনসামঙ্গলের পাতা উলটেও দেখেনি সে। হায় হায়! দুর্যোগের দিনে ভুবনমোহিনী তাকে এসব কী বলছে?
এ কথা মনে করিয়ে দিতেই ভুবনমোহিনী প্রবল আত্মবিশ্বাস গাঢ় চোখে বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ওরে দেশ কি একদিন স্বাধীন হবে না? কত ছয় দফার গান শুনিচি উত্তর দেশে। শেখ সাহেব আইচে বক্তিমো দিতি। এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে। আমরা আবার রয়ানি গান গাব।
হ্যাঁ, ভুবনমোহিনীই ঠিক। এর মাস খানেক বাদে দেশ স্বাধীন হয়। ভুবনমোহিনী বাড়ি ফেরে মানুষের কাঁধে চেপে। কিন্তু তার সেই কলেজপড়–য়া ছেলেটা আর ফেরেনি। এরপর বেশিদিন বাঁচেনি মনোমহোনী। বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে বঙ্কুরও কিছুদিন কোনও যোগাযোগ থাকেনি।
এর বছর পাঁচেক বাদে হঠাৎ একদিন জুচখোলায় বঙ্কুবিহারী এসে হাজির। ঘটনাটা এমন যে যদি সে সময়ে না আসত সে তাহলে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে তার কোনওদিন আর হয়তো দেখাই হত না।
যুদ্ধের পর পর বিষ্ণুপ্রিয়ার সেজদা দেশে এসে ছোটদা তার সঙ্গে ভারতে যেতে বলে। বউ ছেলে মেয়ে রেখে সে যায়। আবার আসে। কিন্তু জমি বেচে ভারতে জমি কেনে। আবার আসে। বছর পাঁচেক সে এই করে। কিন্তু ওই যে সেজদার সঙ্গে প্রথম যেদিন গেছিল ছোটদা সেদিনই বিষ্ণুপ্রিয়া বুঝেছিল, ছোটদাও একদিন সব বেচে চলে যাবে। বিষ্ণুপ্রিয়াও যাবে তার সঙ্গে। প্রায় সব ঠিক। আগের বার বউ ছেলে মেয়ে রেখে এসেছে। এবার দুই ভাইবোন। জনমের মতো বাপ-ঠাকুদার ভিটে ছেড়ে চলে যাবে।
সে সময়ে এসেছিল বঙ্কু হালদার।
এ কাকে দেখেছে বিষ্ণুপ্রিয়া। সেই যুদ্ধ দিনে যাকে দেখেছিল সেই তুলনায় এই কয়েক বছরে লোকটা বেশ মোটা হয়েছে। একটু বেঢপ যেন।
ফলে, আগের তুলনায় খাটো লাগছে। গায়ের রঙে সেই উজ্জ্বলতা নেই।
এসেই বঙ্কুবিহারীর এককথা। আবার দল চালাবে। তার বড়োমার চিরদিনের ইচ্ছা। এতদিন এটা ওটা করে সে বাঁচতে চেয়েছে, পারেনি। মা মনসার কৃপা নেই। আর কোনও কাজ পারে না। বড়োমার সঙ্গে রয়ানির দলে থেকে আজ সে আসলেই অকম্মা!
ওদিকে বিষ্ণুপ্রিয়ার তো বঙ্কুর কাছে একটাই প্রশ্ন, তার খোঁজ কীভাবে জানল। যদি সে এখানে না-থাকত?
বঙ্কুর উত্তরও ছিল একটাই, গ্রামের নাম মনে ছিল তার। মনে ছিল বিষ্ণুপ্রিয়ার ছোটদার নাম ও পদবি। গ্রামে ঢুকে গুষ্টির নাম পদবি বললে মানুষ নিশ্চয়ই খোঁজ দিতে পারবে। এই ভেবে সে চলে এসেছে।
কেন জানে, হয়তো এতদিন এই জন্যে যাই যাই করে ছোটদার সঙ্গে যাওয়া হয়নি বিষ্ণুপ্রিয়ার। একদিন তার কাছে আসবে বঙ্কুবিহারী।
জুচখোলার বিষ্ণুপ্রিয়ার জীবনে জুড়ে গেল হোগলাবুনিয়ার বঙ্কুবিহারী হালদারের সঙ্গে।

একথা সত্যি, কেন কখন কীভাবে বিষ্ণুপ্রিয়ার জীবনে বঙ্কু হালদারÑ গ্রামবাসী কখনওই জানতে চায়নি; বরং এক তরফা বাঁকা চোখে তাকিয়ে তাকে দোষ দিয়ে গেছে। দোষের বাতাস দ্রæত বয়। উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে সময়ও লাগে না। ফলে, জুচখেলা থেকে কোনায় মালিপাটন হয়ে মলঙ্গিডাঙা পর্যন্ত এসব দ্রæত প্রবাহিত হতে কতটুকুই-বা সময় লেগেছে। সেই বহমান হাওয়ার প্রভাব চিরটা কাল বিষ্ণুপ্রিয়ার বয়ে যেতে হবে। নদীর পুব পার হয়ে পশ্চিম পাড়েও তা একই। এই যেমন, বিষ্ণুপ্রিয়ার জানা আছে, এই যে সে বিশ্বেশ্বর মলঙ্গির সামনে; পাতানো ধর্মভাই তার, তাকে দেখতে এসেছে, আভার খোঁজ নিচ্ছে, এই সময়ে অহল্যা বউদিদি তার দিকে কীভাবে তাকাচ্ছে!

বিষ্ণুপ্রিয়া তো এসেছিল আভাকে তাকে দেয়ার কথা বলতে। আভা সংগত দেবে তার গানে। তারপর মেয়ে বড়ো হয়ে যদি বিয়ে-থার কথা ওঠে তখন ভাবা যাবে। আপাতত বিষ্ণুপ্রিয়া আভাকে গড়েপিঠে নিতে চায়। মনের গভীর তার ইচ্ছে, একদিন দলের দায়িত্ব নেবে আভা। সে বিশ্বেশ্বরের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে, অহল্যাকে এটা-ওটা কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে। অহল্যার বাপের বাড়ির দিকের খররাদি নিয়ে কথা বলে। তারপর বিষ্ণুপ্রিয়া বোঝে, আজ আর কোনওভাবেই আভাকে নিয়ে কথা তোলা যাবে না। বিষ্ণুপ্রিয়ার কেন এমন মনে হয়েছিল সে জানে না। তবে অহল্যা কিন্তু যা বোঝার ঠিকই বুঝেছে। সেদিন বিষ্ণুপ্রিয়া চলে যাবার পর পর সে বিশ্বেশ্বরকে বলেছিল, ‘মাইয়ের দিকে নজর পড়ছে তোমার ওই ধম্ম বুইনের!’ বিশ্বেশ্বর আকাশ থেকে পড়েছিল। তার ওঝাগিরি মন্তর এমন আভাস তো দেয়নি! সত্যি নাকি? অহল্যা এত বোঝে। এই গ্রামের মানুষ কি নদীর আর পারের কচুয়া খালিসাখালি শপথকাঠির মানুষ যতই বলুক, মলঙ্গিদের বুদ্ধির সঙ্গে পারা যায় না, সেকথা অবশ্য বিশ্বেশ্বরের সঙ্গে কোনওভাবেই সত্যি নয়। চালিতাখালির মলঙ্গিদের ভিতরে বিশ্বেশ্বরই

বুদ্ধিতে খাটো। হয়তো তাও নয়। মানুষটাই একটু আত্মভোলা। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে উদাসীন। এই নদীর সিকস্তিতে চর বাড়ে। নদী পশ্চিমে এগিয়ে যায়। মলঙ্গিদের গুষ্টির নামে পরিচিত চর, লোকমুখে মলঙ্গির চর। সেখানে যাদের জমি আছে প্রত্যেকেই চর-লাগোয়া নতুন জমির নামে ফি-বছর ডিসিআর কাটে। ধান লাগায়। তাদের গোলায় ধান বাড়ে। ব্যতিক্রম শুধু বিশ্বেশ্বর। এতে যেন তার কোনও হেলদোল নেই। ভাগে জুটলে জুটল, নইলে নেই। ও নিয়ে অফিস কাছারিও দৌড়ানোর মানুষ সে নয়। তার জ্ঞাতিগুষ্টি আর গ্রামবাসী মনে করে, কীসব মন্তর-টন্তর পড়ে আর মথুয়ার দলের সঙ্গে ডঙ্কা পিটিয়ে জীবন পার করে দেওয়ার ধান্দায় আছে লোকটা। অথচ মেয়েটা বড়ো হচ্ছে, পরে আছে আরও দুইখানা সেদিকে যদি একটু নজর দিত। একথা অহল্যাও প্রায় সব সময়েই বলে। আভাও বোঝে, তার বাপ এক উদাসী মানুষ! অহল্যার অমন অনুমানের কথা শুনে বিশ্বেশ্বর চকিতে তার চোখে দিকে চেয়েছিল। গলায় একটু সন্দেহও রেখে তখন জানতে চায়, ‘তুমি তা বোঝলা কী কইরে?’
অহল্যা যেন কিছু কথা জানানোর সুযোগ পেয়েছিল। এমনিতে কখনওই তার কথায় কোনও অনুমোদন না-দেওয়া, গুরুত্ব না-দেওয়া, মতামত উড়িয়ে দেওয়া বিশ্বেশ্বরের তাহলে কথাটা মনে ধরেছে!
অহল্যা বলেছিল, কেন তার মনে হয়েছে। অবশ্য সে-কথার আগে একটু উষ্মাই প্রকাশ করে, ‘দেহো, এইসমস্ত রয়ানি গাইয়ে বেড়ানো বিটি মানুষের মতিগতি আমার ভালোই জানা আছে। তা যতই তোমারে ধম্মো ভাই ডাইক্কা দাদা-দাদা করুক’
অহল্যার প্রায় সব কথায় ধর্মভাই-ধর্মবোন মনে করিয়ে দেওয়া যে একটা খোঁটা বিশ্বেশ্বর তা বুঝতে পারে। বুঝেও কিছু বলে না সে। এখন অহল্যার কথা তার শোনা দরকার। কেন তার মনে হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়ার নজর পড়েছে আভার দিকে। তাই অহল্যার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে। বসা থেকে উঠে যায় না। বরং বলেছিল, ‘তোমার কী জন্যি ওইয়ে মনে হইচে তাই কও’
অহল্যা অবশ্য জানে না, কেন তার অমন মনে হয়েছে। হয়তো সবটাই তার অনুমান। অনুমানও করেছে সে বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখ দেখে। আর মনে হয়েছে, শেষবার বিষ্ণুপ্রিয়ার কথায়। ওই যে বারবার আভার দেওয়া গানের একটা ধুয়োর কথা বলে। কবে কোথায় আভা তার গান শুনেছিল, শোনার পর থেকে সেই যে ধুয়োটা দেয় আভা, তা বিষ্ণুপ্রিয়া ধরিয়ে দেয়, সেটা নাকি বিষ্ণুপ্রিয়ার দোহাররাও অত ভালো দিতে পারে না। তা কেউ পারুক কি না-পারুক, অমন ধুয়ো দেয়া মেয়ে নিশ্চয়ই এই তল্লাটে আরও আছে। যদি দরকার লাগে তাদের কাছে যাও।
এরপর বিশ্বেশ্বরকে অহল্যা বলেছিল তার আরও কী মনে হয়।
এই যে আভার এত প্রশংসা, এই যে দাদা ডেকে একেবারে ঝুলে পড়া, ভাইরা কেউ এই দেশে এই দেশে নেই সেই উছিলায় সময়ে অসময়ে দেখতে আসা; ‘ও দা, দাদাগো’ বলে অমন উতলা স্বরে ডাকা সবটাই তাদের মেয়েটাকে দলে নেবার জন্যে। বিষ্ণুপ্রিয়ার দিন গেছে নগুছগু করতে করতে এখন যদি আভাকে দলে নিয়ে কিছুদিন দল চালাতে পারে। দলও থাকল, তারপর একদিন টুক করে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।
প্রায় একনিশ্বাসে বিষ্ণুপ্রিয়ার সম্পর্কে নিজের ধারণার সকল কথা বলেছিল অহল্যা। বিশ্বেশ্বরও তা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। কথা হয়তো একেবারে মিথ্যে বলেনি অহল্যা। একটু অমনোযোগে ঘরের বারান্দা থেকে দিগন্তে তাকিয়ে বিশ্বেশ্বর ভেবেছিল, মেয়ে মানুষের চোখ, সেই চোখেই বোঝে অন্য মেয়ে মানুষের চোখে কী মতলব আছে।
এসব তো বিষ্ণুপ্রিয়ার জানা কথা নয়। সে একদিন বিশ্বেশ্বরের কাছে সেকথা পড়ে। বিশ্বেশ্বর সেদিন সত্যি অবাক হয়েছিল। যে অহল্যার বুদ্ধির প্রতি তার এতকাল কোনও ভরসা ছিল না, সে ভরসা কিছুটা বাড়ে। সে আবারও একই কথা ভেবেছিল, মেয়েরাই বোঝে মেয়েদের চোখ!
বিষ্ণুপ্রিয়াকে এড়াতে, সেদিন থেকেই বিশ্বেশ্বর মনে মনে বুদ্ধি আঁটে। তা তার জন্যে শাপে বর কি অন্য কোনও অনিষ্ট ডেকে এনেছিল কি না, সে পরিণতি অবশ্য সে কেন, অহল্যাও দেখে যেতে পারেনি।
কুচিবগার দিক থেকে ফিরছিল বিশ্বেশ্বর। শেখমাটিয়ার হাটে কিছু বাজার সদাই করবে। তারপর ফিরে আসবে চর সোনাকুরের ভিতর দিয়ে। যদি বৈরাগীর হাটের কাছে খেয়া পায়, তাহলে সেখানেই নদীর পার হবে। নয়তো আর একটু দক্ষিণে এগিয়ে যাবে টেংরাকালি। সেখানে খেয়া যাবে নিশ্চিত।
এই গ্রামকে গ্রাম হাঁটায় বিশ্বেশ্বর মনে মনে ভাবছিল যদি রঘুনাথপুরের হরলালের সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত। তাকে সে মনে করিয়ে দেবে, দেখা হলে শুধু বিয়াই ডাকলেই হবে না, হয় তার নিজের ছেলের বউ করে নিক অথবা নাই নিক, তার মেয়েটার জন্যে একটা পাত্র যেন দেখে। মেয়ে তার বড়ো হয়েছে। অনেকদিন তো হরলাল আসে না এই মলঙ্গিডাঙা। হরলালকে আসতে বলবে তাদের বাড়ি। আসলে এ ছিল বিশ্বেশ্বরে জন্যে ঢাল। বিষ্ণুপ্রিয়া আন্তরিক আহ্বানকে উপেক্ষা করার জন্যে তার নিজস্ব প্রস্তুতি। তবে, এই সবই ছিল শুধু বিশ্বেশ্বরের ভাবনায়। তার মতো মানুষের কোনও সংকটেই প্রায় কোনও প্রস্তুতিই থাকে না কোনওদিন। ভিতরে ভিতরে অস্থির আর ভেবাচেকা খাওয়ার দশা হয়। সেই দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে এসব ভাবে। মেয়েকে সে কোনওভাবেই বিষ্ণুপ্রিয়ার রয়ানির দলে যেতে দেবে না।

বিশ্বেশ্বর জানে, মেয়ে তার দেখতে সুন্দরী! একহারা গড়ন। মাথাভরতি চুল। নাকটা খাড়া। বিশ্বেশ্বর একটা বোন অল্প বয়েসে মারা গিয়েছিল, এই মেয়ে দেখতে একেবারে সে-রকম। ফলে অন্তরে অন্য ভয়ও তার পিছন ছাড়ে না। যদি তার মেয়েটাও ওই বোনটার মতন আকালে মারা যায়? ওদিকে লেখাপড়ায় মন নেই। বিশ্বেশ্বর খেয়েপরে বেঁচে থাকা মানুষ। কয়েক বিঘা জমি তার সম্বল। তাই দিয়ে সারা বছরের খোরাক। মেয়ে রয়ানি দলে গেলে বদনামের অন্ত থাকবে না। তখন কার হাতে দেবে মেয়েকে? সে উপায় তার জানা নেই। হয়তো এই ভাবনায়, আভাকে নিয়ে চিন্তার দোটানায় হরলালের কথাই মনে পড়েছে বিশ্বেশ্বরের। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, প্রায়ই হয় আর-এক। শেখমাটিয়ায় প্রত্যেক হাটেই হরলাল আসে। অথচ সেই দিন আসেনি। এমন কিন্তু হবার কথা নয়। আবার, সেই দিনই শেখমাটিয়ায় হরলালকে না পেয়ে সে এক হাঁটায় বৈরাগীর হাটখোলায় আসে। কিন্তু কে জানত সেখানে তার বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা হবে? নিশ্চয়ই বিশ্বেশ্বরের ভাগ্যে লেখা ছিল। নইলে এইভাবে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায় বিষ্ণুপ্রিয়া?

সেদিন বৈরাগীহাটের হাটবার নয়। সুনসান হাটখোলা। পাশেই বাঁক ঘুরে সোজা দক্ষিণে বয়ে চলেছে বলেশ্বর। এই সোজা নদীর ওপারে ধুধু চরের দক্ষিণ মাথার মলঙ্গিডাঙায় বিশ্বেশ্বরে বাড়ি। বাঁকের কাছে একটু শুকিয়ে আসা নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে বিশ্বেশ্বর অনুমান করে কোন জায়গায় তার বাড়ি।

নদীসিকস্তি মলঙ্গির চর থেকে বিশ্বেশ্বর মাথা ঘুরিয়েছে। তাকে আর খানিক দক্ষিণে হেঁটে টেংরাখালি যেতে হবে। এ সময়ে হঠাৎ বিশ্বেশ্বরের সামনে হাজির বিষ্ণুপ্রিয়া। শেষ বিকালের রোদে মুখখানা কালো লাগছে। কালো হলেও বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখে লাবণ্য আছে। সেখানে সামান্য ক্লান্তি। চুল জবজব করে সর্ষের তেল দিয়ে আঁচড়ে টেনে বেঁধেছে। তেলে কপালের এপাশ একটু ভেজানো। মাথা ধরা রোগ আছে বিষ্ণুপ্রিয়ার। ওটা বাড়লে কপালে ওভাবে তেল দেয় সে, বিশ্বেশ্বর জানে। কিন্তু হঠাৎ বিষ্ণুপ্রিয়া এখানে উদয় হওয়ায় বিশ্বেশ্বর যেন ভ‚ত দেখছে। মুহূর্তে তার অহল্যার বলা কথা মনে পড়ে। সেই অনুমানের কথা তখনই হালকা ঢোঁক গিলে তখন নিজের ভিতরে রেখে দিয়েছিল সে।

যেখানেই দেখা হোক বিষ্ণুপ্রিয়া বিশ্বেশ্বরকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। এখনও তা-ই করেছে। তারপর উঠে জানতে চায়, এখন কোথা থেকে আসছে সে, কোথায় গিয়েছিল। বিশ্বেশ্বর মোটামুটি বিস্তারিত বলে। বৈরাগীর হাটের একচালাগুলোর সামনে বেঞ্চি নেই। কোনও কোনও হাটে চারদিকে খোলা একচালার পাশে তক্তাপেটানো বেঞ্চি থাকে। এখানে বসার সুযোগ নেই। তবে মাথার উপরে গাছ আর ছায়া আছে। বিশ্বেশ্বরের মনে হয়েছিল, একটু পা-থামিয়ে বসতে পারলে হত। কিন্তু এখনও তো আর জিরানোর সুযোগ নেই। আরও দুটো গ্রাম শপথকাঠি আর সম্মানকাঠি পাড়ি দিয়ে তাকে টেংরাখালি যেতে হবে। ততক্ষণে আলো কমে আসবে। অমাবশ্যার গোন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে যাবে। এতটা পথ বাকি। যদিও বাতাস আছে, তবে গরমের তাপ আজ আর কমবে না। যেমন সব সময়ে বলে সেভাবেই বিষ্ণুপ্রিয়া বিশ্বেশ্বরকে বলেছিল, ‘এহোনো এতদূর পথ, আমাগো বাড়ি লও, ও দাদা।’
বিশ্বেশ্বর জানিয়েছিল, তা এখন কী করে হবে। হাতে কিছু বাজার সদাই। বরং বিশ্বেশ্বর ভেবেছিল, বিষ্ণুপ্রিয়াকে তার সঙ্গে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু বলেনি। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়িতে বঙ্কু এখন একা। নাকি সে বঙ্কুর কথা জানতে চাইবে। কিন্তু তা বলার আগেই, নদীর সেই পাড়ে দাঁড়িয়ে, ডাইন পায়ের বুড়ো আঙুলে একটু মাটিতে খুঁচতে খুঁচতে বিষ্ণুপ্রিয়া আগে কখনও ঠারে ঠারে কখনও মিনমিন করে বলা কথাটা এবার জোর দিয়ে বলেছিল, ‘ও দা, এতদিন ধইরে কব কব ভাবি, তারপরও কওয়া হয় না; ভাবছি একদিন বাড়ি যাইয়া বুঝোইয়ে কব, তবু বউদির সামনে কইতে পারলাম না; ভাবি বউদি কী না কী কয়?’
বিশ্বেশ্বর ভাবছিল, অহল্যা তাকে যা বলেছে, তাই বলে? যদিও মুখে বলে, ‘আমি তোর দাদা না? কী কবি ক’
বিষ্ণুপ্রিয়া সরাসরি বলেছিল, ‘তোমার বড়ো মাইয়েডারে আমারে দেও। আমি আর কয়দিন’
‘কইস কী? বিশ্বেশ্বর এমনভাবে বলল যেন বিষয়টা সে প্রায় বুঝতেই পারছে না। অথবা বুঝলেও এই মুহূর্তে বিষ্ণুপ্রিয়ার কথা কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা ভালো করে বুঝে নিতে চাইছে।
বিষ্ণুপ্রিয়া তার কথাই বলে গিয়েছিল প্রায় গোঁ ধরার মতন করে, ‘দেও, ও দা। আভা মা আমাগো দলডা চালাউক। ওই বঙ্কুবাবুর বড়োমার হাতে গড়া দল। আমি আর কয়দিন?’
বিশ্বেশ্বর যেন এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পেরেছে; কিন্তু বুঝেই সে উলটো দিকে যায়, ‘সেয়া হয় নারে বিষ্ণুপ্রিয়া। কীসের কী? ওই মাইয়ে জানে নাকি রয়ানি গানের কিছু?’
‘হবে। পারবে। যা সুন্দর গলা ভাইঝির আমার। এক দুই বৎসর আমার সাথে দোহারি করতে করতে সব পারবেÑ’
‘না রে বুন্ডি, সেয়া হয় না। আমি এই ওঝাগিরি করি সেইয়ে নিয়ে মানষি কত কথা কয়। আর তারপর আমাগে মলঙ্গিডাঙার মাইয়ে গাবে রয়ানি গান! আমাগো জ্ঞাতিগুষ্টির মানুষ কবে কী? তুই বাদ দে’
‘তয় আর কী কব?’ বিষ্ণুপ্রিয়ার গলায় হতাশা নয়, প্রায় বিষাদ। বিশ্বেশ্বর রাজি না হওয়ায় সে দুঃখ পেয়েছে।
বিষ্ণুপ্রিয়ার কালো মুখখানা আরও কালো হয়ে গিয়েছিল। যেন হঠাৎ দক্ষিণের আকাশে জমা মেঘ এসে মুখখানা ছেয়ে দিয়েছে। অথবা, অমাবশ্যার সন্ধ্যার অন্ধকার ঝুপ করে নেমেছে একটু আগেই। গাছের পাতায় যে বাতাস, তাও যেন থমকে গেছে। বিষ্ণুপ্রিয়া একটু ধরা গলায় বলেছিল, ‘ওদা, যাই তয়, এই বুইডার কথা মনে রাইক্কো।’ একথা হয়তো সে বলার জন্যে বলে। তবে সঙ্গে যুক্ত করেছিল, ‘আভা তো আমারও মাইয়ে। ওই কথাডা আমি আবারও তোমারে মনে করাইয়ে দেব’
কিন্তু ওই কথা বিশ্বেশ্বরে আর মনে করিয়ে দেয়ার সুযোগ হয়নি বিষ্ণুপ্রিয়ার। তার আগেই বিশ্বেশ্বর আভার বিয়ে দিয়ে দেয় তার অনেক দিনের বন্ধু হরলালের ছেলে হরষিতের সঙ্গে।
সেই বিবাহ বাসরে নিশ্চয়ই প্রজাপতির কৃপা ছিল, কিন্তু তার জামাতা মহাদেব শিব যেন তা উলটে দেওয়ার জন্যে নীরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করেছিল। অথবা, হতে পারে দেবাদিদেব শিব চেয়েছিল, আগে তার শ্বশুরের মনোবাঞ্ছাপূর্ণ পুরন হোক, পরে তার কন্যা মনসার। কেননা, এই বিয়ের কদিন পর থেকে হরষিত দেপাড়ায় কুসুমের দলে ঢোল বাজায়। আর কিছুদিন বাদে আভা কুসুমের সংগতকার।
তখন পর্যন্ত কুসুম এই তল্লাটের প্রধান রয়ানি গায়িকা। তার মা গাইত, দিদিমাও। তার কোনও মেয়ে নেই। আভাই ধীরে ধীরে যেন হয়ে ওঠে কুসুমের মেয়ে।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিষ্ণুপ্রিয়া প্রায় হতবিহŸল! কোত্থেকে কী হয়ে গেল। মনে মনে তার প্রায় সাজানো বাগান এইভাবে তছনছ করে দেবে বিশ্বেশ্বর তা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। ফলে সে বছর সিজনের সময়ে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রথম উধাও হয়। হাতে তার অনেকগুলো বায়না নেওয়া ছিল, মাঘের শেষ কি ফাল্গুন পড়লেই সে দল নিয়ে গাইতে বেরুবে এমন কথা ছিল, সেখানে কোথায় কী?
বিষ্ণুপ্রিয়াকে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়েছে একথা বলতে বঙ্কুবিহারী বিশ্বেশ্বরে বাড়িতে আসে। বিশ্বেশ্বর তো কিছুই জানত না। আগেও লাপাত্তা হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। তা সাধারণত সিজনে নয়। তাছাড়া যখন অনেকদিন বিশ্বেশ্বরদের গ্রাম কি পথে কোথাও বিষ্ণুপ্রিয়ার দেখা পেত না, তখন বুঝত নিশ্চয়ই ইন্ডিয়া গেছে। বর্ষা কাদার দিন, বাড়িতে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে এই সুযোগে ভাইদের কাছে থেকে ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভালোই করেছে মেয়েটা। তখন বঙ্কুবিহারী হয়তো চলে যেত নিজ গ্রাম হোগলাবুনিয়ায়।
হঠাৎ বঙ্কু হাজির হয়ে কোনও ভ‚মিকা ছাড়াই বিশ্বেশ্বরের কাছে জানতে চায়, ‘দাদা, আপনার বুইনের কোনও খবর জানেন?’
বঙ্কুর চোখে-মুখে উদ্বেগ। প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে হেঁটে এসেছে। বিশ্বেশ্বরের কাছে কথাটা এমনভাবে জানতে চেয়েছে যেন সে এখন কী করবে, কোথায় যাবে জানে না। নিরুপায় হয়ে এখানে এসেছে। তার কথার উত্তর দেওয়ার আগে বিশ্বেশ্বরও একটু অবাক হয়ে বঙ্কুর দিকে তাকিয়েছিল। তার দীর্ঘ দেহের দৃষ্টি তাই বঙ্কুর মাথার উপর দিয়ে পিছনে বাড়ির সীমানায়। কী বলবে সে।
বঙ্কু আরও বলে চলে যেন বিশ্বেশ্বরের উত্তর তার জানাই আছে, ‘পরশু সকাল সকাল বাড়ি দিয়ে বাইরোইচে। তারপর আর ফেরেনি। এমন তো যায়। ভাবলাম, আইজ কাইলকের ভিতর ফিরে আসবে। কোথায় কী? এমন গেলে তো একদিন আধদিন এখানে ওখানে থাকে, তারপর আবার চইলে আসে।’
বলার ঝোঁকে আর গতিতে এমনভাবে বঙ্কু বলেছিল কথাটা, যেন বিশ্বেশ্বরের উত্তরের তার দরকার নেই। ওদিকে বিশ্বেশ্বরেরও তো বাকিটুকু জানাই আছে যে এমন কখনও কখনও উধাও হয় বিষ্ণুপ্রিয়া।
কিন্তু যেটুকু শুনে বিশ্বেশ্বরেরও কপাল ভাঁজ পড়েছিল, তাহলে, এমন সিজনে উধাও হয় বিষ্ণুপ্রিয়া।
বঙ্কু বলেছিল, ‘কাইলকে সন্ধ্যায় চারাখালির মন্ডলবাড়িতে সাতদিনের গান শুরু হবে। দলের অন্যরা সবাই এসে গেছে। কেউ আসার পথে’
এই সময়ে খোঁজ নেই বিষ্ণুপ্রিয়ার? বঙ্কুর কথা শুনতে শুনতে সব সময়ের উদাসী বিশ্বেশ্বর আরও উদাসী। এখনও পর্যন্ত সে প্রায় কোনও কথা বলেনি। সে বিড়বিড় করে বলেছিল, ‘এই সময়ে, গানের বায়না নিয়ে কোথায় যাইয়ে ডুব দেল?’ নিজের কণ্ঠস্বরের উদাস ভাবের ভিতরে বিশ্বেশ্বরের মনে হয়েছিল, আভাকে তার সঙ্গে না দেওয়ায় এই কান্ড ঘটাল না তো!
সেকথা বিশ্বেশ্বর বলে না। বঙ্কুর সামনে বলাও যায় না। ওদিকে বঙ্কুও যেভাবে এসেছিল, মুহূর্তে সেভাবে চলে যায়। উঠান থেকে দাওয়ায় এসে বসেনি। এক গ্যাস জলও হয়নি। অথবা, সে সুযোগ দেয়নি। অহল্যা বাড়ির পিছনেই ছিল, সেও জানেনি বঙ্কু এসেছিল!
এতে বিশ্বেশ্বরের আরও মনে হয়, বঙ্কুও হয়তো এমন এসে এমন চলে যাওয়ায় এই ইঙ্গিতই দিয়ে গেল যেন, আভাকে না দেওয়াকেই এভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া!
চাইলে বিষয়টা সেভাবে ভাবাই যায়, যদি বিষ্ণুপ্রিয়ার দিক থেকে কেউ ভাবে। আবার বিশ্বেশ্বরের সেখানে দোষ কী? সে তো বিষ্ণুপ্রিয়াকে কথা দেয়নি। একবারও বলেনি। বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে কোনও কিছু লুকায়ওনি। আবার হরলালের ছেলে সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা বলেছে, তাও জানত বিষ্ণুপ্রিয়া। হরলাল রাজি হলে হরষিতের সঙ্গে আভার বিয়ে হবে, তাও একদিন খলিসাখালি থেকে ফেরার পথে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময়ে বলেছিল বিশ্বেশ্বরের মনে আছে। তাহলে এর ভিতরে আভাকে তার সঙ্গে দেওয়া না-দেওয়ার সম্পর্ক কী? নাকি এইসব নিজের মনে আপনে আওড়ে ওঝাগিরি করছে বিশ্বেশ্বর। যেমন সে সাপেকাটা রোগী দেখে আগেই কখনও ভাবে অনুমানে। এ সবই তার অনুমান?
বিশ্বেশ্বর অহল্যাকে কিছুই বলেনি। তবে গোটা বিষয় মাথা থেকে নামিয়েও দিতে পারেনি। বারবার তার মনে পড়েছে বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই আকুতিভরা মুখটার কথা। বৈরাগীর হাটখোলায় যেদিন বিশ্বেশ্বরকে বলেছিল আভাকে দিতে। কী হত আভাকে দিলে? আভা পারে কিছু? তাতে ওই দল চালানোর কী লাভ লোকসান হত বিশ্বেশ্বর সত্যি জানে না। বিষ্ণুপ্রিয়া বলেছিল, আভা তারও মেয়ে। আভাকে পেলে দলটাকে গড়ে পিঠে নিতে পারত। কিন্তু বিশ্বেশ্বর তা চায়নি। চাইত যদি সামান্য হলেও অহল্যার সায় থাকত। এমনকি, যদি হরলাল হরষিতের সঙ্গে আভার বিয়েতে রাজি না হত, তাহলেও ও কথা মাথায় আনা যেত। তাছাড়া, হয়তো বিশ্বেশ্বরেও বঙ্কুর সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়ার সম্পর্ক নিয়ে মনের তলানিতে খচখচানি কিছু ছিল!
আভাকে তার দলে না-দেওয়ায়, অথবা আভাকে না-পাওয়ায় বিষ্ণুপ্রিয়া হঠাৎ এমন নিরুদ্দেশ! বিশ্বেশ্বরের কাছে এর কোনও উত্তর নেই। তবু মাথা থেকে এই ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারে না সে। উদাস তাকিয়ে থাকে। আনমনে ভাবে, হোক পাতানো তবু বোনটা তার কোথায় গেল?
দিন দুয়েক বাদে, দুপুরের আগে আগে এমন ভাবনার ফাঁকে বিশ্বেশ্বর হঠাৎ আভার কারণে বিষ্ণুপ্রিয়ার নিরুদ্দেশের অন্তত একটি কারণ হাতড়ে পায়। হয়তো সে কারণটি বিষ্ণুপ্রিয়ার দিক থেকে যুক্তিযুক্ত, বিশ্বেশ্বরের দিক থেকে নয়।
বিশ্বেশ্বরের মনে হয়েছিল, ওই যে হরষিতের সঙ্গে আভার বিয়ে হয়েছে, তার কিছুদিন বাদেই হরষিত খোল বাজানোর জন্যে কুসুমের দলে যোগ দিয়েছে এটাই কারণ। যদিও সিজন শুরু হয়নি, হবে হবে। এর ভিতরে কয়েক জায়গায় রাজিও হয়েছে হরষিত। আর, নতুন বউ আভাকে বাড়ি রেখে যাওয়ার চেয়ে হরষিত তার সঙ্গেই রাখতে পারে। কারণ, মহড়ার সময় কুসুম খেয়াল করেছে, মেয়েটির গানের গলা ভালো, কোনও কোনও ধুয়ো সুন্দর টেনে তুলতে পারে। হরষিতের সঙ্গে দলে যদি তার বউও থাকে, সে তো ভালো কথা। ফলে, সিজনের আগেই এখানে ওখানে খুচরা রয়ানির আসরে কুসুমের সহযোগী আভা।
এই সংবাদ নিশ্চিত বিষ্ণুপ্রিয়ার কানে গেছে। নাকি বিষ্ণুপ্রিয়া দেখেছে কুসুমের সঙ্গে আভাকে গাইতে। তারপরই আভা তার হাতছাড়া হয়ে গেছে এই শোক ভুলতে বিষ্ণুপ্রিয়া নিরুদ্দেশ!
বিষ্ণুপ্রিয়া আসলে কেন নিরুদ্দেশ হয়েছিল, সেকথা আজও কেউ জানে না। এমনকি এরপরও সে মাঝে মধ্যে নিরুদ্দেশ হবে, কেন হবে তার কারণও কেউ জানবে না।
বিশ্বেশ্বর শুধু ভেবেছিল, যদি কখনও বিষ্ণুপ্রিয়াকে পায়, অথবা হঠাৎ তাদের বাড়িতে এসে উদয় হয়, তাহলে জানতে চাইবে কেন এমন হঠাৎ উধাও হয়ে যায়? আর, আভাকে তার হাতে না দেওয়ায় সে কি তার কি বিশ্বেশ্বরের উপর কোনও রাগ আছে?

এদিকে কুসুমের দলে আভা, হরষিত খুশি। বাপের কথায় বিয়ে করেছে সে। আভাকে চিনত, গ্রাম গ্রামান্তরে যেভাবে চেনে একজন আরেকজনকে। আভার বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি, মাঝখানে দুটো গ্রাম। হরলালের কাছে বিশ্বেশ্বরের যাতায়াত ছিল। আভা হরষিতের অপরিচিত নয়, বরং হরষিত আভার কাছে কিছুটা অপরিচিত। মাঝখানের গ্রাম জুচখোলায় কখনও-সখনও এসেছে সে, কিন্তু রঘুনাথপুরে আগে কখনও আসেনি। আভাদের সমস্ত যোগাযোগ নদীর ওপারের গ্রামগুলোর সঙ্গে। সেখানে একটা থানা সদর, অনেকগুলো হাট, একটা দুটো গঞ্জ। তাছাড়া বিশ্বেশ্বর মলঙ্গির সরাসরি কি লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয়স্বজন নদীর ওপারেই বেশি। এমনকি শ্বশুরবাড়িতে এসেও সে বুঝতে পারে এদিকের লোকও তাই। তাদের কাজ কর্ম-বাজার ঘাট বেশির ভাগেই ওপারে ভাসার কি দেপাড়ায়। আর, কুসুমও দেপাড়ার। এখন সময়ে অসময়ে আভা আর হরষিতের ঠিকানাও ওই কুসুমের বাড়ি।

কুসুমের দলে আভার জায়গা পাওয়াটা অবশ্য একটু আকস্মিক। বিয়ের পরে প্রথম কয়েকদিন একবার বাপের বাড়ি একবার শ্বশুরবাড়ি এই করে কেটেছে। কখনও কোনও আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া। এই করে কিছু দিন কাটানোর পর পরই, হরষিত বউকে নিয়ে বাড়িতে থিতু হতেই হরলাল ছেলেকে জানিয়েছিল, এতকাল গায়ে বাতাস লাগিয়ে খেয়েছে। আর না। বাপের জমি জায়গা তেমন নেই। তা চাষবাস করে কী পাওয়া যায় কি যায় না, তা হরষিতের ভালোই জানা আছে। এখন বউ নিয়েও একইভাবে সে জীবন কাটাবে, তা যেন না-ভাবে।
একথায় হরষিত অবাক হয়নি। বাপকে সে ভালোই চেনে। আভার বাপের মতন না। জীবনে কোনওকিছুতেই ওই উদাসীনতার ধার সে ধারেনি। বরং, সব বিষয়ে তার একটু বেশি বোঝার ধাত আছে। তাতেই জীবনে যে কায়বার যার ডোবার ডুবেছে। তাতেও শিক্ষা হয়নি। তবে হরষিতকে হরলাল কথাটা বলার পরে বুঝেছে, এনিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাছাড়া ঠিকই বলেছে, বিয়ে করেছে হরষিত, বউর ভরণপোষণের দায়িত্ব তার। কিন্তু হরষিতের যোগ্যতা কী? এই প্রশ্ন যদি কেউ তাকে করে, তাহলেই সে দিশা হারায়। গ্রামের আর দশজনের মতন জমির কাজ জানে। সে তো আষাঢ়ে শ্রাবণে। ইদানীং মাঘ ফাল্গুনে ইরির কাজ হয়। এর বাইরে আর কী? বাপের যেটুকু জমি তাদের তা তারা দুইভাই মিলে এক সপ্তাহেই পাতো (বীজ ধান) লাগানোর উপযোগী করতে পারে। তখন জন খাটতে পারে আন্যের জমিতে। এর বাইরে জানা আছে আর কোনও আয় রোজগারের পথ?
সে-পথ একটাই খোলা আছে, খোল বাজানো। হরষিত আগে কীর্তনের দলে বাজিয়েছে। বাজিয়েছে রয়ানি গানের আসরেও। তবে আগে কখনও বাজিয়ে পেট চালাবে, সংসারের খরচ মেটাবেÑ একথা ভেবে কিছু করেনি। সেই সব দল থেকে কিছু দিয়েছে, সে নিয়েছে। কয়েকদিন তাদের সঙ্গে থেকেছে, ঘুরেছে। থাকা-খাওয়া আর যা কিছু হাত খরচ জুটেছে, তাতেই খুশি ছিল হরষিত। এবার হরলাল তাকে সত্যি জীবনের হিসাবের খাতায় তুলেছে।

হরষিতের বড়দা হরবিলাস বাপের এ প্রস্তাবে খুশি। এমনকি আভাও। গত কয়েক মাসে মানুষটাকে যতটুকু বুঝেছে, তাতে মনে হয়েছে, চাপে পড়লে কাজ করে। অন্যথায় গায়ে বাতাস লাগিয়ে খেয়ে বেড়ানো পাবিøক। যদি দেখে মাইট্রে তলানিতে আর কিছুদিন চলার মতো চাল মজুদ, ভিটায় সবজি আছে আর নদী কি খাল থেকে মাছ ধরে আনতে পারে, তাহলে হরষিত করবে কাজ? তখন গ্রামের আনাচে কানাচে পয়সা দিয়ে মার্বেল খেলে কিংবা তাস পিটিয়ে সময় নষ্ট করবে কে? কিন্তু সে কাজ করার সুযোগ তাদেরই থাকে, যাদের সারা বছরের খোরাক জমি থেকে আসে। হরলালের বাপ-ঠাকুর্দার সে সম্বল প্রায় ছিলই না। আজও বাড়েনি, বাড়ার কারণও নেই। হরবিলাশ বরং নদীর ওপারে জন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হরষিত সে তুলনায় গায়ে বাতাস লাগানো।

কুসুমের সঙ্গে দেখা করার বুদ্ধিটা হরষিতকে দিয়েছিল হরবিলাসের বউ নমিতা। হরলালের অমন কথা বউদি হিসাবে তার খারাপই লেগেছে। সবে বিয়ে হয়েছে তার দেওরের। এই সময়ে ঠাকুরমশায় উঁচুগলায় না হোক তবু অমন কড়া কথা না শোনালেও পারত। কিন্তু সে বুঝতে পারে, তাতে সায় আছে তার স্বামীরও। বিড়বিড় করে বলেছিল, বউ আইচে ঘরে এখন যদি গায়ে বাতাস লাগিয়ে খাওয়াটা একটু কমে। কারও কথাই ভালো লাগেনি নমিতার। সে আভাকে বলেছিল, হরষিত মানুষটা ভাই এট্টু ওইরাম। এবার যদি তোমারে পাইয়ে সিধে হয়। কত কিছু কয় আমার শ্বশুর। তোমার ভাসুর। শোনে না।

আভা তখন চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থেকেছে। তখনও জানে না জীবন আসলেই এমন। তারপর বলেছে, ‘আমি কইয়ে আর কী করতি পারব? তুমি কও… আমিও কবানে’
নমিতা আভার কথায় খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল, বুদ্ধি আছে তার জায়ের। আভা ওই কথা না বললেও সে বলত। তাই সুযোগ পেয়ে নমিতা হরষিতকে বলেছিল, ‘তুমি যা সুন্দর খোল বাজাও। যাবা নিকি একবার কুসুম মাসির কাছে?’
কথাটা নমিতা আভার সামনেই বলেছিল। আভা চেনে না কুসুমকে। জানে না, কী করে সে। কিন্তু নমিতা হরষিতের সুন্দর খোল বাজানোর কথা বলায় সে বুঝেছে, যার কাছে গেলে খোল বাজিয়ে দুটো পয়সা রোজগারের সুযোগ আছে। হরষিত কিছু বলার আগেই নমিতা আরও যোগ করেছিল, ‘তুমি যদি যা’তি চাও, তা’লি বড়দারে ক’বানে কুসুম মাসির সাথে কথা কওয়ার জন্যি’ হরষিত তখন অবশ্য কিছু বলেনি। নমিতার কথায় সে একটু অবাকও হয়নি। এই বাড়িঘরে বাপ-মা বলো আর ভাই বোন বলো, তার এই খোল বাজানোয় কারও যদি কখনও খুশি মুখ দেখেছে তা বউদির। এখন হরষিত বিয়ে করায়, নিজের ঘাড়ে সংসারের এক অদৃশ্য দায়িত্ব পড়ায়, নমিতা তার ওই গুণটাকেই কাজে লাগানোর কথা বলেছে। কুসুমকে ভালো মতোই চেনে হরষিত। নমিতার মামাবাড়ির দিক দিয়ে পরিচিত। নমিতার মা আর কুসুম একই গ্রামের, প্রায় সমবয়েসি। নমিতার মাসি ডাকটা শুধু উপরি পরিচয়ের ডাকই নয়, এর ভিতরে সেই জোরটাও আছে যে নমিতার বড়দা কুসুমের কাছে প্রস্তাবনা পড়লে সে কোনওভাবেই ফেলতে পারবে না।

ওই সময়ে হরষিত কিছু না-বললেও হরবিলাস ভাসার হাটখোলায় নমিতার বড়দাকে পেয়ে কথাটা জানিয়ে রাখে। তার দিন দুয়েক বাদেই কুসুমের দলের অধিরাজ আসে হরষিতের কাছে। কী কী দেবে কুসুমের দলে গেলে, আর কবে থেকে বায়না নেওয়া শুরু হবে সবই তাকে সময়মতো জানাবে অধিরাজ। দেপাড়া রঘুনাথপুর থেকে নদীর ওপারে একটু দক্ষিণ পশ্চিমের গ্রাম। অধিরাজের বাড়ি দেপাড়া থেকে কাছে, সানপুকুরিয়ায়। সে সিজনের সময় ছাড়াও প্রায়ই কুসুমের বাড়ি যায়। ওই দলে সে হারমোনিয়াম বাজায় অনেক দিন ধরে।
অধিরাজকে হরিবলাস আর নমিতা চেনে। সানপুকুরিয়া রঘুনাথপুর নদীর এপার ওপার একদম কোনাকুনি গ্রাম। চেয়ে পড়লে যেন দেখা যায়। সানপুকুরিয়ার পরে রাস্তা পথে আন্ধারমানিক তারপরই রঘুনাথপুরের খেয়া। সানপুকুরিয়া থেকে সোজা তাকালে নদীর যে বাঁকটা চোখে পড়ে, তার উলটো দিকে চরময় গ্রামটাই রঘুনাপথপুর। এ-ও যেন হরষিতের জন্যে একটা ভালো সুযোগ। সে বাজাবে খোল, অধিরাজ হারমোনিয়াম। সিজনে হরষিত নদীর পার হয়ে যাবে অধিরাজের বাড়ি। সেখান থেকে সিদে পশ্চিম মুখে হেঁটে দেপাড়া অথবা যে বাড়িতে গানের আসর থাকবে সেখানে চলে যেতে পারবে একসঙ্গে দুজন।

অধিরাজকে হরষিতও চেনে, তবে নমিতা কিংবা হবরিলাসের মতো সে আগে কখনও তার হারমোনিয়াম বাজানো শোনেনি। নাকি শুনেছে? শুনেছে হয়তো, সেভাবে খেয়াল করেনি। কীর্তনের খোলায় কিংবা নামযজ্ঞে অথবা রয়ানি গানের আসরে নিজে উপস্থিত না-থাকলে কারও বাজনাই কখনও মনোযোগ দিয়ে দেখার মানুষ হরষিত নয়। তবে এমন না যে একেবারেই কাউকে চেনে না। কুসুম হয়তো একটু অপরিচিত, কিন্তু তার গান সম্পর্কে সে জানে। এই থানায় আর নদীর ওপারের থানায় অথবা এই যে তল্লাট এখানে সবচয়ে ভালো রয়ানি গান সে-ই গায়। সেই দলের অধিরাজ এসেছে। এটা অবশ্য আভার জন্যেও একটু অবাক হওয়ার। নমিতা তার কাছে হঠাৎ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
অধিরাজদের কথা শুনে ভিতরের ঘরে নীচু স্বরে আভা নমিতাকে বলে, ‘ও দি, এই লোকরে আপনি চেনেন? সত্যি ওই কুসুম মাসির দলে হারমোনিয়াম বাজায়?’
‘কেন? বাজায় তো। কী হইচে?’
‘না, এই লোকরে আমি মনে হয় আগে একদিন দেহিচি। বাবার সাথে কচুয়া দিয়ে ভ্যানে আসতেছিলাম তহোন’
‘সেয়াও মনে আছে?’
‘না, মাথা ভরতি ওই রাম লম্বা চুল, আর ওইরাম খাড়া নাক। আরও কয় বছর আগে তো, আগে বুন্ডির সাতে মানষির চেহারা দিয়ে কত পদের কথা কতাম। সেদিন বিভাও আমার সাথে ছেল, দুই বুইনে ওইয়ে নিয়ে কতা কইলাম, সেই জন্যি মনে আছেÑ’
আভার কথার সারল্যে নমিতা তাকে দেখেছিল। সত্যি, নাকটা অধিরাজের একটু বেশিই খাড়া। মাথায় চুলও প্রচুর। একটু বেশিই লম্বা, ঘাড়ের কাছ পর্যন্ত। তবে গায়ের রংটা কারও মনে রাখার মতো নয়। কালো নয়, কালের কাছাকাছি। পেটানো শরীরে তা ঠিকরে বেরোয়। এই যে প্রায় মাইলখানেক পথ হেঁটে এসে বারান্দায় লাছা পাটিতে বামহাত ভর দিয়ে বসেছে, তাতে হাফ হাতার জামার বোগলের পর থেকে পুরো বাহু বেরিয়ে আছে, তা সবল আর উজ্জ্বল! আভার চোখে তা হরষিতের ঠিক উলটো। পরিষ্কার গায়ের রং হরষিতের, কিন্তু সে রঙে উজ্জ্বলত্ কম। তাদের দুই ভাইয়েরই রং প্রায় একই। কিন্তু হরষিতের গায়ে একটু পলকা হলেও হরবিলাসের চেয়ে কাঠামোয় সুন্দর।
সেদিন অধিরাজ চলে যাওয়ার পরে নমিতা হরষিতকে একটু কটাক্ষ করে বলেছিল, ‘নেও, হইয়ে গেইচে! এহোন বাড়ির ধান কয়ডা কাইটে মলন দিয়ে কয়দিন বাবুয়ানা দিয়ে বউ নিয়ে ঘুরে বেড়াও।’
এ বাড়িতে আসার পর থেকেই আভা লক্ষ্য করেছে, নমিতা কথা জানে। কথা জানে মানে, আভার তুলনায় তো বটেই অনেকের চেয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কাকে কখন কোন কথা বলতে হবে, কাকে কী বললে কাজ হবে, তাও খুব ভালো বোঝে। যে কথাটা নমিতা হরষিতকে বলেছে তাতে সে রাগ হবে না, কিন্তু কথার ভিতরের খোঁটাটা যদি বুঝতে পারে। আভা তো এখনও লোকটাকে বুঝে উঠতে পারেনি। এই যে নমিতা এত কিছু করছে, এ নিয়ে একটা খোঁচাও দিল, তাতে হরষিতের চোখের কোথাও কোনও ভাঁজ পড়েনি।
তবে হরষিত কুসুমের দলে খোল বাজানোর সুযোগ পাওয়ায় আভা খুশি। আর শ্বশুরের কথা শোনা লাগবে না। বাড়ির সবারও চোখে-মুখে খানিক স্বস্তি!

১০

অঘ্রানে বউদের বাপের বাড়ি যাওয়ার রেওয়াজ নেই। আভা তবু বারবার ভেবেছে, যদি একবার সে বাড়ি যেতে পারত। তাতে অন্তত আর বাবাকে একটা কথা বলা যেত, এই ধানের সময়ের পরে তাদের জামাইর একটা কাজ জুটেছে। আর কাজটা একই প্রায়, রয়ানি দলে খোল বাজানো। যে রয়ানি গানে সংগত দেওয়ার জন্যে বিষ্ণুপ্রিয়া পিসি বারবার তার বাপের কাছে আভাকে চেয়েছিল সেই রয়ানি গান আভার জীবন থেকে সরছে না! যদিও আভা তখনও জানে না, জানার সুযোগ নেই, তাকেও একদিন গাইতে হবে কুসুমের সঙ্গে। তখন উত্তরে বাতাসে পিঠ দিয়ে এ বাড়িতে থাকা একটা খিরন-উঠে-যাওয়া খোলে যখন ধীরে ধীরে বোল তুলত হরষিত, তখন অজ্ঞাতসার আভার কেন যেন মনে হত, ওই বোলের তালে তাকেও গলা মিলাতে হবে একদিন। বারবার ভাবত সে, যদি তাই হয়, যদি তাই ঘটে, তাহলে বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে ওই গানের কায়দা কানুন লব্জ ধরন কি ছাড়ন একসময়ে শেখা দরকার ছিল তার। আবার মনে পরত, সেই পয়লা যেদিন তাদের বাড়িতে এসেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া, সেদিন কি তারও পরে কতবার মনসামঙ্গল থেকে একটি দুটি পদ গেয়ে তাকে তার সঙ্গে ধরতে বলত। আর ফাঁক পেলে আভাকে মনে করিয়ে দিত সেই কথা, বিষ্ণুপ্রিয়াকে সেই পয়লা দিন দেখে কী সুন্দর একটি ধুয়ো সে গেয়ে দিয়েছিল। এত গ্রাম ঘোরে বিষ্ণুপ্রিয়া, ঘুরতে ঘুরতে এই জীবনের তিনকাল গেছে, তবু আজও সে এমন মেয়ে কোথাও পায়নি। আর পাবেও না। তাই বুঝি কথায় কথায় আভাকে ওই কথাটা বলত সে। আভাবে যদি পেত, তাহলে তার গুরুমা ভুবনমোহিনীর হাতেগড়া দলটাকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারত।

যদিও এসব কথার কিছু সে তার বিয়ের আগে শুনেছে, কিছু শুনেছে বিয়ের পরেও। অহল্যা একটু ঝামটা দিয়েই বলেছিল, ওই রয়ানি গাওয়া বিডির ধান্দা ছিল মেয়েটাকে নেওয়ার। আভার বিয়ে দিয়েছে, এখন আর তাই সে সুযোগ নেই। হয়তো সে কারণে মেয়েকে বলা যায় এমন সেই পুরনো কথা। কিন্তু, হরষিতের কুসুমের দলে পাকা কথা হওয়ার পরে, আভার অবস্থা উলটো। তার বারবার কেন যেন মনে হয়, সত্যি বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে আর-একটু শেখা থাকলে এখন কাজে লাগত। তখন, ওই সংবাদটা দিতে আভার বাপের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ না-ঘটলেও, বিশ্বেশ্বর এসেছিল। হঠাৎ, বলা নেই কওয়া নেই এমনভাবে বিশ্বেশ্বর আসবে তাই স্বাভাবিক। সেভাবেই এসেছিল। মলঙ্গিভাঙা থেকে কোনও কাজে এসেছিল শেখমাটিয়া, যেমন সে আসে। তারপর কী মনে করে একটু পশ্চিমে এই রঘুনাথপুর। এরপর হয়তো নদীর পার হয়ে ভাসায় কোনও কাজ সেরে হেঁটে যাবে কচুয়ায়। সেখান থেকে খেয়া পার হয়ে আবার চালাতখালি নিজেদের গ্রাম। ওই করে। বিশ্বেশ্বর মলঙ্গির লম্বা পা ফেলে গ্রামকে গ্রাম হাঁটাÑ তাকে পথে দেখলেই অনেকেই জানে উদ্দেশহীনভাবে কোথাও যাচ্ছে লোকটা। হাতে একটা চাটর থালি। গায়ে খাটো ফতুয়া, পরনে আটহাতি খাটো ধুতি। কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসার উদ্দেশ্যেই হয়তো আজ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল বিশ্বেশ্বর। নইলে পরনে পাঞ্জাবি, ঘাড়ে ভাঁজ করা চাদর থাকত না। পায়ে প্লাস্টিকের পাম স্যুও আছে। শীতকাল আসি আসি করছে বলে? না, শীতকালেও বিশ্বেশ্বর এত পরিপাটি হয়ে বোরোয় না। যাক, সেদিন বাপকে দেখে আভা খুশি। কী বৃত্তান্ত, কেন এসেছে তা জানতে চাইল না। বরং, বাবাকে দেখতে সুন্দর লাগছে, পথভুলে হলেও মেয়েকে দেখতে এসেছে। আভার জন্যে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে। হয়তো সেই ঝোঁকে আভা বিশ্বেশ্বর আসার একটু পরেই হরষিতের কুসুমের দলে সে খোল বাজানোর খবরটা দিয়েছিল। আর, আভা খেয়াল করুক কি না-ই করুক, নমিতা দেখেছিল হঠাৎ খানিকটা হলেও বিশ্বেশ্বরের মুখটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আভাকে সেকথা পরেও কখনও বলেনি নমিতা। বলবে ভেবেছিল, কিন্তু বলা হয়নি। তবু নমিতা ভেবেছিল, তালুই মশায়ের মুখখানা অমন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে কেন?

আভার কাছে ওই খবর শোনামাত্র বিশ্বেশ্বরের বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখখানা মনে পড়েছিল। যদিও তখন পর্যন্ত হরষিতেরই শুধু খোল বাজানোর কথাটাই শুনেছে সে, কিন্তু এই সময়ে বিশ্বেশ্বর ওঝা যেন গুনে গেঁথে দেখতে পেয়েছে, জামাই যদি রয়ানির দলে খোল বাজায় তাহলে মেয়ের সেখানে কুসুমের সঙ্গে সংগত দিতে আর কয়দিন? তাহলে বিষ্ণুপ্রিয়া যে তার কাছে আভাকে চেয়েছিল, সেই কথাই তো ফলল। বিষ্ণুপ্রিয়ার দলে নয় ঠিকই, কিন্তু যে দলেই হোক, সেই রয়ানি গানই তো। সেদিন, একটু পরেই বিশ্বেশ্বর আভার শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছিল। বারবার তাকে খেয়ে যেতে অনুরোধ করেছে নমিতা। সেই সঙ্গে আভাও। এমনকি তার বন্ধু হরলালও। কাজ আছে, এখনই যেতে হবে, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল, তাই এমনি এসেছে, আর একদিন আসবে, আজ নয় এইসব বলে চলে এসেছিল বিশ্বেশ্বর। পথে নেমে বিশ্বেশ্বরের মনে হয়েছে, আচ্ছা, আজ হোক কি কাল হোক, যদি আভা রয়ানি গান গায়, তাহলে বিষ্ণুপ্রিয়াকে সে মুখ দেখাবে কী করে?

রঘুনাথপুর খেয়াঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে সেই উত্তর হাতড়ায় বিশ্বেশ্বর। একবার মনে হয়, নদী পার না হয়ে সিদে দক্ষিণে হেঁটে জুচখোলায় আভার বাড়ি গিয়ে কথাটা বলে আসেÑ তুই আমারে ক্ষমা করিস। মনে হয় জামাই আভারে দিয়ে গান গাওয়াইয়ে ছাড়বে।

১১

কিন্তু এইসমস্ত ঘটে যাওয়ার ফাঁকেই তো এক সকালে বঙ্কু এসে বিশ্বেশ্বরের বাড়িতে হাজির হয়েছিল। তাহলে, সেখানে কোথায় কী ঘটেছে? কেন বিশ্বেশ্বরের মনে হয়েছিল, বিষ্ণুপ্রিয়া অভিমান করে নিরুদ্দেশ! আজও সেই অজ্ঞাত কারণের ভিতরের কথাটা তার কাছে অজ্ঞাত! বিশ্বেশ্বরের কাছে সে কারণ যতই অজ্ঞাত থাক, ভিতরের কারণ হয়তো কিছু থাকতেই হয়। নয়তো যে বঙ্কুবিহারী কখনও আসেনি বিশ্বেশ্বরের বাড়ি, সে কেন ওইভাবে বিষ্ণুপ্রিয়ার নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার কথা বলতে প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসবে এখানে। তখন তো বলতে গেলে সিজন শুরু হয়নি। কিন্তু শুকনোর সময়। কুসুম দেপাড়ার দিকে কয়েকটা বায়না পেয়েছে। এই ধোপাখালি পালপাড়া, ওপাশে নাটাইখালি আর পাÐাপাড়ার দিকে। কোনটা তিনদিনের, কোনটা সাতদিনের, দুটো একদিনের। একদিনের রয়ানি গান আসলে ঘটস্থাপন করে শেষ বিকাল কি সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত্তির পর্যন্ত গাওয়া হয়। প্রতিমা দিয়ে সাধারণত হয় না। যাদের একেবারেই ছোটোখাটো মানসিক থাকে তারা এভাবে গান পাতায়। এমন একদিনের একটি গানে হঠাৎ সংগত করেছিল আভা। তার আগে একটা তিন দিনের গান আভা প্রথম দুইদিন বাড়িতেই ছিল। শেষ দিন বিকালে হরবিলাসের ছেলে তাকে নিয়ে গিয়েছিল ধোপাখালি। ¯্রফে গানের সঙ্গে হরষিত কেমন বাজায় তা দেখতে নমিতাই পাঠিয়েছিল। আসলে তাও না, সেই দুই দিনে হরষিতকে না-দেখে আভা যেন একটু আনমনা, একমাত্র নমিতাই ছোটোজায়ের এই উচাটন মনের বিষয়টা বুঝেছিল। তাই তাদের বড়োছেলেকে বলেছিল, আভাকে নিয়ে পালবাড়ির রয়ানি গান দেখে আসতে। যদি তারা থাকতে বলে থাকবে, নয়তো সন্ধ্যারাতেই চলে আসবে। রাতে বড়ো পালবাড়িতে তারা থেকেছিল। শেষ দিনের গান, শেষ হতে হতে রাত গভীর। আভার ভাসুরপো খুব মজা পেয়েছে যখন হরষিত আর অধিরাজ দাসু-বাসু সেজেছিল। অমন মজার অভিনয় যে হরষিত করতে পারে তা তো কোনওভাবেই আভার জানা ছিল না। তবে, হরষিত একবার লখিন্দরের ভ‚মিকায় অভিনয় করেছে, সেখানে সামিয়ানার পাশে বসা আভার নিজেকে বেহুলা ভেবে নিতে সত্যি কষ্ট হয়েছে। আর সেইসমস্ত জায়গা তাদের কুসুমমাসি কী সুন্দর গাইল! আসরভর্তি সমস্ত লোকের চোখে জল!

আভা তো আরও ছোটো বয়েসে বিষ্ণুপ্রিয়ার রয়ানি গান দেখেছে। কুসুমের গানে কয়দা বেশি। তবে বিষ্ণুপ্রিয়া বর্ণনা দেয় সুন্দর। কথাগুলো বেশি স্পষ্ট। কিন্তু কুসুম সে তুলনায় গানে অনেক ভালো। এমনকি একটু বেশি আন্তরিকও। পরদিন সকালে আভা তার ভাসুরপো আর অধিরাজের বউ সাবিত্রী একসঙ্গে ফিরে আসে। আগে আসে অধিরাজের বাড়ি সানপুকুরিয়ায় তারপর তার দুজন রঘুনাথপুর! এর দুদিন বাদে নাটাইখালির একবাড়িতে যে এক রাতের রয়ানি গান, সেখানে আভা হঠাৎ কুসুুমের অনুরোধে গলা মেলায়। যেভাবে গাইতে দেখেছে আগে বিষ্ণুপ্রিয়াকে আর সেইসঙ্গে কদিন আগে ধোপাখালির পালপাড়ায় কুসুমের সংগতকার জোৎ¯œা আর অঙ্কু গলা মিলিয়েছিলÑ সেটুকুই তার পুঁজি। এদিন অবশ্য অঞ্জু ছিল না। ফলে জোৎ¯œার সংগত দেওয়া শেষ হলে যে দ্রæত বাকিটুকু টেনে তুলত অঞ্জু, সেভাবেই করেছে আভা। এতে তার তেমন বেগ পেতে হয়নি। তাছাড়া, একদিনের রয়ানি গানে কাহিনি অনেক দ্রুত চলে। সেখানে দলকর্তা চিনুবাবুর কাজই বেশি। সেই তাতে তাল রেখে এগিয়ে যেতে কী ওস্তাদ কুসুম। এক দিনেই গাইল তিন দিন কি সাতদিনের সবটুকু তবু যেন কোথাও কমতি নেই। শুধু গানের ফাঁকে তার বারবার প্রচুর জর্দা দিয়ে গালভর্তি পান খাওয়ায় যেন একটু ছন্দপতন হয়েছিল। তা গানের কায়দা দিয়ে কীভাবে পুষিয়ে নিতে হয়, সেটাও যেন কুসুমের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। চিনু বাবুও জানে, কুসুমকে কীভাবে দিতে হয় পান-জর্দার সুযোগ!পরদিন জ্যোৎস্নার কাছে থেকেই আভার সংগত দেওয়ার কথাটা জানতে পারে বিষ্ণুপ্রিয়া। অঞ্জুকে বিষ্ণুপ্রিয়া চেনে, চেনে জ্যোৎস্নার। জ্যোৎস্না বলেছিল, নাটাইখালির ওই বাড়িতে অঞ্জু ছিল না বলে তার পরে সংগত দিয়েছে তাদের জলের নতুন খোলবাদক হরষিতের বউ আভা! বিষ্ণুপ্রিয়া তখন কিছুই বলেনি। টেংরাখালির দিকে যেতে রথখোলা গ্রামে বিষ্ণুপ্রিয়া জ্যোৎস্নার কাছ থেকে এই খবর পায়। একথা শুনে অভিমান করেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। এত অল্পে? সেখানে বিশ্বেশ্বরের করণীয় কী? তা যদি হয়, সেকথা আরও বহুদিন অজ্ঞাতই থাকবে।

এর আগেও উধাও হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। তবে তা কোনওভাবেই সিজনের আগ দিয়ে নয়। এবারই যেন প্রথম। ফলে, ওই সিজনে কুসুমরানি ও তার দলের কোনও ফুরসত ছিল না। আর, বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়িঘর একলা আগলে রেখেছে বঙ্কুবিহারী। সে গ্রামের লোক এই প্রথম লোকটার অমন বিষণ্ণ মুখ দেখেছে। বর্তমানের অতীত

১২

বঙ্কুবিহারীকে দেখে নমিতা অবাক! হঠাৎ এই লোক কেন আর কোত্থেকে এখানে এল। নমিতা বড়োঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছে সামনের চিলতে পথ ধরে বঙ্কুবিহারী ঢুকছে। পথে এখনও একসারি করে ইটলাছা। ইট লাছলে বর্ষাকালে হাঁটতে সুবিধা হয়। সামনের রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময়ে পা পিছলানোর সুযোগ থাকে কম। একটু ফাঁকা রেখে লাছা ইটের উপর দিয়ে বঙ্কুবিহারীর হেঁটে আসতে অসুবিধা হচ্ছে। এই কার্তিক মাসে চারদিক শুকিয়ে গেছে। নমিতা ভাবে, লোকটার পায়ে কোনও সমস্যা!

বঙ্কুবিহারীকে অনেক দিন পরে দেখছে নমিতা। এই কবছরে বেশভ‚ষণ এমন বদলেছে যে একেবারে সামনে তাকিয়ে ওইভাবে না ঢুকলে নমিতা হয়তো তাকে চিনতেই পারত না। মাথার চুল প্রায় ঘাড় পর্যন্ত। দাড়িও বুক প্রায় বুক-ছোঁয়া। একটাও আর কালো নেই। সাদারও তো একটা নমুনা থাকে, এ যেন নদীর ক‚লে জন্মানো কাশফুল। একটু ফাঁকা ইটে তার হাঁটতে অসুবিধার ভিতরে সকালে চালানো হালকা বাতাসে উড়ছে দাড়িগুলো।
নমিতার সামনে দাঁড়ানো আভা হরষিতের ছেলে হিরো। বঙ্কুবিহারীকে দেখেই সে ছেলেটার চুলে হাত বোলায়। বুকের একদম তলানি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে নমিতার। লোকটা এখন কোন মতলবে এসেছে কে জানে!

নমিতার এই যে আশংঙ্কা এর পিছনে অবশ্য কারণ আছে। তবে তারও আগে সেই কারণে সামান্য হলেও নমিতা নিজেকে দায়ী করে। হরষিত কিছু করত না, তাই নমিতাই তাকে কুসুমের দলে তাকে খোল বাজাতে বলেছিল। কিন্তু সেদিন কি সে জানত, তার দেওর যদি কুসুমের রয়ানির দলে খোল বাজাতে যায়, তাহলে একদিন সেই দলেই কুসুমের সঙ্গে গান সংগত দেবে আভা। নমিতার মতন চটপটে মেয়ে, নিজের শ^শুরবাড়ি কি এর আশেপাশের অনেকের কাছে যাÑ একটু বেশি বোঝা বউ। যদিও হরবিলাস মনে করে, সংসারটা যে টিকে আছে তা এই নমিতার জন্যে। কারণ হরলাল নামে তাদের বাপের তো আকাজের শেষ ছিল না। মারা যাওয়ার পর না বোঝা গেছে কত জায়গায় কত পদের সমস্যা বাধিয়ে রেখে গেছে। হয়তো, তাদের মা তা বুঝতে পেরে অনেক আগেই নিজেকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
যাক, এখন নমিতার ভাবনার বিষয় এসব নয়। নমিতার চিন্তার কোনও চৌহদ্দিতেও তো এই বিষয়টা ছিল না যে আভা রয়ানি গান গাইবে। আর তারও আগে, আভার বাপের কাছে আভাকে রয়ানি গানের জন্যে চেয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। বিষ্ণুপ্রিয়ার দলের দলকর্তা এই বঙ্কুবিহারী।

এক্ষেত্রে যা হয়, সবাই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে দেখে। নমিতাও দেখেছে। দেখেছে আভার বাপ বিশে^শ^র মলঙ্গিও। যদি হরষিতের মৃত্যু ওইভাবে, ওই জুচখোলার সীমান্তে মালিপাটন গ্রামে রয়ানি গানের আসরে না ঘটত তাহলে তারা হয়তো এইসব কিছুই ভাবত না। আর তারপরই না ধীরে ধীরে একটার পর একটা ঘটনা বেরিয়েছে। অথবা তাও না, পিছনের ঘটনার একটার সঙ্গে অন্যটা তারা মিলিয়ে দেখেছে, কিংবা নমিতাও মিলিয়ে দেখেছে। হয়তো সেজন্যে নমিতা হিরোর মাথায় হাত বোলাল। আজ যদি আবার কোনও অনিষ্ট ঘটে। বঙ্কুবিহারীর প্রায় ঘরের পইঠা কাছে এসে পড়েছে। এতক্ষণে ঘরে পর্যন্তই চলে আসত, যদি না সে উঠানে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে নিরিখ করত কোনও ঘরে যাবে। তখন আরও একবার নমিতা তাকে ভালো করে দেখেছে। কিন্তু নমিতা যে তাকে পরখ করেছে তা বঙ্কুবিহারী দেখেনি। সত্যি লোকটাকে হঠাৎ দেখলে চিনতে পারত না নমিতা। বঙ্কুবিহারী উত্তরে দিকে তাকিয়ে তাদের শরিকি ঘর দেখছে। মানুষ এত বদলায়? নমিতা ভাবে। বঙ্কু হালদারের এই পরিবর্তন কি বিষ্ণুপ্রিয়ার বিরহে। পারেও, তাই দুজনে দেখাইল এক খেল। এই না হইলে বিষ্ণুপ্রিয়া। বঙ্কুবিহারী তার নারায়ণ। এখন বঙ্কুবিহারী এসেছে তাদের দুয়ারে, অতিথি নারায়ণ। কিন্তু নমিতার অন্তরের তলানি ওই যে ছ্যাত করে মোড় দিয়ে ওঠা, দেওর হরষিতের মুখখানা মনে-পড়া আর এইমাত্র হিরোর মাথায় হাত বোলানো?

আসলে, বঙ্কুবিহারীকে দেখেই নমিতা অসহায়। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের ঘরে যায় আভাকে খবরাটা দেওয়ার জন্য। কারণ, কারণ তো একটাই, নমিতা জানে বঙ্কুবিহারী আভার কাছেই এসেছে। সে হিরোকে বলে, ‘চল দেহি, তোর মার ধারে যাইÑ’ তাতে হিরো যে তাকে বলেছে, ‘তয় ইস্কুলে যা’তি হবে না, বড়োমা?’ সেকথা একটুক্ষণের জন্যে হয়তো হারিয়ে যায়। নমিতা আভাকে ডাকে, ‘ও অভা, বঙ্কুবাবু আইচে!’
আভা বোঝে নমিতার স্বরে স্পষ্ট আতঙ্ক! আবারও ওই ‘বঙ্কুবাবু’ বলায় সমীহও। নমিতার অন্তত বঙ্কুবাবু বলার কথা নয়। হয়তো, অন্য সময় হলে বলত, ‘ও আভা, তোর বঙ্কু মামা আইচে।’ অথবা, এমন কিছুই বলত না। শুধু বলত, ‘যাই দেখ আইচে কেডা!’
এর ভিতরে হিরো আভাকে অন্য কথা বলতে শুরু করেছে, ‘ও মা, ইস্কুলে যাব। বড়োমা ক’ল আমার সাতে যাবে, কী এহোন যাবে না?’
হিরোর আবদার হওয়ায় মিলিয়ে যায়। বরং, আভা যে বিছানার এক কোনায় আড়াআড়ি গা-এলিয়ে ছিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে। নমিতার দিকে তাকায়। সে দেখে তার স্বরের আতঙ্ক আভার চোখে-মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বঙ্কুবিহারী ততক্ষণে আভাদের ঘরের সামনে। বারান্দার সামনে মাটির যে ছোট্ট পোতা, সেখানে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বঙ্কুবিহার একটু যেন জড়তাহীন। সে ডাকে, ‘আভা মা জননী, আছ নাকি?’
বঙ্কুবিহারীর গলা বিষণ্ণ শোনায়। গভীর থেকে গলার যে স্বর তার বেরিয়ে এসেছে, তাতে এত দিন বাদে আজকে এখানে আসার কোনওমাত্রে উচ্ছ্বাস অবশিষ্ট নেই। বঙ্কুবিহারীর আভাকে ডাকার স্বরে নমিতা বুঝতে পারে, বঙ্কুবিহারী উঠানে ঢুকে তাকে দেখেনি। এদিকে বঙ্কুবিহারী তাদের বাড়ি পর্যন্ত এসেছে, ভিতরে যা-ই থাকুক আভা তার কথায় উত্তর নেয় আন্তরিকতার সঙ্গে, ‘এই যে, ও মামা, আছেন কীরাম?’
বঙ্কুবিহারী বারান্দায় ওঠে। আভার সঙ্গে নমিতাও বারান্দায়। আভা সামনে। নমিতার পাশে হিরো। এই লোকটির আসায় হিরোর স্কুলে যাওয়ার বিষয়টা ফয়সালা হচ্ছে না। ছেলেটার চোখে বিরক্তি। যেন এখনই লোকটা চলে গেলে হিরো তার বড়োমার সঙ্গে ইস্কুলে যেতে। হিরো স্কুলে একাই যায়। এখন তার স্কুলের দিকে একবাড়িতে যাওয়ার কথা বলেছে নমিতা। বড়োমার সঙ্গে গেলে পথের দোকান থেকে এক প্যাকেট চিপস পাওয়া যাবে। এ জন্যেই হিরো চাইছে, নমিতা কখন তাকে নিয়ে যাবে।
আভা বঙ্কুবিহারীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। তারপর একটু হেসে জানতে চায়, ‘কেমন আছেন, ও মামা?’
বঙ্কুবিহারী চোখ কিন্তু তার সেই ডাকে স্বরের মতো বিষণ্ণ। আভার গলার উচ্ছ্বাসে তার মুখের রেখার কোনও পরিবর্তন হয় না। ততক্ষণে আভার হিরোকে বলেছে, ‘সেবা দাও বাবা, তোমার এক ভাই (দাদু)।’
বঙ্কুবিহারী বলে, ‘না থাক, থাক। আছো ভালো, ও দাদুভাই?’
তার গলা একই খাঁজে। বরং আরও দুঃখিত যেন, ‘ওরে দেখতে আসলাম, হাতে কিছু নেই। যাক, সে সাধ্যও আজ আর আমার নেই। শোন মা, এট্টা খবর দিতি আসলাম’
খবর দেওয়ার কথাটা করুণ স্বরে খুব ভারাক্রান্ত গলায় বঙ্কুবিহার বলে, ‘তোর পিসিমা দেহরক্ষা করেছে।’
নমিতা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘কবে?’
‘তা আইজকে দশদিন’
কথাটা শুনে আভা ঢুঁকরে কেঁদে উঠতে পারত। কাঁদবে না সে। বঙ্কুবিহারীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল হতে পারত, নাকি আভা জানে না সেটা কোনওভাবেই ঘটবে না। সে শুধু বলে, ‘বসেন।’ তারপর ভিতরের ঘরে চলে যায়।
এদিকে নমিতা তার কোল-লাগোয়া হিরোর মাথায় আবার হাত বোলায়। আর জানতে চায়, ‘আপনে জানলেন কবে?’
বঙ্কুবিহারী বলে, ‘কাইল সন্ধ্যায় চিঠি আইচে’
নমিতা বলে, ‘আপনি এহোনও সেগো সেই বাড়িই থাহেন?
‘হু।’ বঙ্কুবিহারী উদাসী স্বরে জানায়, ‘আমার আর যাওয়ার জায়গা আছে, মাগো? আমি আর যাব কোথায়?’
‘ও কথা কইয়েন না। কত বড়োঘরের মানুষ আপনি’
নমিতাকে কথা শেষ করতে দেয় না বঙ্কুবিহারী, ‘তয় এবার যাব। দুই চোখ যেদিক যায় চইলে যাব। তারে কথা দিয়েছিলাম, কথা রাখিছি। যাই, মা জননী। আভারে কইও’
নমিতা বঙ্কুবিহারীকে বসতে বলে। একটু জল মুড়ি বাতাসা অন্তত মুখে দিক। না, শোকগ্রস্ত বঙ্কুবিহারী আজ নিরম্বু উপবাস। দিনমণি আস্তাচলে যাওয়ার আগে জলও গ্রহণ করবে না।
উঠানে নেমে, উলটো দিকে মুখ দিয়ে বঙ্কুবিহারী এরপর বিড়বিড় করে, ‘আজ সে মহাপ্রস্থানের পথে। তোমরা তারে মাফ কইরে দিও, কোনও মান অভিমান রাইক্কো না।’
আর, শোনা যায় না। নমিতা দাঁড়িয়ে থাকে। আর কিছু বলে কি না শুনতে চায়। শোনা যায় না। হয়তো আর কিছুই বলেনি বঙ্কুবিহারী। একবার উলটো ফেরে। দেখে, নমিতা দাঁড়িয়ে আছে। নমিতার মনে হয়, এখনও বিড়বিড় করে বলছে, মাফ কইরো।
বঙ্কুবিহারী দৃষ্টির বাইরে চলে যেতেই নমিতা স্বরূপে ফেরে। ঘরে এসে সে আভাকে বলে, ‘ওই ব্যাডারে আইজে সামনে পাইয়ে তুই কিছু কইলি না যে?’
আভা ঘরে এসে অন্য কথা ভাবছিল। হয়তো বঙ্কুবিহারী কিছুই জানে না। তার মনে পড়েছে হরষিতের মুখ। যদিও আভার জানা ছিল নমিতা তাকে একথাই বলবে। কিন্তু আজ আর ওই লোকটাকে সেই সন্দেহের কথা শুনিয়ে কী লাভ!
আভা বলে, ‘আইজে ওইয়ে শুনইয়ে আর হবেডা কী?’
‘তবু সামনে পাইয়ে তারে কিছু ক’বি না?’
‘কী ক’বো?’
‘কবি মানষি যা কয়। দশজনে যা জানে যা বুজিচে। এমনকি দশজনে যা দেখিচেÑ সেইয়ে শুনোইয়ে দিতিÑ’
‘তাতে আর হবেডা কী? আমার যা গেইচে তা আর ফিরে আসপে না। ওদিকে যে মানুষটা মইরে গেইচে তারেও আর ফিরোইয়ে আনা যাবে না। কোন ক্ষণে আমার বাপ তারে ধম্ম বুইন ডাকিল?’
‘হইচে। খালি জানতি পারলাম না তোর বাপের ওই ধম্ম বুইন কীভাবে মরিচে। ওই বঙ্কুবাবু যাওয়ার আগে বিড়বিড় করতিল, তোমরা কোনও মান অভিমান রাইখে না। সে চইলে গেইচেÑ’
আভা বিস্ময়ে নমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

১৩

এ সময়ে ঘরের জানলা দিয়ে কার্তিকের হালকা উত্তুরে বাতাস আসে। তাতে বঙ্কুবিহারী চলে যাওয়ার পরে এই সকালে আভা সাত বছর আগের বিষাদময় দিনটিতে ফিরে যায়।
জুচখোলার উত্তর মাথায় মালিপাটন গ্রাম-লাগোয়া মালিবাড়িতে রয়ানির গানের শেষ আগের দিন। সে বাড়িতে সাতদিনের গান। আজ ছয় নম্বর রাত। গত রাতের আসরে লখাইকে দংশন করেছে কাল সাপ। আজ বেহুলার বিলাপ দিয়ে পালা শুরু হবে।

এখন এ দলকর্তা প্রবীণ চিনুবাবু। কুসুমের জায়গায় মূল গায়িকা আভা। আভা কুসুমের দলে যোগ দেওয়ার পরে বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই যে উধাও হওয়া শুরু হয়েছিল, তা বহালই থাকে। বিষ্ণুপ্রিয়ার দলই পরে আর টেকেনি। বঙ্কুবিহারী এভাবে সেভাবে জোড়াতালি দিয়ে দল রক্ষার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার জায়গা পূরণ হওয়ার নয়। আভা জানত, এখন তার বিষ্ণুপ্রিয়া পিসি গায়ই না, তবে কোনও কোনও গৃহস্থের অনুরোধে কখনও কখনও নাকি আসরে ওঠে। আজও সে যখন ল²ীন্দরের জন্ম কিংবা বিবাহ অথবা বেহুলার সাজনের অংশ গায়, ওই গায়কী আর কার আছে। তবে দুঃখের যাওয়াগুলো, বেহুলার বিলাপ কি চান্দর বিলাপ আর লক্ষ্মীন্দর জিয়ন এই জায়গাগুলো আজও কুসুমের মতো দরদ নিয়ে গাইতে পারে না কেউ। কিন্তু কুসুম তো নেই। কুসুম দেহরক্ষা করেছে। ওই যে যখন থেকে আভা কুসুমের দলে সংগত দেয়, হরষিত খোল বাজায় আর সেই সংবাদ শুনে বিষ্ণুপ্রিয়ার উধাও হওয়া, তার কিছুদিন পর থেকে কুসুমের শুকিয়ে যাওয়ার শুরু। কুসুম দিনকে দিন শুকিয়ে যেত আর আভার মনে হত, যদি খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে এই গান এই গলা আর গাওয়ার ধরন দিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। নইলে ওই শ্বশুরের ভাত খেয়ে তার আর হরষিতের বেঁচে থাকার উপায় থাকবে না। ফলে সেই সময়ে আভা প্রত্যেক গানের আসরে প্রতি মুহূর্তে কুসুম হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে। কুসুম বলত, ‘ও মা, মা আভা, আমার গলা যে আর পারে না।’ বছর ঘুরতে না ঘুরতে একটা মানুষের এই দশা হয়! নিশ্চয়ই কুসুমের শরীরে বড়ো কোনও রোগ বাসা বেঁধেছে। নতুন সিজন শুরু হওয়ার আগে আভা হরষিতকে বলেছিল, মাসিরে ডাক্তার দেখানো লাগে। একদিন কুসুমের বাড়িতে গিয়েও ছিল, হরষিত আর অধিরাজ। তাকে জেলা সদরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কুসুম যাবে না। কুসুমের প্রায় প্রতিবেশী চিনুবাবুকে দিয়েও বলিয়েছে, তাতেও কোনও লাভ হয়নি। তাই পরে একদিন হরষিতকে নিয়ে তাকে দেখতে গিয়ে আভা কুসুমকে বলেছিল, ‘মাসি, ডাক্তার দেখাও ভালো হইয়ে যাবাÑ কত মানুষ ভালো হয় কত রোগে। তোমার রোগডা যে কী সেইয়েই তো বোঝলা না। তুমি না থাকলি দল থাকপে?’ আভার এমন আশঙ্কার কথায় বিছানায় শোয়া মলিন কুসুম পারে তো উঠে বসে। আধ শোয়া হয়েছিল সে। বলেছিল, ‘কী কইস তুই? দল থাকপে না মানে? আমি সগ্গে যাই কি নরকে যাই যেহানে যাই দিব্য চোখে দেখতি পারিতিচি দল চলবে। দল চালাবি তুই’
আভার বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠেছিল। না, এটা অন্য আশঙ্কায়, আজ একথা বলছে বটে কুসুম মাসি কিন্তু আভার সাধ্য কি একটা রয়ানি গানের দল চালানোর। দল চালাবে বা দলকর্তা নাহয় চিনুবাবু, কাহিনির পরম্পরা সে-ই ধরিয়ে দেবে, কিন্তু গান তো গাইতে হবে আভাকেই! সেখানে কুসুমের মতো মানুষের জায়গায় সে। তা কী করে সম্ভব। আভা ভেবেছিল, কুসুম মাসির অসুখে মাথাটাথা ঠিক আছে তো।
হরষিত বসেছিল কুসুমের পায়ের কাছে। আভা খাটের মাঝখানে কুসুমের কোল বরাবর। এ সময়ে কুসুমের পুতের বউ ঘরে ঢুকে হরষিতের হাতে ছোট্ট গুছইতে কিছু মুড়ি আর গুড় দিয়ে যায়। হরষিত খাক বা না খাক গুছইটা হাতে নিয়ে বসেছিল। আর কুসুম তার পুত্রবধূকে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘ও বউমা? কওদি আমি চক্ষু বুজনি আভা মা আমার এই দল চালাতি পারবে না? যে সুন্দর গায়!’
কুসুমের পুতের বউ শ্বাশুড়ির কথায় সায় দিয়েছিল, ‘পারবে। বুন্ডি তো এহেবারে আপনের মতন গায়। ওই যে বড়ো আন্ধারমানিক মন্ডলবাড়ি গানে।’

সেকথা আজও মনে আছে দেখি এই মেয়ের। পাশেই তার তালই বাড়ি। সেখানে কুসুম, ‘মনসার কোপদৃষ্টিতে চন্ডীর ঢলিয়া পড়ন’ অংশের পরে হঠাৎ আসরকে বলেছিল, ‘এরপর আমি চন্ডীর চৈতন্য অংশটুকু গাব, তারপর মনসার বিবাহ অংশ থেকে কিছুদূর গাবে আভা।’ এরপর চিনুবাবুর দিকে তাকিয়ে কুসুম বলে, ‘ও বড়দা, পারবে না আভা? আপনি ধরাইয়ে দিয়েন।’ সত্যি, কুসুমের পুতের বউ কেন, হরষিতেরও মনে আছে, চিনুবাবুও অবাক হয়েছিল, জীবনে কখনও মনসামঙ্গলের পৃষ্ঠাও দেখেনি এই মেয়ে, যার বাপ মথুয়াপন্থী, বিজয় গুপ্তের পদ্মাপুরাণ হয়তো বিশ্বেশ্বর কোনও দিন ছুঁয়ে দেখেনি, সেই বাড়ির মেয়ে কীভাবে এমন গায়? হ্যাঁ, কুসুমের গান নির্ভুল, বাণী নির্ভুল! কিন্তু গায়কী অর্থাৎ গানের কেতা? যেন তা কুসুমেরই। চিনুবাবু সেদিন কাহিনির পরাম্পরা ধরিয়ে দেবে কি, নিজেই আভা নামের এই গায়ের রং চাপা, একহারা লম্বা মেয়েটির স্মৃতিশক্তির প্রশংসাই করেছিল। আজও করে। আর ভেবেছিল, ভাগ্য বলতে হবে হরলাল ঘরামির। জীবন হরলালের মতো লোক কত পুণ্য করলে এই আভার মতো একটা মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পায়। নমিতাকেও চেনে চিনুবাবু, বরং আভার চেয়ে ভালোই চেনে, নতিমা বুদ্ধিমতী হয়তো কিন্তু আভা একেবারে গুণবতী।
কুসুমের পুতের বউ সেই মন্ডলবাড়ির গানের কথা মনে করিয়ে দিল বটে, কিন্তু সে ছিল একেবারে শুরুর দিক। অর্থাৎ, তখন সবে কুসুম এইভাবে আভাকে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। এরপর আরও কত আসরে এমন ঘটেছে। কত আসরে হঠাৎ মাঝখান থেকে থামিয়ে দিয়ে আভাকে বলেছে বাকিটুকু টেনে নিতে। সেই সময়টা কুসুম জিরিয়ে নিয়েছে। এ সময় থেকেই কুসুম শুকিয়ে যাওয়া শুরু। তখন সে হয়তো সন্ধ্যার শুরুতে একটু গাইত আর শেষ দিকে আসর শেষ হওয়ার আগে আগে, বাকি সময় চালিয়ে নিয়েছে আভা।
ফলে, সেদিন হঠাৎ কুসুমের অমন আবেগময় প্রস্তাবে, আর তার পুত্রের বউর ওইভাবে সায় থাকার পরে, আভার আর কী বলার থাকতে পারে।
তবু আভার বলার ছিল, বলার ছিল হরষিতেরও। তারা বলেওছিল। আপাতত দলের কথা ভাবা বাদ। আগে কুসুমের শরীর। একটা মানুষ একবারও ডাক্তার কবিরাজ বদ্যির কাছে না গিয়ে এইভাবে ধুঁকে ধুঁকে শরীর ক্ষয় করবে! তা হতে পারে না। কুসুমের পুতের বউকে তারা বলেছে, বলেছে তার ছেলেকেও, কিন্তু তারা বলেছে, মাকে কোনওভাবেই বোঝাতে পারেনি। বুঝিয়ে কোনও লাভ হয়নি, তাদের মায়ের একটাই কথা, যাবে না ডাক্তারের কাছে।
কিন্তু সেদিন, হরষিত আর কুসুমের পুতের বউয়ের সামনে কুসুমের প্রস্তাবে আভার মাথায়ও একটা বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল। সে বলেছিল, ‘মাসি, মা মনসার কৃপা আর তোমার আর্শীবাদ থাকলি আমি দল চালাইয়ে নিতি পারব। তয় আমি রাজি হ’তি পারি যদি তুমি আমার এট্টা কতা শোনো।’
আভার কথার প্যাঁচটা যেন কুসুম আগেই বুঝতে পেরেছিল। বলার ধরনে সে হেসেছে। শুকিয়ে যাওয়া মুখে শুকনো হাসি। যদিও তখন বর্ষাকাল। প্রকৃতিতে শুকনার কোনও ব্যাপার নেই। নদীতে জালভরতি, মাঠে জল, রাস্তাও অনেক জায়গায় কাদায় তলানো। অমন আর্দ্র প্রকৃতিতেও কুসুমের চকচকে সাদা দাঁতের হাসিতে, সেই মুখখানা তখন তাদের বড়ো শুকনোই লেগেছিল। লাগুক, তবু সেই মুহূর্তে বুদ্ধি করে কথাটা বলতে পেরেছে আভা।
কুসুমও বুঝতে পেরে বলেছিল, ‘কী ক’তি চাস তুই আমি জানি। ক’বি আমি যদি ডাক্তার দেখাই তা’লি আমার কথা শুনবি সেইয়ে তো?’
তখন অবশ্য অবাক হওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি ছিল না। যদিও তারা অবাক হয়েছিল, বিষয়টা কুসুম আগেই বুঝে গেছে।
আভা কিছু বলার আগেই সে বলেছিল, ‘শোন, আমি জানি আমার কী হইচে। আমার আর ফেরন নেই। কোনও ডাক্তার আমারে ভালো করতি পারবে না। তবু কইচিস যহোন যাবানেÑ খোকা বাড়ি আসুক।’
না, কুসুমের ছেলের জন্যে অপেক্ষা নয়, হরষিত আর অধিরাজ জেলা সদরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে কুসুমকে। কুসুম যতই রাজি হোক, তবু তার নিজেকে নিয়ে আপত্তি থামেনি। বারবার বলেছে, কোন লাভ নেই। তার চেয়ে এই দেহ নিয়ে যেভাবে আইচি, সেইভাবেই আমারে ফেরত যা’তি দে।’
ডাক্তারের কাছে থেকেই জানা যায়, কুসুমের ক্যান্সার। আসলে ডাক্তার তাও বলেনি। বলেছিল, বাড়ি নিয়ে ভালো মন্দ যা খেতে চায় খেতে দিন। যা করতে মন চায় তাই করুক! অবশ্য কথাগুলো কুসুমের সামনে বলেনি ডাক্তার। তখন কুসুম বাড়িতেই। কী সব পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ওই ছিল ডাক্তারের শেষ কথা।
হরষিত আর অধিরাজের মুখ দেখেই যেন কুসুম যা বোঝার বুঝেছিল। সে বলেছিল, ‘আগে কই নিই ডাক্তারের কাছে যাইয়ে লাভ আমার যাওয়ার সময় হইচে আইচে।’
তারা আজও ভাবে, হয়তো ডাক্তারের কাছে না নিলে আরও কিছুদিন বাঁচত কুসুম!
কুসুম অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি। তার নাম এই তল্লাটের প্রখ্যাত রয়ানি গায়েনদের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। যেমন, লক্ষণচন্দ্র হালদার আর কানন, বিপিন ঘরামি, প্রতাপপুরের বুদ্ধদেব, মনমোহিনী, হেমাঙ্গিনী, লক্ষ্মী, ছোটো কানন এঁদের রয়ানি গানের কথা বললে কুসুমের নামও একই সঙ্গে আসে।
আভা আজও বিস্মিত সে দলের দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ায় আধশোয়া কুসুম বিছানায় উঠে বসে তার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, পুত্রের জননী হও মা। সত্যি সত্যি, এর কিছুদিন পরই হিরো তার পেটে আসে। কিন্তু হিরোর জন্মের আগেই কুসুম দেহরক্ষা করেছিল। আভার সেই আপশোষ কোনওভাবেই যায় না, যদি তার ছেলের মাথায় ওই অশক্ত হাতখানা রেখে আর্শীবাদ দিয়ে যেতে পারত কুসুম। তাহলে মা মনসার কৃপা সারাটা জীবনভার থাকত তার ছেলের সঙ্গে।

নৌকা মাঝনদীতে আসার পরে বিশ্বেশ্বর ভেবেছিল, অন্তত বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলার মতো উত্তর সে পেয়ে গেছে। তার আর কী? বিয়ে হওয়া মেয়ের গোত্রান্তর হয়। স্বামী-শ্বশুরেরর ইচ্ছাই তার ইচ্ছা অনিচ্ছা। ফলে, খোলবাজানো স্বামীর সঙ্গে থাকতে থাকতে একদিন যদি মেয়েও ওই কাজ করে তাহলে বাপ হিসেবে তার কী বলার থাকতে পারে? শুনে বিষ্ণুপ্রিয়া কী বলবে, তার মুখের অবস্থা কী হবে তাও ধারণা করতে পারে বিশ্বেশ্বর। তবু তার মনে হয়েছিল, কথাটা বলা দরকার। তাতে অন্তত বিষ্ণুপ্রিয়ার ওই কথাটা, ‘ও দা, মাইয়েডারে আমারে দেও’ তা নিয়ে তার কোনও দায় থাকে না!

১৪

সেবার সিজন শুরু হওয়ার আগে আগে জন্মেছিল হিরো। ছেলেকে কোলে কাঁখে নিয়েই রয়াানি গানের আসরের বায়না নিয়েছে আভা। দলকর্তা চিনুবাবুও আভাকে চাপ দেয়নি। হরষিতকেও এনিয়ে কিছু বলেনি। শুধু বলত, যদি আভার শরীর সয় তাহলেই বায়না নেবে।
হিরো জন্মেছিল অগ্রহায়ণে। কুসুম চিরদিনের জন্যে চোখ বুঝেছিল আশ্বিনে, বড়োপূজার পর পর, লক্ষ্মী পূজার আগের দিন। যদিও তিথি হিসাবে সেটা পূর্ণিমাই। আভা জানে, অমন ল²ীমন্ত মানুষ ছিল সে, মা লক্ষ্মী তার পুণ্য তিথিতেই নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছে।

সেবার শীতের শেষ কোনও বায়না নেয়নি চিনুবাবু। অর্থাৎ মাঘ মাস পর্যন্ত আভার শরীরের কথা ভেবে সব গৃহস্থকেই বলেছিল ফাল্গুনের পনেরো দিনের পরে এবার তারা বায়না নিতে পারবে। নিয়েওছিল তাই। আভা হিরোকে সঙ্গে নিয়ে যেত। আসরের মাঝখানে কোনও ফুরসতে ছেলেকে দুধ দিত। আর আভা আজও মনে করে, সন্ধ্যার পরে একঘুমে মাঝরাত পর্যন্ত পাইয়ে দিত ছেলে, এই সবই কুসুমের আর্শীবাদে। ফলে, এমন ছেলেকে নিয়ে আসরে আসরে ঘুরতে আভার সমস্যা কোথায়! এই তল্লাটের মানুষ আজও মনে করে, সেই প্রথম আভার ভিতরে সবাই ফুটে উঠতে দেখেছিল কুসুমের ছায়া। আজকের বয়স্করা মনে করে, ওই মেয়ের হাঁটাচলা একেবারে নায়িকা দেবশ্রী রায়ের মতন। তরুণদের কাছে অবশ্য তা নয়, তারা দেবশ্রী রায়কে মনে করে কিন্তু তার সঙ্গে মেলায় না। যদিও এক মাখা চুল, দীর্ঘ দেহী একাহারা আভা দেবশ্রী রায়ই। বরং, কুসুমের ধরন ছিল নায়িকা শাবানার মতন। সেই আমলের হিসাবে মনসার গানে শোকের জায়গাগুলো সে ভালো গাইত, শাবানা যেমন দুঃখের দৃশ্যে ভালো অভিনয় করে।

আভা এসব সব ছাপিয়ে। তবু সেই প্রথম গ্রাম ইউনিয়নবাসী তাদের একসময়ে ভাড়া করে ভিসিপিও ছবি দেখার অভিজ্ঞতায় আভাকে দেবশ্রী রায় ভাবে। তরুণরা অবশ্য বোম্বের নায়িকাদের সঙ্গে তুলনা করতে চায়। কিন্তু বিশ্বেশ্বর মলঙ্গির মেয়েকে সে তুলনা করা যায় না। তাছাড়া পোষাক-আষাকের ঠাঁট বলেও একটা বিষয় থাকে। কুঁচি দিয়ে কি না-দিয়ে একরঙা শাড়িপরা আভাকে বম্বের নায়িকাদের সঙ্গে তুলনা করলে মানাবেই-বা কেন? কেউ কেউ ইন্দ্রাণী হালদার কি শাবনূরের কথা ভাবতে চায়। তাও হয় না। সেটা ভাবাও কোনওভাবে তাদের সঙ্গত নয়। আসলে এই প্রথম আভার নাম ছড়িয়েছে। অথবা নাম ছড়ানোর সেই শুরু। আভার রয়ানি গান তখন আর শুধু শোনার নয়, দেখারও। অথবা বিষয়টা তাও না। যদি কেউ সেইদিনগুলোকে মনে করে, যদি ভেবে নিতে চায়, তাহলে ভেবে নিতে পারে, আভার সেই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আজও সেসব কথাগুলো ডালপালা মেলে বিভিন্নভাবে বাহিত হয়। যদিও বিষয়টা তা ছিল না। আসলে, কুসুম মারা যাওয়ার খবরে তার দলে দোহার এই মেয়েটির গান নিয়ে গৃহস্থরা একটু সংশয়েই ছিল। চিনুবাবু আভাকে বুঝ দেওয়ার জন্যে যতই বলুক, এবার বায়না সে খুব হিসাব করে নিয়েছে, আসলে বায়না পেয়েছিলও কম। ওদিকে আভার ছেলে হয়েছে, সে জন্যে কিছু হলেও বাড়তি খরচ আছে। চালবাটা খাওয়াও আর বার্লি খাওয়াও, এর বাইরে গ্রামান্তরে ঘুরতে ছেলের জন্যে আরও কিছু খরচ আছে। হয়তো সেই জন্যে মূল রয়ানি গানের বাইরে আভাকে বাড়তি কিছু অভিনয়ের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। যেমন, মনসার গোয়ালিনীবেশ ধারণ কি বেহুলার সাজনের মতো অনেক জায়গায় আভার হাতে সেই সুযোগ ছিল। হয়তো, এতদিনকার রয়ানি গানের আসরে যে শুধু কণ্ঠস্বর আর হাত নাচিয়ে দোহার সংগতকারের দিকে কাহিনির পরাম্পরা ঠেলে দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যেত, আভাই সেখানে প্রথম সংস্কার করে। ফলে আভার গান ধীরে ধীরে আর শুধু শোনার থাকেনি, একই সঙ্গে দেখারও।

আভা এই সুযোগটা নিয়েছিল বাধ্য হয়ে। যদি তা সামাজিক আর রাজনৈতিক হিসাব দিয়েও বিবেচনা করা হয়, তাহলে আভা সেখানে প্রয়োজনেই ওই বুদ্ধি খাটিয়েছে। আসলে পরিবর্তনটা ভিতর থেকেই, প্রয়োজনে অজ্ঞাতে সংঘটিত হয়েছে। শুধু প্রয়োজন ছিল, এইÑ সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্রই আতঙ্ক। কোনও কোথাও অত্যাচার। মানুষ অনিশ্চিত। ফলে, আভার মতো নতুন গায়েনের বায়না কম, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু আশেপাশে, নদীর এপার ওপারের যাদের কুসুম কি বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো দীর্ঘদিনের সুনামÑ তারও তখন গানের বায়না কম পেতে থাকল। কোথাও দেশ ছেড়ে যাওয়ার হিড়িক। দক্ষিণের বাঁধাল সাইনবোর্ড আর মোড়েলগঞ্জের কোথাও কোথাও যে সব গৃহস্থবাড়ি প্রায় প্রতি বছরই রয়ানি গানের আসর বসত, সেখান থেকেও প্রায় কেউই কোনও বায়না পায়নি। এমনকি সেদিকের রয়ানি গানের দল আসেনি এদিকে। বরং, পুবের আর উত্তরের অবস্থা ছিল খানিকটা ভালো। রঘুনাথপুরের আশেপাশে নাজিরপুর শেখমাটিয়া শ্রীরামকাঠি মাটিভাঙা দীর্ঘা চালিতাখালি। এদিকে সেই সব বছরে রয়ানি গানের আয়োজন প্রায় একই ছিল। আর চিনুবাবুর মারফত দেখেছে, পশ্চিম দিকের অবস্থা আসলেই ছিল তথৈবচ। সেদিকে সব সময়ই গান কম হয়, দেপাড়া ধোপাখালির পর সুলতানপুর যেতে যেতে রয়ানি গানের কথা তো প্রায় শোনাই যায় না। যদি কেউ সিজনে গান পাতায় তা যেন একেবারেই হাউসে।

যাক, সেই গুমোট আর অস্বস্থিকর পরিস্থিতির ভিতরে আভার ওই গায়কী পরিবর্তন ধীরে ধীরে সত্যি কাজে দিয়েছিল। যদিও তা নিয়ে সমালোচনার তো কোনও শেষ ছিল না। প্রবীণরা কেউ বলত, ও মেয়ে গায় ঠিকই কুসুমের মতন, কিন্তু গানের ভিতরে অত চটকদার অভিনয় দেখানোর কী থাকতে পারে! ও কি সিনেমার নায়িকা নাকি? কেউ কেউ মনসার ভ‚মিকায় তার অভিনয়ের বিষয়টাও ভালোভাবে নেয়নি। শত হলেও দেবী। তার সঙ্গে মহাদেব আর চাঁদ সওদাগরের কথোপকথন অত ঢং করে দেখানোর কী থাকতে পারে। আবার, সেই তালে তখন তাল দিত হরষিত আর অধিরাজ। মনমোহন তখন খঞ্জনি বা করতাল বাজায়, সে-ও সুযোগ পেলে দাসু-বাসু ইত্যাদির সঙ্গে অন্যান্য ভ‚মিকায় যোগ দিত।
কেউ কেউ চিনুবাবুর কাছে অভিযোগ করত, এই আভা তো এতদিনের রয়ানি গানের ধরন-ধারণের আর কিছুই রাখল না। কেউ কেউ পারলে আরও বাড়িয়ে বলত, এই মাইয়ের গানের দলের দলকর্তা তুমি বা আপনি, এমন দল ছাড়ো না কেন? তখন সেই অভিযোগকারীর গলায় শোনা যাবে কুসুমের বাড়তি প্রশংসা। হয়তো মৃত কুসুমকেই তার ততক্ষণে ফেলেছে এই তল্লাটের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রয়ানি গায়িকা। সেখানে হয় চিনুবাবুকে দেওয়া হত সেরা দলকর্তার তকমা। স্বর্গীয় ল²ণচন্দ্রের নাম বলে কপালে হাত ঠেকিয়ে তারা বলত, একদিন তো তাকেও কাহিনি পরস্পরা ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে এই গানের দল নিয়ে থানা থেকে থানা, উপজেলা থেকে উপজেলা ঘুরতে দেখেছে তারা, দেখছে কুসুমের সঙ্গে চিনুকেও। আজ তাদের বিবেচনা, কুসুমের সঙ্গে চিনুই ছিল সেরা, তারপর আর অমন হয়নি। হয়তো সেই সময়ে কেউ কেউ হঠাৎ মাথার একদম ভিতর থেকে বসিয়ে নিয়ে আসত বিষ্ণুপ্রিয়া আর বঙ্কুবিহারীর নাম। তারা তখনও সজীব। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া আসরে ওঠেই না। কুসুমের মৃত্যুর পরে বিষ্ণুপ্রিয়ার আসরে না-ওঠাও তাই ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে আর এক বিলাপে। কিন্তু কী আর করা। বঙ্কুবিহারীকে কখনও কোনও বাড়ির রয়ানি গানের আসরে দেখা যায় বটে। তা একেবারেই দর্শক হিসেবে। কেউ তাকে তার দলের কথা মনে করিয়ে দিলে বঙ্কুবিহারী উদাস তাকাতও কি আসরে ছেড়ে চলে যেত, অথবা বলত, যে গানে সেই যদি বায়না নেয়ার পরে উধাও হয়ে যায় তাহলে সে আর দল চালায় কীভাবে। এই কথা বলে বঙ্কুবিহারী সঙ্গে সঙ্গে উদাস হয়ে যেত। অথবা, দেখতে আসা আসর ছেড়ে চলে যেত সে। ফলে বঙ্কুবিহারীহীন তল্লাটে চিনুবাবু অপ্রতিদ্ব›দ্বী!
চিন্ময় মন্ডল ওরফে চিনুবাবু মানুষটা দেখতে ছোট্টোখাট্টো, বোধেও তাই। কুসুমের প্রশংসা আর তাকে অপ্রতিদ্ব›দ্বী তকমা দিয়ে যে যাই বলুক তা তার বোধের চিঁড়ে সেভাবে ভিজত না। এইটুকু বুঝত সে, চারদিকের পরিস্থিতি যেভাবে পালটে যাচ্ছে, তাতে আভা যা করছে তা ঠিকই। তাছাড়া আভাকে বাদ দিয়ে তার পক্ষে অন্যদলে যাওয়া? অসম্ভব।

আভা যেমন কথা দিয়েছে সেও তো কুসুমের কাছে একই রকমভাবে কথায় বন্দি। না, কুসুমকে সে কোনও কথা দেয়নি। কিন্তু পড়শি ভাইবোনের মতো তারা দুজন এই তিরিশটা বছর ধরে দলটাকে টেনে নিয়ে চলেছে। আজ কুসুম নেই, আছে আভা। সেই দল ছেড়ে অন্য কোথায় সে যায়। আর যে যা-ই বলুক, পিছনে যত কথাই হোক, আভা রয়ানি গানের তেইশ প্রায় মেরে দিয়েছেÑ এতে চিনুবাবু চুপ থাকাই সমীচীন মনে করত। কারণ সে জানে, এই দলে শুধু আভা একলা নয়, আছে হরষিত আর অধিরাজ। হরষিত খোলে যা বোল তোলে, দল ছাড়লে আজকাল ও ছেলে যে কোনও দিন কোনও কীর্তনের দলে জায়গা পাবে। বাপের সঙ্গে বনিবনা কম বলেই হয়তো এখানে আছে। অথবা, আভা রয়ানি গায়, তাই দুইজন একসঙ্গে। নইলে চিনুবাবুর এটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে হরষিত কেমন বাজায়। আর অধিরাজ? এত ভালো হারমোনিয়ামের রিটে হাত চালায় যে কখনও কখনও তো ওর আঙুলগুলো দেখাই যায় না। আবার গানের সঙ্গে থামা আর শুরু করা, হাত তোলা হাত নাচানো। হরষিতের সঙ্গে একইভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ওই দুইজনের দারুণ জুড়ি। তাছাড়া, জ্যোৎ¯œা আর অঞ্জু আভার সঙ্গে যা সুন্দর সংগত দেয়! এমনকি মনমোহন বলে যে ছোকরা খঞ্জনি বাজায় তারও এই গানের উপর যথেষ্ট দরদ আছে। তারা সবাই এই মায়ার বাঁধনে বাঁধা।
ফলে, সিজন না-থাকলে, ঘোরতর বর্ষাকালে খেতে হাঁটু তলিয়ে ধানের পাতো (চারা) লাগাতে লাগাতে, কিংবা আশ্বিনের শেষে ধান খেতের ভিতরে দাঁড়িয়ে কিংবা বাড়ির সীমানায় ছোট্ট পুকুরের মতো ঘেরটার কিনারে দাঁড়িয়েও চিনুবাবু একমনে মনসামঙ্গল থেকে পদ আওড়ায় আর সে আগামী সিজনে পুবে আর দক্ষিণে, কি খানিক পশ্চিমে কোথায় কোথায় দল নিয়ে যাবেÑ সেই ভাবনায় বিভোর হয়। তার মনে হয়, আভা যা করছে সবই ঠিকই। দিনের বদলের সঙ্গে সব বদলায়। গানের ধরনও যদি একটু বদলায়, তাতে সবার এত আপত্তি কেন? কই বছরকে বছর বায়না তো বাড়ছে। নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। গৃহস্থের অনিশ্চয়তা কমবে। মানুষ আবারও গান পাতাবে। মা মনসার কৃপায় একদিন সবার অনায়াস স্বর্গারোহন ঘটবে।
তাই হয়তো একটু প্রবীণদের কাছে আভা আভারানি; আভার সমবয়েসিদের কাছে ঠমকে দেবশ্রী রায় আর একেবারেই তরুণেরা আভার রয়ানি গান শোনার বদলে দেখে অভিনয়। আর এর ভিতরে শোনা যায় অন্য ফিসফিসানি, আভা গায় আর কী, দেখায় ঢং! ওর লাঙে বাজায় হারমোনিয়াম ভাতারে বাজায় খোল। যদিও একথা পয়লা চিনুবাবুর কানে পৌঁছেনি। এমনকি দলের ভিতরে থেকে অধিরাজের প্রতি আভার বাড়তি কোনও টানও সে দেখেনি। বরং যেদিন একথা সে শুনেছে, বুঝেছে দলটা ভাঙার জন্যে এ আর এক পদের অপপ্রচার।

১৫

মালিপাটনের ঘটনাটাই আভার জীবন বদলে দিয়েছে। মালিপাটন জুচখোলার পাশের গ্রাম। সেখানের মালিবাড়িতে রয়ানির গানের আসরে ষষ্ঠ দিনে যা ঘটেছিল, তা সাধারণ কোনও ঘটনা নয় বরং দুর্ঘটনাই। এই তল্লাটের ইতিহাসে রয়ানি গানের আসরে কি আসরের আগে পরে আর কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। হয়তো ভবিষ্যতে কখনও কোনওদিন ঘটবে না।

এতে শুধু আভা কেন, বদলে গেছে চিনুবাবু আর অধিরাজও। এমনি মনমোহনের কাজ বদলেছে। সেসব যদিও সরাসরি যুক্ত নয়। এর সঙ্গে আভার বদলের আসলেই কোনও তুলনা করা যায় না।
সেদিন আভার গান শুনতে উপস্থিত হয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। আভা তার বিষ্ণুপ্রিয়া পিসিকে দেখামাত্রই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিল। তাই স্বাভাবিক। এমনকি কুসুম মাসিকেও তো দেখেছে, কত সমীহ করেছে বিষ্ণুপ্রিয়াকে। তার মতো সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু দেখা হওয়ামাত্র আগেই করজোরে কুসুম বিষ্ণুপ্রিয়াকে নমস্কার জানাত। বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রতি নমস্কার জানিয়ে জড়িয়ে ধরত কুসুমকে। তারপর বিষ্ণুপ্রিয়া তার স্বভাবমতো আভার প্রশংসা করত। প্রায় সব সময়ই জানত সেই একটি কথাÑ কবে আভা তার মামাবাড়ির কাছে একবাড়িতে তার গান শুনে পরে অবিকল একইভাবে বিষ্ণুপ্রিয়াকে শুনিয়েছিল। সেটা ছিল একটা ধুয়ো। কুসুমের সাত জনমের পুন্নি যে এমন মেয়েকে সঙ্গে পেয়েছে। সঙ্গে এও জানতে ভুলত না, এই মেয়ে সম্পর্কে তার ভাইঝি।

আজ কুসুম নেই। বিষ্ণুপ্রিয়া আভার গান শুনতে হাজির। ঘটনাটা আভা কোনওভাবেই মিলাতে পারে না। এই গ্রামকে পাশের খালটির কারণে মালিপাটন বলা হয় ঠিকই, আসলে এও তো জুচখোলারই অংশ। সেই গ্রামের সবচেয়ে বড়োঘর এই মালিরা, তাদের বাড়ির রয়ানি গানে বিষ্ণুপ্রিয়া আসবে তাতে অবাক হওয়ার কী। বিষ্ণুপ্রিয়া অবশ্য জানিয়েছে, আগেই আসত কিন্তু ‘তোর বঙ্কুমামার ছিদেম জ্বর সেই জন্যি আসাত পারিনি। একেবার প্রলাপ বকতিল। আইজকে কোমল সেই জন্যি আসতি পারলাম।

আভা সেদিন ভেবেছিল বিষ্ণুপ্রিয়াকে সেই কথাটা বলবে। এই যে সে কুসুমমাসির দলে, এজন্যে তার করার কিছুই ছিল না। আজ কুসুম নেই। দলটা তাকেই চালাতে হচ্ছে। কেন যেন বলা হয়নি। কথাটা বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলবে কি না তা হরষিতের কাছে জানতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, দরকার নেই কিছু বলার। পাশ থেকে অধিরাজ শুনেছিল, সেও বলেছিল বলার দরকার নেই, যা গেছে গেছে। অধিরাজ আরও যোগ করেছিল, এই যে সে আজ কুসুমের দল চালিয়ে নিচ্ছে, বললে বরং বুড়ির মনে হবে আভাকে সেদিন তার বাপ তার হাতে দিলে একদিন বিষ্ণুপ্রিয়ার দলটাই চালিয়ে নিত আভা! পরে আভার মনে হয়েছে, তার ঠিকই বলেছিল, সেদিন ওকথা বললেই বা কী, আর না বললেই বা কী যা ঘটার তা কোনওভাবেই হয়তো রোধ করা যেত না!

সেই আসরে আভার গানের প্রশংসা করেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। তার গান গাওয়ার ধরন যে তাদের আমলের চেয়ে অনেক জায়গায় নতুন তা বলেছিল। তার সঙ্গে একটু ভুলও ধরেছিল। বলেছিল, যখনও সাত দিনের গান, তখন কোনও কোনও অংশ আরও একটু বিস্তারিত গাওয়া যেত। জানিয়েছিল, আভা তো এই কয়েক বছর ধরে গায়, দলকর্তা চিনু যদি কাহিনির পরাম্পরা তাকে আর একটু ভালোভাবে ধরিয়ে দিত! এর সঙ্গে যোগ করেছিল, আজকের অংশে ‘লক্ষ্মীন্দর জীয়ান’ ‘ছয় ভাসুর জীয়ান’-এর এই-এই জায়গায় একটু বেশি মনোযোগ দিলে আভা আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারত। যেমন, আভা মনে করতে পারে বিষ্ণুপ্রিয়া তাকে গলা নীচের খাদে রেখে গেয়ে শুনিয়েছিল:
(প্রথমে ধুয়া গেয়েছিল):
ও বিষ নাইরে।
লখাইর শরীরে বিষ নাইরে।
কপালে হাত ঠেকায় বিষ্ণুপ্রিয়া। এরপর, আভা যে অংশে সমস্ত আসরকে একই সঙ্গে কেঁদে ভাসাতে আর উজ্জীবিত করতে পারে, সেই জায়গা গায় সে:
চারিভিতে চাহে লখাই স্থির নহে মন।
বেহুলারে চিনে মাত্র না চিনে অন্য জন/
লক্ষ্মীন্দর বলে বেহুলা বুঝিতে নারি কার্য।
কোথায় আসিয়াছি এ দেশ কোন রাজ্য/
সত্যি, এখনও গলায় কী ক্ষমতা। হয়তো আভার মতো অভিনয় করে দেখাতে পারে না। আসরের পরে আর সে সুযোগ নেই। এখন সবাই খেতে বসবে। উঠানের অন্য প্রান্তে দুই সারিতে পাতা লাছা হয়ে গেছে। কিন্তু হ্যাজাক আলোয় বিষ্ণুপ্রিয়াকে আবার অপরিচিত লেগেছিল। কাঁপা গলার বিস্ময়কর টানে সত্যি তাকে ওই মুহূর্তেটিকে অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিল।

আভা বলেওছে সে-কথা, ‘ও পিসি, যা শুনাইলা। এহোনো তোমার গলায় যা তেজ। এই যে আসরের এক কোনায় বইসে শুইনেও মনে হল সারা উঠানের মানুষ শুনতি পারিচে।’
‘হইচে। তোর এহোন গলায় জোয়ার, তুই তো ওইরাম শুনবিই। ছেমড়ি আমার আর সেদিন নেই।’
‘হ, ক’লিই হল?’
‘এহোন তোগে দিন। মা মনসার এই গান তোগে গলায় গ্রামকে গ্রাম ঘুইরে বেড়াবে। বাঁইচে থাকপে বিজয় গুপ্ত মশাইর মনসামঙ্গল। ‘জয় পদ্মাবতী’ বলে বিষ্ণুপ্রিয়া কপালে হাত ঠেকায়। হয়তো এরপর ছয় ভাসুর জীয়ান নিয়ে কোনও কথা বলত, কিন্তু মালিবাড়ির লোকজন তাদের খেতে ডাকায় বিষ্ণুপ্রিয়া আর তা বলার সুযোগ পায়নি।

বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে থেকে ওঠার পর পরই সে আভাকে বলেছিল, ‘মা জামাইরে ডাক। তোগে দুইজনরে একসাতে নিয়ে কয়ডা সেবা করি।’ তাই ঘটেছিল। বিষ্ণুপ্রিয়া মাঝখানে, তার ডাইনে আভা বামে হরষিত। আভার ডাইনে জ্যোৎস্নার এইভাবে বলেছিল তারা মাটিতে পাতা পেতে উঠানের এক কোনায়। খাবার পরিবেশ করা হচ্ছিল হরষিতের দিক থেকে। বিষ্ণুপ্রিয়ার বয়েস হয়েছে, কিন্তু এই বাড়িতে প্রবীণ রয়ানি শিল্পী হিসেবে সম্মানীয়, তাকে কোনও পদের খাবার বেশি দিলেই সে কখনও হরষিত কখনও আভাকে তুলে দিয়েছে।
এই পর্যন্তই। রাতেই সেই শেষ প্রহরে এরপর বিষ্ণুপ্রিয়া নিজের বাড়িতে চলে যায়। আভা জ্যোৎস্না অঞ্জু ঘুমাতে যায় গোরস্তের বড়ো ঘরে। হরষিত অধিরাজ মনমোহনসহ বাকিরা কাছারি ঘরে। ভোর হয় হয় এই সময় আভাকে এসে ডেকেছিল মনমোহন, ‘ও বউদি, হরদা খালি টাট্টিতে যায়। দোস্ত হইচে। বমি আসে কিন্তু আসে না।’

শুনে, মালিবাড়ির লোকজনও কেউ কেউ জাগে। হরষিত কাহিল হয়ে পড়েছে। মালিপাটন থেকে নাজিরপুর থানা সদর দূরে। বরং, ওপারে কচুয়া থানা সদরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগে নেওয়া যাবে। আর্সেনিকমুক্ত চাপকলের জলে ওরাল স্যালাইন খাওয়ানো হয়েছে হরষিতকে। পাশের বাড়ির এক কোয়াক ডাক্তার এসে কি একটা ওষুধও খাইয়ে গিয়েছে।
তখন সবার উদ্বেগÑ যদি নদী পাড় পর্যন্ত নেওয়ার ভ্যান না পাওয়া যায়? ভ্যান একটা জুটেছিল। খেয়াও ছিল। কিন্তু এইসব সংকট উৎরে হরষিতকে থানার ডাক্তারের কাছে নিতে নিতে সে প্রায় নেই। ডাক্তার এসে বলে রোগী শেষ!
ওই বাড়ির খাবারে আর কারও কিছু হয়নি, তাহলে একমাত্র হরষিতের খাবার নিয়ে তো কোনও কথা তোলা যায় না। হরষিতেরই এমন হবে কেন?

সকালে খবর পেয়ে নমিতা এসেছিল, সেই আভার কাছে জানতে চায় তাদের সঙ্গে আর কে কে খেয়েছে? আভা জানিয়েছে। তখন নমিতাই প্রথম আভার কাছে সন্দেহের কথাটা পাড়ে। মৃত হরষিতকে রঘুনাথপুরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানে উপস্থিত বিশ্বেশ্বরকেও কথাটা বলেছিল নমিতা। বিশ্বেশ্বর শুনে যেন মুক। বোবার মতো শূন্যে তাকায়। তার বন্ধু হরলালের দিকে তাকাতে পারে না। আভার মুখের দিকে তাকানোর মতো শক্তি তো তার নেই-ই। জীবনে কতভাবে কত ভুল ঘটে, বিশ্বেশ্বর ভেবেছিল। ওই জুচখোলার সীমান্তে মালিবাড়িতে একদিন ওঝাগিরি করতে এসে তার সঙ্গে ওই বিষ্ণুপ্রিয়ার পরিচয়। আজ সেই বিষ্ণুপ্রিয়াই তার জীবনটা এইভাবে তছনছ করে দিয়ে গেল। হা কৃষ্ণ হা গৌরাঙ্গ হায় হরিচান হায় গুরুচান। এই এক বিলাপ করতে করতে বিশ্বেশ্বর মৃত জামাই হরষিতের মুখখানা না-দেখেও বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিল। শুধু নমিতা কোনওভাবেই বিষয়টা যেন মানতে পারেনি। তার গলায় বিলাপ নেই। সে একবার একবার প্রায় মুর্ছিত আভার কাছে আসছিল আর গলায় অস্বাভাবিক দৃঢ়তা রেখে বলেছিল, ‘করিস দেহি বেউলার পাঠ, পারলি নে, পারলিনে তোর লখাইরে বাঁচাতি যা এহোনে চিতেয় যাইয়ে ওট।’ নমিতাকে কে থামায়। সে হরবিলাসকে তার সন্দেহের কথা বলে। কিন্তু বলেই-বা কী? প্রমাণ আছে কোনও? কিছুদিন পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, সেইদিন ভোর ভোর মালিবাড়ি থেকে আর নিজ বাড়িতে ফেরেনি বিষ্ণুপ্রিয়া। এ তল্লাট থেকে থেকে সেদিনই চিরতরে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিল!

১৬

বিষ্ণুপ্রিয়ার মৃত্যুসংবাদ দিতে আসা বঙ্কুবিহারী চলে যাওয়ার পরে, আভা তার জীবনের সেই দিনটিকে আর একবার ভেবে নিতে পারল। এইমাত্র ভেবেছে ভেবেছে আগ্রে। অবশ্য, কোনও ক‚ল পায়নি আজ পেল না। পাবে না, সে জানে। তারপর থেকে তো সে প্রায় ¯্রােতের শ্যাওলা। না, তা নয়। ভাবনাটা কোনওভাবেই দানা বাঁধছে না। বাঁধবে না সে জানে। এখন হিরোকে নিয়ে নমিতা স্কুলের দিকে যাওয়ায় তবু সে দানা না-বাঁধা ভাবনাগুলো একটার পাশে একটা ফেলে মিলিয়ে নিতে পারে। হয়তো অন্য কোনও সময় হলে তাই মিলিয়ে নিত সে। এখন আর? না, তাও দানা বাঁধবে না। তবু হঠাৎ, কেন যেন আবার অহল্যার কথাটা মনে পড়ে। উঠোনে শেষ কার্তিকের রোদ। আভা সিদে দক্ষিণে তাকায়। একবার ভাবে, আজ অধিরাজের আসার কথা আছে, যদি আসে। এখন আসলেই বরং নিরিবিলিতে দুটো কথা বলা যেত। তারপর পাশের শরিকি ঘর থেকে কারও একটা ডাকে অধিরাজকে নিয়ে চিন্তাটা কেটে যায়। একটা বাচ্চার গলা। মা বলে ডাকছে। তাতে আভার নিজের মাকে মনে পড়ে। এভাবে কখনও কখনও প্রায় তারস্বরে মাকে ডাকত ছোটোবোন বিভা। হরষিতের মৃত্যুর দিন পনের বাদে, মাথা কামানো ছোট্ট হিরোকে কোলে নিয়ে অহল্যা বলেছিল, ‘মা শীতলার অভিশাপ!’

অহল্যা কখনওই পরিস্থিতি বুঝে কথা কওয়ার মানুষ না। সেদিও বলেনি। তার মেয়েটার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। আবাল নাতিটি বাপ হারা হয়েছে, এখন সে তারই কোলে। তবু এর ভিতরে অহল্যার যেন অমন কথা না বললেই নয়। হয়তো পিছনে একটাই কারণ আভার বাপ বৈষ্ণবভাবাপন্ন, কোনও কালেই প্রতিমার পায়ে মাথা ঠোকেনি। সে কালী হোক কি দুর্গা; বাসন্তী কি শীতলা। ঘরে অহল্যা লক্ষ্মীর প্রতিমার সামনে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায় ঠিকই, আজতক কোনও বিষ্যুদবারে সে প্রতিমার জন্যে দুটাকার বাতাসা কিনে আনেনি বিশ্বেশ্বর। ওদিকে মেয়ে গায় রয়ানি গান। তার প্রতি অন্য দেবীর কুদৃষ্টিতো থাকতেই পারে। নয়তো, অমন জোয়ান তাজা জামাইটা এক শেষ রাত্তির পোহানোর আগেই ওইভাবে শেষ হয়ে যায়!
অহল্যার কানে একথা ঢুকিয়ে ছিল বিভার শ্বাশুড়ি। তাতে কম করে হলেও বিভার সায় ছিল। তার শ্বশুরবাড়ির সামনে শীতলা খোলা। কে জানে সেই দীর্ঘা ইউনিয়নের লোকজন বুঝি ডায়রিয়া পাতলা পায়খানা কোনও দিনও পটল তোলে না!

মায়ের অমন কথা শুনে চকিতে সেদিকে তাকিয়েছিল আভা। অহল্যার কোলে বছর আড়াইয়ের হিরোর হাতে একটা কাঁচা আম। তার মনে হয়েছিল, ছেলেটার অমন করে কাঁচা আম খাওয়া ঠিক না। যদিও বিভা বলেছিল, ‘এহোন এইসমস্ত কথা কইয়ো না মা।’
‘ওরে বাপু কই কী সাধে তোর বাপ সারাডা জীবন কী কইরে কাটাল। সে ফল ভোগ করতি হবে না?’
বিভা বলেছিল, ‘বাবা আবার কী করল?’
‘সেই তো করল, করল আর কেডা? ওই বিডিরে ধম্মবুইন বা ডাকিল কেডা? আর এই মাইয়েডার দিক চোখও তো পড়িল তার। আমি জানি, সেইয়ের প্রতিশোধ নিছে।’
বিভা একথার কিছু বুঝেও যেন বুঝতে পারছিল না। তবে তাদের মা যে কথাটা বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে বলেছে, তা বুঝেছে। কিন্তু তার ভিতরে বাকি যে সমস্ত গোমর তা সে বোঝে কীভাবে?
যাক যা গেছে গেছে। সেইসমস্ত কথা এখন আর ভাববে না আভা। প্রায় স্রোতের শ্যাওলা হয়ে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে অধিরাজ অন্তত তাকে ফিরিয়েছে। সেকথা আভা ভেবে নিতে চায়।

১৭

হরষিতের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটা ঘটেছিল ভরা সিজনে। মালিপাটনের মালিবাড়ির পরে পর পর তিন সপ্তাহ নদীর এপার ওপার তিনবাড়িতে রয়ানি গানের বায়না ছিল। কিন্তু, দুর্ঘটনায় তো কারও হাত থাকে না। আভার পক্ষে এই সিজনে তো ভালো, সামনে কতদিনে আসরে ওঠা সম্ভব হবে, তা যেন মা মনসাই জানে।
চিনুবাবু সান্ত¦নাস্বরে সাদা শাড়ি পরা আভাকে বলেছিল, ‘খুকি, তোর গায় এই বেশ এই জীবনে দেখতে হবে, তাতো কোনও দিনও ভাবিনি। তবু দেখলাম।

পাশে দাঁড়ানো নমিতা বলেছিল, ‘ও কা, থাক এই যে কইয়ে আর কী? যাতে হিরোরে নিয়ে বাঁইচে থাকতি পারে।’ এরপর নমিতা গলা নামিয়েছে, বাড়িতে শ্বশুর আছে, তাকে ভালোই চেনা আছে তার। বলেছিল, ‘ওই হিরোরে নিয়ে বাঁইচে থাকার উপায়ও ওই গান। ওরে আবার আসরে উঠতি হবে। সে আইজ হোক আর কাইল হোক। আপনি ওর মাথার উপর দিয়ে কোনওভাবে হাত সরাইয়ে নিয়েন না।’

অনেকে যেমন ভাবে, চিনুবাবু বোধে একটু খাটো, সেই জন্যেই হয়তো মানুষটা একটু একরোখাও। স্থানীয় ভাষায় অনেক প্রশংসা অনেকে নিন্দা করে যাকে বলে, ঘাউড়ো। অর্থাৎ, ঘাড়ত্যাড়া। যদি সে অনেকের মতো বেশি বোঝা পদেরই হতো তাহলে যখন আভার গান নিয়ে আপত্তিগুলো উঠেছিল তখনই হাত সরিয়ে নিত ওর মাথার ওপর থেকে। তালেশ্বরের কমলিনী আর রথখোলার পারুলের মতো উঠতি রয়ানি গায়িকারা তাকে দলকর্তা হিসেবে পাওয়ার জন্যে ইতিমধ্যে চেষ্টা করেছে।

এসবের বাইরে চিনুবাবু মনের কোনে অন্য আশংকাও খেলা করে। সে বড়ো জটিল দোলাচল। মানুষের রুচি দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে। হিন্দুদের আজকাল পূজা আর্চার বিষয়টা আর আগের মতন নেই। এক দুর্গা পূজাতেই যত ধুমধাম। বাকি ছোটো পুজোগুলো দিনকে দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আয়োজন প্রায় নেই। বলি উঠে গেছে। ব্রত পার্বণ আজকাল মেয়েরা পালনই করে না। শিবরাত্রির উপবাস কিংবা নিস্তানি পূজার কথা শোনাই যায় না। ফলে, আর কত কাল গ্রামকে গ্রাম এই রয়ানি গানের আসর টিকবে কে জানে। তার জীবন তো গেছে। তা আভা যতই গানের ধরন পালটাক, চারধারের পরিবর্তনের সঙ্গে একদিন আদৌ কেউ আর রয়ানি গান শুনবে, তাও যেন তার কাছে দুরাশা মনে হয়। তবু পদাবলি কীর্তন আর নামকীর্তনের জোয়ার দেখে চিনু বাবু। তাতে বারোয়ারি হরিখোলা কি হরিসভাগুলোর উৎসাহেরও প্রায় শেষ নেই। কিন্তু চারদিকে রাস্তাঘাট বাড়ছে, বিদ্যুতের আলো বাড়ছে, হারিকেন কমেছে, আসরে হ্যাজাক জ্বলবে না আর তারপর সাপের ভয়ও তো মানুষের থাকবে না। একথা তাকে বলেছিল তার এক উচ্চশিক্ষিত সহপাঠী। তারা একসঙ্গে নাটাইখালি স্কুলে পড়ত। চিনুর গোটা মনসামঙ্গল মুখস্থ জেনে সে বলেছিল, ‘তোর যা স্মৃতিশক্তিÑ কাজে নাগাইলি নারে চিনু। আইজ ওই পদ্মাপুরাণ বইলে দিন পার করো। তবু ভালো কয়দিন বাদে ওই বই দেখিছে এমন মানুষই এই তল্লাটে থাকপে না। আইজকাল যে ডিজে জেনারেশন!’
শব্দটা সেই প্রথম শুনেছিল চিন্ময়। পরেও আর অনেকদিন শোনেনি। শহরের এমনকি গ্রামেও অনেক ছেলেমেয়ে সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত। (চিনুর মোবাইল নেই। আভারও না।) সেসমস্ত ছেলেমেয়েরা শুনবে রয়ানি গান। এ তো আশঙ্কার কথা।
দেপাড়া থেকে কোন্দলার দিকে ইজি বাইকে যেতে যেতে সেই বন্ধু চিনুর কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘এই যে আমরা এই এলাকার মানুষজন রাত্তির ধইরে মনসামঙ্গল গাওয়াকে রয়ানি গান কই এই রয়ানির অর্থ জানিস চিনু?
অর্থটা জানত চিনু। আজ আর মনে নেই। হয়তো মনে আছে কিন্তু পুরো বিষয়টা স্পষ্ট নয়। সে কিছু বলছে না দেখে চিনুর বন্ধু বলেছিল, ‘রজনি থেকে রয়ানি।’
এইটুকু বলতেই যেন পুরো বিষয়টা চিনুর স্মরণে এসেছিল, ‘হুঁ, মনে পড়িছে। সন্ধ্যারাত্তির দিয়ে গাওয়া হয় শুরু হয় এই গান, তাই রয়ানি।’
‘হুঁ। রজনি ধীরে ধীরে রয়ানিতে পরিণত হয়েছে।’
‘এক-তিন আর সাত রাত্তিরের গানÑ কিন্তু কতদিন যে আর এইয়ে গাওয়া যাবে, তা তোমরা ক’তি পারোÑ আমরা কিছু বুঝি না।
চিনু তার শিক্ষিত বন্ধুকে হঠাৎ তুই করে বলতে পারে না। সংকোচ হয়, চাকরি করা অফিসার মানুষ। সেই বন্ধু তখন চিনুর মুখে আশংকা দেখেছিল। পরিস্থিতি স্বস্তিকর নাকি অস্বস্তিকর তা শহরে যেভাবে বোঝা যায়, গ্রামের ধরন নিশ্চয়ই উলটো। তবু সে বলেছিল, ‘কেন কী হইচে?’
‘থাহো তো টাউনে। সেহানে এই রয়ানি গানও নেই আবার অন্য উৎপাতও নেই। আবার রয়ানি গানের প্রয়োজনও নেই।’
চিনুর বন্ধু বলেছিল, ‘এ তো আসলেই আশংকার কথা!’
সেই আশংকার কথা কি আভাকে বলা যায়? না, তা তখন সে বলতে পারেনি। বলতে চায়ওনি। বরং আবারও বলেছিল, ‘শোন মা আভা, নিজেরে শক্ত কর। জীবন এমনই। ভগবান কার জন্যে কখন কোথায় কী লিখে রাখছে তা কেউ জানে না।’

১৮

এই ‘কেউ জানে না’ কথাটা চিনু মাঝে মধ্যেই বলে। বলে, সবই তার লীলা। কিন্তু অধিরাজ বলে প্রায় উলটো। ভুরু নাচিয়ে কয় সে-কথা। এমনকি অনেক অনেকদিন আগে শপথকাঠির ভিতর দিয়ে বাবার সঙ্গে ভ্যানে যাওয়ার সময়ে যে অধিরাজকে দেখেছিল আভা, সেই দেখার কথা যে আজও তার মনে আছে, তা কথা বলার সময়ে হঠাৎ একটু ভুরু নাচানোর জন্যে। এমনিতে অধিরাজের যা চেহারা, তাও যে-কোনও মানুষ দেখলে এমনিতেই মনে থাকার যথেষ্ট কারণ আছে। যদিও তেমন ভাবে আভা তো তাকে সেদিন দেখেনি। অথবা, দেখে মনে রাখার কোনও কারণ ছিল না। আর হরষিতের সঙ্গে কুসুমের দলে আসার পর থেকে সিজনে কতই দেখা হয়েছে। কিংবা অধিরাজ তার সানপুকুরিয়া গ্রাম থেকে খেয়া পার হয়েছে এসেছে রঘুনাথপুর। ফিরে যাওয়ার সময়ে হরষিত আর আভার সঙ্গে দেখা করে গেছে। যখনই এসেছে হিরোর জন্যে হাতে বাঁধিয়ে খাওয়ার কিছু নিয়ে এসেছে। আজও এনেছে। মাথাকামানো হিরোকে একবার কোলে নিয়ে তারপর দিয়েছে বউ সাবিত্রীর কোলে। বারান্দায় সাবিত্রীর পাশেই দাঁড়ানো নমিতা। হিরো নমিতার কোলে যাবে। অধিরাজ খানিকটা পরিচিত হলেও সাবিত্রী একেবারেই অপরিচিত বাচ্চাটার কাছে। এই কয়দিন বাড়ি ঘরে নানান মানুষ দেখেছে হিরো। এার ভিতরে হরষিতই একমাত্র নেই। যতটুকু বুঝতে পারে তাতে বাবা কোথায় কেউ জানতে চাইলে হাত তুলে দেখায় তার বাবা খালের পাশে। সেখানেই চিরতরে রাখা হয়েছে হরষিতকে। দাহ করা হয়নি। তাই হিরোর হয়তো কখনও কখনও মনে হয়, একদিন না একদিন তার বাপ উঠে আসবে মাটির নীচ থেকে। হিরোকে কোলে নিয়ে নমিতা সাবিত্রীর সঙ্গে খালপাড়ের দিকে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে অধিরাজ বলেছিল, ‘চিনুদা কী সমস্ত কয়, যেন গীতা পাঠ করতেচে। কী ভাইগ্য কর্মফল, সবই ভগবানের লীলা খেলা!’
এই মাসখানেকে আভার মন এখনও নরম। উপরে সে যতই শক্ত হওয়ার অথবা শক্ত দেখানোর চেষ্টা সে করুক না কেন, হিরোর মুখের দিকে তাকালে নিজস্ব সেই শক্তভাব মুহূর্তে উবে হারিয়ে যায়। চোখ দুটো জলে ভরে। ভাগ্য ভালো ছোটো ভাসুরপো হিমেল সব সময় হিরোকে নিয়ে খেলে, কাছে রাখে। নমিতাও চোখছাড়া করে না। যদি একলা মানুষ হত, ধারে কাছে কেউ না-থাকত, তাহলে আভা জানে না এই কষ্ট সে কী করে সামাল দিত! অধিরাজের কথাটা অন্য সময় হলে আভা হয়তো অন্য উত্তর দিত, এসময় বলেই সে বলেছিল, ‘ঠিকই তো কয় চিনুকাকা!’
‘হয় হইচে। ওইয়ে ভাবদি গেলি আর জীবন চলে না।’ বারান্দায় চেয়ার টেনে বসেছিল অধিরাজ। নমিতা তাকে আগেই বসতে বলেছে, তখন বসেনি। একটু আগে আভাও বলেছে, তখনও বসেনি। কিন্তু কথাটা বলার পরে সে দপ করে বসে পড়েছিল। তারপর আভার উত্তর শোনার জন্যে ভুরু নাচিয়ে তাকায়। কিন্তু আভার উত্তরটা অধিরাজের কাছে মোটেই জুতের মনে হয়নি। অনেকটা যে জলেপড়া মানুষের মতো উত্তর দিয়েছে সে। তাই সেই সময়ে অধিরাজের জোড়ভুরু আবার নেচে উঠেছিল, ‘কী কও তুমি, জলে পড়ছ?’
আভা কিছু না বলে ঘরে চৌকাঠে বসেছিল।
অধিরাজ বলেছে, ‘না, জলে পড়ো নাই। এই অধিরাজ মাঝি আজও বাঁইচে আছে। সে জানে, এই তল্লাটে এহোন তোমার চাইয়ে ভালো রয়ানি গান আর কেউ গায় না। আসলে চিনুদা পাইচে ভয়।’
আভা চুপ করে শুনছিল অধিরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে।
অধিরাজ এবার ব্যাখ্যা দেয় কেন চিনুবাবু ভয় পেয়েছে, ‘সে ভাবিচে, যদি সত্যি সত্যি মা শীতলার অভিশাপ লাইগে থাহে? না’লি (নইলে) হরষিতের মতো একজন জলজ্যান্ত মানুষ ওইভাবে এক ভোর রাতে শেষ হইয়ে যায়। আর কারও কিছু হল না।’
আভা কোনও কথা বলেনি। অধিরাজের মুখে দিকে তাকিয়েছিল। আবার সেই পুরানো কথা এখন খুঁচিয়ে তুলবে নাকি অধিরাজদা। এসব আর কত শোনা যায়। সে ভাবছিল, নামিতাদি এখন কেন ওদিকে গেল। সাবিত্রী বউদিও তো এখানে থাকতে পারত। আভা সোজা উঠোন বরাবর তাকিয়ে থাকে। এই মাসখানেকে সময়ে অসময়ে দরকারে অদরকারে ওই এক গান তার কানের কাছে কতজন কতভাবে গেয়েছে। এখন আবার শুরু করল অধিরাজ। আর পারা যায় না।
বৈশাখের বাতাস হঠাৎ একটু উত্তাপ-মাখিয়ে গালে লাগে। গাছের অল্পবয়েসি পাতায় রোদের যে ঝিলিক, তাতে আভার বিরক্তি বাড়ে না ঠিকই, কিন্তু অধিরাজের কোনও কথাই সে যেন শোনে না। ফলে, একটু আগে অধিরাজের কথায় ভুরুর যে নাচানি ছিল তা আপসে থেমে গেছে।
অধিরাজ বলেছিল, ‘কী হইচে। এইসব পুরানো কথা শুনতি মন চাচ্ছে না? আচ্ছা কবনানে কিন্তু তুমি এট্টা কথা কওÑ ভাইঙে পড়াব না তো?’
‘আমি ভাইঙে পড়ব কি পড়িচি।’ আভা প্রায় জানতে চাওয়ার মতো করে একটু ঠ্যাস দিয়ে কথাটা বলেছিল, ‘সেয়া আপনারে ক’ল কেডা?’
অধিরাজ যেন আবার মুখে এমন কথাই শুনতে চাইছিল। এতে সে খুশি। কিন্তু আভার জিজ্ঞাসারও তো একটা উত্তর দিতে হয়। সে বলেছিল, ‘কবে কেডা, কওয়ার জন্যি ক’লাম। ক’লাম এই জন্যি, তোমারে ভাইঙে পড়লি চলবে না।’
‘ভাইঙে আমি পড়ব না। তয়, যে আমার এই ক্ষতি করিচে, সত্যি যদি সে কইরে থাকে, উত্তর দেওয়ার উপায়ও এট্টাÑ মা মনসার কৃপায় আমারে গান গাইয়েই যা’তি হবে।’
‘হঁÑ’
‘সেয়া আমি গাব। আপনি আছেন। চিনুকাকা।’
‘মোহন তো খোল বাজাতি পারে। চাকি (খঞ্জনি) বাজানোর মানুষ পাইয়ে যাব।’
‘কিন্তু এবার আমাগে যে ক্ষতি হল।’
‘ওরে জীবনে এইরাম হয়। আগাইয়ে পাচাইয়েই চলে মানষির জীবন। গানে আছে আছে আজ যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়…।’
‘কেন, চাঁদ সদাগর?
‘হঁ।’
‘এই দেখতিচেন সাদা থান পেঁচানো আভা। আইজে স্বামীর শোকে কাতর, এইরাম কাতর তো বেউলাও হইল, সেও তো আবার নাচিল ইন্দ্রের রাজসভায়।’
‘হুঁ।’
‘ছওয়ালডার দিক চাইয়ে আমারেও বাঁইচে থাকতি হবে। আমি তো আর স্বামীরে ফিরোইয়ে আনতি পারব না। অত পুণ্য এই তো করিনি এই জীবনে। কিন্তু বাঁইচে তো থাকতি হবে।
‘তাছাড়া’ অধিরাজ বলেও বলেনি কথাটা। বলতে চাইছিল আভা কি শ্বশুরবাড়িতে থেকে গান গাইতে পারবে? অধিরাজ বাকিটুকু বলার আগেই আভা বলতে শুরু করেছিল, ‘ওই শোকের ভিতরেও আমারে দল চালানোর মতো সাইজে গান গাইয়ে যা’তি হবে, উপায় নেই।’
‘হ। তয় আমি আছি। আমারে তোমার সাথে রাইখো।’ বলে অধিরাজ চেয়েছিল আভার হাত ধরে। কিন্তু যা দূরত্ব। অধিরাজ চেয়ারে, আভার চৌকাঠে বসা। আভা হাত বাড়িয়ে দিলে অধিরাজ ডাইন হাতে ধরতে পারত আভার বাম হাত।
অধিরাজ তাও বলেছিল, ‘সামনের সিজনে ছোটো-বড়ো সব বায়না নেব। এবার আমাগে ওদিকের কমলিনী আর পারুলের গেইচে রমরমা দিন। ওরা তো আগে ছোটো বায়না নেত। আবার আমরা আর না গাওয়ায় ওরা সব রকমের বায়না নি’ছে।’
‘শুনিচি। চিনুকাকা কইচে। তাগে দেপাড়ায়ও হাসিদি একেবারে সুলতানপুর হ’তি পান্ডাপাড়া পর্যন্ত বাদ রাখিনি। হাসিদি নাকি চিনুকারে তাগে দলে যা’তি কইল।’
পরস্পরের এসব কথা চলে। অধিরাজ তো এসেছিল আভার মনোভাব বুঝতে। ভিতরে কোনও মতলব করে সে আসেনি। তবু কথায় কথায় শুনতে চেয়েছিল, শোক সামলে উঠতে উঠতে আভার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যদি আভাকে দেখত এখনও একইরকম ভেঙে আছে, তাহলে সাবিত্রীকে দিয়ে প্রবোধ দেওয়াত। আসলে অধিরাজ জানে না কিন্তু বোঝে, আভার জন্যে সেই ভাবনাও তার হয়, এই ঘটনায় মেয়েটা যেন ভেসে না-যায়। যা গেছে গেছে, আভার গলার শক্তি সামর্থ কোনওকিছুই তো আর হরষিত নিয়ে যায়নি। তাই যদি হয়, তাহলে আভার পক্ষে আবার মাথাঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব।
দুজনেই সামনে তাকিয়েছিল। খালপাড় থেকে নমিতা সবাইকে নিয়ে ফিরছে। এখন সাবিত্রীর কোলে হিরো। এখান থেকে তারা ওদিকে যাওয়ার সময়ে সাবিত্রীর কোলে থাকতে চায়নি হিরো। নমিতার কোলে চলে গিয়েছিল। তারা এদিকে এগিয়ে এসে এল না, দাঁড়িয়ে থাকল। নমিতা সাবিত্রীর সঙ্গে নীচু গলায় কথা বলছে।
সেদিকে তাকিয়ে আভা বলেছিল, ‘আমার নিজেরে নিয়ে তো কোনও চিন্তে নেই। চিন্তে ওই ছওয়ালডারে নিয়ে। ওডারে মানুষ করতি হবে।’
অধিরাজ আভার কথায় ভাবছিল কী বলবে। হিরোর কথা উল্লেখ করায় সেও তাকিয়ে সাবিত্রীর কোলে হিরোকে দেখেছে। তারপর প্রায় স্বগোক্তির ঢঙে বলেছে, ‘সব ঠিক হইয়ে যাবে।’
‘হ’লি হয়। তয় আমার জীবনে যে ক্ষতি হইয়ে গেল তা কোনও দিন পূরণ হবে না।’
‘ওরে, একথা কইয়ে আর কী? এর উত্তর তো কেউ জানে না। তয় ওমুকে ওমুক করিছে, ওমুকের অভিশাপে ওমুকতা হইচে, এইয়ে ভাইবে না।’
আভার মনে হয়েছিল, অধিরাজ লোকটা দলে হারমোনিয়াম বাজায় ঠিকই, কোন পদাবলি কীর্তনের দলেও নাকি বাজিয়েছে, আসলে তার মনে হয় কোনও ভয় নেই, ভক্তি শ্রদ্ধাও নেই। মা মনসার নজর কারুর দিকে পড়লি কী ঘটে! এই ভেবে আভা বলেছিল, ‘ওই সব নাস্তিকের কথা কইয়েন না। মা আস্তিক মুণির (মা মনসার) কৃপায় সব হয়, তার বাপ মহাদেব দেবাদিদেব।’
‘সে তুমি কও, আমিও মানি, কিন্তু ভগবান বড়ো একচোখা।’
‘হ’তি পারে।’
‘হ’তি পারে না, সেইয়ে।’ অধিরাজের ভুরু নাচচ্ছিল। অর্থাৎ, সে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে, ‘ওই চিনুদার মতো লাগাম ছাইড়ে দেয়ার মানুষ আমি না, তুমিও না। খারাপ ভালো সব মিলিইয়ে জীবন। জীবন জীবনের মতো। ভগবান সবাইর দিকে চায় না। সেই জন্যি কইচি একচোখা, সেই ভগবানরে সায়েস্তা করার কায়দা হল, হাল না ছাড়াÑ’
নমিতা অধিরাজের কথা শুনছিল। সাবিত্রীর সঙ্গে নমিতার নীচু গলায় কথা শেষ। সে এদিকে এসে বলেছে, ‘ভাইডি, ভালো কথা কইচো।’
আভা বলেছিল, ‘কয় ভালো। দেহি সামনে সেয়া কাজে পরিণত করতি পারে নিকি।’
অধিরাজ চকিতে আভার দিকে তাকিয়েছিল। চকিতে, চোখ একটু বড়ো করে। যেন বুঝতে চেয়েছিল, হঠাৎ এমন কথা কেন বলল আভা।
এ সময়ে সাবিত্রীর বলেছিল, ‘কী বাড়ির দিক যাওয়া লাগবে না? চলো।’
দুপুর হয়ে

১৯

এই সময়ে, উলটো দিক দিয়ে যা আশঙ্কা করেছিল আভা তাই ঘটেছিল। হয়তো সেই ঘটনাই তার হাত নেই। যে বিপদ চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরছে, এই ছিল তার প্রথম ধাক্কা।
মেয়ের জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটায় বিশ্বেশ্বর স্বাভাবিক ভাবেই মন-মরা। আজকাল ওঝাগিরি সে প্রায় করেই না। আগে দরকারে অদরকারে গ্রামকে গ্রাম যে ঘুরে বেড়াত সেখানেও টান পড়েছে। বয়েসেও ধরেছে লোকটাকে। আভার ঘটনায় সে বাড়ি থেকে বের হওয়া কমিয়েছে। আবার, এই বসে থাকায় অহল্যাও সময়ে অসময়ে কানের কাছে কথা বলতেই থাকে। এইভাবে বসে থাকলে জীবন চলে না। অথবা, এইভাবে বসে বসেই সে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। বিশ্বেশ্বরের এই বসে থাকা রোগের কারণেই তাদের মেয়েটার জীবনে এমনতর বিপর্যয়। না, একেবার এই পর্যন্ত, অতটা অবুজ হয়ে অহল্যা বলে না ঠিকই, কিন্তু মনে করিয়ে দেয় মেয়েটার জীবনে যা ঘটে গেছে, তাতে বিশ্বেশ্বরের অন্তত একটু হাত-পা ঝাড়া দেওয়া দরকার।
অহল্যার কথাতেই হোক অথবা সেই পুরনো বাতিকেই হোক, বিশ্বেশ্বর ভাদ্দরে রোদে ছাতা মাথায় দিয়ে উত্তরমুখী হেঁটেছিল। বিকেল শুরু হওয়ার আগে সে পৌঁছেছিল শেখমাটিয়া হাটখোলায়। সেদিন সেখানে হাটবার। হাট তখনও বসেনি। আজকাল অবশ্য শেখমাটিয়ার হাটখোলায় কয়েকটি স্থায়ী দোকান বলেছে, বিকেলের দিকে প্রায় দিকই কাঁচাবাজার আর মাছ পাওয়া যায়। আর একটু এগোলে নদীর ওপারে ভাসার হাটখোলা এখন আর হাটখোলাই নেই, সেখানে বাজার। হাটের বাজারে পরিণত হওয়া, তবু হাটবারে পরিতোষ ডাক্তারে হোমিওপ্যাথি চেম্বার খোলা দেখে সে সামনের বেঞ্চিতে বসে পড়েছিল। কিন্তু ডাক্তার নেই। তাতে যেন বিশ্বেশ্বরের জিরোনোর একটু সুবিধাই হয়েছিল। সে ডাক্তার দেখাতে আসেনি। বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে ভাসার দিকে যাবে। আর যদি পরিতোষ এর ভিতরে আসে, তাহলে তার বড়বউদি কবে দেশে ফিরবে সে কথা জিজ্ঞাসা করবে। না হলে অন্যদিন।

এই সময়ে পরিতোষ সাইকেল থেকে নামে। পাশের কলেজের পিছনে একবাড়িতে রোগী দেখতে গিয়েছিল। সে-কথা জানিয়ে পরিতোষ বিশ্বেশ্বরের কাছে জানতে চেয়েছিল, সে কেন এখানে বসে আছে? বাড়ি থেকে এত দূর পথ। কোনও দরকার। এই হাটখোলায় তো আজকাল বিশ্বেশ্বরে আসার কোনও প্রয়োজন নেই। তাছাড়া চালিতাখালির উলটো দিকে কচুয়া থানা সদর। বাজারঘাটের প্রয়োজনে বিশ্বেশ্বর নিশ্চয়ই সেখানে যায়। পরিতোষ নিজেও কি তাদের গ্রামের মানুষজনও তো তাই করে। তাদের গ্রামের পাশের বৈরাগীর হাটই তো শুকিয়ে গেছে। সেখানেও কতকাল বিশ্বেশ্বরকে দেখেনি পরিতোষ। আসলে পরিতোষ বিশ্বেশ্বরের গ্রামকে গ্রাম ঘোরার বাতিকের কথা ভুলে গেছে। সেই জন্যেই যে এখানে এসে বসে থাকতে পারে বিশ্বেশ্বর, সে-কথা একবারও তার মনে আসেনি।

এই দুজনের ভিতরে একটা বৈবাহিক সম্পর্ক আছে। প্রায় শ’খানেক বছর আগে পরস্পরের গুষ্টির জেঠা ও পিসির বিয়ে হয়েছিল। তারা তাদের পরের প্রজন্মের শেষ দিকের সন্তান। সেই সম্পর্কের যেটুকু লতায় পাতায় জড়ানো ভাব তা তখনও তাদের ভিতরেই অবশিষ্ট আছে। বিশ্বেশ্বর বয়েসে সামান্য বড়ো। সেই তুলনায় পরিতোষকে দেখতে জোয়ান। পরিতোষ বলেছিল, ‘ও বিশ্বদা, কোনও সমস্যা?’
‘না। এমনে বইসে রইচি। জিরোই, হাঁটতে হাঁটতে বাড়িদে আসলাম। এত দূর পথ মেলা দিন হাঁটি না।’
‘হয়, কয়দিন যা মেঘলা গেল। বৃষ্টিও। মানুষ বাইরোত পারিচে কোনও দরকারে?’
‘আচ্ছা, ও পরি, তোগে বাড়ির বড়বউদি আসপে কবে?’
‘জানি না তো। তয় কার্তিক অগ্রহায়ণের আগে তো আসার কথা না। কেন ওদা?’
‘এমনে।’ আসলেই এমনি। বিশেশ্বর যেন জানে না দরকারটা কী। যদিও এটুকু জানে, অহল্যাই তাকে কদিন আগে কথায় কথায় খোঁজ নিতে বলেছিল।

পরিতোষ কঠার পাটাতনের দোকানঘরের মতো চেম্বারে উঠে গিয়েছিল। বসেনি, দাঁড়িয়ে কথা বলছিল বিশ্বেশ্বরের সঙ্গে। যদি রোগী আসে তাহলে বসবে। পিছনের আলমারিতে ওষুধ দেখেছিল, তখনই তার মনে পড়েছে আভার কথা। আভার স্বামীর নাম সে মনে করতে পারছে না, কিন্তু আভার জীবনে এও বড়ো ঘটনাটা ঘটেছে, ওই মালিপাটনে কি জুচখোলায় তখন কোনও ডাক্তার বৈদ্য ছিল না? অন্তত এক ডোজ। এই সময় পরিতোষ নিজেই ওষুধের নাম হাতড়ায়। আচ্ছা, যদি বিষ দেওয়া হয় ওয়াশ করা ছাড়া কোনও গতি থাকে না। ওদিকে বিশ্বেশ্বরও যেন অপেক্ষা করছিল, পরিতোষ কি একবারও তার বাড়িঘরের কথা জিজ্ঞাসা করবে না?
ওখনই পরিতোষ জানতে চেয়েছিল, ‘ওদা, মাইয়েডা আছে কীরাম?’
‘ওই আছে।’ শুকিয়ে আসা বলেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বিশ্বেশ্বর যেন স্বগতোক্তি করে। আবার, এতক্ষণে পরিতোষ তার কাছে আভার কথা জানতে চাওয়ায় সেও এখন কথা বলার একটা বিষয় পায়।
‘ওই আছে কী? মাইয়েডার কপালে এমন এট্টা ভোগ বাদল আর তুমি কত ওই আছে!’
‘কী কব, ভাইডি। মাইয়ের মুখের দিক তো আমি তাকাতি পারি না। সেই জন্যি দেকতিও যাই না। একদিন গেইলাম তয় শুনচি আছে কোনও রকম। নাতিডার কপালে এইয়ে ঘটপে।’
‘রয়ানি গান গায় না আর?
‘সেয়া তো ক’তি পারব না। কেন?’
‘আমাগে বড়বাড়ির মাইজদার পুত্রের বউ একদিনের গান দেবে সামনেÑ এই অঘ্রান মাসেÑ আমারে একদিন কইল, আমি তহোন আভার কথা কইলাম। কইলাম, বউমা ও এহোন কী অবস্থায় আছেÑ বিশ্বদার মাইয়েÑ’
‘দেহি, খোঁজ নেবানেÑ দেরি আচে এহোনো।’
বিশ্বেশ্বর পরিতোষের কাছে শোক জানানোর কোনও সুযোগ খুঁজছিল না। শুধু ভেবেছিল, পরিতোষ তো একবার ও জানতে চাইল না। পরিতোষ তবু বলেছিল, ‘আভার জীবনে এইয়ে হ’ল! ছ’ল-মাইয়ের (ছেলে-মেয়ে)জীবন ঠিকঠাক চললি বাপমার শান্তি।’

এদিকে পরিতোষের সঙ্গে আভার বায়না নেওয়া-র কথা শেষ হওয়ার পর পরই বিশ্বেশ্বর উঠে দাঁড়িয়েছিল। যেন, এখনই যদি পারে তো হেঁটে যাবে রঘুনাথপুর। এরপর খেয়া পার হয়ে সানপুকুরিয়া শপথকাঠির ভিতর দিয়ে পৌঁছবে কচুয়া। সেখানে থেকে টেংরাখালির খেয়া পার হয়ে যাবে বাড়িতে। আজ আর যাবে না ভাসায়।
বিশ্বেশ্বর হাঁটতে শুরু করেছিল। পরিতোষ তাকে ডেকেছিল। সে ফেরেনি। হঠাৎ আভা আর নাতিটাকে দেখার ইচ্ছা নাকি বায়নার সংবাদ দেবে সেই টানে বিশ্বেশ্বর বিকালের রোদ মেখে তখন বেশ দ্রুতই হাঁটছিল। আর হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবছিল, পরিতোষের বড়বাড়ির বউদি ফিরলেই কথাটা বলতে হবে। কিন্তু বিশ্বেশ্বরের তখনও জানা ছিল না, একটু পরেই তার এই কথাগুলো ভাবার কোনও দরকারই পড়বে না। তার রঘুনাথপুর পৌঁছানোর আগে উলটো পথে দেখা হবে হরলালের সঙ্গে।

কিছুদিন আগে ছেলেহারা হরলাল, একই রকম জামাইহারা বিশ্বেশ্বর। আর তাদের কতকালের বন্ধুত্ব। দেখা হওয়ামাত্র শোক প্রকাশের কোনও বিষয় তো তাদের নেই। পরস্পরের চোখেমুখে এমনিতেই লেপটে আছে বিষাদের ছায়া। তখন বিশ্বেশ্বর যে হরলালের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল, তাও তো হরলালের তাকে দেখেই বোঝার কথা। হরলাল থেমেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা যতটা না বিশ্বেশ্বরকে দেখে, তারচেয়েও বেশি তার ভিতরের এই কথাটা বলার জন্যে, ‘যদি পার কয়দিন মাইয়ে আর নাতিডারে তোমাগে বাড়ি নিয়ে রাখো।
এ কথায় অবশ্য বোঝা যায়নি, আভাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে হরলাল নাকি এমনিতে বাপ-মায়ের সঙ্গে গিয়ে থাকার কথা বলছে। শুনে, তখনই বিশ্বেশ্বর কিছু বলেনি। তবে, ভিতরে ভিতরে যে হরলালের কোনও মতলব আছে, তা বুঝেছিল সে বিশ্বেশ্বরের সঙ্গে নিজেদের বাড়ি পর্যন্ত না-আসায়।
আভাকে দেখতে এসে সে-বাড়িতে ঢুকবে কী, বিশ্বেশ্বর ভাবছিল, মেয়েটার কাপালে সামনে না জানি কী আছে! কিন্তু আভাকে কিছু বলল না সে। যদি তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়, সে জন্যে আসবে দুদিন বাদে।

চলমান বর্তমান

২০

বিশ্বেশ্বরের কথাই ফলেছিল। সিজনের শুরুতে আভার প্রথম বায়না পরিতোষদের বড়বাড়িতেই। না, তা বিশ্বেশ্বরের ইচ্ছা অনিচ্ছার তেমন কোনও কারণ নেই। সে যে পরিতোষকে কথাটা বলেছে, সেই কথাটাই পরিতোষ বলেছিল বিশ্বেশ্বরকে। ততদিনে আভা বাপের বাড়ি। বিশ্বেশ্বরের মাথায় বাড়তি বোঝা, তাই তার তরফ থেকে উপায় একটায় যদি মেয়ের জন্যে আসা কোনও বায়নায় সে তাকে রাজি করাতে পারে। আভার রাজি হওয়ায় কোনও সন্দেহ অবশ্য বিশ্বেশ্বরের ছিল না। সে শুধু সন্দেহ করেছিল এই, যদি আভা কোনও কারণে এক রাতের গানে সিজন শুরু করতে রাজি না-হয়। কিন্তু আভার রাজি না-হয়ে উপায় ছিল না। বাপের বাড়িতে আশ্রয় জুটেছে। ছেলেটো বড়ো হচ্ছে। ওদিকে ভাইটা বাগেরহাটে থেকে কলেজে পড়ে। ফলে, সিজনের শুরুতে এই বাড়িতে হোক অথবা যেখানেই হোক গান তাকে গাইতেই হত।

বড়বাড়িতে একদিনের গান। এ বাড়ির মেঝজনের বড়োছেলের বউর মানত। এরা একেবারেই শক্ত পরিবার। প্রতি বছর মনসা পূজায় পাঁঠা বলি হয়। কালীপূজা এখনও হয় আড়ম্বর করে। সেই অমাবশ্যায় পাত পেতে এখনও শানেক মানুষ খায়। কিন্তু রয়ানি গান মানতের ঐতিহ্য কোনও কালেই ছিল না। এ ¯্রফে ওই নতুন বউয়ের মানত। হয়তো তিন দিনের কি সাতদিনেরও হতে পারত, কিন্তু এই সব পরিবারের অনেক কিছুই ঐতিহ্যে থাকতে হয়, তা নেই বলে, পরিতোষের সেই মেঝবউদি অথবা ওই নতুন বউয়ের শ্বাশুড়ি একদিনের রয়ানি গানেই রাজি হয়েছে। ওদিকে বিশ্বেশ্বর ভেবেছে, এই সময়ে যদি এ বাড়ির বড়োবউ বাড়িতে এসে থাকে তাহলে সে যেজন্যে দেখা করতে আসতে চেয়েছিল সেই কথাটা পাড়বে। কিন্তু বড়োবউ আসেনি।

আভার নতুন সিজন শুরু হচ্ছে একদিনের রয়ানি গান দিয়ে। আন্ধারমানিক গ্রামের এই বাড়িতে গ্রামবাসী ইউনিয়নবাসী কি তল্লাটবাসী দেখবে নতুন আভাকে। বিধবা আভা এখন থেকে সাজবে সধবা বেহুলাব সাজ। যারা ভেবেছিল, মেয়েটা আর হয়তো গানই গাইবে না, তাদের কৌত‚হল আর এই বাড়িতে এক রাত্তিরের গান হলেও আত্মীয়বান্ধব মিলে লোকজন হবে বেশ। এক দাগে টানা এই গ্রামে এই গুষ্টিরই বাড়ি মোট বাইশখানা। তাই কেউ কেউ বলে বাইশ বাড়ির গ্রাম। যার পুরোটাই এই এক গুষ্টির। ওদিকে এত আয়োজন, এতকিছুর ভিতরে আর যে কারণ, সেটিই প্রায় চাপা পড়ে যায়।

ওই নতুন বউ, গতবার এই বাড়িতে আসার পরে মাঝ উঠানে একটা কেউটের ছাও দেখেছিল। মেয়েটি পুবের। অর্থাৎ, বরিশাল অঞ্চলের। সেখানে মনসার প্রতি ভক্তি এই দিকের চেয়ে তীব্র। সে-ই শ্বাশুড়িকে বলেছে। যদিও তার স্বামী আর খুড়োশ্বশুর পরিতোষ দুইজন উঠোনের কোনায় ও ঘরের চারদিকে কার্বলিক এসিডের বোতল রাখাই সমাধান মনে করে। কিন্তু বউটির অমন ভক্তিকেও একই সঙ্গে আমলে না নেওয়ার কোনও কারণ নেই।
ফলে, পরিতোষের বলা বিশ্বেশ্বরের অনুরোধ আবার পক্ষে ফেলানোর কোনও উপায় ছিল না। অথবা, হতে পারে বিধাব আভার দিকে তাকিয়ে অনেকে এইভাবে ভেবেছে, আসলে আভা তো চাইছিল, হোক একদিনের গান, সিজন তো শুরু হোক। সে বাড়ি বিশাল উঠানে আভা গান গাইবে। অন্য বছর হলে সকালে সে বাড়ি পৌঁছে মহড়া সেরে নিতে পারত, কিন্তু গত আট মাসের একবারও আসরে ওঠেনি, সেখানে যাওয়ার আগে অন্তত একদিন তো নিজস্ব রিহার্সেল দিয়ে নিতে হয়।

আন্ধারমানিক যাবার আগের দিক সন্ধ্যায় চালিতাখালি বিশ্বেশ্বরের বাড়ির আঙিনায় মহড়া। অধিরাজ আর মনমোহন এসেছে হারমোনিয়াম আর খোল নিয়ে। মনমোহন এতদিন এই দলে করতাল বাজিয়েছে। এখন সে খোল বাজাবে। আভার সন্দেহ হয়, সেকি হরষিতের মতো বাজাতে পারবে। না পারুক, পুরোদমে সিজন শুরু হতে এখনও দেরি আছে। এই মাসখানেকে অধিরাজ তাকে কিছু তালিম দিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু করতাল বাজানোর লোক? এই সমস্যার আপাতত সমাধান করে এসেছে মনমোহন। কাল সন্ধ্যা নাগাদ ওই বাড়ির আসরে পৌঁছে যাবে তার ভাইপো উজ্জ্বল। সে করতাল খুব খারাপ বাজায় না, কিন্তু আগে কখনও দলে বাজায়নি। তাকে দুই এক আসার সুযোগ দিলেই পেরে যাবে।

অঞ্জু আর সন্ধ্যা অবশ্য আসেনি। তাদেরও কাল এলেই চলবে। দোহারির কাজ। আভার ওই ঘটনার পরে তারা অবশ্য দোহারি করেছে একজন কমলিনীর সঙ্গে অন্যজন হাসির সঙ্গে। তাদের অন্য গায়েনের সঙ্গে দোহারি করা নিয়ে আভার অবশ্য কোনও আপত্তি ছিল না। আপত্তি যা করেছে দলকর্তা চিনুবাবু।
এদিকে অন্য সমস্যা, তাও আবার চিনুবাবুকে নিয়ে। সেটা মহড়া শুরু হতেই বোঝা গেল। আভা তার মেয়ের মতো। দলকর্তা হিসেবে সে গানের সূত্র ধরিয়ে দেবে। সেখানে বলবে শিবের কুমারী। বলবে পিতাপুত্রীর সম্পর্কে কথা। শিবের সেই কুমারী মেনকারও তো বিবাহের বিষয় কাহিনিতে আছে। আছে সতী বেহুলার স্বামীকে উদ্ধার। সেসব কথা তার মেয়েতুল্য বিধবা আভাকে নিয়ে গাইতে হবে!

কাহিনি ধরিয়ে দিতে চিনুবাবুর যেন ক্ষণে ক্ষণে সেই কথাই মনে পড়ছিল। সে আভার দিকে তাকায়। তার চোখ বড়ো হয়। আভাকে দেখে। আর বারবার তার মনে হয়, এই মেয়েটির জীবনে কী ঘটে গেছে। সেকি ওই মেয়ের গানের সঙ্গে বলে বলে, মনে করিয়ে দিয়ে রয়ানির কাহিনি এগিয়ে নিতে পারবে। আভা কোথাও খেই হারিয়ে ফেলবে না তো। যদি এই মহড়ার বিকালে তা নাও ঘটে কাল গানের আসরে কী তেমন কিছু ঘটবে না? মাত্র তো একদিনের গান। কাহিনি দ্রুত এগোবে। চিনুবাবুর জানা আছে গেরস্তবাড়িতে কোনটুকু বেশি শুনতে চায়। প্রথম দিকের কাহিনি প্রায় একটানে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। চাঁদ সওদাগর মা মনসাকে পূজা দেবে না কোনওভাবে। ছয় ছেলে যাবে। সপ্ত ডিঙ্গা যাবে। এরপর লখাইকেও সাপে কাটবে। লোহার বাসর ঘরেও কোনও কাজ হবে না। একদিনের কাহিনি শুরু হবে এই জায়গা থেকে। বেহুল দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে তার স্বামী লখিন্দরকে।

চিনু দেখল, না, আভা একই আছে। গানের গলায় কোনও বদল নেই। এই যে প্রায় আটমাস গায়নি, কোনও রেওয়াজ করেনি, জীবনের উপর দিয়ে অমন ঝড় বয়ে গেছে, তার কোনওমাত্র আভাস সেখানে নেই। চিনু তো তাই চাইছিল। অধিরাজ হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে ভাবল, আর ভয় নেই। আভা পারবে।
চিনুবাবু শুরু করল কাহিনি অনেকখানিক এগিয়ে নিয়ে। আভার সঙ্গে সেভাবেই তার যুক্তি করা ছিল। একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলে এই মাত্র এক রাত্তিরে কতটুকুই-বা গেয়ে তোলা যাবে।
চাঁদ সওদাগরের মনসার পূজা না-দেওয়া গাওয়া হয়েছে একটু আগে। শেষ বিকেল ধীরে ধীরে সন্ধ্যায় মিলে যাচ্ছে। এরপর লখিন্দরের বাসর। এ পর্যন্ত আভাকে গান বা অভিনয় দুটোই সেভাবে দেখাতে হয়নি। চিনুবাবুর বলার কাহিনির মাঝখানে ধরে সে গেয়ে গেছে। কোথাও কোথাও গায়ওনি। কখনও আভা ধরেছে, দোহার হিসাবে অঞ্জু বা সন্ধ্যা কাজ চালিয়ে নিয়ে গেছে।

লোহার বাসর ঘরে লখাইকে দংশিছে কাল সাপ। লখাই নেই। গাঙুড়ের জলে তাকে ভাসানো হবে। এই লাশের সঙ্গে যাবে সদ্য বিবাহিতা বেহুলা। ভেলায় ভেসে ভেসে যাবে সে। আগে এই দৃশ্যে অভিনয় করেছে সাধারণত মনমোহন। তবে মাঝে মধ্যে অধিরাজ কিংবা হরষিত। আজও তাই ঘটত। মনমোহন হয়তো লখাইর মতো নিস্তেজ শরীরে শুয়ে থাকবে। কিন্তু তার আগে, আভা এই বাড়ির এক কিশোরকে হাত ধরে উঠানে বিছানো পাটির এক কোনায় নিয়ে এল। এই লখাই। লখাইকে উদ্ধারে করা হবে। ওই কিশোরের মায়ের কাছে আভা বকসিশ চাইল। তার মায়ের কাছে গিয়ে বেশ সুর ধরে গান গাইল। এমনকি ওই কিশোরকে বলল, যে যেন চাঁচে শুয়ে পড়ে।

অঘ্রানের শেষ দিক। এই বাড়ির উঠানে ধান আছে। তবে তা এক কোনায়। কাছারি ঘরে উলটো পাশে কিছু ধান মলনের জন্যে রাখা হয়েছে। এরা এখন আর নিজেরা ধানের কাজ করে না। জমি বান্দা লাগিয়ে দেয় বছর কাবারিতে। তবু চারদিকের ধানের গন্ধে, হালকা মম একটা ভাব। শীত পড়তে এখন বাকি কিছু দিন। তবে, সন্ধ্যা রাত্রে একটু শীত শীত ভাব। তবে গায়ে চাদর জড়াতে হয় না সন্ধ্যারাতে। ওই কিশোরকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে লখাই বানানোর আগে তার মা আভার কাছে কোনও একটা ফয়সালা করে। তাতে আসার জুড়ে বেশ হাসির রোল। যদিও এই দৃশ্য বা কাহিনি তো এখন আর হাসির থাকবে না। পূর্ণ বিষাদ। দুঃখের। কষ্টের। এক নারী তার জীবনের সকল চেষ্টা এক করে স্বামীকে ফিরিয়ে আনবে। ওই ব্যাপারটা ফয়সাল হওয়ার ভিতরেই অধিরাজ মনমোহনকে দেখিয়ে দিল, হারমোনিয়ামের কোন দুটো ঘাট চেপে রেখে ধীরে ধীরে বেøাটা টেনে যেতে হবে। এখন খোল দরকার নেই। ধীরে ধীরে হারমোনিয়ামের ওই শব্দ এই সদ্য সন্ধ্যার অন্ধকারে তৈরি করবে বিষাদময় আবহ।

এক রাত্রির আয়োজন বলেই কোনও হ্যাজাক নেই। উঠানে কোনও বাল্বও টেনে আনা হয়নি। তবে ওই চাঁচখানার কোনায় আর উঠানের আরও দুই দিকে হারিকেন রাখা হয়েছে। এই উঠানের সামনের দিকে মÐপ। সেখানে কালীমূতি। সেই মন্ডপের সামনে মনসার একটা ছোট্ট ঘট স্থাপন করা হয়েছে। অধিরাজ তাহলে এখন লখাই সেজেছে। আভা শাড়িটা আঁচলে পেঁচিয়ে গান শুরু করার আগে আধো অন্ধকারে চিনুবাবু এই জায়গার কাহিনি বলে দিল। আভা তাকে এই সুযোগটা দিল এই জন্যে যে, তাতে এক উপযুক্ত আবহ তৈরি হবে। হলও তাই।

এখন অধিরাজ লখাই। আভার কী হল কে জানে। সে গানের অনেকখানিক সুর টেনে গাইতে গাইতে যেন হরষিতকে হারানো আভা হয়ে যাচ্ছিল। চারদিকে তাকাল। অকুল পাথার। এর ভিতরে অধিরাজ তাকাল। আভা তার মুখ নামিয়ে এনেছে অধিরাজের মুখের কাছে। তার লখাই। বসে কোলে তুলে নিল অধিরাজের মাথা। আর সেই মুহূর্তে অধিরাজ চোখ খুলে তাকালে, আভার চোখের জল পড়ল, অধিরাজের নাকের পাশে পড়ে চোখের দিকে গড়িয়ে গেল।
অধিরাজ জানে না, এই মুহূর্তে সে কোন আভাকে দেখল। আগে যেন কখনওই দেখেনি ওই মুখ। মুখে বিষাদ আছে কষ্ট আছে। তারপরও আধো অন্ধকারে চোখে চোখে পলকহীন দৃষ্টি।
অধিরাজ তখন যদিও লখাই তবু ওই তাকানোর কোনও অর্থ ওই মুহূর্তে খুঁজে পেল না। চাঁচে শুয়ে শুনছিল, আভা তাকে উদ্ধারের জন্যে চলছে ইন্দ্রের রাজসভার দিকে।

রাত তৃতীয় প্রহর। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। অধিরাজ কাছারিঘরের সিঁড়িতে বসে। গায়ে সন্ধ্যায় আসরে পরা ধুতিখানা জড়ানো। একটু দূর থেকে বোঝা যায়, এখানে কেউ বসে আছে। হাতে বিড়ি।
কাছারির ভিতরে থেকে কাঁচাঘুম ভেঙে আভা এসে তার সামনে দাঁড়াল।
অধিরাজ বিস্মিত। আভা এখানে! হঠাৎ? সে বলল, ‘তুমি?’
‘হয় আমি’
এবার কী বলে অধিরাজ? সে কথা হাতড়ে না-পেয়ে বলল, ‘আইজ এইভাবে কান্দলা?’
‘না, কান্দি নাই চোখ এমনি জলে ভরে যায়’
‘যেভাবে আমার দিক তাকাইয়ে ছেলা!’
‘কীভাবে? ভালো হইচে, তাকাইচি’
‘না, ভালো হয় নাই। তোমার মনে হ’ল আমিই লখাই?’
‘তো কী? এই সমায় আমি বেউলাই, তয় তুমি লখাই না তা’লি কী?’
‘আমি লখাই?’
‘হÑ’
‘কী? আমি লখাই?’
‘হুঁ, তুমি লখাই।’
অধিরাজ একটানে আভাকে কাছে টানল। আভা তার গায়ের উপর পড়তে পড়তে পাশে বসল। তারপর আবার বলল, ‘হুঁ, তুমিই লখাই!’

আসছে। গৃহস্থ বাড়িতে যত বিপর্যয়ই ঘটুক অতিথিকে থাকতে খেতে বলতে হয়। নমিতা তাই করেছিল। আভা অবশ্য কিছু বলেনি। তার বলা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু অধিরাজ ও সাবিত্রী কারওই দুপুর পর্যন্ত থাকার সময় নেই। তাদের ছেলে দুটো ইস্কুল থেকে ফিরবে। তারা এসেছিল আভা-হরষিতের বাপ-মরা ছেলেটাকে দেখতে। দেখা হয়ে গেছে। এখন চলে যাবে।

নদীর পশ্চিম পারে বাড়ি ফেরার পথে সাবিত্রী আর অধিরাজের আভার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছিল। কিন্তু অধিরাজ তখন ভেবেছে, আভার বলা ওই শেষ কথাটাই অধিরাজ যা বলে তা কাজে পরিণত করতে পারে কি না? ভাবতে ভাবতে অধিরাজ সাবিত্রীকে বলেছিল, ‘ও সাবি, তোমার কী মনে হয় না, আভা চিনুদা আমি মিলে আবার দল দাঁড় করাতি পারব? কি পারব না?’

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত