| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা উপন্যাস: একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে

আনুমানিক পঠনকাল: 28 মিনিট

 

সত্তর দশকের উত্তাল বাংলা। নকশাল আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। শহর জুড়ে নেমে এসেছে অদ্ভুত শীতলতা। সেই সময়েই কলকাতা থেকে বহুদূরে মুর্শিদাবাদের এক সম্ভ্রান্ত গ্রাম আজিমগঞ্জে পালকি চেপে নতুন বৌ শ্বশুরবাড়ি এলো। সমস্ত রাস্তাটাই অন্ধকার। যতদূর চোখ যায় জনমানব নেই। শুধু সামনে হাঁটছে নতুন বর আর বরের দুজন বন্ধু। হ্যারিকেন হাতে আরো সামনে বরের মামা।

নতুন বউ স্বর্ণালী আধা মফঃস্বলের মেয়ে। রেল কোয়ার্টারে বাবা– মা সাত ভাইবোন নিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। আলো আছে তাদের ওখানে। এই পাড়াগাঁয়ে এত অন্ধকারে কী করে থাকবে ভেবে ভয়ে বুক কাঁপতে শুরু করল তার। তবুও প্রায় দুবছর আজিমগঞ্জ আর বাপের বাড়ি রামপুরহাটে কাটাবার পর স্বামীর হাত ধরে সে এল কলকাতায়। তার স্বামী আর্যর কর্মক্ষেত্র। বইপাড়ার শিক্ষা সভ্যতা দপ্তরে পাঠ্য বইয়ের মার্কেটিং এর কাজ করে আর্য।

শুরু হল তাদের জীবনের এক অচেনা অজানা পথ চলা।সেই পথ কোথায় নিয়ে যাবে তাদের তার উত্তর কেবল মহাকালই জানে।আপাতত তাদের বাসস্থান বেলেঘাটায় শিক্ষা সভ্যতা দপ্তরের কর্ণধার শক্তি সান্যালের বাড়ি।  

বেলেঘাটার এই বাড়িটায় আসাও প্রায় ছমাস হতে চলল স্বর্ণালীর। বাড়িটার একদিকে বড় রাস্তা। বেলেঘাটা মেন রোড। তার এক পাশে থানা। পেছনে বস্তি। প্রথম প্রথম কলকাতা আসা নিয়ে উত্তেজনা থাকলেও এখন স্বর্ণালীর কান্না পায়। সেই সকাল ৯টায় শক্তিবাবুর স্ত্রী প্রতিমা আর ছেলে অফিস বেরিয়ে যায়। আর্য আর শক্তিবাবুও দশটার মধ্যেই তৈরি অফিসের জন্য।রান্নার ছেলে সুবল সকালে রান্না করে তাদের সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ে।

স্বর্ণালী তখন একসঙ্গে বসে ভাত খেয়ে নেয়।তারপর থেকে রাত দশটা অবধি পুরো একা।খিদেয় পেট চুঁ চুঁ করে। অথচ খাবার মতো কিছুই খুঁজে পায় না।এ বাড়িতে মুড়ি, বাদাম, চানাচুর, এমনকি বিস্কুট পর্যন্ত থাকে না। রাতে সকলে ফিরলে আরেক দফা রান্না হয়। তখনি আবার খাবার মেলে।

স্বর্ণালী নীরবে চোখের জল ফেলে। আর্যর ক্লান্ত মুখটা দেখে কিছু বলতেও পারে না। কতই বা মাইনে পায় সে! সামান্য যেটুকু পায় তার থেকে অর্ধেকেরও বেশি পাঠিয়ে দিতে হয় বাড়িতে। সেখানেও তিন দেওর, মা। অথচ বাপের বাড়িতে স্বচ্ছন্দে বড় হয়েছে সে। প্রাচুর্য না থাকলেও অভাব কাকে বলে তা কোনোদিনই জানে নি। বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। ফলে সাতটা ভাই বোন হলেও অভাব ছিল না। কলকাতায় তাদের নিত্য যাতায়াত লেগেই থাকত। শ্যামবাজার টেলি পাড়া লেনে তাদের মামার বাড়ি।বাড়ি থেকে বেরলেই পুরো হাতিবাগান বাজার। যা ইচ্ছা কেনো, খাও,ঘুরে বেড়াও। বাবা অত্যন্ত রাশভারী হলেও পায়ে শিকল বেঁধে ঘরে আটকে রাখেননি।স্বেচ্ছাচারীতা ছিল না, কিন্তু স্বাধীনতার অভাব ঘটেনি।

স্বর্ণালীর ইচ্ছে করে মামার বাড়ি চলে যেতে। সেজমাসির এখনো বিয়ে হয়নি। তার সঙ্গে খুব ভাব তার। আর্যর সঙ্গে বিয়েটাও তার চেষ্টাতেই। তার মনে পড়ে যায় তাদের এক সঙ্গে বিকেল হলেই বেরাতে যাবার কথাগুলো।হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে যেত বাগবাজার ঘাটে। সেখানে গঙ্গার পাড়ে বসে থাকত তারা। সূর্য ডোবা অবধি চলত তাদের গল্প।

বিয়ের পরে আজিমগঞ্জে শাশুড়ি মা বিকেল হলেই সাজিয়ে গুজিয়ে পাড়া বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সারাদিন কিছু না কিছু খাওয়া হতই। অথচ এখানে তার সব আনন্দই কেবল কান্নায় পরিণত হয়েছে। দুপুরগুলো যাও বা বারান্দা আর বিছানা করে কেটে যায়, সন্ধে নামলেই এক অজানা ভয় তাকে ঘিরে ফেলে। বিশাল বাড়িটা তাকে গিলে খেতে আসে। সে তাড়াতাড়ি জানলা দরজা সব বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে থাকে।

তারপর যখন একে একে সব বাড়ি ফেরে তখন সে চেতনা ফিরে পায়। তার মনে হয় এই বাড়িটা আসলে একটা মেস বাড়ি। যে যার মত সারাদিন কাটিয়ে রাতে শুতে আসে।এটা খালি মাথা গোঁজার একটা আশ্রয় মাত্র।

এর আগে আর্যর সঙ্গে চিঠিতে বা বাড়ি এলে যত কথা হত, এখানে এসে তার এক ভাগ হয় না। সারাদিন পর বাড়ি ফেরা আর্যকে দেখে বুকের ভিতরটা কেমন হু হু করে ওঠে তার। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত একটা শরীর যেন কোনোরকমে নিজেকে টেনে নিয়ে চলেছে। দুমুঠো ভাত খেয়েই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে। সেই মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজের যন্ত্রণা ভোলার চেষ্টা করে স্বর্ণালী।

এমনি ভাবেই চলছিল দিন। সূর্য উঠছিল নিজের ছন্দে,আবার ডুবেও যাচ্ছিল,তার জায়গায় চাঁদ তারার দল সামিয়ানা বিছিয়ে রাতের গান শোনাচ্ছিল। একদিন খেতে বসে শক্তিবাবু হঠাৎই বলে উঠলেন, আচ্ছা বৌমা, আমরা যে ১০ টায় বেরিয়ে যাই, আর ফিরি সেই রাতে, তুমি তো আমাদের সঙ্গেই ভাত খেয়ে নাও, তারপর এতটা সময় কী খাও? প্রশ্নটা শুনেই স্বর্ণালীর দুচোখ ভরে গেল জলে। জমানো অভিমান, দুঃখ, খিদে সব হঠাৎই সমস্ত বাঁধা ভেঙে দুর্বার গতিতে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।

শক্তিবাবু কোনো কিছু বললেন না। শুধু সেদিন থেকে প্রতিদিন স্বর্ণালীর জন্য বরাদ্দ হল ২০ টাকা। আর বাইরে বেরিয়ে যা খুশি খাওয়ার ছাড়পত্র পেল সে। স্বর্ণালী কদিনের মধ্যেই চিনে ফেলল আশেপাশের খাবার দোকান, টুকিটাকি সামগ্রী কেনার দোকান, মুদিখানা।

দুপুর হলেই সে বেরিয়ে পড়ত। হেঁটে হেঁটে চিনে নিত এ গলি ও গলি। মাথার উপর সূর্য এলে, পাড়া যখন নিঃস্তব্ধ হয়ে যেত, কেবল বাস, গাড়ি, রিকশা আর কিছু ফেরিওয়ালা ফেরি করত, তখন কিছু খাবার কিনে সে ফিরে আসত ঘরে। খেয়ে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেল হলেই আবার বেরিয়ে পড়ত নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায়।

সাহস করে একদিন আলোছায়া সিনেমা হলে পাঁচ টাকা দিয়ে দুপুরের শোতে উত্তম সুচিত্রার সিনেমাও দেখে ফেলল সে। কখনো কখনো প্রতিমাদি তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে যেত। সে সরকারি আধিকারিক।

প্রতিমাদির এটা দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী। প্রথম স্বামী পথ দূর্ঘটনায় মারা গেছিল। তখন তার ছেলে পেটে। শক্তিবাবু ছিলেন তার স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সদ্য স্বামীহারা সন্তানসম্ভবা মেয়েটিকে একা ফেলে দিতে পারেনি শক্তিদা। বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেয় তাকে।

এসবই সে শুনেছে আর্যর কাছে। প্রতিমাদি অবশ্য এসব নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করে না।সে তার অফিস আর ছেলের গল্প করতেই বিভোর থাকে।তার ছেলে ব্যাঙ্কে চাকরি করে।স্বর্ণালীর থেকে একটু বড়।কিন্তু ভুলেও একটি কথাও বলে না।সামনাসামনি হয়ে গেলে বড়জোর একবার তাকিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে যায়।

ভারি অদ্ভুত লাগে স্বর্ণালীর। কিন্তু নিজে থেকে যেছে কথা বলতে সে কখনোই এগোয় না। সে এও লক্ষ করে দেখেছে প্রতিমাদির সঙ্গে শক্তিদার কোনো সম্পর্কই নেই।যতটুকু সময় তারা এক সঙ্গে থাকে ততটুকু সময়েও তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটা বাক্য বিনিময়।

রাতে কী চিকেন স্টু হবে? কানাই প্রশ্ন করলে প্রতিমাদি শক্তিদার মুখের দিকে তাকায়, তারপর কোনো দিন ঘাড় নাড়ে, কখনো বা হ্যাঁ বলে। কিংবা হয়তো চাইনিজ খাওয়ার কথা হল, তখন কি আনা হবে সেইটুকুই বলে নিজের ঘরে ঢুকে যায়।

স্বর্ণালীর অবাক লাগে। এক ছাদের তলায় দীর্ঘদিন থেকেও তাদের মধ্যে এতটুকুও সম্পর্ক গড়ে উঠল না? দুজনেই তো রক্তমাংসের মানুষ। মনের চাহিদা নয় চাপা দিয়ে রাখা গেল, কিন্তু শরীর! পাশাপাশি থেকেও ঘি আর আগুনে সংযোগ হল না- ভাবতেই অবাক লাগে তার।

আর্য বলে, পৃথিবীর বহু মানুষই এভাবেই বেঁচে আছে, এরা তো তবু আলাদা ঘরে থাকে।আর অনেক মানুষ আছে,যারা নিয়ম করে এক ঘরে পাশাপাশি এক বিছানায় শোয়, অথচ কেউ কাউকে স্পর্শ করে না।কথা বলে না। সারাটা জীবন তাদের এই নিঃসঙ্গতা নিয়েই কেটে যায়। একা একাই তাদের বুকে কথারা জমা হয়, একা একা সেগুলো জমতে জমতে ক্ষয়ে যায়। তারা একসময় নিজেরাও ভুলে যায় তাদের কী কথা বলার ছিল, আর কাকেই বা বলার ছিল! এত কাছে থেকেও আসলে তারা বহু আলোকবর্ষ দূরে ছিল। জানো, মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে আদৌ কী তারা বেঁচে আছে নাকি সম্পর্কহীণ দুটো জীবন মৃতবৎ পড়ে আছে!

স্বর্ণালীকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় সে। কপালে চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, যেদিন আমি কথা বলা বন্ধ করে দেব, সেদিন যেন আমার মৃত্যু হবে। আমি মৃত মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারব না।আমার চাই প্রচুর প্রচুর শব্দ। তারা মালার মতো ঘিরে থাকবে আমাকে। আমি আমার পছন্দ মতো সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কাছেরটাকে টেনে নেব।

আর আমি? স্বর্ণালী জিজ্ঞেস করে।

তুমি সেই শব্দের মালা শরীরে জড়িয়ে স্রোতস্বিনী হয়ে উঠবে।

আর্যর এসব কথার মানে স্বর্ণালী ঠিক মতো বুঝতে পারে না। শুধু একটা ভালো লাগা তাকে ঘিরে ধরে। তার মনে হয়, জীবন তো এক নিরবিচ্ছিন্ন স্রোত। তাতে কখনো জোয়ার কখনো ভাঁটা।

প্রতিমাদি যেদিন তাড়াতাড়ি ফেরে সেদিন একজন মহিলা আসে তার কাছে। সে নাকি বডি ম্যাসাজ করে তেল দিয়ে। স্বর্ণালী প্রথম প্রথম অবাক হয়ে যেত। একটা বড় মানুষকে আরেকটা মানুষ কিভাবে তেল মাখিয়ে দেবে সে বুঝে উঠতে পারে না। ক্রমশ সে জেনেছে, এটা এক ধরণের থেরাপি, যার নিয়মিত প্রয়োগে শরীর চনমনে থাকে, গা হাত পায়ে ব্যথা কমে যায়, আর বয়সটাও কম লাগে চামড়ার জৌলুসের কারণে।

সে প্রতিমাদির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে।সত্যি তাকে দেখে বোঝা যায় না বয়স পঞ্চাশ পেড়িয়ে গেছে, অত বড় ছেলের মা সে।

সে মনে মনে ভাবে, যদি ঈশ্বর মুখ তুলে চান, নিজে টাকা পয়সা রোজগার করতে পারলে সেও এমন একজন কাউকে রাখবে।

কখনো কখনো সবাই চলে গেলে সে বই নিয়ে বসে।মন খারাপ করে পড়াশোনাটা শেষ করতে পারলো না বলে।যদিও আর্য তাকে রামপুরহাট গার্লস কলেজে ভরতি করে দিল তবুও একটা সংশয় কাঁটার মতো বিঁধে থাকে বুকে।আদৌ কি শেষ পর্যন্ত সে আবার কলেজে ফিরতে পারবে? এতগুলো বছরে সে কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি।কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কলেজ যাওয়াটা অনিয়মিত হয়ে গেল। এখন তো ফাস্ট ইয়্যার থেকে সেকেন্ড ইয়্যার ওঠার পরীক্ষাও শেষ।তার এক বছর নষ্ট হল।

শুয়ে শুয়ে সে ভাবে জীবন যতটা রূপকথার মতো মনে হয়েছিল বিয়ের আগে বাস্তবে তা নয়।তবু বাপের বাড়ি বা শ্বশুড় বাড়িতে সবার সঙ্গে মজা করে থাকাটা হয়।কিন্তু এখানে আসার পর তার সব আনন্দ যেন মুছে গেছে জীবন থেকে।

বড্ড একা লাগে তার। ভেবে পায় না কিভাবে সময় কাটাবে। তবু যাহোক করে সকাল কেটে যাচ্ছিল।কিন্তু সন্ধে নামলেই তার বুক অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠত। পাশের থানা থেকে ভেসে আসত বিভৎস চিৎকার, কান্না আর নৃশংস অট্টহাসি। সে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছে কী নিদারুন অত্যাচার চালানো হচ্ছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলোর উপর। কারের পায়ের নখ উপরে নেওয়া হচ্ছে তো কারোর পায়ু দ্বারে মোটা লাঠি ঢুকিয়ে সারা শরীরে আঘাত হানা হচ্ছে। মেয়েগুলোকেও রেহাই দেয় না এরা।

সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। ছেড়ে দাও এদের- বলে প্রতিবাদ করে।কিন্তু জানলা ভেদ করে সে শব্দ গিয়ে পৌঁছায় না সমবেত উল্লাসিত মানুষগুলোর কানে।

স্বর্ণালী বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদে একা একাই। আর ভাবে কবে মুক্তি পাবে এই বাড়িটা থেকে।

বারান্দা থেকেও একই দৃশ্য দেখে শিউরে ওঠে না সে।চিৎকার করে তোরা কী মানুষ নাকি জন্তু? তোদের ঘরে ছেলে পুলে নেই? এত বর্বর হতে পারে কেউ? 

পরদিন পুলিস আসে বাড়িতে। জানলা ও বারান্দা সিল করে ঠান্ডা গলায় শাসিয়ে যায় আর যেন কোনো দিন ওদিকে না দেখি।

ক্রমশ সে কেমন করে যেন জেনে যায় এই বন্দীরা নকশাল। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এই ছেলেলেমেয়েগুলো। তাই এদের উপর এমন ভয়ঙ্কর নির্যাতন। সে বুঝে উঠতে পারে না ব্রিটিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর যে ভাবে  অমানসিক অত্যাচার করত সেই একই পদ্ধতি কেন স্বাধীন দেশের নাগরিক এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর উপর পুলিস প্রয়োগ করবে! তবে কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তার রূপ সবসময় এক হয়! স্বাধীন পরাধীন এই শব্দগুলো আসলে কেবলই পুঁথিগত! মূল বিষয় তবে বশ্যতা! যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যারা আছে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকাটাই সত্য, বাকি সব মিথ্যে!

কিন্তু এদের প্রতিবাদ তো জমিদার তন্ত্রের বিরুদ্ধে। জমি যে চাষ করবে সেই ভূমির উপর তার অধিকার, এইটুকু তো চায় তারা।রাষ্ট্র কিভাবে এর সঙ্গে যুক্ত ভেবে কূল কিনারা পায় না।তবে এইটুকু সে বোঝে এই আন্দোলনের মূল কেন্দ্র এই রাজ্য।তাই এখানেই সবচেয়ে বেশি ধড়পাকর, নির্যাতন।       

সে ঘুমের মধ্যেও দেখতে পায় নির্যাতনের নানা দৃশ্য। তার মাথা ছিঁড়ে যায় যন্ত্রণায়। রোজ জ্বর আসে। ডাক্তার বলে স্থান পরিবর্তন দরকার। কিন্তু এই মাইনেয় তাকে নিয়ে কোথায় যাবে আর্য! মাথা গোঁজার তো স্থান চাই! তাছাড়া তার এখন ভীষণ কাজের চাপ।বইয়ের ক্যানভাসিং চলছে।তাকে প্রায়ই যেতে হচ্ছে উত্তরবঙ্গ। মালদা, শিলিগুড়ি দিনাজপুর, রায়গঞ্জ- এই জায়গাগুলো তার কাজের প্রধানক্ষেত্র। এর পাশাপাশি তাকে যেতে হয় মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়াতেও।

কিন্তু স্বর্ণালীকে এভাবে আর ফেলে রাখা যাচ্ছে না। ক্রমশ ডিপ্রেসনে ডুবে যাচ্ছে মেয়েটা। ডাক্তারও বলেছেন, রোজ রোজ এই জ্বর আসাটা আসলে মনের উপর অসম্ভব চাপের ফসল। শেষ অবধি শক্তিদার সঙ্গে পরামর্শ করে আর্য ঠিক করে এবারের উত্তরবঙ্গ সফরের সময় সে স্বর্ণালীকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। কাজ শেষ করে তারা ক’দিন ঘুরেও আসবে দার্জিলিং থেকে।পাহাড়ি জল হাওয়ায় মেয়েটার মন ও স্বাস্থ দুইই মেরামত হবে। ফেরার পথে তাকে বাপের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে আসবে।সেখানে সবার মধ্যে থাকলে নিশ্চিতভাবেই এই ডিপ্রেসন কেটে যাবে। কিন্তু তার সফরের আরো এক সপ্তাহ দেরি।আর্য তাই তাকে দিয়ে এল টেলি পাড়া লেনে স্বর্ণালীর মামার বাড়ি। আপাতত সেখানেই শ্বাস নিক মেয়েটা।

পর্ব ২

আর্যর মন ভালো নেই। এই চাকরিটা সে করছে ঠিকই কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। সারাদিন বই ঘাড়ে এক স্কুল থেকে আরেক স্কুল, এক কলেজ থেকে আরেক কলেজ।একই বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের বোঝানো।কাজটার সঙ্গে মেধার কোনো যোগ নেই।কেবল কতগুলো ডেটা। তাই দিয়েই ক্যালকুলেসন। এই কাজ কী তাকে সারাজীবন করে যেতে হবে? নিজেকেই প্রশ্ন করে সে। উত্তরও নিজেই দেয়। আর টেনেটুনে বছর খানেক বড়জোর। তারপর অন্য কিছুর চেষ্টা। একটা সরকারি চাকরি হলে সবচেয়ে ভালো হয়, সেটাকে রেখে পাশাপাশি অনেক কাজ করা যাবে।

কতদিন কবিতা থেকে সরে আছি। শেষ লেখা হয়েছিল কবে তাও মনে পড়ছে না। কবিতার জন্যই আজিমগঞ্জের স্কুলের স্থায়ী চাকরি ছেড়ে পাড়ি দিলাম অনিশ্চিত জীবনের দিকে। ভেবেছিলাম সাহিত্যিক হতেই হবে। অথচ কলকাতা আসার পর পরিস্থিতিটাই বদলে গেল। কলেজস্ট্রিটে দেখা হয়ে গেল শক্তিদার সঙ্গে। সেদিনই তার ফিরে যাওয়ার কথা। ঠিক ছিল সারাদিন চেষ্টা করবে যদি কোনো চাকরি পাওয়া যায় সংবাদ পত্র দপ্তরে কিংবা প্রকাশনা সংস্থায়।পেলে থেকে যাবে। নইলে ফিরে গিয়ে আবার স্কুলে।

স্কুলের চাকরিটাও তার ভালো লাগে না।কতগুলো গঁথে বাঁধা কথা পড়ানো। ছেলেরা তার থেকে বেশি কিছু শুনতেও চায় না। অথচ ইতিহাস বাংলা পড়তে গেলে যে একটা দেশের প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতি, পুরাণ, মাইথোলজি,এমনকি বিশ্ব সাহিত্য পড়াটাও জরুরী সেটা সে কাকে বোঝাবে! অবশ্য চাকরিটা সে ছেড়ে দিয়ে আসেনি। এটাই একমাত্র বাঁচোয়া। সে যখন রেজিগনেসন লেটার দিতে গেছিল প্রধাণ শিক্ষক যে চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।

তুমি এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিও না চাকরির বিষয়ে। বরং কিছু কারণ দেখিয়ে ছুটির আবেদন করো। এক কাজ করো তুমি বরং আরেকটা এম এ পড়ে নাও এই সুযোগে। হেডমাস্টার অখিলবাবু বললেন, দেখো তুমি আমাদের খুব প্রিয় মানুষ। যদিও জানি তুমি এই ধরা বাঁধা জীবনে বেঁচে থাকার জন্য জন্মাওনি, তবু  যতক্ষণ না আরেকটা ভালো কিছুর ব্যবস্থা হচ্ছে ততক্ষণ এটা পুরোপুরি ছেড় না।

আর্য অবাক হল অখিলবাবুর কথায়। একটা এম এ পাস করার জন্য তাকে কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রাইভেটে এই ছোট্ট গ্রামে সেই প্রথম এম এ। অবশ্য এর পুরো কৃতিত্ব ছোটো মামার। সেই ফর্ম ফিলাপ করা থেকে বই যোগাড়, নোট বানানো সবই করেছিল। সে শুধু পরীক্ষার আগের দিন সারা রাত সেইসব বইয়ের পাতা উল্টে দেখে নিয়েছিল। নিশ্চিত ছিল পাস করবে না। অথচ একবারেই সাফল্য এসে গেল। আর তখনি তার স্কুল থেকেই তাকে পড়াবার জন্য ডেকে পাঠালেন অখিল স্যার। মাইনে আশি টাকা। সেই নিদারুণ অভাবের দিনগুলোতে এই টাকাটা ছিল লক্ষ টাকার সমান।

মায়ের মুখটা তার মনে পড়েছিল। ভাইগুলোকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করার স্বপ্ন তাকে বাধ্য করেছিল হেডস্যারের প্রস্তাবটা মেনে নিতে। অথচ সে মনে প্রাণে সন্ন্যাসী হবার জন্য প্রস্তুত। বিয়েটাও শেষ অবধি মেনে নিতে হয়েছে। এখন তো এদের সকলকে পথে ভাসিয়ে পালানো যাবে না। অথচ তার আর ভালো লাগছে না এই জীবন। কফি হাউসে বসে কফি খেতে খেতে এসবই ভাবছিল আর্য। সামনে কফির কাপ, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

বসতে পারি? বলে চেয়ারটা টেনে নিয়ে সামনে বসে আবার বললেন, কি ভাবছেন এত?

আর্যর এতক্ষণের ভাবনা সহসা ভঙ্গ হল। নিজের ঘোর থেকে উঠে এসে বলল, কই কিছু নাতো! তারপর ভালো করে লক্ষ করল সামনে বসা লোকটিকে। পরনে লাল আলখাল্লা, কপালে সিঁদুর আর চন্দন মিলিয়ে বড় একটা তিলক আঁকা।চোখ দুটো যেন জ্বলছে। লোকটার মুখে একটা স্মিত হাসি। একদৃষ্টে তাকিয়ে তার দিকে। আর্য হাত তুলে নমস্কার করল। তারপর তার দিকে চেয়ে রইল একই ভাবে।

এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। এতক্ষণ বাদে ভদ্রলোক কথা শুরু করলেন। আপনার এখানে থাকার তো কথা নয়। আপনি তো সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলেন। আর্য কোনো উত্তর না দিয়ে পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষা করতে লাগল।

আপনার বাবাও তো সন্ন্যাসী। তিনি অবশ্য আর কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবেন পরিবারের কাছে।তবে আপনি কিন্তু চিরদিন গৃহী সন্ন্যাসী হয়েই থাকবেন। আপনার মন থাকবে ঈশ্বরের খোঁজে আর সংসার আপনাকে বেঁধে রাখবে গৃহে। আর্য অবাক হচ্ছিল তাঁর কথা শুনে। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ না করে- কফি বলি, বলে ওয়েটারকে ডাকল। তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেশলাই সমেত এগিয়ে দিল তার দিকে।

ভদ্রলোক সিগারেটটা ধীরে সুস্থে ধরিয়ে বললেন, অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে! ভাবছেন, আমি কে! এত গাঁজাখুরি গল্প কেন বলছি! আর্য নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান দিল। তারপর বলল, না, অবাক হচ্ছি না। কিন্তু আপনার পরিচয়টা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।

আমি খুব সামান্য একজন মানুষ। আমার নাম শুক্রাচার্য।

শুক্রাচার্য মানে যিনি জ্যোতিষ চর্চা করেন, তিনি?

হ্যাঁ, অল্পবিস্তর এসব নিয়ে চর্চা করি। কিন্তু আপনাকে সেরকম কিছু ধারণ করতে বলার জন্য আমি এখানে বসিনি।বলে হেসে উঠলেন শুক্রাচার্য।

আর্য হাসল। বলল, বেদ গুরু শুক্রাচার্যর সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। সেতো লাগল। কিন্তু বেটা তুমি তো এই বই বেচার জন্য জন্মাওনি।তুমি জন্মেছ এমন কিছু কাজ করার জন্য যা পৃথিবীর মানুষ মনে রাখবে সারাজীবন।

আমিও তো চাই এমন কিছু করতে। কিন্তু অনেক দায়িত্বের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। সেগুলোর থেকে মুক্তি চাইছি, অথচ বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। একটু থামলো আর্য। আমার কথা না হয় পরে শুনব, ভাবব। কিন্তু আপনি বাবার কথা বললেন। শুক্রাচার্য হাসলেন। তোমার কপালে লেখা আছে তুমি রাজযোগী হবে। আর সেই ক্ষমতার উৎস তোমার বাবা। অবশ্য যতদূর সম্ভব তোমার পিতৃকূলে আরও অনেক সাধক ছিলেন।তাদের প্রভাবও তোমার রক্তে বইছে।

আর্য ক্রমশ আশ্চর্য হচ্ছিল শুক্রাচার্যের কথায়। লোকটি যেসব কথা বলছে, সেগুলো মিথ্যে নয়। তার পূর্বপুরুষেরা অনেকেই তন্ত্র সাধনা করতেন, এ কথা তার মায়ের থেকে শোনা। আর বাবা তো তিন সন্তান জন্ম দেবার পরই বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলেন। পরে জানা গেছিল তিনি সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেছেন। একবারই এসেছিলেন বেনারস থেকে, তাও অনেক বছর হয়ে গেল। সেও তো বেরিয়ে পড়েছিল সন্ন্যাস হবার পথেই। কিন্তু নিয়তি তাকে বেঁধে দিল সংসারে। সে চুপ করে শুনতে চাইল শুক্রাচার্যের কথা।

শুক্রাচার্য আবার শুরু করলেন বলা। মন শান্ত করো। ঈশ্বরের খোঁজ কী এত সহজে পাওয়া যায়! এক জন্মে কেন বহু জন্ম কেটে যায় তাকে পেতে। কিন্তু তার জন্যে সংসার ছাড়ার দরকার নেই। তুমি সবকিছুর মধ্যেই তাঁকে পাবে। সেও দুপা বাড়িয়েই আছে তোমার দিকে। ভক্তের যেমন তাঁকে দরকার, ঠিক তেমনি তাঁরও ভক্তকে প্রয়োজন।নইলে কে তাঁকে গুরুত্ব দেবে!

আর্য ঈশ্বর নিয়ে এত কথা শুনতে চাইছে না। সে জানে তার ভিতরে এই নিয়ে একটা তীব্র ভাবনা সব সময় বয়ে যায়।প্রতিমুহূর্তে তাঁর অস্তিত্ব সে নিজের চারপাশে উপলব্ধি করে। নইলে এই কলকাতা শহরে কিভাবে সে টিকে গেল! শেয়ালদা স্টেসনে নেমেছিল মাত্র তিন আনা পয়সা নিয়ে। সারাদিনে যদি কোনো কাজ যোগাড় না হয় ফিরে যাবে গ্রামে। কাউকেই তো চিনত না সে। কোনো সুপারিশ পত্র ছিল না তাঁর কাছে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবনে গিয়েছিল সে হেঁটেই। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে পরিচয় হয়েছিল শ্রীপদ সিং কলেজের এক অনুষ্ঠানে। কবিতা লিখে তরুণ শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে সম্মানপত্র তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। আর নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কলকাতা এলে তাঁর বাড়ি যাবার।

বুদ্ধদেববাবুর শরীর ঠিক ছিল না। তবুও তার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়েই আলোচনা করেছিলেন। কবিতা লেখা ছাড়তে বারণ করলেন। বললেন, তাঁর পিতাও তার জন্মের একদিনের মধ্যেই মা মারা যাওয়ায় তাকে মাতামহ মাতামহীর কাছে রেখে ঘর ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। কদিন আগেই প্রকাশিত বিপন্ন বিস্ময় উপন্যাসটি তাকে উপহার দিলেন। রিলকে আর্যর অন্যতম প্রিয় কবি শুনে তাঁর অনূদিত রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা বইটি পড়ে দেখতে বললেন।

আরো বললেন মহাভারত নিয়ে একটি দীর্ঘ কাজ তিনি করছেন। চেষ্টা করছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটা শেষ করতে।

পরিচয় হল তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসুর সঙ্গে। তিনি নিজেও বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক। আর্য তাঁর গল্প উপন্যাস পড়লেও বিশেষ করে সমুদ্রহৃদয় বেশ কয়েকবার পড়লেও এর আগে দেখেনি তাঁকে। তিনি বললেন, আমিও ভাবছি মহাভারত নিয়ে কিছু লিখব। তবে পান্ডব বা কৃষ্ণকে নায়ক করে নয়। অন্যভাবে কিছু ভাবছি। অবশ্য কবে লিখব কিভাবে লিখব তা জানি না।

তাঁর আন্তরিক ব্যবহার আর্যকে মুগ্ধ করল। তিনি নিজে হাতে করে মিষ্টি আর সরবত দিলেন। সেদিন রাত অবধি ওইটুকু খাবারই তার জুটেছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসেছিল কলেজস্ট্রিটে। চুপচাপ বসেছিল কফি হাউসে। অপেক্ষা করছিল রাতের ট্রেনে ফিরে যাবার। সেখানেই হঠাৎ করেই আলাপ হয়ে গেল শক্তিদার সঙ্গে। গল্পে গল্পে কথায় কথায় রাত হয়ে গেল। শেষ ট্রেন ততক্ষণে চলে গেছে। রাতে কোথায় থাকা যায়, কিই বা খাব এসব ভাবতে ভাবতেই শক্তিদার সঙ্গে রাস্তায় নেমেছিল সে।

তখনি তাকে অবাক করে শক্তিদা বলেছিলেন, আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছে। যদি আজ রাতটা আমার বাড়িতে থেকে যান খুবই আহ্লাদিত হব।

যদিও মুখে না শব্দটা আনার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না, বরং এমন প্রস্তাবে তার অনেক চিন্তা মুহূর্তের মধ্যেই দূর হয়ে গেছিল, তবু সে বলল, অসুবিধা হবে নাতো আপনাদের? বাড়ির লোকজন কী মনে করবেন আমি এই মাঝরাতে আপনার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলে? সেসব কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে শক্তিদা বলেছিল, আরে আমার বাড়িতে আপনার কোনো অসুবিধাই হবে না। বরং সারারাত আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

আপনার স্ত্রী? আর্য জানতে চেয়েছিল।

সেসব কোনো ফ্যাক্টর নয়। বলে জোর করেই তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। পরদিন সকাল থেকেই কাজে বহাল হয়ে গেল সে। থাকা খাওয়া ফ্রি। আর্যর কাছে এর থেকে আনন্দের আর কীই বা হতে পারত সেদিন! সে মনে মনে পরমেশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল।

কিন্তু তার পরেও এই চাকরি তার আর ভালো লাগছে না। দেশে বা বসুমতীতে শেষ যে কবিতাগুলো পাঠিয়েছিল আজিমগঞ্জ থেকে সেগুলোও বেরিয়ে গেছে। কিন্তু নতুন কিছু পাঠাবার জন্য লেখা দরকার। তা হচ্ছে কই! সকাল দশটায় বাড়ি থেকে বেরোনোর পর তার সব সত্তা নষ্ট হয়ে গিয়ে সে কেবল বেচু বাবু।

কি মশাই কী ভাবতে বসলেন! এত ভাবার কিছু নেই। আপনার ভাগ্য দ্রুত পরিবর্তনের মুখে। শীঘ্রই ভালো খবর আসবে। তবে মশাই আপনার কিন্তু পুরোপুরি সন্ন্যাস হওয়া হচ্ছে না। এই মনুষ্য শরীর এই সংসারের মধ্যে থেকেই আপনার কাজ চলবে।

আর্য কিছু না বলে আরেকটা সিগারেট ধরালো। আরেকটা এগিয়ে দিল শুক্রাচার্যর দিকে। সিগারেট হাতে নিয়ে শুক্রাচার্য বললেন, আর খুব বেশিদিন নেই। এই সিগারেট আর নিজে কিনে খেতে হবে না আপনাকে। আর্য জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো তার দিকে।

মিলিয়ে নেবেন আমার কথা। এর থেকে অনেক নামি দামি ব্রান্ডের সিগারেট আপনাকে যোগাবেন তিনি। শুধু সময়ের অপেক্ষা। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন শুক্রাচার্য। একটা কাগজে নিজের টেলিফোন নম্বর আর ঠিকানা লিখে দিয়ে বললেন, যদি কখনো মনে পড়ে আমার কথা চলে আসবেন। কাগজের টুকরোটা পকেটে রেখে শুক্রাচার্যের সঙ্গেই রাস্তায় নেমে এল আর্য।

                          

 পর্ব ৩

দুদিন হল টেলিপাড়ালেনের মামার বাড়িতে এসেছে স্বর্ণালী। উত্তর কলকাতার হৃৎপিন্ড যেন এই অঞ্চলগুলো। সরু সরু গলি, তস্য গলি।গাড়ি যাবার কোনো উপায় নেই। বড় মাসির বিয়ের সময় মোড়ের মাথায় গাড়ি থেকে নেমে রিকশা করে বর এসেছিল বিয়ে করতে।

এই বাড়িটা চৌকো আকারের। দোতলা। চারদিকে ঘর আর মাঝখানে বিশাল উঠোন।গলি দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে একটা ছোটো ঘর। সেই ঘরের দরজা রাস্তার দিকে। গলি শেষ হলে উঠোনের বাঁদিকে একটা বড় ঘর। সে ঘরটা বড় মামার। মামী আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে তারা এই ঘরটায় থাকে। ছেলেটার বয়স দশ। মেয়েটার ছয়। সে স্বর্ণালীর গা ঘেঁষা। এলেই ছুট্টে কোলে চলে আসে।

মামার ঘর শেষ হয়ে বাঁ দিকে ঘুরে  রান্নাঘর। সেখানে চব্বিশ ঘন্টাই উনুন জ্বলে। এই উনুন নিভতে সে ছোটো থেকে কখনোই দেখেনি। তারা মাসি বোনঝিরা বলাবলি  করত, এ হল রাবণের চিতা। কখনো নেভে না। দিদা একবার শুনে বলেছিল, যাদের এত বড় পরিবার তাদের বাড়িতে হেঁশেলের আগুন নেভা কখনো সম্ভব নয়। তোরা তাকে রাবনের চিতা বল আর চুলো বল তাতে কিছুই পালটাবে না।

রান্না ঘরের পাশে কল ঘর। সেখানে কেবল স্নান করা যায়। বড় বাথরুম পেলে পিছন দিকে বাঁধানো খাটা পায়খানা আছে, সেখানেই যাওয়া। কলঘর থেকে ঘুরে ডান দিকে পরপর দুটো ঘর। চারটে সিঁড়ি বেয়ে তাতে যেতে হয়। তারমধ্যে ছোটটায় থাকে দিদা। পরের ঘরটায় বড় মাসি মেসো আর বোচন। বোচন তাদের একমাত্র মেয়ে। তার পাশ দিয়েই উঠে গেছে দোতলা যাবার সিঁড়ি। সেখানে থাকেন মামাদাদু। প্রথম ঘরটা তার লাইব্রেরি, আরেকটা শোবার ঘর। ওপরেও রান্না ঘর বাথরুম আছে। যদিও তা রাত ছাড়া ব্যবহৃত হয় না।            

এই বিশাল বিশাল বাড়িগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা পর পর লাগানো। দুপাশের দেওয়ালগুলোও এক। ছাদগুলোতে কোনো বাউন্ডারি বা পাঁচিল দেওয়া নেই। ফলে যেকোনো একটা ছাদে উঠে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যায় মোড়ের মাথার শেষ বাড়িটায়। সেখানে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে পরের বাড়িটার ছাদে উঠলে আবার পৌঁছে যাবে মনীন্দ্র কলেজের উল্টোদিকের মেন রাস্তায়।যে রাস্তাটা পাঁচ মাথা মোড় হয়ে বাঁ দিকে ঘুরে গেছে।

বিয়ের আগে এভাবেই তারা সারা দুপুর এ ছাদ থেকে আরেক ছাদে ঘুরে বেরাত। সঙ্গী ছিল ছোটো দুই মাসি। অবশ্য একেবারে ছোটটার বিয়ে তার বিয়ের আগেই হয়ে যাওয়ায় এখন সে এখানে নেই। তার বিয়ে হয়েছে জামশেদপুরে। তার বিয়েতেও সে আসতে পারেনি। তখন তার বাচ্চা হবে। ছোটোর ওপরে যে মাসি তারও বিয়ে হয়ে গেছে তার বিয়ের আগে আগেই। তারও কোলে ছেলে। মাসিদের মধ্যে একটা মাসির বিয়েই এখনো বাকি।এই মাসির তদারকি আর উৎসাহেই আর্যর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল।

দিদা আর মাসি ছাড়া এ বাড়িতে রয়েছে আরও তিন মামা। মামাদের মধ্যে খালি বড় মামারই বিয়ে হয়েছে। বাকি দুই মামা বিয়ে-থা করবে না বলে ঠিক করেছে। আর সবচেয়ে প্রিয় প্রায় বন্ধুর মতো পিঠোপিঠি দীপু মামা চাকরি নিয়ে চলে গেছে আসামে।

এই মামার সঙ্গে তার ভারি ভাব। একবার ঠাকুর দেখতে যাবার সময় তাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে একদল বখাটে ছেলে শিস দিতে দিতে বলেছিল, আরিব্বাস,কি দিনকাল পড়ল! এতটুকু ছেলে মেয়েগুলোয় প্রেম করছে। দীপু মামা রেগে গিয়ে তাদের মারতে উদ্যত হয়েছিল। তখন সে চিৎকার করে ডেকে উঠেছিল, এই মামা চলে আয়, এগুলো সব লোফার। এদের সঙ্গে গুন্ডামি করতে হবে না তোকে। বাবা জানলে দুজনকেই পেটাবে।

তার মুখে মামা ডাক শুনে তারা থেমে গেছিল। দীপুকে জিজ্ঞেস করেছিল, এটা তোর দিদির মেয়ে? বেড়ে দেখতে। তারপর তার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বলেছিল, এই যে খুকুমণি এই মামাগুলোর দিকেও মাঝেমাঝে কৃপা দৃষ্টি দিও।

মামা তাদের মধ্যে সবচেয়ে মোটা ছেলেটার কলার টেনে ধরে বলেছিল, হ্যাঁ, নিজের বড় দিদির মেয়ে।তাতে তোদের কী! এই রাস্তায় আবার দেখলে তোদের চোখ গেলে দেব।আমার নাম জেনে রাখ। পাড়ার লোকতো বাদই দে, এখানকার পুলিসও আমায় ভয় পায় বুঝলি! আমার নাম দিপু গুন্ডা।তারপর সিনেমার নায়কদের মতো আঙুল নাচিয়ে বলেছিল, নামটা মনে রাখিস।আর যেন এমুখো না হতে দেখি।

তারপর থেকে সে দীপু মামার সঙ্গে বেরতে একটু ভয় পেত।যদি গুণ্ডাগুলো প্রতিশোধ নেবার জন্য কিছু করে দেয়! তাছাড়া সে এও বুঝতে পারে না দীপু মামা আবার কবে থেকে দীপু গুন্ডা হল!

মামাকে জিজ্ঞেস করায় সে হো হো করে হেসে উঠে বলেছিল, গুন্ডাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে নিজেকে গুন্ডাই বলতে হয় বুঝলি খুকুমণি! তারপর বলেছিল, এসব কথা যেন ভুলেও দিদি জামাইবাবুর কানে না যায়। গেলে আমার কিছুই হবে না। কিন্তু বেকার তোর আসাটা বন্ধ হয়ে যাবে।

স্বর্ণালী এটা কেবল মাত্র মাসিকেই বলেছিল। মাসি শুনে বলেছিল, কুস্তি লড়ে ভাইটির গায়ে যেমন জোর তেমনি মেজাজও চটেই থাকে। তোর আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।

কাউকে কিছু আর বলেনি সে। কিন্তু পারতপক্ষে মামার সঙ্গে বেরনো বন্ধ করে দিল।

এই বাড়িটা তার বড়দাদু শ্যামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি দিদার পিসতুতো ভাই।

দিদা বলেছিল, আমার এই ভাই হল ছাতা পড়া ব্যানার্জি বাড়ির ছেলে। আমার পিসির বিয়ে হয়েছিল তখন দিনের কোটিপতি জমিদারের সঙ্গে।কিন্তু হলে হবে কি! ভাগ্য মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ তা জানে না। দাদা হবার পর কেউ পিসেমশাইয়ের খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। সেই খাবার খেয়ে পিসেমশাই মারা গেলেন।দাদা তো তখন ছোট।সাত-আট বছর হবে।পিসি বিধবা হয়ে ফিরে এল বাপের বাড়িতে।দিন রাত মনমরা হয়ে বসে থাকত। একদিন আমার ঠাকুমাকে বলল, মা আমি যদি কোথাও চলে যাই, তোমরা আমার ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবে তো!

ঠাকুমা ভাবলেন, মেয়ের মন মেজাজ ঠিক নেই।হয়তো তীর্থযাত্রায় যাবার কথা ভাবছে। তিনি বললেন, যা না কথায় ঘুরতে যাবি ঘুরে আয়।শ্যাম তো বড় বউয়ের কাছেই থাকে। কোনো অসুবিধা হবে না।

বড় বউ মানে?

আমার মা। দাদা তার কাছেই সর্বক্ষণ থাকত। আমার মাকেই মা বলত। তার মা তো দিন রাত নয় পুকুর পাড়ে নয় বাগানে গিয়ে বসে থাকত। খেতে দিলে খেত।চুলও বাঁধত না, মা না বেঁধে না দিলে।

তারপর? স্বর্ণালী জানতে চাইল।

তারপর আর কি! ঠাকুমা তো বলে দিল,যা তুই ঘুরে আয়, তখনকার দিনে বেশিরভাগ বিধবারাই তীর্থ ক্ষেত্রে যেত।অনেকেই বেনারস, বৃন্দাবন, পুরী দিয়ে আর ফিরত না। সেখানেই তারা সারাজীবন কাটিয়ে দিত।

তাদের বাড়ির লোকজন?

কেউ কেউ হয়তো নিত। কিন্তু বেশিরভাগই আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না। তাহলে তাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে হতো তো! আবার সম্পত্তির ভাগও হয়তো দিতে হবে, এই ভেবে বিধবাদের ঘর ছাড়া করতে তারা ব্যস্ত থাকত। কাজেই কেউ যদি স্বেচ্ছায় কাশিধামে বা বেনারসে যেতে চাইত, তবে সবাই খুশি হয়েই তাকে সেখেনে পাঠিয়ে দিত।

আর তার ছেলেপুলেরা?

তাদের অবস্থা যে কী হত তা একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানতো না। ছেলে হলে যাও বা এক রকম, মেয়েদের অনেকেরই স্থান হত কুঠিবাড়িতে। তাদের আর সমাজে ঠাঁই হত না।

খুব দুঃখের ছিল তাদের জীবন বলো দিদা?

হ্যাঁ, বলে একটা বড় শ্বাস ছাড়তেন দিদা। তারপর পান চিবাতে চিবাতে বলতেন, মেয়েরা মুখ্যু হলে তাদের কপালে এমন কষ্ট চিরকাল লেখা থাকবে। তাই তো বলি লেখাপড়া করো।

সেতো আমি করছি। প্রতি বছর প্রথম হই। দুবার ডবল প্রমোশন পেয়েছি। বৃত্তিও তো পাই। কিন্তু তুমি বলো পিসি ঠাকুমার কী হল? স্বর্ণালীর মন এখন অতীতের গল্প শুনতে অপেক্ষা করছে।

দিদিমা পানের পিক সামনে রাখা রুপোর পিকদানিতে ফেলে ঠোঁটটা মুছে নিয়ে বলল, পরদিন সকালে পিসিমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ঠাকুমা বলল, তীর্থযাত্রায় যাবে বলেছিল। বাবারা আশেপাশে কেউ সেদিন ভোরে তীর্থযাত্রায় রওনা হয়েছে কিনা খোঁজ খবর করল। কিন্তু কেউ সেদিন যায়নি। একদিন পুরো এভাবেই কেটে গেল। পরদিন সকালে নদীতে জাল ফেলতে গেছে জেলেরা। তখন তাদের জালে পিসির মৃতদেহ ধরা পড়ল। আসলে রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পিসিমা গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিল। সাঁতার জানতো বলে বুঝতে পেরেছিল এমনিতে ডুববে না। তাই কলসী গলায় বেঁধে ডুব দিয়েছিল।

এমা! স্বর্ণালীর মন খারাপ হয়ে গেল এই গল্প শুনে। সে বলল, কিন্তু বাচ্চাটার কী হল? বাচ্চাটাই তো বড় দাদু তোর। সেতো আমার মায়ের কাছেই মানুষ। বাবা তাকে পড়াশোনা শিখিয়ে এত্তবড় করেছে।

স্বর্ণালী ক্রমশ জেনেছে তার নিজের দাদু চাকরি করতেন মেঘালয়ে ব্রিটিশ কালেক্টটরিতে। এক পথ দূর্ঘটনায় পা কেটে বাদ গেলে তিনি পরিবার নিয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়। এসে দেখলেন তাঁর পৈত্রিক বাড়ি দখল করে নিয়েছে অন্য ভাইয়েরা। তখন দিদার এই ভাই তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে রাখলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ভাষার অধ্যাপক নিঃসন্তান এই মামাদাদু দিন রাত পুঁথিতে ডুবে থাকতেন। স্বর্ণালী পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় তার কাজ ছিল মামাদাদুর সব কাগজপত্র বই নির্দিষ্ট তাকে রেখে দেওয়া, বের করা। কখনো বা মামাদাদু যেগুলো লিখে রাখতে বলতেন, সেগুলো সে তাঁর নোটবুকে টুকে রাখত।

মায়ের কাছে সে শুনেছে, মামার বিয়ে হয়েছিল বিশাল বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে। সেও বেশ পড়াশোনা জানা মেয়ে। ব্রাহ্ম স্কুলে পাস দিয়েছিল একাদশ ক্লাস। তার পরে বিয়ে হয়ে গেল এখানে। কিন্তু মনের দিক থেকে সে একেবারেই ধনী ছিল না। মায়ের সঙ্গে দিন রাত ঝগড়া করত। কথায় কথায় তার বরের টাকায় সব চলছে বলে মাকে দেমাক দেখাত, কথা শোনাত। কিন্তু মামার সামনে ট্যাঁফু করতে পারত না। বাচ্চা-কাচ্চাও হল না। ফলে সব সময়ই মেজাজ তুঙ্গে থাকত। একদিন সন্ধে বেলায় হাঁটতে বেরিয়েছিল একা একাই। সেইসময় একটা অল্প বয়সী ছেলে গাড়ি চালানো শিখছিল। কোনো কারণে ব্রেক ফেল করে মামীর গায়ে উঠে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মামী মারা গেল। আর সেই ছেলেটার কী হল? শাস্তি পেল?

না। তারা এসে মামার কাছে ক্ষমা চাইল। ছেলেটির বাবা বলল, যে শাস্তি আপনি দিতে চান দিন, ছেলে অন্যায় করেছে, যদি জেলে যেতে হয় যাবে। কিন্তু মামা বলল, আমার যা ক্ষতি হবার তো হয়ে গেছে, এখন আপনার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে আর কী হবে! কিন্তু সে যেন আর গাড়ি না চালায় কখনো। আসলে মামার মন অনেক বড়। নিজে ছোটোবেলা থেকে মা বাবাকে পায়নি, তাই সব সময় চেষ্টা করত কেউ যেন এই আঘাত না পায়।

কিন্তু মা তোমরা একথা কেন বল যে মামাদাদু ছাতা পড়া ব্যানার্জি বাড়ির ছেলে! বাড়িতে আবার ছাতা পড়ে নাকি!

শুনে গৌরী দেবী হেসে উঠতেন। আরে মামারা তো কোটিপতি ছিল। এখন সেসব টাকা দেশের স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশদের রাজস্ব হিসেবে দিতে হত। আবার স্বাধীনতার পর আমাদের সরকারকেও সে টাকা দিয়ে দিতে হবে।তাই অনেকেই তখন নিজেদের টাকা পয়সা মাটির নিচে, দেওয়ালের গায়ে, মেঝের নিচে লুকিয়ে রাখত। ভাবত পরে একটু একটু করে বের করে নেবে। কিন্তু টাকা মানে তো কাগজ। তাতে উই লেগে যেত কিংবা যখন বার করা হত দেখা যেত মাটি লেগে সেগুলোতে ছাতা ধরে গেছে।মানে শ্যাওলা জন্মে গেছে টাকার গায়ে। মামার বাবারা তো বংশানুক্রমে জমিদার ছিল। তারা এভাবেই বছরের পর বছর টাকা রেখে দিত। একদিন দেখা গেল সেইসব টাকা এভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।তখন থেকে তাদের বাড়ির নাম ছাতা পড়া ব্যানার্জি বাড়ি।

সেই বাড়িটা কোথায় মা? আমাকে দেখতে নিয়ে যাবে? মেয়ের কথায় গৌরীদেবী বলত, সে তো হুগলীতে। আমরাই যাইনি কখনো।শুনেছি সে বাড়ির অর্ধেক গঙ্গায় তলিয়ে গেছে, আর খানিকটায় মামার শরিকরা থাকে।

আর এই বাড়িটা?

এটা তো মামার নিজের কেনা। কলেজে পড়তে ঢুকে পৈত্রিক যেটুকু টাকা পেয়েছিল তার থেকে কিনেছিল।বলেই গৌরী দেবী বলত, ভাগ্যিস কিনেছিল।নইলে আমাদের ভাইবোনেদের যে কী হত!

কার কী হত সে নিয়ে স্বর্ণালীর আপাতত কোনো মাথাব্যথা নেই। একসঙ্গে তারা এই বাড়িটায় মেতে থাকে, আড্ডা মারে, আবার পড়াশোনাও করে, এই বাড়িটাই তার মামার বাড়ি। এটাই একমাত্র সত্য তার কাছে।মামাদাদুর লাইব্রেরিতে বসে এসব কথাই তার মনে পড়ে যাচ্ছিল। বিয়ে হবার পর আর এ বাড়িতে সেভাবে আসা হয়নি। অথচ আগে প্রতি বছর ছুটি পড়লেই তারা চলে আসত এখানে।

মাসি বাড়িতে নেই। সে এখন জামশেদপুর গেছে ছোটবোন ইলুর ছেলেকে সামলাতে।ইলু তার থেকেও ছোটো। হঠাৎ তার মনে হল আমার ছেলেপুলে হলে কে সামলাবে? ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠল শরীর মন। কলকাতায় আসার পর তাদের প্রথম শারিরীক মিলন। এর আগে এতদিন সে এই আদর থেকে বঞ্চিত ছিল। ধীরে ধীরে মনকে বুঝিয়েছিল, তার স্বামী আর পাঁচ জন মানুষের থেকে এই বিষয়ে আলাদা। মা কিংবা শাশুড়িমা বারবার আকার ইঙ্গিতে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সে নানা অজুহাত দিয়ে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। কিন্তু মনে মনে একটা অজানা সংশয় তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল।এভাবেই কী কাটবে তাদের দাম্পত্য জীবন! যদিও আর্যকে সে গভীরভাবে ভালোবাসে, আর্যও যে তাকে ভালোবাসে সেটা বুঝতে তার আর অসুবিধা হয় না। নাই বা থাকল তাদের শারিরীক সম্পর্ক, তা বলে এই ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়।

তাদের ফুলশয্যা হয়নি। সারারাত আর্য তার বন্ধুকে নিয়ে বাসর ঘরে গীতা আর চন্ডীপাঠ করেই কাটিয়ে দিয়েছিল। তার কিছুদিন পর সে একদিন আর্যকে বলেছিল, সবাই হানিমুনে যায়, আমরা যাব না? আর্য সেদিন হেসেছিল। তার দিন কয়েকবাদে একদিন স্কুল থেকে ফিরে আর্য তাকে তাড়াতাড়ি সেজে নিতে বলল। কোথায় যাব- জিজ্ঞেস করায়  মুচকি হেসে বলেছিল, দেখো না কোথায় যাই! ভালো করে আগে সাজো।

তাদের বেরাতে যাবার কথা শুনে শাশুড়িমা তাড়াতাড়ি খোঁপা বেঁধে তাতে বেলফুলের মালা গেঁথে পরিয়ে দিয়েছিল। তারা গেল স্টেসন পেড়িয়ে ভাঙা রাজবাড়ির ঘাটে। সেখানে গঙ্গার জল তিরতির করে বইছে।কিনারায় বাঁধা এক খানা বড় নৌকা। তার উপরেই বসল তারা।

মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদ। তার আলোয় চারপাশে মায়া জাল তৈরি হয়েছে। আর্য সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে স্বর্ণালীর মাথা টেনে নিল নিজের দিকে। বলল, ওই দেখো আকাশে পূর্ণ জ্যোৎস্না। চারদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে সে তার ছটায়। মাটির এই পৃথিবীতে এই নদীর পাড়ে আমাদের এই নৌকা আসলে ময়ূরপঙ্খী। এটাই আমাদের হানিমুন। মধুর মতো মিষ্টি আর উষ্ণ। প্রাণ ভরে উপভোগ করো আজকের সন্ধেটা। দেখো কেমন মন ভালো করা একটা সন্ধে দৃঢ় পদক্ষেপে নীরবে এগিয়ে চলেছে রাতের দিকে, সমর্পন করে দিচ্ছে নিজেকে রাতের গভীরে। এই সমর্পনটাই হল ভালোবাসার সবচেয়ে বড় ধাপ। একবার পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পিত করে দিলে আর কোনো ভয়, দ্বিধা, সংশয় থাকে না সেখানে।

হাতের মুঠোর মধ্যে তার হাত টেনে নিয়ে তারপর বলেছিল, ‘দুজনের চোখে দেখেছি জগত, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে- মরুপথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে। ছুটিনি মোহন মরীচিকা পিছে-পিছে, ভুলাইনি মন সত্যেরে করি মিছে- এই গৌরবে চলিব এ ভবে যতদিন দোঁহে বাচি। এ বানী প্রেয়সী, হোক মহীয়সী ‘তুমি আছ আমি আছি’।

এরপর স্বর্ণালী কেবল একটি কথাই নিজের মনে গেঁথে নিয়েছে তুমি আছ আমি আছি।

পর্ব চার

কিরে এলোচুলে ভর সন্ধে বেলায় লাইব্রেরিতে কি নিয়ে এত ভাবতে বসেছিস? হাতে তো কোনো বই দেখছি না। বলতে বলতে মহালহ্মী দেবী কখন দোতলায় লাইব্রেরিতে উঠে এসেছে টেরও পায়নি স্বর্ণালী। সে কিছু না বলে চুপ করে রইল। বুঝলাম নাতনি আমার এখানে বসে বসে নাতজামাইয়ের ধ্যান করছে। আর এই বুড়িটা যে কখন থেকে ডেকে যাচ্ছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই।

তুমি ডাকছিলে আমায়? আমি একদম শুনতেই পাইনি দিদা। বলে দিদার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় স্বর্ণালী বলল, কি বলছিলে গো! আমি দেখতে এলাম তোর আবার জ্বর আসেনিতো! খিদেও তো পেয়েছে নিশ্চয়ই। সেই দুপুরে কখন ভাত খেলি।তারপর তো কিছুই খাসনি। মুড়ি মেখেছি, খাবি চল। চুলটাও বেঁধে দেব।

দিদা এখানে একটু বসবে? দিদার হাত ধরে স্বর্ণালী বলল।

নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে সেখানেই বসে পড়ল মহালহ্মী দেবী। এই নাতনিটি তার বুকের ধন। একে বড় মেয়ে গৌরীর বড় কন্যা, তাতে আবার ছোটো থেকেই দিদা অন্ত প্রাণ। তাছাড়া পড়াশোনা, স্বভাব, ব্যবহার সবেতেই সে তুলনাহীণ। নাতনীর চুলে হাত বুলিয়ে জট ছাড়াতে ছাড়া বলল, কি বলবি বল। 

 এই যে এখানে এত বই তুমি কখনো পড়েছ এগুলো?

আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ। এত বড় বড় বই কি আমি পড়তে পারি? তবে গল্পের বইগুলো সব পড়া। রবীন্দ্রনাথ তো পড়িই নিয়মিত, যেমন করে লোকে শাস্ত্রের বই পড়ে। তবে আমার শাস্ত্রে অত মতি নেই। আমি আশাপূর্ণা পড়ি, রাধারাণী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী এদের বই পড়তে ভালো লাগে।

দিদা তুমি স্কুলে যেতে?

না না। আমার বাবা তো বর্মায় ইংরেজ সরকারের ডাক্তার ছিল। বাড়িতে মেমসাহেব এসে পড়াতেন অল্প বিস্তর ইংরেজি। তারপর তো এখানে হাসপাতালে বাবা চলে এল।তখন বাংলা পড়ব ভাবছি। কিন্তু ঠাকুমা বাড়ির মেয়েদের পড়াশোনা করতে দেবে না কিছুতেই। পড়াশোনা শিখলে নাকি অকালে বিধবা হতে হয়। তাকে কে বোঝায় যে আমার পিসি তো কিছুই পড়তে লিখতে জানতো না, সে নিজেও জানতো না,তবু কী করে বিধবা হল!  বাবাও রাজি  করাতে পারল না তাকে। এদিকে আমার তো ভীষণ ইচ্ছে পড়বার। তখন এই দাদা বলল, বুড়ি তুই চিন্তা করিস না, আমি যা যা পড়তে শিখব তোকে বাড়ি এসে সেগুলো শিখিয়ে দেব। তা দিনের বেলায় তো সেগুলো শেখা যাবে না। আমার স্লেট পেন্সিল খাতা বই কিছুই নেই। তখন বাড়ির পিছন দিকে যেদিক দিয়ে মেথরেরা যাতায়াত করত সেই রাস্তা দিয়ে মা আমাকে লুকিয়ে দাদার কাছে পাঠিয়ে দিত। এভাবেই কয়লার বালতিতে করে আমার জন্য খাতা বই আসত। মা শাড়ির ভাঁজে সেগুলো লুকিয়ে আমাকে ঘরে চুপিচুপি দিয়ে যেত। আমি সেগুলো নিয়ে কখনো ছাদে, কখনো বাগানের পিছনে, গাছের ডালে বসে দাদার দেওয়া পড়াগুলো করে রাখতাম। এভাবেই অংক, ইতিহাস, বাংলা, ভূগোল, সংস্কৃত, পালি পড়তে শিখলুম। কিন্তু সায়েন্স পড়তে পারিনি। ইংরেজিও অল্পবিস্তর পড়তে পারি। আমার বোনেরা অবশ্য একটুও পড়তে শেখেনি। কোনো রকমে নিজেদের নামটা লিখতে শিখেছিল।

এত কষ্ট করে তোমাকে পড়তে হয়েছে?

হ্যাঁ। কিন্তু তখন এটাকে কষ্ট মনে করতুম না। বরং দারুণ একটা উত্তেজনা কাজ করত। মানুষ অন্যায় করলে লুকিয়ে চুরিয়ে করে। আর আমি পড়ছি, সেটা লুকিয়ে। বেশ মজার তাই না! কিন্তু তোকে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না।শরীর ঠিক হয়ে গেলে আবার কলেজে যেতে শুরু কর। তোর মামাদাদু বলছিল, মেয়েটা এত ভালো পড়াশোনায়, কোথায় প্রেসেডেন্সীতে পড়বে, তা না বিয়ে দিয়ে দিল জামাই।

তোমার নাতজামাইও আমাকে পড়াতেই চায় গো। কলেজে ভরতি করে দিয়েছে। এবার ফিরে গিয়ে আবার ক্লাসে যাব ভেবে রেখেছি।

হ্যাঁ। তাই যাস। মেয়েদের পড়াশোনা শেখাটা খুব দরকার। শুধু যে চাকরি করার জন্য তা কিন্তু নয়, সন্তানদের মানুষ করার জন্যেও মায়ের শিক্ষা দরকার।      

মহালহ্মী দেবী বলল, এবার নিচে চল। মুড়ি মিইয়ে যাবে তো!

যাচ্ছি। কিন্তু আজ আমি তোমার গল্প শুনব।

কি গল্প?

এই তোমার ভাইবোনের গল্প, তোমার বিয়ের গল্প এইসব আর কি…

বুঝলুম, আজ মাসিরা নেই বলে নাতনি আর আমাকে ছাড়ছে না। কিন্তু এখন রান্নাটা সেরে নিতে হবে তো।তারপর না হয় বলব! রাতে দিদার পাশে শুয়ে স্বর্ণালী শুনতে লাগল দিদার ছোটো বেলার কথা।

আমরা ছিলুম তিনবোন, আমি বড়। নৈহাটিতে যে মাসির বাড়ি গিয়ে তোর সঙ্গে নাতজামাইয়ের দেখা হল, সেই বোন হল মেজো দেবলহ্মী। তার বর আবার একদিকে আমার ননদাই। আমার ননদ পাঁচ নম্বর বাচ্চা জন্ম দিয়ে গিয়ে সুতিকাগৃহে মরে গেল। তা অতগুলো বাচ্চাকে দেখবে কে? সৎ মা কেমন হবে তারও কোনো ঠিক নেই। তখন আমি ঠিক করলুম বোনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেব। বোনের তখনো বিয়ে হয়নি। দেখতে শুনতে একেবারে ভালো ছিল না সে। কালো, রোগা। যে সম্বন্ধই আসছে বাতিল করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বোনটা আমার খুব নরম মনের আর খাটতেও পারত ভীষণ। আমি ভেবে দেখলুম এক ঠিলে দুই পাখি মারা যাবে এতে। বোনেরও গতি হবে আর বাচ্চাগুলোও একটা মা পাবে। তা সত্যি বলতে কী আমার ননদাই তাকে মাথায় করেই রেখেছে। ছেলে মেয়েগুলোও মা অন্ত প্রাণ। দেখেছিস তো!

তোমার আরেক বোন তো রাজলহ্মী দিদা। সেতো দারুণ সুন্দরী।

হ্যাঁ। সে রূপে গুণে সত্যিই রাজলহ্মী। বিয়েও হয়েছে তেমনি ঘরে। রাজ রাজেন্দ্র নন্দিনী সে। অবশ্য এখন আমাদের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ রাখে না। আমরা তো গরীব। স্বর্ণালী আর কিছু জানতে চায় না। দিদাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে দেখে আর্য তাকে জড়িয়ে আছে। সেও পরম সুখে তাকে জড়িয়ে ধরে।

পর্ব ৫

কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভেঙে যায় মহালহ্মীর। নাতনির হাতটা নিজের বুকের থেকে আলতো করে সরিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই ব্রহ্ম মুহূর্তে সূর্য মন্ত্র পাঠ করাটা তার ছোটোবেলার অভ্যাস। এত বছরেও তাতে কখনো ফাঁকি পড়েনি। বাবা বলত, সকালে সূর্য দেবতাকে প্রণাম করে দিন শুরু করলে শরীরে সদর্থক শক্তি কাজ করে।

তা করে বৈকি! কম ঝড় ঝাপটা তো বয়নি এই শরীরের উপর দিয়ে! এগারোটা ছেলে মেয়ের জন্ম, তাদের প্রতিপালন।ছোটোবেলায় অভাব এই শব্দটার সঙ্গে কোনোদিন পরিচয় হয়নি। ঘুম থেকে উঠে ফলের রস খাওয়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হত দিন। কাজু পেস্তা আখরোট মুঠো মুঠো খেত। গায়ের রং এর ফলে এমনি হয়েছিল যে লোকে ভাবত তারা সাহেবের বাচ্চা। একটু বেলা হতেই মেমসাহেব আসতেন পড়াতে।এ বই সি ডি এর পাশাপাশি ইংরেজি ছড়া আর বাইবেল।

মা পড়াশোনা কিছুই জানত না। তার ছিল রান্নার শখ। কত রকম পদ যে তিনি রাঁধতেন সারা দিন ধরে। আর সেলাই করত। এই জামা বানাচ্ছে তো পরমুহূর্তেই সোয়েটার, মাফলার। দশ বছর বয়সে আবার ফিরে আসা এদেশে।ল্যান্স ডাউন রোডে বাবার ভাড়া বাড়ি। উপরে থাকত দক্ষিণ ভারতীয় এক ব্রাহ্মণ পরিবার, আর নিচের তলায় তারা। মিলেমিশেই থাকা। সেখানেও সুখ ছিল। সে বাড়ির দুপাশে ছিল থোকা থোকা কাগুজে ফুলের গাছ। আর মধু মালতি।তার বোটাটা টিপে মিষ্টি একটা রস বের হত। এখনো চোখ বুঝলে মাঝে মাঝে সেই বাড়িটা সামনে এসে দাড়ায়।নিচের হলঘরটা ছিল তাদের খেলার জায়গা। আর দুপুরে তারা গিয়ে বসত রান্নাঘরে। মায়ের পাশে বসা ঠানদিদির সঙ্গে তারা গল্প জুড়তো।

ঠানদিদি তাদের বলত, সাহেবরা সুঁদর মেয়ে দেখলেই তুলে নিয়ে চলে যায় তাদের কোঠিবাড়িতে। তোমরা কখনো ঘরের বাইরে বেরবে না।

যেদিন মা গঙ্গা স্নানে যেত সেদিন পালকি এসে দাঁড়াতো বাড়ির সামনে।মুখে ঘোমটা টেনে মা গিয়ে বসত তাতে। তারপর তারাও আরেকটা পালকিতে।চার চারটে দশাসই চেহারার লোক হুম না হুম না বলতে বলতে তাদের নিয়ে যেত সেই বাবুঘাটে। একটা বড় জায়গা ঘেরা থাকত মেয়েদের স্নানের জন্য। ওইটুকু সময় যেন মায়ের জীবনে অনন্ত আনন্দ নিয়ে আসত। তার চান আর শেষ হত না।সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তারা আবার ঘর মুখো হত।

আর বাড়ি ফিরেই ঠাকুমার বকানি শুরু হয়ে যেত। বেহায়া মেয়ে মানুষ, এতক্ষণ চান করতে লাগে? নিশ্চয়ই মিনসে দেখা হচ্ছিল। আর মেয়েগুলোও হয়েছে তেমনি ধিঙ্গি। মা বলল, তো নেচে নেচে চলল। কেন বাপু এত ফূর্তি কিসের! তারপরেই খোকা খোকা বলে ডাক ছেড়ে বলত, আমার ছেলেটার কপাল পোড়া। নইলে এমন মেয়েমানুষ জোটে? দুদিন বাইরে থেকেই নিজেকে মেমসাহেব ভাবছে। সইবে না ধম্মে সইবে না এই অনাচার।

তারা বুঝে উঠতে পারত না এই ধম্ম জিনিসটা কি! কিন্তু সেসব বোঝার আগেই বারোতে পড়তে না পড়তে বিয়ে হয়ে গেল। শ্বশুড়ের কোনো বাড়ি ছিল না। চারটে ছেলে তার। বিয়ে হল বড়টার সঙ্গে। বাবার মনে হয়েছিল ছেলেটা সৎ ব্রাহ্মণ বংশের ছেলে, খারাপ হবে না।

তা বিয়ের পর তারা খারাপ ছিল না। কিন্তু বাধ সাধল কপাল।দূর্ঘটনায় একটা পা কাটা পড়ল।কোম্পানি আর রাখল না। বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হল কলকাতায়। কিন্তু থাকার জায়গা নেই,বাবাও ততদিনে চলে গেছেন, মার অবস্থা তথৈবচ। দুটো বোনের বিয়ে হয়নি। ভাড়া বাড়িটাও ছেড়ে দিতে হল। তখন এই দাদা সবাইকে নিয়ে এসে তুলল এই বাড়িটায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই হল।ভাগ্যিস মায়ের কাছে সেলাই ফোঁড়াই কিছুটা শিখেছিলুম, তাই তো মা আর আমি দুজনে মিলে সংসারটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারলুম।

তাছাড়া সে লোকটা তো খারাপ ছিল না। ফিরে এসে কাজের চেষ্টা তো কম করেনি।না পেলে কী করবে! দুঃখে দুঃখে মানুষটা কেমন হয়ে গেল। গ্লোব নার্সারিতে একটা চাকরি পেল, তাকে তখন ফুলের নেশায় ধরল। প্রায়ই শেখান থেকে ফিরে বলত, জানিস বউ আজ গোলাপটা এত ভালো ফুটেছে যে অন্য ফুলগুলোর জৌলুস ম্লান হয়ে গেছে। আবার কখনো বলত, চলো বউ আজ সারারাত নার্সারিতেই থাকি।বাগান ভরে গেছে বেলী আর রজনীগন্ধায়। লজ্জায় মরে যেতাম। লোকটা বলে কী! মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেল যে! তবু তো ছিল। তারপর যে কী হল, হঠাৎই কোনো কিছুর সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। ডাক্তার বলল, হার্ট এট্যাক। সেই থেকে একা একাই টানছি এতগুলো পেট। তবে দাদা মাথার উপর ছিল বলে বাড়ি ছাড়া হতে হয়নি। একটাই স্বান্তনা মেয়েগুলোর সব ভালো বিয়ে হয়েছে। ছোটো ছেলেটাও ভালো চাকরি পেয়েছে।এখন নাতি নাতনিগুলো সব ভালো থাকলেই শান্তি।

এসব ভাবতে ভাবতেই উনুনে আঁচ দিচ্ছিল মহালহ্মী।

শহরটা তখন জেগে উঠছে। রাস্তায় রাস্তায় হুঁশ পাইপ দিয়ে গঙ্গার জল ঢালা হচ্ছে। সারাদিনের যাবতীয় কাদা নোংরা পরিষ্কার করা হচ্ছে।মোড়ের মাথায় চায়ের দোকানেও ঝাড়পোছ শুরু হল। একটু বাদেই মহা রবে শুরু হয়ে যাবে একটা ব্যস্ত দিন। চায়ের কেটলি উনুনে বসিয়ে দিন শুরু হল তারও।

              

পর্ব ৬

সাতদিন টানা বাঁকুড়া পুরুলিয়া মেদিনীপুরে কাজ করল আর্য। এই কদিন বিশ্রামের অবকাশ প্রায় পায়নি। সারাদিন স্কুল কলেজ পরিক্রমা আর রাতে একটা মাঝারিমাপের হোটেলে কিংবা কোনো শিক্ষকের বাড়িতে রাত কাটিয়ে আবার সকাল হলেই বই নিয়ে বেরিয়ে পড়া।এইসব জায়গায় স্কুল কলেজগুলো অনেক দূরে দূরে।এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বেশ কষ্টই হয়। তাছাড়া পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার আবহাওয়া তার সেভাবে সহ্য হয় না। অথচ কাজ করা ছাড়া উপায় কি!

তারই ফাঁকে সে চেষ্টা করে সেই অঞ্চলের কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে দেখা করার। এবার যেমন পরিচয় হয়েছে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কবি মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তুলদেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল আর্যর। রোগা ছিপছিপে চেহারা ধুতি পাঞ্জাবী পরা মানুষটিকে আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। কিন্তু অদ্ভুতভাবেই আর্যর সঙ্গে জমে গেল। কমিউনিস্ট ভাবধারায় প্রভাবিত হলেও মানুষটির মধ্যে এক সহজাত সাহিত্য বোধ আছে। তাছাড়া প্রত্যন্ত মানুষদের প্রতি তার মনোভাব আর্যকে বেশ মুগ্ধ করল। সেদিন অনেক রাত অবধি তাঁর সঙ্গে আড্ডা চলল আর্যর।

কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, সমাজে বাস করতে গেলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতাকে স্মরণ রেখেই কবিতা লিখতে হয়। কবিতা লিখতে বসার সময় তো প্রথমেই এই চিন্তাটাই মনে আসে কি লিখব, কাদের জন্য লিখব? আমার উপর তো আর সারা পৃথিবীর ভার নেই যে আমি সকল নিপীড়িত দুখী মানুষের জন্য লিখতে পারব! কিন্তু যে ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে ঘটছে, ঘটেছে সেগুলোর কথা তো বলতে হবে।নইলে যে নিজের কাছেই জবাবদিহি করতে হয়। আমি কবিতায় বিপ্লব আনতে পারব না এটা যেমন ঠিক তেমনি একটা কবিতা যদি কিছু মানুষের মনে প্রশ্ন তোলে, তাতে যদি রাষ্ট্র অল্প হলেও ভাবে তবেই কবির স্বার্থকতা।

তিনি আর্যর বসুমতি আর দেশে প্রকাশিত কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। কলকাতা থেকে এত দূরে বসে কেউ তার কবিতা পড়েছেন, এবং প্রশংসা করছেন দেখে সে অবাক হয়ে গেল।

তিনি বলছিলেন, বুঝলেন আর্যবাবু, আমিও একদিন জ্যোৎস্নার নাবিক হতে চেয়েছিলাম।কিন্তু এখানকার মানুষগুলোর দুঃখ দারিদ্র আমার ব্যক্তিগত শোক বা ইচ্ছাকে ভুলিয়ে দিল। ভাতের জন্য এরা লড়াই করে। এদের জমিতে ফসল উঠলে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেতে পারে না।টুসু সাঁওতাল সহ প্রত্যন্ত এই মানুষগুলোর পিঠে চাবুকের দাগ আর শুকিয়ে যাওয়া জলের ধারা আপনাকে বাধ্য করবে চেনা বৃত্তের বাইরে হাঁটতে। আপনি তো একজন অনুভূতিপ্রবণ আবেগ সম্পন্ন মানুষ। আমিও বদলে গেলাম ধীরে ধীরে। তাদের কষ্ট আমাকে লিখিয়ে নেয় অন্য ধাঁচের কবিতা যার সঙ্গে শহরের কোনো যোগ নেই। আমি এখন বুঝি গ্রাম মানে কিছু গাছগাছালি একটা নদী একটা বন কিছু লাল মাটি আর গোবর মাখা বাড়িঘর নয়। গ্রাম মানে ইস্পাত তাতানো উত্তাপ। আমি তাই গরীব ক্ষেত মজুরের ভাষায় কবিতা লিখে সেই কবিতাকে পৌঁছে দিতে চাই ক্ষেতে খামারে মাঠে ময়দানে কলকারখানায় গ্রামেগঞ্জে।এই যে গ্রামে গ্রামে ভূস্বামীদের শোষণ চলছে আমি কবিতার মাধ্যমে সেখানে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে চাই। যদি একজন মেহনতী মানুষও এই কবিতা পড়ে, তবেই আমি খুশি।

মার্ক্সীয় দর্শন নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা চলে আর্যর। আর্য বলে, মার্ক্স তো শুধু একটা দর্শন হতে পারে না, দেশ কাল পরিবেশ অনুযায়ী সেই তত্ত্বের প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন। যেমন ধরুন এই যে নকশাল আন্দোলন চলছে, তারা নিজেদের বলছে মার্ক্স মাও সে তুনের আদর্শে অনুপ্রাণিত। কিন্তু এটাও তো ঠিক কোথাও একটা আদর্শের নাম করে হত্যা শুরু হয়েছে। আর তাকে দমন করার নামে সরকার একটা প্রজন্মকে পুরো ধ্বংশ করে দিচ্ছে।এখন ভেবে দেখা উচিত কিসের বিনিময়ে কতটা রক্ত ঝরিয়ে এই আন্দোলন থামবে।

হয়তো আপনি যেটা ভাবছেন সেটা ঠিক, আবার তারা যেটা ভাবছে সেটাও ঠিক। আপনার একটা লেখায় আমি পড়েছি আপনি স্টেশনের ট্রেনের ওভারহেডের তার ছাতা দিয়ে টেনে টেনে ছিড়ে দিয়েছিলেন।তখন আপনার বয়স মাত্র সাত কি আট।আপনি কিন্তু জানতেন না ঠিক কিসের জন্য এটা করেছিলেন, কেউ একটা সভায় বলেছিল ব্রিটিশদের দেওয়া রেল গাড়ি বর্জন করতে হবে।সেই কথাটাই আপনার মাথায় ঢুকে গেছিল।আপনি আপনার মতো করে তাই প্রতিবাদ করেছিলেন। এর ফলে যে আপনার জেল হবে এই ভাবনাটা আপনার মাথায় আসেনি।অথচ যখন জেলে গেলেন, মনে হল একটা বীরত্বের কাজ আপনি করে ফেলেছেন।এরাও সেরকম ভাবেই ভাবছে।

একটু থেমে মোহিনীমোহন বলেছিলেন, আপনি তো মহাকরণ অভিযানও করেছেন স্কুল শিক্ষকদের মাইনে বাড়াবার দাবীতে। আমি তো দেখেছি আপনাকে সেখানে। মারও খেয়েছেন, জেলও তো হয়েছিল।

আর্য বলে, হ্যাঁ তিনমাস জেলে ছিলাম।

আসলে যেকোনো বিপ্লব যখন আসে তখন সে এভাবেই প্রভাবিত করে ছেলেমেয়েদের। এটাও একদিন থেমে যাবে। তবে মানুষের অধিকার পাবার লড়াই আজকের নয়। যবে থেকে তার সৃষ্টি তবে থেকেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম। একটু থেমে বলেছিলেন, তবে আমার মনে হয় আপনার বিপ্লব প্রবল বস্তুতাত্তিক জীবনের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের। আপনি মশাই একেবারেই জ্ঞানী পুরুষ। মাটিতে নেমে এসব লড়াই করার পথ আপনার জন্য নয়।ভাবুন ভাবুন ঠিক কী করতে চাইছেন! আপনার লক্ষ পথ অন্য কিছু।

ওঠার মুখে বললেন, সত্যিকারের একটা মানুষ আঁকতে হবে, দুঃখ ভেজা চোখের জলে কিংবা বুকের আগুন দিয়ে। আমি জানি এটাই শিল্প এটাই কাব্য। এ জন্য চাই সন্ধিবিহীন একটা লড়াই…।

লাইনগুলো কয়েকবার নিজের মনেই আউড়ালো আর্য। সত্যি সে কি চাইছে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু এই কাজটা করতে তার আর ভালো লাগছে না।নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই চলছে। তার মনের মধ্যে একটা মৃত্যু চেতনা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে সব ছেড়ে সন্ন্যাস হবার তীব্র বাসনা, ঈশ্বরকে পাওয়ার আকুতি অন্যদিকে বিশাল পরিবারের দায়িত্ব তাকে মুক্তি দিচ্ছে না মুহূর্তের জন্যেও। বাবার মতো সে কখনো পারবে না সবাইকে আবার অনিশ্চিত একটা জীবনের মুখে ফেলে পালাতে।ছোটো ভাইগুলোর পড়াশোনার দায়িত্ব তার কাঁধে। স্বর্ণালীও এখন তার উপর নির্ভরশীল। এই অবস্থায় পালাবার পথ নেই।কেবল অপেক্ষা আর কাজ করে যেতে হবে তাকে।

সেদিন কলকাতা ফিরে অনেক রাতে কাজের ফিরিস্তি লেখার ডায়েরির পিছন পাতায় আর্য লিখল- দৃঢ় পদক্ষেপে একটা স্থির মৃত্যু এগিয়ে আসছে- আমি অসহায় ভাবে তার হাতে নিজেকে কেমন করে যেন সমর্পণ করে দিচ্ছি। যেমন করে আলো নিজেকে নিভিয়ে দিয়ে সমর্পন করে অন্ধকারকে।

পর্ব-৭

মামার বাড়িতে আর ভালো লাগছে না স্বর্ণালীর। পনেরো দিন হয়ে গেল মানুষটা তাকে এখানে রেখে দিয়ে চলে গেছে।তারপর আর একদিনও এলো না। বলেছিল, এবার তাকে উত্তরবঙ্গ নিয়ে যাবে।অবশ্য তার আগে তার পুরুলিয়া যাওয়ার কথা।এতদিনে ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই। নিজের মনেই ছাদের মেঝের উপর বসে এসব ভাবে সে।

এমন একটা মানুষকে বিয়ে করাটা আদৌ ঠিক হয়েছে কিনা সেটা নিয়েও সে ধন্ধে পড়ে। মানুষটার সঙ্গে কথা বলার সময়, কাছে থাকলে মনে হয় যুগ যুগ ধরে এমন একজন মানুষের জন্যেই তার এই নারী জন্ম। অথচ যখন সে দূরে থাকে কোনো ভাবেই আর তাকে ছুঁতে পারে না সে। কেমন যেন রহস্যময় জীবন তার। এত জ্বর নিয়ে এখানে রেখে গেল,তখন দেখে মনে হচ্ছিল খুব চিন্তিত। দিদা পর্যন্ত বলল, ভাগ্য করে স্বামী পেয়েছিস তুই। সাক্ষাৎ নারায়ণ। অথচ সেই নারায়ণের আর দেখা নেই।

একবার ভাবল এখান থেকে কলেজস্ট্রিট বেশি দূর নয়। ট্রামে করে চলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসবে। পরমুহূর্তেই অভিমান জড়ো হল।কেন যাব? আমি কি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি! সেই দিয়ে গেছে। যাব না আমি। অন্য আরেকটা মন আবার কূ গায়। খারাপ কিছু হল নাতো! অসুখবিসুখ জ্বর জ্বালা! কে জানে! শরীরটার উপর দিয়ে তো কম ধকল যায় না।আজ এখেনে তো কাল সেখানে। খাওয়া দাওয়ারও কোনো ঠিক নেই।

কি যে করি আমি… সে ঠিক করল সেজোমামাকে নিয়ে রবিবার বেলেঘাটায় চলে যাবে।

মহালহ্মীর গলা কানে আসছে। উত্তর দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতেই রেলিং দিয়ে নিচের দিকে তাকালো স্বর্ণালী। উঠোনের উপর দাঁড়িয়ে আর্য।হাতে একটা মিষ্টির ভাঁড়। রোগা লাগছে খুব। শরীর নির্ঘাত ভালো নেই, ভেবে সে দ্রুত নিচে নেমে এল। আর্য ততক্ষণে দিদার ঘরে চৌকির উপরে বসে গেছে। ভাইবোনগুলো ঘিরে ধরেছে তাকে। সে তার সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা একটা করে লজেন্স বের করে তাদের হাতে দিচ্ছে। দরজার চৌকাঠ থেকেই স্বর্ণালী সে দৃশ্য দেখতে লাগল।

দিদা সরবত বানিয়ে তাকে ডাকল। যা, দিয়ে আয়। আমি চট করে নুচি ভেজে নিই। হ্যাঁ রে জামাই স্টিলের থালায় খায় তো?

দিদার প্রশ্নে স্বর্ণালীর মনে পড়ে গেল অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়িতে মা নতুন জামাইকে কাচের প্লেট বাটিতে ভাত তরকারি মাছ মাংস গুছিয়ে খাবার বেড়ে দিয়েছিল। আর্যর জন্যেই এসব কেনা হয়েছিল। কিন্তু সে সেই বাসন দেখে না খেয়েই উঠে চলে গেছিল।য়ার ফিরে আসেনি। দেওর এসে তাকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গেছিল দিন সাতেক বাদে।সে তখন বুঝতেই পারেনি কী এমন ঘটল যাতে আর্য না খেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল! অনেক পরে জেনেছিল, কাঁসার বাসনে খেতে না দিলে তার নিজেকে অতিথি মনে হয়। কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরে জামাইকে কাচের বাসনে খেতে দেওয়া মানে প্রচ্ছন্নে অপমান করা। সেদিনকার কথা মনে পড়তেই স্বর্ণালী তাড়াতাড়ি করে বলল, দিদা তোমার নাতজামাইকে যাই দাও না কেন কাঁসার বাসনে দিও।সে তাতে খেতেই পছন্দ করে।

দিদা হেসে রান্না ঘরে ঢুকে গেল। স্বর্ণালী মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরে ঢুকে প্রণাম করল। তারপর সরবতের গ্লাসটা দিয়ে বলল মনে পড়েছে তাহলে আমাকে! তোমার শরীর ঠিক আছে তো? খুব রোগা লাগছে।

আর্য হেসে হাতটা টেনে ধরল। হ্যাঁ, ঠিক আছি। তারপর বলল, তৈরি হয়ে নাও। আজ তোমাকে বেলেঘাটায় নিয়ে যাব। দুদিন বাদে মালদা যেতে হবে। তুমিও সঙ্গে যাবে। কাজ মিটিয়ে চলে যাব দার্জিলিং। দিন তিনেক সেখানে থেকে ফেরার পথে তোমাকে রামপুরহাটে দিয়ে আসব। তোমার জায়গা পরিবর্তন দরকার। ডাক্তার বলেছেন, চেঞ্জে গেলেই তুমি ঠিক হয়ে যাবে। এখানে আসার পর আর জ্বর এসছিল? স্বর্ণালী মাথা নাড়ল। তার মানে বেলেঘাটার বাড়িটার আশেপাশের পরিবেশটাই তোমার সহ্য হচ্ছে না।ফিরে এসে একটা বাড়ি দেখতে হবে অন্য কোথাও।

আমাদের আলাদা বাড়ি হবে গো?

হবে, স্বর্ণালী, সব হবে। তুমি শুধু তোমার এই বরটার উপর ভরসা রেখো।

পরম নির্ভরতায় সেই ভরসার হাতদুটো নিজের হাতে জড়িয়ে তারা শেষ ট্রামে উঠে বসল। তাদের দুচোখে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন উপচে পড়ছিল। মাথার উপর একটা নিটোল চাঁদ তাদের সেই অজানা অচেনা ভালোবাসার পথের সন্ধান দেবার জন্য ট্রামের আগে আগে রাস্তা দেখিয়ে চলল।               

                        

             

                                             

              

    

   

              

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত