| 25 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা অনুবাদ: মনের পছন্দ । এউদা মোরালেস

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

Gustos del Magín মনের পছন্দ/এউদা মোরালেস Euda Morales (গুয়াতেমালা)/অনুবাদ– জয়া চৌধুরী


কোস্তারিকাগুয়াতেমালানিকারাগুয়াহন্ডুরাস এবং এল সালভাদোর ২০২০২১ সালে তাদের স্বাধীনতার দ্বি শতবর্ষ উদযাপন করছে। ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০২১ সে উদযাপন সম্পন্ন হয়েছে। সেন্ট্রাল আমেরিকার এই পাচঁটি দেশ এই ১৫ ই সেপ্টেম্বর ১৮২১ সালে একটি যৌথ সাক্ষরের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী স্পেনের কবল থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। লাতিন আমেরিকার কোন দেশ ঠিক এরকম তুলনামূলক কম রক্তপাতের মাধ্যমে স্বাধীন হয়নি। এই মহান ক্ষণটি স্মরণ করে রাখবার জন্য সেন্ট্রাল আমেরিকার স্বাধীনতার দ্বি শতবর্ষ উদযাপন করতে চাইছি। উপরের দেশগুলির বিভিন্ন সমসাময়িক সাহিত্যিকদের লেখা তুলে আনার চেষ্টা থাকবে এই প্রয়াসে। প্রথম পর্বের গল্প গুয়াতেমালার লেখিকা এউদা মোরালেস ।


তারিখ এগিয়ে আসছে। ঠাম্মার চোখের সজাগ চাউনিতেহাতের তৎপরতায়এমনকি হাঁটাচলার ভঙ্গীতেও সেটা দেখতে পাচ্ছি। বাইরে গোটা শহরটাকেই মনে হচ্ছে আরেক নতুন নভেম্বরের আরম্ভর সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। আমার নিজেরও আশ্চর্য লাগছে সেই তারিখটা আবার চলে এল। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন আমরা আমাদের মৃত মানুষদের সঙ্গে দেখা করে এলামএকসঙ্গে খাওয়াদাওয়াও করলামআরো একবার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ঠাম্মার বানানো মিষ্টি আয়োতে কন পানেলা (গুড়ে পাকানো কুমড়োর মিষ্টি)খেতে খেতে গল্প করলাম। আমার এই ছোট্ট জীবনের ছোটবেলা থেকে বরাবর ভেবেছি এই দিন মোটেই মৃত মানুষদের জন্য নয় বরং বেশি বেশি করে জীবিত মানুষের জন্য। এদিনে পরিবারের মানুষেরাও অনেক বেশি পরস্পরের কাছাকাছি হয়। এদিনে ঠাম্মার চোখে কেবল পুরনো দিনের মায়া ঝলক ফুটে ওঠে না উপরন্তু চলনে যৌবনের বাতাসের ঝাপটও লাগে। ঠাম্মাকে এরম ভাবে দেখতেই আমার ভাল লাগত। চিরটা কাল আমি গরম চাদরের তলায় সেঁধিয়ে ঠাম্মার মিষ্টি গলায় শুনবার জন্য অপেক্ষা করতাম– “ললিতাড়াতাড়ি উঠে পড়োআমাদের ‘মুন্ডি’ বানাতে হবে।

সেদিনটা বিশেষ দিন ছিল। ঠাম্মা বংশ পরম্পরায় সাবধানে রাখা এই মিষ্টির গোপন পারিবারিক রেসিপি আমায় শেখানোর জন্য মুখিয়ে থাকত। পরের দিন একটা প্লেটে সাজিয়ে সে মিষ্টি কবরখানায় খোসে দাদুর সমাধিস্থলে নৈবেদ্য হিসাবে দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হত। সে যাই হোক ও মিষ্টি অবশ্য কখনই তার গন্তব্যে পৌঁছত না। কিন্তু সেদিন সকালবেলা ঠাম্মা আগে থেকে কোন আভাস না দিয়েই মেঝেয় আছাড় খেয়ে পড়ল। তখন শুধু যে ক্রিস্টালের বড় বাটি ভর্তি আয়োতে কন পানেলা… মানে দারচিনিলবঙ্গভরা সুগন্ধী মিষ্টির নৈবেদ্যই পড়ে গেল তা নয়সেই সঙ্গে বংশপরম্পরায় গচ্ছিত রাখা রেসিপির রহস্যও গেল। এতবার চিৎকার করে ঠাম্মাকে ডেকেছিলামজীবনে কোনদিন এতখানি জোরে ডাকি নি। কিন্তু ঠাম্মা কোন উত্তরই দিল না। ঠাম্মার ঠোঁটে ছেলেমানুষের মত একটা পাতলা হাসি লেগে ছিলযেন রেসিপি নিয়ে দূরে চলে গিয়ে খুব মজা পাচ্ছে। বাইরে ঝড় উঠেছিল জোরালো। আর রঙবেরঙের ঘুড়িগুলো চঞ্চল হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল ওরা মৃতদের কাছে এখানকার সংবাদ বয়ে নিয়ে যেতে চায়। আমি আবার ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম ঠাম্মার গুলিপাকানো শিরা ভরা হাতআঙুলের ফাঁকে একটা ডুমুরের পাতা আবিষ্কার করলাম।

বছরের পর বছর আমরা কবরখানায় মিষ্টি নৈবেদ্য নিয়ে গেছি। যদিও পদটা কীভাবে বানাতে হয় বিশদে সেসব কিছুই জানতাম না।

ঠাম্মা মারা যাবার পর থেকে ঘুড়ি ওড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার ভাই টমাস বসে বসে দেখে আর হাসে আর বলে

ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেদের কাজ।

কিন্তু বাবা আমার মন খারাপ দেখে এ কাজ করার অনুমতি দিয়েছিল। নিজেই আমার হাতে পেন্সিল আর কাঁচি তুলে দিয়ে বলেছিল– “ভাল করে একটা ছবি আঁক দেখি– মরসুমী ফলের। তোর ঠাম্মাকে নিয়ে আমি এক অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছি রে। একটা বিশেষ কিছু পাবার জন্য মা আমার কাছে আবদার করছে”।

একা একা ঠাম্মার সমাধির ওপর বসে কাজ করছিলাম আর ভাবছিলাম। আর ততক্ষণ ঠাম্মা ওই মিষ্টি খাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। ছোটবেলা থেকেই মৃতদের এই অনুষ্ঠানের জন্য বহুবার ঠাম্মার সঙ্গী হয়েছি। সমাধির মাথার কাছে একটা মুন্ডির সামনে হলদে সাদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে বোনা পাইন পাতার ছোট আসনের ওপর খাবারের পাত্রটা সাজানো থাকে। মোমবাতি নিতে যেন ভুল না হয়। বোধহয় আত্মার শুদ্ধিকরণের জন্যই এই নিয়ম।

মাতিলদে ঠাম্মা চলে যাবার পর মৃত মানুষেরা আমার অবসেশন হয়ে দাঁড়াল। একা একা ওসব বই গোগ্রাসে পড়তাম যেগুলোয় মৃতদের কথা লেখা থাকত আর আমার স্কুলের শিক্ষিকাকে জিজ্ঞেস করলে আমার প্রশ্নের উত্তরে মায়া সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করা জ্ঞানের উত্তর দিতেন। “মৃত্যু ব্যক্তি আর তার আত্মার মধ্যে ফারাক দেখায়এবং মৃত্যুর অব্যবহিত সময় পরেই সে যাত্রা শুরু হয়। এবং তখন ডাইনি মাগিন (ভাল ডাইনিবা ছায়া কিছু সময়ের জন্য তা সেটা ন’দিন বা যতদিনহোক না কেন ততখানি সময় পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে স্থায়ী হয়ে থেকে যায়। লোকে বলে এটা কারো ছায়া তবে সময় হয়ে গেলে সে ছায়াও অদৃশ্য হয়ে যায়”।

ঘুড়ি বানাবার সময়েও ঠাম্মাকে খুব মনে পড়ে। মনে হতে থাকে ঠাম্মা মোটেও এখান থেকে চলে যায় নি। এমনকী কখনও কখনও মনে হয় আমার পাশেই বসে আছে বা ঠাম্মার গায়ের গন্ধ অবধি পাই। ঠাম্মাকে ছাড়া কোন নভেম্বরের শুরুটাই আর আগের মত থাকবে না। মিষ্টির স্বাদও আর আগের মত থাকবে না। মা যদিও মিষ্টিটা বানাবার সময় এতে আরো বেশি করে ফল দিতে বলে – আয়োতে বা মধু ছড়ানো কুমড়োর মিষ্টি কিংবা আখের গুড়ের গন্ধওয়ালা কানেলা পাত্র থেকে ভুরভুর করে লবঙ্গদারচিনিগোটা গোলমরিচের গন্ধ বের হয়। এ ঐতিহ্য হিস্পানিক যুগের ঢের আগেকার দিনের। কিন্তু তখনকার দিনে চিনি মেশানো হত না। তখন বড়জোর কুমড়োজামাইক্যান প্লামছোট আপেলচায়োট ফল (পিয়ার জাতীয় ফল) সম্পর্কে ধারণাটুকুই শুধু ছিল। মনে পড়ে ঠাম্মার সেই আনন্দে ভরা মুখযখন বলত– “সব শেষে এক চামচ ক্রিম দিতে ভুলো না যেন”।

বাড়িতে স্ফটিকের সেই পাত্র থেকে আলো ছড়াত। সন্ধ্যে নেমে এলে ঐতিহ্য অনুযায়ী টেবিলের ওপর ওই পাত্র রাখা হত। আর মা সেই কটা লাইন ক্রমাগত বিড়বিড় করে বলে যেত– “আবার এক অম্ল ভোর হতে চললকেননা এটা ওঁর আত্মার অংশ হয়ে রয়ে গিয়েছে। ওঁর আত্মা এই অংশটা নিয়ে খেলছে”।

ঘুড়ি হাতে বাবা এগিয়ে এল। ওটা বিশাল বড় আকারের ছিল। হাতে ধরে রাখাই যেত না বেশিক্ষণ। প্রায় আট মিটারের মত আকার। ঘুড়িটার গায়ে মরশুমী ফলের ছবি আঁকা। ওটা বানাতে আমার ঘন্টার পর ঘন্টা সময় লেগেছে।

এটার গায়ে শুধু তোমার পাঠানো সংবাদটাই লেখা নেই।

এতে সন্দেহ নেই। আমি লাইল্যাক রঙের একটা কাগজ বেছেছি। ঠাম্মার প্রিয় রঙ ছিল ওটা। সেখানে বড় বড় করে লিখেছি– মুন্ডিতে একটা জিনিষ নেইআর আমি জানি তোমার তা ভাল লাগছে না।

জানি না কথাগুলো যখন লিখছিলাম তখন কেন মনে পড়ছিল মৃত্যুর দিন ঠাম্মার ঠোঁটে লেগে থাকা শিশুর মত দুষ্টু হাসি।

-“ঠাকুমার জন্য একটাই সংবাদ”?- বিরাট ঘুড়িখানা সামলাতে সামলাতে বাবা জিজ্ঞেস করল।

কাগজটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে। মাঞ্জা দেয়া সুতোয় বেঁধে এটাকে ঝুলিয়ে রাখ। আমরা যখন টান মেরে উড়াব তখন এ সুতো ঘুড়ি পর্যন্ত টান মেরে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে”। এটা করতে গিয়ে চোখ বুজে ফেললাম। কারণ লোকে বলে এভাবে কাজ করাই আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে ভাল উপায়।

ওখানে আমরা সবাই পৌঁছে গেলাম। ঝলমলে সমাধিস্থল থেকে নানান রঙের আলো ছড়াচ্ছিল। আমাদের আসনটাও চারপাশে পাইন পাতা আর ফুলের গন্ধ ছড়াচ্ছিল। দেখলাম মুন্ডিটাও যথাস্থানে রাখা আছে। দাদারা ঘুড়িটাকে প্রাণপণ সোজা ধরে রেখেছিল যতক্ষণ না বাবা ছাড়তে নির্দেশ দেয় আর সবার হাততালির মধ্য দিয়ে ওটা উড়তে শুরু করল। বাবা শক্ত হাতে কিন্তু ছোট্ট নিপুণ শক্তিতে টান মারল। আমাদের চোখ চকচক করে উঠল। ঘুড়ি ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাড়ির গতিও দ্বিগুণ বেড়ে গেছিল। আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম ঘুড়িটা সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছে যাবে। আর মৃত মানুষদের আত্মার কাছে পৌঁছে যাবে আমাদের বার্তা নিয়ে যা আমরা তাদের জন্য পাঠিয়েছি। মাতিলদে ঠাম্মার নতুন স্বপ্ন মাখা হাসির কাছে পৌঁছে যাবে। বাকী সব্বার ঘুড়িকে ছাড়িয়ে উঁচুতে উঠবে আমাদের ঘুড়ি।

-“পেরেছিআমরা পেরেছি!- বাবা বলে উঠল। – বাচ্চারা এইবার আমাদের মিষ্টিতে ডোবানো আয়োতে খাবার প্রাপ্য”।

মা আমাকে সেই এক বাটিতে এই মিষ্টি খেতে দেয় যা বছরে একবারই ব্যবহার করা হয়। ঠিক যখন খাবারটা চাখতে যাব আমার হাতে লাইল্যাক রঙের একটা কাগজের টুকরো এসে পড়ল। কাগজের পেছনে মাতিলদে ঠাম্মার হাতে স্পষ্ট লেখা ছিল– পানেলা পাত্রে মধু ভরে দিলে সেটা সবচাইতে স্বাদু হয় আর তার গা থেকে ডুমুর পাতার গন্ধ বেরোয়”।

ঠাম্মা!”- আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাসের এক ঝাপটা হাত থেকে টুকরোটাকে কোথায় উড়িয়ে দিল। এক মাগন ডাইনির উত্তর এইবার তার পথে যাত্রা করেছে।

মাগিনঃ– গুয়াতেমালার উপকথা অনুসারে এক ডাইনি নামযিনি বাচ্চাদের শুভ করেন।

মুন্ডিঃ– মুন্ডি হল পাথরের ছোট খণ্ডমৃত মানুষের কবরের উপরে মাথার দিকে সেটি সাজানো থাকে।

 

 

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

এউদা মোরালেস

গুয়াতেমালার এই প্রোথিতযশা শিল্পী ও লেখক রান্না বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন। বর্তমানে Siglo 21 পত্রিকায় ধারাবাহিক কলাম বের হচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রন্ধন বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন এবং বর্তমানেও যুক্ত আছেন। ২০০৬ সালে গুয়াতেমালার সংস্কৃতি দফত তাঁকে সে দেশের খাদ্য বিষয়ক সংস্কৃতি বিষয়ের রাস্ট্রদূত ঘোষণা করেন। বেশ কয়েকটি বই রয়েছে তাঁর। Teseros, recetas con historia তাঁর বহু পুরস্কৃত ও বিখ্যাত বই। কয়েক বছর আগে তিনি কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় প্রধান অতিথি হিসাবে যোগদান করে গেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত