| 24 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা সিনেমা: কাহিনী কুড়ানো নির্মাতা । বিধান রিবেরু

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

বাস্তবকে পুনঃউৎপাদন করে কারো কণ্ঠস্বরকে ফিরিয়ে দেয়ার নাম প্রামাণ্যচিত্র নয়, বরং একটি দুনিয়ার পুনঃউপস্থাপনের নামই প্রামাণ্যচিত্র। প্রামান্যচিত্রের কণ্ঠস্বর অন্য, যারা নিজেদের অবস্থান থেকে আমাদের অভিন্ন দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করে, তাদের বক্তব্য সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলে। কথাগুলো চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক বিল নিকোলসের।

সম্প্রতি বাংলাদেশী বংশদ্ভূত জার্মান ভিত্তিক নির্মাতা শাহীন দিল-রিয়াজের কিছু কাজ দেখার সুযোগ হয়েছে, পাশাপাশি সরাসরি তাঁর কথা শোনারও। তিনি প্রামাণ্যচিত্রের ভেতর দিয়ে গল্প বলতে চান এবং গল্পের ভেতর দেখাতে চান দ্বন্দ্ব।রিয়াজ মনে করেন, সকল কিছুই আসলে কাহিনী, এমনকি প্রামাণ্যচিত্রও, আর এই কাহিনীর ভেতর দিয়ে তিনি উন্মোচন করতে চান নানা মাত্রার বৈপরীত্য, পার্থক্য, বৈষম্য ও বিরোধ।দ্বান্দ্বিক বয়ানেরবিস্তারে তিনি আদতে আমাদের যাপিত জীবনের বাইরে অভিন্ন পৃথিবীর অদেখা জীবন দেখান, যে জীবনের সাথে আমাদের সচরাচর দেখা হয় না।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


‘লোহাখোর’ (২০০৭) ছবিতে উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত কৃষক খলিলদের যেমন আমরা দেখি বেঁচে থাকার তাগিদে পাড়ি জমায় দেশের দক্ষিণে, কাজের আশায় তারা হাজির হয় কুখ্যাত জাহাজভাঙা কারবারে। সেখানকার নারকীয় কর্মপরিবেশ আমাদের অজানাই ছিলো এতোদিন, অন্তত অসংশ্লিষ্ট লোকজনের কাছে। এর বড় কারণ সেখানে শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে কাজ করেন, তা সঙ্গত কারণেই লুকিয়ে রাখতে চায় মালিক শ্রেণি। তাছাড়া পরিবেশ দূষণের ব্যাপারটিও চেপে রাখতে চায় তারা। কিন্তু সেই নিষিদ্ধ ঘেরাটোপের ভেতরেই ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে যান রিয়াজ। তিনি প্রথমেই যে বৈপরীত্য হাজির করেন, তা ভৌগলিক, উত্তর থেকে দক্ষিণ, বাংলাদেশের এমাথা থেকে ওমাথা। এরপর আমরা দেখি জাহাজের বিশাল বপু বনাম মানুষের ক্ষুদ্রাকায় শরীর। অথচ এই ছোট শরীরের মানুষগুলোই দানবাকৃতির জাহাজকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে, যেখান থেকে সারাদেশের রডের চাহিদা মেটানো হয়।

একদিকে শ্রমিকের জীবন ধারণ, অন্যদিকে মৃত্যুর ঝুঁকি। একদিকে শ্রমিকের পরিবার ও নিজের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে মালিকের কাছে পাওনা মজুরি আদায় করার লড়াই। একদিকে কৃষকজীবন, তো আরেকদিকে জাহাজভাঙার শ্রম। একদিকে নিষ্ঠুর জীবিকা, অপরদিকে দারা-পুত্র-পরিবার জীবন। সর্বোপরী মানুষের মানবিক জীবনের পরিবর্তে অমানবিক জীবনের উপস্থিতি। জাহাজভাঙার কাজ থেকে যখন শ্রমিকরা ফিরে এসে আবার কৃষক বনে যায়, তখন তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কথা মনে করে শিউরে ওঠে। বলে, আর যাবে না ওখানে। কিন্তু মন্দাকাল শুরু হলে, পেটে টান পড়ে,তখন তাদের আবার পুটলি বেঁধে রওনা দিতে হয় ‘নরকে’র পথে। এই টানাপোড়েন চলতেই থাকে।

বাংলাদেশে জাহাজভাঙ্গা শিল্পের গড়ে ওঠার পেছনে দুটি মূল কারণ রয়েছে: একটি যুদ্ধ, অন্যটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বিধ্বস্ত জাহাজ এসে জড়ো হয় বঙ্গোপোসাগরের উপকূলে, এছাড়া ঝড়ঝঞ্ঝায়বহু জাহাজ আছড়ে পড়ে চট্টগ্রামের বন্দরে। সেসব জাহাজ ভাঙার ভেতর দিয়েই এই শিল্পের শুরু। বাংলাদেশে এই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের জীবনযুদ্ধ ও তাদের কপালে লেগে থাকা দুর্যোগের খবর শহুরে মধ্যবিত্ত ও পশ্চিমা দুনিয়া জানতে পারে শাহীন দিল-রিয়াজের ‘লোহাখোরে’র মাধ্যমেই।

রিয়াজ একইরকম করে আমাদের খোঁজ দেন বাঁশ কাটা শ্রমিক ও বেপারিদের, তাঁর ‘বাঁশবৈভবে’ (২০১৯)। এবার রিয়াজ উত্তর বা দক্ষিণ নয়, গেছেন বাংলাদেশের পূর্বদিকে, সিলেটের শেষ প্রান্তে। সেখানকার বিশাল বাঁশবন থেকে বাঁশ কেটে বেপারিরা তা নিয়ে আসে ঢাকায়। পঁচিশ-ত্রিশ হাজার বাঁশ বেঁধে বিশাল বাঁশ-বহর বানানো হয়, একে চালি বলে, এই চালি দীর্ঘ নদী পথ পাড়ি দিয়ে রাজধানীতে পৌঁছায়। রিয়াজের ছবিতে আমরা দেখি বেপারিরা ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে যাত্রা শুরু করে কুশিয়ারা নদী বেয়ে সুরমায় আসে, এরপর আরও কয়েকটি নদী পেরিয়ে মেঘনার স্রোতে মেশে। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে বৈদ্যের বাজার তাদের গন্তব্য, সেখান থেকে বাঁশ বিপনন হয় রাজধানী ও অন্যান্য এলাকায়।

এই ছবির দ্বন্দ্বের জায়গাটি হলো বিশাল চালির চালান বনাম দীর্ঘ নদীপথ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলডাকাতের দল।অবশ্য এর আগে বাঁশবনে লিয়াকতদের লড়াইটাও প্রণিধানযোগ্য। বনের ভেতর জংলী হাতির চলাচল খেয়াল রেখে পাহাড়ি প্রতিকূল পরিবেশে তাদের বাঁশ কাটতে হয়। এরপর শহীদ লোকবল নিয়ে বাঁশের বহর সাজাতে থাকে। শুরু হয় খোলা আকাশের নিচে এক কঠোর যাত্রা। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া, প্রাকৃতিক কর্ম সবই এই বাঁশের উপর। দিনে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ আর রাতে ডাকাতের উৎপাত তো আছেই। শুটিং টিমকে তো ডাকাতের ভয়ে একবার বাঁশের চালি থেকে নদীতেই নেমে যেতে হয়েছিল।মেঘনা নদীর স্রোতের টান কারো অজানা নয়, সেই নদীতেই ঘটে এমন ঘটনা।

তবে নদীর যাত্রাপথের চেয়ে বনের ভেতর শুটিং করা ছিল আরো কষ্টের ব্যাপার। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রিয়াজ বলেন, “নদী পথে যাত্রাটা ছিল মনোরম। চাঁদনি রাতে বেশ ভালোই লাগতো।কিন্তু জঙ্গলের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। সেখানে প্রচন্ড গরম। জোঁক। মশার অত্যাচার।নানা রকম পোকামাকড় সারাক্ষণ আক্রমণ করছে। পাহাড়ী এলাকায় বৃষ্টিতে পথঘাট খুবই পিচ্ছিল।আমরা বারবার পড়ে যাচ্ছিলাম।”

কষ্ট সয়ে যে প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন রিয়াজ, সেটি আমি মনে করি সার্থক হয়েছে: মানুষের অমানবিক শ্রম,বৈরী প্রকৃতি আর বদ লোকেদের মোকাবিলা করতে করতে যেভাবে বাঁশের চালান বাজারে এসে পৌঁছায়, এ এক অজানা যাত্রার কথা বলে, আমাদের দেশের প্রান্তজনদের কথা তুলে ধরে। শ্রমজীবী মানুষের বাইরেও রিয়াজ তাঁর ক্যামেরার নজর প্রসারিত করেন, অন্য ধরনের যাত্রার কাহিনীও তিনি তুলে ধরেন আমাদের সামনে, যেমন ‘দেশান্তর’ (২০১৫)।

কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী জার্মান শিক্ষার্থীর বাংলাদেশ যাত্রা ও তাদের সেবা কর্মকাণ্ডের উপর তৈরি করা হয় প্রামাণ্যচিত্র‘দেশান্তর’। ২০১২-১৩ সালে যখন ছবিরদৃশ্য ধারণের কাজ হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে। প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মুখোমুখি অবস্থানের মাস কয়েক আগেই শুরু হয় জার্মান শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ সফর। এখানকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কার্যক্রমে যুক্ত হয়। প্রথমেই তারা যেসব ভিন্নতার মুখে পড়ে, তাহলো ধর্ম, পোশাক ও আচার আচরণ। এরপর দারিদ্র্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পার্থক্যটাও তারা পরখ করে নেন। ইউরোপের নিশ্চিত ও গতিময় জীবনের বিপরীতে এদেশের গ্রামের মানুষের নিঃস্তরঙ্গ ও অনিশ্চিত জীবন তাদের বিচলিত করে ঠিকই, তবে একইসাথে এদেশের প্রাকৃতিক শোভা তাদের মুগ্ধও করে।

রোজা, ফেলিক্স, আনারা মোট আটজন হলেও, কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই একজন হতাশ হয়ে নিজ দেশে ফিরে যান। বাংলাদেশে সফর শুরু করার জন্য তারা বেশি সময় পাননি। আসার আগে তাদের যে উত্তেজনা ছিলো, আসার পর সেই উত্তেজনা ও উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়ে। এর বড় কারণ শহরের যানজট ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য। তবে গোটা ছবিতে তুলনামূলক যে যাত্রাটি ফুটে ওঠে তা হলো পরিচালকের নিজের দেশান্তরী হওয়া, জার্মানিতে গিয়ে দুই দশকের বেশি সময় কাটানো, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে জানা, বিপরীতে এই আটজন জার্মান তরুণ-তরুণীর বাংলাদেশে কয়েক মাসের জন্য আসা ও তাদের অভিজ্ঞতা।

বলা যায়, ভালোই অভিজ্ঞতা হয়েছে তরুণদের। প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যতটুকু স্মৃতির ভাঁড়ার ভরে তোলা যায়, ততোটুকুই তারা করেছে। এরমধ্যে একদিকে যোগ হয়েছে গ্রামীণ সরলতা, অন্যদিকে রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা। জার্মান স্বেচ্ছাসেবীরা আহত ও নিজ হাতে অঙ্গ কেটে ফেলা পোশাকশ্রমিকের সাথেও দেখা করতে যান। অপরিসীম কষ্ট ও অনিশ্চয়তা নিয়েও সেই আহত নারী শ্রমিকটি যে হাসছেন, সেটা বোধহয় তাদের বিস্মিতই করে। এসময় গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে সরব, বিপরীতে মৌলবাদী গোষ্ঠী রাজনীতিবিদদের আসকারায় শক্তি প্রদর্শন করছে। পরিচালক এই বৈপরীত্যে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন, রানা প্লাজায় যারা শ্রমিক হত্যার পেছনে দায়ী, তাদেরও কি ফাঁসি হওয়া উচিত নয়?

যে দেশে ভবন ধ্বসে, আগুন লেগে শ্রমিক মরে কুকুর-বিড়ালের মতো, যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায়, রোগ ও পুষ্টিহীনতায় মানুষ মরে কীটপতঙ্গের মতো, যে দেশে ধনী ও গরীবের বৈষম্য আকাশ-পাতাল তফাতের সমান, সে দেশের মানুষ নাকি সবচেয়ে সুখী! লন্ডন স্কুল অব ইকোনমির এক জরিপে এমনটাই দেখা গেছে। মজার বিষয়, এর বিপরীতে, জার্মানির মানুষদের স্থান হয়েছে ৪২ নম্বরে (জরিপ চালানো হয় মোট ৫৪টি দেশে), বোঝা যাচ্ছে তারা বেশ অসুখী, কিন্তু বাংলাদেশে এতো সমস্যা নিয়েও মানুষ সবচেয়ে সুখী হয় কি করে? হয় তারা বোকা, তারা বোঝে না সুখী হওয়া মানে কি, নিজের অধিকার সম্পর্কে তারা সচেতন নয়, অশিক্ষিত ও অচেতন, নয় তো তারা সত্যি সত্যি সুখী। সুখের সংজ্ঞা ও সুখী মানুষের খোঁজ করতেই শাহীন দিল-রিয়াজ বানান ‘দ্য হেপিয়েস্ট পিপল’ (২০০৫) এবং বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ছবির শুটিং লোকেশন সেই বাংলাদেশ, পরিচালকের পরিচিত শহর ঢাকা।

যুক্তরাজ্যের সুখী লোক সংক্রান্ত জরিপ দেখে জার্মান লেখক সিবিল বেরি বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন, সুখের সন্ধানে। এরপর এক খোলা চিঠিতে তিনি ব্রিটিশ জরিপের প্রতিক্রিয়ায় লেখেন: বাংলাদেশে জীবন হলো নরক গুলজার। এই নরকেই পরিচালক রিয়াজ এসে চারজন মানুষকে বেছে নেন, যারা সমাজের নানাস্তরের মানুষ এবং ভিন্ন ভিন্ন জীবনে অভ্যস্ত। তাদের মধ্যে একজন হাসান, স্বাপ্নিক চলচ্চিত্রকর্মী এবং আয় -রোজগারের ক্লিশে জীবন নিয়ে উদাসীন। হাসানের বরাতেই খোঁজ মেলে রাসেলের, কিশোরবালকটি রিকশা চালালেও, তার বড় পরিচয় সে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ছবিতে অভিনয় করেছে। বড় হয়ে সে বড় অভিনেতা হতে চায়। তৃতীয়জনের নাম মিলি, ঢাকা-বিলেত তার আসা-যাওয়া, নিজের ব্যবসা আছে। চতুর্থজন কুট্টি, গরীব ঘরের মেয়ে, মানুষের বাসায় কাজ করতো, তবে সেসব ছেড়ে সে পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছে, অর্থনৈতিক কষ্টের পাশাপাশি আছে, বাবা-মায়ের কাছে অনাদৃত থাকার বেদনা।

হাসান, রাসেল, মিলি, কুট্টি—এই চারজনের ভেতরেই সুখী মানুষের খোঁজ শুরু করেন রিয়াজ। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় প্রত্যেকের ভেতরেই রয়েছে সজীব দুঃখের নদী, কিন্তু বাস্তবে তারা সুখী থাকার অভিনয়টা করে যাচ্ছেন শুধু। মানুষ মাত্রই কি তা নয়? কি নিদারুণ বৈপরীত্য, কি অপূর্ব স্ববিরোধ! রিয়াজ বোধহয় আমাদের বুঝিয়ে দেন, পৃথিবীতে সুখী মানুষ বলে কিছু নেই। কারণ এই ছবিতে আমরা নির্মাতা তারেক শাহরিয়ারের মৃত্যুও দেখি। মৃত্যু আছে বলেই মানুষ তাকে ভুলে থাকার ছক সাজায় এবং সেখানে সুখী থাকার কোশেস চালিয়ে যায় আমৃত্যু। এ ছবি শেষতক এক দার্শিনক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাদের: প্রকৃত সুখী বলতে কেউ কি আছে?


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


একই প্রশ্ন জারি থাকে রিয়াজের আরেক ছবি ‘জীবন জলেবেলে’ (২০০২)। এই ছবিতে আমরা দেখি মানুষের জীবন জলে ভাসা পদ্মের মতো। ছয় মাস পানির নীচে, আর ছয় মাস বালির উপর। চরের উপর এই ভাসা ও ডোবা মানুষগুলো তারপরও খুশী। তারা পানিবন্দী জীবন ছেড়ে যেতে চায় না, উত্তপ্ত বালুর উষ্ণতাও তারা ত্যাগ করতে চায় না। প্রকৃতির খেয়ালের ভেতরেই তারা গলা সাধে, ঘরকন্যা করে, সংসার পাতে। এই ছবিতে প্রকৃতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব আছে, আবার একসাথে বসবাস করার ঐক্যও আছে। জলে ডুবে যাওয়া জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে, আবার নিশ্চিন্তে চরের উপর ঘর তুলে বসবাস করার তৃপ্তিও আছে, যেহেতু তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কথায় বলে, যার মাথার উপর ছাদ নেই, তার কাছে আকাশটাই ছাদ। যার ভিটেমাটি নেই, নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, তার এই চরের বালিই সম্বল।

মানুষকে কতকিছুকেই না সহায়-সম্বল করে বাঁচতে চায়। মানুষ শুধু রুটিতে বাঁচে না, তার ধর্মও চাই। শাহীন দিল-রিয়াজের আরো একটি গাঢ় সমাচার প্রচার করা ছবি ‘কোরান সন্তান’ (২০০৯), যেখানে আমরা দেখি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দিনে বারো ঘন্টা করে শুধু কোরান মুখস্থ করে, কোরানে হাফেজ হবে বলে। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েরা আসে ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত হতে, যদিও তারা জানে, এই শিক্ষা তাদের ভবিষ্যতে মূলধারার কোন পেশায় জায়গা করে দেবে না। তবে তাতে অভিভাবকদের কিছু যায় আসে না। রিয়াজের ছবির ভেতর দিয়ে দুটি সত্য উদ্ভাসিত হয়, মূলত দুটি কারণেই ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠানো হয়: হয় পরিবার দরিদ্র, নয়তো পরিবারের পক্ষ থেকে একজনকে উৎসর্গ করা হয় সৃষ্টিকর্তার নামে, যাতে পরকালের জন্য সওয়াব কামানো যায়। তবে বাবা-মা বা পরিবারের এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কি এই বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে না?

বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছে স্বাধীনতা লাভের দুই দশকের মধ্যেই, এদেশের সমাজ দিনকে দিন ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, এরইমধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে যেভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গড়ে তোলা হচ্ছে, তাতে গোটা দেশে আর অসাম্প্রদায়িক চর্চা, সংস্কৃতি থাকবে কি না তা নিয়েইসংশয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য আর সংশয় প্রকাশ না করলেও চলে, সকলেরই বর্তমান বাস্তবতা জানা রয়েছে। কঠিন সত্যহলো, আমাদের দেশে একদল অভিভাবক তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করাচ্ছে, আরেকদল আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষায় মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেখাচ্ছে।মধ্যবর্ত্তী একটি দল আছে, যদিও সংখ্যায় কম, তারাই কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি সৎ থেকে লেখাপড়া শিখছে, ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকা বলতে বোঝাচ্ছি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকার কথা। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে ওঠার কথা ছিলো অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক, এই দেশের শিক্ষার মাধ্যম হওয়ার কথা ছিলো মাতৃভাষা। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমাদের বিচ্যুতি ঘটেছে। আমরা বিপরীত পথের যাত্রী হয়েছি। কিন্তু কি আশ্চর্য এই দ্বান্দ্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই আমরাসামনেএগিয়ে চলেছি। রিয়াজ সেই বৈপরীত্যের কথাই বলেন এই ছবিতে।

ভুলে গেলে চলবে না, আরো একদল ছেলেমেয়ে আছে আমাদের দেশে, যারা শিক্ষার আলো থেকেই বঞ্চিত, ইংরেজি-বাংলা-আরবি কোনো ভাষাতেই তারা শিক্ষা অর্জন করতে পারছে না। দরিদ্র পরিবারের হাল ধরতে তাদের ঝরে যেতে হয় স্কুল থেকে, শৈশব থেকেই জড়িয়ে যেতে হয় আয় রোজগারের সাথে। এবার চলুন দেখা যাক রাকিবের জীবন। দশ বছরের এই শিশুটির রঙীন-সাদাকালো জীবনের দ্বন্দ্ব নিয়ে রিয়াজ তৈরি করেন ‘রাকিব খান: দ্য প্রোজেকশনিস্ট’ (২০১২)। রাকিব মফঃস্বল শহরের একটি ছোট্ট প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রক্ষেপনে সহকারী হিসেবে কাজ করে। তার শরীরের চাইতে তিনগুণ বড় যন্ত্র নিয়ে কাজ করতে করতে তার সখ্য গড়ে ওঠে চলচ্চিত্রের রঙীন দুনিয়ার সাথে। হাতের ফোনেও সে সিনেমার গান ভরে নিয়েছে। চলচ্চিত্রের জীবন কত রঙীন! কিন্তু রাকিবের জীবনটা কেমন? বাবা তাদের সংসারে থাকেন না। মা একাই সংসার চালান। কিশোর বড় ভাই আছে, তবে অকর্মা, শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। মা আর তার আয়েই সংসার চলে। আর দশটা সাধারণ শিশুর মতো পরিবার সে পায়নি, এমনকি এ বয়সে যা করার কথা সেটাও তার হয়ে ওঠেনি। সাদাকালো নয়, তার বাস্তবের জীবন বলতে পারেন অন্ধকারেই রয়ে গেছে। যতই রাকিব অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় আলো ফেলে দর্শককে রঙ্গীন দুনিয়া দেখাক না কেন, নিজের মা ছাড়া তার আর কেউ নেই, যে তার জীবনে রঙ ছড়িয়ে দিতে পারে।

এমন আরো অনেক প্রামাণ্যচিত্র শাহীন দিল-রিয়াজের রয়েছে। কিন্তু সঙ্গতকারণেই সকল ছবি নিয়ে আমরা আর এখানে আলাপ করবো না। যা বলে শুরু করেছিলাম, তা দিয়েই শেষ করি, তা হলো আমাদেরই পরিচিত দুনিয়ার অপরিচিত রূপ তুলে ধরে শাহীন দিল-রিয়াজ, আর এটাই প্রামাণ্যচিত্রের সত্যিকারের রূপ। এটাই শিল্পের দায়: অদেখাকে দেখিয়ে দেয়া, অপরিচিত পরিবেশকে পরিচিত প্রতিবেশে পরিবেশন করা। শাহীন দিল রিয়াজ যেন ঠাকুরমার ঝুলির সংগ্রাহক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, যিনি শহর-গ্রাম ঘুরে ঘুরে কাহিনী সংগ্রহ করেন, তারপর সেটির ভেতর দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করেন, বৈপরীত্য খুঁজে পান এবং সেগুলো সাজিয়ে তাঁর মতো করে আমাদের গল্পটা শোনান। দেখান আমাদেরই সহবাসিন্দা, সহনাগরিক ও সহযোদ্ধাদের জীবন ও জীবিকা: অচেনা, অপরিচিত, বিস্ময় জাগানো। শাহীন দিল-রিয়াজ নিজের সৃষ্টির মতোই আমাদের বিস্মিত করেন।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত