| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: অপরাজিতা । মৌসুমী রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com-সুখী, অ সুখী,আয় সোনা। সবাইকে নোকপালিশ পরালাম। তুই বাদ যাবি কেন? দাদার বে বলে কতা!

-এই যাই ঠানদি। ছুটে ছুটে এসে একটি ঝলমলে সদ্য যুবতী দুহাত পেতে দিলো ঠানদির কোলে।

-ওমা! সুখী, তোর নখগুলি তো কুলোর মত রে! বড়বৌ, অ বড়বৌ! শোন দেখি একবার। ঠানদির ডাকে বাড়ির বড়গিন্নী হন্তদন্ত হয়ে আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে ছুটে এলেন,

-বলুন মামণি।

-সুখীর ঠিকুজি কোষ্ঠী করাস নি বড় বৌ? কাশীবাসিনী মামণির মুখের কথাই বেদবাক্য। বড়বৌকে একটু দিশেহারা দেখাল।

-কেন মামণি! আপনিই তো সেবার গুরুদেবকে দিয়ে…

-হুমম। দেখি গুরুদেবের সঙ্গে আবার কথা বলতে হবে। এমনিতেই এই মেয়ের গড়ন-পেটন বাড়ি ছাড়া। কটা কটা চুল তায় আবার লক্ষ্মীট্যারা! গলার আওয়াজ খানিও বাজখাঁই! ব্যাটাছেলেদের মত! ওর বিবাহযোগটা দেখতে হবে ঠিক করে। যার বিয়ে নিয়ে মা ঠাকুমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, সে ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দিদি বৌদিদিদের শাড়ির জলসায়।

-ইঃ মিষ্টুদি, ঐ নীল শাড়িটা তুই নিস না বাপু। ওটা আমাকে দে!

-সেই! ঐ গায়ের রঙে এই নীল শাড়িটা পড়লে তোকে আর দেখতে হবে না। মন্দাবৌদির বাড়ির লোকেরা “ভাগো, ভূত আয়া!” বলে পালিয়ে বাঁচবে। মিষ্টুদির হাতে একটা মোক্ষম রামচিমটি দিয়ে সুখী হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে ওঠে

-ইল্লি আর কি! পালালেই হলো! আমার বৌমণিকে তাহলে রবিন দাদাভাই জাষ্ট তুলে নিয়ে আসবে। বুঝলি! সিংঘি বাড়ির প্রেষ্টিজ বলে কথা! হি হি হি!

-উফ্! তুই মেয়ে, নাকি একটা রাক্ষসী রে! এত জোরে কেউ চিমটি কাটে? রেগে ওঠে মিষ্টু।

-আহা রে, ব্যথা লেগেছে বুঝি! তুমি আমাকে ভূতনী বলবে আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব ,অত সোজা নয়।অমৃতা সিংহ কাউকে রেয়াত করে না। আমার পেছনে লাগলে… গেট মাই পয়েন্ট ,ডার্লিং?বড়গিন্নী গোলমাল শুনে এগিয়ে এলেন,

-কি হল রে তোদের? বাচ্চাদের মত ঝগড়া কিসের? দাদার বিয়ের তত্বগুলো কে সাজাবে শুনি? জলদি সবাই হাত লাগা। রাত পোহালে বিয়ে! সিংঘি বাড়ির বড়ছেলের বিয়ে বলে কথা!

-না না বড়মামী ,আমি তো সুখীর সাথে ঠাট্টা করছি গো। মিষ্টু সামলে নিলো।

-হ্যাঁ, মা ,আমরা মজা করছি জাষ্ট। এখুনি তোমার তত্বগোছানো হয়ে যাবে। টেনশন লেনেকা নেহী ,বস! মাকে জড়িয়ে ধরে একটা চকাম চুমু সুখীর!

মন্দা আগে থেকেই সুখীর চেনা। সিংহ বাড়িতে নিজেদের পরিচিত গন্ডীর মধ্যেই বিয়েথার রীতি। পাল্টি ঘর, জাত গোত্র, ঠিকুজী কুলুজী, রাজযোটক, সামাজিক প্রতিপত্তি সব মিলিয়ে সম্বন্ধ হয়। এ ব্যাপারে ঠানদির মতামতই শেষ কথা। ঠানদি দীর্ঘদিন কাশীবাসিনী। শাস্ত্রীয় রীতি নীতি তাঁর নখদর্পণে। সুখীর বাবার বিজনেস পার্টনারের মেয়ে, মন্দাকে দেখে, তাঁর কোষ্ঠী মিলিয়ে ঠানদি গ্রীণ সিগন্যাল দেবার পরেই দাদাভায়ের কোর্টশীপ পর্ব! আর আজ এই বিয়ের আসর। সিংহাসনে বসে বৌমণিকে একদম অচেনা লাগছে। কি সুন্দর করে সাজিয়েছে! যেন অষ্টমীর দুগ্গা ঠাকুরটি! চারদিকে আলোর ঝলকানি।সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। একেবারে জমজমাট বিয়ের আসর। বৌমণি আদর করে সুখীকে কোলের কাছটিতে বসিয়েছে। কনেকে নিয়ে সেল্ফী তোলার হিড়িক। হ্যান্ডিক্যাম হাতে এক হ্যান্ডসাম হাঙ্ক অনেকক্ষণ ধরেই নিবিষ্ট চিত্তে ডিউটি করছিল। কোন এক সুন্দরী বাহুবলীর ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে ঝপ করে সুখীর কোলে। সুখী হাউমাউ করবে কি, তাকে দেখে একেবারে ফার্ষ্ট বলেই বোল্ড আউট! বোধহয় সেও! দুজন দুজনকে নির্নিমেষ দেখেই চলেছে।গতিক সুবিধের নয় দেখে মন্দা বলে উঠলো

-ইনি হলেন অমৃতা। ডাকনাম সুখী। আমার একমাত্র রায়বাঘিনী ননদিনী ,বুঝলে দাভাই? সম্বিত ফিরতে ,দুজন কাঁচুমাচু উঠে দাঁড়িয়ে যে যার মত উল্টো দিকে চলে গেলেও মাঝেমাঝেই চোখাচোখি হতেই থাকল!

দাদাভায়ের বিয়েতে গিয়ে রীতিমত মন খুইয়ে ঘরে ফিরল সুখী।সুখী আর সুখীটি নেই।সে এখন ভয়ানক দুখী।এখনো তাঁর ‘স্বপ্নো কি রাজকুমারের’ আতাপাতা কিছুই পায় নি! ছেলেটি কে, কি করে?কিছুই জানে না সে। বৌমণিকেও ফাঁকা পাচ্ছে না যে জিজ্ঞেস করবে, কে ঐ হিরো! দিনরাত এক করে সুখী তাঁর চিন্তাতেই মগ্ন।রিসেপশনের দিন প্রতিটি মুহূর্ত কাটল অপেক্ষায়।নাহ, তাঁর দেখা নেই। অবশেষে দ্বিরাগমনে তাঁর আগমন।একেবারে বৌমণিকে নিতে সটান হাজির! বৌমণির দাদার বেষ্টফ্রেন্ড যে তিনি! আড়াইদিন ধরে প্রাণভরে দেখাশোনা, আলাপ প্রলাপ সবই চলল। সুখী যেন ভেসে চলেছে সুখের সাগরে! প্রেম যে এত মধুর, সুখী ভাবতেও পারেনি। সর্বস্ব নিয়ে ডুবলো সে। সারারাত টুং টাং মেসেজের চলাচল। সারাদিন ইতিউতি ফোন।

-অমৃতা।

-উউ।

-আর পারছি না তোমাকে ছেড়ে থাকতে…

-আমিও।

-জানাও বাড়িতে… সুখী জানে, বাড়িতে জানালেই ঠানদির হাজার নিয়ম নীতির গেঁড়ো কাটিয়ে ,নানান পরীক্ষা দিয়ে বিদ্যুৎকে জয়ী হতে হবে। সেই সব শর্ত পূরণ করতে না পারলে এ জীবনে তাদের বিয়ে সম্ভব নয়।

-অমৃতা,উত্তর দিলে না যে!

-বিয়েটা চুপিচুপি সেরে ফেললে হয় না? সুখীর ব্যাকুল প্রশ্ন।

-তাই হয় নাকি! তুমি মল্লিক বাড়ির বড়বৌ হবে। এভাবে লুকিয়ে বিয়ে হয় নাকি? আমাদের একটা প্রেস্টিজ নেই! সুখী চুপ করে আছে। মনে হয় কাঁদছে। বিদ্যুৎ ব্যাকুল হয়ে পড়লো।

-কাঁদছ কেন অমৃতা? প্লীজ বলো আমাকে… প্রেমের গতি বড়ই বিচিত্র। বাণভাসি প্লাবনের মুখে কি বালির বাঁধ টেঁকে?

-সুখী,সুখী! বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো মন্দার। বিছানা,টয়লেট,ব্যালকনি ,কোথাও সুখী নেই! তাঁর আশংকাই কি সত্যি হল তবে! হাত কামড়ায় মন্দা। কেন সে সংকোচ কাটিয়ে সাবধান করলো না সুখীকে। ও কি জানে , বিদ্যুৎ মল্লিক তাদের একনম্বর বিজনেস রাইভ্যাল বলরাম মল্লিকের ছেলে! তাদের বাড়িতেও বিদ্যুৎদার যাওয়া আসা নিয়ে বড়দের আপত্তি। নেহাত দাদার প্রাণের বন্ধু তাই ,রাগ হলেও বাবামা মেনে নিয়েছে। কিন্তু সিংহদের সাথে মল্লিকদের টক্করটা একটু বেশীই!সুখীর রবিনদাদা টের পেলে যে কি অনর্থ হবে! মন্দা ভাবতে পারছে না, কি দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে! সে ছুটে শাশুড়ির ঘরে গেলো। বাড়ির মধ্যে এই একটি মানুষ, একটু ঠান্ডা মাথার।বাকি তো সবাই উগ্রচন্ডী! সব শুনে তিনি হতচকিত হয়ে গেলেন। সুখী তাঁর বড় আদরের মেয়ে। কিন্তু সিংঘিবাড়িতে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীকে মর্মান্তিক সাজা দেওয়া হয়! আর মল্লিক বাড়ির সাথে এদের যে কত জন্মের রেষারেষি! বেলা গড়াতেই সব জানাজানি হলো। থমথমে বাড়ির পরিবেশ। ঠানদির ঘরে বাড়ির সব ছেলেরা। দরজা বন্ধ করে গোপন কিছু শলা-পরামর্শ হলো। রাতে মন্দা রবিকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করতেই ধমকে উঠলো রবি। নতুন বৌয়ের আদর-সোহাগের দিন শেষ। মন্দা বুঝলো,রবিন সিংহের মধ্যে সিংহবাড়ির পুরুষ সিংহ জেগে উঠেছে। এই রবিন তাঁর ভীতু প্রেমিকটি নয়। ওদিকে, পালিয়ে বিয়ের জড়তা কাটিয়ে শ্বশুরবাড়িতে দিব্বি মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে সুখী। মাঝেমাঝে মায়ের কথা, বাড়ির সকলের কথা মনে পড়লে শাশুড়ির কোলে মাথা রেখে একচোট কেঁদে নেয় সে। শাশুড়ি খুব আগলে রাখেন। তবে বাড়ির অন্যান্যরা খুব একটা পছন্দ করেনি সুখীকে। শত্রুপক্ষের মেয়ে, পুরুষালী ছিরিছাঁদ! এই কাঁটাটুকু না খচখচ করলে, সুখী এখন সত্যিই সুখী। সে মা হতে চলেছে। শাম্ব, ফুটফুটে এক ছেলে এলো সুখীর কোলে। সুখী আজ পূর্ণ, তৃপ্ত।বিদ্যুতের মত কেয়ারিং স্বামী। যেন সে মেঘ না চাইতেই জল এনে হাজির করে সুখীর জন্য। বিদ্যুৎ ভীষণ ব্যালান্সড মানুষ।সারা সপ্তাহ চুটিয়ে কাজ। কিন্তু উইক এন্ড পরিবারের জন্য। প্রতি সপ্তাহেই তারা তিনজনে মিলে বেরিয়ে পড়ে লং ড্রাইভে। কাছে পিঠে ,দূরে ,বহুদূরে… সেদিনও ছিল তেমনই এক আনন্দের দিন, শনিবার। বিদ্যুতের নীল রং এর অডি গাড়িটা মাখনের মত  চলেছে মন্দারমণির পথে। সুখী আনন্দে হেঁড়ে গলাতেই গাইছে,

-এমনি করেই যায় চলে দিন যাক না… শাম্ব কচি গলায় মায়ের সাথে দোঁহার তুলছে,

-দাকনা, দাকনা। মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে নিজের খেয়ালে হাততালি দিচ্ছে। বিদ্যুৎ মা ছেলের  ফূর্তি দেখে মিটি মিটি হাসছে আর আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে। সাবধানী পুরুষ সে। নতুন গাঁয়ের বাঁকে সামনেই একটা কালো কাঁচে ঢাকা গাড়ি ঠিক আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে গেল। নিতান্ত বাধ্য হয়েই ব্রেক চাপলো বিদ্যুৎ। হর্ণ দিলেও গাড়িটি সাইড দিচ্ছে না,সরছেও না। বিরক্ত হয়ে বিদ্যুৎ নামতেই কয়েকটি মুখঢাকা মুসকো লোক ঘিরে ধরলো তাকে। বিদ্যুৎকে এলোপাথারি চড় ঘুষি লাথি মারছে ,ওদের হাতে চকচকে ড্যাগার! সুখী ভয়ে চিৎকার করে গাড়ির দরজা খুলতেই  বিদ্যুৎ চিৎকার করে উঠলো,

-তুমি নামবে না অমৃতা। ছেলেকে নিয়ে ব্যাক করে যাও।

-না। অমৃতা নেমে এলো। শাম্ব কাঁদছে,

-পাপা, পাপা,তোমলা পাপাকে ছেলে দাও। আল মাববে না। সুখী ছুটে বেরিয়ে আসতেই ওরা গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শাম্বকে বার করে নিলো। শাম্ব প্রচন্ড কাঁদছে,-

-পাপা, মাম্মি,পাপা… কোপ খেতে খেতে বিদ্যুৎ তখন প্রায় নিথর। সুখী বিদ্যুতের পড়ে যাওয়া শরীরটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

-আমাকে না মেরে ওকে তোমরা মারতে পারবে না। হঠাৎ প্রচন্ড জ্বালা মুখে চোখে সুখীর!চেতনা হারাবার আগে শুনতে পেল,খুব চেনা একটা গলা,

-শুয়ারের বাচ্চা! এটা তোরা কি করলি…?

গরানখালির “অপরাজিতা”য় খুব ধুমধাম। সকাল থেকেই ছিমছাম বাড়িটিকে কাগজের চাঁদমালা, ফুলের তোড়া দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। অপরাজিতার সদস্যরা সবাই নিজের ইউনিফর্ম পড়ে মাথায় জুঁই ফুলের মালা জড়িয়ে একেবারে রেডি। ডাঃ মুখার্জী অনেকদিন পরে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছুর তদারকি করছেন।আজ একটা বিশেষ দিন। মাননীয় জেলাশাসক আজ অপরাজিতায় আসবেন। অপরাজিতার প্রাণপ্রতিমা অমৃতা সিংহকে তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত করবেন। নিজের ঘরে বসে অমৃতা তাঁর ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবছিলেন। সেই দুঃস্বপ্নের দিনের পরে কেটে গেছে প্রায় কুড়ি বছর। তারপর জীবন জুড়ে কত ভাঙচুর, কত উথালপাতাল!

ঐ ঘটনার পরে যখন সুখীর জ্ঞান ফিরলো, তার মাঝে যে কতদিন কেটে গেছে ,টের পায় নি সে। শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রণা নিয়ে চোখ মেলে দেখল,সে হসপিটালে। ডাক্তার,নার্স ,আয়া সবাই বহু যত্নে ধীরে ধীরে তাকে সুস্থ করে তুলেছে। একটু একটু করে উঠে বসবার ক্ষমতা ফিরে পেল সে। হাত পা মুখে কোথাও আর পুরোনো সুখীর চিহ্নটুকুও নেই! সে যেন এক নতুন মানুষ! কুঁচকানো, গলে যাওয়া দলাপাকানো এক অ্যাসিড সারভাইভার!সারাদিন বসে বসে কাঁদত সুখী!

বিদ্যুৎ, শাম্ব! প্রতি মুহূর্তে ওদের কথা মনে পড়তো! বাঁচবার ইচ্ছেটুকুও সে হারিয়ে ফেলেছিল সে। তারপরেও মেয়েদের হোমে কেটেছে আরো কিছুটা সময়। ততদিনে খানিকটা হলেও নিজেকে সামলেছে সুখী।

-অমৃতা! সুখী মুখ তুলে চাইল। ডঃ পুরুষোত্তম মুখার্জী, তিনিই সুখীকে হাইওয়ে থেকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে, চিকিৎসা করে জীবনদান করেছেন।

-বলুন।

-কিছু ভাবলে, এবার কি করবে?

-লড়াই!

-কার সাথে অমৃতা?

-সেদিন জ্ঞান হারাবার আগে আমি রবিন দাদার গলা শুনেছিলাম।

-আমি পুলিশ এনকোয়ারীতে তোমার ব্যক্তি পরিচয় পেয়েছি অমৃতা। কিন্তু রবিন সিংহের মত প্রভাবশালী মানুষের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে যে রসদ দরকার, তা কি তোমার আছে? অবশ্য তুমি তোমার শ্বশুরবাড়ির হেল্প নিতেই পারো। বাট দে হ্যাভ ডিনায়েড ইউ টু বি দেয়ার রিলেশন! হয়তো নাতি আর ছেলের অকালমৃত্যুর জন্য তোমাকেই দায়ী করে তারা। সো আই গেস, এই লড়াইটা তোমাকে একলাই লড়তে হবে। ধক্ করে জ্বলে উঠলো সুখীর ক্লান্ত চোখদুটো। টান ধরা, কোঁচকানো মুখের শিরায় শিরায় প্রতিজ্ঞা।

-আমাকে আমার স্বামী আর সন্তানের হত্যাকারীকে সাজা দিতেই হবে। সে আমার নিজের দাদা হলেও। আমি কাউকে ছাড়ব না।

-কি করবে তুমি? তোমার দাদার মত সুপারি কিলার লাগাবে?

-আমি আইনের দরজায় কড়া নাড়বো। আইনের চোখে সকলেই সমান। আমার স্থির বিশ্বাস, আমি জিতবোই!ডাঃ মুখার্জী মুগ্ধ হলেন সব হারানো মেয়েটির আত্মপ্রত্যয়ে।

-বেশ, আমি তোমার পাশে আছি।

আইনের পথেই গিয়েছিল সুখী। অসম এক লড়াই। দিন রাত, রাতদিন এক করে সে এক মহাযুদ্ধ! একটা একটা করে সমস্ত প্রমাণ যখন বিপক্ষে যাচ্ছে, সিংহবাড়ি কেঁপে উঠলো। অন্দরমহলে হাহাকার! ততদিন মেয়ের শোকে অকালেই এক এক করে চলে গেছেন সুখীর বাবা ,মা। ঠানদি তো সেই কবেই শিবলোকে!মন্দা বৌমণি নিজেই সুলুক সন্ধান করে ছুটলো সুখীর কাছে,তাঁর প্রিয় রবিন দাদার প্রাণভিক্ষায়! বহুদিন পরে সুখীকে দেখে, তাঁর ভয়ানক পরিণতি দেখে কেঁদে ভাসাল মন্দা। আদরের সুখীকে বুকে জড়িয়ে সে চাইতে পারেনি স্বামীর প্রাণভিক্ষা।  বরং দৃপ্তকন্ঠে বলে এলো, “তুই জয়ী হবি সুখী।’’

মাথা নীচু করে ফিরে এলো মন্দা। বাড়ি ফিরে, কুলদেবতা বিরূপাক্ষের পায়ে পড়ে চোখের জলে ভাসল সে। এ কি ভয়ানক ধর্মসংকট! একদিকে স্বামী, অন্যদিকে সত্য! কে জিতবে?

বিদ্যুৎ মল্লিক আর তাঁর শিশুপুত্রের নারকীয় হত্যা তদন্তে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ! হাই প্রোফাইল এই আইনী লড়াই এ শেষ পর্যন্ত্য সত্যের জয় হয়। নামী দামী সমস্ত কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল অমৃতার লড়াইয়ের কাহিনী। ধীরে ধীরে অমৃতা সিংহ নামটি হয়ে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেয়েদের লড়াই এর এক নাম। হোমে থাকাকালীন সে দেখেছে, মেয়েদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার জীবন, তাদের দুঃখ, শোক, বঞ্চনা। সকলের কষ্ট দিনরাত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সুখীকে। অদম্য সাহসে সে দৌড়ে বেরিয়েছে দুয়ার থেকে দুয়ারে। তিলতিল করে সঞ্চয় করে গড়ে তুলেছে তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান “অপরাজিতা”। সব হারানো মেয়েদের নিয়েই অপরাজিতার সংসার। সমাজের সংসারের চোখে দাগিয়ে দেওয়া মেয়েরা আশ্রয় পেয়েছে অমৃতার কাছে। তাদের সকলের কাছে সে এখন অমৃতা মা।

তাঁর এক সন্তান চলে গিয়ে যেন অনেক সন্তান ফিরে এসেছে। মেয়েদের হাতে তৈরী বড়ি, পাঁপড়, আচার,দীপাবলীর প্রদীপ, কাঁথাস্টীচের শাড়ি, ধূপকাঠি, সাবান, ফিনাইল সব কিছুই বিক্রী করা হয় অপরাজিতার বিভিন্ন ইউনিটে। অ্যাসিডে পোড়া, বিকলাঙ্গ,ধর্ষিতা,বাতিল হয়ে যাওয়া যৌনকর্মী , জেলফেরত আসামী, সমাজের অপাঙ্ক্তেয় এইসব মেয়েরাও যে এমন ম্যাজিক জানে, বোঝা যায় অপরাজিতায় এলে। এদের নিয়েই অমৃতা আজ তৃপ্ত, পূর্ণ। তবু কি কোথাও পরাজয় নেই? আছে! জীবনের ঝড়ঝাপটায় প্রতি পদক্ষেপে পাশে পেয়েছেন ডাঃ মুখার্জীকে। ওঁর প্রতি নির্ভরশীলতা যে কবে ভালবাসা হয়ে গেছে টের পাননি অমৃতা। বুঝতে পেরে নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেছেন অমৃতা! বিদ্যুৎ চলে যাবার পরে আর কাউকে যে তিনি আবার চাইতে পারেন, এ তাঁর কল্পনার অতীত।নিজের মনেই লজ্জা পেয়েছেন, শিউরে উঠেছেন। তবু সত্যিকে অস্বীকার করেননি অমৃতা। কম্পিত স্বরে জানালেন ডাঃ মুখার্জীকে। ডাঃ মুখার্জী সব শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ কেটে গেল নিবিড় নিস্তব্ধতায়। শেষে মুখ তুলে চাইলেন ডাঃ মুখার্জী। শান্ত, মন্দ্র গলায় বললেন,

-আমি যে বিবাহিত। মৈথিলি আমার স্ত্রী! আমি তাকে ভালবাসি। আমি তোমার বন্ধু অমৃতা। আমৃত্যু বন্ধুই থাকতে চাই। একটা জীবনে কতবার , আর কতবার মরে মানুষ? অমৃতা ভিজছেন। প্রবল ভিজছেন। গহন কুঠুরির সেই রক্তক্ষরণ আজো তাকে বিদ্ধ করে,রিক্ত করে!

মনে মনে আরো একা হয়ে গেলেন অমৃতা সেদিন! প্রত্যাখ্যান! সেই তো! মৈথিলি যে বড় ভালো মনের মানুষ! নিজেকে খুব দুর্বল মনে হয় অমৃতার! ঠিক করলেন, নিজেকে গুছিয়ে সব্যস্ত করতে হবে। কাজ, কাজ, আরো কাজ। কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে। এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটলেন মেয়েদের তৈরী জিনিস নিয়ে। এক দরবার থেকে অন্য দরবারে ফান্ডরেইজিং এর জন্য। অমৃতা সিংহ হারতে শেখেনি। তাঁর অপরাজিতাকে এখন এক ডাকে সারা দেশের মানুষ চেনে। অনেক নতুন নতুন মেয়ে আসছে রোজই। এদেশের মেয়েদের দুর্দশা কখনো ফুরায় না। পুরোনো মেয়েরা হাল ধরেছে অপরাজিতার। আস্তে আস্তে অমৃতা ওদের হাতে কিছু কিছু দায়িত্ব তুলে দিচ্ছেন। ওরাও শিখুক। রমা, ব্রততী, দীপশিখা,সালমা, জোয়ারা এখন অপরাজিতার এক একটি স্তম্ভ। অমৃতার বুক গর্বে ভরে ওঠে তাঁর মেয়েদের নিয়ে। ওদের উৎসাহ দেখে নিজেও নতুন করে বাঁচতে শেখেন।

ডাঃ মুখার্জী পেশাগত ব্যস্ততায় এখন আর আগের মত আসতে পারেন না। শহরের অন্যতম সফল ডাক্তার তিনি। আজ মেয়েরা বিশেষ ভাবে নিমন্ত্রণ করে তাকে এনেছে। এসেই সমস্ত কাজকর্ম তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কাজের মানুষ তিনি…

-মা, মা, শিগ্গির নীচে এসো! রুকসানা, মুম্বই এর মধুশালা থেকে উদ্ধার করা ছোট্ট মেয়েটি, অমৃতার পায়ে পায়ে ঘোরে সবসময়।

-কেন রে?

-বৃন্দাদিদি বললো, ডিএম আসছেন। তুমি শিগ্গির চলো। অমৃতার হাত ধরে তাকে নিয়ে চললো রুকসানা। সব অনুষ্ঠান মিটতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। অতিথিরা সকলে চলে গেছেন। ডাক্তার মুখার্জীও। সারাদিনের ক্লান্তির শেষে ফ্রেশ হয়ে অমৃতা সাগরপারে হাঁটতে বেরিয়েছেন। এই সময়টায় তিনি রোজ হাঁটেন। একলা। নিজের সঙ্গে জমানো কথা , বোঝাপড়া চলতে থাকে। মুখে তাঁর অদ্ভূত প্রশান্তি। কত কাজ তিনি করেছেন। আরো কত কাজ বাকী! একজীবনে কি সব শেষ হবে? তারাভরা আকাশের দিকে অনিমেষ চেয়ে অমৃতা।

বিদ্যুৎ, শাম্ব, ডাঃ মুখার্জী, তাঁর অপরাজিতার মেয়েরা… চলার পথে কত সঙ্গী পেলেন, হারালেন কতজনকে।তবু পথ চলতে হবে। ভেজা বালিতে পায়ের ছাপ ফেলে, দৃপ্তপায়ে অমৃতা এগিয়ে চললেন মহাজীবনের পথে…

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত