| 24 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: গোধূলির পর । পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

                                                                    

আবার একটা বিপন্ন বিকেল। মানে, শ্রুতি বিপন্ন বোধ করা শুরু করল। এমন সুন্দর একটা বিকেল শুধু শ্রুতির জন্যই বিষণ্ণ রূপ ধরতে চাইছিল যেন।

এখন না-গরম না-শীত। স্ট্রীট লাইট জ্বলে ওঠার সময় হয়নি, আবার দুপুরের সূর্যের অতি উজ্জ্বলতাও নেই আর। সুন্দর আলো সুন্দর আকাশ সুন্দর হাওয়া। এখনও রাস্তায় ততো ভিড় নেই। ভাতঘুম শেষ করে নগর সবে আড়মোড়া ভাঙছে। অল্প কয়েকজন মানুষ এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে হাঁটছে। সকালের ব্যস্ততা নেই এখন। আবার সন্ধ্যের সমাগমও শুরু হয়নি। শ্রুতি এইসব দেখছিল আর ভাবছিল। দেখছিল অন্যমনস্ক হবার জন্য। কিন্তু মন ঘুরে ফিরে এক ভাবনায় চলে আসছিল।

অথচ তমাল যখন সিনেমাটা দেখার প্রস্তাব দিয়েছিল তখন সব কিছু কেমন আনন্দঘন হিসেবে কল্পনায় এসেছিল। শ্রুতিই তো আগ বাড়িয়ে তিনটে টিকিট কাটতে বলেছিল।

শ্রুতি সব সময়ে লিপির সঙ্গেই সিনেমা যায়। আর কোন সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই। লিপির অনেক সঙ্গী আছে। তাও ও যে শ্রুতির সঙ্গে যায় এতে শ্রুতি কৃতজ্ঞ। আজ তমালের সঙ্গে একা একা চলে এলে তো বেইমানী হত। সিনেমাটা সত্যি ভালো। সব কটা রিভিউয়েই প্রশংসার বন্যা। লিপিরও এটা দেখার ইচ্ছে ছিল। তাই তিনটে কাটতে বলেছিল। এটা কী এমন ভুল! অথচ মা বলবে এসব শ্রুতির হাঁদামি।

লিপি ওদের বাড়ি পৌঁছনোর পর একসঙ্গে চা খেয়ে বেরিয়েছে। তমাল আগেই এসে গেছিল। বেরনোর পর থেকে লিপি ক্রমাগত তমালের সঙ্গেই বকবক করে যাচ্ছে। নানা প্রশ্ন। তমালও উত্তর দিয়েই যাচ্ছে। একটা ফুটপাথে তো তিনজন পাশাপাশি হাঁটা সম্ভব নয়, তাই যারা কথা বলছে তারা পাশাপাশি আর শ্রুতি পেছনে। কী আশ্চর্য সব ব্যাপার শুধু শ্রুতির সঙ্গেই ঘটে। যখন শ্রুতির কোন বান্ধবী, সেটা লিপিও হতে পারে, তার কোন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কোথাও যাবার সময়ে বাড়িতে টুপি পরানোর জন্য শ্রুতিকে সঙ্গে নেয় তখনও কিন্তু শ্রুতিই আগাছার মত পেছন পেছন হাঁটে। কিন্তু সেখানে শ্রুতির কোন মনোকষ্ট হয় না। কারণ সেটাই স্বাভাবিক। আবার আজও শ্রুতিই পেছনে। মা এসব শুনলে বলবে শ্রুতিরই দোষ। ওরই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা নেই। না হয় নেই। তাবলে স্বাভাবিক বলে কিছু থাকবে না। সব সময়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ করতে হবে?

শ্রুতি একা, শ্রুতি পেছনে, শ্রুতি বিপন্ন। তাই শ্রুতি বিকেল দেখছে। বুঝতে পারছে না বিকেলটা সুন্দর নাকি বিষণ্ণ। মনে হচ্ছে, না এলেই ভালো হত। মনে হচ্ছে ফিরে যাই। এই পেছন পেছন অনুসরণকারীর ভূমিকা একেবারেই ভালো লাগছিল না। ছোটবেলার খেলার দুধুভাতুর মত লাগছিল নিজেকে। তবে শ্রুতির এই ব্যাপারটা আলাদা করে নতুন কিছু মনে হচ্ছিল না। শুধু ক্লান্ত ভাবে ভাবছিল, আবার একটা বিষণ্ণ বিকেল। কিন্তু এটাই যেন স্বতসিদ্ধ, এটাই যেন রুটিন, শ্রুতি এতেই অভ্যস্থ। এমনটাই যেন হবার কথা। না হলেই খুব আশ্চর্য হত। শ্রুতির মা বলে, শ্রুতির কোন লজ্জা নেই, শিক্ষা হয় না, বোধবুদ্ধি নেই, হাবা। আরও কত কী যে বলে। আচ্ছা, শ্রুতির ঠিক কী করা উচিত মারপিট ধাক্কাধাক্কি নাকি বন্ধুত্ব ত্যাগ? কী করলে ঠিকঠাক বলবে সকলে?  

কেন তার জীবনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে? কেন তার অবচেতন তাকে বারবার সংকেত পাঠাতে থাকে যে এমনই ঘটবে? তাহলে কি শ্রুতি এবনরম্যাল?  

সঞ্জয়ের সঙ্গে যখন সম্পর্ক ছিল তখন কী করে যেন অদিতি মাঝখানে ঢুকে পূর্ণ গ্রাস গ্রহণের মত সঞ্জয়কে গ্রাস করে নিয়েছিল। মৃদুলের সঙ্গে সম্পর্কের সময়ে তো ও পুরো বোকা হয়ে গেছিল। মৃদুল দিনের পর দিন ওকে কথা দিয়েও মিট করত না। সেই দুঃখের কথা ও বিশাখাকেই বলত। অথচ মৃদুল তখন বিশাখার সঙ্গেই দেখা করতে যেত সেকথা ও পরে অন্যদের থেকে জেনেছে। মৃদুল আর বিশাখা কেউ ওকে বুঝতে দেয়নি যে ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হয়েছে। দুজনেই ওকে ধোঁয়াশায় রেখে দিয়েছিল। অসাধারণ অভিনয়। তারপর ওদের কয়েকবার একসঙ্গে দেখেছিল। দুজনেই অনর্গল মিথ্যে বলেছে। ওদের মধ্যে সম্পর্ক হয়েছে একথা শ্রুতিকে জানিয়ে দিলে কী হত? শ্রুতির জীবন থেকে ফালতু অতগুলো বছর নষ্ট হয়ে যেত না। জানতে তো পারলই। মিছিমিছি মন নষ্ট। ওই বয়েসে জীবন থেকে অতগুলো বছর নষ্ট করে দেবার অপরাধে ওদের কোনদিন ক্ষমা করবে না।

ওদের সম্পর্কও বেশিদিন টেঁকেনি। একটা সময়ে জানাজানি হল বিশাখার বহু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক, মৃদুলেরও অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। তখন দুজনেই দুজনের দিকে কাদা ছুঁড়ছে। শ্রুতি ভীষণ একমুখি। যখন যার সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে তাকে ছাড়া কাউকে ফিরেও দেখেনি।

শ্রুতি মেয়েগুলিকে দোষ দেয় না। ওই ছেলেগুলি না চাইলে মেয়েগুলির একার ইচ্ছেতে কি এমন হত? ওই মেয়েরা না এলে অন্য কেউ এসে যেত। নিশ্চয়ই শ্রুতির মধ্যেই কিছু একটা অসম্পূর্ণতা রয়েছে যার জন্য সকলে অন্য দিকে বাঁক নেয়। শ্রুতির হাতের অঞ্জলিতেই আঙুলগুলো ভালো করে জোড়া লাগে না। ফাঁক দিয়ে জল গলে যায়। শ্রুতির হাত থেকে যেমন সব সময়ে জিনিস ফস্কে পড়ে যায় তেমনই সম্পর্কও। শ্রুতিরই দোষ। ও কাউকে ধরে রাখতে পারে না। ওর সঙ্গে সম্পর্কে থেকে কেউ পূর্ণ হতে পারে না। তাই চলে যায় অন্যদিকে। ইদানীং তাই আর শ্রুতি কাউকে নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবে না। তমালকে নিয়েও ভাবেনি। বিশেষ ভাবে না ভাবলে কোন যন্ত্রণা নেই। কেবল একটা হাল্কা বিষাদ। নদীর স্রোতের মত, চাঁদের আলোর মত, ফুলের গন্ধের মত।  

শ্রুতির চোখের সামনে বিকেলের রঙ বদলে হাল্কা কমলা আভা নিয়ে গোধূলি বেলা এসে গেল। গোধূলি বেলা নাকি শুভ দৃষ্টির সময়। তাই সেই আলোকে বলে কনে দেখা আলো। এই আলোতে যে যাকে দেখবে সে সেখানেই আটকে যাবে। শ্রুতিকে কি কেউ কোনদিন এরকম আলোতে দেখেনি? অবশ্য ঘরকুনো শ্রুতি প্রয়োজন ছাড়া বেরোতেই চায় না। বাড়ির লোকজন ছাড়া কেই বা ওকে দেখবে?

কলকাতার রাস্তায় গোধূলির রঙ পুরোপুরি আবছায়াতে পৌঁছনোর আগেই জ্বলে ওঠে স্ট্রীট লাইট। ঝলমল করে ওঠে ইলেকট্রনিক বিজ্ঞাপনী প্ল্যাকার্ড। বিজ্ঞাপনের অসাধারণ সব সুন্দরীরা জীবন্ত হয়ে উঠে মোহ বিস্তার করে। রাস্তাতে সুন্দরী মেয়েদের ভিড় বাড়ে। বিপণীগুলোতে ভিড় জমে। নগরের গায়ে মেক আপ, অঙ্গসজ্জা। চট করে চোখে পড়বে না প্লাস্টিক জমা নর্দমা , পিচ উঠে যাওয়া খানাখন্দ, পানের পিক, থুতু, কফ, হিসি।

আলোও কি মেক আপ? আলো কেন মেক আপ? সূর্যের আলো স্বাভাবিক আর মানুষের জ্বালানো আলো মেক আপ? না না। শ্রুতির মন মানতে চায় না। এই দ্বিধাগ্রস্ত মনের অবস্থার মধ্যেই শ্রুতির মন পুরপুরি আবছায়া হয়ে ওঠার আগেই তমাল আলো জ্বালিয়ে দিল। এ আলো কি কৃত্রিম? কে জানে? আলোর কি কৃত্রিম আর আসল হয়? আলো তো আলোই। প্রদীপই হোক আর হারিকেন।

শ্রুতিরা বাড়ি থেকে অনেক সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে যাবে বলে। গল্প হচ্ছিল, হাঁটাও হচ্ছিল। কেবল শ্রুতি একলা পড়ে যাচ্ছিল।হলের কাছাকাছি এসে হঠাতই পেছন ফিরে শ্রুতির হাত ধরে একটা টান দিয়ে শ্রুতি আর লিপি দুজনকেই হতচকিত করে তমাল রাস্তা পার হতে হতে চেঁচিয়ে লিপিকে বলল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। এখুনি ফিরছি।

ভাগ্যিস সিগন্যালে গাড়িগুলো সব তখন দাঁড়িয়ে ছিল।

লিপি পেছন থেকে চিৎকার করে বলল, সিনেমা শুরু হয়ে যাবে যে। কোথায় চললেন।

শ্রুতি পেছনে তাকাল। কিন্তু ওর হাত টেনে তমাল সামনে চলেছে। ফলে ওর পা সামনেই এগোচ্ছে।

লিপিও ওদের দিকে আসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ঠিক তখুনি সিগন্যাল খুলে গাড়িগুলো ছেড়ে দিল। ফলে ওরা দুজন এপারে পৌঁছে সহজেই দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেল। বড় রাস্তার প্যারালাল একটা রাস্তায় এসে একটা কফি শপের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। শ্রুতিকে সিটে বসিয়ে কাউন্টারে গিয়ে কফি এনে মুখোমুখি বসল তমাল।বলল, সিনেমা শুরু হতে অনেক দেরি আছে। টেনশন করতে হবে না।

শ্রুতি বলল, লিপিকে বাদ দিয়ে কফি খাব? এটা কি ভালো হল?

তমাল একটা চুমুক দিয়ে বলল, ঠিক ভুল তুমি কত বুঝতে পার তা আমি বুঝে গেছি। কয়েকটা কথা বলার জন্য এখানে এলাম। কফি খাও।

শ্রুতি কফিতে চুমুক দেয়।

তমাল বলল, শোন, সিনেমা হলে তুমি আমার পাশে বসবে। লিপিকে তোমার অন্য পাশে বসাবে। দুদিকে দুজন মহিলা নিয়ে আমি বসতে পারব না।

শ্রুতি অবাক হল। বলল, ও যদি বসে পড়ে তবে কী করব? উঠিয়ে দেব নাকি?

তমাল বলল, সে আমি পরিস্থিতি বুঝে যা বলার বলব।  তুমি চুপ থাকবে। না না কী হয়েছে ও ওখানে থাকুক না, এসব বলতে যাবে না। বুঝেছ? নিজে কিছুই পেরে ওঠো না যখন তখন চুপ থেকো অন্তত। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।

শ্রুতি বলল, এটুকুর জন্য এত কাণ্ড ?

হ্যাঁ। এটুকুর জন্য অনেক কাণ্ড ঘটে। তুমি এত সহজ সাধারন, তোমার বান্ধবীগুলো এরকম অদ্ভুত কেন? কী গায়ে পড়া রে বাবা। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিল। তুমি পেছন পেছন আসছ। একবারও তাকিয়ে দেখছে না। কোন তাপ উত্তাপ নেই। তমাল রাগত স্বরে অভিযোগ জানাল।

শ্রুতি বলল, ওইটুকু ফুটপাথে তিনজন পাশাপাশি চলা যায় নাকি? তাহলে অন্য লোকেরা যাবে কী করে? তোমরা কথা বলছ। তাই আমিই পিছিয়ে গেছিলাম।

তমাল বলল, ঠিক আছে। আমি যা বোঝার ঠিকই বুঝে নিয়েছি। আমাকেই হাল ধরতে হবে। সেই জন্যই এখানে আনলাম। নাও কফি শেষ করো।

শ্রুতির চোখে জল এসে যাচ্ছিল। এটা পাবলিক প্লেস। উপচে পড়তে চাওয়া জল কোনোক্রমে আটকালো।

তমাল একটা হাত রাখল ওর মাথায়।

শ্রুতি তমালের দিকে এক আশ্চর্য চোখে তাকাল। এমনভাবে ও শুধুমাত্র দুজন পুরুষের দিকে তাকিয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ আর রবীন্দ্রনাথ। তাদের ফটোর দিকে। 

কলকাতা ঝলমল করছে। ঝলমল করছে শ্রুতির মন।

                                                    

                          

2 thoughts on “ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: গোধূলির পর । পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত