| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প : সাদা রক্ত । সাদিয়া সুলতানা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
মায়ার বুক থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে মরেনি-রক্তের উপচানো ধারায় খাবি খাচ্ছে শুধু। হাতের তালু চটচট করছে। রক্ত লেগে আছে, রক্ত! এত রক্ত কোথা থেকে এলো ভাবাভাবির সময় নেই। মায়া রক্তের উৎসমুখে দুধের বাচ্চাটাকে প্রাণপণে ঠেসে ধরছে বারবার। ওর হাতের বাঁধন দৃঢ়। বাচ্চাটা তবু কী করে যেন মায়ার হাত গলে আবার মেঝেতে পড়ে যায়।
বুকের মিঠাপুকুরে হাহাকার ওঠে। মেঝেতে তাকিয়ে আলুথালু মায়া কাঁপতে থাকে। ছোট বাচ্চার পালক নরম ছোট দেহ। মাটিতে গড়িয়ে এখনই যেন মা মা করে কলকলিয়ে উঠবে। কিন্তু একটানা মা ডেকে শ্রান্ত শিশু ঘুমে বিভোর। সে নড়ে না। হাসে না। খেলে না। ডাকে না। তুলতুলে ওড়নার পোঁটলার ভাঁজে বেদিশ হয়ে ঘুমায়।
‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিবো কিসে?’
খোকা ঘুমালে ফেরেশতার সঙ্গে কথা কয়। কে যেন বলে, ‘তোর মাকে নিয়া যাব।’ খোকা মায়ের বুকের অমৃত পান করতে করতে হাসে, ‘ন…না।’ আবার বলে, ‘তোর মা নাই। নিয়া নিছি।’ খোকা মুখ তুলে চায় না, মুটুর মুটুর হেসে বলে, ‘এই যে আমার মা। আমার মুখে মায়ের দুধের ঘ্রাণ।’ খোকা হাসে আর হাসে। তার হাসিতে মণি-মুক্তা ঝরে। 
মায়া মণি-মুক্তা কুড়াবার মতো মোজাইকের শীতল মেঝে থেকে খোকাকে লুফে নেয়। এবার সে হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে। পাঁজরের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে খোকাকে। খোকা আরাম পেয়ে চোখ খোলে না। মায়া স্তনাগ্র উন্মুক্ত করে খোকার নরম নরম ঠোঁট ফাঁক করে। কেউ নজর দেয় ভেবে রঙিন আঁচলে আড়াল করে ঘুমন্ত দেহটাকে। রক্তে মায়ার বুকের আঁচল জবজব করে। সে ভেজা আঁচলে হাত বুলাতে বুলাতে ছেলেভুলানি গান গায়।
‘আয় ঘুম আয় বাগদিপাড়া দিয়ে 
বাগদিদের ছেলে ঘুমায় জাল মুড়ি দিয়ে।’
খোকা পেটে থাকতে একদিনও মাছ খেতে পারেনি মায়া। দূর থেকে কাঁচা মাছের গন্ধ পেলেও বমি আসতো ওর। ক্ষণে ক্ষণে বিবির পেট উগড়ানো দেখে মিজান ঘরে খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিল। আর মাছ ছাড়া জগতের অন্যসব খাবারের প্রতি লোভী হয়ে উঠেছিল মায়া। বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগির কষা মাংস আর আমচুর গলা ডাল দেখলে হুশ থাকতো না ওর। কাজ থেকে ফিরে সন্ধ্যায় মায়া নিজের জন্য মন দিয়ে রাঁধা-বাড়া করতো। শেষের দিকে পেটের ভারে নড়তে চড়তে পারত না তেমন। সেই সময়ে ডিমভাজি-ভর্তা-ভাত দিয়ে সে গলা পর্যন্ত খেয়ে উঠলে পেটের খোকাও শান্ত থাকতো বেশ। 
কোলের খোকা মায়ের বুক পেলে শান্ত একদম। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠোঁট গোল করে সে নিজের খাবার ঠিকই খুঁজে নেয়। শাল দুধ পায়নি খোকা। মাতৃস্তনে প্রথমবার ঠোঁট রাখতে গিয়ে নীল হয়ে উঠেছিল শরীর। নার্স তোয়ালেতে কচি শরীর জড়িয়ে তখনই ছুটেছে।
রাত তখন নিঃসাড়। দিনরাত মিলিয়ে সেদিন হাসপাতালে চারজনের মৃত্যু হয়েছিল। তাই বুঝি অবিনাশী মৃত্যুর ঘ্রাণ ভাসছিল হাওয়ায়। মায়া তৃষিত চোখজোড়া দরজায় নিবদ্ধ করতে করতে গোঙাচ্ছিল। মার খেতে খেতে যে মায়া শতবার মরতে চেয়েছে সে হাসপাতালের হাওয়ায় মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়ে দম আটকে শুয়ে সন্তানের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করেছে।
‘খোকন খোকন করে মায়
খোকন গেল কাদের নায়
সাতটা কাকে দাঁড় বায়
খোকনরে তুই ঘরে আয়।’
স্বচ্ছ বাকশের ভেতরে রাখা খোকনের নাজুক দেহে সেই সময়ে ওম দিচ্ছিল দেবদূতেরা। আর মায়া স্তনের ভারে ছটফট করছিল। সমুদ্দুরের জোয়ারের মতো দুধ নেমেছিল বুকে, গন্তব্য না পেয়ে পাথর করে তুলেছিল স্তনজোড়া। মুহুর্মুহু ঝিলিক উঠছিল নরম মাংসপিণ্ডের অভ্যন্তরে। ব্যথার তোড়ে আছড়েবিছড়ে কাঁদতে চেয়েও পারেনি মায়া। বোন ছায়ার হাত ধরে গুমরে উঠেছে, ‘আমার মানিকরে আইনা দে।’ 
ছায়া ব্যস্ত তখন। সে বুবুর পাথরসদৃশ স্তন থেকে ঘি রঙা দুধ বের করছিল। মেলামাইনের ঘোলা স্যুপ বাটিতে ঘন সরের মতো দুধ দেখে দাঁত চেপে ঠোঁট কেটে ফেলেছিল মায়া। আর ছায়া স্তন চেপে চেপে দুধ ফেলে সদ্য প্রসুতিকে স্বস্তি দেবার চেষ্টা করছিল। ছায়া নিজে মোটেও স্বস্তিতে ছিল না। ‘আবিয়াইত্তা’ অপবাদ পাওয়া ছায়া এত দিনে বুঝে গেছে মাতৃস্তন আর নারী স্তনের ফারাক।
হাসপাতালের নিঝুম করিডোরে আগের রাতে তার স্তনে থাবা পড়েছিল বোন জামাইয়ের। এ থাবা ঝানু শিকারির। এ থাবা ভয়ংকর, পুনঃপুন ঘায়েল করতে চায় শিকারিকে। এসব কথা বুবুকে বলেনি ছায়া। তবু মায়া জানে। জানে বলেই সন্তানহীনা বাঘিনী মায়া স্বামীর দিকে থাবা বাড়ায়।
‘তোর বজ্জাতি আমি ছুটামু এইবার। কোলের মানিকরে পাইয়া লই।’
কোলের মানিককে ঐদিন বিকালেই কোলে পেয়েছিল মায়া। আর মায়াকে শাসিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছিল তার স্বামী মিজান। বিল পরিশোধ করতে মায়ার মা তার হাতের একমাত্র চিকন চুড়িটা বিক্রি করেছিল। আর মায়ার বাবা এর ওর হাতে পায়ে ধরে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়েছিল। হাসপাতালে আসার দিন নিজের সঙ্গে কানাকড়িও আনতে পারেনি মায়া। এখানে পা দেবার আগেই লুট হয়ে গিয়েছিল ওর সকল সঞ্চয়।
চাকরির রক্ত-ঘাম ভেজা টাকা নিঙড়ে নিঙড়ে এসেছিল এই সঞ্চয়। ছুটি পায়নি, অর্থও প্রয়োজন তাই বাচ্চা প্রসবের আগের দিন পর্যন্ত গার্মেন্টসে কাজে গিয়েছে। মেশিনের ঘটঘট ঘটঘট শব্দের তালে পেটের বাচ্চাটাও দুলেছে। দুলতে দুলতে মাঝরাতে মাতৃথলি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। পানি ভেঙেছে এক গাঙ। কী করে ঐদিন হাসপাতালে পৌঁছেছিল মায়া জানে না।
আজও কীভাবে কার সঙ্গে এখানে এসেছে ওর মনে নেই। চৌকিতে গোলাপি পদ্ম হয়ে ফুটে থাকা মানিককে লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দেয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে শুধু। মানিক ঘুমিয়েই ছিল। দেয়ালে ঝুলন্ত একটা পেটমোটা টিকটিকি আলোভূক পোকার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার পাঁয়তারা করছিল। কামে জড়ো জড়ো মিজান অনিচ্ছুক মায়াকে চেপে ধরেছিল বিছানায়। তার শরীরে তখন বেশুমার জ্বর। অতৃপ্তির তাপ অঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে। বিবির না শুনবার সময় নাই। তরঙ্গ ওঠার দরকার নাই। শুকনো জমিনে তীরের ফলায় তাই সে গেঁথে দিয়েছে সোহাগের চিহ্ন। এমনই এক সঙ্গমের উত্তাপে জন্ম নিয়েছিল বলেই হয়তো নিজের ঔরসজাত শিশুকে লোমহীন বুকের মানুষটা সীমারের মতো মেঝেতে আছড়ে ফেলেছিল। মুহূর্তের মধ্যে পাগলা ঘোড়ার মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছিল মায়া।
‘আম পাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া
ওরে বুবু সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া।
পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে, চাবুক ছুঁড়ে মেরেছে।’
চারমাসের ক্রন্দনরত মানিক বাবার নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে পারেনি। মেঝেতে পড়েই থেমে গেছে। মায়াও ছাড়েনি। যতক্ষণ শ্বাস ফুরায়নি ততক্ষণ মিজানের গলা চেপে রেখেছিল। ঐ সময়ে এক ঝলকে চম্পার মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। মিজানের প্রথম বিবি চম্পা বলেছিল, ‘একদিন জুত মতো পাইলে হারামির গলাটা চিপ দিয়া ধরমু।’
সেদিন চম্পা অন্ধকারে পথ আটকেছিল ওর। শুনেছে মেয়েটা বেশ্যার খাতায় নাম লিখিয়েছে। তাই রগড়ই অমন। আঁধার না হলে পথে নামে না, শরীর না ছুঁয়ে কথা বলে না।
‘খুব সুখ দিতাছে বুঝি হারামিটা। বুঝবি বুঝবি, বছরও ঘুরবো না। দেখবি টাউয়া উদাম শালা ফুট্টুস।’
চম্পার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকেছিল মায়া। অনেকক্ষণ ধরে বাসনা ভরা সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছিল। তারপর ঘষে ঘষে সময় নিয়ে গোসল করেছিল। তখনও গার্মেন্টসে ঢোকেনি সে। মিজান একাই কাজ করতো। বাড়ি ফিরলে নতুন বিবির প্রতি সোহাগ উথলে উঠত তার। সেদিনও অপেক্ষার পর নিষ্পেষণের ক্ষণ এসেছিল। কিছুতেই আড় ভাঙছিল না মায়ার দেহের। মিজানই বা ছাড়বে কেন, সে তার কলমা পড়া বিবি, যখন স্বামী ডাকবে তখনই বিছানায় যেতে তৈরি থাকবে। স্বামীর আগ্রাসী থাবায় বিদ্ধ হতে হতে ঐদিনই প্রথম কেঁদেছিল মায়া। বুঝেছিল বাজারের মেয়েমানুষটা সত্যি বলে গেছে।
মায়া ভালো করে মানিককে বুকে চেপে ধরে কপালে দীর্ঘ একটা চুমু খায়। চুমুতে খোকার নজর টিপ লেপ্টে যায়। কাজলের ছোপ পড়ে মায়ার শুষ্ক ঠোঁটে। মুঠোবন্দি ফোনটা কেঁপে ওঠে আচমকা। ওপাশে ছায়ার ফিসফাস শোনা যায়।
‘বুবু পুলিশ শুয়োরটার লাশ নিতে আসছে। তোমারে খুঁজতেছে।’
মায়ার মুখাবয়বে কোনো আলোড়ন ওঠে না, ব্যথার চিহ্ন ফোটে না। অনেকক্ষণ হলো সে হাসপাতালে এসেছে। ফিনাইল আর ডেটলের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ মেখে গেছে শাড়িতে। রক্তের আধারও টুবুটুবু হয়েছে। দেবদূতেরা আজ তাদের কোমল হাত তুলে নিয়েছে। খোকাকে ওম দেওয়া বাকশে ঢুকায়নি। খোকাও চোখ মেলে তাকায়নি। 
মোবাইল ফোনটা কেঁপে ওঠে আবার। মায়া কাঁপে না। কাটাকুটি খেলে রক্তভেজা আঁচলে।
‘লেখো দেখি বাঘ
বাঘ
ব কেটে ছ করো।
ঘ কেটে গ করো
হয়ে যাক ছাগ
বাঘ তুই ভাগ।’
আচমকা মানিককে বুকে ধরে ছুটে শুরু করে মায়া। রক্তের বিভ্রম কাটে না। মানিকের দেহটা মায়ার দেহের সঙ্গে যত চাপ খায় তত টাটিয়ে ওঠে স্তন। ছুটন্ত মায়ার স্তনাগ্র ভেদ করে রক্ত ঝরে। এই রক্তের রং দুধ সাদা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত