| 19 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: এটা একটা প্রেমের গল্প হতে পারত

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

‘চৌদ্দ বছর বয়সে আমার রোগটা ধরা পড়ে। সিস্টেমিক স্ক্লেরসিস।’

সামনে বসা মেয়েটা শান্ত স্বরে কথাটা বলল। চেহারা দেখে তার বয়স বোঝা মুশকিল। লম্বায় বয়সের তুলনায় বেশ খাটো, হাত পায়ের আঙুলগুলো লিকলিকে, চামড়া হাড়ের সাথে সেঁটে আছে। মাথায় চুল সামনের দিকে একেবারে পাতলা, শীর্ণ অপুষ্ট কিছু চুল পড়ে আছে, তাই কপালটা উঁচু দেখায় বেশি। সবচেয়ে ডিস্টার্বিং হল তার ঠোঁট দুটো।  সূঁচালো দুটি ঠোঁট মুখের পাতলা নীলচে চামড়ার কারণে শক্ত হয়ে লেগে আছে চোয়ালের সাথে। কথা বলার সময় পুরো মুখ খুলতে যে ওর কষ্ট হয় বেশ বোঝা যায়। একটু আগেই সে বলেছে তার বয়স এখন একুশ। তার মানে গত সাত বছর ধরে এই রোগে ভুগছে। 

নীচু কন্ঠে আবার শুরু করল মেয়েটা-খুবই জটিল রোগ, প্রথমে কেউ ধরতেই পারছিল না। হাত পায়ের চামড়া ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছিল। হাড় বেরিয়ে যাচ্ছিল। আঙুলগুলি ডাইনি বুড়িদের মত হয়ে যাচ্ছিল। খেতে কষ্ট হয়। কথা বলতে কষ্ট হয়। তারপর চেহারাটাও দিন দিন পালটে গেল। বীভৎস দেখাতে লাগল আমাকে। কেউ দেখলে আঁতকে উঠত। স্কুলে কেউ আমার সাথে মিশতে চাইত না। প্যারেন্টসরা ঘুরে ঘুরে তাকাত আর ফিসফিস করত। অবশ্য স্কুলে যাবার মত শারিরীক অবস্থাও আর রইল না। ততদিনে নানা রকমের জটিল চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে। তার ভয়ংকর সব সাইড এফেক্ট। আমি স্কুল ছাড়তে বাধ্য হলাম। দুই তিন বছরের মাথায় আরো নতুন নতুন সব রোগ বালাই দেখা দিল আমার। ডায়াবেটিস।  থাইরয়েডের সমস্যা।  হাই ডোজ স্টেরয়েডের নানা এফেক্ট। চুল পড়ে গেল বেশির ভাগ। আমি পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। একবার সুইসাইডের চেষ্টাও করেছি। ইনসুলিনের ডাবল ডোজ নিয়ে গভীর কোমায় চলে গেছিলাম। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করে বাঁচিয়েছেন। 

আমি তার পুরনো কাগজপত্র দেখতে চাইলাম।  এর আগে কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছে কিনা।  কেউ আমার কাছে রেফার করেছে কিনা। বর্তমানে কোন এন্টি ডিপ্রেসেন্ট বা মানসিক সমস্যার ওষুধ চলছে কিনা ইত্যাদি ইতিহাস জানতে চাইলাম। আমি পেশায় সাইকোলজিস্ট।  কাউন্সেলিং করা আমার কাজ।  বেশির ভাগ সময় অন্য চিকিৎসকরা কাউন্সেলিং এর জন্য রোগীকে আমার কাছে পাঠান।  এই কাউন্সেলিং সেন্টারে যারা আসে তারা এই সমাজের সব হতভাগ্য মানুষ।  তাদের নানা আশ্চর্য আর বিচিত্র সব গল্প আছে। আমি এসব গল্পে বিচলিত হই না সহজে।  তাই নির্বিকার মুখে ওর  গল্প শুনছিলাম।

সত্যি বলতে কি মেয়েটা যখন আমার চেম্বারে ঢুকে তখন কয়েক মুহুর্তের জন্য আমি নিজেও একটু থমকে গিয়েছিলাম। তরুণ বয়সী একটি মেয়ে, ছিপছিপে শরিরে জড়ানো সুন্দর ডিজাইনের গাঢ় সবুজ সালোয়ার কামিজ, চোখগুলো টানা টানা, কাজল দেয়া। শরির থেকে সুন্দর একটা পারফিউমের সুবাস আসছে।  সবই ঠিক আছে কিন্তু চেহারার দিকে তাকালে একটা ধাক্কা লাগে বুকে। হয়তো এককালে সে ফুটফুটে সুন্দর বালিকা ছিল। ফুল ফুলপ্রিন্টের ফ্রক পড়ে সারা ঘরে ছুটে বেড়াত।  স্কুলে বন্ধুদের সাথে এক্কা দোক্কা খেলত।  বাবা মার হাত ধরে বেড়াতে যেত সমুদ্রের ধারে। এখন নিশ্চয় সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে চার দেয়ালের মধ্যে। বাইরের পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে।  ওর আশপাশের আর দশটা তরুণীর কেউই ওর মত নয়।  অন্তত দেখতে।  মানে চেহারায়।জীবনযাপনে তো নয়ই। হ্যাঁ, ওর ডিপ্রেশন হওয়াটা স্বাভাবিক।   

-আমার ফেসবুক নাম শর্মিলা। -বলে উঠল মেয়েটা-তবে আমার আসল নাম মিলা।  শুধু মিলা।  বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। ওই ভয়ংকর অবস্থা থেকে আবার ঘুরে দাড়িয়েঁছিলাম কেবল আমার বাবার আদর আর ভালবাসার কারণে। আমার চিকিৎসার কোন ত্রুটি রাখেন নি বাবা। ইন্ডিয়ায় নিয়ে গেছেন। সিঙ্গাপুর থেকে দামি ওষুধ আনিয়েছেন। দিন রাত সেবা করার জন্য নার্স রেখে দিয়েছিলেন এক সময়। স্কুলে যেতে পারি নি বলে বাড়িতে শিক্ষক রেখে প্রাইভেটে সব পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তবে সত্যি কথা হল আমাকে ডিপ্রেশনের গভীর খাদ থেকে বাঁচিয়েছেআমার ছবি আঁকার বাতিক।  আমি দিন রাত ছবি আঁকি। বাবা টিচার রেখে দিয়েছিলেন।  চার বছর তাঁর কাছে ছবি আঁকার সব টেকনিক শিখেছি আমি। দেখেন, আমার হাতের আঙুলগুলি কেমন বাঁকা, আর সরু সরু। প্রায়ই রক্ত চলাচল কমে যায় হাতে। ঘা হয়। চামড়া ফুটে রক্ত বেরোয়।  সারা রাত হাত ঝিন ঝিন করে। তবু এই হাত দিয়ে ছবি এঁকেআমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি।  প্রতিযোগিতায় প্রশংসার ফুলঝুরি ছুটেছে। যদিও কোন পুরস্কার আনতে আমি যাই নি। আমি লোকসমক্ষে বের হতে পছন্দ করি না। তবে আপনি ফেসবুকে শর্মিলা ফ্রিদা নামে সার্চ করলে আমার আঁকা ছবিগুলো দেখতে পাবেন। অবশ্য শর্মিলা আমার ফেইক নাম।  আর ফ্রিদা নামটা ফ্রিদা কাহলো থেকে ধার করা। দুই মিলে শর্মিলা ফ্রিদা। আর এই ফেইক আইডি দিয়েই অনন্যর সাথে আমার পরিচয়।

এবার আমি নড়েচড়ে বসলাম একটু।  কাহিনীর তাহলে অন্য দিকও আছে।  কেবল অসুস্থতা আর নিজেকে লুকিয়ে রাখাই মূল সমস্যা নয়।  আমি কিছু না বলে অপেক্ষা করতে থাকলাম পুরোটা শোনার জন্য। আমাদের প্রফেশনের মূল নীতি হল আগে শোন।  লিসেন।  ক্লায়েন্টকে আগে বলতে দাও। যতটা সম্ভব প্রাণ মন খুলে আর বিনা বাধায় বলতে দাও। এই চেয়ারে বসে ক্লায়েন্টদের কথা শুনতে শুনতে বিগত বছরগুলোতে আশ্চর্য অবিশ্বাস্য সব কাহিনী, ভয়ংকর সব থ্রিলার আর রগরগে সব নাটকের মুখোমুখি হয়েছি আমি। আমাদের এই সমাজটাকে বাইরে থেকে যেমনটা দেখা যায়, ভেতরটা যে মোটেও তেমন নয়-এই চেয়ারে না বসলে কোনদিন জানতেই পারতাম না। সমাজ আর চারপাশের গভীর ঘোর ক্লেদাক্ত অন্ধকার এই ছোট ঘরটিকে বহুবার আচ্ছন্ন করেছে এর আগে। দেয়ালগুলো সাক্ষী হয়েছে কত অসহ্য কষ্টকর বিবরণের। প্রথম প্রথম চমকে উঠতাম এই অন্ধকার দেখে। আজকাল কোন কিছুতেই আর আগের মত অবাক হই না। 

মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে একটু থামলে আমি বললাম-আপনি চাইলে পানি খেতে পারেন। ওই টেবিলে বোতল আর গ্লাস রাখা আছে।  আর যদি চা বা কফি খেতে চান তাও আনিয়ে দিতে পারি।

-পানি খাব। আর কিছু না।  থ্যাংকস।

আমি উঠে গিয়ে বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে দিলাম। মেয়েটা, মানে মিলা, অল্প অল্প করে চুমুক দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পানিটুকু খেল। ওর যে পানি বা খাবার গিলতে কষ্ট হয় তা আগেই বলেছিল। এখন বেশ বুঝতে পারছি। গ্লাসটা সে নিজেই রেখে এল সাইড টেবিলে। ফিরে এসে গুছিয়ে বসল। তারপর কথা শুরু করল আবার।

-খুবই চমৎকার ছেলে অনন্য আজাদ।  সেনসিটিভ। রুচিশীল।  ছবি টবি সম্পর্কে বেশ ধারণা রাখে। নিজে দু এক লাইন কবিতাও লেখে। তবে সেই কবিতা লজ্জায় কাউকে পড়তে দেয় না। তাছাড়া সে একজন আর্কিটেক্ট।  আর আর্কিটেক্টরাও এক রকম শিল্পী আসলে-সেটা নিশ্চয় স্বীকার করবেন। সেকারণেই আমার সাথে তার চমৎকার একটা বোঝাপড়া হল। আমরা পরস্পরকে খুব ভাল বুঝতে পারতাম। অনন্য আমার একমাত্র ফেসবুক ফ্রেন্ড।  তবে কেবল ফ্রেন্ডশিপ বলা যায় না এটাকে, ও আমার সোল মেট বলতে পারেন।  তফাত কেবল এই যে আমরা কেউ পরস্পরকে কখনও দেখি নি।  এমনকি ছবিও না।  আমি যে ফেসবুকে ছবি দেই না তাতো বুঝতেই পারছেন।  ইন ফ্যাক্ট আমি কখনও ছবিই তুলি না। কোন সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে শাদী, জন্মদিনে যাই না আমি। কখনও সাজগোজ করি না, ভাল জামা কাপড় কিনি না। আমি আমার পৃথিবীতে থাকি। আমার ঘরটাই আমার গোটা পৃথিবী। আর আমার রঙ, ক্যানভাস। ব্রাশ। আর বাবা। আর যোগ হল এই অনন্য।

এবার আমি মাঝখানে কথা বললাম-অনন্যর সাথে পরিচয় কত দিনের?

-প্রায় এক বছর।  -একটু ভেবে বলল মিলা- মানে আট মাসের একটু বেশি।  এই আট মাস দিনে অন্তত কয়েক ঘন্টা ওর সাথে চ্যাট করেছি। ওর তো অফিস, কাজ কর্ম আছে।  ব্যস্ত মানুষ।  তবু এর ফাঁকে যখনই সময় মিলত ছোট ছোট মেসেজ পাঠাত। বা নিজের তোলা একটা পথচলতি ছবি পাঠাত।  কোথাও গিয়ে একটা সন্ধ্যামালতীর ঝাড় দেখেছিল তার কথা বলত। কিংবা গাড়ির কাঁচে ঝুম বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসা শহরের কথা লিখত। কিংবা হঠাৎ রুমীর লেখা দুলাইন কবিতা। যা কিছু ভাল লাগত তাই বলে বা ছবি তুলে পাঠাত আমাকে।  আমি তো ঘর থেকে বের হই না। তাই ওর চোখ দিয়েই এই শহর দেখতাম। চারপাশের পৃথিবীটাকে অনুভব করতাম। আমিও যখন যেটা আঁকি বা ভাবি, কিংবা পড়ি, তৎক্ষণাৎ তাকে না দেখিয়ে শান্তি পাই না। ধরেন সকাল বেলা আমার জানালার পাশে দুটা শালিক এসে ঝগড়া করছিল -সেকথা তক্ষুণি ওকে জানানো চাই।  কিংবা একটা গল্পের বই পড়ে খুব মন খারাপ হচ্ছে, মন খারাপটা তার সাথে শেয়ার করা চাই।  মানে হল গিয়ে আমাদের কথা বলার বা চ্যাট করার বিষয়ের কোন অভাব হত না কোনদিন। চাইলে আমরা অনন্তকাল ধরে পরস্পরের সাথে এভাবে কথা বলেই কাটিয়ে দিতে পারতাম। 

মিলা এবার থামল। অনেকক্ষণ কথা বলে একটু হাঁপিয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে আমি সাবধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি করে ফেললাম তাকে-আপনার অসুখটার বিষয়ে কি কখনো তাকে কিছু বলেছেন?

মিলা বড় বড় টানা চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল। তার অস্বাভাবিক টান টান শক্ত মুখে এক রাশ  দ্বিধাদ্বন্দের খেলা। বুঝতে পারছি আমি কেস হিস্ট্রির প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌছেঁ গেছি।  এবার মূল সমস্যার মুখোমুখি হবার পালা। 

-না। কখনো বলি নি। বুঝতেই পারছেন। প্রথম দিকে কিছু বলা হয়নি কারণ আমাকে দেখলে ও নিশ্চয় আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে না। পরে যখন বন্ধুত্ব হয়ে গেল তখনও কিছু বলতে পারি নি। কারণ তখন ওকে হারানোর ভয় ঢুকে গেছে মনে। যদি সে দূরে সরে যায়। যদি সে  সত্য গোপন করার জন্য আমার ওপর রাগ করে! বলতে চেয়েও বার বার পিছিয়ে এসেছি। ভেবেছি, থাক। কী হবে এসব বলে! যেমন আছে তেমনই থাকুক না।  কোন সমস্যা তো হচ্ছে না। 

কথার মাঝখানে বন্ধ দরজায় নক পড়ল। কাউন্সেলিং ওর সময় এই ঘরে কারও প্রবেশ নিষেধ। তবু আমি উঠে দরজা খুললাম। দরজার বাইরে আমার সহকারী জিনিয়া ফিস ফিস করে বলল-স্যার, আধ ঘন্টা শেষ। পরের রোগী অলরেডি এসে গেছেন।  উনি খুব অস্থিরতা করছেন। আপনি টাইমলি শেষ কইরেন।  

খোলা দরজার কোণ দিয়ে সিরিয়ালে বসে থাকা ছেলেটিকে এক ঝলক দেখলাম। নার্ভাস, অস্থির। পা দুটি দোলাচ্ছে অবিরত। বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। মানুষের বডি ল্যাংগুয়েজ পড়া আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। ছেলেটি আসলে মনস্থির করতে পারছে না কাউন্সেলিং নেবে কিনা। বলা যায় না হয়তো হঠাৎ উঠে চলে যাবে। আমি জিনিয়াকে আশ্বস্ত করলাম যে ঠিক সময়েই তাকে ডাকা হবে।  পনেরো মিনিট পর সে যেন আবার একটা নক করে।

নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসতেই মিলা বলল-ভাববেন না, আমি এখন একটু দ্রুতই শেষ করব।  তো বুঝতেই পারছেনসব কিছু যেমন আছে তেমনই থাক-মুখে বললেও তা আর সম্ভব হয় নি।  বুঝতে পারছিলাম যে অনন্য আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে।  সে কিছু একটা বলতে চায়, দেখা করতে চায়।  আমিও কি আর নিস্পৃহ থাকতে পারি? আমার রাতে ঘুম হয় না।  সারা রাত পায়চারি করি। সারাক্ষণ অনন্যর কথাই ভাবি।  সে কেমন। নিশ্চয় খুব হ্যান্ডসাম। মার্জিত। তার হাসিটা নিশ্চয় ভুবনভুলানো। কন্ঠস্বরটি নিশ্চয় ভরাট। চুলগুলো একটু লম্বা হলেই ভাল। আচ্ছা আমাকে প্রথম দেখলে সে কী করবে? দৌড়ে পালাবে? চমকে উঠবে? কিন্তু আমি কেমন করে তার মুখোমুখি হব? এদিকে আমার বাবা মার মধ্যে এ নিয়ে তুলকালাম ঘটে গেল একদিন।  মা আমার এই দিন রাত ফেসবুকে চ্যাট করা মোটেও পছন্দ করতেন না। প্রায়ই শাসাতেন, কেন তুমি ছেলেদের সাথে চ্যাট করো? তোমার কি কান্ডজ্ঞান নাই? বড় হইছো, এই টুকু বুঝো না? বাবা চাপা ধমক দেন মাকে-আহ, তুমি ওর বয়সটার কথা ভাবো। এই বয়সে সবাই একটু এটেনশন চায় ছেলেদের। মা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন-বাজে কথা বলো না। এইসবের পরিণতি কি জান না? ওর মিনিমাম সেন্স থাকলে এইসব করে? মা কয়েকবারই আমার ফোন ল্যাপটপ কেড়ে নিলেন। কেঁদেকেটে রাগারাগি করে আবার ফিরে পেলাম। কিন্তু বাড়িতে আমার এই ফেসবুক বন্ধুত্ব নিয়ে বিরাট অশান্তির সৃষ্টি হল। ওদিকে অনন্যও দেখা করার জন্য উদগ্রীব। বার বার লিখছে সে কিছু একটা বলতে চায়।  কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি আর এই স্ট্রেস নিতে না পেরে একদিন অনন্যকে ব্লক করে দিয়ে আবার সুইসাইডের চেষ্টা করলাম। এবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে।  তিনদিন হাসপাতালে ছিলাম।

মিলার গল্প শেষ হলে আমি তাকে পরবর্তী সেশনের তারিখ ও সময় লিখে দিলাম।  যে চিকিৎসক তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন তাঁর ওষুধ দুটা কনটিনিউ করতে বললাম। এই পুরো সময়ে মিলা ছিল আশ্চর্য রকমের শান্ত আর নির্লিপ্ত, কোন কান্নাকাটি করে নি, আবেগপ্রবণও হয়ে পড়ে নি। এই ব্যাপারটা বেশ আশাব্যান্জক মনে হল আমার কাছে।  মেয়েটা তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি ম্যাচিউরড। শৈশব থেকে নানা জটিল অসুস্থতা আর একাকীত্বর সাথে লড়াই করে বড় হয়েছে বলে সামলে ওঠা তার জন্য সহজ হবে।  তবে এ ধরণের মানুষ ঠান্ডা মাথায় অনেক কিছু করে ফেলতে পারে। তাই আবার যে সে আত্নহত্যার চেষ্টা করবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই।  

মিলা, ওরফে শর্মিলা ফ্রিদা শান্ত স্বরে ধন্যবাদ জানিয়ে নির্ধারিত ফি দিয়ে বেরিয়ে গেলে আমি উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম।  মনে মনে ভাবলাম অনন্য ছেলেটা একটু অন্যরকম হলেও তো হতে পারে। এমনও তো হতে পারে যে সব কিছু জেনে আর দেখেও সে মিলাকে ভালবাসতে চাইল। তবে উল্টোটা হবার সম্ভাবনাই বেশি।  তবু মিলাকে ভয় আর সংকোচ ঝেড়ে ফেলে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। সবচেয়ে বেশি যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল তাকে বুঝতে হবে যে কেউ তার প্রেমে পড়ুক আর না পড়ুক, তার নিজের জীবনটা নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই জীবন নিয়েই সে সানন্দে বেঁচে থাকতে পারে।   

আমি টেবিলে রাখা ডেস্কটপে শর্মিলা ফ্রিদা নাম দিয়ে সার্চ বাটনে টিপ দিলাম। অমনি তার টাইমলাইন ভেসে উঠল চোখের সামনে। কভার ফটোটা দেখে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল আমার।  গাঢ় নীল ক্যানভাসে তিনটি লাল কবুতর উড়ে যাবার আগ মুহুর্তে ডানা মেলে বসে আছে। আকাশের রঙ যেমন উচ্চকিত নীল, কবুতরগুলোও তেমন অস্বাভাবিক রাগী। কবুতরগুলোর ছাই রঙা ডানা পুরো ছবিতে একটা আলাদা এফেক্ট এনে দিয়েছে।  কী সুন্দর, কী সুন্দর!

জিনিয়া দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল-স্যার ওনাকে পাঠাব?

আজ আমার আর কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এই আশ্চর্য সুন্দর ছবিটা দেখে আমার মাথা নষ্ট হবার উপক্রম।  চোখ ফেরাতে পারছি না। তবু স্ক্রিন থেকেচোখ সরিয়ে বললাম-পাঠাও। 

অস্থির প্রকৃতির ছেলেটা ঘরে ঢুকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণদাঁড়িয়ে রইল। আমি হেসে বললাম-বসেন মিস্টার শাহাদাত। কেমন আছেন?

ছেলেটা ঘামছে খুব। প্রথমে চশমা খুলে হাতে নিল সে। তারপর চশমাটা কি করবে বুঝতে না পেরে আবার পরে নিল চোখে।  তারপর একটা টিস্যু চেয়ে নিল কপালের ঘাম মোছার জন্য।  আমি তাকে সময় দিলাম।  পা দোলানো বন্ধ করে একটু স্থিতু হয়ে তারপর সে প্রথমে জানাল যে সে একজন বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ড্রাগ নিয়েছিল। লেখাপড়া আর শেষ হয় নি। পরবর্তীতে নেশার পথ থেকে সরে আসতে পারলেও আয় রোজগারের কোন পথ হয় নি। তাই সে বেছে নিয়েছে প্রতারণার ব্যবসা। নানা পদ্ধতিতে প্রতারণা করে থাকে সে। সবচেয়ে বেশি যেটা করে তা হল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নাম বলে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে অসুস্থ ক্যান্সার রোগীদের কম খরচে ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করে দেবে বলে আশ্বাস দেয়।  একটু কম শিক্ষিত গ্রামের মানুষদের টার্গেট করে সে।  তারা সরল বিশ্বাসে তার কথায় প্রলুব্ধ হয়।  সে কাগজপত্র পাঠানোর কথা বলে, পাসপোর্ট আর মেডিকেল ভিসা করার নামে, কলকাতাগামী বাসে বা বিমানে অগ্রিম সিট বুকিং এর জন্য বার বার টাকা নেয় তাদের কাছ থেকে।  তারপর এক সময় চম্পট দেয়।  অন্য কোন হাসপাতালে অন্য কোন ক্লায়েন্ট ধরে।  এর বাইরেও আরও নানা রকমের ভুয়া ব্যবসা আছে তার। 

ছেলেটার কথা শুনতে শুনতে অবাক হচ্ছিলাম। কত রকমের ব্যবসা আর ধান্দা আছে এই শহরে। নিত্য প্রতারণা আর মিথ্যের বেসাতি এখানে। তা যাই হোক, আমি তো আর পুলিশ নই, এসবে আমার দরকার কি, তাই আমি জানতে চাই তার সমস্যাটি কি। কেন সে আমার কাছে এসেছে।

ছেলেটা টিস্যু পেপার দিয়ে ঘাম মুছে বলে-সমস্যা হল, আমি একজনের প্রেমে পড়ছি।  যার প্রেমে পড়ছি সে আমার বিষয়ে এই সব কিছু জানে না। সে জানে যে আমি ভাল চাকরি করি। আমার অফিস গুলশানে, গাড়ি আছে। আমি একটা সুন্দর সভ্য ভদ্র লাইফ লিড করি।

বাহ, আজকে দেখি সব প্রেমঘটিত সমস্যা! বিচিত্র সব প্রেমের গল্প শুনতে ভালই লাগছে আমার।  আমি আগ্রহ ভরে চেয়ে রইলাম ছেলেটার দিকে। এরকম একজন ভন্ড প্রতারক এমন অস্থির আর নার্ভাস হলে কেমন করে হবে? নাকি প্রেম তাকে বদলে দিয়েছে?

ছেলেটা বলতে থাকে-আমি প্রচুর মিথ্যা কথা বলি।  কনফিডেন্টলি ঠান্ডা মাথায় মিথ্যে বলতে পারি আমি।  অন্যকে কনভিন্স করতে মিথ্যা বলতেই হয়। প্রথমে নিজেকে সুশিক্ষিত, মার্জিত, এটিকেট সম্পন্ন দেখাতে অনেক রাজা উজির মারি। অন্যের শ্রদ্ধা আদায় করে নেই। পেশার প্রয়োজনে কাউকে কথায় কথায় ইংলিশের তুবড়ি ছুটাতে হয়, কাউকে অর্মত্য সেনের ডায়লগ বলতে হয়, কারও সঙ্গে আলাপ করতে হয় শেক্সপীয়ার নিয়া। তো এই গুলি সম্পর্কে আমি নিয়মিত পড়াশুনা বা হোম ওয়ার্ক করি। রীতিমত বিসিএস ভাইভার প্রস্তুতির মত। আপটুডেট থাকতে চেষ্টা করি সব সময়। আমার সাথে আধা ঘন্টা কথা বললে, আমি নিশ্চিত, আপনিও পটে যাবেন। আপনার মত মানুষকে পটানোর জন্য মনস্তত্ব, ফ্রয়েড, সাহিত্যে প্যারানোয়েড সাইকোলজি ইত্যাদি নিয়া কথা বলতে হবে। অথচ সেই আমি এখন গুছিয়ে কথা বলতে পারতেছি না। সব কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে গেছে আমার। মিথ্যা বলতে গিয়া কথা জড়ায়ে যাচ্ছে।  এই অবস্থা হইছে ওই মেয়েটার জন্য। বিরাট ধরা খাইয়া গেলাম স্যার!

আমি তার সরলতায় একটু হেসে বললাম-এটা খারাপ কিছু না। প্রেম আপনাকে পালটে দিচ্ছে। মন্দ থেকে ভালর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আপনি এটাকে একটা অপরচুনিটি হিসাবে নেন। জীবনটাকে বদলে ফেলেন।  সিনেমাতেই এই রকম হয়, আপনার জীবনে বাস্তবে হল-এটা আপনার সৌভাগ্য। 

কিন্তু-শাহাদাত নামের ছেলেটা আমতা আমতা করে-মেয়েটা যখন এই সব জানবে, তখন নিশ্চয়  আমাকে আর ভালবাসবে না। সম্পর্ক রাখবে না কোন। সবচেয়ে বড় কথা সে নিশ্চয় ভীষণ কষ্ট পাবে। কারণ মেয়েটা খুবই ভাল।  খুবই সুন্দর, আর সফিস্টিকেটেড। কোন কালিমা নাই ওর মধ্যে।  আর সে খুবই বিষন্ন। ওর কোন বন্ধু নাই আমি ছাড়া। আমি কি করে ওকে এসব বলব? 

আমি পরামর্শ দিই-এরপর যেদিন আপনাদের দেখা বা কথা হবে, সেদিন আপনি তাকে সব খুলে বলেন।  এই রিস্ক তো আপনাকে নিতেই হবে শাহাদাত সাহেব। আপনার বলা সমস্ত কথা মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু আপনি যে তাকে ভালবাসেন তা তো আর মিথ্যা না। তারপর হয় সে আপনাকে ঘৃণা করবে। অথবা সব জেনেও ভালবাসবে। এই দুই সিচুয়েশনের জন্যই নিজেকে প্রস্তুত রাখবেন। তবে আপনি তাকে প্রমিজ করবেন যে এসব আর করবেন না।  বলবেন যে কেবলমাত্র তার ভালবাসা পাবার জন্যই আপনি নিজেকে পুরাপুরি পালটে ফেলতে চান।  তারপর দেখেন কী হয়। ভাই, দুনিয়াতে নো রিস্ক নো গেইন। দেখেন চেষ্টা করে।

শাহাদাত নামের ছেলেটা এবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। তার মুখ টুখ লাল। চোখ লাল। আমি তাকে কাঁদতে দিলাম। টিস্যুবক্সটা এগিয়ে দিলাম। এরকম স্মার্ট একটা যুবক বসে বসে এভাবে কাঁদছে বিষয়টা খুব বিব্রতকর। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মুখ চোখ মুছে সে এবার বলল-‘ওর সাথে আমার পরিচয় হইছিল ফেসবুকে। আমাদের মধ্যে কখনও দেখা সাক্ষাত হয় নাই। কিন্তু যেদিন থেকে আমি বুঝতে পারছি তাকে আমি পাগলের মত চাই, সেই দিন থেকেই নানা ভাবে তার সাথে দেখা করতে চাইতেছি। সে বার বার এড়ায়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কোন কারণ ছাড়াই আমাকেহঠাৎ ব্লক করে দিছে। এখন আমার তো সব শান্তি সুখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি এইটা কী করলাম জীবনে! সব আমার পাপের ফল স্যার! এইটাই আমি ডিজার্ভ করি। 

এই বলে ছেলেটা আবার কাঁদতে শুরু করল। আমি তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম-‘মেয়েটার নাম কী ছিল? অন্য একটা আইডি থেকে নক করেন। ক্ষমা চান। চাইলে আমার এখান থেকেও করতে পারেন। ইফ ইউ ওয়ান্ট। ‘

যেন ডুবে যেতে যেতে খড়কুটো খুজেঁ পেয়েছে-এমন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল শাহাদাত। এতক্ষণে একটু হাসি ফুটল তার মুখে।  সে বলল-‘ স্যার আমি তো একটা ফেইক আইডি ব্যবহার করতাম।  আমার নাম ছিল অনন্য আজাদ। আর মেয়েটার নাম শর্মিলা ফ্রিদা। কী ভীষন সুন্দর ছবি আঁকে সে। আসল শর্মিলা  নিশ্চয় তার ছবির চেয়েও সুন্দর। কল্পনায় তাকে আমি অনেক বার দেখেছি।  আর তার ছোট ছোট কথা, একটা গানের লাইন, প্রিয় কোন বই থেকে তুলে দেয়া সংলাপ। সব কিছু সুন্দর ওর। কসম খেয়ে বলতে পারি স্যার আমি কোন দিকেই ওর যোগ্য নই। তবু একবার তার সাথে কথা বলতে চাই। খালি সাহস করে উঠতে পারতেছি না।  এইটুকু সাহস করার জন্য গত দশ রাত এক ফোঁটা ঘুমাইতে পারি নাই। সারা রাত পায়চারি করতেছি।  ব্যবসা লাটে উঠছে  বিশ্বাস করেন স্যার’-

ছেলেটা আরও অনেক কিছু বলতে থাকে হড়বড় করে। কিন্তু সেসব কেন যেন আমার কানে যায় না। আমি হঠাৎ নীরব হয়ে যাই। অকারণেসামনে খুলে রাখা ডেস্কটপের স্ক্রিনে অসম্ভব গাঢ়নীল ব্যাকগ্রাউন্ডে তীব্র লাল রাগী কয়েকটি কবুতরের দিকে চেয়ে থাকি। কবুতরগুলো উড়তে গিয়েও উড়তে পারে না।  তাদের ছাই রঙা ডানাগুলি কেবল ওড়ার ভঙ্গিতে আটকে থাকে নীলরঙা জমিনে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত