| 20 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা গল্প: যারা আত্মহত্যা করেনি । বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 39 মিনিট

অলিভিয়া অ্যাভেনিউয়ের একদম শেষের বাড়িটা মনসিজ আর রূপাদের। বাড়ির অন্যদিকের রাস্তাটা প্যাকার্ড স্ট্রীট। ওয়ান ওয়ে, সোজা ওই রাস্তা ধরে মাইল দুয়েক গেলেই ডাউন টাউন। শহরের একদম মাঝ বরাবর, তাই জায়গা হিসেবে কুলীন। র‍্যাঞ্চ স্টাইল বাড়িটা বেশ অনেকটা জমি জুড়ে। তিনটে বেডরুম নিয়ে বেশ ছড়ানো, বয়েস সত্তরের উপর। বাড়ির আকাশ ছোঁয়া দাম দেখে রূপা পিছিয়ে গেছিল। এ মা! এতো ছোট ছোট ঘরের জন্য এতোগুলো টাকা? 

আগেকার দিনের বাড়িগুলোর ঘর অমন ছোটই হয়। মনসিজ আশ্বস্ত করেছিল। চিন্তা করো না, ডাউন টাউনের কাছে বাড়ি এতো কমে আর পাবে না। আমরা ইন্টেরিয়ার বদলে নেবো। ফিক্সার আপার। 

কেনার পর বাড়িটায় অনেক অদল বদল করেছিল ওরা। টাকা ঢাললে করা যায়। দেওয়াল সরিয়ে পাঁচখানা ঘরকে কমিয়ে তিন করতেই কেমন খোলামেলা। তাছাড়া পুরো কার্পেট সরিয়ে মেপল কাঠের মেঝে হল, প্রতিটা ঘরে নিজস্ব রঙের আকাশ। খোল নলচে বদলে নিয়েছিল একেবারে। জীবনটাকেই এমন বদলে বদলে এগোলাম, এ তো কেবল একটা বাড়ি! জাঁক করে রূপাকে এই কথাটা বলেছিল মনসিজ।  

এখন লিভিং রুমের প্রশস্ত কাঁচের দরজা পেরিয়ে বিশাল বড় ডেক, তার ওপারে সুদৃশ্য ছড়ানো বাগানে ঘেরা উঠোন। টেনিস কোর্টের মত সমান ছাঁটে কাটা সবুজ ঘাস বিছানো লন আর লনের সীমানা ধরে সার দিয়ে জেরানিয়াম আর পেটুনিয়ার কেয়ারি। এইসব কিছুর পিছনে মনসিজের নিজের কোন কেরামতি নেই যদিও। তার বাগানের পুরোটাই পারফেক্ট লন সার্ভিসের জিম্মায়। বিকেলের এই সময়টায় পশ্চিমঘেঁষা কটনউডের পাতা চুঁইয়ে চৌকো চৌকো রোদের টুকরো  গড়াচ্ছিল বাগানে। ছোট ছোট উড়ানে কুটুর কুটুর করে খাবার খুঁটে খাচ্ছিল একগুচ্ছ পাখি। বেশির ভাগই গোল্ডফিঞ্চ আর রবিন। মাঝে মাঝে লেকের ধার থেকে উড়ে যাওয়া হেরন এসে বসে ডেকের রেলিঙ্গে। আজ ছিল না। তার বদলে ডেকে ছোটাছুটি করছিল দুটো কাঠবেড়ালি। ডেকের ছড়ানো ছেটানো বেতের চেয়ারের একটার থেকে আর একটায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল লুকোচুরি খেলার ভঙ্গিমায়। পটে আঁকা ছবি।   

মনসিজ সদ্য অফিস থেকে ফিরেছে। পোষাক বদলে শর্টস আর একটা হলদে রঙের পোলো টি শার্ট পড়ে ডেকে এসে দাঁড়িয়েছিল। চট করে মোবাইলটা নিয়ে দুটো ছবি তুলল ফটাফট। তারপর ঘরে ঢুকে পর্দাটা পুরো খুলে দিয়ে লিভিংরুমের সোফায় পা ছড়ালো। রূপা স্কুল থেকে ফেরে ঘণ্টা দেড়েক আগেই। মনসিজ বসতেই গরম কফির কাপ এনে ধরিয়ে দিল। কিছু খাবে সঙ্গে? 

মনসিজের চেহারাটা তেমন কিছু বড়সড় নয়, পেটটা একটু বাড়লেই তাই বড্ড চোখে লাগে। মনসিজের নয়, রূপার চোখে। সেটা মনে রেখে মনসিজ পেটের উপর একটা হাত রেখে বলল, কাল থেকেই জিমে যেতে হবে বুঝলে। বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। দাও, ওই যে প্যাটেল ব্রাদার্সের সামোসার প্যাকেট থাকে, আছে নাকি? দিতে পারো গোটা দুয়েক গরম করে। 

কালকে তোমার সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যেও জিমে। নাহলে তোমার তো আর যাওয়া হয়ে উঠবে না। রূপার গলার খোঁচাটা মিষ্টি হাসির মোড়কে আসে ঠিক বঁড়শির টোপের পিছনে লুকোনো কাঁটার মত। কিন্তু অনেক দিনের অভ্যাসে এইসব কথায় খুব বেশি মাথা ঘামায় না মনসিজ। রূপা চলে যেতে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলের সদ্য তোলা ছবিদুটো এডিট করল খানিক, একটু আধটু আলোর কমবেশি কেমন স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে দেয় ছবিতে। ফেসবুকে আপলোড করতে যাচ্ছিল, কিন্তু থমকে গেল শৈবালের একটা পোস্ট দেখে। ওদের একটা পুরোন ছবি। কলেজ, ফার্স্ট ইয়ার। পরীক্ষার পাট চুকিয়ে হস্টেল ছেড়ে গরমের ছুটিতে যে যার বাড়ি ফিরবে। তার আগে এক দিনের জন্য দীঘা গেছিল সবাই। কতদিনের কথা, পঁচিশ বছরের বেশি ছাড়া কম না। সাদা কালো ছবি, রঙ্গিন ছবি কমই হত তখন। এতদিনে খানিক বাদামী। তাতেই সন্ধ্যাটায় অন্য রং ধরে গেল। ফেসবুকে সুপারলাইক দেওয়ার উপায় থাকলে তাই করত মনসিজ। আনন্দ চাপতে না পেরে গলা ছেড়ে ডাক দিল রূপা, রূপা!

সামোসার প্লেট ঠক করে নাবিয়ে রূপা নিয়মমাফিক বিরক্তি প্রকাশ করল। ব্যাস, সারাদিনে পোষায় নি, অফিস থেকে ফিরেই আবার ফেসবুকে মুখ। তোমার এই স্ক্রীন অ্যাডিকশান আমাদের শেষ করে দেবে। 

ধুর, ধুর ছাড়ো তো সেইসব কথা। বরং এই ছবিটা দেখো। দেখি আমায় চিনতে পারো কি না। মন ভাল হওয়া গলা টসকাতে দেবে না মনসিজ।   

কই দেখি। সবচেয়ে ল্যাবাটা নিশ্চয়। 

ও, আমাকে ল্যাবা দেখেই বিয়ে করেছিলে বুঝি? 

গড়ে পিটে নিয়েছি। না হলে বিয়ের সময় যা একটা ছিলে তুমি। এই চেক কাটা জামাটা না? আচ্ছা, একটা কথা বলো, সবাই কেমন জিন্স কিংবা হাফ প্যান্টে আছে, তোমার এই ঢোলা পাজামার কারনটা কি? সাধে হস্টেলে তোমার নাম দিয়েছিল ঢোলা?  

কলেজের দিনের স্মৃতিচারন মন ভাল করার মোক্ষম ওষুধ। হা,হা,হা শব্দে অবারিত হাসি হাসল মনসিজ। সে ওই ফার্স্ট ইয়ারেই। তারপর আর পাজামা পড়েছি কোথায়? এখন তো শুধু দুর্গা পূজায় পাঞ্জাবির সঙ্গে চোস্তা। নামটাই রয়ে গেল সারা জীবনের জন্য। মনে মনে নামটার গায়ে হাত বোলাল একবার। গোঁফের কানায় দুধের সরের মত হাসি লাগানো মুখে বলল, আর কাউকে চিনতে পারো কি না দেখি। তুমি দেখেছ এদের অনেককে।

এটা কে গো, এই যে একদম ডান পাশে? 

আহা ওটাই তো শৈবাল। আমাদের ফুচু। এতো দেখেছো –

ও মা, অত্তো চুল ছিল তখন ওর মাথায়? আচ্ছা, আমার কি দোষ বলো তো, শৈবালদাকে টাক ছাড়া দেখেছি কক্ষনো? 

ওটা ওদের বংশের ধারা, তিরিশ বছরেই মাথা ফাঁকা। 

এতক্ষণে বেশ উতসাহ নিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল রূপা। এইটা তো উত্তমদা, হাসি দেখলেই চেনা যায়। এখনো এমনি আছে। উত্তমদা অনেকদিন এদিকে আসে না আর, কোথায় আছে এখন?

উদো আছে পাও অল্টোতে। বিগ বস এখন, সময় কোথায়। 

আর এইটাতো প্রসেনজিত, জামসেদপুরে আমাদের সঙ্গে ছিল। বলতে বলতে থমকে গেল রূপা। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এবার বসে পড়ল মনসিজের পাশে। পার্টিতে গিয়ে মনসিজ লুকিয়ে চুরিয়ে সিগারেট টানলে যেমন নাকটা একটু কুঁচকে জামার গন্ধ থেকে হদিশ নেওয়ার চেষ্টা করে, রূপার মুখটা এখন সেরকম। এটা রূপার গভীর ধন্ধের মুখ। আচ্ছা, তোমরা নাকি বেড়াতে গেছো! সবাই এমন রকমারি ভঙ্গিতে হাসছে, তার মধ্যে এই ছেলেটা এমন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে কেন? এই ছেলেটা কে? একে তো দেখিনি কখনো। 

মোবাইলটা নিজের কাছে টেনে নিল মনসিজ। দেখি,দেখি। আঙ্গুল বুলিয়ে ছবিটা একটু বড় করতেই বুঝল। অঙ্কুশ। অঙ্কুশ!

ওর মুখ শুকনো মনে হচ্ছে তোমার? খুব অবাক চোখে তাকাল মনসিজ। কোথায় সেরকম তো কিছু –

তুমি যেদিন সিন্থিয়ার কাছে ঝাড় খেয়ে বাড়ি ফেরো, আয়নায় নিজের মুখ দেখেছ কখনো? 

সিন্থিয়া ল্যাম্ব মনসিজের বস। খুব রগচটা মহিলা, রেগে গেলে খুব খোঁচা মেরে কথা বলে। দিনটাই বরবাদ হয়ে যায় মনসিজের। এরকম অনেক দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্টিয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে ভেবেছে, ধুস শালা, ছেড়ে দেবো এই চাকরিটা। 

কি করে বোঝো ঝাড় খেয়ে ফিরেছি? কি দেখো তখন আমার মুখে? এই কথাটা বলে মনসিজ অনেকটা জমি ছেড়ে দিল রূপাকে। 

কাজের তাড়া ছিল, শেষ দানটা দেওয়ার ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়াল রূপা। এইখানেই তো তোমরা ছেলেরা জিতে গেলে। আমরা মুখের দিকে চেয়ে কথা বলি, চোখের দৃষ্টি দিয়ে বুকের ভিতরটা পড়ে ফেলি। আর তোমাদের একেকজনকে চিনামাটির বাসনের মত আতু আতু করে রাখি।  

এমনি সময়ে হলে মনসিজ বলতো, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই জন্যেই তো ডিশ ওয়াশারে না ঢুকিয়ে নিজের হাতে ধোলাই করো। কিন্তু এখন এসব চাপান উতোর ভাল লাগছিল না। অস্থির ভাবে রূপার হাত টেনে ধরল মনসিজ, আহা বাটি উপুর করে কথা বলো না! কি দেখতে পাচ্ছো তুমি অঙ্কুশের মুখে? 

উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঠোট ছুঁচলো করে নিবিষ্ট মনে ছবিটা দেখল রূপা। শরীরের ভারটা পুরো ছেড়ে দিয়েছে মনসিজের কাঁধে। বড্ড ভারি হয়ে গেছে রূপার শরীর। একসময়ে এইভাবে গায়ে গা ঠেকিয়ে এলে শরীরে পুলক জাগতো, এখন হাঁসফাঁশ। অবশ্য সে কথা প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয় নয়, মনসিজ উত্তরের অপেক্ষা করছিল। 

মুখে নয় গো চোখে। ধীরে ধীরে বলল রূপা, ভাবতে ভাবতে কথা বললে যেমন শোনায়।  

মানে? এইটুকু টুকু সাদা কালো ছবি থেকে তুমি বুঝে গেলে ওর চোখের ভাষা। মনের কথা পড়ে ফেলা-টেলা বোগাস – রূপার দাবীতে এবার বিশ্বাস হারাচ্ছিল মনসিজ। 

দেখছ না, তোমরা সবাই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছো, চোখগুলো হাসছে। অথচ এই ছেলেটার চোখ দেখো। কেমন মাটির দিকে। যেন নিজেকে লুকাতে চাইছে।  

জানো রূপা, ওর সঙ্গে ওইদিনই শেষ দেখা। গরমের ছুটির পরে আর ফেরেনি অঙ্কুশ। দীর্ঘশ্বাস চেপে কোনমতে বলল মনসিজ। অঙ্কুশের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠছিল তখন। 

এমা কেন? 

আত্মহত্যা করেছিল অঙ্কুশ। বিকেলের রোদটা হঠাত মিইয়ে গেল মনসিজের জন্য। বহু বছরের ওপার থেকে আসলেও দুঃখের ঝাপটায় নড়ে গেছিল আজকের মনসিজ। কিভাবে একদম ভুলে গেছিল ওকে, অথচ এই অঙ্কুশের সঙ্গে হস্টেলের প্রথম বছরটা কিরকম গলাগলি করে কেটেছে।  

কি হয়েছিল গো?   

এমন নয় যে কোন অজানা দুই যুগ আগের এক আত্মহত্যার রহস্য জানার জন্য রূপা খুব উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। উত্তরের অপেক্ষায় থাকে নি,চলে গেছিল নিজের কাজে। কিন্তু ভাবনাটা মনসিজকে পেড়ে ফেলল একেবারে। কেন আত্মহত্যা করেছিল অঙ্কুশ? পঁচিশ বছরের পুরনো ছবি দেখে যদি বোঝা যায়, ছেলেটার কিছু হয়েছে, সামনাসামনি থেকেও ওরা কেন বুঝল না কিছু হতে চলেছে? বুঝলে হয়তো অঙ্কুশকে বাঁচান যেত। চিন্তাটা গোলগোল ঘুরছিল মনের মধ্যে। এক ভাবনা থেকে আরেক, মানুষের মন যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকে।  

খানিক বাদে রূপা এসে দেখল ওই একইভাবে বসে আছে মনসিজ। কি ব্যাপার বলো তো? পঁচিশ বছর আগে কি হয়েছে, কে মারা গেছিল যেটা এই ছবি না দেখলে তোমার মনেও পড়েনি, সেটা নিয়ে সারা সন্ধ্যে কাটিয়ে দেবে নাকি?  

না আসলে তুমি যেই বললে না, সবাই হাসছিল শুধু ওর চোখের চাহনিটা অন্যরকম ছিল তখন আমার কি মনে হল জানো তো –

কি? 

এই যে ফেসবুকে রোজ এতো ছবি দেখি। অত খেয়াল করে তো দেখি না। সবাই হাসছে এরকমই তো মনে হয়। আর একটু খুঁটিয়ে দেখতে পারলে, হয়তো বোঝা যাবে কারো মনে কোন কষ্ট আছে কিনা। কে জানে আমাদের কোন পরিচিত লোক হয়তো আত্মহত্যার কথা ভাবছে। 

তুমি এখন ফেসবুকে সবার ছবি উলটে পালটে দেখবে সকলের মনের অবস্থা বোঝার জন্য? রূপা আকাশ থেকে পড়ল একেবারে। 

দেখছিলাম জানো। গত এক ঘন্টা ধরে এইতো করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম না। সবার চোখই তো বেশ উজ্জ্বল, ঝকঝকে চোখে ক্যামেররা দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ পাহাড়ে, কেউ সমুদ্রে। বিয়েবাড়িতে কিংবা নিজের বাড়ির বারান্দায়। একা কিংবা দলবেঁধে। যেখানেই হোক, যার সঙ্গেই হোক ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে নেয়নি একবিন্দু, মুখে হাসিও ধরে রেখেছে। কিরকম বিভ্রান্ত লাগে মনসিজের। আমরা কি অনেক বেশি সুখী আসলে, কেউ তাহলে আত্মহত্যা করছে না আর? কিংবা – হঠাত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মণসিজের চোখ। আমার কি মনে হয় জানো, কম বয়সে লোকে বেশি সুইসাইড করে। ওই সময় কিছু চাওয়ার জেদ আর না পাওয়ার দুঃখটা অনেক বেশী। এই আমাদের মত যারা, আমাদের বন্ধু বান্ধব সবাই তো এইরকম বয়সী। আমাদের হলে হার্ট অ্যাটাক হবে, আত্মহত্যার সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি।  

করলে কি সেটা ফেসবুকে এসে পোস্ট দিয়ে যাবে? আত্মহত্যার কোন বয়েস নেই বুঝলে। এইতো গেল মাসে রনিতার বাবা সুইসাইড করল, কলকাতায়। ওনার বয়েস হয়েছিল চুয়াত্তর।   

থমকে গেল মনসিজ। তার মানে বলছো সব বয়েসেই এই রিস্কটা আছে। শুধু ছবি দেখেই কিছু বোঝা যাবে না তাহলে। আরও গভীরে যেতে হবে। বুঝলে, মানুষের বিষয়ে আর একটু বেশি খোঁজ খবর নেওয়া উচিত আমাদের। একটু তলিয়ে। বলতে বলতে হঠাত চমকে উঠল মনসিজ। একটা কথা মনে পড়ে গেল গো। জানো নীপা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল অঙ্কুশের কথা। কি হয়েছিল, আমরা কোন ভিতরের খবর জানি কি না। নীপা ছিল আমাদের ক্লাসমেট। ওর সঙ্গে কোন প্রেমঘটিত ব্যাপার ছিল হয়তো?  

আচ্ছা মেয়েটা জিজ্ঞেস করেছে তো কি অন্যায় করেছিল? সেই সময় না ছিল ফেসবুক, না মেল। তোমরা দূর দূর থেকে এসে সবাই হস্টেলে আছো। হঠাত একজন ফিরল না, আর কোনদিন ফিরবে না। জিজ্ঞেস করতে পারে না? সুইসাইড করলেই তার পিছনে কোন মেয়ে থাকবে? স্টিরিওটাইপ!

রূপা ঘোষণা করে চলে গেল, কিন্তু মনসিজের তবু মনে হল নীপাকে খুঁজে পেলে হয়তো কোন হদিশ পাওয়া যাবে।  

নীপার সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না, যদিও ওদের ক্লাস মেট। আসলে কে যে কোথায় চলে গেছে, সবার খোঁজ কি রাখা যায়। তখনকার দিনে ওটা সহজ ছিল না। ফেসবুকে একটা সার্চ লাগাল মনসিজ। নীপার কি পদবী ছিল মনে নেই, ফেসবুক ঘাঁটতে অনেক নীপা উঠে এলো। তবে ছবি দেখে বুঝে গেলো। নীপা হালদার। মেসেজ পাঠালো – চিনতে পারিস? কেমন আছিস নীপা?

এই মেসেজের উত্তর আসতে পনেরোদিন লেগেছিল। তার মাঝখানে শৈবালের সঙ্গে কানেক্ট করেছিল মনসিজ। ফোনে। আমরা কেন বুঝতে পারলাম না রে ফুচু? তাহলে হয়তো ওর মরে যাওয়াটা আটকাতে পারতাম।

শৈবালের বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। এতো বছর পরে এসব কথা উঠছে কেন? মৃত্যুচিন্তা এলো নাকি রে? তারপর নিজেকে সমব্যাথী বোঝাতে জোরে শ্বাস টেনে বলল, আটকানো যায় না রে। অভিজিত সুইসাইড করল, পারলাম কি আটকাতে?  

শৈবাল আর মনসিজ যখন পার্দু ইউনিভারসিটিতে পড়তে এসেছিল, তখন অভিজিতও ছিল সেখানে। যদিও অভিজিত ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নয়, ফিজিসিস্ট। ওরা যখন এসেছিল, অভিজিত পিএইচডি করছিল। 

আসলে ওর দেশে ফিরে যাওয়াটা আটকাতে পারলেই হয়তো বেঁচে যেতো। 

ও যাওয়ার আগে তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল? 

হ্যাঁ, ও তো ইন্ডিয়ানায় পড়াতো। আমি গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করতে, ফিরে যাওয়ার দিন পনেরো আগে। 

ওর মধ্যে কিছু দেখেছিলি যাতে মনে হয় –

কি দেখবো?

মানে কোন সুইসাইড টেন্ডেন্সি?

কি বলছো গুরু! ফিরে যাওয়ার দু বছর বাদে সুইসাইড করেছিল, এতদিন আগে থেকে কি করে বোঝা যাবে? শৈবালের গুরু সম্বোধনেই বোঝা যায় ও এখন মনসিজকে নিয়ে কলেজ জীবনের কায়দায় খিল্লি করছে। 

মনসিজ সেসব গায়ে না মেখে আবার অঙ্কুশে ফিরে এলো। আচ্ছা, অঙ্কুশ যখন মারা গেল তখন তো আমরা এতো জাপটা জাপটি করে থাকতাম – তোর রুম মেট ছিল ও হস্টেলে। তুই কিচ্ছু বুঝিস নি? 

ফোনের ওধারে শৈবালের গলার স্বরটা অস্পষ্ট হয়ে গেল। এতবছর পরে এইসব ডিটেলস কি মনে থাকে রে ঢোলা। মুখে বললেও ভাবনাটা চাড়িয়ে যাচ্ছিল শৈবালের মনে। আমতা আমতা করে বলল, একটা অদ্ভূত কথা হঠাত মনে পড়ল রে। এখন মনে হচ্ছে অথচ আগে কক্ষনো ভাবিনি।

একটা সূত্র পাওয়ার আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠল মনসিজ। শৈবালকে উৎসাহ দিল, বল না বল। নাথিং ইস স্মল অর ইনসিগনিফিক্যান্ট। 

এত বছর আগের ব্যাপার, অঙ্কুশ মারা যাওয়ার দুঃখটা ফিকে হয়ে গেছে কবে। শৈবালের গলায় সুরটা তাই হালকা, যাব্বাবা! তুই তো শার্লক হোমসের মত কথা বলছিস রে ঢোলা। এতদিন বাদে এসব জল ঘুলিয়ে কি লাভ বল তো? 

মনসিজের মনে হল শৈবাল যেন জাল কেটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। হয়তো ওর কোন ভূমিকা ছিল, তাই বলতে গিয়েও এখন চেপে যাচ্ছে। সুর পালটে গলাটা এবার মিহি করল, জানতে না পারলে আমার রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছে রে ফুচু। জানিনা কেন এমন হচ্ছে, বেশ তো ভুলে ছিলাম এতগুলো বছর। 

আচ্ছা, আচ্ছা বলছি। সেরকম কিছু ব্যাপার না। মাথাটা তো একটা অদ্ভূত জায়গা, কখন যে কোন স্মৃতিটা উপরে উঠে আসে! তুই তো জানিস আমি লাল হলুদের পাঁড় সাপোর্টার ছিলাম। অঙ্কুশ ছিল মোহনবাগানের। একেবারে কট্টর যাকে বলে। আমরা যেদিন দীঘা যাচ্ছিলাম, তার আগের দিন ছিল আই এফ এ শিল্ডের ম্যাচ। আমরা জিতলাম একগোলে। হস্টেলের কমনরুমে খেলা দেখছিলাম, হইহল্লা করেটরে ঘরে ফিরলাম। জানিনা অঙ্কুশ কোথায় ছিল। অনেক বাদে যখন ফিরল মুখচোখ কেমন একটা ছিল।

শৈবালকে বলেনি, কিন্তু মনসিজ নোট নিচ্ছিল। যেন অফিসের কোন মিটিং। সেটায় আর একবার চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, তার মানে তুই বলছিস একটা ফুটবল ম্যাচে প্রিয় দল হেরে যাওয়ায় সুইসাইড করেছিল? কেমন বিশ্বাসযোগ্য লাগছিল না মনসিজের। যাঃ! এরকম হয় নাকি? অবশ্য ব্রাজিলে হতে শুনেছি, ওরা যেরকম ফুটবল পাগল। 

না, না আমি তা বলিনি। অঙ্কুশকে আমি যখন ম্যাচের রেজাল্ট নিয়ে লেগপুল করতে গেলাম, ও কেমন অদ্ভূত চোখে আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেছিল, তাই নাকি? আজ বুঝি ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা ছিল? তুই ভাব ঢোলা। সেই যুগে যখন টিভিতে ইংলিশ ফুটবল লিগের খেলা দেখানো শুরু হয়নি, আমাদের কাছে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের ম্যাচ কিরকম ছিল। আর অঙ্কুশ, যে ছেলে কিনা মোহনবাগানের সঙ্গে বাটার খেলা থাকলেও রেডিওতে রিলে শুনতো – বুঝতে পারছিস আমি কি বলছি? বলতে বলতেই কেমন গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল শৈবালের। কিরকম অদ্ভূতভাবে একটা কোন কালের ধূসর সন্ধ্যা জাগ্রত হয়ে উঠেছে ওর মনে, যেন হাত বাড়ালেই খাকি হাফ প্যান্ট আর নীল চেক শার্ট পড়া হলহলে লম্বা অঙ্কুশকে ছুঁয়ে ফেলতে পারবে। 

ফোনের অন্য ধারে কথাটা ধরতে পেরেছে মনসিজ। তার মানে তুই বলতে চাইছিস, জীবনের দৈনন্দিন আনন্দের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা আলগা হয়ে গেছিল। বলতে বলতেই নোটবুকে খসখস করে লিখে ফেলল– ইন্ডিফারেন্ট। তারপর শব্দটার চারপাশে একটা গোল পেন্সিলের রেখা টেনে দিল। 

সেটাও হতে পারে, অথবা সামথিং মোর ইম্পর্ট্যান্ট মে হ্যাভ হ্যাপেনড। যার জন্য এইসব ফুটবল ম্যাচ ট্যাচ আর সেরকম টানছিল না ওকে। এখন শৈবালের গলা ক্লান্ত শোনাচ্ছিল, ও আর এই বিষয়ে কথা চালিয়ে যেতে চাইছিল না। সেই সন্ধ্যাটাকে আবার অতীতের গহ্বরে ফেরত পাঠাতে চায়। ছেড়ে দে ঢোলা, এতবছর বাদে এসব আর ঘাঁটাঘাঁটি করে কি হবে!   

শৈবাল রেখে দিল, কিন্তু মনসিজ ছাড়তে পারল না। নোটবুকে ওর এখন তিনটে এন্ট্রি – অঙ্কুশ, অভিজিত, রনিতার বাবা। অঙ্কুশের নামের নীচে লিখল – 

১। ক্যামেরার দিকে সোজাসুজি তাকায় নি। 

২। রোজকার ঘটনায় নির্লিপ্তি।  অথবা অন্য কোন বড় ঘটনা ঘটেছে? 

অভিজিতের ব্যাপারটা এখনো তেমন কিছু জানতে পারেনি। শুধু লিখল –

১। দেশে ফিরে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ? 

রনিতার বাবার বিষয়ে তো কিছুই জানেনা, ভদ্রলোককেই তো চিনতো না। কিন্তু অনুমান করে লিখে ফেলল –  

১। বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা? রূপাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, রনিতার মা কবে মারা গেছিলেন।   

সব কটা কেস নিয়েই আরও খোঁজ নিতে হবে। অভিজিতের ব্যাপারটা নিয়ে জানতে মনসিজ রূপাকে ধরল আবার। ইন্ডিয়ানায় রূপার মাস্তুতো দিদি থাকে। যদি কিছু খবর জানে।  

রূপা এইসব কথায় খুব বেশি উৎসাহ পাচ্ছিল না। মোবাইলে স্ক্রল করতে করতে হ্যাঁ হুঁ দিয়ে চালাবার চেষ্টা করছিল। পাত্তা না দিলে মনসিজ আবার টসকে যাবে। তাই চোখের কোনায় উতসাহের অন্তত একআধটু ঝিলিক অবশিষ্ট আছে এই ভরসায়, থুতনির নিচে ডান হাতের মুঠি পাকিয়ে মুখটা সামনে বাড়িয়ে রেখেছিল। মাথায় অন্য কথা ঘুরলেও মুখে একটা হাল্কা হাসি – বেশি নয়, ধরে রাখা ছিল। মনসিজ পুরনো দুঃখের পরত খুলে খুলে দেখছে, তার সঙ্গে যতটা মানানসই।   

কিন্তু মনসিজ নাছোড়বান্দা। পারবে না রূপা? প্লিজ। 

আর বেশী ছেড়ে খেললে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাবে। তাই রূপা এবার মনসিজকে সংযত করার চেষ্টায় মোবাইল সরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই শোনো, কি হয়েছে বলোতো তোমার? কে কোথায় মরেছে, তাও আজকে নয়, কতগুলো বছর হতে চলল। তোমার সে সবের হাল হদিশ জানার এতো কি প্রয়োজন? গভীরভাবে কিছু ভাবলেই রূপার চোখের দৃষ্টিটা ধারাল হয়ে যায়। যেন একটা এক্সরে মেশিন। 

মনসিজ কি ভাবে বোঝাবে ভাবছিল। এই কথাটা বোঝানো মুশকিল। ও মানুষের মনের গোপন দুঃখ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। না, কথাটা ঠিক তা না। নিজেকেই সংশোধন করতে চাইল মনসিজ। এই যে অঙ্কুশের ছবিটা দেখল, যদি আগে একটু ভাল করে দেখত, মানে অঙ্কুশ সুইসাইড করার আগে তাহলে হয়তো কোনভাবে ওর সঙ্গে কথা বলে আটকাতে পারত। যদি বুঝত –

রূপা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। কি করতে চাও তুমি? সাইকিয়াট্রিস্ট হবে? 

আহা, তা কেন? দেখো না আজকাল সবাই ফেসবুকে ছবি দেয় এতো। ভাল ভাল ছবি, কত রকমের কমেন্ট দেয় ফেসবুকে। কেউ আবার এসব দিতে দিতে হঠাত একদিন চুপ করে যায়। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি? যদি ছবি দেখে বা কোন লেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া কোন এক্সপ্রেশান অ্যানালাইজ করে বোঝা যায় কেউ এরকম কিছু করার কথা ভাবছে –

রূপা মনসিজের পাশে এসে বসল। চলো আমরা ঘুরে আসি কোথাও কটা দিন? তুমি বড্ড বেশি ভাবছ এইটা নিয়ে। প্রতিটা মানুষ আলাদা, ওইভাবে কিছু বোঝা যায় নাকি? আস্তে আস্তে মনসিজের চুলে আঙ্গুল চালাচ্ছিল রূপা। এমা, তোমার চুলগুলো কিরকম পেকে যাচ্ছে দেখো। গলায় একটা উচ্ছলতা ঢেলে দিতে চাইছিল রূপা। ডাই করো না কেন?

কিন্তু ভাবনাটা ছাড়ল না মনসিজকে। 

এর মধ্যে নীপার মেসেজ এলো। ইনবক্সে উচ্ছসিত। কত বছর বাদে রে, কি করে পেলি আমাকে? 

আরও দুই একটা মেসেজের পরে ফোন নাম্বারটা পেয়ে যেতেই মনসিজ একদিন অনেক রাতে ফোন করল নীপাকে। নীপা থাকে কলকাতায়, ওর তখন সকাল।

কি রে অফিসে নাকি? মনসিজ এমনভাবে কথা শুরু করল যেন এই তো গেল সপ্তাহে দেখা হয়েছে নীপার সঙ্গে।

ও মাই গড মনসিজ, সিমস লাইক আ লাইফ টাইম। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।

নীপার সঙ্গে যে খুব কিছু মাখামাখি ছিল কলেজ লাইফে সেরকম নয়। তবু ওর উচ্ছ্বাসটা খুব ছুঁয়ে গেল মনসিজকে। নিজের গলাটা নিজের কানেই ভেজা ভেজা শোনাল। এতো বছর পরে কথা বলতে গিয়ে প্রথম দিনেই অঙ্কুশের কথা তোলা ঠিক হবে কিনা ভাবছিল। কিন্তু ঝাড়া পনেরো মিনিটে পঁচিশ বছরের মাইলস্টোনগুলো বাঁটোয়ারা হয়ে যাওয়ার পরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল মনসিজ।

অঙ্কুশকে মনে আছে রে নীপা?

এতক্ষণের ঝরঝরে কথার ট্যাপটা কেউ যেন ঝটিতি বন্ধ করে দিল। থমকে গেল নীপা। হোঁচট খাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, হঠাত অঙ্কুশের কথা? মনে ছিল না, তবে কোন কথাই কি আমরা একেবারে ভুলে যাই? 

এরপর কিছু একটা বলবো বলবো গোছের নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ। আসলে নীপা কি বলবে সেটা ভাবছিল, মানানসই কোন কথা। তারপর সেরকমভাবে কিছু মনে করতে না পেরেই হয়তো বলল, মনে আছে। শান্ত ছিল ছেলেটা, নাইস।   

মনসিজ সাফাই দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আসলে বুঝলি কি হল – শৈবাল, মনে আছে তো ওকে? আমাদের কলেজ লাইফের একটা ছবি পোস্ট করেছিল, ওখানে অঙ্কুশকে দেখে পুরোন কথা মনে পড়ে গেল। 

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে আমি তোর টাইমলাইনে গিয়ে দেখেছিলাম ছবিটা। তোরা ছেলেরা ছেলেরা গিয়েছিলি বোধহয় দীঘাতে। নীপার গলাটা আবার একটা সরলরেখায় ফিরে আসছিল। 

মনসিজ সোজাসুজি জিজ্ঞেস করতে পারছিল না তুই কেন আমার কাছে ওর না আসার কথা জানতে চেয়েছিলি রে নীপা। বরং এবার সত্যিই গোয়েন্দাদের মত চুপিসারে সেই কথায় ঢুকতে চাইল। আসলে জানিস কি, ওর ছবিটা দেখে মনটা কেমন হুহু করে উঠল। বারবার ভাবছি, কি হয়েছিল ছেলেটার? আমরা কেউ কেন বুঝতে পারলাম না এত বড় একটা স্টেপ নিতে যাচ্ছে ছেলেটা। তাই বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞেস করে দেখছি, আমি তো বুঝিনি। আর কেউ কি বুঝতে পেরেছিল?

তোরা ওর ক্লোজ ছিলি। ফার্স্ট ইয়ারে তোদের সঙ্গে আমার অত আলাপও ছিল না। আমি কি করে জানব বল? 

আসলে কি জানিস নীপা, কিন্তু কিন্তু ছেড়ে এবার ঝেড়ে কাশল মনসিজ। তোর মনে আছে কিনা জানি না, কলেজ খোলার পরে ও যখন ফিরল না, আর আমরা খবর পেলাম অঙ্কুশ সুইসাইড করেছে, তুই আমাকে এসে জিজ্ঞেস করেছিলি আমি কিছু জানি কিনা। বলতে বলতে কত বছর আগেকার দিনটা পুরানো বইয়ের হলদে পাতার মত খুলে গেল যেন চোখের সামনে। মনসিজের স্পষ্ট মনে পড়ে গেল নীপা বেশ আড়ালেই কথা বলতে এসেছিল। নীপা, মনিকা, সুদেষ্ণা ওরা তো সব সময়ে একসঙ্গেই থাকত। কিন্তু এই কথাটা নীপা একা বলতে এসেছিল। কেন?

নীপা একটু চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর যখন কথা বলল, গলার স্বর একটু ভেজা। একটা অদ্ভূত ঘটনা হয়েছিল জানিস? গরমের ছুটিতে যাওয়ার শেষদিন হঠাত অঙ্কুশ এসে ক্লাস নোটের একটা খাতা দিল। বলল এটা সুদেষ্ণাকে দিয়ে দিবি? আমি পিকেটির নোটসের জন্য নিয়েছিলাম, ওকে ফেরত দেওয়া হয়নি। আমি বললাম, বেশ তো তুই নিজেই কেন দিয়ে দিচ্ছিস না। তখন ও ওর সঙ্গের ব্যাগ দেখাল। আমাকে এখুনি বেরিয়ে যেতে হবে, তা না হলে ট্রেন মিস করবো। না হলে আমিই দিতাম। বলেই হ্ন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। 

দিয়েছিলি খাতাটা সুদেষ্ণাকে? 

না। মানে দিতে গেছিলাম। সুদেষ্ণার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি সেদিন, কিংবা দেখা হলেও মনে ছিল না। দিন পনেরো বাদে মনে পড়তে ওকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু অবাক কান্ড, সুদেষ্ণা হেসে উড়িয়ে দিল। ধুর, আমি তো ওকে কোন নোটস দিই নি। 

তাহলে? কার ছিল ওই নোটবুকটা? রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় মনসিজের কেমন দমবন্ধ লাগছিল।  

নীপার গলার স্বরে দ্বিধা। বলবে কি বলবে না ভাবছে যেন। অনেক রাত হয়ে গেছিল, রূপা শুতে এসে মনসিজকে জেগে থাকতে দেখে অবাক। কিন্তু ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ওকে থামাল মনসিজ। কারন নীপা আবার বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই খাতার কথা না বলে জিজ্ঞেস করল, তুই কি এই জন্যেই আমাকে এত বছর বাদে ফেসবুক খুঁজে বার করলি মনসিজ? 

মনসিজ কিছু বলার আগেই ঠক করে ফোনটা রাখার আওয়াজ পেলো অন্যদিকে। লাইন কেটে গেল নাকি রেখে দিল? নীপা কি রেগে গেল?  

রূপা কে আর আটকে রাখা যাচ্ছিল না। কি শুরু করেছ বলো তো এতো রাত্তিরে? আবার সেই সুইসাইডের পিছনে পড়েছ তুমি? 

মনসিজ কিছু বলার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠল। নীপা। বলল লাইনটা কেটে গেছিল রে। কিন্তু গলার স্বরটা কেমন ভারি হয়ে গেছে, এই একটু আগের উচ্ছলতা শুষে নিয়েছে যেন কেউ।  আমি কোনদিন কাউকে বলিনি মনসিজ। সুদেষ্ণার সঙ্গে কথা হওয়ার পরে সেই প্রথমবার আমি ওই নোটবুকটা খুলে দেখেছিলাম। 

কার ছিল নোটবুকটা? 

সব পাতা সাদা। কিচ্ছু লেখা নেই। 

সাদা খাতা? এটা কিরকমের ধাঁধা?

শুধু সেই খাতার প্রথম পাতায় মার্জিনের উপরে একটা ফোন নাম্বার ছিল।

অঙ্কুশের নাম্বার? 

জানি না, আমি তো ফোন করিনি। কেমন অসহায় শোনাচ্ছিল নীপার গলা। প্রায় ফিসফিস করে বলল, এতো শান্ত, ভাল ছেলে ছিল একটা। মনসিজের মনে হল নীপা বোধহয় এবার কেঁদেই ফেলবে। স্বস্তি পেল যখন নিজেকে সংযত করে কথায় ফিরে এলো। নিজের ভাবনাকে গুছিয়ে তোলার চেষ্টাতেই হয়তো আবার করে বলল, এতো শান্ত, ভাল ছেলে ছিল একটা। আমার সঙ্গে কোনদিন সেরকম ভাবে কথা হয়নি ওর। মাঝে মাঝে লুকিয়ে চুরিয়ে যেন দেখত আমায়, কোনভাবে আমাকে বিরক্তও করেনি তাই বলে। কেন এরকম একটা মজা করল আমার সঙ্গে এটা ভেবে বিরক্ত লেগেছিল। ভেবেছিলাম কলেজ খুললে আচ্ছাসে দেবো ওকে। তারপর কলেজ খুলল –  

তুই যদি ফোন করতিস, হয়তো ও চাইছিল তুই ওকে ছুটিতে ফোন কর –

কেন, আমি কেন? নীপার গলা উঁচু পর্দায় চড়ছিল এবার। আমার সঙ্গে ওর কিসের সম্পর্ক ছিল? 

না না সেজন্য নয়, হয়তো কোন দুঃখের কথা তোর সঙ্গে শেয়ার করতে চাইছিল। সেটা করতে পারলে আর ও হয়তো এরকম – এক ঝটকায় থামিয়ে দিল ওকে নীপা। গলা চিরে গেছিল ওর এতক্ষণে। তোরা ওর বন্ধু ছিলি, আমি তো ছিলাম না। তবে কেন আমাকে দিয়ে গেছিল ওর ফোন নাম্বার, আমি কি হাত গুনতে জানতাম? 

মনসিজ বলতে গেছিল, তুই রাগ করিস না নীপা। কিন্তু সেটা শোনার আগেই ঠক করে ফোনটা রেখে দিল। এবারের লাইনটা কেটে দেওয়ার মধ্যে কোন দ্বিধা ছিল না, তাই মনসিজ কলব্যাক করার কোন চেষ্টা করল না। বরং বেডসাইডের টেবিল থেকে নোটবুকটা খুলে অঙ্কুশের নামের নিচে দুটো এন্ট্রি করল-

৩। অঙ্কুশ কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু নীপাকেই কেন? কোন কথা কি শুধু অপরিচিতদের বলা যায়?

৪। সঙ্কেত দিয়ে যায় মৃত্যুমুখী মন 

তিন নম্বর মন্তব্যে অপরিচিতদের কথাটার নিচে আন্ডার লাইন করল। চার নম্বর মন্তব্যে সঙ্কেতের চার পাশে গোল করে দাগ কাটল মনসিজ। এটা যেন প্রমান করে তার ধারনা। সঙ্কেত পাওয়া যায়, সেটা ধরতে পারলে আটকানো যায়। এতক্ষণ রূপা শুধু একদিকের কথা শুনতে শুনতে ছটফট করছিল। নোটবুকে টান দিয়ে বলল, কি হচ্ছে সেটা আমায় বলবে? 

মানুষের মন কিভাবে যে কোন পথে চলে! পুরোটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপা। 

কিন্তু একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সেটা তো স্বীকার করবে? একটা এস ও এস। বেশ উত্তেজিত লাগছিল মনসিজের। 

কিন্তু তুমি খামোকা তোমার এই বন্ধু – নীপা না কি নাম, ওর মনে খুঁচিয়ে ঘা করলে।   

মনসিজ শুরুতে সেটা নিয়ে একটু লজ্জিত ছিল। কিন্তু পরদিন ফেসবুকে নীপার একটা পোস্ট দেখল। লাল শাড়িতে, কোন বিয়েবাড়ির ছবি। ওর কোন বন্ধুর লাল শাড়ি চ্যালেঞ্জের খেলা শুরু করেছিল ফেসবুকে, তার জের। মনসিজের সঙ্গে কথা হওয়ার সাত ঘণ্টা বাদে। হিসেব করে দেখেছিল মনসিজ। ঘা ফা কিচ্ছু হয়নি, এইতো বিন্দাস ছবি দিয়েছে।  

নীপাকে আর ফোন করেনি মনসিজ। কিন্তু রূপা হেল্প করতে রাজি হল। বলল রনিতাকে ফোন করে জানবে ওর বাবার ব্যাপারটা। মাসখানেক আগেই তো হয়েছে, ব্যাপারটা এখনো টাটকা। 

স্পীকারে রেখে কথা বলবে? আমি একটু শুনবো? আবদারি ভঙ্গী মনসিজের গলায়। 

যাঃ! এরকম কেউ করে নাকি? রন্তি বুঝতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। 

রনিতার বাবাকে চিনতাম কি আমরা? খেয়াল করতে পারছিল না মনসিজ। 

আসেন নি নাকি গত দশ বছরে সেরকম। তার আগে এসে থাকবে, তখনো আমার সঙ্গে রন্তির অত আলাপ ছিল না। 

তুতিয়ে পাতিয়ে রাজি করানো গেল রুপাকে। কোনরকম শব্দ করবে না কিন্তু! হাঁচি কাশি কিচ্ছু না। জানাজানি হলে কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না। যাও তো, একটু দূরে বসেই শোনো। না হলে তোমার ফোঁসফোঁস নিশ্বাসের শব্দ যদি শোনা যায়? 

রূপা ফোন স্পীকারে করল, মনসিজ বাধ্য ছেলের মত দরজার কাছ ঘেঁষা ফুটনটায় বসল। নোটবুক আর পেন্সিল হাতে, কিন্তু রূপাকে নিশ্চিন্ত করতে চোখ রাখল ডেকে, ভাবখানা এমন রবিবারের সকালের পাটভাঙ্গা রোদে বাগানে কাঠবেড়ালির গোল্লাছুট দেখছে। কান যদিও রূপার ফোন থেকে ছিটক বেরোনো প্রতিটা শব্দে।  

রূপা সন্তর্পণে কথা পাড়ল। হ্যাঁরে রন্তি, সব কাজ মিটে গেল? 

ও মা তোমার সঙ্গে কথা হল যে দেশ থেকে ফেরার পর। শ্রাদ্ধশান্তি চুকিয়েই তো এলাম। আমার দাদা তো কলকাতাতেই থাকে, বাদবাকি দাদাই দেখে নিচ্ছে।

তোর বাবা বুঝি দাদার সঙ্গেই থাকতো? এই কথাটাও খুব আলগোছে ছাড়ল রূপা। মনসিজ মনে মনে বাহবা দিল, একেবারে ওয়াটসন হবার দিকে এগোচ্ছে।

না, না বাবাকে আনতে পারলে তবে না। বাবা থাকতো সেই ডানকুনিতে। বলতো ওই বাড়িতে এত স্মৃতি, কার কাছে ছেড়ে আসবে। মাও তো ওই বাড়িতেই – রনিতার কথাগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছিল এইখানেই। এক বছরের মধ্যেই বাবা মা দুজনকে হারিয়েছে বেচারি। বোঝে রূপা। তাই ফোনের অন্যপ্রান্তে চুপচাপ ওকে সময় দিচ্ছিল। রনিতা গলা নিজের বশে আনতে আনতে বলল, এমন কিছু দূরে নয়, দরকার পড়লেই ছুটে যেতে পারত দাদা। আমরাও সেই ভরসাতেই ছিলাম। 

তোমার বাবা খুব সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট ছিল তার মানে। 

কিংবা ছিল না। না হলে মা মারা যাওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি কেন নিজে থেকে চলে যাবে বলো? জেদ, শুধু জেদ করে করে নিজের মৃত্যু এমনভাবে ডেকে আনল বাবা। রাগ ঝলসে উঠল এবার রনিতার গলায়। যেন রূপা ছাইয়ের গাদা খুঁচিয়ে আগুন উসকে দিয়েছে। আমরা কি মরে গেছিলাম? নাকি বাবার দেখভাল করতে অস্বীকার করেছি কোনদিন? তুমি জানো না রূপাদি, আমি আর দাদাই কতবার বুঝিয়েছি বাবাকে। শুনলে তো! একা একা থাকবে। কোথাও যাবেও না। এমন নয় যে বাবার অনেক বন্ধু বান্ধব ছিল, তাসের আড্ডা ছিল। কোন সামাজিক কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকতে দেখিনি কক্ষনো। লোকে কি ভাবে বলো তো? আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি না হয় দূরে থাকি। বলে বলে বাবাকে আনাতে পারিনি গত দশ বছরে। কিন্তু দাদাই? ওর বাড়িতেও পা ফেলতো কালেভদ্রে। লোকে তো বলতে ছাড়বে না। যে কি রকম সব ছেলে মেয়ে, বাবা মাকে দেখে না!

একা থেকে বাবা মারা গেছে না কি লোকের কথা – কোনটাতে বেশি দুঃখ রনিতার সেটা কেমন মিলেমিশে যাচ্ছিল মনসিজের কানে। 

তোমরা আগে থেকে কিছু বুঝতে পারো নি, তাই না?

এখানে থমকালো রনিতা। জলের তলায় ডুব সাঁতারে যাওয়ার আগে যেমন দম নিয়ে নেয় লোকে, তারপর ডুবুরির মত শ্বাস চেপে খুঁজে বেড়ায় হারানো জিনিস। জল থেকে উঠে এলে হাতে কি পেলো দেখার আগে প্রথমে ভুস করে হাওয়া খুঁজে বুড়বুড়ি কাটে।  এত দূর থেকে কি বোঝা যায় রূপাদি? যতই ভিডিওতে চলতে ফিরতে দেখো না, ছোঁয়া তো যায় না মানুষকে। 

গলাটা এরপরেই খাদে নাবল রনিতার। প্রতি শনিবার বাবার সঙ্গে স্কাইপ করতাম, নিয়ম করে। নাতি নাতনির সঙ্গে কথা বলতো বাবা। সেদিন হঠাত বুধবারে বাবার ফোন এলো। করে না বাবা এমন। আমাদের সকাল তখন, মানে সবাই অফিসে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি ভাবলাম শরীর খারাপ বুঝি। বলল, তোকে বলতে ভুলে গেলাম সেদিন। আমাদের বাড়ির কোনায় কাঠগোলাপ গাছটা মনে আছে রে খুকি? তোদের মা নিজের হাতে পুঁতেছিল। গত দুই বছর ফুল হয়নি এক ফোঁটা। এইবার আবার- 

তোর বাবা বাগান করত বুঝি খুব?

সেরকম কিছু নয়, ছোট উঠোন। কয়েকটা গাছ ছিল। রনিতা বাবার নিজের থেকে ফোন করার বিস্ময়টা উলটে পালটে দেখছিল তখনো। রূপাদি, ফোন তো আমরাই করতাম। বাবা কোনদিন নিজে থেকে করেনা। সেদিন ফুলের খবর দিতে ফোন করেছিল। জ্যোতস্নায় নাকি সেই কাঠগোলাপের গাছ ভেসে যাচ্ছিল একেবারে, বাবা না ঘুমিয়ে গভীর রাতে জানালা খুলে তাই দেখছিল। ফেস টাইম করে আমাকেও দেখাতে চাইল, হয় নাকি? আমার কাছে তো সব কেমন অন্ধকার ঠেকল। বাবার এত খুশিঝরা গলা আমি শুনিনি আগে। অথচ শনিবার ভিডিও কলের আগেই – এবার হাপুশ হুপুশ করে কাঁদছিল রনিতা।

রন্তি, রন্তি! এমন করে না সোনা। তুই কি করে জানবি বল? রূপা হাত নেড়ে মনসিজকে ওখান থেকে যেতে বলল। কারো এরকম দুর্বল মুহূর্তে এরকম ওঁত পেতে বসে শোনাটা ভাল দেখায় না। মেয়েটা জানতে না পারলেও। মনসিজ তাই ডেকে বেরিয়ে গিয়ে বেতের চেয়ার টেনে বসল। নোটবুকে রনিতার বাবার নামের নিচে লিখল

২। সঙ্কেত ছিল। কিন্তু বোঝা যায় না। 

সঙ্কেত শব্দের নিচে আন্ডারলাইন করল। তারপর লিখল 

৩। ফুলের মধ্যে দিয়ে রনিতার মাকে ফিরে আসতে দেখেছিলেন উনি? 

রূপা ফোন রেখে দরজা ঠেলে আসতে সেই কথাটাই বলেছিল মনসিজ। স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন ভদ্রলোক, বুঝলে? হয়তো ওনার জীবনে রনিতার মাই ছিলেন অ্যাংকর। খুব কল্পনাপ্রবন হয়ে যাচ্ছিল মনসিজ। কে জানে, ওই জ্যোতস্না রাতে ভেসে যাচ্ছিল কাঠগোলাপের ঝাড় আর ওকে তীব্র আকর্ষণে হাত বাড়িয়ে ডেকেছিল, আসো, আসো আবার আমরা একসঙ্গে হই। কে জানে সেই ফোন করার পর থেকে রোজ রাতে হয়তো ওইভাবে বসে থাকতে থাকতেই বাস্তব জীবনের থেকে সরে সরে যাচ্ছিলেন।  

রন্তি কি বলল জানো? 

রূপার কথায় এমন শীতল শনশনে হাওয়া জড়ানো ছিল যে নিজের ভাবাবেগ থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে এলো মনসিজ।  

তুমি আসার পর ওকে শান্ত করলাম, কথা ঘুরাতে জিজ্ঞেস করলাম বাবা তো একা থাকতো। এখন ওদের ওই ডানকুনির বাড়িটার কি হবে? বলল সেইসব কথা নাকি সব পাকা হয়ে গেছে। ইন্ডিয়া থেকে ফেরার আগেই দলিল পত্রে সইসাবুদ করে এসেছে। বিক্রি করে দিচ্ছে, ওখানে কোন কন্ডো হবে, মানে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স।

কতদিন ছিল ও কলকাতায়? শ্রাদ্ধ শান্তির মাঝখানে এত তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা হয়ে গেল? নিজের একটা ফ্ল্যাটবাড়ি বিক্রি করেছে মনসিজ এদেশের সিটিজেন হওয়ার পরে। সময় লাগে বেশ, আজকাল আবার রিয়াল এস্টেট মার্কেট একটু ডাউন চলছে। 

ওর দাদা নাকি গেল বছর থেকেই এইসব কথা বার্তা শুরু করেছিল ডেভেলপারদের সঙ্গে। ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে ন্যাশানাল হাইওয়ে হওয়ার পরেই জায়গাটার দাম চড়চড় করে বেড়ে গেছিল। রন্তির বাবা প্রথমে রাজি ছিল না। তাই কথাটা এগোতে পারছিল না। কিন্তু আত্মহত্যা করার আগে ভদ্রলোক সব কিছু স্পষ্ট ভাষায় লিখে বাড়ি ওদের দুজনের নামে করে দিয়ে গেছেন। আইন আদালতের দরকার হয়নি কোন। রূপার গলার মধ্যে কাঁটা ফুটলে যেমন খরখর করে সেরকম একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে ছিল। উষ্ণ হচ্ছিল ওর গলা। তুমি এইসব নিয়ে খোঁজ খবর করা একটু বন্ধ করবে এবার? না হলে কিন্তু একটা কান্ড হয়ে যাবে। 

রাগ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর নিচের স্কেলে ফিরছিল রূপার গলা। মানুষের জীবনের দুঃখ গুলো চাপা থাকলেই ভাল, সব কথা না জানলেই জীবনের ভারসাম্য থাকে। বড্ড জটিল হয়ে যায় তা না হলে জীবনটা।

মনসিজের মনে হল এই চাপা দুঃখটাই তো ভিতর থেকে চারিয়ে যায়, তারপর আর যখন পারে না সেটা ফেটে বাইরে বেরিয়ে আসে আগ্নেয়গিরির মত।

সেটা এই দেশে। মানুষের যখন সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে, একটা মেসিনগান নিয়ে স্কুলে নয় মলে চলে যায় আর ধ্যারাধ্যার গুলি চালিয়ে আরও দশটা লোককে সঙ্গে নিয়ে মরে। মনে নেই টুবুনের স্কুলে কি হয়েছিল? বলতে বলতেই রূপার চোখমুখ থেকে কে যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে পুরো প্রাণ শুষে নিল।  

আহা, এত বছরের পুরনো কথা মনে করে কি করবে বলো তো?   

তোমার জন্যেই তো। মাথা নেই মুন্ডু নেই, সারাক্ষণ এইসব নিয়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছ। তুমি তো খোঁজ রাখো না, আমি এখনো কত মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে যাই। কাঠের মেঝেতে দুমদুম শব্দ তুলে রূপা চলে গেল। এবার বেশ রেগেছে। 

মনে আছে মনসিজেরও। দগদগে ঘায়ের মত। দশ বছর বাদেও। 

অফিসে কাজ করতে ফোনটা পেয়েছিল। টুবুনের স্কুলে একটা গানম্যান ঢুকে পড়েছে। তখন তো ও ছোট। টুবুন ছাড়াও আরও বারোটা বাচ্চাকে হোস্টেজ করে একটা ঘরে বন্ধ হয়ে বসে রয়েছে। শুনে অবধি কাঁপছিল মনসিজ। রূপাকে কানেক্ট করতে পারল না, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ছুট। 

কিন্তু যাবে তো যয় কি করে? স্কুলের দিকে যাওয়ার সব রাস্তাই পুলিশের গাড়ি দিয়ে আটকানো। এতোসব লাল নীল আলোর ঝলকানিতে একটা অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মনসিজ পন্টিয়াক ট্রেল দিয়ে এগচ্ছিল, স্কুলের কাছাকাছি এসে দেখল আর সামনে যাবার উপায় নেই। গাড়ি পার্ক করে হাঁটা শুরু করল। একটু এগোতেই এক ডেপুটি দাঁড় করিয়ে দিল। Stop Sir! You can’t go no more! কি করবে বুঝতে পারছিল না। অনুনয় করল, অফিসার! আমার ছেলে স্কুলের মধ্যে আছে, আমাকে যেতেই হবে।

দশাসই চেহারার অ্যাফ্রো-আমেরিকান ডেপুটিটি বেশ কড়া ধাতের। মনসিজের মুখের ভাবসাব দেখে একটু গলল। চেহারার তুলনায় বেশ নরম গলায় বলল, বুঝতে পারছি। কিন্তু এখান দিয়ে তো যাওয়া যাবে না। বাচ্চাদের বাবা মাকে নিউ পোর্ট রোডের দিক দিয়েই শুধু যেতে দেওয়া হচ্ছে। অন্য কাউকে স্কুলের কাছে যেতেই দেওয়া যাবে না। 

থ্যাঙ্ক ইউ অফিসার। স্কুলে এখন কি অবস্থা একটু বলবে? কিছু প্রশ্ন করতে হয়, করা দরকার কিন্তু উত্তর না শোনার ইচ্ছাটা বেশী থাকে। এটা সেরকম একটা প্রশ্ন।    

এখনো কোন ক্যাজুয়াল্টির খবর পাওয়া যায় নি। সাসপেক্ট তিন রাউন্ড গুলি করেছে, কিন্তু হাওয়ায়। মোটিভ বোঝা যাচ্ছে না। কোন বাচ্চা ইঞ্জিওরড হয়েছে বলে খবর নেই। কথার সমতল থেকেও লোকটা রাস্তার দিকে নজর রাখছিল। আরেক বাবা মা মনসিজের মতই আসছিল। এবার তাদের থামাতে স্টে আউট! স্টে আউট! বলে এগিয়ে গেল।

ডেলহাই ব্রিজ থেকে নাবতে নাবতেই আরো কিছু গাড়ির জটলা চোখে পড়েছিল। কয়েকটা নিউজ চ্যানেলের গাড়িও। ওখানেই ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছে। লোকজন তার বাইরে। জনা তিরিশ হবে। লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের গেট এখান থেকে চার-পাঁচশো ফুট দূরে। বুঝলো এর বেশী এগোনো যাবে না। গাড়ি থেকে নেবে মনসিজ চেনা মুখ খুঁজছিল। দুএকজন পেরেন্টসকে চেনে। কিন্তু তাদের কাউকে দেখল না। ফিরে ফোন করতে যাবে ঠিক সেই সময়েই পেলো রূপাকে। স্কুল গেটের ধার ঘেঁষা একটা রেডবাড গাছের তলায় দাঁড়িয়ে। গাছের গোলাপি ফুলের পাপড়ি কয়েকটা ঝরে পড়েছে রূপার মাথায়, পায়ের চারপাশে। স্তব্ধ অবয়ব ঠিক যেন পাথরের মূর্তি। অথবা ছুটতে ছুটতে কেউ গো স্ট্যাচু বলে দিয়েছে। ডান হাতটা গালের উপর, মাথাটা একটু ডানদিকে ঝুঁকানো। ওই ভঙ্গীতেই হয়তো অনেকক্ষণ। দেখেই বুকটা কেমন করে উঠেছিল মনসিজের। তখনো সন্ধ্যা নাবেনি। দিনের শেষ আলোয় তেমন রং নেই। তবু সেই বিবর্ণ আলোয় ওর কান্নাভেজা মুখ বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছিল মনসিজ। যেন সব হারিয়ে গিয়েছে। তাদের আমেরিকার জীবন, এতদিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন কেউ যেন এক ফুৎকারে বুঁজিয়ে দিয়েছে।  

মনসিজ পাশে আসতেই রূপার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠল, কিন্তু শব্দ বেরোল অনেক দেরীতে। আমাদের টুবুনের কি হবে মনসিজ? ওকে বোধহয় আর- বলতে বলতে দুহাতে জড়িয়ে মনসিজের কাঁধে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল রূপা।  

এমনি সময়ে রূপা শক্ত থাকে, মনসিজ বেশি উতলা হয়। কিন্তু রূপার এমন অবস্থা দেখে মনসিজ যতটা সম্ভব নিজেকে সামলাচ্ছিল। কোন খবর পেয়েছো?  

নিঃশব্দে মাথা নেড়েছিল রূপা। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমিও এখুনি এলাম, কেউই ভাল করে কিছু জানেনা।    

চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা মায়ের মৃদু গলার কথোপকথন থেকে মনসিজ অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছিল। বেশীর ভাগ কণ্ঠস্বর কান্নায় জড়ানো বলে কথা খেয়ে যাচ্ছে, স্পষ্ট নয়। স্কুলের গেটের কাছে অন্তত পাঁচ সাতটা গাড়ি ক্রিশক্রশ করে রাখা। নিউজ চ্যানেলের একজন ঘুরে ঘুরে কথা রেকর্ড করার চেষ্টা করছিল। সেই কথা থেকে বুঝতে পারল দুজন ডেপুটি পেছন দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু গুলি চললেও কেউ মারা যায় নি। শেরিফ মেগাফোন মুখে কিছু বলছে, এখান থেকে তার মানে উদ্ধার করা মুশকিল। হয়তো লোকটাকে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে অথবা অন্যমনস্ক রাখছে যাতে পিছন দিয়ে ওরা ঢুকে যেতে পারে। এমনি সময়ে একটা শোরগোল। গেটের কাছে বন্দুকধারী ডেপুটিদের মধ্যে আকস্মিক ততপরতা। এবার দেখা গেল একটা লোককে দুদিক থেকে বন্দুক ঠেকিয়ে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। বাবা মায়েরা কথা থামিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ওদের সামনে দাঁড়ানো পুলিশের লোকটা আটকে দিল। না এখনো নয়, অপেক্ষা করতে হবে আরেকটু। 

বেশ অকিঞ্চিতকর চেহারার লোকটা গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ছটফট করে চেঁচিয়ে উঠল শ্যুট মি, শ্যুট মি বলে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কোন দরকার ছিল না। ধাক্কা মেরে ওকে শেরিফের গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেই দাঁড় করানো অ্যাম্বুলেন্স থেকে দুটো স্ট্রেচার নিয়ে প্যারামেডিক্সের লোকজন দৌড়ে ঢুকে গেল স্কুলের গেট দিয়ে। বাবা মায়েদের সব চাঞ্চল্য থেমে গেল এক মুহূর্তে। তবে কি কোন ক্যাজুয়াল্টি হয়েছে? কার? সবার চোখে একই জিজ্ঞাসা। মনসিজ দেখেছিল রূপার ঠোঁট নড়ছে শব্দহীন, নিঃসন্দেহে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী নেবে আসছিল সেখানে। মনসিজের বুকে কথারা জমাট বেঁধে গেছিল। শুধু টুবুনের মুখটা ভেসে উঠল মনের পর্দায়। ওকে সুস্থ দেখতে পাবে তো? 

ওদের জীবনের দীর্ঘতম অপেক্ষা ছিল সেদিন।

সেই মুহূর্তে পুলিশ রেডিওতে খবর এলো। বাবা মায়েদের আটকে রাখা ডেপুটি একমুখ হেসে বলল, God is great! তোমরা ভয় পেয়ো না। কেউ ইঞ্জিওরড হয়নি। 

তাহলে আসছে না কেন ওরা? 

উদ্বিগ্ন বাবা মায়েদের হইচই শান্ত করতে ডান হাত উপরে তুলল লোকটা, আঘাত না পেলেও বাচ্চাদের সাইকোলজিক্যাল স্ট্রেস হয়েছে খুব। প্রিলিমিনারি চেক করে যাদের ছেড়ে দেওয়া হবে তাদের একজন একজন করে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমি নাম ডাকব, তোমরা তখন এগিয়ে এসে বাচ্চাদের নিয়ে নেবে। যাদের ফারদার চেক আপ করতে হবে তাদের মিশিগান মেডিসিনের ট্রমা কেয়ারে নিয়ে যাওয়া হবে। ওদের বাবা মা অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গেও ওখানে যেতে পারে। নিজের গাড়িতে গেলেও অসুবিধা নেই। 

এক সময়ে টুবুনের নামটা ডাকা হল। সে যে কি রিলিফ! 

একজন ডেপুটির হাত ধরে টুবুন এগিয়ে আসছিল। ছেলেটার সারা মুখে ক্লান্তি, চোখে শুকিয়ে যাওয়া কান্না। রূপাকে দেখেই মাম্মি বলে ছুটে এলো। রূপা ততক্ষণে হাঁটু গেড়ে রাস্তায় দুহাত বাড়িয়ে বসে পড়েছে। মার মুখে মাথা গুঁজে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছিল টুবুন। ওর ছোট্ট শরীরটা কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছিল। রূপার মুখে থেকে বেরোন অস্পষ্ট শব্দেরা ওকে উষ্ণ কম্বলের আবিলতায় জড়িয়ে ফেলছিল দ্রুত। এইটুকু ছেলে, ওর উপর দিয়ে কি যে গেছিল সেদিন। সাইকোলজিকাল ট্রমা আটকাতে অনেকদিন অবধি কাউন্সেলিং হয়েছে স্কুলে। এমন কি ওদেরও। টুবুন যে একটু একাচোরা হয়ে গেল, কে জানে হয়তো সেই কারণেই। এমনিতেই এদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে টিন এজে একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়। এই ঘটনা হয়তো সেটা আর বেশি জটিল করে দিয়েছিল।     

তবে রূপার কথাই ঠিক। এরকম ঘটনা হামেশাই ঘটছে তো। এরকমই কোন নিঃসঙ্গ, একা মানুষ হঠাত কোনদিন মেশিনগান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। স্কুলে, মলে, পাবে। নিজে তো মরেই, সঙ্গে আরও কয়েকজন নিরপরাধকে সঙ্গে নিয়ে যায়। টুবুনের পুরো স্কুল জীবনটা কি ভয়ে ভয়ে যে কেটেছে মনসিজদের। কোথাও এমনি ধারা কিছু হলেই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ত সেই সব খবর। বেশীর ভাগ সময়েই এইসব লোকেরা ফেসবুকে কিংবা এরকম অন্য কোন সাইটে কিছু না কিছু লিখেছে – কোন ইঙ্গিত যার থেকে বোঝা যায় কিছু করতে চলেছে। এই লোকটা যেমন ফেসবুকে একটা করে নাম্বার পোস্ট করছিল ৩০ দিন ধরে, রোজ এক এক করে কমছিল। যেদিন স্কুলে অ্যাটাক করল তার আগের দিন নাম্বারটা ছিল ১। কিন্তু অন্য কেউ বোঝার চেষ্টা করেনি। আসলে ইঙ্গিত থাকে, কেউ বোঝে না। বুঝলে আটকানো যেতো। 

এই ধারনাটা চারিয়ে যাচ্ছিল মনসিজের মনে। অঙ্কুশ, রনিতার বাবা সবাই কিছু বলতে চেয়েছিল। কিংবা টুবুনের স্কুলের এই লোকটা, সাইমন। সেও তো এরকম নিঃসঙ্গ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কেউ যদি একবার ওর সঙ্গে কথা বলতো, হয়তো এমন করতো না। 

কথা বলতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে এমনি সব লোক। কিছু হয়ে যাওয়ার পর চুকচুক করে কোন লাভ নেই, আটকাতে হবে। যারা আত্মহত্যা করেনি তাদের বাঁচাতে হবে। ইন্সপায়ারড লাগছিল নিজেকে। চেনা পরিচিত বন্ধু, আত্মীয় স্বজন তাদের মধ্যে কারো সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা দেখবে মনসিজ। তারপর চেষ্টা করবে, তাতে ক্ষতি আছে কোন? গুগুল করে দেখেছে। এরকম লোকের সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলতে হবে, বুঝতে হবে কেন কষ্ট পাচ্ছে সেই মানুষটা। সঙ্গে থাকতে হবে। বড় করে শ্বাস নিল মনসিজ। একদম! তবে না জীবনের মানে!  

কিন্তু বুঝবে কেমন করে? যে কটা কেস স্টাডি করল, অন্তত ইঙ্গিত থাকে একটা। সেটা নিশ্চিত। গুগুলে সার্চ করেও সেই ক্তহাই পেলো। বেশিরভাগ মানুষ যখন আত্মহত্যা করার কথা ভাবে, কোনভাবে কাউকে জানাতে চায়। সোজাসুজি না। ঘুরিয়ে, ইঙ্গিতে। কিন্তু সেরকম সঙ্কেত মনসিজকে কেন কেউ দেবে? দিলেও মনসিজ কিভাবে সেটা বুঝবে? কারো রোজকার ব্যবহার থেকে কিছুটা হয়তো আন্দাজ করা যায়। আর কিছু? অজ্ঞানের গুগুল ভরসা। খুটিয়ে খুঁটিয়ে বেশ কটা সাইট পড়ল মনসিজ। এই সাবজেক্টটা যেন নেশার মত ঘাড়ে চেপেছে। খসখস করে লিখে ফেলল ওর নোটবুকে  

১। সমাজের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলা, নিজের কথা কাউকে বলতে না চাওয়া 

২। খিটখিটে মেজাজ, মনখারাপ/অবসাদ  

৩। অগোছালো জামা কাপড় 

৪। ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিংবা খুব রোগা হয়ে যাচ্ছে 

৫। অন্যমনস্ক   

ভেবে দেখল ১ নাম্বারটা হয়তো ফেসবুক ফলো করলে বোঝা যেতে পারে। একদম কাছের লোক না হলে ২ নাম্বারটা বোঝা মুশকিল। ভাল জামাকাপড় না পড়ে কেউ কি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে? আসলে দূরত্ব আর একটা ব্যাপার। এমনিতেই  দেশের থেকে এতো দূরে থাকে। রনিতার বাবার মত, কাছের কেউ যদি মানসিক যন্ত্রণায় ডুবে যাচ্ছে তাকে বুঝতে হলে ফোন করে দেখা দরকার। 

মনসিজের নিজের বাবা মা গত হয়েছেন বেশ কিছু বছর। কি মনে হল, ফোন করল রূপার মাকে। রূপারা মনসিজের পাড়ারই। তার থেকেই তো পরিচয়, প্রেম, বিয়ে। মনসিজ ছোটবেলা থেকেই ওর মাকে চিন্টুমাসি বলে ডেকেছে, বাবাকে বিনুকাকু। বিয়ের পরে বলে বলেও বদলানো যায়নি। আজকেও দরাজ গলায় জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো চিন্টুমাসি? 

তুই এমন অসময়ে ফোন করলি মানু? শরীর ভাল নেই নাকি? চিন্টুমাসির গলার উদ্বেগ ফোনেও চাপা ছিল না। 

শুনেই অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেল মনসিজের। কেন, আমার শরীর নিয়ে রূপা কিছু বলেছে নাকি?

না, আমাদের এখানে তো অনেক রাত। এমন সময়ে ফোন করলি, এদিকে সন্ধ্যাবেলাতেই রূপার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। তাই। তোদের কি ঝগড়া চলছে, কথাবার্তা বন্ধ?  

বাহ, মাসি। আমি বুঝি ফোন করতে পারি না? নাকি শুধু মেয়ের সঙ্গেই কথা বলবে? কথার চালটা হালকা রাখার চেষ্টা করল মনসিজ। 

খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করছিস তো মানু? 

হ্যাঁ, কেন করবো না? 

হজম হচ্ছে? পেট-টেট ফাঁপছে নাকি? চিন্টুমাসির গলায় চিন্তাটা বাড়ছিল। 

আমার বয়েস কত হল মাসি? তুমি কিভাবে জিজ্ঞেস করছ জানো? ছোটবেলায় যখন রাত্রে খাবার সময় মা আরও ঠোসার চেষ্টা করতো আর আমি খাবো না বলে মুখ সরিয়ে নিতাম, মা বলতো এইরে আবার পেট ফেঁপেছে তোর? দেখি তো বলে পেটের উপর টকটক করে টোকা দিত। হা হা করে হাসল মনসিজ। আর আমি কি করতাম জানো তো মাসি? পেটটা ফুলিয়ে দম চেপে নিতাম যাতে মা ঢকঢক আওয়াজ পেয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। 

চিন্টুমাসির গলাটা এবার খুশি খুশি শোনাল। এইরকম হাসিখুশি থাকবি মানু। দুশ্চিন্তায় থাকলেই পেট গরম হয়, তার থেকে মাথা গরম। আমরা এতো দূরে থাকি, শুধু তোদের কথা মাথায় ঘোরে।  

আমাদের জন্য এতো চিন্তার কি হল আবার? খুব অবাক লাগছিল মনসিজের। রনিতার বাবার কেসটা শুনে সে বরং চিন্তা করছিল ওদের জন্য।   

আসলে কি জানিস, বয়েসটাই এমনি। তোর কাকুরও এই বয়সে এমনি মৃত্যুচিন্তা পেয়ে বসেছিল। 

রূপা তোমাকে কি যা তা বলেছে শুনি? কে বলেছে আমার মৃত্যুচিন্তা হচ্ছে? মাথাটা টং করে উঠল মনসিজের। নিশ্চিত রূপার কান্ড। 

চিন্টুমাসি একটু থতোমতো খেয়ে গেলেন। না, না সেরকম কিছু বলেনি তো আমায়। বলছিল তুই সারাক্ষণ কে কোথায় সুইসাইড করেছে তার খোঁজ করে বেড়াচ্ছিস, এইসব আর কি!   

কিচ্ছু পেটে থাকে না রূপার। মনে মনে গজগজ করলেও কথাটা জিভে আনল না। লোকের কথা ভাবা কি অন্যায় মাসি? ভাবো তো কতলোক একটু মিষ্টি কথা শুনলে, আশার আলো দেখলে জীবনে বাঁচার পথে ফিরে আসতে পারে।

হ্যাঁ হ্যাঁ সেতো বটেই, সেতো বটেই। চিন্টুমাসি নিজের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বলটা নিজের পায়ের পিছনে লুকিয়ে ফেলার ভঙ্গিতে বললেন, তোর মনটা বরাবরের নরম মানু। ছোটবেলার থেকে দেখছি। আমার কিরকম খোঁজ খবর রাখতিস। মনে আছে স্কুলে যাওয়া আসার পথে এসে জিজ্ঞেস করতিস মাসি তোমার জন্য দোকান থেকে কিছু আনতে হবে? কাকু অফিস থেকে ফিরে আবার কেন কষ্ট করে যাবে। 

রূপার সঙ্গে দেখা করার জন্য এরকম কত বার চিন্টুমাসির বাজার করতে হয়েছে মনসিজকে। সেটা আর মাসির কাছে ভাঙ্গল না এখন। কিন্তু এই কথাটা মাসির শান্তি প্রস্তাব ধরে নিয়ে আর বেশি টানল না। অন্তত এটা বুঝল চিন্টুমাসির গলায় কোন অবসাদ অথবা বিষণ্ণতা নেই। জীবনেও উৎসাহ যথেষ্ট, অতদূর থেকেও মেয়ের সঙ্গে এতদিনের পুরনো জামাইকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে পারছে যখন। 

এরপরে মেজোকাকু। 

মেজো কাকু বিয়ে করেনি। সারা জীবন দেশোদ্ধার আর রাজনীতি অন্তপ্রান। এখন বয়স হয়ে বসে গেছে, একা থাকেন। বরাবরই স্বনির্ভর। এমনিতে মেজোকাকুর সঙ্গে কথা হয় বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে – নববর্ষ, বিজয়া এইরকম। তাই হঠাত ফোন পেয়ে কাকু চমকে গেল। 

আজকে কি দিন রে খোকন? আমি কি বেভুল হয়ে গেলাম? হা হা হা! 

কেন কাকু আমি ফোন করতে পারি না বুঝি?  মনসিজ তার আহত হওয়াটা নিপুনভাবে গলায় ফুটিয়ে তুলল।   

না, না করবি না কেন। আমি এতদিন নিজের মাথাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি, তোর ফোন পেয়ে ভাবলাম ডিমেনসিয়াটা আমায় বুঝি পাকড়েই ফেলল। হা হা হা! দুর্গাপুজা পেরিয়ে গেল, আমি জানতেও পারলাম না বুঝি। হঠাত হাসি থামিয়ে কাকুর গলা গম্ভীর হয়ে গেল। বাড়িতে সবাই ভাল আছে তো রে খোকন? বউমা? প্রজ্জ্বল?     

আমরা সক্কলে ভাল, তুমি কেমন কাকু? একলা থাকো, চিন্তা হয় আমাদের।

ওরে তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে – গলা ছেড়ে তান ধরেই থেমে গেল কাকু। কাকুর গলাটা এবার আবেগাপ্লুত।  একলা থাকতে চাইলেও কি থাকতে পারি রে খোকন। সারা জীবনে এতো বেশি লোকের সঙ্গে পথ চলেছি, দিনভর কেউ না কেউ এসেই যাচ্ছে। ব্রজেনদা কেমন আছো, ব্রজেনদা এই কাজটা কিভাবে করবো, হেন তেন – সারাদিনে ফুরসত পাই কোথায়! 

মনসিজ খুব মন দিয়ে শুনছিল। কাকু ভাল আছে তো? এই হাসছে, এই আবার গলায় মৃদু কাঁপন। এটাকে কি ঘনঘন মুড সুইং বলা যায়? শেষের দিকে কাকুর গলা কি ফাঁপা শোনাল? সত্যি অনেক লোক কাকুর সঙ্গে দেখা করতে আসে না কি বানিয়ে বলছে? মনসিজ ভাবল এটাই সঙ্কেত, তাকে সোজাসুজি পাকড়াতে হবে।

কারা আসে কাকু তোমার কাছে? 

মানে?

এই যে বললে দিনভর আসছে, কারা? তোমার পার্টির লোক? অবিনদা আসে আজকাল?

এবার গম্ভীর হয়ে গেল কাকুর গলা। ও এখন এম এল এ হয়েছে, যখন তখন আসার সময় কোথায়? ওই তোর মত বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে খোঁজ নেয়। বলতে বলতে গলাটা বাঁকার দিকে এগোল। 

একসময় তোমার সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরত। 

তখন ও ছায়া ছিল। এখন আমি একটা ছায়া। একটা শ্বাস চাপার আওয়াজ ফোনের অন্যদিকে।  

ঢিলটা ঠিক জায়গায় লেগেছে। মনসিজের নিজেকেই বাহবা দিতে ইচ্ছা করল। বাইরের লোক বাইরে থাকে কাকু, কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে সটকে পড়ে।  ঘরের লোক সবসময় পাশে থাকবে। 

যেমন তুই আছিস? দশ হাজার মাইল দূর থেকে ফোন করে জ্ঞান মারছিস।

কাজের জন্য দূরে থাকি কাকু। আমি তো তোমাকে কতবার বললাম, ভিসা করিয়ে দিচ্ছি। আমাদের কাছ থেকে একবার ঘুরে যাও। একা একা থাকতে কারুর ভাল লাগে নাকি? 

আমি তোকে কবে বলতে গেলাম যে একা থাকতে আমার ভাল লাগছে না? 

ফেস টাইমে নেই, কিন্তু কাকুর চওড়া ভুরু কুঁচকে উঠছে ভেবে একবার ঢোঁক গিলল মনসিজ। একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে নাকি? যা থাকে কপালে বলে তবু এগিয়ে চলল মনসিজ। তোমাকে কেন বলতে হবে? নিজের থেকে ভাবতে নেই? 

তাহলে এরকমাভাবে কেন কথা বলছিস, মনে হচ্ছে কাউন্সেলিং করছিস।

না হয় করলাম। মনে করো তোমার নিঃসঙ্গ মনে একটু আলো বাতাস খেলাচ্ছি। 

তুই কোথাকার থেরাপিস্ট এসেছিস রে? আমার হয়েছেটা কি? কাকুর গলা ছ্যাঁকছ্যাঁক করছিল। 

আচ্ছা কাকু, তোমার ছেলে থাকলে তোমাকে এমন একলা ছেড়ে দিত? জানো আমি কত ভয়ে ভয়ে থাকি? কবে কি করে বসো?

আমি কি করে বসবো আবার? আমি কি কোন বাচ্চা ছেলে যে একা একা থাকি বলে এটা সেটা করে বেড়াবো? 

জানো আমার এক বন্ধুর বাবা কি করেছে? একা থাকতে থাকতে সুইসাইড করেছে। হ্যাঁ সুইসাইড।

হা হা হা! আর তখুনি তুই ভাবলি তোর মেজ কাকু একা থাকে। বুড়োটা বসে বসে পটল তোলার প্ল্যান করছে। আত্মহত্যা করা থেকে বাঁচাতে চাস তুই লোকটাকে? 

নাচতে নেবে ঘোমটা টেনে লাভ নেই। যা থাকে কপালে, বুক ঠুকে বলে ফেলল মনসিজ। যদি চাই তাতে অন্যায় আছে কোন? 

কিচ্ছু অন্যায় নেই। কতজনকে বাঁচাতে চাস বল?

এর মানেটা কি কাকু? তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?

একদম না। জানিস তো এই দেশে হাজারে হাজারে চাষী রোজ সুইসাইড করছে। গলায় দড়ি দিচ্ছে নয়তো ফলিডল খাচ্ছে।

আমি তাদের কেমন করে বাঁচাবো কাকু?  

টাকা দিয়ে। ওরা তো আর তোদের মত শখের জীবন কাটায় না যে কথা নেই বার্তা নেই গলায় দড়ি দেবে। ওরা মরে কারন লোনের দায়ে ঘটিবাটি বেচেও বাড়ির লোকের মুখে দুটো ভাত দিতে পারে না। আমরা একটা ফান্ড করেছি, সেভ দ্য ফারমারস ফ্রম সুইসাইড। লোকে মাসে মাসে টাকা দেয়, একবারেও দিতে পারিস তোদের তো অনেক টাকা। যত দিবি, তত লোকের প্রাণ বাঁচাবি। 

কথাটা অন্যদিকে ঘুরে গেছে। মনসিজ বলল, ঠিক আছে কাকু, লিঙ্কটা পাঠিয়ে দিও। কিংবা ব্যাঙ্কের ডিটেল। আমি দিয়ে দেবো। 

খুব ভাল কথা। পাঠাবো। কিন্তু বউমাকে একবার জানিয়ে রেখো। আমি পরে কোন কথা শুনতে চাই না।

তোমাকে কে কথা শোনাল কাকু?

দেখো বাপু, নিজের জন্য কোনদিন কিছু চাইনি। আমার এক অতি প্রিয়পাত্রের অপারেশানের জন্য একবার তোমাকে সাহায্য করতে বলেছিলাম, তুমি পাঠিয়েও ছিলে। মিথ্যা বলবো না। কিন্তু পরে বউমা আমায় কথা শোনাতে ছাড়েনি।

কথা কবে শোনাল রূপা?

শোন আমি রূপাকেও চিনি, ওর বাপ ঠাকুর্দাকেও চিনি। একই পাড়ায় বড় হয়েছি তো। ওদের কথা শোনানোর স্টাইল আমি জানি। তোমার অভ্যেস হয়ে গেছে, গায়ে লাগে না। কিন্তু আমি মল্লিক বাড়ির ছেলে, আমার ওসব কথা সহ্য হয় না। 

আর আমি বুঝি মল্লিক বাড়ির ছেলে নই? কাকুর কথায় মাথাটা গরম হচ্ছিল মনসিজের। 

পদবীটা থাকলেই তো আর সেই তেজ থাকে না রে বাবা। বিয়ে করলে মেয়েদের পদবী যায়, ছেলেদের পৌরুষ। 

ওল্ড ফুল! মনে মনে বলল মনসিজ। কি কুক্ষণে ফোন করে খোঁজ নিতে গিয়েছিল। খামোকা দুটো কথা শুনিয়ে দিল। ওর বাবার সঙ্গে তোমার বনতো না, সেই জন্য রূপাকে কোনদিন পছন্দ করো নি তুমি। বারবার বলেও আমার এখানে আসতে পারো নি একবার।

তোমার শ্বশুর লোকটিকে এতদিনেও চিনলে না। আমি একবার যেতাম, তারপর দশ বছর পাড়ায় সেই নিয়ে আলোচনা চালাত। 

তোমাকে ফোন করাই ভুল হয়েছে আমার কাকু।

ভুল দিনে তো বটেই। বিজয়ার এখনো তিনমাস বাকি আছে তো।

রাগ করে ফোন রেখে দিল মনসিজ। বুড়ো হয়ে মেজোকাকুটা একেবারে খেঁকুরে হয়ে গেছে। বয়েস বাড়লে কি ভীমরতি ধরে নাকি মানুষের? এরকম ঝগড়াটে লোক সবার জান কয়লা করে দেবে, কিন্তু মনসিজ নিশ্চিত নিজের প্রাণ নিতে যাবে না কোনদিন। অন্তত সেইটা পুরোাদস্তুর বোঝা গেল। 

তবে এতগুলো কথা হজম করেও দমে যায়নি মনসিজ। ভাল কাজে অনেক বাধাবিঘ্ন আসে। শুধু ঠিক করল সরাসরি কাউকে ফোনে ধরার আগে ফেসবুকে সেইসব লোকেদের পোস্ট পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিয়ে দেখবে এবার থেকে। 

গোয়েন্দারা যেমন আতস কাঁচ নিয়ে খুনের জায়গা তন্নতন্ন করে খোঁজে, মনসিজ খুব গভীর মনোযোগের সঙ্গে ফেসবুকের কোনায় কোনায় খুঁচিয়ে দেখা শুরু করল। কথায় বলে না যেখানে পাইবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন? তেমনি অধ্যাবসায়ের সঙ্গে মনসিজ প্রতিটা বন্ধুর প্রোফাইল দেখতে শুরু করল, তাদের প্রতিটা পোস্ট। প্রথমে ভেবেছিল বন্ধুর লিস্টে হাজারের উপরে নাম, এতজনের ডিটেলস দেখবে কতক্ষণে। কিন্তু নামের তালিকা দেখে বুঝলো এদের মধ্যে অনেককেই বিন্দুমাত্র চেনে না মনসিজ। কিভাবে যে তারা বন্ধুর লিস্টে এসে ঠাঁই পেয়েছে সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। এইসব তুতানো বন্ধুদের বাদ দেওয়ার পর হাতে রইল শ দুয়েক। তার মধ্যে জনা তিরিশকে পাওয়া গেল যারা প্রতি আধ ঘণ্টায় একটা করে পোস্ট দেয় ফেসবুকে। ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্টের সানি সাইড আপের ছবি দিয়ে গুড মর্নিং বলে সেই যে একবার চালু হয়ে যায়, রাতে শুতে যাওয়ার আগে সবাইকে ঘুম পাড়ানি গানের লিঙ্ক পাঠিয়ে তবে শুতে যায়। সুইসাইড করলেও আগে ফেসবুকে লাইভ হয়ে নেবে। এদের সুইসাইড করার চান্স কম। ডিপ্রেশানের জন্য সময় কোথায়? এটা ঠাট্টা করে রূপাকে বলতে, ও অবশ্য উল্টো কথা বলল। জানো এই যারা ঘনঘন ফেসবুকে পোস্ট দেয় তাদের জীবনে দুশ্চিন্তা আর বেশি? 

তার মানে? খুশি থাকে তাই না এতরকম ছবি, কথা ফুরফুর করে বেরোচ্ছে।

এই নাকি তুমি লোকের সাইকো অ্যানালিসিস করছো? একেকটা লোক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কিরকম টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যায় তোমার কোন ধারনা আছে? কতগুলো লাইক পড়ল, শুধু লাইক না কমেন্ট মিনিটে মিনিটে তার হিসেব রাখতে হয়।

ধ্যাত, লোকের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি? 

তুমি কি বলছ? জানো বন্ধুরা ঠিক ঠিক সময়ে লাইক না দিলে ফোন করে কান্নাকাটি করতেও ছাড়ে না।

তোমাকে করেছে কেউ? খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ল মনসিজ। ঠিক বলেছে রূপা। এরাই তো সবচেয়ে বেশী অ্যাংসাইটির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কে জানে যথেষ্ট পরিমানে লাইক না পেলে এদের সেল্ফ ওয়ার্থ কমে যায় হয়তো! কে বলেছে তার নামটা বলো না গো রূপাসুন্দরী। 

রূপার চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠল। তুমি শ্যামার জিলিপির প্যাঁচ দেখেছিলে?

শ্যামার জিলিপির প্যাঁচ? কেন মেয়েটা তো বেশ ভালই, মানে কক্ষনো মনে হয়নি খুব প্যাঁচালো টাইপের বলে। মাঝে মাঝে রূপার কথার খেই ধরতে পারে না মনসিজ। 

ধুর, কি বলছি আর কি বুঝছো। বাড়িতে জিলিপি বানিয়েছিল, তার ছবি পোস্ট করেছিল ফেসবুকে। কেউ বোধহয় বলেছিল, প্যাঁচটা ভাল হয়নি। ব্যাস! সে কি তুলকালাম! 

হুম! শুধু খেতে ভাল হলে হবে না, দেখতেও ঠিকঠাক হতে হবে। আমার মনে হয় লোকের কাছে কদর পাওয়ার জন্য সবার একটা আকাঙ্খা থাকে। সেটা না পেলেও মানসিক অবসাদ আসতে পারে। খসখস করে নোট নিতে নিতে মাথা তুলল মনসিজ। এরকম আর কোন কেস জানো নাকি?  

বা বা, এখন খুব তেল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তোমার এরকম ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানর কি দরকার বলবে? আমার তো মনে হচ্ছে, তোমাকেই ডাক্তার দেখান প্রয়োজন। 

আমাকে কেন? বন্দুকের নলটা তার দিকে ঘুরে যেতে মনসিজ হকচকিয়ে উঠল। আমার মধ্যে কি রোগ পেলে? 

মা তো বলেছিল, তোমাকে ডাক্তার দেখান দরকার।

রাগটা ছাইচাপা আগুনের মত পড়েছিল, এবার দপ করে জ্বলে উঠল। তুমি চিন্টুমাসিকে আমার বিষয়ে কি বলেছ বলো তো? মা মেয়েতে মিলে আমার গুষ্টি কাটছো। মনে মনে বলল, মল্লিকবাড়ির উপর তোমাদের সবসময়ে একটা চাপা রাগ। মেজোকাকু সাধে বলছিল?   

চোখটা ছলছল করে উঠল রূপার। হ্যাঁ, আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। তোমার এই অদ্ভূত খেয়াল দেখে আমার যে কি টেনশান হ্য় সেটা শুধু আমি জানি। কারো সঙ্গে শেয়ার তো করতে হয়। টুবুন যাওয়ার পরে বাড়িতে আর একটা লোক নেই যার সঙ্গে আমি শেয়ার করবো। ছেলেটাও এমন হয়েছে, ফোনে পাওয়া যায় না কক্ষনো। কি করবো তাই মাকেই বলি। 

কান্না একটা অস্ত্র যার সামনে মনসিজ দিশাহারা বোধ করে। এই রূপা, শুধু শুধু এরকম কান্নাকাটি করো না না। আমার কিচ্ছু হয়নি, এই দেখো কেমন ফিট আমি। মল্লিকবাড়ির সব দর্প ভুলুন্ঠিত করে বউয়ের তোয়াজে মন দিল এবার, বিয়ে করেনি মেজোকাকা এসবের কি বুঝবে! দেখো না রূপু, আজকাল তোমার কথা শুনে একদিন অন্তর জিমে যাচ্ছি, রাতে রুটি চিবাই, মাটন খাওয়া বন্ধ। চিজ বার্গার খেতে দেখেছ আমাকে আর? 

হ্যাঁ, সে একটা বড় স্যাক্রিফাইস বটে! মেঘ ফেটে রোদ ঝলকালো। তুমি কথা দাও তুমি কোন থেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলবে। একবার।

একেবারে বেঁকে বসল মনসিজ। কক্ষনো না। আমি কি পাগল হয়ে গেছি নাকি?

এই দেশে এতদিন থেকেও তোমার এরকম ধারনা কেন বলো তো? এখানে প্রতি তিনজনে একজন সাইকোথেরাপি করাতে যায়। 

সেসব সাদাদের মধ্যে। 

ও, তাহলে তুমি কেন দেশোয়ালিদের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছ কোথায় কে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে? যার মানসিক ব্যারাম নেই সে কেন মরতে যাবে?

তুমি বলছো, আমার ব্যারাম আছে? 

আমি সেটাও বলছি না। কিন্তু তাপ্তি বলল একবার দেখিয়ে নিলে কোন দোষ নেই –

মনসিজ আলগোছে হাতটা রূপার কাঁধে রেখেছিল। এবার তিড়িং করে তিন ফুট দূরে ছিটকে গেল। তুমি তাপ্তির সঙ্গেও আমাকে নিয়ে কথা বলেছ? আর কার কার কাছে আমার বদনাম করেছে বলো তো? 

বদনামের কি আছে। তাপ্তি আমাকে বলল –

আর কাকে কাকে বলেছ শুনি? 

শুধু ওকে বলেছি, অন্যায়টা কি করেছি?  ও একজন ডাক্তার। 

হ্যাঁ, গাইনি।

তাতে কি, ডাক্তারি পড়েছে তো নাকি? আমাকে বলল তোমার এই ব্যাপারটাকে নাকি নেকরোফোবিয়া না কি একটা কিছু বলে।

মনসিজের চেহারাটা তখন ঝাঁপিয়ে পড়া নেকড়ে বাঘের মত একেবারে। তুমি জনে জনে ডেকে আমাকে অপদস্ত করতে পারোনা রূপা।

তোমাকে অপদস্ত করার জন্য একটু জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলাই যথেষ্ট। আমার ধারনা এই বাড়িতে নিশ্বাস নেওয়ার অধিকার আমার এখনো আছে।  

নিশ্বাস নাও, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ো। কিন্তু সেটা তোমার বন্ধু মহলে না ছাড়লেও পারো।  

শোন তুমি যা করছো, তাতে আমার চিন্তা হচ্ছে ব্যাস। আমার কথা তো শুনবে না, তাই লোককে বলতে হয়। তাপ্তি বলল মনসিজদা না যেতে চাইলে আমাকে বলবি, আমি নিজে কথা বলবো। 

বলুক তোমার তাপ্তি, রেয়াত করি নাকি? আমি কোথাও কাউকে দেখাতে যাচ্ছি না। আমরা মল্লিকবাড়ির লোক, বুঝেছ? মানুষের কথা ভাবি, শুধু একার জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে জানি না।  

দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনে খুনশুটি, রাগারাগি দৈনন্দিনের ব্যাপার। কিন্তু আজকেরটা রোজদিনকার হিসেবের বাইরের। দুটো বেড়ালের একে অপরকে আঁচড়াবার মতন, আঘাত প্রত্যাঘাতে ফালাফালা করে দিতেও পেছপা নয়।      

ফলস্বরূপ সে রাত মনসিজ বেসমেন্টে কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছন থেকে রূপা গলা তুলল, যাও ফেসবুকে মুখ গুঁজে বসে থাকো। ছেলে বউ মরল কি বাঁচল তার ঠিকানা নেই, উনি চললেন দেশোদ্ধার করতে।

এরপর সিদ্ধান্তে অনড় থাকা ছাড়া আর কোন উপায় রইল না। বেসমেন্টের বড় সোফাটায় শোবে না হয় আজ। কাল সকালে দেখা যাবে খন। ঘুমটা কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া হল। এমনিতে বেশ ভাল ঘুম হয় মনসিজের। কিন্তু আজ অদ্ভূত সব কথা আধাস্বপ্নের ছায়া হয়ে ঘুমের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। পুরনো দুঃখ, ভুলে যাওয়া অনুভব কোনটাই স্বপ্ন দেখার মত গভীর নয়, আবার এতো হালকা নয় যে মাথা থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিতে পারে। যদি গোঁসা ঘর থেকে নিজের বিছানায় ফিরে যেতো, তবে হয়তো একটা সুরাহা হত।  কিন্তু যা হয়, একবার বেঁকে বসলে সেখান থেকে সরে আসাও অত সোজা নয়। বাড়িতে আর কেউ তো নেই যে মধ্যস্ততা করবে। তাই শুধু এক রাত নয়, দূরে দূরেই কাটল কটা দিন। দুজনের মুখই একদম বন্ধ রইল, গয়নার বাক্সের ঢাকা তালা মেরে আটকে দেওয়ার মত।   

মনসিজ অবশ্য তার রিসার্চ বন্ধ রাখে নি। ফেসবুকে একের পর এক সবার প্রোফাইল ঘেঁটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল প্রতিবিম্ব দেখছে যেন। একটার ভিতর আর একটা আয়না, তার মধ্যে আর একটা থাকলে যেমন হয়, যার কোন শেষ নেই। একটা আয়না আর একটার মধ্যে নিজের আধার খুঁজে পেয়েছে, ধার করে নিয়েছে একে অপরের চেহারা। মনসিজের মনে হচ্ছিল সে যেন একটা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, সব দিক একই রকম লাগছে তাই বেরিয়ে আসার পথ নেই। বিনু লাহিরির পোস্টে চোখ আটকে না গেলে লোকের ছবি দেখতে দেখতে চোখে ধাঁধা লেগে গেছিল একেবারে। বিনু লাহিরির পোস্টে কোন ছবি টবি নেই। শুধু লেখা। সেটা দেখে নড়েচড়ে বসল মনসিজ। 

যেমন লিখেছে – না পাওয়ার যন্ত্রণা আমাকে তেমন বিচলিত করে না, শুধু তোমাকে হারাবার ক্ষত আজো গভীর দগদগে ঘায়ের মত চেতনায়। 

এটা কি কোন কবিতার লাইন? না কি ওর মনের কথা? কাউকে ফেসবুকে নিজের মনের দুঃখ লিখতে তো দেখা যায় না বিশেষ। বিনুর লেখা পড়ে একটু নড়ে চড়ে বসল মনসিজ। 

এটা তো মার্চ মাসের পোস্ট। তার আগে কি এরকম অন্য কিছু লিখেছিল? 

পিছনে যেতে যেতে ফেব্রুয়ারির শেষে আবার এক লাইন – শুধু রাতভর জেগে থাকা, পায়ে পায়ে ঘিরে ধরে অচেনা সময়। 

কোন ছবি নেই তো। অন্তত ইদানিং কালের পোস্টে। ফোন করে দেখাই যায়। অনেকদিন দেখেনি সুভাষদা আর বিনুকে। ইদানিংকালের কোন পার্টিতে দেখেছে বলেও মনে করতে পারল না। ভেবেই কেমন একটা অপরাধী লাগল নিজেকে। সে সাধারণত বিনুকে একটু এড়িয়ে চলে। একই শহরের, এমনিতে খারাপ কিছু নয়। কথাবার্তায় একটু আলুকশালুক ভাব, নিন্দুকে বলে গায়ে পড়া। রূপাও তেমন পছন্দ করেনা। মনসিজ তো আগে বিনুদি বলেই ডেকেছে। একদিন একটা পার্টিতে, বোধহয় সুনীলদার বাড়িতে পাকড়াও করেছিল, অ্যাই! তুমি আমাকে বিনুদি ডাকো কেন বল তো? আমি একটা বুড়ো বরকে বিয়ে করেছি বলেই কি সবার দিদি হয়ে গেলাম? 

না মানে – আমতা আমতা করছিল মনসিজ।

তোমার জন্মসাল বলো আমায়। বেশ সিরিয়াস মুখেই জানতে চেয়েছিল।  

সিক্সটি নাইন। জানুয়ারী।  

তাহলেই দেখো। বিজয়ীর হাসি হাসল বিনু। আমি সিক্সটি সেভেন অক্টোবার। এক বছরের ডিফারেন্স মোটে, তাহলে বিনুদি কেন?

আসলে সুভাষদাকে দাদা বলে ডাকি কিনা। 

ওই টেকো বুড়োকে তুমি দাদা ছাড়া আর কি বলবে! আমার থেকে দশ বছরের বড়। সেটা বড় কথা নয়, তিরিশ পেরোনোর আগেই মাথার চুল খালি করে দিয়েছিল। যে কটা চুল আছে তাকেও পাকিয়ে ফেলেছে তাড়াতাড়ি। সবাই ভাবে আমিও তাই। সত্যি করে বলো। আমাকে দেখে ওর বউ বলে মনে হয়?  

বিনুদি খুব সিরিয়াসলি মনীষের কাঁধে নিজের ডান হাতটা রেখে জিগ্যেস করেছিল। কি বলা যায় এমন কথার উত্তরে? আসলে বিনুদির চেহারার ধাঁচটাই এমনি, বয়সের তুলনায় বেশী লাগে হয়তো। খারাপ দেখতে নয়, কিন্তু হয়না কারো কারো চেহারা! অথবা বয়েস কমিয়ে বলছে। মনসিজ এই অস্বস্তিকর আলোচনা থেকে পাশ কাটাতে চাইছিল। সুভাষদাকেও খুব স্মার্ট লাগে বিনুদি, তোমরা খুব ভাল জুড়ি। 

রাখো তোমার স্মার্ট। এই দেশে এসেও ওরকম ফুটবলের মত ভুঁড়ি বানিয়ে ঘুরছে। অ্যাই, আমাকে আবার বিনুদি বললে কেন?

বিনুদির ডান হাতটা মনসিজের কাঁধে বেশ চেপে বসেছে ততক্ষণে। মনসিজ আর দ্বিরুক্তি না করে বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ বিনু, we are all set. 

এই না হলে চলে, এবার কেমন বন্ধু বন্ধু মনে হচ্ছে। মনসিজের বাঁ হাতটাকে নিজের ডান হাতের করতালুতে বন্দী করে আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে হেসেছিল বিনু লাহিড়ী। মনসিজ তখন মনে মনে ভয়ে আধমরা, রূপা দেখলে কি বলবে তার ঠিক নেই।  

শুধু সেখানে থামলে কথা ছিল। খানিক বাদে সিগারেট খাবে বলে বাইরের ডেকে বেরিয়ে এসেছে। 

এই সময় খুট করে আওয়াজ পেয়ে দেখল দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে বিনু। কি বিপদ!

কি ব্যাপার মনসিজ, বেরিয়ে এলে যে?

ভিতরে অনেক লোক তো, গুমোট লাগছিল। 

আমারও। বাইরেটা খুব সুন্দর আজ, কদিন বাদেই পূর্ণিমা বোধহয়। 

বিনু আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখে ঠান্ডা হাওয়া নিল। জ্যোতস্নারাতে এই যে দুধ সাদা আলো গাছের পাতায় পাতায় টপকায়, শুধু শুধু মন খারাপ করানোর ফিকির! যা তা! তারপর সলজ্জ হেসে বলল, আমাকে একটা সিগারেট দাও তো, খাই।

একটু চমকেছিল মনসিজ। কোনদিন খেতে দেখেনি তো। তুমি সিগারেট খাও নাকি বিনু?

টেনেছি দু একবার। মাঝে মাঝে নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছে করে। কেন মেয়েরা খেলে কোনো অসুবিধা? 

ধ্যাত তা কেন। এমনি জিজ্ঞেস করছি, আগে কবে খেয়েছ?

কলেজে থাকতে। দুই একবার বন্ধুদের সঙ্গে। এখন সেই সব দিন কতো দূরের মনে হয় যেন। বিনুর চোখে পুরোন দিনের জন্য মন কেমন করা দৃষ্টি। 

সুভাষদা বোধহয় একদম খায় না এসব। 

ও কিছুই ছোঁয় না। খুব নিয়ম মাফিক জীবনে এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই।   

বিনু কিছু বলতে চেয়েছিল হয়তো, কিন্তু মনসিজ সেই সুতো ধরে এগোয় নি। বিনু বরং নিজেই বলল, সবাই ভাবে একবার এই দেশে এসে পড়তে পারলেই সব সুখ। সম্পদ আর স্বাচ্ছল্যটুকু সরিয়ে নাও, দেখবে অনেকেই তোমার সুভাষদার মত হাওড়ার সনাতন বক্সী লেনের জীবন যাপন করছে। 

সেটা মনসিজও দেখেছে। নিজেদের মধ্যে থাকাটা বাড়ছে। মানুষ যেন নিজের জীবনটাকে দুটো ভাগে ভেঙ্গে নিয়েছে। একটা কাজের জায়গায়, সবার সঙ্গে। আর একটা সামাজিক জীবন, নিজেদের দেশের লোক ছাড়া মিশতেই চায় না। আসলে মানুষ স্বভাবত ট্রাইবাল মানসিকতার। হয়তো বিনু আমেরিকায় একটা অন্য জীবনের খোঁজ পেতে চেয়েছিল।  

বিনুর ভাবনা অন্যপথে মোড় নিয়েছিল। সত্যিকারের সুখ জিনিষটার খিদে অত বেশী নয়। ওই দুটো দানা পেলেই খুশি। কিন্তু কত লোক সেইটুকু দানা দিতেই বা জানে। এমন জীবনে হাঁফ ধরে যায় না?     

বিনুকে তখন অন্যরকম লাগছিল মনসিজের। একেকটা মানুষকে কতরকমভাবে চেনা যায়। 

সেসব অনেক বছর আগের কথা, পাঁচ সাত বছর তো বটেই। তারপরে দেখা হয়েছে, ওদের বাড়িতেও গেছে বেশ কয়েকবার। পূজো টুজোতে দেখা হয়। আর কক্ষনো সিগারেট খেতে চায়নি। একটু বেশি রিলিজিয়াস হয়ে গেছে বরং। 

ফোন করতেই পেয়ে গেল।

কেমন আছো বিনু?

ভেবেছিল বিনু জিজ্ঞেস করবে কি ব্যাপার হঠাত ফোন করেছ মনসিজ? আসলে কোনদিন তো করে না, কালেভদ্রে নিমন্ত্রণ করার থাকলে, কিংবা উইশ করার থাকলে তখনই শুধু। তাই ভেবে রেখেছিল কি অজুহাত দেবে।

কিন্তু বিনু সেসব কিছুই না জিজ্ঞেস করে বলল, ক্যাসেরিয়ান এঙ্গেরি!

মানে? এটা কি বললে বিনু? অ্যাঙ্গারস্ট্রাক হয়ে গেছো নাকি? বাংলা বলে তো মনে হছে না। 

কাঁচভাঙ্গার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাসল বিনু। ঠিক বলেছ। এটা বাংলা নয় মোটেই। এটা আফ্রিকার মাসাইদের গ্রীটিং – মানে হচ্ছে বাচ্চারা কেমন আছে? 

বাচ্চা আর কোথায় আছে? ছেলে বড় হয়ে গেছে, তোমাদের মত আমরাও এখন এম্পটি নেস্টার।

আহা সেরকম নয়। মাসাই যোদ্ধারা নিজেদের বাচ্চা না থাকলেও এর উত্তরে বলে, সব বাচ্চা ভাল আছে। তার মানে হচ্ছে জীবন খুব সুন্দর, সবাই ভাল আছে।

বাহ, বেশ মজার তো। তার মানে তুমি ভাল আছো। 

খারাপ থাকবো মনে হল কেন? 

না, আমতা আমতা করে বলল মনসিজ , তোমার ইদানিং-এর একটা পোস্ট দেখছিলাম ফেসবুকে। মনে হল কোন কারনে-

কেন এমন মনে হল নাকি যে মনের দুঃখে আত্মহত্যা করতে চলেছি? 

মনসিজের অবস্থা এখন হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে চেটে খেতে গিয়ে গলা ফেঁসে যাওয়ার মত। বামাল সমেত ধরা পড়ে গেছে এমন ভাব করে বলল, ভয় তো লাগে, লাগে না? চারদিকে এমন সব ঘটছে-

হাসল বিনু। জানো তো যত সমস্ত আত্মহত্যা ঘটে সব কিন্তু ওই রাতের বেলায়। যখন হেরে যাওয়া মানুষেরা বাঁচা আর মরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকে একটা ধাক্কার অপেক্ষায়। দিনের বেলা ফোন করে সে খবর কখনো পাবে না তুমি। খুব রহস্যময় শোনাচ্ছিল বিনুর গলা। মনসিজ ঢোঁক গিলল দুবার। নিজের গলায় শনিবারের বারবেলা ঘনিয়ে তুলে বিনু ফিসফিস করে বলল, কিন্তু বেশি খোঁজ রাখাও ভাল না, কে জানে তোমার কখন এই দোলাচলটা ভাল লেগে যেতে শুরু করে।   

মনসিজের ভাবনা চিন্তা কেমন ঘেঁটে গেছিল একদম। কাউন্সেলারের ভাব করে ফোন করেছিল, এখন কিভাবে পালাবে সেই পথ খুঁজছে।  কিন্তু কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না।   

বিনু আবার হাসল, এবার বেশ প্রাণখোলা হাসি। আরে আরে ভয় পেয়ে গেলে নাকি? পরমুহূর্তে কথার গতিপথ পাল্টে বলল দেখো, তার মানে ফেসবুকে সবাই শুধু ছবি দেখে না, বলো? অন্তত একজন হলেও ছুঁয়ে দেওয়া গেছে তো। আমি সার্থক। থ্যাঙ্ক ইউ মনসিজ।

আসলে তোমার পরপর কটা পোস্ট পড়লাম। মনে হল কোন কারনে কষ্টে আছো। 

বিনুর গলার স্বর আবার বদলে গেল, খুব নরম গলায় বলল, এতদিনে দেখো কেমন সত্যিকারের বন্ধু হলে। তবেই না যেচে খোঁজ করছ বলো? তারপর একটু থামল বিনু। দুঃখ থাকাটা কিছু খারাপ নয় মনসিজ। সুখ দুঃখ নিয়েই তো সংসার। আমার দিদা কি বলতো জানো? এ পদে, ও পদে খাই। যে পদে গোবিন্দ পাই। জীবনের মানে কোথায় যে লুকিয়ে আছে তার তো খোঁজ করতে হয়। শুধু সুখের খোঁজ রাখলে বাঁচার অর্ধেকটাই তো ফক্কা। 

বাহ, বেশ বলেছ তো বিনু। এ পদে, ও পদে খাই। যে পদে গোবিন্দ পাই। আমরা সবাই যদি এইভাবে চিন্তা করতাম তাহলে জীবনের ওঠা পড়া অনেক সহজে নিতে পারতাম। 

অনেক পথ পেরিয়ে তবে সেটা বুঝেছি। তাই তো দুঃখকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি, ফিরে ফিরে অনেক সময় পুরোন দুঃখেরও স্বাদ নিতে হয়। বেঁচে থাকার ওটাও একটা শর্ত। আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো মনসিজ?

খুব ভাবার মত কথা বলছিল বিনু। বেশ গভীরভাবে চিন্তা করে তো মহিলা। মনসিজ এরকমটা আশা করেনি। পাশাপাশি থাকলেও মানুষকে কত কম জানা হয়। জিজ্ঞেস করল, কি?

মনে হয়, আমরা যেন সত্যিকারের বেঁচে নেই। ভাবছি বেঁচে আছি, কিন্তু আসল জীবনের থেকে যেন অনেক দূরে চলে গেছি। ফারাকটা কেমন জানো? যেমন ধরো সমুদ্রের জলে স্নান করতে নেবেছ। চোখে মুখে নোনা জল ঢুকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের ধাক্কায় বালিতে গড়িয়েই পড়লে হয়তো, হাত পা ছড়ে গেল। কিন্তু সব কিছু ভিতর থেকে দেখছো। অনুভব করছো সমস্ত শরীর দিয়ে। সেটা একরকম বাঁচা। আবার মনে করো ক্রুজ শিপে করে চলেছ। পৌঁছে গেছো সমুদ্রের মাঝ বরাবর। কিন্তু ভেবে দেখো জলের থেকে কত দূরে। নাচগানে এত ব্যস্ত, জলের কথা ভুলেই গেছো হয়তো একদম। আমার কি মনে হয় জানো মনসিজ, আমরা এইরকমই জীবন কাটাচ্ছি যেন। জীবনটাকে ছুঁয়ে দেখতেই ভুলে গেছি একদম। তোমার এরকম মনে হয় না মনসিজ?

ফোন ছাড়ার অনেকক্ষণ বাদেও বিনুর কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল শুধু দুঃখবিলাস নয়, মহিলার কথার মধ্যে ধাক আছে। এই যে বসন্তে তার নিজের বাগানে এতো ফুল ফোটে, কই  ছুঁয়ে দেখে নাতো? সে শুধু ছবি তুলে দিয়ে দিল ফেসবুকে। জীবন পিছনে চলে যাচ্ছে, আর সে যেন চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখেই যথেষ্ট হয়েছে বলে মনে করছে। 

তরতর করে ডেক হয়ে বাগানে নেবে গেল মনসিজ। সত্যিই জেরেনিয়ামের কেয়ারির পাশে একেবারে থেবড়ে বসে পড়ল আজ। সবুজ ঘাসের এমন গালিচা পাতা, তবু শেষ কবে এইভাবে বসেছে? শর্টস পড়েছিল মনসিজ, থাইয়ের পিছনে ভেজা ঘাসের স্পর্শে কেমন শিরশির করছিল। এত ভাল লাগেনি কতদিন!  সাদা, কমলা আর গোলাপি রঙের জেরেনিয়ামের গুচ্ছ হাওয়ায় তিরতির করছে। ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক নতুন অনুভবের আনন্দে কাঁপছিল মনসিজও।  

এইখানে বসে বসে বিনুর কথাগুলো আরো ভিতরে চারিয়ে যাচ্ছিল, আত্মস্থ হচ্ছিল। তাহলে আমরা কি সবাই মরে গেছি? কেউ আর ঠিকঠাক বেঁচে নেই? একেকজন মিশরের মমি, তাই সেজে গুজে বাঁচার ভান করে ঘুরে বেড়াচ্ছি সবাই। বেঁচে না থাকলে আর মরবো কি করে? দুঃখ তো আর ছুঁতেই পারে না আমাদের। আমরা তাই আর আত্মহত্যা করি না। যারা বেঁচে আছে একমাত্র তারাই তো আত্মহত্যা করতে পারে। 

সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল মনসিজ। ঠিকই বলেছে বিনু। জীবনটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাঁচতে হবে। এখনো দেরী হয়ে যায় নি। যেমন বিনু বলছিল তেমনি নোনা জল খেয়ে, ঢেউয়ের ধাক্কা গায়ে নিয়ে বেঁচে থাকা। তার মধ্যেই রূপার হাতে হাত ধরে সমুদ্রতীরে ঝিনুক কুড়াবে। এখনো দেরী হয়ে যায় নি। মনে মনে বলল রূপাকে, তোমার মুখে সুখ দুঃখের রেখাগুলো ওঠানাবা করে, আমাকে তেমন করে কেন ভাবায় না আর? অথচ ছোটবেলায় তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানালা সরিয়ে একবার উঁকি মারবে সেটা দেখার জন্য কেমন তরসে থাকতাম। 

অথচ গত চারদিন রূপার সঙ্গে কথা বলা হয়নি। একে অপরের মুখের দিকে সোজা চোখে তাকায়নি পর্যন্ত। ভাবতেই কেমন হু হু করে উঠল মনটা। সব ভুলে গলা তুলল রূপা! রূপা! 

কোন সাড়া নেই। বুঝেছে মনসিজ। আজ তো নতুন নয়। ঠিক জানে মহারানী এখন রাগ করে গোঁসা ঘরে বসে থাকবে। সোজা চলে গেল মাস্টার বেডরুমে। পাশ ফিরে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়াল। রূপা!

তবু সাড়া নেই।

তখন ঝুঁকে পড়ে থুতনি ধরে মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইল। 

একি তোমার চোখ এমন লাল কেন? ফোলা ফোলা? মাঝে মাঝে মন কষাকষি তো হয়েই থাকে। এতগুলো বছরের পর তাতে এত ধাক নেই যে চারদিন বাদেও চোখে জল এনে দেবে। মনসিজ খুবই আশ্চর্য হল। 

গলার নলি ওঠানাবা করল, কিন্তু কোন শব্দ শোনা গেল না। 

এই রূপা, উঠে বসো তো দেখি। এত কান্নাকাটি করার মত কি করলাম বলো তো। হাত ধরে বিছানায় উঠিয়ে বসাল রূপাকে। গালে বিছানার দাগ চেপে বসেছে, চোখের কোলে জলের দাগ শুকিয়ে আছে। 

কি হয়েছে বলবে তো। মনসিজের অধৈর্য লাগছিল এবার।

আমার খুব ভয় লাগছে। রূপার চোখে নতুন করে জল ছলকে পড়ল।

কেন, ভয়টা কিসের? মনসিজ মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না।  

টুবুনের সঙ্গে তোমার কবে লাস্ট কথা হয়েছে বলবে? রূপার ডান হাতের আঙুলগুলো এখন মনসিজের কাঁধে চেপে বসেছে নোঙর খোঁজার অস্থিরতায়। 

এ আবার কি কথা? মনসিজ ছেলেকে তো অত ঘনঘন ফোন করেনা। যা কথা হয় মা আর ছেলেতেই বেশি। 

ছেলের সঙ্গে কেমন একটা দূরত্ব হয়ে গেছে মনসিজের। হয়তো মনসিজের মধ্যে টুবুন এক আমেরিকান বাবাকে খোঁজ করত। চাইতো নোয়েল কিংবা জুডের বাবার মত খেলুক মনসিজ। বেসবল। কিংবা বাস্কেটবল, একসঙ্গে দুজনে লাফিয়ে উঠে বাস্কেট করবে। স্কুলের স্পোর্টস টিমে কোচিং করাবে মনসিজ, যেমন কলিনের বাবা তাদের বাস্কেটবলের কোচ, অথবা জুডের বাবা শেখাতো ভলিবল। পারে না মনসিজ, খেলাধুলা নেই তার ধাতে। পড়াশোনাটা বুঝত, তাই অঙ্ক নিয়ে লেগে থাকত ছেলের পিছনে। অঙ্কের কোচিং। সেটা আরো রাগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনসিজ নাকি পড়াতে জানে না, ওদের আমেরিকার অঙ্ক কি আলাদা কিছু? ছেলে বাবার কাছে আসাই বন্ধ করে দিল। 

তোমরা কি চাও বলো তো? ঘাড় ত্যাড়া কড়ে বলেছিল একদিন টুবুন। লম্বায় তখন মাথায় মাথায় ছেলে। ভাল রেজাল্ট তো? এসএটিতে হাই স্কোর আর ভাল কলেজে অ্যাডমিশান – হয়ে যাবে।

তোমার ভাল ছাড়া কিচ্ছু চাই না টুবুন। ভুলে যেও না, আমরা এদেশে প্রথম। আমাদের চামড়ার রং আলাদা, তাই তোমার বন্ধুরা যা পারে তোমাকে পেতে হলে ওই মাথাটাই ভরসা আমাদের। 

আমাকে কেন তোমাদের মত করে ভাবতে হবে ড্যাড? আমি কেন তোমাদের রেপ্লিকা হয়ে অঙ্কে মাথা গুঁজে বসে থাকবো? আমার চামড়ার নিচে আমি দেশী কি বাদামী ছাপ বয়ে বেড়াতে পারবো না সারাজীবন। পনেরো বছর বয়েসেই চোখে চোখ রেখে বলেছিল টুবুন। আমাকে আমার মত থাকতে দাও। 

ছেলে কলেজ চলে গেছে, ওই দূরত্বটা এখনো অতিক্রম করতে পারেনি মনসিজ। কথা হয়। টুবুনের উত্তরগুলো দায়সারা থাকে। মনসিজ জড়িয়ে ধরতে চায়, কিন্তু ছুঁতেও পারে না ঠিকমত। 

এসব কথা মনের মধ্যে গিলে নিয়ে মনসিজ জিজ্ঞেস করল, কেন তোমার সঙ্গে তো কথা হয়। আমার সঙ্গে তো কারনে ছাড়া ফোন করে না। কথাটা বলতে বলতেই গলার মধ্যে কেমন দলা পাকিয়ে গেল মনসিজের। আচ্ছা সেও কি মেজোকাকার মত খেঁকুরে হয়ে গেছে? সেও যেমন মেজোকাকাকে পরবের দিন ছাড়া ফোন করে খোঁজ নেয় না, টুবুনও দরকার না থাকলে নিজের থেকে বাবাকে ফোন করে কোথায়? বাড়ি এলে অবশ্য কথা হয়, শজারুর কাঁটায় আর অত ধার নেই। কিন্তু সেও তো ছমাসে একবার। নিউ ইয়র্ক থেকে অত ঘনঘন আসে না টুবুন।  

গত সাতদিনে আমাকে ফোন করেনি টুবুন। রূপা ফিসফিস করে বলছিল প্রায় মনসিজের কানের কাছে।  

তাহলে ফোন করে দেখোনি কেন ছেলেকে? তুমি করো। 

করেছি। কতবার। কেউ ধরছে না।

মেসেজ করে দেখেছ?

তাও করেছি। প্রথমে একটা কি দুটো শব্দে উত্তর দিয়েছিল। তারপর সেটাও বন্ধ। 

তোমার সঙ্গে কোন কারনে কিছু হয়েছিল?     

করুণ শোনাল রূপার গলা। না, সেরকম কিছু তো হয়নি।

কিরকম কিছু হয়েছে? 

মানে ওর ক্লাসের একটা মেয়েকে নিয়ে আমি একটু বলেছিলাম।

তুমি তাকে দেখলে কোথায়?

ফেসবুকে।

টুবুন বলেছে না, ওর ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট না পাঠাতে। 

না, এমনি ওর পেজে গিয়ে দেখেছিলাম।

কি দেখেছিলে?

একটা মেয়ের সঙ্গে দুটো ছবি দেখলাম, কেমন মনে হল ওরা বুঝি –

তো কি হয়েছে? কত বয়েস হল তোমার ছেলের? গার্লফ্রেন্ড থাকবে না?

সেজন্য না। 

মেয়েটা কি বাঙালি নয়?

মাথা নাড়ল রূপা।

কোন প্রদেশের?

এই দেশের।

তাতে কি হয়েছে? টুবুন নিজেও তো এই দেশের। কিছুতেই বুঝতে পারছে না মনসিজ, সমস্যাটা কোথায়।

আহা ওরকম এই দেশের না।

সাদা? তাতেই বা কি হল। এই তো সুবোধদার মেয়ে এক জার্মান ছেলেকে বিয়ে করল।

সাদা না।

তো?

ব্ল্যাক। আফ্রিকান অ্যামেরিকান।

একবার ঢোঁক গিলল মনসিজ। রূপার সমস্যাটা বুঝতে পারছে। এটা বেশি দূর এগোলে ফোনে ফোনে কথা শুরু হয়ে যাবে। জানে সেসব মনসিজ। তবু যতদূর সম্ভব গলায় জোর এনে বলল,  তো কি হয়েছে? তুমি কিছু বলেছিলে ওকে? কেন বলতে গেলে বলো তো? ছেলে বড় না অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো তোমার যত সখীরা?

আর তোমার বন্ধুরা? তারা বুঝি পিঠ চাপড়াবে তোমার? ফোঁস করে উঠল রূপা।   

মনসিজ আবার ঝগড়ায় ফিরতে চাইছিল না। তার সময় নয় এখন। গলাটা যথাসম্ভব খাদে নাবিয়ে আনলো মনসিজ। জানো তো, আমার মন বলছিল রূপা। মনে হচ্ছিল কেউ আমাদের সাহায্য চাইছে, পাশে চাইছে। 

মন বলছিল তো ছেলেকে ফোন করো নি কেন? রাজ্যের লোকের সঙ্গে কথা চলছে, কার কোথায় দুঃখে বুক ফাটছে, তার অনুসন্ধানে ব্যস্ত উনি। অথচ নিজের ছেলের বেলায় শুধু আমি? 

দেখো এখন আর নিজেদের দোষারোপ করে কোন লাভ নেই। বরং আমরা নিউ ইয়র্ক যাই।

এখন, এমনিভাবে? 

তো কি হয়েছে? দশ ঘণ্টার ড্রাইভ বই তো নয়। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নেবো। সিন্থিয়া যা বলে বলুক। হয়তো কিছুই হয়নি, সেটা মনে করেই চলছি আমি। নিশ্চয় কিছু হয়নি। রাগ হয়েছে ছেলের, এইটুকুই ব্যাস। 

বলছো?   

একদম। তবু যাবো। একদিন আমরা তিনজনে নিউ ইয়র্ক শহরটাই ঘুরে দেখবো না হয়, টুবুনের চোখ দিয়ে। 

আমি মোটেই কিছু ঘুরবো না। রেসিডেন্স ইনে বুক করো, কিচেন থাকবে। আমি ওকে রান্না করে খাওয়াবো।

মেয়েটাকেও?

এক মুহুর্তের জন্য থমকালো রূপা। তারপর সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর গলায় বলল, যদি খায়, নিশ্চয়। বলতে বলতেই গলায় আবার ফাটল ধরল। টুবুনের কিছু হয়নি তো গো? তুমি কথা দিচ্ছো? 

রূপার কব্জিতে আলগা মোচড় দিল মনসিজ, পাশে থাকার আশ্বাস। একে অপরের। এই মুহূর্তে এর বেশি আর কিই বা দিতে পারে। মনে মনে বলল, আমি খেলবো টুবুন তোর সঙ্গে। নিবি আমায়? ব্যাডমিন্টান খেলবি, ওটা আমি ছোটবেলায় খেলতাম। পারি। কিংবা টি টি। খেলেছি কয়েকবার কলেজে। অত পারি না, কিন্তু খেলবো আমরা বাবা ছেলে। প্লিজ টুবুন।      

ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল মনসিজ। পাশে রূপা কাঁদছিল ফোঁসফোঁস করে। মাঝে মাঝে হাতের চেটোয় চোখ মুছে জিজ্ঞাসার চোখে তাকাচ্ছিল মনসিজের দিকে। কিন্তু সে কি ভরসা দিতে পারে? সোজা রাস্তায় চোখ রেখে শুধু মনে মনে বারবার আওড়াচ্ছিল, থাকিস টুবুন। আমাদের জন্য অপেক্ষা করিস সোনা। আমরা আসছি, এই এসে গেলাম বলে। 

        

 

          

        

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত