| 20 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা শিশুতোষ গল্প: ফুচকা জন্মবৃত্তান্ত রহস্য

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

সে অনেককাল আগের কথা। আমাদের দেশে রাজত্ব করছে ছোট ছোট রাজ্যের রাজারা। এমনই এক রাজ্য বঙ্গপুর। সেই রাজ্যের রাজা ফটিকচন্দ্র তাঁর রানী চন্দ্রবালাকে নিয়ে পড়লেন মহাবিপদে। রানীর শুধু খাই খাই। তার উপর বায়না রোজ নতুন নতুন খাবার চাই। আজ যা খেলেন কাল তা রানীকে খাওয়ায় কার সাধ্যি। ফলে দেশ তো বটেই বিশ্বের যত রকম মুখরোচক খাদ্য আছে তার বেশিটা খাওয়া হয়ে গেলেও রানী চন্দ্রবালার তৃপ্তি নেই। কিন্তু রোজতো আর নতুন খাবার যোগান দেওয়া যায় না। তাই অবুঝ রানী চিৎকার চেঁচামেচিতে রাজপ্রাসাদকে মাথায় তুললেন। শেষমেশ রোজ নতুন খাবারের অভাবে রাগে শোকে রানী শুকিয়ে যেতে থাকলে রাজা পড়লেন মহা চিন্তায়! রাজকার্য রইলো পড়ে। সিংহাসনে বসে দুহাত মাথায় চেপে দিন নেই রাত নেই রাজা ফটিক চন্দ্র শুধু ভাবতেই থাকেন। রাজার দেখাদেখি মন্ত্রী, সেনাপতি, কবি, সভাসদ, প্রহরী এমনকি বিদূষকের পর্যন্ত মাথায় হাত।এমন একটি খবরে রাজ্যের প্রজারাও নিজেদের রোজকার কাজকর্ম ফেলে মুখে হাত দিয়ে ভাবতেই থাকে কি করলে রানী চন্দ্রবালার খাই খাই অসুখ কমে!

বঙ্গপুর রাজ্যের এহেন অরাজক অবস্থার সুযোগে পাশের রাজ্যের রাজারারাজ্যটাকে দখলের ফন্দি আটলে রাজা ফটিক চন্দ্র নড়েচড়ে বসে। মন্ত্রীকে ডেকে বলে ‘দেখ মন্ত্রী আমি হলাম গিয়ে কোথায় রাজা। ধনদৌলতের কোন অভাব আমার নেই। রানী যত ইচ্ছে খাক কিন্তু তাঁর রোজ নতুন খাবারের জন্য বায়নাটা বড়ই বেমানান। আমার মনে হয় এটা একটা জটিল রোগ। এখন এই রোগ সারাতে না পারলে রাজ্য রাখাই দায়। তুমি ঘোষণা করে দাও রানীর অসুখ যে সারাতে পারবে তাঁকে আমি আমার রাজত্বের অর্ধেক দিয়ে দেব’!

এই ঘোষণা শুনে দেশ বিদেশ থেকে কতজনই না এলেন। কত নতুন খাবারই না তারা রানী চন্দ্রবালাকে খাওয়ালেন কিন্তু তাতে ফল হোল উল্টো! রোগ গেল আরো বেড়ে! এখন রানী সকালে যা খান দুপুরে তা খান না! দুপুরেরটা বিকেলে আর বিকেলেরটা রাতে খান না! খেতে ইচ্ছে হলেই নতুন খাবার চাই! এতে রাজা গেলেন ভয়ানক রেগে। অসুখ সারাতে যারা এসেছিল তাদের প্রত্যকের মাথা মুড়িয়ে তাতে ঘোল ঢেলে গাধার পিঠে তুলে দিলেন রাজ্য থেকে দূর করে।

ভয়ে মন্ত্রী-সেনাপতি- পাত্রমিত্র –বিদূষক কেউই আর রাজার সামনে আসে না। রাজ্যময়হাহাকার। অন্যদিকেনা খেয়ে খেয়ে রানী চন্দ্রবালার অবস্থাও দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। রানীর শোকে রাজার চোখে জল। তা দেখে রাজ্য শুদ্ধ প্রজা সকলের সে কি কান্না! রাজ্যটাই বুঝি এবার যাবে ভেসে!

এমন সময় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি প্রায় লম্বা, মাথায় অল্প টাক, গায়ের রং বাদামি, প্যাকাটির মতন রোগা, টিকালো নাক আর নাকের নিচে মোটা গোঁফের এক তরতাজা যুবক রাজসভায় উপস্থিত। তাঁকে দেখে আর তাঁর কথা শুনে রাজা ফটিক চন্দ্র বলে ওঠেন ‘হাতী ঘোড়া গেল তল মশা বলে কত জল… তুমি সারাবে রানীর অসুখ’!

আগন্তুক কিন্তু বলে ওঠে ‘আজ্ঞে হ্যাঁ রাজামশাই, আমি না পারলে রানীমার খাই খাই রোগ আর কেউ কোনদিন সারাতে পারবে না’!

এত দুঃখেও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রাজা  ‘এত দেমাক! তা মহাশয়ের নামটা কি শুনি?
আজ্ঞে আমার নাম হোল গিয়ে ‘চামচিকে’!
‘চামচিকে’! বাঃ বাঃ খাসা নাম। তার উপর কথা শুনেতো মনে হচ্ছে কিছু একটা তুমি করলেও করতে পার। তা দেরি না করে লেগে পড় দেখি চট পট।
চামচিকে নড়ে না । চুপচাপ একজায়গায় দাঁড়িয়ে পা ঠুকতে থাকে।
বিরক্ত রাজা বলে ওঠে ‘দাঁড়িয়ে কেন? যাও কাজে লেগে পড়’!
এবার চামচিকে মুখ খোলে ‘আমার একটা শর্ত আছে রাজামশাই’!
‘শর্ত’!অবাক রাজা ফটিকচন্দ্র বলে ওঠে ‘আমিতো বলেইছি অর্ধেক রাজত্ব’!
‘আমি তা জানি রাজামশাই। আসলে রাজত্ব অর্ধেক বা গোটা যাই পাই না কেন আমিতো রাজাই হব। কিন্তু আমার এমন কেউ নেই যাকে আমি রানী বানাতে পারি। তাই রাজকন্যে কেও যদি দেন…, চামচিকের কথা শেষ হয়নি সিংহের মতো গর্জে ওঠেন রাজা ‘রাজকন্যেকেও চাও? এত বড় সাহস! যাও যাও অর্ধেক রাজত্বের বেশি কিছুই পাবে না!
‘তাহলে অপরাধ নেবেন না রাজামশাই, রানীমার রোগ সারানো আমার দ্বারা হবে না! এখন যদি আদেশ দেন তাহলে আমি যাই’! এই কথা কটি বলে চামচিকে রাজা ফটিক চন্দ্রের উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।চামচিকেকে যেতে উদ্যত হতে দেখে রাজা মনে মনে ভাবে রোগ যদি সারে তবেইতো রাজত্ব আর রাজকন্যে! তাই তিনি বলে ওঠেন ‘ঠিক আছে তোমার শর্তই মানছি। কিন্তু মনে রেখ যদি রোগ না সারে তাহলে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাধার পিঠেতো তুলবোই সেই সঙ্গে বাচাল জিভটাও নেব কেটে’।

রাজার আদেশ শুনে চামচিকে লাফিয়ে ওঠে। ‘ঠিক আছে রাজামশাই এবার দেখুন আমার কেরামতি। তবে এর জন্য আমায় কয়েকটা দিন সময় দিতে হবে’। রানী চন্দ্রবালা সুস্থ হয়ে যাবে কয়েকটা দিনেই, এমন একটা আশার আলো দেখে ফটিকচন্দ্র বললেন ‘তাই দিলাম’।

এরপর একদিন যায়- দুদিন যায়- চামচিকের দেখা নেই। তৃতীয় দিন সকাল থেকেই রাজা ভাবতে থাকেন ‘চামচিকে লোকটা নির্ঘাত পাগল না হয় ভয় পেয়ে পালিয়েছে! অত বড় বড় কবিরাজ- ওঝা-বদ্যি পারলো না আর কোথাকার কে চামচিকে সে সারাবে রানীর অসুখ!

সেদিনই সন্ধ্যেবেলা পূর্ণিমার আলোতেও থমথমে হয়ে থাকা বঙ্গপুর রাজপ্রাসাদের সিংহাসনে একাকী বসে দুঃখী রাজা ফটিকচন্দ্র। রাজপ্রহরী এসে খবর দিল ‘মহারাজ চামচিকে এসেছে’!

‘চামচিকে’ রাজাচমকে উঠলেন, ‘যাও-যাও ওকে এক্ষুনি ভিতরে নিয়ে এসো’।
কিছুক্ষণ পর মাথায় একটা ঝাঁকা নিয়ে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে চামচিকে বলে ‘রাজামশাই আমার ঝাঁকার মধ্যেই রয়েছে রানীমার রোগ সারাবার ওষুধ তাই দেরি না করে আমায় রানীমার কাছে নিয়ে চলুন’।

রাজা এক লাফে সিংহাসন থেকে নেমে এসে নিজেই চামচিকেকে অন্দর মহলে নিয়ে গেলেন। পিছন পিছন মন্ত্রী-সেনাপতি-পাত্রমিত্র-বিদূষক এমনকি জিভ কাটার জন্য জল্লাদও। রানী চন্দ্রবালার সামনে ঝাঁকাটা নামিয়ে রানীর পাশে বসে থাকা রাজকন্যেকে একবার আড়চোখে দেখে খুশিতে গদ গদ চামচিকে বলে, রানীমা উঠে পড়ুন দেখি…আজ আপনাকে আমি এক নতুন খাবার খাওয়াব’!

শরীরের দুর্বলতা সত্ত্বেও নতুন খাবারের লোভে রানী নড়েচড়ে বসে। আর চামচিকে আলুসেদ্ধ-নুন-তেল-লেবু-সেদ্ধ মটর-বাদাম-ধনে পাতা-লঙ্কা-নানা রকম মশলা ইত্যাদি কি সব একসঙ্গে মাখায়। রানীর হাতে শালপাতা ভাজ করে দেয়। ঝাঁকায় রাখা মাটির হাঁড়ির ঢাকনা খুললে অদ্ভুত এক সুঘ্রাণ পেয়ে উপস্থিত সবাই এমনকি রাজকুমারী পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে ‘হাঁড়িতে কি রয়েছে গো’? উত্তরে চামচিকে জানায় ‘আজ্ঞে তেঁতুল জল…সঙ্গে গন্ধ লেবুর রস’! তেঁতুল জলের কথায় রানীসহ সেখানে উপস্থিত সবারই জিভে জল এসে যায়। এবার চামচিকে ঝাঁকার ভিতর থেকে হাল্কা বলের মতো কি একটা বার করে তাতে আলুমাখা পুরে তেঁতুল জলে ডুবিয়ে রানীর শালপাতায় দিলে রানী প্রথমে একমুখ বিরক্তি নিয়ে তা মুখে তোলেনএবং এরপরই শুরু হয়ে যায় চামচিকের খাবারের কেরামতি! চন্দ্রবালা একটা করে সেই অভিনব খাবার মুখে পোড়েন আর আনন্দে নেচে ওঠেন!

মাঝখানে খাওয়া থামিয়ে রানী বলেন ‘এতদিন কোথায় ছিলে বাবা? আরো আগে কেন এলে না? আগে এলে আমাকে আর এত আজেবাজে খাবার খেতে হোত না! তা হাঁ করে দেখছো কি –দাও দাও রাজকন্যে -রাজা ছাড়াও এখানে যারা আছে তাদের সবাইকে এই খাবার দাও’।

রানী চন্দ্রবালার কথায় চামচিকে সবাইকে খাবারটা খাওয়ালে চারিদিকে স্বাদু স্বাদু রব ওঠে। স্বয়ং রাজা ও রাজকন্যে পর্যন্ত বেশ কয়েকটা খেয়ে ফেললেন। এরপর চামচিকে যখন রানীকে বললো ‘এই শেষ রানীমা কাল আবার খাওয়াবো, তখনো পর্যন্ত রানী চন্দ্রবালার আরো খাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা বলে তিনি রাগলেন না উল্টে দুহাত তুলে চামচিকেকে আর্শীবাদ দিলেন এবংজানতে চাইলেন ‘এই খাবার তুমি কিভাবে বানালে বাবা’? চামচিকে বললো ‘স্বপ্ন দেখে রানীমা! আপনার সমস্যার কথা শোনার পর থেকে আমি রোজ রাতে রান্নার দেবীর নাম নিয়ে শুতে যেতাম। যাতে তাঁর কৃপায় আপনার রোগ যায় সেরে! একদিন হল কি ঘুমের মধ্যে এক জ্যোর্তিময়ী দেবী উপস্থিত হয়ে আমাকে এই খাবারটার কথা জানিয়ে গেলেন’।

রান্নার দেবীকে বার বার প্রণাম জানিয়ে রানী বললেন ‘তা বাবা তোমার খাবারের নাম কি? চামচিকে বিনয়ে নতজানু হয়ে বললো ‘রানীমা রান্নার দেবীর আদেশ ছিল এই খাবারের নামটা আপনাকেই দিতে হবে’!

রানী চন্দ্রবালা এতে বেশ খুশি হলেন। কিছুটা সময় কি যেন ভাবলেন তারপর চামচিকের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘যে উপকার তুমি আজ করলে তাতে তোমাকে আমার বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু বয়সে তুমি অনেক ছোট…’! রানীর কথা শেষ হয়নি চামচিকে বলে ওঠে, তাতে কি রানীমা! আমারতো মা নেই আপনি আমাকে বাবা বলে ডাকলে সেটাই হবে সব থেকেও বড় পুরস্কার’।  এই কথা শুনে রানী চন্দ্রবালা বললেন, ঠিক আছে আজ থেকে তুমি আমার পুচকে বাবা আর তোমার এই খাবারের নাম দিলাম পুচকা’!

রানীর কথায় আনন্দে চামচিকের দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নামলো। রানী তার পুচকে বাবাকে কাছে টেনে নিলেন। উপস্থিত সবাই ‘পুচকে বাবা’ শব্দটি ঠিক শুনলেও প্রবল হই হট্টগোলের মধ্যে ‘পুচকা’ শব্দটি কে শুনলো ‘ফুচকা’! চারিদিকে তখন ‘পুচকে বাবা’ আর ‘ফুচকা’ নামের জয়ধ্বনি। ফলে তখন থেকেই লোকমুখে খাবারটির নামই হয়ে গেল ‘ফুচকা’!

এরপর থেকে রানীর খাই খাই রোগ গেল কমে। তবে প্রতি সন্ধ্যায় কিছু ফুচকা তাঁর লাগতোই। ঐদিকে রাজাও মহাখুশ। কথামত বঙ্গপুর রাজ্যের অর্ধেক আর রাজকন্যে সবই পুচকে বাবার হাতে দিলেন তুলে। নতুন রাজ্যের নাম হোল রঙ্গপুর!

তারপর শ্বশুর জামাই মিলে যারা এতদিন তাদের রাজ্য দখলের ফন্দি করেছিল সেইসব রাজ্যের রাজাকে উচিত শিক্ষা দিতে তৈরি হচ্ছেন তখনই ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা। একে একে সব রাজ্যের রাজাই তাদের রানী, রাজকন্যে আর প্রজাদেরচাপে রাজা ফটিকচন্দ্র ও রাজা পুচকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইলো! শর্ত একটাই ‘ফুচকা নামের মজাদার খাবার তৈরির পদ্ধতি তাদের ও শেখাতে হবে’। ফলে যুদ্ধ আর হোল না । বিনা রক্তপাতে রাজ্য রক্ষার এমন সহজ আর শান্তিপূর্ণ সমাধান বঙ্গপুরের রাজা ফটিকচন্দ্র ও রঙ্গপুরের রাজা পুচকেচন্দ্র সহজেই মেনে নিলেন। সেই থেকেই পৃথিবীতে সবার প্রিয় ফুচকা খাওয়া শুরু!

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত