উৎসব সংখ্যা গল্প: মৃত্যুজাল । অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটাই অন্ধকারে জেগে আছে। চারিদিকে জমাট অন্ধকার।আকাশে মেঘ জমেছে। একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না। খুব কাছেই কোথাও শেয়াল ডেকে উঠল। কাঁপা গলায় প্রদ্যুন্ম বলল, “আপনি কি এসেছেন?” দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন করল “আপনি কি এসেছেন?” এবারেও কোন উত্তর এলো না ।
প্রদ্যুন্ম হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। ঠিক সেইসময় কেউ একজন হাত ধরে টানল। যেন বলতে চাইছে, ‘যেও না’। সেই হাতের স্পর্শ সরীসৃপের শরীরের থেকেও ঠাণ্ডা। প্রদ্যুন্মর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে সে এসেছে। কিন্তু কে এসেছে?
“কোথাও বসে কি কথা বলা যায় না?” প্রদ্যুন্ম উত্তরের অপেক্ষায়। জমাট অন্ধকারে অপর জনের কোন অবয়ব দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা হাত প্রদ্যুন্মকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই পথ প্রদ্যুন্মর চেনা নয়। সে আগে কখনও কালীতলার শ্মশানে আসেনি। এদিকটায় রাতের বেলা কেউ আসে না। একসময় কালীতলার শ্মশানে নাকি চিতা নিভত না কখনও। দিবারাত্রি দূর থেকেও শ্মশানে চিতার আগুন দেখা যেত, কিন্তু সেদিনের পর থেকে কালীতলার নির্জন শ্মশানে কেউ আসে না । ঘটনাটা প্রদ্যুন্ম শুনেছে।
হঠাৎ প্রদ্যুন্মর খেয়াল হল এখন কেউ তার হাত ধরে নেই। সে আর শ্মশানে দাঁড়িয়ে নেই। সামনে একটি স্যাঁতস্যাঁতে ভগ্ন অট্টালিকা।তার সামনে ধুনি জ্বলছে। কিন্তু কাউকেই চোখে পরল না। সন্তর্পণে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উঠে সদর দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করতে করতে খুলে গেলো। মনে হল নাজানি কত যুগ বুঝি খোলা হয়নি। ভিতরে প্রবেশ করতেই দরজাটা নিজের থেকেই খুব জোরে আওয়াজ করে বন্ধ হয়ে গেল। প্রদ্যুন্ম দৌড়ে এসেও দরজাটা খুলতে পারল না। কেউ যেন ইচ্ছে করেই দরজাটা বন্ধ করে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিলো। সেই আওয়াজ টুকুই পাওয়া গেলো। সামনের প্রসস্থ বারান্দা সোজা একটি বন্ধ ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে জল জমে আছে। তার মধ্যে না জানি কত শীতল রক্তের প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাবতেই প্রদ্যুন্মর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কিছু দূরে নিয়ন আলোয় একজন দাঁড়িয়ে আছে। “প্রদ্যুন্ম আমাকে বাঁচা।”
“আকাশের গলা তো।” প্রদ্যুন্মর সঙ্গে আকাশের আলাপ কলেজে। সেই থেকে তারা বন্ধু। তাকে বাঁচাতেই তো কালীতলার শ্মশানে আসা। “আকাশ আমি বাঁচাব তোকে। ভয় পাস না আমি আসছি।”
দৌড়ে যেতেই চোখের নিমেষে আকাশ যেন কোথায় মিলিয়ে গেলো। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দরী মেয়ে। এই মেয়েটিকেই তো প্রদ্যুন্ম তার স্বপ্নে দেখেছে। তার হাতছানিতেই তো এখানে আসা। সেই বলেছিল, আকাশ কোথায় আছে সে জানে। কিন্তু এ তো এখন মেয়ে নয় এক বৃদ্ধা। না, না বৃদ্ধা নয় এক জীর্ণ কঙ্কাল। তার গা থেকে গলে পরছে মাংস খণ্ড। দুটো হাত এগিয়ে আসছে। প্রদ্যুন্ম চোখ বন্ধ করে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র সংকেত বুঝতে চেষ্টা করছে। সব বিপদ থেকে মুক্তির পথ সেই বলে দেয়। এখন এই মুহূর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। চোখ বন্ধ করেই কঙ্কালের খুলি থেকে এক মুঠি চুল টেনে ধরেছে সে। একশ পিশাচের গর্জনের মত আওয়াজ হচ্ছে। তার পরক্ষনেই সব যেন চুপ।
প্রদ্যুন্ম হাঁপাচ্ছে। সে কি কোনো ভুল করল? কোনো ভয়ঙ্কর মৃত্যু জালে নিজের অজান্তেই পা দিলো! নাকি এটা শুধুই একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! চোখে ভোরের আলো এসে পরেছে।চোখ খুলতেই দেখল কালীতলার শ্মশান ঘাটের সিঁড়িতে সে শুয়ে আছে। হাতে একগোছা লম্বা চুল। তাহলে সবটা স্বপ্ন ছিল না। কিন্তু আকাশ! সে কোথায়!
প্রদ্যুন্মর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার বলছে আকাশ মরেনি। সে বেঁচে আছে। আজ এক বছর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে নাকি শেষ দেখা গেছিল সেই রাতে যেদিন কালীতলার শ্মশানে ঘটনাটা ঘটেছিল। সাত জনের দেহ পাওয়া গেছিল এই শ্মশানে। দেহ নয় শুধুই ধর। মুণ্ডুহীন সাতটা ধর। একমাত্র আকাশের দেহটা পাওয়া যায়নি। কিন্তু কি হয়েছিল ঠিক সেদিন কালীতলার শ্মশানে। কেউ জানে না। কেউ বলতে পারে না। কিন্তু তারপর থেকে কেউ আসেনা এখানে। রাত কি দিনের বেলাতেই এইদিকে লোক দেখা যায় না।
“কালীতলা শ্মশান খুব প্রসিদ্ধ স্থান। এখানে এসে বামাক্ষেপাও নাকি সাধনা করেছিলেন। তার শিস্য ছিলেন হরনাথ চট্টরাজ। একসময় তিনি আশেপাশের গ্রামকে রক্ষা করেছিলেন।” তেমনটাই বলেছিল আকাশ। সেও অবশ্য এই গল্প লোকমুখে শুনেছে। প্রদ্যুন্ম অবাক হয়ে সবটা শুনতে চেয়েছিল।
“একসময় নাকি আশেপাশের গ্রামে ভূতের খুব উপদ্রব ছিল। রাতের অন্ধকারে তারা সারা গ্রাম দাপিয়ে বেড়াত। গরমের দিনে মানুষ জানলা খুলতেও ভয় পেত। রাত বিরেতে পুকুর পারে গেলে সে মানুষের দেহ পরের দিন জলে ভেসে উঠত। এমনি দিনের পর দিন চলতে চলতে একসময় সবাই অতিস্ট হয়ে হারাধন চট্টরাজের পায়ে এসে পরে। সব কথা শুনে এই কালীতলার শ্মশানে এক মস্ত চিতা জ্বলে ওঠে। উনি তন্ত্রের সাহায্যে আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কিছু ক্ষতিকর অতৃপ্ত আত্মাও ছিল । তাদের মুক্তি হয়নি। তাদের একেকটা পুতুলের মধ্যে বন্দি করে, কালীতলার প্রাচীন বটগাছের ঝুরির সঙ্গে বেঁধে দেন। দীর্ঘদিন সেই আত্মারা বন্দি। আজও নাকি অমাবস্যার রাতে তাদের গোঙানির আওয়াজ পাওয়া যায় ।”
আকাশের মুখে সবটা শুনে প্রদ্যুন্মর কালীতলা শ্মশানের বটগাছটাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। এখন দশহাত দূরেই সেই বটগাছ। পুতুলগুলো এখনও ঝুলছে। জরাজীর্ণ অবস্থা, কারোর চুল নেই, কারোর হাত খসে পরেছে, মাথা নেই। কালের বাতাস বয়ে গেছে তাদের উপর দিয়ে। কিন্তু একটা জিনিস দেখে অবাক হল এখনও পর্যন্ত হরনাথ চট্টরাজের বাঁধন আলগা হয়নি। আজও সেই বাঁধনে অশরীরীরা পুতুলের শরীরে বন্দি।
প্রদ্যুন্ম সামনের দিকে এগিয়ে গেল। প্রদ্যুন্ম তো কোনদিন আকাশদের গ্রামে আসেনি। তাহলে সে কি করে পৌঁছবে মোহনপুর গ্রামে! কোনদিকে গেলে মোহনপুর? হঠাৎ কেউ কাঁধে হাত রাখল। পিছন ঘুরতেই দেখল আকশের মা। “মাসিমা আপনি এখানে? ভালোই হল। চলুন আপনাদের গ্রামে যাবো।”
মাসিমার মুখে কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে “না বাবা আমি তো এখন যেতে পারব না। পরে যাবো। তোমায় রাস্তা বলে দিচ্ছি। সামনের সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাও। এক প্রকাণ্ড বেল গাছ পাবে। তার বাঁ পাশদিয়ে সোজা চলে যাবে। আমি জানি তুমি আকাশকে ঠিক খুঁজে বার করবে।”
সময় নষ্ট না করে আকাশের গ্রামের দিকে রওনা দিলো। ভাগ্যিস সঙ্গে দাদুর গাড়িটা এনেছিল। বেশ পুরনো হলেও এখনও সার্ভিস ভালো। আকাশের গ্রামের নাম মোহনপুর। খুব দূরে না হলেও খুব কাছেও নয়। রাস্তার পাশে মাইল ফলকে লেখা মোহনপুর– সাত কিলোমিটার। মেঠো রাস্তা। কোথাও এবড়োখেবড়ো, কোথাও বেশ সমান। রাস্তাটা খুব প্রসস্থ নয়। অন্যদিক থেকে গাড়ি এলে বেশ মুশকিল। কিছুদূর যাবার পর এক প্রকাণ্ড বেলগাছ তারপাশে দুটো রাস্তা বেঁকে গেছে। প্রদ্যুন্ম নিজের মনেই বলল “এই বেলগাছের কথাই কি আকাশের মা বলছিল!” বেলগাছের বাঁ পাশ দিয়ে খুব সরু একটা রাস্তা চলে গেছে। সেখানে কোনোক্রমেই গাড়ি ঢুকবে না। বটগাছের একপাশে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে প্রদ্যুন্ম কাঁচা মাটির রাস্তা ধরল।
ভোরের আলোয় গ্রামের শোভা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল। বসন্তে গম পাকতে শুরু করেছে। সোনালী রঙ ধরেছে। গম ক্ষেতের এক প্রান্তে একটা শিমূল গাছ। পাতা নেই, ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। প্রদ্যুন্ম শহুরে মানুষ। এসব তার দেখা হয় না। একঝাঁক শালিক রাস্তার ধুলোয় খেলা করছে। পুকুরে হাঁসের দল চরে বেড়াচ্ছে। আশপাশ থেকে পাখির কলকাকলি ভেসে আসছে । রাস্তাটা একটা বড় আম গাছের পাশ থেকে বেঁকে গেছে। গাছ ভর্তি আমের মুকুল এসেছে। তার টানে মৌমাছির দল ভনভন করছে। সেদিকে একদৃষ্টে প্রদ্যুন্ম তাকিয়ে ছিল। “কি খোকা কাউকে খুঁজছ?”
প্রদ্যুন্মর সম্বিত ফিরল। একজন বয়স্ক মানুষ। মাথায় গামছা জড়ানো। গায়ে ফতুয়া আর ধুতি। তার দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। “কি হল কাউকে খুঁজছ? আগে তো কোনোদিন তোমাকে এই গাঁয়ে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।”
প্রদ্যুন্ম হাসল “না আমি এই গাঁয়ে এই প্রথম।একবন্ধুর বাড়ি যাবো। কিন্তু তার বাড়িটা চিনি না। শুধু জানি সে মোহনপুরের বাসিন্দা।”
বৃদ্ধ এবার মাথা চুলকে বললেন “আমি মোহনপুরেই থাকি। আমাকে বলতে পারো কার বাড়ি যাবে। আমি গ্রামের বহু পুরনো লোক, সবাইকেই প্রায় চিনি।”
“তাহলে তো ভালোই হল।” প্রদ্যুন্মকে নিশ্চিন্ত দেখাল। “আমি যাবো আকাশ রায়ের বাড়ি।”
বৃদ্ধর কপালে ভাঁজ দেখা দিয়েছে “আকাশ রায়! মানে মা আর ছেলে থাকত! শহরের কলেজে পড়াশুনো করে এসেছিল। গতবছর…।” বলে থমকে গেল।
প্রদ্যুন্ম বলল “হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। গতবছর কালীতলার শ্মশান থেকে হারিয়ে যায়।”
বৃদ্ধ এবার ভয় পেয়ে বললেন “তুমি জানলে কি করে সে হারিয়ে গেছে?”
প্রদ্যুন্ম উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল “আপনার নামটা তো জানা হল না।”
“আমার নাম শঙ্কর পাল। আকাশ আমাকে জ্যাঠা মশাই বলত।”
প্রদ্যুন্ম শঙ্কর পালের হাতে হাত রাখল “আপনি তো অনেক রাত ঘুমতে পারেন নি । দুঃস্বপ্ন দেখেন সারারাত।”
বৃদ্ধর চোখ ছলছল করে উঠল “তুমি কে?”,
“আমি আকাশের বন্ধু প্রদ্যুন্ম”
পাল মশাই জড়িয়ে ধরল “তুমিই প্রদ্যুন্ম। আকাশ তোমার কথা খুব বলত। তোমার অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথাও বলেছে। জানো আমাদের গ্রামে কি কি হয়ে গেছে?”
প্রদ্যুন্ম নিচু স্বরে বলল “আকাশের মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়ছিল ছমাস আগে। তিনি আমায় আকাশের নিরুদ্দেশের কথা বলেছিলেন।”
বৃদ্ধ এবার দুঃখ প্রকাশ করলেন “কতবার বারন করেছিলাম সবাই। তবু গেল। কি হল গিয়ে? অকালে প্রাণটাই চলে গেল। আকাশের মাও এক সপ্তাহ হল মারা গেছে।
প্রদ্যুন্ম চমকে উঠল আকাশের মা নেই? কিন্তু আজ সকালে… কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
বৃদ্ধ এখনও মুখের দিকে তাকিয়ে “কি আজ সকালে?”
প্রিদ্যুন্ম ঘাড় নাড়াল। না কিছু না। তবে আকাশ কিন্তু বেঁচে আছে।
বৃদ্ধ এবার হুঙ্কার দিয়ে উঠল “না বেঁচে নেই। তুমি কতটুকু জানো?”
প্রদ্যুন্ম ঠাণ্ডা গলায় বলল “না পাল মশাই আকাশ বেঁচে আছে। আমার ষষ্ট ইন্দ্রিয় কোনোদিন আমাকে ভুল সংকেত দেয় না।
পাল মশাই কি ভেবে বললেন “এসো আমার সঙ্গে।” প্রদ্যুন্মর হাতটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। একটু গিয়েই একটা চায়ের দোকান । দুটো বেঞ্চ পাতা। সেখানে জনা দশ বারোজন বসে আছে। চায়ের আড্ডা চলছে। বৃদ্ধকে দেখেই একজন বলল “কি হল পাল মশাই এমন হন্তদন্ত হয়ে কাকে ধরে আনছেন?
প্রদ্যুন্ম বুঝল পাল মশাই আজ তাকে ছাড়বেন না। কিন্তু কি জানাতে চান তিনি? কি এমন অজানা রয়ে গেছে যা আকাশের মা বলেনি তাকে?”
প্রদ্যুন্মকে ঘিরে একটা জটলা তৈরি হয়েছে।একজন প্রশ্ন করল “আকাশকে তুমি চেন কি করে?”
প্রদ্যুন্ম জবাব দিলো আকাশ আমার কলেজের বন্ধু। অবশ্য একবছর হল যোগাযোগ ছিল না। ছমাস আগে ওর মায়ের সঙ্গে দেখা কলকাতায়। তখন সব জানতে পারলাম।
আরেকজন তির্যক মন্তব্য করল “সব বলতে কি জেনেছ?”
প্রদ্যুন্ম যতটা জানে ততটাই বলল। গ্রামে এক বৃদ্ধ মহিলার শব দাহ করতে গিয়ে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। সাতজন যারা শ্মশানে এসেছিল তাদের মুণ্ডু হীন দেহ পাওয়া যায়। আর আকাশকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রামের সবাই বিশ্বাস করে আকাশ বেঁচে নেই।
এবার পাল মশাই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন “কেন বিশ্বাস করি জান! কারণ সেই বৃদ্ধা মহিলা সাধারন মানুষ নয়, সে ছিল এক ডাইনি। ডাইনিদের মৃত্যু হয় না। তারা শুধু দেহ পরিবর্তন করে। আকাশকে আমরা সবাই বারবার করে বলেছিলাম ওই ডাইনিটার দাহ কাজ না করতে। ওকে নিয়ে শ্মশানে না যেতে। কিন্তু কিছুতেই শুনল না। বলল এসব কুসংস্কার। ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গলা মেলাল গ্রামের ওই সাতটা ছেলে। ভিড়ের মধ্যে থেকে কুঁজো মতন এক থুড়থুড়ে বুড়ো বেরিয়ে এলো “ডাইনির মরণ নাই। সে মরেনি। তার দেহ রুপান্তর হয়েছে। তার জন্য তার দরকার ছিল সাতটা টাটকা কাটা মুণ্ডু। সে নিয়েছে। আর দরকার ছিল একজন ভালো মানুষ। যাকে সে বশ করে তার আদেশ পালন করাবে।”
প্রদ্যুন্ম অবাক হয়ে বলল তাহলে আকাশ এখন তার ক্রিতদাস! কিন্তু এখন ডাইনী কি রুপে আছে?
বুড়ো গম্ভীর হয়ে বলল “আকাশ ডাইনির ক্রিতদাস হলেও মনে হয় না ডাইনি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ডাইনি এখন যুবতী রুপে ঘুরে বেড়ায়। রাতের অন্ধকারে অনেকেই তাকে দেখেছে। সেই রুপে ভুললেই মৃত্যু। কিন্তু এই রুপ তার দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে না। তার প্রয়োজন সিংহ রাশি যুক্ত, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্পন্ন কোন পুরুষের রক্ত। তার শবের উপর সাধনা করে তবে সে চির যৌবনবতী হবে।তার ক্ষমতা অনেকগুন বেড়ে যাবে। তোমরা হয়ত এখনকার ছেলেরা এসব বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার ঠাকুমার কাছ থেকে আমার এসব শোনা। আমার ঠাকুমাও ডাইনি বিদ্যে জানত। কিন্তু সবার ভালোর জন্য তা প্রয়োগ করত না।”
ভিড়ের থেকে কেউ একজন বলল “মানুষের কখনও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে আমি শুনিনি। এমন মানুষ সে পাবে কোথায়?”
পাল মশাই প্রদ্যুন্মর দিকে তাকিয়ে বলল “এই গাঁয়ে বেশিক্ষন থেকো না। বিপদ বাড়বে। তুমি ফিরে যাও।”
“না আমি আমার বন্ধুকে না উদ্ধার করে কিছুতেই ফিরব না। গ্রামে এত কিছু হয়ে গেছে আপ্নারা পুলিশকে খবর দেননি?”
পাল মশাই কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল “পুলিশ এসেছিল। কিন্তু কিছু কুল কিনারা করতে পারেনি। এখন ওসব কথা বাদ দাও। “তুমি এখানে থাকবে কোথায়?”
“আকাশদের বাড়িটা কি তালা দেওয়া?”
“না। কিন্তু সেখানে তোমায় থাকতে হবে না। তুমি আমার বাড়িতে থাকতে পারো। আমি একাই থাকি। তবে আমি নিরামিষ আহার করি। যদি তোমার অসুবিধা হয় তুমি নিজে মাছ রান্না করে খেতে পারো।”
প্রদ্যুন্ম স্মিত হেসে বলল “আমার কোন অসুবিধে নেই। আমিও আপনার সঙ্গে নিরামিষ আহার করবো।
ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। যে যার কাজে চলে গেছে। প্রদ্যুন্ম পাল মশাইয়ের বাড়িতে এসে উঠেছে ।
টালির ছাদ, মাটির দেওয়াল, খুব বড় না হলেও, খুব ছোটও নয় বাড়িটা। বাড়ির দেওয়ালে ফুল পাখি আঁকা। সামনে নিকানো প্রশস্ত উঠোন। উঠোনের পূর্বদিকে একটা নিমগাছ। তার ডালে একটা দোলনা বাঁধা। তার একটু দূরে তুলসীমঞ্চ। প্রদ্যুন্ম লক্ষ করল তেমন হাওয়া না থাকলেও দোলনাটা বেশ জোরেই দুলছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ সেখানে বসে দুলছে। পাল মশাই কুয়ো থেকে জল তুলে দিলেন। “নাও হাত পা ধুয়ে দুটো খেয়ে নাও। ঘরে মুড়ি আর গুঁড় আছে। খেয়ে দেয়ে কথা বলব।”
প্রদ্যুন্ম কুয়োর মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখল, বেশ গভির। কুয়োর শীতল জলে হাত পা ধুয়ে শরীরটা জুড়িয়ে গেল। পেটে খাবার যেতেই চোখে ঘুম নেমে এলো।
চারিদিকে আঁধার নেমে এসেছে। কুয়োর মধ্যে পা ঝুলিয়ে একটি তরুণী মেয়ে বসে আছে। প্রদ্যুন্ম তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। ঝুপ করে একটা আওয়াজ হল। মেয়েটা কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিলো। তাকে বাঁচানোর জন্য প্রদ্যুন্ম কুয়োতে ঝাঁপ দিতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে কে যেন প্রদ্যুন্মকে টেনে ধরল।
প্রদ্যুন্মর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কুয়োর কাঁচা কার্নিশে এক পা, আরেক পা শুন্যে, সে দাঁড়িয়ে আছে। পাল মশাই তার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। “তুমি কি পাগল? কুয়োতে ঝাঁপ দিচ্ছ কেন?”
প্রদ্যুন্ম ভয় পেয়ে বলল “দেখলাম যে মেয়েটা ঝাঁপ দিলো।”
পাল মশাই গম্ভির হয়ে বললেন রাতের পর রাত আমি ঘুমতে পারি না। স্বপ্ন আমায় তাড়া করে নিয়ে যায়। একবছর হল আমার বউ, মেয়ে আমার চোখের সামনে এই কুয়োতে ডুবে মরেছিল। কারণ ছিল না কোন। তারা কেমন মধ্যরাতে উন্মাদের মতো কুয়োতে ঝাঁপ দিলো। আমি তখন জড় বস্তু আমার নড়বার ক্ষমতা ছিল না। আমি শুধু শুনছিলাম ডাইনির হাসি। ওই ডাইনি তাদের টেনে নিয়েছে। রোজ রাতে আমার মেয়ের গলা পাই, বাঁচার জন্য চিৎকার করে “বাবা আমাদের বাঁচাও। ”পাল মশাই হু হু করে কেঁদে উঠলেন। চোখ মুছে বললেন “আমার মেয়েটা আমায় খুব ভালবাসত তাই ছেড়ে যেতে পারেনি। ওই নিমগাছের দোলনাটাতে থাকে।
প্রদ্যুন্ম বুঝল তাই দোলনাটা ওভাবে দোলে। পাল মশাই দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল “এই একবছরে গ্রামে কত অপমৃত্যু ঘটেছে। কত মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। আজকেও সেই ডাইনি এসেছিল। তুমি আজকেই কুয়োতে পরে মারা যেতে। ক্লান্তিতে আমারও চোখ লেগে এসেছিল। কিন্তু ঠিক সময়ে আমার মেয়ে আমায় ডেকে দিয়েছে। তাই তোমার জীবন রক্ষা পেলো। সব থেকে ভালো হয় তুমি ফিরে যাও। তোমার জন্য আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। হয়ত তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে ডাইনি। আজকের রাতটাও ভালো না।”
প্রদ্যুন্ম অবাক হয়ে বলল “কেন?”
পাল মশাই একটা ছেঁড়া ক্যালেন্ডারে হাত রাখলেন “আজকেই সেই রাত আসছে যেদিন ওই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটেছিল কালীতলার শ্মশানে। আজকে আবার অমাবস্যা। কি যে ঘটবে আজ!”
প্রদ্যুন্মর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন জেগে উঠেছে। “পাল মশাই আমাদের খুব কাছেই কেউ আছে। চুপ করে কথা শুনছে। তার নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি আমি। কিন্তু আজকে আমি কোন অমঙ্গল ঘটতে দেব না। খুব কাছেই যেন কেউ খ্যাস খ্যাসে গলায় হেসে উঠল। পাল মশাই প্রদ্যুন্মকে ঘরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করল।
প্রদ্যুন্ম দমে যাওয়ার পাত্র নয়। পাল মশাই ঠিক রাত বারোটার সময় আমাকে সেই ডাইনির বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন?”
পাল মশাই আঁতকে উঠলেন “কি বলছ তুমি? তোমাকে ইচ্ছে করে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারব না। ”
“পাল মশাই, কিছু হবে না আমার। আপনি বিশ্বাস রাখুন।”
পাল মশাই কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে “আমি জানি তোমার কিছু আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। কিন্তু সেই ক্ষমতাই যদি তোমার বিপদ ডেকে আনে?”
“তাহলে সেই রক্ষা করবে পাল মশাই।”
“একটা প্রশ্ন করব প্রদ্যুন্ম?”
“বলুন”
“তুমি কালীতলার শ্মশানে পৌঁছলে কি করে? তুমি তো কলকাতায় থাকো।”
তাহলে শুনুন পাল মশাই আমাকেও এক স্বপ্ন তাড়া করে। রাতের পর রাত আমি নিদ্রাহীন। স্বপ্নে অচেনা এক নারী এসেছিল। তাকে আমি চিনি না, তার মুখ দেখিনি আমি। সে আমাকে কালীতলার শ্মশানে আসতে বলেছিল। তার আগেই আমি আকাশের খবরটা পেয়েছিলাম। সেই নারীর আহ্বান আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। আমাকে সে টানছিল। সেই যেন আমায় কালীতলার শ্মশানে নিয়ে গেছিল। তারপর এক ভগ্ন অট্টালিকা। আকাশের সঙ্গে দেখা। সব কেমন স্বপ্নর মতো।
পাল মশাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন “তুমি বুঝতে পারনি সে সেই ভয়ঙ্কর ডাইনি।”
“তাহলে আগের দিন আমাকে হাতের নাগালে পেয়েও কেন আমার হত্যা করেনি?”
পাল মশাই প্রদ্যুন্মর হাতটা চেপে ধরেছে “কাল যে তার দিন ছিল না। আজ অমাবস্যা আজ সেই ভয়ঙ্কর দিন আজ সে তোমার রক্ত পান করে চির অমরত্ব লাভ করবে।
জানি না পাল মশাই আজ সে অমরত্ব লাভ করবে নাকি চিরকালের মতো মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু আমাকে আকাশকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতেই হবে। ডাইনির দুর্বলতা তার চুলে। সেই চুলের গোছা আমার কাছে আছে। যতক্ষণ তা আমার কাছে, সে কিছুতেই আমাকে হত্যা করতে সাহস করবে না। আজ রাতে আপনি আমায় নিয়ে যাচ্ছেন তার বাড়িতে।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত গভির হচ্ছে। পাল মশাইয়ের বাড়ির আশেপাশে যেন কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে তার পায়ের নুপূরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কয়েকবার ঝড়ো হাওয়া না থাকলেও জানলা দরজা প্রচণ্ড আওয়াজ করে দরাম দরাম করে খুলে গেছে। পাল মশাই ইষ্ট নাম জপ করছেন। দরজার বাইরে মনে হল কেউ ডাকছে। প্রদ্যুন্ম গলার আওয়াজ শুনে বলল “আকাশের মা আমায় ডাকছে।”
পাল মশাই আঁতকে উঠলেন “আকাশের মা তো মারা গেছেন। সব ডাইনির চক্রান্ত। তুমি বাইরে যেও না।” না প্রদ্যুন্ম কোন কথাই শুনল না। অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে গেল। বাড়ির পিছনে আকন্দ ফুলের জঙ্গল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সামনের শাড়ি পরা ভদ্রমহিলাকে অনুসরণ করে চলেছে। খুব আবছা দেখা গেলেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। এবার সে ঘুরে দাঁড়ালো। সামনে আকাশের মা। “প্রদ্যুন্মর কাছে এসে বলল “বন্ধুর জন্য নিজেকে বলি দিতে পারবে?”
কথাটা শুনে অবাক হল প্রদ্যুন্ম। মাথা নামাতেই দেখতে পেল উলট দুটো পা। বুঝতে বাকি থাকল না যে ইনি আকাশের মা নয়, স্বয়ং ডাইনি এসেছে ছদ্দবেশে। প্রদ্যুন্ম পকেট থেকে দেশলাই বের করে ফস করে জ্বালিয়ে দিল। “আমার জীবনের পরিবর্তে যদি আমার বন্ধুর জীবন বাঁচত, আমি তাই করতাম। কিন্তু ডাইনি সবটাই তোর ভয়ঙ্কর চক্রান্ত। দেশলাই এর আলোতে ডাইনির অবয়ব মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোনায় লেগে রয়েছে ধূর্ত শয়তানের হাসি।
রাত বারোটা বাজে। পাল মশাই গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে উঁচু মাটির ঢিপির উপরে একটা ছোট কুঁড়ে ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখালেন। যদিও অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। প্রদ্যুন্ম, পাল মশাইকে গ্রামের লোকদের নিয়ে কালীতলার শ্মশান ঘাটের দিকে যেতে বলল। “পাল মশাই আমি শুনেছিলাম কালীতলা শ্মশানে একসময় হারাধন চট্টরাজ বিশাল এক চিতা জ্বালিয়ে ছিলেন অশরীরীদের মুক্তির জন্য। আজ সেরকমই এক চিতা জ্বালাতে হবে।” পাল মশাই আর দেরি করলেন না নিজের কাজে লেগে পরলেন।
নদীতে এখন জোয়ার চলছে। জলের স্রোত বেড়েছে ।তার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেল। টর্চের আলো ফেলে প্রদ্যুন্ম উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে, মাটির ঢিপির উপর উঠে এলো। কুঁড়ে ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে জমাট অন্ধকার। অন্ধকারের গায়ে প্রদ্যুন্ম টর্চের আলো ফেলতেই মনে হল একটা ছায়া মূর্তি তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে সরে গেল। ভিতরে এসে প্রদ্যুন্ম টর্চের আলোয় যা দেখল তাতে তার হাড় হিম হয়ে এলো। সারা ঘরে কাটা আঙুল, হাতের অংশ, কাটা পা পড়ে রয়েছে। কেউ যেন একটু আগেই এখানে বসে এগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। প্রদ্যুন্ম আসাতে তার আহারে বুঝি ব্যাঘাত ঘটেছে। ভিতর ঘরে ধম, ধম করে আওয়াজ হচ্ছে। প্রদ্যুন্ম ছুটে গেল। মাটির গভীরে একটা সুড়ঙ্গ নেমে গেছে। কেউ যেন খুব তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছে ।
প্রদ্যুন্ম খুব দ্রুত গতিতে তার পিছন ধাওয়া করল। যত গভিরে নেমে যাচ্ছে একটা অদ্ভুত আঁশটে গন্ধ আসছে। প্রতিটি সিঁড়িতেই আধখাওয়া মানব শরীরের অংশ পরে রয়েছে। হয়ত নিখোঁজ মানুষগুলো ডাইনির আহারে রুপান্তরিত হয়েছে। একসময় সিঁড়ি শেষ হয় এসেছে। টর্চের আলোর আর প্রয়োজন হল না। কে যেন প্রদীপের বৃত্ত তৈরি করেছে! সেই বৃত্তের মধ্যে বসে আছে আকাশ। প্রদ্যুন্ম দৌড়ে গেল “আকাশ তুই এখানে এভাবে বসে আছিস কেন? আমাদের এখুনি পালাতে হবে। চল।”
আকাশ এবার অট্টহাসিতে ফেটে পরল। আমি পালাব না। তোকে আমার মায়ের হাতে তুলে দেব।
তোর মা মানে? প্রদ্যুন্ম অবাক হয়ে গেল।
“আমার জন্মদাত্রী মা, যাকে তোরা ডাইনি বলিস। তোর রক্ত পান করে আমার মা চির কালের অমর ডাইনি, চিরো যৌবনবতী হয়ে যাবে। কেউ তাকে মারতে পারবে না।”
প্রদ্যুন্ম অবাক হল এই আকাশ তার বন্ধু! তুই কি ইচ্ছে করেই আমায় ডেকে এনেছিস?
এবার আকাশ হিস হিস করে বলল “ঠিক ধরেছিস। তোকে এখানে আনার জন্যই তো এত ষড়যন্ত্র। তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব।
প্রদ্যুন্ম যত শুনছে তত অবাক হয়ে যাচ্ছে। “ষড়যন্ত্র! ডাইনিকে তুই মা বলছিস কেন? তোর মা তো এক সপ্তাহ আগেই মারা গেছে।”
আকাশ আবার হাহা করে হেসে উঠল, “সে আমাকে পালন করেছে মাত্র। আমার জন্মদাত্রী হল আমার ডাইনী মা। সে জন্মদিয়েই আমাকে ফেলে এসেছিল আমার পালক মায়ের কাছে। এই দুবছর হল আমি জানতে পেরেছি আসলে আমি ডাইনির সন্তান। আমার ডাইনি মায়ের আয়ু শেষ হয়ে আসছে। প্রতি একশ বছরে তার নতুন রুপ হয়। সে আবার যুবতী হয়ে ওঠে। সে চিরতরুণী। আমাকে ছেলের কর্তব্য করতেই হবে। আমার ডাইনি মা কে বাঁচাবার জন্য তোর রক্ত চাই।
প্রদ্যুন্ম পিছিয়ে এলো “আমার রক্ত? কেন? ”
কারণ তুই কোন সাধারন মানুষ নয়। তোর ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা আছে। তাই তোর রক্তপান করলে আমার মা আবার আগের মতো যুবতী হয়ে উঠবে আবার একশ বছর পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াবে।
প্রদ্যুন্মর গলা কাঁপছে “তাহলে ডাইনির মৃত্যু হয়নি সেদিন। আর ওই সাতটা ছেলের মাথা কে কেটে নিলো?“
আকাশ উঠে দাঁড়িয়েছে “সেই সাতটা ছেলেকে আমার ডাইনি মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সে তাদের মাথা কেটে নিয়েছে। কেটে শয়তানের ভোগ চরিয়েছে।
প্রদ্যুন্ম চিৎকার করে উঠল “না ওই ডাইনি তোর মা নয়। তোর আসল মা হল যে তোকে পালন করেছে । তাই মৃত্যুর পরও সে শান্তি পায়নি। আমার কাছে এসে মিনতি করেছে তোকে যেন আমি বাঁচাই।
আকশ কিছুক্ষনের জন্য অবাক হয়ে বলল “মা এসেছিল!”
এর মধ্যেই ডাইনিটা কোথায় ঘাপটি মেরে ছিল। এবার প্রদ্যুন্মর সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই অতি বৃদ্ধা। দেহ থেকে চামড়া গলে পরছে। এগিয়ে এসে বলল “আমার চুলের গোছাটা দে।“
প্রদ্যুন্ম বাঁকা হাসি হেসে বলল, “না সে ভুল আমি করছি না।” হাতের মধ্যে সেই চুলের গোছা পেঁচিয়ে সুরঙ্গর সামনের দিকে দৌড়তে লাগল। পিছনে ভয়ঙ্কর চিৎকার করতে করতে ডাইনি যেন উড়ে আসছে। তার পিছনে আকাশ দৌড়চ্ছে। “প্রদ্যুন্ম তুই এভাবে বাঁচতে পারবি না। তার থেকে বরং তোর মৃত্যুটা যাতে ভয়ঙ্কর না হয় সেটা আমি দেখব।
প্রদ্যুন্ম থামছে না। দৌড়তে দৌড়তে সেদিনের দেখা সেই ভগ্ন অট্টালিকার প্রাঙ্গনে পৌঁছে গেছে। জোরে সামনের বন্ধ দরজা ঠেলে দিতেই সেটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পরল।সেখনে দেখা যাচ্ছে শয়তানের প্রেতমূর্তি। তার সামনে সাতটা মুণ্ডু দিয়ে আসন করা। প্রদ্যুন্ম পাশ কাটিয়ে ছুটে চলল। কাছেই দেখা যাচ্ছে কালীতলার শ্মশান ঘাট। সেখানে বিশাল এক চিতা জ্বালিয়েছে পাল মশাইরা। প্রদ্যুন্ম একটুও সময় নষ্ট না করে প্রাচীন বটগাছের সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ আমাবস্যা। বটগাছে বাঁধা পুতুলগুলো যেন আজ জেগে উঠেছে। তাদের চোখ জ্বলছে। কতবছর ধরে তারা বন্দি। সেই আক্রোশে তারা গর্জন করছে। প্রদ্যুন্ম তাদের সামনে চিৎকার করে বলতে লাগল “আর কতকাল বন্দি থাকবে তোমরা? মুক্তি চাও না?”
একসঙ্গে বন্দি প্রেতাত্মারা কেঁদে উঠল “আমরা মুক্তি চাই।”
প্রদ্যুন্ম তাদের অভয় দিয়ে বলল আজ তবে ওই ডাইনিকে নিয়ে যাও তোমাদের সঙ্গে। মানুষের উপকার করো। এই গ্রামকে আবার আগের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরে যেতে দাও। ঈশ্বর তোমাদের নিশ্চয়ই মুক্তি দেবেন। প্রদ্যুন্ম বটগাছের প্রতিটা ঝুড়ি তে বাঁধা পুতুল গুলোকে খুলতে শুরু করেছে। কখন ডাইনি তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রদ্যুন্মকে ছোঁয়ার আগেই, আশ্চর্য ভাবে পুতুলগুলো ডাইনির সারা গায়ে শুঁয়োপোকার মত লেপটে ধরে তাকে হিড়হিড় করে আগুনের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রদ্যুন্মর হাতে থাকা চুলের গোছাটাও চিতার আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ডাইনির সারা শরীর চিতার আগুনে পুরে যাচ্ছে। ঝলসে পরছে তার চামড়া। তার বিদীর্ণ চিৎকারে আকাশ কেঁপে উঠছে। আর সঙ্গে জ্বলে যাচ্ছে কয়েকশ পুতুলের দেহ। বাতাসে ছড়িয়ে পরছে পোড়া চামড়ার গন্ধ ।
পাল মশাই সহ গ্রামের সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। এর কোন যুক্তি নেই। কালীতলার শ্মশানের সেই চির পুরাতন বটগাছটাও মাটি থেকে শেকর সমেত তার প্রতিটা ঝুড়ি নিয়ে মুখ থুবড়ে পরেছে। কেউ যেন তার শিকর ধরে উপড়ে ফেলেছে। এবার অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা গেল আকাশের মধ্যে। তার উগ্র রুপ আর নেই। সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে আগুনের সামনে।
প্রদ্যুন্ম তার ক্ষমতা দিয়ে আকাশের জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু তার কিছুই মনে নেই। এই দু’বছর সত্যি সে ডাইনির ছেলে নয় ক্রীতদাস ছিল। প্রদ্যুন্ম সেদিন চিতার আগুনের আলোয় আরেকজনকেও দেখছিল। আকাশের পালক মা। যে তাকে জন্ম না দিয়ে বুকের রক্ত দিয়ে মানুষ করেছে। সে দুহাত ভরে প্রদ্যুন্মকে আশীর্বাদ করছে।

জন্ম – ১৯৮৩ ,১৬ই মার্চ , আসানসোল । দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক ।ইতিহাসে স্নাতকোত্তর । প্রথম প্রকাশিত গল্প প্রতিদিন সংবাদপত্রের রবিবারের ছুটির পাতায় ( ২০১৫)।
গল্প প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রপত্রিয়ায় যেমন – আনান্দবাজার, বর্তমান ,এবেলা ,প্রতিদিন , এই সময় , আজকাল , যুগ শঙ্খ
এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পের বই – ইচ্ছেমৃত্যু, রুপকথা নয় ,যে গল্পের শেষ নেই (কমলিনী, পরিবেশক – দে’জপাবলিশিং), অনির্বাণ ও মুখবই (অশোকগাথা)।
“ইচ্ছেমৃত্যু” বইটি আত্মজ সাহিত্য সম্মাননা এবং ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার পায় ২০১৭ সালে ।এই সঙ্কলনের “ব্রেকিং নিউজ” নামে গল্পটি নাটক রুপে একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে ।
ছোটদের জন্য প্রথম প্রকাশিত গল্প সন্দেশ পত্রিকায় (২০১৮) ।আনন্দমেলা , কিশোর ভারতী, শুকতারাতেও ছোটদের জন্য গল্প লিখেছেন ।