Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,puja 2021 kids story gazi tanzia

উৎসব সংখ্যা শিশু: যাদু ঘরের অদ্ভুত যাদু । গাজী তানজিয়া

Reading Time: 4 minutes

বল, কে পাঠিয়েছে তোকে?
কে আবার পাঠাইব, নিজেই আসছি!
বদিউলের কথা বোধহয় লোকগুলো বিশ্বাস করছে না। তারা সার্চলাইটের মতো চোখ দিয়ে গুরুতর অপরাধী খোঁজার ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর এখানকার হেড অব দি সিকিউরিটি আবারও হুš‹ার ছোড়ে, বল সত্যি করে, কে পাঠিয়েছে তোকে? মুদ্রা চোর, নাকি মূর্তি চোরের গ্যাং তুই?
বদিউল এসব কথার কোনো মাথা মুন্ডু বোঝে না। তার দুচোখ ভরে ঘুম আসতে থাকে। তার সামনে এখন ঘোর বিপদ জেনেও সে হাই তোলে।
তার হাই তোলা দেখে সিকিউরিটিদের একজন বলে, ‘স্যার মনে হয় ছেলেটা নিরীহ, সত্যিই কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না’।
‘আবার উল্টোটাওতো হতে পারে, ছোড়া পাক্কা ধড়িবাজ’।
বদিউলের চোখে এখন রাজ্যের ঘুম ভর করেছে। তার চোখের সামনে একটা পালক ভাসছে হাওয়ায়, হাওয়ায়। সে তার পেছন পেছন ছুটছে। বদিউল ওই পালকে ভর করে তার দেশে ফিরতে চাইছে। সে এখানে থাকতে চায় না, আর থাকতে চায় না। পালকটা বাতাসে ভাসছে ভাসছে। মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ খাঁচায় বন্দি মুরগী বা কবুতরের শরীর থেকে আলগা হয়ে খসে পড়া এই পালকটা প্রাণ পেয়েছে। বাতাসে ভর করে সে ছুটছে ছুটছে আর ওর পিছু পিছু ছুটছে কারওয়ান বাজারের মিনতি বদিউল।

সে এখানে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। এখানে আসার সখ ছিল তার সেই ঢাকা আসার পর থেকেই। যাদুঘর না জানি কেমন!
সে সেদিনও বাজারে উড়তে থাকা এমন একটা পালকের পিছু পিছু ছুটছিল, এমন সময় তার বন্ধু হাফিজুল বলল, ‘এই বদি তুই উপরের দিকে কি দেখতে দেখতে যাইতাছ? গাড়ির নিচে পড়বি তো’!
দেখ, পালকটা কেমন বাতাসে ভাসতাসে।
ও তো সব সময়ই ভাসে। তুই ওর পিছনে দৌড়াইতেছিস কেন? বদিউল ওই উড়ন্ত পালকটার দিকে চোখ রেখেই বলে, ‘দেখি এইভাবে কতদূর যাইতে পারে’।
‘বেশিদূর পারব না, বাতাসটা উল্টা ঘুরলেই পইড়া যাইব’।
হাফিজুরের কথা শেষ না হতেই পালকটা একটা পাক খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল নোংরা ধুলিভরা রাস্তায়।

বদিউলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ‘ইস্স পড়ে গেল’!
তুই মাঝে মাঝে এমন করস না বদি, ওইটা পড়ব না? শধু একটা পালক কতক্ষণ একলা একলা ভাসতে পারে! চল ছুটি কাজের পিছে। দেখতো এর মইধ্যে কতো কাস্টমার ছুইটা গেল।
ঊদিউল আবার তার কাজে লেগে পড়ে। বাজার করতে আসা এক মোটা সোটা ভদ্রলোকের পিছু নেয় তারা। সে যে দোকানে যায় পিছু পিছু যায় তারা, আর ওদের হাতে থাকা ঝুড়িটা এগিয়ে ধরে। সবজি, ফল আর মুরগি-কবুতরে ভরে ওঠে ঝুড়িগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। এই সবকিছু কিনে ফেলেছেন মোটা লোকটা। বাজার শেষ হলে লোকটা বলল, ‘নে চল, গাড়িতে উঠা সব’।
অসম্ভব ভারী হয়ে ওঠা ওই ঝুড়িটার সব জিনিস গাড়ির বনেটে তুলে দিয়ে ওরা তাকায় লোকটার দিকে, ‘স্যার ট্যাকা’।
ভদ্রলোক পকেট থেকে বিশটাকা বের করে প্রায় ছুঁড়ে দেন ওদের দিকে। ওরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, ‘এতো কম’!
হাফিজুল বলে ওঠে, স্যার এতো বড় দুইটা ঝুড়ি বইলাম আর মাত্র বিশ টাকা দিলেন?
আর কত দিব এইটুকু পথের জন্য?
সারা বাজার ঘুরলাম আর এইটুকু পথ হইল?
আরে যা যা। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করো।
ওরা দুইজন দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর আবার ছুটলো কাজের খোঁজে।
বদিউল ভাবল, এতো কম টাকা পেলে আজো তিনবেলা খাওয়ার টাকা জোগাড় করার পর যাদুঘর দেখতে যাওয়া হবে না। সেই যে গত মাসে সে তার মা-বাপ আর বোনের সাথে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসেছে, এখন পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচেই তাদের বাস। মাথার ওপর ছাউনিওয়ালা একটা ঘরের কথা সে যেন ভুলতেই বসেছে। রাতে কারওয়ান বাজারের সামনের রাস্তার ফুটপাতে ঘুমানোর আয়োজন করতে করতে ভাবে মাথার ওপর একটা ছাউনিওয়ালা ঘর কেমন হয়? কত আরামদায়ক হয় সেই ঘর! বদিউল তার বাজার বওয়া ঝুড়িটার ভেতরে কাঁথাটা যতটা সম্ভব ভালো করে বিছাতে চেষ্টা করে। আর আতঙ্কিত হয় শীতের ভয়ে। যত রাত বাড়ে শীতটা যেন কন কন করে ঢুকে যায় হাড়ের ভিতরে। শেষরাতে সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে, তার ওপরে টপ-টপ করে শিশির পড়ে ভিজিয়ে দেয় গায়ে জড়িয়ে রাখা কাঁথাটা। আর সেই ছেড়া কাঁথাটা ক্রমাগত শরীরের সাথে জড়িয়ে নিতে নিতে বদিউল ভাবে কাল সে যাবে যাদুঘর দেখতে। কালকে সে যাবেই, দরকার হলে একবেলা সে খাবে না। সেই টাকাটা বাঁচিয়ে সে যাবে যাদুঘর দেখতে। যাদুঘর নামটা শোনার পর থেকেই তার ভেতরে ভীষণ এক কৌতুহল জন্মেছে। কী যাদু আছে ওই ঘরটাতে? ওখানে গেলে কি সে যাদু শিখতে পারবে? সেই যাদু তার মাথার ওপরে একটা ছাদ এনে দিতে পারবে? বা তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে পারবে তাদের দেশ-গ্রামে। যেখানে শীতলক্ষা নদীর পানি উঠে ডুবে আছে ঘর-বাড়ি। যাবে সে যাদুঘরে, কাল-ই যাবে।

পরদিন একবেলা না খেয়ে সেই পয়সায় টিকেট কিনে যাদুঘরে ঢুকল বদিউল। হাফিজুলকে আসতে বলেছিল কিন্তু সে আসে নাই। তার হাতে নাকি অত সময় নাই, শখও নাই। বদিউল কি আর শখে আসছে, সেও তো আসছে যাদু দেখতে। কী যাদু আছে ওই বড় বাড়িটার মধ্যে?

বদিউল যাদুঘরে ঢুকে দেখে শুধু ঘরের পর ঘর। কত পুরানা আমলের রাজা-বাদশাহদের জিনিসপত্রে ঠাঁসা। কিন্তু এর মধ্যে যাদু কোথায়? একটা বিশাল ঘরের মধ্যে রাখা হয়েছে একটা বিশাল তিমি মাছের কঙ্কাল। একটা মৃত মাছের কঙ্কালের জন্য এতা বড় একটা ঘর! আর তারা জলজ্যান্ত মানুষ হয়েও দিনের পর দিন, রাতের পর রাত খোলা আকাশের নিচে কাটাচ্ছে! এ কেমন দেশ! আর এইটা কী এই দেশের যাদু! বদিউল তার পরও হতাশ হয় না। তন্ন তন্নœ করে এ ঘরে সে ঘরে যাদু খোঁজে। আর খুঁজতে খুঁজতে একসময় সে ভাবে, যাদু তো সে-ই দেখাতে পারে। আজকের রাতটা, এই কনকনে শীতের রাতটা সে খোলা আকাশের নিচে প্রচণ্ড শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য কাটিয়ে দিতে পারে এখানে। ওই যে রাজা মহারাজাদের বড় বড় খাটগুলো আছে, মখমলের চাদর বিছানো বিছানা- ওখানে শুয়ে ঘুমাতে পারে একটা রাত। শান্তির ঘুম।

বদিউল ভাবে সন্ধ্যা হলে সে এখান থেকে বের হবে না। লুকিয়ে চুরিয়ে থেকে যাবে এখানে। সে একটা ছাদের নিচে ঘুমাতে চায় অন্তত একটা শীতের রাত। এর মধ্যে সন্ধ্যা নামল। যাদুঘর থেকে সব লোক বের হয়ে যাওয়ার জন্য ঘন্টি বাজল। সব লোক বের হয়ে যাচ্ছে আর বদিউল এঘর থেকে সে ঘরে সে ঘর থেকে ও ঘরে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

এক সময় সব লোক বের হয়ে গেল। বিশাল এই বাড়িটা তার যাবতীয় প্রাচীন জিনিসপত্র নিয়ে থমথমে হয়ে জেগে রইল। আর বদিউল গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ল নওয়াব সাহেবের খাটে।
যেই না শুয়ে পড়েছে অমনি তাকে এসে ধরে ফেলল গার্ড। আইন অমান্য করে এখানে থেকে যাওয়ার জন্য বদিউলের এখন শাস্তি হবে। বদিউল গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তার সামনে একদল সিকিউরিটি। এর মধ্যে প্রধানজন তাকে জেরা করছে।

তুই এখানে থেকে গিয়েছিলি কেন? চুরির মতলব? দেশের মূল্যবান পূরাকীর্তি বিদেশে পাচার করতে চাস? বল কে পঠিয়েছে তোকে? তোর গ্যাং-এর নাম বল।
বদিউল কি বলবে, সে যে এর কিছুই জানে না। সে শুধু জানে বাঁধ ভেঙ্গে পানি জমার কারণে তাদেরকে ভিটে-বাড়ি ছেড়ে লেখা-পড়া ছেড়ে, কাজের আশায় খাদ্যের খোঁজে ঢাকা আসতে হয়েছে। গ্রামে তাদের বাড়ি আছে, সেই বাড়ি পানি বন্দি। আর এখানে খাদ্য আছে থাকবার জায়গা নাই।
সিকিউরিটি আবার হুঙ্কার ছোড়ে, বল কে পাঠিয়েছে তোকে?
বদিউল বলে, কেউ না ছার, আমি নিজের ইচ্ছাতেই আসছিলাম যাদু দেখতে। কিন্তু দুইন্যাতে যে যাদু বলতে কিছু হয় না, সেইটা কে জানতো!

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>