| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা শিশুতোষ গল্প: ধর্মবুদ্ধি ও পাপবুদ্ধির গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

এক গাঁ।

গাঁয়ে সবাই মোটামুটি বেশ সুখেই থাকে। সবার সঙ্গে সবার ভাব।এর কাজে ও এগিয়ে আসে, ওর কাজে এ।সেই গাঁয়ে বেশির ভাগ মানুষই কৃষ্ক। রোদে ঝড়ে জলে কখনো পুড়তে পুড়তে, কখনো ভিজতে ভিজতে চাষ করে। গাঁয়ে একটি আছে পাঠশাল, যেখানে গাঁয়ের যত বাচ্চা পুঁথি হাতে, কুশাসন বগলে পড়তে যায়। সারা সকাল সেখানে পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে মন দিয়ে লেখাপড়া করে। পাঠশাল শেষ হলে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফেরে। একটি আছে আপণ, যেখানে সম্বৎসরের চাল ডাল ঘি তেল নুন মশলাপাতি চিঁড়ে মুড়ি বাতাসা নকুলদানা থেকে শুরু করে পিদ্দিমের সলতে পাকানোর তুলোটুকু পর্যন্ত পাওয়া যায়।

এক ঘর কুমোর, এক ঘর লোহার, এক ঘর তাঁতি, এক ঘর ছুতোর, এক ঘর জেলে; তাও আছে। কুমোরে বানায় সব হাঁড়ি কুঁড়ি কড়াই মড়াই পিদ্দিম পিলসুজ, ঘর সাজানোর মাটির ঘোড়া, পালকি কাঁধে ছয় বেহারা। বানায় জলের কালো কুঁজো, ঘোর গরমেও জল থাকবে বুকজুড়োনো ঠাণ্ডা, মোটা মস্ত বড় বড় জালা, ভেতরে তাকালে যেন নিঃসীম আঁধার, যেখানে অনেকটা করে জল ধরে রাখা যায়। লোহার বানায় সুতীক্ষ্ণ ছুরি, কী শক্ত তার বাঁট, তাতে আবার নক্শা করা, ধারালো শাবল– এক কোপে ছোটোখাটো গাছ নুয়ে পড়ে, মাটি কোপানোর চওড়া কোদাল– চাষের জমিতে ঝপাঝপ পড়ে, আর খাবলা করে মাটি উঠে আসে, লোহার মস্ত কড়াটড়া, উৎসব অনুষ্ঠানে লোক খাওয়ানোর সময় লাগে, ঝনঝন আওয়াজ করা শেকল, এমনকী দরজার হুড়কো পর্যন্ত ।

তাঁতির কাছে পাবে কত রকম ধুতি আর শাড়ি। সরু পাড়ে কল্কা, চওড়া পাড়ে সারি দিয়ে হাঁস চলেছে ফুল ফুটেছে হাতি নাচছে ঘোড়া ছুটছে! ময়ূরবরণ ময়ূরাক্ষী শাড়ি, মেঘের মতো মেঘডম্বর শাড়ি, রাতের আকাশের মত নীলাম্বরী, তাতে জরির ফোঁটা দেওয়া, যেন আকাশের গায়ে তারারা ঝলমল করছে। তাঁতি-বউ বানায় ছোটদের কাপড়চোপড়। গামছা মশারী।
ছুতোর বানায় বসার জন্য জলচৌকী, শোওয়ার জন্য খাট-পালঙ্ক, তাতে আবার কখনো বাজপাখি ডানা মেলে তীক্ষ্ম ঠোঁটে তাকিয়ে থাকে, কখনো বা দুই দিকে দুটি মেয়ে হাতজোড় করে হাসি মুখে চেয়ে থাকে।

আর জেলের জালে ধরা পড়া মাছের জন্য তো সারা গাঁয়ের লোক হাঁ করে থাকে! মাছ পড়বে যেরকম, রান্না হবে সেইরকম! কই পেলে তেল-কই বা একদিকে মিষ্টি অন্যদিকে টক হরগৌরী, রুই পেলে বড় দাগা দিয়ে কালো জিরে দিয়ে ঝোল, পেটি দিয়ে সর্ষে ঝাল, ইলিশের সময় ঝকঝকে রুপোলি ইলিশ ভাজা ভাপা সর্ষে, বা বেগুন দিয়ে পাতলা ঝোল, যার যেমন ইচ্ছে!!

সেই গাঁয়ের সবাই সুখী, আগেই বলেছি।তবে একজন ছাড়া। তার নাম পাপবুদ্ধি। ছোট থেকেই সে কোনো কিছুতে খুশি নয়। পাঠশালে তার তেমন কোনো বন্ধুই ছিলনা। পড়াশোনাতে মন ছিল না, খেলাধুলো ভালোবাসত না। মুখটা সারাক্ষণ যেন গোমড়া, ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্য। সেই ভাব বড় হয়ে আরো বাড়ল। পাপবুদ্ধি খালি ভাবত কম খেটে কি করে বেশি পয়সা করা যায়!! পয়সা বাঁচানোর জন্য তার যত ফন্দী। বিছানার চাদরে চিমটি কাটলে ময়লা, পরার জামাকাপড়ে চিমসে গন্ধ, শুকনো চিমড়ে গায়ে খড়ি ওঠে! পাপবুদ্ধি আর তার বাবা সকালে খায় ভাতের মধ্যে জল ঢেলে, রাতে খায় জলের মধ্যে ভাত ঢেলে। সঙ্গে থাকে কোনোদিন দুটি লঙ্কা আর ডালের বড়া। কোনোদিন তাও না। তার বাড়িতে না আসত কোনো অতিথ্, না সে যেত কারুর বাড়ি। জ্বরজারি হলে বরং তার মুখে হাসি ফুটত। বাবাকে বলত, “একবেলা উপোস দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! একবেলার খাবার বেঁচে গেল!”

যে ঘরে তারা থাকত, তার ছাদের চাল ফুটো ফুটো। দেওয়াল যেন ভেঙে পড়বে যখনতখন। ঘরের ভেতর বাইরে ছুঁচোর কীর্তন! গাঁয়ের ওপর দিয়ে উড়ে চলা পাখিরাও জানে যে এইখানে খুদকুঁড়োও জুটবে না। তাই ভুলেও আসে না।

পাপবুদ্ধির ঘরের পাশ দিয়ে যে পথ গিয়েছে বেঁকে, সেই পথ ধরে খানিক এগোলেই এক ছোট্ট দোতলা কুঁড়ে ঘর। তার দেওয়ালে গেরুয়া মাটি দিয়ে লেপা। তাতে আবার কত কী চিত্র করা। কোথাও শঙ্খলতা কোথাও হংসলতা। উঠোন একেবারে ঝকঝকে তকতকে করে নিকোন। উঠোনের এক পাশে ছোট্ট বাগানে বেল জুঁইও ফুটছে, আবার লাল ডাঁটা আর ঝাল লঙ্কাও হয়েছে। চালের ওপর উঠে গেছে সবুজ নরম লাউয়ের লতা। তার সাদা ফুল ধরেছে কত! এই ঘরখানি ওই সুখী গাঁয়ের সবচেয়ে সুখী মানুষটির। ধর্মবুদ্ধির।

খুব যে সুপুরুষ সে, তা না হলেও তার মুখে সর্বদা হাসি। পাঠশালে সে যেত পরিপাটি হয়ে সবার আগে। পাপবুদ্ধি যখন এক কোণে বসে তেরচা চোখে সবাইকে দেখত, তখন ধর্মবুদ্ধি সবাইকে নিয়ে খেলা করত। ঘর থেকে আনা মিষ্টি ভাগ করে খেত। পাপবুদ্ধিকেও দিত। কতবার তাকে ডাকত, “আয় না রে, আমাদের সঙ্গে খেলা করবি? এমন একা একা বসে থাকিস কেন?”
সেই ধর্মবুদ্ধি বড় হল। পড়াশোনার সঙ্গে কাপড় বোনা শিখল। ঘরের পাশে ছোট আরেকটি ঘর তুলে তাতে তাঁত বসাল। কাপড়ের নকশায় নতুন নতুন ভাবনা আনল। সেই কাপড় জমলে বছরে দুই বার নগরের হাটে নিয়ে যেত ধর্মবুদ্ধি। হু হু করে সব বিক্কিরি হয়ে যেত। ওই আয়েই এসোজন বসোজন, সংসার চালানো সব কিছু।

পাপবুদ্ধি নিজের ঘরের সামনে বসে বসে সব দেখে। আর ভাবে, “ওই ব্যাটা ধর্মবুদ্ধিকে দেখলে কে বলবে ছোটবেলায় বাড়িতে রোজ দুবেলা হাঁড়ি চড়ত না। ওর মা কতদিন রাতের বেলা চুপিচুপি এসে আমার মায়ের কাছে চাল চেয়ে নিয়ে যেত! সেই ধর্মবুদ্ধি এখন অবস্থা ফিরেছে। তবে যেভাবে চালাচ্ছে, বেশিদিন আর এই পয়সা থাকবে না। সব ফুড়ুৎ হয়ে আগের অবস্থায় ফিরতে হবে।”

এইভাবে দিন যায়। একদিন ধর্মবুদ্ধি নিজের ঘরে বসে কাগজের ওপর রঙ দিয়ে নতুন নক্শা আঁকছিল। খুব মন দিয়ে। গলা খাঁকরানোর আওয়াজ পেয়ে চমকে মুখ তুলে দেখে পাপবুদ্ধি সামনে দাঁড়িয়ে। তড়িঘড়ি করে উঠে পুরোনো বন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাল সে, “আরে পাপবুদ্ধি যে! এস এস। তুমি তো কখনো আসোই না! অবশ্যি নানা কাজে আমারও যাওয়া হয়ে ওঠে না! তা যাক্ গে। ভালোই হল তুমি এসেছ। এখন কি খাবে বলো দেখি! দুপুরে কিন্তু এখানেই খাও। ভোরবেলাতেই জেলেভাই দু তিন রকম মাছ দিয়ে গেছে দেখলাম। কই মৌরলা আর কাঁচকি। তুমি বসো, আমি মাকে বলে এক্ষুণি আসছি”।
“দাঁড়াও ভাই ধর্মবুদ্ধি! খাওয়া দাওয়া হবে’খন। তোমার সঙ্গে একটা দরকারি পরামর্শ করতে এসেছি। সেটা আগে বলি। তারপর বাকি সব।”
“কি ব্যাপার বলো তো”? সামনে আসনে পাপবুদ্ধিকে বসতে বলে নিজেও কাপড়চোপড় সামলে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল ধর্মবুদ্ধি।

চারপাশে ঝালর দেওয়া, লাল কাপড়ে সবুজ টিয়া আঁকা আসনটিতে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের চারিদিক দেখল পাপবুদ্ধি। কী সুন্দর সাজানো! জানলাতে ছবি আঁকা কাপড় ঝুলছে। কোনোটায় আসমানি রঙের আকাশ, কোনোটায় সবুজ ঘাস। দেওয়ালে মাটির প্রজাপতি লাগানো, ছোট থেকে বড়, পরপর, একটু কোণাচে করে উঠে গেছে। ঘরের চালের মাঝখানে পিদিম রাখার জন্য মাটির খোপকাটা শিকল ঝুলছে। ঘরের কোণে জলচৌকীর ওপর মাটির থালায় কত রকম ফুল। নীল সাদা অপরাজিতা, ঝুমকো জবা, বেল। পাশেই একটা ধূপদানী। সেখানে ধূপের ছাইটুকু পড়ে। এখনও যেন সেখান থেকে একটু সুগন্ধ ভেসে আসছে।

ধর্মবুদ্ধি ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলতে শুরু করল সে, “দেখো ধর্মবুদ্ধি, তোমার ঘরসংসার দেখে বুঝতেই পারছি, দিন চলে যাওয়ার মতো অর্থ তোমার ভালোই আছে। কিন্তু নিজের উন্নতির কথা তো ভাববে? এখানে, এই গাঁয়ে বসে থেকে কি খুব এগুতে পারবে? তার চেয়ে চল না, বছরখানেক বিদেশে ঘুরে আসি দুজনে। বলে, বিদেশের মাটিতে সোনা ছড়িয়ে আছে। আর শুধু অর্থ উপার্জন তো নয়, দেশবিদেশ ঘুরলে কত রকম অভিজ্ঞতা হয়, কত কী নতুন জানা যায়! ছেলেমেয়ে নাতিপুতিদের বলার জন্য কত গল্প জমবে তোমার ভাঁড়ারে। চল না আমার সঙ্গে, বছর খানেকের জন্য ঘুরে আসি। একা যাওয়ার থেকে দোকা তো ভালো বেশি। কী বলো!”
বন্ধুর কথা খুব মন দিয়ে শুনছিল ধর্মবুদ্ধি। কথা শেষ হতে ঘাড় নাড়ল সে, “ঠিকই বলেছ বন্ধু। ওই বছরে দুবার শাড়ি নিয়ে নগরে যাওয়া ছাড়া বেরোনোই হয়ে ওঠে না!
এর পরে এসব তো আরো কঠিন হয়ে উঠবে! বরং এই বেলা ঘুরে আসা যাক। সাতটি দিন দাও ভাই। সব গুছিয়ে নিই। মায়ের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তাঁতঘর যাতে চলতে থাকে, সে সব বন্দোবস্ত করতে হবে তো। তারপর।”

“বেশ”। উৎসাহে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল পাপবুদ্ধি। “তাহলে ওই কথাই রইল। সাত দিন পরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি চলে আসব। তারপর দেখা যাক্, ভাগ্যে কি আছে!”

সাত দিনের দিন কথামতো পাপবুদ্ধি হাজির। পাপবুদ্ধির বাবা একটা ছেঁড়া গামছায় ভরে দিয়েছে চারটে গায়ে জড়ানো কাপড়, দুটো ধুতি; সে সবই ছেঁড়াফাটা। ভালো দু একটা থাকলেও বাইরে যাচ্ছে যখন, তখন পুরোনো দেওয়াই ভালো! বিদেশে গিয়ে কখন কি অবস্থা হবে, বলা তো যায় না! পথে খাবার জন্য চারটি চিঁড়েভাজা। অনেক দিন হয়ে গেছে বলে একটু কালচে আর গন্ধ, তা হোক গে! কিছু টাকাকড়ি ট্যাঁকেই গুঁজে নিয়েছে পাপবুদ্ধি। ভালো করেই জানে যদিও, ধর্মবুদ্ধি থাকলে ওইই সব খরচপাতি করবে। তবু………।

ধর্মবুদ্ধির মা তিন দিন ধরে পথের জন্য শুকনো খাবার করে একটা বড় সাজিতে গুছিয়ে রেখেছেন, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, গজা, কড়াপাকের সন্দেশ। সঙ্গে কুড়কুড়ে চিঁড়ে ভাজা, বাদাম ছোলা ভাজা। ধর্মবুদ্ধি যত বারণ করে, “ও মা, এত কিছু লাগবে না, পথে খাবার পেয়েই যাব ঠিক”, মা শোনেন না। একটা সুন্দর দেখে বড় গামছায় বেঁধেছেন পরার কাপড়চোপড়। দুটি আসন। সঙ্গে দিয়েছেন মা লক্ষ্মীর ঘট থেকে দুটি প্রসাদী কড়ি। মা যেন ওদের মঙ্গল করেন। মায়ের গোছানো দেখে মিটিমিটি হাসে ধর্মবুদ্ধি। আসলে এত দিনের জন্য ছেলে কখনো বাইরে যায় নি তো! মা পারলে বাড়িটাই গুছিয়ে ওই পুঁটুলিতে ঢুকিয়ে দেয় আর কী!!

বেরোনোর আগে মাকে পেণ্ণাম করে, জড়িয়ে ধরে আদর করে দরজার কাছে এসে ধর্মবুদ্ধি দেখল, পাপবুদ্ধি আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা পুঁটুলি। কাঁধে মস্ত বড় একটা থলি। ধর্মবুদ্ধির জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকাতেই এক গাল হেসে বলল, “আরে, টাকা ভরে আনতে হবে না?”

তো দুজনে যাত্রা শুরু করল। সারা দিন পথ চলে। সূর্য অস্ত গেলে সামনে কোনো গ্রাম পেলে সেখানে কোনো বাড়িতে আশ্রয় নেয়। অথবা কোনো মুদীর আপণে। বাড়িতে আশ্রয় পেলে নিজেদের কিছু আর বার করতে হয় না। কখনো কখনো ওরা কোনো বড় গাছের তলাতেও আশ্রয় নেয়। ডালপালা জড় করে তাতে একটু চাল ফুটিয়ে নেয়। আগুনে দুটো বেগুন ফেলে দেয়। ধর্মবুদ্ধির মা সঙ্গে ঘি দিয়ে দিয়েছেন, নিজের হাতে করে, তাই দিয়ে গরম গরম বেগুনপোড়া ভাত। পথে কোনো হাট পড়লেই কোনো না কোনো তরকারি কিনে নেয় দুজনে। আর অল্প খানিক চাল ডাল। তেল নুন লঙ্কা। আর কিছু তো লাগে না। ভোর হলে চারিদিক দেখতে দেখতে আবার হাঁটা।

এইভাবে যেতে যেতে একদিন এক বনের মধ্যে ঢুকেছে দুজনে। খানিক যেতেই একটা ক্ষীণ কাতরানির আওয়াজ ওদের কানে এল। ধর্মবুদ্ধি পা বাড়াতেই পাপবুদ্ধি ওর কাপড় টেনে ধরল, “কোথায় যাচ্ছ, ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার বাপু! আমরা এগোই চল।” পাপবুদ্ধির বারণে কান না দিয়ে ধর্মবুদ্ধি এগিয়ে গিয়ে দেখল একটা গাছের তলায় একজন প্রৌঢ় শুয়ে। দেখে মনে হচ্ছে মুমূর্ষু। ওদের দেখে একটু মাথা তোলার চেষ্টা করেই আবার কাত হয়ে পড়ে গেলেন। ধর্মবুদ্ধি এক দৌড়ে গিয়ে তাঁর মাথাটা কোলের ওপর নিল। তার ইশারায় পাপবুদ্ধি ওদের সঞ্চয় থেকে একটু জল এগিয়ে দিল। ধর্মবুদ্ধি সেই জল একটু একটু করে প্রৌঢ়ের মুখে ঢেলে দিল। অনেকক্ষণ নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকার পর তিনি খুব ধীরে ধীরে মৃদু স্বরে বললেন, “আমি আর বেশিক্ষণ নেই। আপনারা আমার সৎকার কাজটি করে যাবেন। এখানে ফেলে যাবেন না। এই আমার শেষ অনুরোধ! আর…..আর….আমার ওই পুঁটুলিতে যা কিছু আছে….আপনাদের …….” বলতে না বলতে পাপবুদ্ধি গিয়ে সেই পোঁটলাটি নিয়ে এল। ধর্মবুদ্ধি বলল, “আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমরা আছি। কিছু হবে না আপনার”। প্রৌঢ়ের মুখে একটু হাসির রেখা ফুটল। তারপর তিনি চোখ বন্ধ করলেন। আর আস্তে আস্তে তাঁর নিঃশ্বাস যেন ফুরিয়ে গেল। পাপবুদ্ধি এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তৎক্ষণাৎ পুঁটুলিটা খুলে ফেলেই তার চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে গেল। অবাক হয়ে গেল ধর্মবুদ্ধিও। প্রৌঢ়ের পোষাক আশাক দেখে কল্পনা করা যায় নি যে তিনি ওই ময়লা কাপড়ের পুঁটুলিতে এতগুলি সোনার মোহর নিয়ে ঘুরছিলেন।

পাপবুদ্ধি একগাল হেসে বলে উঠল, “দেখেছ তো, বিদেশে বেরোলে বনেজঙ্গলেও পয়সা পাওয়া যায়! এখন চল। এগোই।”
ধর্মবুদ্ধি কোনো কথা না বলে, দূরে নদী দেখা যাচ্ছিল, প্রৌঢ়ের দেহটি কোলে নিয়ে সেই দিকে গেল। পাপবুদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলল, “যত পারো ডাল কুড়িয়ে চিতা প্রস্তুত করো। ওঁকে কথা দিয়েছি। সেই কাজটি না করে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়”। পাপবুদ্ধি বেজার মুখে ধর্মবুদ্ধির পেছন পেছন গেল। আবার যখন ওরা সামনের দিকে এগোল, চিতার আগুনে সেই প্রৌঢ়ের দেহটি তখন অসীমে মিলিয়ে গেছে।

দুজনে চলেছে। পাপবুদ্ধির মনে বেশ স্ফূর্তি। একেবারে বিনা আয়াসে এতগুলো সোনার মোহর! ভাগ্য তাদের ভালোই বলতে হবে। চলতে চলতে পথে হঠাৎই এক ভবঘুরের সঙ্গে দেখা। মুখে না কামানো দাড়ি গোঁফের বোঝা। গা থেকে দুর্গন্ধ আসছে। পাপবুদ্ধি তাড়াতাড়ি নাকে হাতচাপা দিয়ে বলল, “সরে যাও সামনে থেকে, উজবুক কোথাকার”! ভবঘুরেটি পাপবুদ্ধির ধমকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ধর্মবুদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলল, “মহাশয়, আমি দীর্ঘদিন হিমালয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। বহু দিন হল ভাত খাই না। আমাকে একটু ভাত খেতে দেবেন?”
“যা যাঃ! শখ দেখো না! গায়ের গন্ধে কাছে আসা যায় না, ওঁকে পাশে বসিয়ে পঞ্চব্যান্নন খাওয়াতে হবে!!”
“অমন করে বলতে নেই পাপবুদ্ধি। অসহায় বেচারা একটু ভাত খেতে চাইছে, তাতে আপত্তি করছ কেন! বসুন মহোদয়। আমরা এখুনি রান্না বসাচ্ছি।” এই বলে ধর্মবুদ্ধি আগুন জ্বেলে চালেডালে খিচুড়ি বসিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সেই ভবঘুরে পাপবুদ্ধি ধর্মবুদ্ধির পাশে বসে পেট ভরে তৃপ্তি করে সপাসপ খিচুড়ি খাচ্ছে। খেয়েদেয়ে হাত ধুয়ে ভবঘুরে তার পোঁটলা খুলে একটা মোটাসোটা মোড়কে জড়ানো কি একটা ধর্মবুদ্ধির হাতে দিয়ে তাকে নমস্কার করে দ্রুত সামনের দিকে পা বাড়াল। পাপবুদ্ধি তক্ষুণি হাত বাড়িয়ে সেই মোড়কটা নিয়ে খুলতে গিয়ে দেখে মোড়কের একটার পর একটা পরত। শেষ পরতটি খুলেই কতগুলো লোময়ালা গোল গোল শুকনো টুকরো বেরোলো আর চারিদিক গন্ধে আমোদিত হয়ে গেল। পাপবুদ্ধি চমকে বলল, “কি এ”? ধর্মবুদ্ধি বলল, “এ অমূল্য ধন! কোনো সুগন্ধি বানায় এমন লোক লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে এ কিনে নেবে। এ কস্তুরী। পুরুষ হরিণের পেটে তৈরি হয় সুগন্ধী গ্রন্থি। মিলন ঋতুতে পুরুষ হরিণের সেই কস্তুরী গ্রন্থি থেকে সুগন্ধ বের হয়, যা মেয়ে হরিণকে আকর্ষণ করে ৷ মিলন ঋতুর শেষে হরিণের দেহ থেকে গ্রন্থিটি খসে পরে যায় ৷ সেটা সংগ্রহ করে রোদ শুকিয়ে কস্তুরী তৈরি করা হয়। এই ভবঘুরে হিমালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে থেকেছে বলল না? নিশ্চয়ই সেই সময়েরই সংগ্রহ!”

পাপবুদ্ধি চুপচাপ সেই কস্তুরীর টুকরোগুলো আগের মতো করে সযত্নে জড়িয়ে তার থলিতে ফেলে দিল। ওই তীব্র গন্ধে দুজনের ততক্ষণে মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। ওই খানেই শুয়ে পড়ল দুজনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে অচেতনে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল একেবারে ভোরের বেলায়। পাখিদের কলরবে।

এইবার ওদের পথে পড়ল বেশ একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ধর্মবুদ্ধির কানে এল খুব চেনা আওয়াজ। তাঁত চালানোর আওয়াজ। সেই শব্দ শুনেই পাপবুদ্ধির হাত ধরে সেই দিকে পা চালালো সে। খানিক যেতেই দেখল বেশ চকমিলোন ঝকঝকে একটি দুইতলা বাড়ি। সেই বাড়ির একতলায় বিরাট ঘরে অন্তত দশটা তাঁতে খটাখট শব্দে শাড়ি বোনা হচ্ছে। ঘরের এক কোণে একটি বৃদ্ধ মানুষ মাথায় হাত দিয়ে বসে। ওদের পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে অতিথ্ দেখে তাড়াতাড়ি এসে সামনে দাঁড়ালেন। “আসুন আসুন, অহো ভাগ্য আমার। ওরে! কে আছিস পা ধোওয়ার জল নিয়ে আয়। আর ভেতর বাড়িতে খপর দে। বল্। দুজন ভিনদেশি অতিথ্ এয়েছেন। এখানেই যা হোক দুটি মুখে দেবেন। শিগগিরই যা।”

পা টা ধুয়ে দুজনকে আদর করে কাছে বসিয়ে তাদের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। ধর্মবুদ্ধি সব বলে তাঁকে বলল, “আচ্ছা, আমরা এলাম যখন, আপনাকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিল! আমাকে একটু বলবেন? কী বিষয়? অবশ্য যদি কোনো গূঢ় কথা না হয়!”
“না। তেমন কোনো গূঢ় কথা নয়।অবশ্য আমার বস্ত্র ব্যবসার ক্ষেত্রে একটু গোপনীয়। তবে আপনাদের বলতে আর কিসের বাধা! আসলে পরের বছরে আমাদের জমিদারের মেয়ের বিয়ে। জমিদার মহাশয় আমাকেই ভরসা করে মেয়ের জন্য একশটি শাড়ি বানানোর বরাত দিয়েছেন। কিন্তু বলেছেন প্রতিটি শাড়ির নকশা আলাদা হতে হবে! আমি তিরিশটা শাড়ি তৈরি করেছি। কিন্তু আর ভেবে পাচ্ছি না! যেমন তেমন নকশা হলেও তো চলবে না! এদিকে আমার মাথায় আর নকশা আসছে না। কি করব, তাই ভাবছি!”

ধর্মবুদ্ধি একবার পাপবুদ্ধির দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, “আমি নিজে বস্ত্র বুনি। আর ভালোবাসি নতুন নতুন ছবি আঁকতে, শাড়ির জন্য। আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”
ধর্মবুদ্ধির কথা শুনে আপ্লুত হয়ে সেই বৃদ্ধ তাঁতী একবারে জড়িয়ে ধরলেন তাকে, “আপনি ঈশ্বর প্রেরিত! এখুনি চলুন, আমার নকশা আপনাকে দেখাই। সেই বুঝে বাকি কাজ। এই কদিন দয়া করে আপনারা এই অধমের কাছেই থেকে দুটো খুদকুঁড়ো গ্রহণ করবেন।”

পুরো দুটি পক্ষ লাগল ধর্মবুদ্ধির বাকি নকশা তৈরি করতে। বৃদ্ধ তাঁতী তো আনন্দে আত্মহারা। ফেরার পথে ধর্মবুদ্ধির হাতে তুলে দিলেন মস্ত টাকার তোড়া। সঙ্গে তাঁর নিজের হাতে বোনা দুর্লভ দশখানি মসলিনের শাড়ি।

এই ভাবে কিছুদিনের মধ্যেই ধর্মবুদ্ধির বিবেচনা উদ্যম আর প্রত্যুতপন্নমিতার জন্য পাপবুদ্ধির ঝোলা ভরে উঠল টাকায়। ইতিমধ্যে কেটেও গেছে অনেকগুলো দিন। ধর্মবুদ্ধি বলল, “বন্ধু, চলো। তোমার থলিও ভরে উঠেছে। অনেক অভিজ্ঞতাও ভাঁড়ারে জমেছে। এবার ফিরি। তুমি বাবাকে, আমি মাকে ছেড়ে এসেছি। এবার একটু মন কেমনও করছে। আর যা উপার্জন করেছি, যথেষ্ট।”
পাপবুদ্ধিও সায় দিল এ’কথায়। আর দুজনে এবার নিজেদের গাঁয়ের পথ ধরল।
গাঁয়ের সীমানা যখন কাছাকাছি, আর কিছুটা পথ মাত্র বাকি, তখন পাপবুদ্ধি বলল, “দেখো ভাই ধর্মবুদ্ধি, এই এত টাকা নিয়ে ঘরে না যাওয়াই ভালো। উল্টো পাল্টা কারণে দুমদাম করে খরচ হয়ে যাবে। বরং এখানেই একটা বিশেষ জায়গা দেখে পুঁতে রাখি। যার যখন প্রয়োজন হবে, অপরজনকে সঙ্গে এনে তুলে নেবে। কি বলো তুমি?”
“বেশ। বুদ্ধি খারাপ দাও নি। তাই করি। চলো, ওই বট গাছটির তলায় পুঁতি।”
গাছের তলায় বেশ অনেকটা গর্ত খুঁড়ে সেই মোহর টাকা সমস্ত পুঁতে রাখা হল। নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করে যে যার বাড়ি ফিরে গেল।

মাস ছয়েক কেটে গেছে। ধর্মবুদ্ধি ভাবল ওই টাকাটা তুলে নিজের অংশটা নিয়ে একটা বড় ঘর তুলে ওর তাঁতঘরটি বড় করবে। ইতিমধ্যে ওর নকশা করা শাড়ি বেশ সুনাম করেছে। ভালোই বরাত আসছে। একটা দুটো তাঁতে আর চলছে না। কথামতো পাপবুদ্ধির কাছে গিয়ে ধর্মবুদ্ধি বলল, “ভাই, বড্ড টাকার দরকার হয়ে পড়েছে। চলো, টাকার থলিটা তুলব। আমার ভাগটুকু আমি নিয়ে নেব।”

দুজনে শাবল হাতে চলল সেই গাছতলায়। গর্ত খুঁড়ে দুজনে দেখে গর্ত খালি!! পাপবুদ্ধি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। “ছি ছি ছি ধর্মবুদ্ধি ভাই!! তোমার টাকার দরকার বলে তুমি এইভাবে টাকা তুলে নেবে!! আবার কায়দা করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছ? শেষকালে তুমি চোর বেরোলে? হায় হায়!”

ধর্মবুদ্ধি স্থির চোখে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর কঠিন গলায় বলল, “পাপবুদ্ধি, তুমিও জানো, আমিও জানি, এই টাকা সরিয়েছে কে! ভালো চাও তো টাকা ফেরত দাও।”
পাপবুদ্ধি হাঁউমাউ করে উঠল–“ধর্মবুদ্ধি, আমি চললাম বিচার সভায়। তবেই তুমি জব্দ হবে”। এই বলে সে হনহন করে হাঁটা লাগাল। থামল গিয়ে একেবারে বিচারালয়ে, বিচারকের সামনে গিয়ে। পেছন পেছন ধর্মবুদ্ধিও। যে বিচারটি চলছিল, সেটি শেষ হতে না হতে পাপবুদ্ধি চিৎকার করে উঠল, “ধর্মাবতার, এই ভালোমানুষের মত দেখতে মানুষটি চোর। আমাদের দুজনের উপার্জিত সমস্ত টাকা এ লুকিয়ে সরিয়ে নিয়েছে। আপনি বিচার করুন। এই অধমকে তার অংশ দিতে হুকুম করুন দয়া করে।”
বিচারক বললেন, “কি ব্যাপার! আমি তো আদ্যোপান্ত কিছুই বুঝলাম না। আমাকে পরিষ্কার করে সবটা বলুন। তার আগে নিজে শান্ত হন।”

পাপবুদ্ধির সমস্ত কথা শোনার পর ধর্মবুদ্ধির দিকে তাকিয়ে বিচারক বললেন, “আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন।” ধর্মবুদ্ধি শান্ত স্বরে বললেন, “হে ধর্মাবতার, এই জঘন্য কাজ করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। এই কাজ, এই নিচু ভাবনা এই লোকটিরই। নিজেই টাকা সরিয়ে এখন আমার ওপর দোষ দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে।”

পাপবুদ্ধির দিকে তাকিয়ে বিচারক বললেন, “মহাশয়, আপনার কাছে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ কিছু আছে? বিনা প্রমাণে আমি কাউকে অভিযুক্ত করতে পারি না।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পাপবুদ্ধি বলল, “আমার মতো দরিদ্র অসহায় মানুষের হয়ে কে আর সাক্ষ্য দেবে বলুন, একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া? যদি সত্যি বলে কিছু থাকে, তবে আমি বলছি বৃক্ষদেবতা আমার হয়ে সাক্ষ্য দেবেন।”
পাপবুদ্ধির কথা শেষ হওয়া মাত্র বিচারালয়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেল– বলে কি লোকটা? অ্যাঁ? পাগলটাগল হয়ে গেল নাকি টাকার শোকে? গাছদেবতা সাড়া দেবেন? এসব তো গল্প কথায় শোনা যায়!

বিচারক বললেন, “মহাশয়, যা বলছেন, ভেবে বলছেন তো? আমরা সকলে উপস্থিত থাকব সেখানে। আর যদি আপনার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে চুরির সঙ্গে বিচারালয়ে মিথ্যা বলার জন্যেও কঠোর শাস্তি আপনার প্রাপ্য হবে!”
পাপবুদ্ধি মাথা উঁচু করে বলল, “আমার নিজের সততার ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আপনারা সকলে কাল সূর্য্যোদয়ের পরে আমাদের গ্রামের বাইরে উত্তর দিকে যে বিশাল বট গাছটি আছে, সেখানে উপস্থিত হবেন। আর ধর্মবুদ্ধি, আশা করি তুমিও আসবে। ভয়ে পেয়ে পালাবে না।”

বাড়ি ফিরে পাপবুদ্ধি বাবাকে নিয়ে শেখাতে বসল।
“বাবা, তুমি সাহায্য না করলে আমার টাকা মান সব যাবে। কারাগারে কাটবে বাকি জীবনটা। তুমি একটু সঙ্গ দিলেই কেল্লা ফতে! সব টাকাটাই আমার আর ওই ব্যাটা ধর্মবুদ্ধির সব বারফাট্টাই শেষ!!!”

“কিন্তু কি করতে হবে আমাকে? আমার কথা কেই বা বিশ্বাস করবে!!!

“করবে বাবা। কারণ তুমি তো তুমি থাকবে না। তুমি বৃক্ষ দেবতা হয়ে যাবে। ধর্মবুদ্ধি যখন বট গাছটি বেছেছিল, তখনই আমি ওখানে একটি কোটর দেখেছিলাম। তখনই আমার মাথায় টাকা লোপাট করার আর তা ধর্মবুদ্ধির ঘাড়ে চাপানোর মতলবটা এসেছিল। তোমাকে আমি আজ মাঝরাতেই ওই কোটরে লুকিয়ে রেখে আসব। তুমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তরে বলবে, টাকা ধর্মবুদ্ধি নিয়েছে! আর কী চাই!”

সূর্যোদয়ের খানিক আগেই বিচারালয়ের উপস্থিত লোকজন ভিড় জমাল ওই বটগাছ তলায়। এলো গাঁয়ের লোকও। বিচারপতিও এলেন। আর ধর্মবুদ্ধি এলো মায়ের সঙ্গে। সবাই অপেক্ষা করছিল পাপবুদ্ধির জন্য।

পাপবুদ্ধি এসে ওই বটগাছটিকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। তিনবার প্রদক্ষিণ শেষে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে প্রণাম করল। তারপরে উচ্চৈস্বরে জিজ্ঞাসা করল, “হে বৃক্ষ দেবতা, আপনি আমার এক ও একমাত্র ভরসা। আপনি বলুন, আপনার আশ্রয়ে রেখে যাওয়া টাকা পয়সা কে নিয়েছে? কে মিথ্যা বলছে?”

কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর সেই গাছের ভেতর থেকে আওয়াজ এল, “ধর্মবুদ্ধি চোর। টাকা ওই নিয়েছে”।

সমস্ত ভিড়টা থেকে একটা সমবেত বিস্ময় ধ্বনি শোনা গেল। এও কী সম্ভব!!!! গাছের ভেতর থেকে দেবতার কন্ঠ! এই ধর্মবুদ্ধিকে দেখে তো সত্যি বোঝা যায় না যে ভেতরে ভেতরে ও এমন!

কিন্তু এইবার কি করবে ও? এত বড় একটা সাক্ষ্যের পরে ওর আর কি বা বলার থাকতে পারে!!! সবার দৃষ্টি গেল ধর্মবুদ্ধির দিকে। আরে, এইবার কি এই লোকটি উন্মাদ হয়ে গেল! লজ্জায় ভয়ে??? কি করতে চায় লোকটা??
বৃক্ষ দেবতার গলা শোনামাত্র ধর্মবুদ্ধি মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিচু হয়ে ডালপালা কুড়োতে আরম্ভ করেছিল। চারপাশের কারুর কথায় কান না দিয়ে ও সেই সব কুড়োনো ডাল বট গাছটির চারিদিকে রেখে চকমকি পাথর দিয়ে আগুন ধরিয়ে সরে এল।

কেউ খেয়াল করল না পাপবুদ্ধির বিবর্ণ মুখ! বরং সবার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে সেই কোটর থেকে বেরিয়ে এল একটি ঝলসানো বৃদ্ধ। পাপবুদ্ধির দিকে আঙুল তুলে সে বলল, “ওই…..ও….সব ওর কাজ…আমাকেও…..”এই ক’টি কথা কোনোক্রমে বলে বৃদ্ধ লুটিয়ে পড়ল।

ধর্মবুদ্ধি মায়ের হাত ধরে এগিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে। ততক্ষণে ঝলমল করে সূর্য উঠে পড়েছে পূব আকাশে। অন্ধকার কেটে আলোয় আলো হয়ে গেছে চার দিক।

(বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্র থেকে নেওয়া )

 

 

 

One thought on “উৎসব সংখ্যা শিশুতোষ গল্প: ধর্মবুদ্ধি ও পাপবুদ্ধির গল্প

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত