| 24 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা শিশু: মন্দেরা প্রলোভিত হয় মহতেরা সহ্য করে

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
মূল গল্প – লেভ তলস্তয়
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক লেভ তলস্তয়(১৮২৮-১৯১০)। তিনি বড়দের জন্যে ভারিক্কী সব বই লিখতে লিখতে শিশু ও কিশোরদের  জন্যেও কিছু অমর সাহিত্য রচনা করেছেন। কিশোর সাহিত্যের ভান্ডার থেকে নেওয়া এই গল্পটির রচনাকাল ১৮৮৫।

অনুবাদ – চন্দ্রাণী বসু


অনেক অনেকদিন আগে এক খামারবাড়িতে একজন সৎ ও দয়ালু মানুষ বাস করতেন। তিনি সকলের জন্য নানা ধরণের ভালো কাজ করতেন এবং তাঁর চাকর-বাকরেরা তাঁকে এই কাজে সবসময় সাহায্য করত। এই চাকরেরা তাঁদের মালিকের মতো একজন ভালো প্রভু পেয়ে খুব গর্বিত হয়ে সবসময় বলত – “সূর্যালোক যতটা জায়গা জুড়ে পড়ে ততটা জায়গা খুঁজলেও আমাদের মালিকের মত একজনও ভালো মানুষ আর পাওয়া যাবে না। তিনি আমাদের যত্ন করে খেতে ও পরতে দেন, আমাদের যার যার শক্তি অনুসারে তিনি কাজের ভার দেন, তিনি কখনও কুৎসা করেন না, কাউকে কোনও কু-কথা বলেন না। 
যারা তাদের চাকরদের গরু-ভেড়ার পালের থেকেও খারাপ ভাবে রাখে, সবসময় চাকরদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, কারণে অকারণে শাস্তি দেয়, তিনি সেই অন্য মালিকদের মত একেবারেই নয়। বরং তিনি সবসময় আমাদের সঙ্গে সুব্যবহার করেন, সর্বদা আমাদের মঙ্গলের চিন্তা করেন। ওঁর চেয়ে ভালো প্রভু আমরা কখনওই পেতাম না, এর চেয়ে ভালোভাবে থাকতেও পারতাম না।”
চাকরদের প্রভুর প্রতি এত ভালোবাসা দেখে এক “শয়তানের” খুব রাগ হল। সে অ্যালেব নামে এক চাকরকে ভয় দেখিয়ে আদেশ দিল যে ওঁর  চাকরদের ওই মহৎ মালিকের বিরুদ্ধে প্রলোভিত করতে হবে। 
একদিন যখন সব চাকরেরা মিলে বিশ্রাম নিচ্ছিল এবং তাদের মালিকের গুণ গাইছিল, তখন অ্যালেব জোরে জোরে সেখানে গিয়ে বলতে লাগল, – ” প্রভু তার ভালোমানুষী দেখিয়ে আমাদের বোকা বানাচ্ছে। “শয়তান”ও তোমাদের প্রতি দয়ালু হবে যদি তার কথা তোমরা মান্য কর। আমরা আমাদের প্রভুর যথাযথ সেবা করি। তাঁর সমস্ত প্রয়োজন মেটাই।তিনি যখন যা ইচ্ছে করেন, তৎক্ষণাৎ আমরা তার ইচ্ছে আমরা পূর্ণ করি। তাহলে তিনি কেন আমাদের প্রতি সদয় হবেন না ? একবার পরীক্ষা করে দেখো যদি আমরা তার সেবা করার বদলে কোনও ক্ষতি করি,  তিনি অন্য সবার মতোই মন্দ আচরণ করবেন।  তিনিও সকলের মতই খারাপ প্রভুই হয়ে উঠবেন। ” 
কিন্তু অ্যালেবের এই কথা যখন কেউই মানতে রাজি হল না, তখন শেষ পর্যন্ত অ্যালেব তাদের সঙ্গে বাজি ধরল। অ্যালেব তাদের প্রভুকে রাগিয়ে দেবেই।  এবং তার খারাপ আচরণ সকলের সামনে প্রকাশ করাবে। যদি সে হেরে যায় তাহলে সে আর উৎসবের পোষাক নেবে না। আর যদি সে জিতে যায় তার কথা সবাইকে মেনে নিতে হবে। তবে বাকিরা তাকে কথা দিল – এই কাজের জন্য যদি তাকে কারাগারে যেতে হয় তবে তারা প্রভুর বিরুদ্ধে গিয়েও শাস্তি বা কারাগার থেকে তাকে মুক্ত করবে। অ্যালেব জানাল পরদিন সকালে সে মালিককে ক্রোধান্বিত করে তুলবেই।
অ্যালেব ছিল একজন মেষপালক। এবং সে মালিকের প্রিয় মেষদের দেখাশোনার দায়িত্বের কাজে নিযুক্ত হয়েছিল। 
পরদিন সকালবেলা তার প্রভু যখন কিছু অতিথিকে নিয়ে তার প্রিয় মেষদের সাথে সাক্ষাৎ করাতে নিয়ে এল তখনই অ্যালেব তার সঙ্গীদের বলল,- “দেখো এবার কী করে আমি প্রভুকে রাগিয়ে দিই ! “
বাকি চাকরেরা বেড়ার একপাশে জড়ো হয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে  কান্ড দেখতে লাগল আর সেই “শয়তান” কাছেই একটা গাছের উপর উঠে দেখতে লাগল অ্যালেব তার কথা মতোই কাজ করে কি না।
তাদের প্রভু অতিথিদের ছোট বড় নানান প্রিয় মেষদের দেখাতে দেখাতে এগোতে থাকল এবং শেষে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মেষের দর্শন করাবার জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠল। সে বলল, -” সব মেষই আমার প্রিয় তবে সবচেয়ে প্রিয় বাঁকানো শিংওলা মেষ, যা আমার কাছে অমূল্য, আমার চোখের মণিও বলতে পারো।”
অচেনা লোকজন দেখে মেষরা ভয় পেয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল, ফলে অতিথিরা ঠিকভাবে সেই মেষকে দেখতে পারছিল না। যদিও বা তারা একটু স্থির হচ্ছিল, কিন্তু অ্যালেব সঙ্গে সঙ্গে তাদের তাড়া দিয়ে আবার ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। যাতে এমন মনে হয় যে তারা নিজেরাই বিপদে পড়ে এমন ছুটোছুটি করছে, এবং তারা যেন আবার সবাই একসঙ্গে মিশে যায়। ফলস্বরূপ অতিথিরা কিছুতেই প্রভুর সেই বিশেষ মেষটিকে দেখতে পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত প্রভুই চেষ্টা করল এবং অ্যালেবকে ডেকে বলল, ” প্রিয় অ্যালেব, যে মেষটি আমার ভীষণ প্রিয়, যার শিংগুলো সম্পূর্ণ বাঁকানো সেই মেষটিকে খুব সাবধানে কিছু মুহূর্তের জন্য ধরে নিয়ে আসতে পারবে ? “
যেইমাত্র তার প্রভু বলল, সেই মুহূর্তে অ্যালেব মেষ পালের মধ্যে সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং প্রিয় মেষকে জাপটে  ধরল। তার গায়ের পশমগুলোকে প্রথমে সে খামচে ধরল এবং প্রভুর চোখের সামনেই মেষটির পিছনের বাঁদিকের পা ধরে হ্যাঁচড়াতে শুরু করল। সে মেষটির পা ভেঙে দিল এবং হাঁটু থেকে রক্তপাত শুরু হল। যখন বাঁদিকের পা ঝুলে পড়ল, তখন সে ডানদিকের পিছনের পা ধরে টানতে শুরু করল। 
অতিথি ও বাকি চাকরেরা যখন এই ঘটনা দেখে শিউড়ে উঠছে তখন গাছের উপরে বসে সেই “শয়তান” ভীষণ মজা পাচ্ছিল। 
প্রভুর মুখ বজ্রগর্ভ মেঘের মতো কালো হয়ে গেল এবং সকলের সামনে মাথা নীচু  হয়ে গেল। সে একটা কথাও বলতে পারছিল না।
অতিথি এবং বাকি চাকরেরা নীরব দর্শক তখন। কী ঘটতে চলেছে তার অপেক্ষায়।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর প্রভু তার মনের ভার মুক্ত করে ফেললেন। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
তারপর অ্যালেবের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন,-” তোমার প্রভু আমাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য তোমায় পাঠিয়েছিল। কিন্তু আমার প্রভু তোমার প্রভুর চেয়ে অনেক শক্তিশালী। আমি তোমার উপর রাগ করিনি, কিন্তু তোমার প্রভু এবার আমার উপর আরও রেগে যাবেন। তুমি ভয় পেয়েছিলে আমি যদি তোমায় কোনও শাস্তি দিই ! এবং তুমি মুক্তি চেয়েছিলে। আমি তোমায় কোনও শাস্তিই দেব না, আমি আমার অতিথিদের সামনেই তোমায় মুক্তিই দিলাম। যাওয়ার আগে তোমার উৎসবের পোষাক নিয়ে যেতে ভুলো না “
এরপর মহৎ প্রভু তার অতিথিদের নিয়ে ঘরের দিকে রওনা হলেন।
আর ওই “শয়তান” দাঁত কিড়মিড় করতে করতে গাছ থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে মাটির উপর জোর আছাড় খেয়ে পড়ল। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত