| 28 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা সঙ্গীত: গঞ্জহাটের কোরাস । সুবীর সরকার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
আমার একটা গঞ্জহাটের পৃথিবী আছে।আমার পৃথিবী জুড়ে অগণন সুপুরিগাছের সারি।আমার পৃথিবীতে ভরা নদীর ওপর ঝুঁকে পড়া মাযাবৃক্ষ।ভুমিলগ্ন আবহমানের সব চিরায়ত সোনার বরণ মানুষজন।আমার একটা নাচঘেরা বাজনাঘেরা অপরূপ লোকপুরাণের দেশ রয়েছে।সেখানে ‘ভইসা গাড়ির’ নীচে কালিমাখা লণ্ঠন দোলে।আর ধু ধু পাথারবাড়ির দিকে গান ছড়িয়ে পড়ে-
‘ও হো রে,কুচবিহারত হামার বাড়ি
ঘাটাত দেখঙ ওরে ভইসা গাড়ি’
কিংবা-
‘ও কি হায়রে হায়
আজি মনটায় মোর
পিঠা খাবার চায়’
মানুষ যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়,জীবন যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়,আমিও সেভাবে এই লোকমানুষের দিনদুনিয়ায় ডুবে গেছি।উত্তরের এই লোকজীবনের মায়া ও জাদু আমার চরম প্রাপ্তি।চরমতম শক্তি।
২.
আমি যখনই অস্থির হয়ে পড়ি,আমি যখনই একা হয়ে যাই তখন এই লোকায়ত ভুবন,উত্তরের লোকগান আমাকে ফিরিয়ে আনে জীবনে।ফিরিয়ে আনে লড়াইয়ে।ফিরিয়ে আনে চূড়ান্ত স্বপ্নের ভেতর।
আমি আবার নুতন হয়ে উঠতে থাকি।আর নিশিগঞ্জের  হাট থেকে প্রেমেরডাঙ্গার গঞ্জ থেকে ঝাঁকুয়ার টারি থেকে দেখি ভেসে আসে হাতিমাহুতের অন্তহীন যত গান-
‘ও মোর গণেশ হাতির মাহুত রে
ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে
মোক ছাড়িযা কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তীর শিকারে’…
জীবন দুলে ওঠে।জীবন উৎসবে পরিণত হয়।
আর আমি প্রনাম করি আমার উত্তরের মাটিকে।
উত্তরের মানুষকে।
৩.
তখন মধ্য নদীর চর থেকে,নদী তোর্সার চর থেকে ইসমাইল শেখের জোড়া মহিষের চকিত ডাক উঠে আসে।নদীর জলে গা ডোবানো সেই জোড়া মহিষের ডাক কিভাবে মিশে যেতে যেতে একসময় গাছপালা, ঝাড়ঝোপেই ডুবে যায়।তখন ইসমাইল শেখের চোখে কি এক দূরাগত স্মৃতিহীনতা!এভাবেই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে মানুষকে বারবার স্মৃতিতেই ফিরে যেতে হয়।তাকে স্মৃতিময় হয়ে উঠতে হয়।প্রেক্ষিত জুড়ে নদী,জলরাশি,নদীর চর,অগুনতি হাঁস,চৈত্রের ধুলো আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই জোড়া মহিষ।ইসমাইল শেখের অন্যমনস্কতায় পুরোন এক দেশকাল প্রবেশ করতে থাকে।আর এই প্রবেশ ও প্রস্থানের মাঝখানে গানের ধুয়ো ওড়ে_
“আজি বাথানে না যান
ও মোর মৈশাল রে”
ইসমাইল হেঁটে যেতে থাকেন রসুনখেতের পাশের  আলের ওপর দিয়ে।তাকে রাস্তা চেনাতে থাকে সেই জোড়া মহিষ।মস্ত এক কালখন্ড রচিত হয় এভাবে আর দৃশ্যের পর দৃশ্যে ঘন ঘন হোচট খেতে থাকে ইসমাইল শেখের  জোড়া মহিষ।
৪.
জনমভর পালাতে হয় মানুষকে।জন্ম তো আসলে একটা ট্রমা।তাই হয়তো পালাতেই চায় মানুষ।মানুষ ঘুম থেকে,জাগরণ থেকে,সম্পর্ক থেকে,মৃত্যু থেকে,জন্ম থেকে পালাতে পালাতে একটা নো ম্যানস ল্যান্ডে এসে বারবার দাঁড়ায়!এই যে পালিয়ে যাওয়া,এই যে পলায়ন এতো আসলে এক চিরায়ত খেলা।যাপিত জীবনে মুখস্থবিদ্যার মত এই পলায়ন একধরনের ধরাছোঁয়ার খেলা।পালাতে পালাতে মানুষ কি দুপুর রৌদ্রে এসে দাঁড়ায়! পোষা বেড়ালের সাথে খেলা করতে করতে মানুষকে কি গ্রাস করে নিতে থাকে বিপন্নতা!কিংবা অন্যমনস্কতা!এই সব সমাধানহীন দার্শনিকতার দিকে যেতে যেতে মানুষকে তাড়া করতে থাকে ভ্রম ও বিভ্রম।আর শেষ পর্যন্ত জনমভর পালাতে পালাতে মানুষ আবার ট্রমার ভিতরে ঢুকে পড়তে থাকে।আর জেগে থাকে গান।বান বরিসা ধান সরিষার গান।লাল টিয়ার গান।হাতি মাহুতের গান।
৫.
“হলদি রে হলদি
হলদিবাড়ির হলদি”
সেই কবে মেখলিগঞ্জে তিস্তার চর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে চরবসতি থেকে এক প্রাচীন মানুষের কণ্ঠ থেকে এই গানের সুর উঠে আসছিল।আর সেই সুর
ঘুরে ঘুরে চর,বসতি আর নদী তিস্তায় বুঝি ডুবে যাচ্ছিল।এত বছর পেরিয়ে আবার সেই কালখন্ডে ফিরে যেতে চায় জীবন।
আর আমি দেখি মস্ত সেই দেওয়ানগঞ্জের হাট।ভরা হাটের উজানে একা একা হেঁটে যাচ্ছেন ফকির,মিসকিন আর গা_গঞ্জের মানুষেরা।
আমি হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর ভেতর খুঁজতে থাকি ঘোড়া জোতদার,ধনী বাড়ি আর পদুমোহন বরাইকের কাঠের খড়ম।
হেলাপাকরি থেকে ভান্ডানি যাবার রাস্তায় সেই উদাসীন জোড়া মহিষের পিঠে বাচ্চা মৈশাল আর সেই মৈশাল একা একাই গেয়ে উঠেছিল বিরহের গান।
জীবনে এভাবেই কত কত গল্প জমে ওঠে।
আমি দেখে ফেলি রাখালকাকুর মাকে,আপনমনে যিনি শোলোক বলছেন_
“শামুক খাজারে আমার বাড়ি আয়
রকম রকম শামুক দিমু
হলদি দিমু গায়”
রিয়ালিজম এভাবেই গড়িয়ে যাওয়া ব্যাটারির মতন কখন কিভাবে একটা ম্যাজিক নিয়ে আসে বুঝি আমাদের জীবনে!
৬.
আমি জনপদের পর জনপদ ঘুরে বেড়াই।আমি আখ্যান খুঁজতে যাই।গল্প কুড়োতে যাই।দেশকাল জড়ানো মানুষের জীবনযাপনের গন্ধ তীব্র আমোদিত করে আমাকে। কালপানীর ভূগোল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে আসি।তোর্সা নদীর চরে দাঁড়িয়ে দেখি উজান আকাশে কালো মেঘ জমছে।চাঁপাগুড়ির চরের উপরে “হাড়িয়া ম্যাঘের আন্ধার”।আর নদী পেরোতেই শুরু হলো কালবৈশাখী ঝড়।ইসমাইল ভাইয়ের দাওয়ায় বসে ঝড় দেখা আর শুরু হয় তোর্সা নদীর বৃত্তান্ত।সে এক দূরাগত পৃথিবীর গল্প!চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেকার ভূগোল ইতিহাস।তখন নদী ছিল প্রসস্থ আর খরস্রোতা। বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা।পালতোলা নৌকা। মাল্লাদের দাঁড় বাওয়া।নৌকা বাইচের গান।বর্ষাকালে তোর্সার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সংঘর্ষ চলতো।মুরুব্বীরা বলতেন “তোর্সা নদীত কামান”।
বড় বড় চর তোর্সা জুড়ে। এলুয়া কাশিয়া।আর ধনীদের মৈশের বাথান।মৈশের গলায় ঘান্টির শব্দের সুর।মৈশাল বন্ধুর গান।আশেপাশে কত কত ধনীর জোত।এরা ধনী,কামেস্বর ধনী, পঞ্চা ধনী,এমদাদ ধনী, আদ্য ধনী, ছেকাখাওয়া ধনী।কমেশ্বর ধনীর ঘোড়া ছিল।আদ্য ধনীর ছিল বন্দুক।সে এক বর্ণময় সময়।কমেস্বর ধনী ছিলেন কোচবিহারের মহারাজার শিকার সঙ্গী।         ছেকাখাওয়া ধনী রোদে শুকোতে দিতেন তার টাকা।
কত কত বার তোর্সা তার খাত পাল্টালো।হারিয়ে গেল বাথান।হারিয়ে গেল ধনীবাড়ি।আর দেখা যায় না “উত্তরের সাতাও”।
অনেক বছর পরে সেই সব পুরোন গল্পগুলি উঠে এলো বিনয় অধিকারী,ঘুটি বাবু,লুৎফর চাচা,আব্বাস ব্যাপারীদের কণ্ঠে।এরা সব অপরূপ কথোয়াল।আমি ফিরে আসি আর বাতাসে গান ভাসে_
“হাউসের মেলা জোড়া খেলা বড়বাড়ীর কাছারে
ও রে ধনীর বেটার নৌকা ফাইনালে”।
৭.
এত এত হাট,এত এত গঞ্জ,এত এত নদীপরিধির ভেতর মানুষের বেঁচে থাকা।বেঁচে থাকতে থাকতে আবহমান এক জীবনকে বারবার পাল্টে পাল্টে দিতে থাকা।ইয়াকুব মহিউদ্দিন লোকমান সাজু চোরা আরো কত বর্ণময় আর বিচিত্র মানুষের সমাবেশ দিয়ে সেজে ওঠে গঞ্জহাটের এক চিরকালের ভুবনজোত।
এক হাট থেকে মানুষকে চলে যেতে হয় অন্য কোন হাটে।নুতন নুতন হাটে।নয় ফরেস্ট আর কুড়ি নদীর দুনিয়ায় কত যে হাট!
ইয়াকুব একবার পানবাড়ি হাটে গিয়ে ফেরার পথে পথ ভুলে গিয়েছিল।তাকে কি তবে ভুলায় ধরেছিল!
বগরিবাড়ির যতীন ডাকাতের সাথে দেখা হবার পর পরেই ইয়াকুব যতীন কে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল চিকন চিড়ার হাটখন্ডের দিকে।সেখানে বসে দই চিড়া খেতে খেতে যতীন তার ডাকাতিয়া জীবনের রোমহর্ষক সব গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিল।
লালজি রাজার ভাই প্রণবেশ সাহেবের সামনেই তো একবার ব্রহ্মপুত্রে জেগে ওঠা নয়া চরে চরদখলের লাঠালাঠিতে কি এক ভয়ানক লড়াই!সেবার মাথা ফেটেছিল যতীনের।
যতীনের ডাকাতিতে হাতখড়ি হয়েছিল বিজনির হামিদ মিদ্দার কাছে।তিরিশ বছর ডাকাতির জীবনে একবারই যতীনকে থমকে যেতে হয়েছিল!তার চোখ কান্নায় ভিজে গিয়েছিল!এবং এই প্রথমবার পুলিশের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল সে।
সেবার ডাকাতি করতে গিয়েছিল যতীন রূপসীর নন্দ ধনীর বাড়িতে।খবর ছিল তামাক বিক্রির প্রায় তিন লক্ষ টাকা ধনীর বাড়িতেই রাখা আছে।আছে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার।ধনসম্পত্তি।
মধ্যরাতে দল নিয়ে যতীন হানা দিয়েছিল নন্দ ধনীর বাসায়।তারপর সে এক ধুন্ধুমার মারি ফেলা কান্ড!
হঠাৎ নন্দ ধনীর বছর পাঁচ বয়সী বাচ্চা ছেলে যতীনের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে এলে যতীন আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক চালিয়ে দেয়।
চোখের সামনে ছটফট করতে করতে সেই বাচ্চাটির মৃত্যু যতীনকে হতভম্ব করে দেয়।
তারপর সব ইতিহাস।জেল থেকে বেরিয়ে যতীন ডাকাতি ছেড়ে দেয়।যোগ দেয় কুষাণ গানের দলে।
দোয়ারির ভূমিকায়।মাঝে মাঝে কীর্তন করে বেড়ায়।
আর ইচ্ছে মত দোতরা কাঁধে ঘুরে বেড়ায় কোন কোন হাটে।দাতের মাজন,হজমি গুলি,কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করে আর গান করে ফাঁকে ফাঁকে।
আর দেখা হলেই চেনা বা অচেনা লোকজনকে শোনাতে থাকে ডাকাতিয়া জীবনের নানান গল্পকথা।
জীবন কি অদ্ভুত!
ঘোর লাগা দুই চোখ জাগিয়ে রেখে যতীন বিড়বিড় করে গান তোলে_
“এপার থাকি না যায় দেখা রে
নদীর ওই পারের কিনার”
৮.
ইউসুফ মোল্লার বেশ মনে পড়ে শালমারার বড় বালার চরে বড় রাজকুমারীর গান নিয়ে নাচ নিয়ে বাদ্য বাজনা নিয়ে এক শীতের রাতে জমিয়ে তোলা গানবাড়ির কথা।ইউসুফ মোল্লা তখন সদ্য যুবক।পালতোলা নৌকোর দুরন্ত মাঝি।ব্রহ্মপুত্র শাসন করে সে।পণ্য পৌঁছে দেয় বন্দরে বন্দরে।আর নেশা বলতে গানবাড়িতে ঘুরে ঘুরে গান শোনা।
তখন রাজবহাদুর প্রভাত বড়ুয়া বেঁচে।
শিকারে যান মস্ত দাঁতাল হাতি জংবাহাদুরের পিঠে চড়ে।বড় রাজকুমারী আর ছোট রাজকুমারী তখন গঞ্জ গা হাট ঘুরে ঘুরে গান,নাচ, শোলোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন।নিজেরাও নাচছেন।গাইছেন।
বালাবাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সব গান।যা চিরকালীন।যা ভরভরন্ত জীবনের কথা বলে_
“কালা বাইগণ ধওলা রে
বাইগণের গোড়ায় কাটা”
এক হাট থেকে বেরিয়ে নুতন এক হাটে প্রবেশ করতে গিয়ে এই চার কুড়ি পেরিয়ে আসা জীবনে বারবার ইউসুফ মোল্লার মনে পড়ে সেই সব সোনার বরণ পাখির মতন দিনগুলির কথা।
হায়রে,কত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে মানুষের জীবনে!জলে ভিজে ওঠে ইউসুফের চোখ। সে দেখতে পায় “টলমল টলমল কচুপাতের পানি”।
ঠিক এখানেই একটা গল্প শেষ হয়ে যায়,নুতন এক শুরুর অপেক্ষায়!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত