| 18 এপ্রিল 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

উৎসব সংখ্যা সঙ্গীত: শারদ অর্ঘ্য । সংগ্রামী লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

কাল রাতে রাঙামাসি এসেছিল। পুজোর জামা দিতে। টুটু মহা খুশি। এবছর তাহলে নটা জামা হল। পঞ্চমীষষ্ঠীসপ্তমী… আঙুলে কড় গুনতে থাকে সে। সকালে একটাবিকেলে একটা। একদিনে তাহলে দুটো নতুন জামা পরা যাবে এবার। উফকী আনন্দকিন্তু নাহিসেবে মিলছে না তোপঞ্চমী থেকে দশমী – পাঁচ দিনের জন্যে তাহলে দশটা জামা চাই। একটা কম পড়ছে যেকী হবেমুখ শুকনো করে বসে আছে। জ্যাঠামণি ফিরল অফিস থেকে। ডাকছে। সেও অপেক্ষায় থাকে। হাতমুখ ধোয়া হলেই কোলে চেপে বসবে। সারাদিন কে কে তাকে কী কী বলেছেকত অন্যায়অবিচার তার সঙ্গে ঘটছে এ সংসারেতার ফিরিস্তি শোনাবে। জ্যাঠামণি সবাইকে ডেকে ধমকে দেবে। শান্তি।

আজ জ্যাঠামণির হাতে বই। পুজোসংখ্যা তো কবেই এসে গেছে। কাগজকাকু সাইকেলে চড়ে এসে দিয়ে গেছে। এ বই পুজোসংখ্যার মত লম্বাটে নয়। বরং চওড়ায় বেশি। অনেক অনেক পরে সে জানবেকাগজের এইরকম বিন্যাসের নাম ল্যান্ডস্কেপ। পাতলা বইবেশি মোটাও নয়। সুন্দরচকচকে পাতাগুলি। মলাটে দুগ্গাঠাকুরের ছবি।



টুটু তিড়িং করে একটা লাফ মারে। কী কাণ্ডজামা গুনতে গিয়ে সে কিনা শারদ অর্ঘ্যের কথাই ভুলে বসে ছিলআজই তো ছিল মহালয়া। রাত থাকতে উঠে মুখহাত ধুয়ে রেডিওতে বাণীকুমারের অনুষ্ঠান শুনতে বসেছে বাড়ীর সবার সঙ্গে। ‘যা চণ্ডীমধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী’… ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর’… তারপর অবধারিত ঘুমিয়ে পড়েছে আবার। ঘুম ভেঙেছে ‘রূপং দেহি জয়ং দেহি’ গানে। তখন সকাল হয়ে গেছে। আজই তোআজই তো রেকর্ডের দোকানে আসে সেই বই। জ্যাঠামণি নিয়ম করে অফিস ফেরত কিনে আনে। শারদ অর্ঘ্য। পুজোর গানের বই। গানের পুজোবার্ষিকী। HMVর পুজোর রেকর্ড বেরিয়েছে। চকচকে মোটা মোটা গ্লসি পাতায় সেই সব রেকর্ডের শিল্পীদের ছবিতাঁদের সইগানের কথা। নাঃটুটুর আর কোনো দুঃখ নেই। জামা নাই বা হলকী এসে গেলতার তো শারদ অর্ঘ্য আছে। আর কিচ্ছু চাই নাকিচ্ছু না।

মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুলমধ্যবয়সিনী সোমা চশমাটা খুললেন। কাজের দিন। একের পর এক মিটিংইমেলব্যবসায়িক আদানপ্রদান। অক্টোবর মাসআর্থিক বছরের শেষ কোয়ার্টারব্যস্ততা তুঙ্গে। তার মধ্যেই ওই ছোট্ট মেয়েটা হঠাৎ হঠাৎ এসে শেকড় ধরে টান মারে। বিদেশের ব্যস্ত শহর একমুহূর্তে বদলে যায় কলকাতার কাছের এক শান্ত মফস্বলে।



বিশ্বকর্মা পুজোর পরে পরেই রেডিওতে বাজানো হত HMVর পুজোর গান। পুজোর ক’দিন তো কথাই নেই। পুজোপ্যান্ডেলে টানা কয়েকদিন ধরে বাজবে সে বছরের পুজোর গানগুলো।

আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়া পড়েছেআল দিয়ে কে গেছে কোথায় জানি না।

সবুজ ঘাসের শীষ যে কটি ঝরেছেশিস দিয়ে কোন ময়না কী গায় জানি না।

তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় শরৎরানির সাজটি সম্পূর্ণ হল।

সে গান শেষ হতে না হতেই এবার বেজে উঠেছে একই রেকর্ডের অন্য গানটি।

রাত দুটো বেজে গেললক্ষ্মীটি ঘুউউউমো…’

নাক সিঁটকায় মেয়েটা। এটা তার পছন্দের গান নয়। গানের মাঝখানে আবার সুর করে কেউ একজন বলে, ‘নানানানাআ।‘ শুনলেই হাসি পায়।

বরং তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই গানটা খুব ভালো লাগে। ‘চলো রীনাআআআআ’ – বলে ওপরের দিকে উঠে কেমন সুন্দর একটা টান দেন। কী মাদকতাশুনলেই মনে হয় বেরিয়ে পড়ি। মন ছুটে যায়। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়ে চলেন,

চলো রীনা ক্যাশুরিনার ছায়া গায়ে মেখে,

এঁকে বেঁকে লাল কাঁকরের পথ ধরে

একটু একটু করেএগিয়ে যাই 

বলোযাবে কিনা?’

ভেতরটা যেন নেচে ওঠেবলতে ইচ্ছে করে, “যাবযাব।

কী নিপুণভাবে গানে প্রকৃতির ছবি আঁকা হচ্ছে,

সোনারোদে ঝিকমিকদেখো বালু চিকচিক

ছোট্ট নদীমিষ্টি খোয়াই – পার হয়ে যাই।

চলো রীনা…’

সেও তো পুজোরই গানশারদ অর্ঘ্যের পাতায় তার সঙ্গে পরিচয়।

খুব পছন্দের আরেকজন শিল্পী নির্মলা মিশ্র। শান্তমায়া জড়ানো মুখ। তিনকোণা চশমার ফ্রেমটি কখনোই বদলায় না। আর বদলায় না সুরস্থির হয়ে থাকে অনবদ্য মিষ্টি গলায়।



এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম নাযাতে মুক্তো আছে

এমন কোনো মানুষ খুঁজে পেলাম নাযার মন আছে।

গানটা মেয়েটার মুখস্থ। কয়েকবার শুনেই তুলে নিয়েছে। যথন তখন গুনগুনিয়ে ওঠে সুর,

পথেই শুধু পথ হারালামনিরুদ্দেশে গেলাম না

ভালো বাসা অনেক পেলামভালোবাসা পেলাম না।

ভালো বাসা‘ আর ভালোবাসা‘ উচ্চারণ দিয়েই নির্মলা বুঝিয়ে দিচ্ছেন দুটো কথার তফাৎ। মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে সে কোন এক অজানা বিষাদ।

রেডিওতে বাজে নির্মলার আরো অনেক সুপারহিট গান। পিসি তাকে শুনিয়েছে,

ও তোতাপাখি রেশিকল খুলে উড়িয়ে দেবমাকে যদি এনে দাওআমার মাকে যদি এনে দাও।

ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলেকখন যে মা গেল চলে,

সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছেখুঁজে নাও

এ গানটা শুনে মেয়েটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে মায়ের কোলে গিয়ে মুখ গুঁজে দিয়েছিল। মায়েরা কখনো এমন করে চলে যেতে পারেতার মাও কি কোনোদিন

মা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন, “কী হল রেকাঁদছিস কেনএ কী?”

গান…” মেয়েটার ফোঁপানি আর থামে না।

পিসি তখন জিভ কেটেছে, “ইসকেন তোকে শোনাতে গেলাম!”



পিসির সঙ্গে বসে আরেকটা গান শুনতে বরং তার খুব ভালো লাগে। এ গান নাকি তার জন্মের অনেক আগের গানপুজোর গান। রেডিওতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় বাজে,

বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই,

মা গো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই?

পুকুরপাড়ে লেবুর তলেথোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে

ফুলের গন্ধে ঘুম আসে নাতাই তো জেগে রই 

রাত্রি হল মা গো আমার কাজলা দিদি কই?’

সত্যিই তো তাদের বাড়ির পুকুরধারে একটা বাতাবি লেবুর গাছ। ওদিকে বাঁশবাগান। সরু সরু বাঁশপাতা দেখতে কী যে সুন্দরসন্ধেবেলায় চাঁদ উঁকি মারে পাতার ফাঁকে। জোনাকি ওড়ে। হাসনুহানার গন্ধে ভারী হয়ে আসে বাতাস। পিসি তাকে বলেছেএ গান লিখেছেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী। লালউঁচু রোয়াকে পিসির পাশে পা ঝুলিয়ে বসে সে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছাতিনি কি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেনকী করে জানলেন এসব?”

পিসি হাসে, “নিজেই বুঝতে পারবি একদিন।” সে পিসি আজ না ফেরার দেশে। বড্ড অভিমানসবকিছু পিসি বুঝিয়ে দিয়ে যায়নি।

শারদ অর্ঘ্যের বইতে মাঝে মাঝেই মেয়েটা দেখে সিনেমার আর্টিস্টদের ছবি। তাঁরাও গান রেকর্ড করেন। কয়েকজন তো খুবই ভালো গাইতে পারেন। বিশ্বজিৎ সিনেমার নায়কসে শুনেছে। কী সুন্দর দেখতে। তাঁর গাওয়া পুজোর গান মেয়েটার খুব ভালো লেগেছে। যেমন সুরতেমন মিষ্টি গলা। গলার জোয়ারি বোঝার ক্ষমতা তখনও তার হয়নি।

তোমার চোখের কাজলে আমার ভালোবাসার কথা লেখা থাকবে,

আমায় ভালোবাসবে আর মনে রাখবে

তোমার স্মৃতির আঁচলে আমার প্রেমের প্রদীপখানি জানি ঢাকবে,

আমায় ভালোবাসবে আর মনে রাখবে।

মেয়েটা জানেএ হল বড়দের গান। তাতে কীগান শোনায় আর তুলে নেওয়ায় কোনো বারণ নেই। তবে সিনেমা দেখা মানা। বাড়ির কেউই প্রায় সিনেমাহলের দিকে যান না।

সিনেমা না দেখলেও সে কিন্তু হেমা মালিনীর নাম জানে। তাঁকে দেখেছে বইয়ের ছবিতে। কী সুন্দরকী সুন্দরবাবাদম বন্ধ হয়ে আসে যেন। তাঁর ছবিও শারদ অর্ঘ্যের পাতায় দেখা যায়। পুজোর গান রেকর্ড করেন। মোটামুটি লাগে শুনতে। সবাই কি আর বিশ্বজিতের মত গায়কনায়ক?

আর একজন নায়ক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কেও সে দেখেছে শারদ অর্ঘ্যের বইতে। গানও শুনেছে।

পুজোর সময় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় হাসির নাটক রেকর্ড করেন। সেগুলো আবার রেডিওতে নাটকের স্লটে শুনতে পাওয়া যায়। গীতা দের সঙ্গে নাটক করলেন ‘রাজযোটক’। শুনে হেসে মরেউফকী মজার উচ্চারণ ভানুর। তাঁর চেহারাটাও তেমন। এমন ছবি তোলান যে ছবি দেখেই সবাই হাসতে শুরু করে।

লোকগীতি শুনতে এমনিতে মেয়েটার ভালো লাগে না। কিন্তু অংশুমান রায় যখন পুজোর রেকর্ডে গাইতে থাকেনসে গানের সঙ্গে আঠার মত সেঁটে যায় সে।

ভাদরআশিন মাসে ভমর বসে কাঁচা ঘাসে,

মন আমার কেমন কেমন করে ও বঁধু হে,

আর কি থাকিবে বাপের ঘরেতে ও বঁধু হেআর কি থাকিবে বাপের ঘরে…’

যেন মনে হয় গানের তালে তালে পা ফেলছে কেউ। সে শুনেছেএ গানের নাম ঝুমুর।

আরো একজন সেবার গান গাইলেনঅমৃক সিং অরোরা। মাথায় পাগড়ি। খুব দ্রুত লয়ে নাচের তালের গান।

রূপসী দোহাই তোমারতোমার ওই চোখের পাতায়,

আমাকে কাজললতার কালি করো…’

এ গান শুনে বাবা মা দুজনেই নাক সিঁটকালেনএসব কী রেকর্ড বেরোচ্ছে আজকাল?

মেয়েটার কিন্তু চটুল ছন্দের গান শুনতে বেশ মজাই লেগেছিল।

অক্টোবরের বেলা পড়ে আসছে। ঘড়ির দিকে তাকান সোমা। পৌনে ছটা। উঠে পড়েন ল্যাপটপ ছেড়ে। এক্ষুণি রেডিওতে শুরু হবে অনুরোধের আসর। বিবিধ ভারতীতে। পুজোর গান বাজবে। শারদ অর্ঘ্যটি কোলের কাছে নিয়ে হাঁ করে শুনবে ফ্রকপরা মেয়েটা। তারপর পড়তে বসা।



মন লাগে নাতুমি বিনা মোর জীবন যেনচাঁদিনী বিহীনা রজনী।

নিশিদিন নিশিদিন বাজে স্মরণের বীণসে যে তুমি বিন জানে না…’

লতা মঙ্গেশকর গাইবেন সলিল চৌধুরীর সুরে।

ও মোর ময়না গোকার কারণে তুমি একেলা‘ কিংবা

আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অজস্র গান শোনাবেন তাঁর মধুঝরা কণ্ঠে।

আরতি মুখোপাধ্যায় একদম অন্যরকম স্টাইলেঅন্যরকম মিষ্টত্ব ভরে দেবেন গানে।

জলে নেবো নাআর থই পাবে না‘ কিংবা বন্য বন্য এ অরণ্য ভালো

আশা ভোঁসলে গাইবেন আর ডি বর্মনের সুরে।

আর হেমন্তমান্নাকিশোরকুমার রাজ করবেন পুরুষদের দিকে।

শারদ অর্ঘ্য বইয়ের দৌলতে এঁদের সবার ছবি মেয়েটার খুব চেনা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মোটা কালো ফ্রেমের চশমামান্না দের মাথার টুপিসন্ধ্যা মুখার্জির দুই বিনুনীকিশোরকুমারের কোঁকড়া চুলআরতির ঠোঁটের ওপর কালো তিল – সঅব তার মুখস্থ।

শুধু তো আধুনিক গানই নয়আরো কত গান চিনেছিল সেই মেয়েটা, HMVর পুজোর গানের দৌলতে। সে জানত কীর্তনের গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়কেকী সুন্দর সাদা সিল্কের চাদর জড়ানো স্নিগ্ধ চেহারা। শুনেছিল কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের অতুলপ্রসাদীপান্নালাল ভট্টাচার্যের শ্যামাসংগীত। মেয়েটা তাঁর মায়ের কাছে শুনেছেআধুনিক গানের জনপ্রিয় শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য হলেন পান্নালালের দাদা। কিন্তু দুজনের গানে কোনো মিল নেই।। গোবিন্দগোপাল ও মাধুরী মুখোপাধ্যায়ের স্তোত্রগান মুগ্ধ করত তাকে। বাবা বলতেন, “বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ শেখ এঁদের কাছ থেকে।



সোমা উঠলেন। মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠছে সনৎ সিংহের একটি বিখ্যাত ছোটদের গান। প্রবাসে অনেক বাচ্চাকে গানটি শিখিয়েছেন তিনি।

একেক্কে একদুয়েক্কে দুই

নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে,

নন্দীবাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে,

মন বসে কি আর?

আহাহা চণ্ডীতলায় বাদ্যি বাজে ঢাক গুড়গুড়

তা ধিনা তাক তা ধিনা তাক তা ধিনা তাক কুড়কুড়কুড়ুর কুড়ুর তাক!’

ব্যাকইয়ার্ডে গাছের পাতায় হেমন্তের উজ্জ্বল রং চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে আটচালা। দেবীর মূর্তি গড়ার কাজ শেষ। বোধনের আর দেরি নেই। নিমেষে নামতাপড়া পাঠশালার পড়ুয়া হয়ে গেলেন তিনি। আজ আর কাজে মন বসবে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত