উৎসব সংখ্যা সিনেমা: ভবা-ভবি, দেশভাগের শিকার যমজ ভাইবোন
16 অক্টোবর 2021
টোকন ঠাকুর
আনুমানিক পঠনকাল: 7মিনিট
দেশভাগের পর নদী সীমান্তরেখা হয়ে গেছে। নগর কোলকাতার কয়েকজন থিয়েটারকর্মী এসেছে নদীর পাড়ে, যার ওপারেই বাংলাদেশ বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান। থিয়েটার দলের অস্থির ও বিষণ্ণ নির্দেশক, যুবক ভৃগু তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের গ্রামটির দিকে। দলের নতুন সদস্যা যুবতী অনুসূয়াকে ভৃগু বাংলাদেশের গ্রামটিকে দেখিয়ে বলে, ‘ওই যে আমাদের গ্রাম, ওখানেই আমাদের বাড়ি ছিল কিন্তু কোনোদিন আমি আর ওখানে যেতে পারব না।’ চরম এক হতাশার অতল থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারা দেশভাগের যাতনার আখ্যান বলে দেয় কয়েকটি সংলাপে_আমরা ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘কোমলগান্ধার’ ছবিতে এরকমই দেখতে পাই। পুরো ‘কোমলগান্ধার’ ছবিতেই দেখি দেশভাগ এপিক হয়ে ওঠে। দেশভাগ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। ‘সুবর্ণরেখা’তেও দেখি বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ভাইবোনের গল্প, ছোট্ট বোন সীতা ও তার ভাই অভিরামের গল্প। ভাইবোন হাঁটছে নদীপাড়ের বালিয়াড়ি ধরে, বাড়িহীন ভাইবোন হাঁটছে। সীতা হাঁটতে হাঁটতেই প্রশ্ন করে, ‘দাদা, আমাদের নতুন বাড়িটা কোথায়?’ ভাই উত্তর দেয়, ‘ওই তো, সামনেই।’ একটি নতুন বাড়ির সন্ধানে তারা নদীপাড়ের বালিয়াড়ি ধরে হাঁটতে থাকে। দেশভাগে তাদের বাড়িটা হারিয়ে যাওয়াই তারা বাড়ি হারিয়েছে। নতুন দেশের সীমানার ভেতর শরণার্থীদের জন্যে গড়ে ওঠা যে নবরতন কলোনি, আপাতত কি সেখানে আশ্রয় মিলবে? এরকমটি দেখতে পাই ঘটকের ‘সুব রেখা’য়। আমরা জানি, সুবর্ণরেখা একটি নদীর নাম। ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে যেমন দেখা যাবে পূর্ব বাংলা থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা এক উদ্বাস্তু তরুণী বঙ্গবালাকে, যাকে দেখে প্রোটাগনিস্ট নীলকণ্ঠ বাগচী, যে কিনা মাতাল, যে কিনা তার নিজের ভাষায় ‘আমি হচ্ছি কোলকাতার ব্রোকেন ইন্টেলেচুয়াল বা ভাঙা বুদ্ধিজীবী’, সেই নীলকণ্ঠ বাগচীর দিশেহারা তাড়া খাওয়া মেয়েটি তার ঘরে নক করলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কে, কে ওখানে?’ মেয়েটি ঘরে ঢুকে পড়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলে নীলকণ্ঠ বাগচী বলেন_’আশ্রয়? আশ্রয়ের সন্ধানে নীরহাড়া আরেকটি পাখি, যে পাখির নাম, বাংলাদেশ।’ স্মর্তব্য, মাতাল লেখক নীলকণ্ঠ বাগচী বা ব্রোকেন ইন্টেলেচুয়াল ক্যারেক্টারে অভিনয় করেছেন স্বয়ং পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক। ১৯৭৪ এ নির্মিত এটাই ঘটকের শেষ ছবি, এরপর ১৯৭৬ এ তিনি মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা গেলেন কোলকাতায়। আর দেশভাগের জ্বলন্ত দলিল তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’। ‘মেঘে ঢাকা তারা’তে ঋত্বিক ঘটক দেশভাগের যন্ত্রণাকে আরো বিস্তারিত এঁকেছেন আরো মহিমা দিয়ে, যেখানে ক্ষতটা আরো বেশি দৃশ্যমান হতে দেখি আমরা। সম্পূর্ণ করা ঘটকের বাকি কাজ বলতে ‘নাগরিক’, যেটি তার প্রথম কাজ, ১৯৫২ তে নির্মিত কিন্তু কী অপার দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৬ সালে পরিচালকের মৃত্যুর পরের বছর ১৯৭৭ সে ছবি মুক্তিপ্রাপ্ত। এ ছাড়া ‘অযান্ত্রিক’ ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ও কোলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসে নির্মিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মালোপাড়ার ছেলে অদ্বৈত মল্ল বর্মণের একমাত্র উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম।’ আর বাকি কাজ কিছু তথ্যচিত্র বা অসমাপ্ত খণ্ড খণ্ড কিছু প্রয়াস_এই হচ্ছেন ঋত্বিক ঘটক। এককথায় দেশভাগের এপিক নির্মাণে ঋত্বিক ঘটকই এক জ্বলজ্যান্ত আর্কাইভ। এই ২০১৯ এ এসেও আমরা অনুভব করি, ঋত্বিক কুমার ঘটক কতখানি আলোচ্য, ভাবোচ্য, যথেচ্ছ তর্ক-বিতর্কের অনুঘটক। এবং এটা এতদিনে প্রকাশ্য হয়ে গেছে যে, শিল্পকলার নানাবিধ মাধ্যমে দেশভাগ কমবেশি ফোকাস হয়ে থাকলেও, সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে ঋত্বিক ঘটকের চোখে, তাঁর ছবিগুলোর ভেতর দিয়ে। এতটা আর কেউই ধরে রাখতে পারেননি গান্ধি-জিন্নাহ-মাউন্ট ব্যাটেন নেতৃত্বে হয়ে যাওয়া দেশভাগকে। ঋত্বিক পেরেছেন বা একথাও বলা চলে, তিনি আত্মগত এক দায়-বদ্ধতায় পারতে বাধ্য হয়েছেন নিজের জীবন ব্যেপে, যে জীবন বড্ড স্বল্পায়ুর এবং ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত।
৪ নভেম্বর ঋত্বিক ঘটকের ৯৪ তম জন্মদিন। তিনি ১৯২৫ সালে জন্মেছেন পুরোনো ঢাকার হৃষীকেশ দাস রোডের এক বাড়িতে এবং ঋত্বিকের যমজ প্রতীতি দেবী ঘটক জন্মেছেন পাঁচ মিনিটের অনুজ সহোদরা হিসেবে। তাঁদের বাবা সুরেশ ঘটক ছিলেন তৎকালীন ঢাকার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট। সুরেশ ঘটকের প্রথম সন্তান ছিলেন সাহিত্যিক মনীশ ঘটক। মনীশ ঘটকের জন্ম ১৯০০ সালে। মধ্যে আরো কয়েক সন্তানের পর বা ২৫ বছর পর এই যমজ সন্তানের জন্ম। যমজের ডাকনাম ভবা ও ভবি। ভবা হচ্ছেন ঋত্বিক, ভবি হচ্ছেন প্রতীতি দেবী। প্রতীতি দেবী অর্থাৎ ভবি এখনো আমাদের এই শহরেই বাস করছেন, সিদ্দেশ্বরীতে, যার বয়স আজ ৯৪। ভবা বা ঋত্বিক ঘটক মাত্র ৫১ তে চলে না গেলে তিনিও থাকতেন কোলকাতায়। কী অদ্ভুত কথা, নাহ? যমজ তাঁরা, ঢাকায় জন্মেছেন। কিন্তু দেশভাগের ফলেই একজন কোলকাতার নাগরিক হয়ে বেঁচে ছিলেন এবং একজন ঢাকার নাগরিক। এমনটিও খুব সচরাচর নয়। তাই দেশভাগ মানে ঋত্বিক কুমার ঘটকের কাছে যমজ ভাইবোনের ভাগ হয়ে যাওয়া। উল্লেখ করি, ঋত্বিক ঘটকের কয়েক ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে যিনি বড় ছিলেন, সেই মনীশ ঘটকের মেয়ে হচ্ছেন মহাশ্বেতা দেবী। মহাশ্বেতা দেবীর ডাকনাম খুকু। খুকু, ভবা ও ভবি বয়সের হিসেবে কাছাকছি তাদের সময়ে জন্ম। মহাশ্বেতা দেবীর স্বামী ছিলেন নাট্যকার ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য, সেই চল্লিশের দশকের গণ্নাট্য আন্দোলনের পুরোধা একজন। ঋত্বিকের ছবিতেও তাঁকে দেখি আমরা। বিজন বাবু ছিলেন রাজবাড়ি-ফরিদপুরের লোক। বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতা দেবীর পুত্র কবি ও কথাসাহিত্যের এক নতুন ‘এরা’ নবারুণ ভট্টাচার্য, আমরা পড়েছি তাঁর কবিতা, ‘এই ম্রত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, এই জল্লাদের ভূমি আমার দেশ না।’ পড়েছি ও দেখেছি তাঁর ‘হারবারট’ ‘ফ্যাতাড়ু।’ পড়েছি ‘অ্যাকুরিয়াম’। ২০০২ সালে সার্ক রাইটার্স ফাউন্ডেশন কার্যক্রমের আওতায় সাহিত্য আকাদেমির আমন্ত্রণে ‘তরুণ কবি’ অভিধায় আমি প্রথমবারের মতো কোলকাতায় গিয়েছিলাম আমি আর শাহনাজ মুন্নী। আকাদেমি থেকে আমাদের একজন গাইডের সঙ্গে ট্যাক্সিতে করে পাঠানো হয় মহাশ্বেতা দেবীর বাসায়, আড্ডার জন্যে। কাঁচা পাকা দাঁড়ি গোঁফের সেই গাইড লোকটি ট্যাক্সিতে বসে তো টেরই পেতে দেননি যে, তিনিই কবি নবারুণ ভট্টাচার্য। পরে, গলফ গ্রিনে মহাশ্বেতা দেবীর তৎকালীন বাসায় যাওয়ার পর সব পরিষ্কার হলো যে, তিনি বিজন ভট্টাচার্যের ছেলে বা ঋত্বিক ঘটকের ভাগ্নেও বটে। কয়েকবছর আগে, নবারুণ দা আগে এবং মহাশ্বেতা দি পরে চলে গেছেন। তাঁদের প্রয়াণ নিয়ে ভবি বা ঋত্বিক ঘটকের যমজের সঙ্গে মানে প্রতীতি দি’র সঙ্গে সিদ্দেশ্বরীতে বসে কথাও হয়েছে, সেই কথা বলার সময় প্রতীতি দি বলছিলেন, ‘শোন, দীর্ঘ আয়ু অভিশাপের মতো_এ কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন।’ আমি বললাম, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠিক বলেননি।’ দিদি বললেন, ‘কেন?’ বলেছি, ‘তাহলে ভবার মতো তোমার সঙ্গেও আমাদের দেখা হতো না।’ প্রতীতি দেবী বললেন, ‘এই যে তোমরা আসো, আমার জন্যে আসো? আসো তো ভবার জন্যে, ঋত্বিকের জন্যে, ওর কাজ ওর ছবিগুলোর জন্যে আসো। নইলে আর আমি কে? বড়জোর ধীরেন দত্তের পুত্রবধু। তাই না?’ ১৯৫৪ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত,তার আগে ১৯৪৮ এ পাকিস্তানের মাটিতে বসে বাংলা ভাষার প্রশ্নে ধীরেন বাবু তার যে অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন, পরে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের পর ২৯ মার্চ কুমিল্লায় তাঁর বাড়িতে সেদিনের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভাষা সৈনিক ও ভারতবর্ষের সুবিদিত রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপরে অমানবিক নির্যাতন চালায় এবং পরবর্তী দুই মাসের মধ্যেই তিনি মারা যান। সন্দীপ দত্ত তার পুত্র, সন্দীপ দ্ত্তের বধূই প্রতীতি দেবী ঘটক, আমাদের প্রতীতি দি বা ঋত্বিক ঘটকের যমজ।
আমি নানা বিষয়েই দিদির সঙ্গে তর্কবিতর্ক করি বটে, এ ব্যাপারে আর তর্ক বাড়াই না। প্রতীতি দেবীর ঘরে নানান দেশ থেকে যমজ ভাইবোনের ছোটছোট পুতুল পুতুল ভাস্কর্য, যেগুলো তাঁর মেয়ে ( ১৯৭১ এ রোকেয়া হলের ছাত্রনেত্রী ও বর্তমানে সরকারের সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদ) আরমা দত্ত এনে দিয়েছেন। আরমা দত্ত আর রাহুল দত্ত, ভাইবোন প্রতীতি দেবীর সন্তান, ঋত্বিক ঘটকের ভাগ্নে-ভাগ্নি। রাহুল দা প্রায়ই আমাকে ফোন করেন, ‘টোকন দা, আজ ডেইলি স্টারে ছোট্মামার উপরে একটা আর্টিকেল ছেপেছে, পড়েছো?’
ছোটমামা বলতে ঋত্বিক ঘটক। রাহুল দার মায়ের যমজ ভাই। যাদের জন্ম হয়েছিল ঢাকায়, সেই ১৯২৫ সালে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার, ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করতে এসে দুপুরবেলার আহ্নিকের জন্যে আতিথ্য নিয়েছিলেন তদানীন্তন ঢাকার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশ ঘটকের হৃষীকেশ দাস রোডের বাড়িতে। কথায় কথায় একদিন প্রতীতি দি’কে বললাম, ‘ তোমার আর ঋত্বিকের বয়স তখন মাত্র ১ বছর।?’
প্রতীতি দি বললেন, ‘হ্যা।’
বললাম, ‘তাহলে তো রবীন্দ্রনাথ তোমাদের কোলেও নিয়েছেন।’
দিদি বললেন, ‘তা তো নিতেই পারেন, আমি আর ভবা তখন মাত্র ১ বছরের যেহেতু।’
বললাম, ‘সে কারণেই, ধরো কোলে নেওয়ার পর তোমরা রবীন্দ্রনাথের গায়ে হিসুও করে দিতে পারো, তাই না?
এক পশলা হাসাহাসি হয় আমাদের। আমরা সেকাল-একাল একাকার করে ফেলি এবং প্রতীতি দি’র সঙ্গে আড্ডায় সেটা অনায়াসেই সম্ভব। দিদির লেখা একটি বই আছে, ‘ঋত্বিককে শেষ ভালবাসা।’ বললাম, দিদি, ‘সুরমা ঘটকের বইও পড়েছি।’ দিদি বললেন, শ্রীহট্টের মেয়েরা তো ভালো না। ভবাকে ঠিক মতো বুঝতেই পারেনি। ভবাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। তবে ওখানকার আলী দা আসতেন আমাদের বাসায়, আলী দা ভালো।’
বললাম, ‘আলী দা কে?’
দিদি বললেন,’ সৈয়দ মুজতবা আলী, পড়োনি আলী দা’র লেখা?’
‘পড়েছি।’
দিদি একদিন বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পর আর ডেডবডি দেখতে এসো না।’
বললাম, ‘কেন?’
প্রতীতি দি বললেন, ‘ জীবদ্দশার চেহারাটাই মনে থাকবে তাহলে, আমি সেটাই চাই।’
কথায় কথায় কত কথা হয়। আমাদের নির্মাণাধীন ছবি ‘কাঁটা’র টিম নিয়ে গেছি দিদির সঙ্গে আড্ডা দিতে। সেদিন দিদির মেয়ে আরমা দি’ও এক সন্ধ্যে পুরোটা সময় আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যুক্ত থাকলেন। একসময় দিদি বল্লেন, ‘আচ্ছা, এখন ঢাকায় ‘বাংলা’ কোথায় পাওয়া যায়, জানো? মরার আগে একদিন ‘বাংলা’ খাব। ‘বাংলা’ ভাবলেই ভবার কথা মনে পড়বে। একসঙ্গে মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে মায়ের পেট থেকে জন্মালাম, ও কত আগেই আমাকে রেখে চলে গেল।’
চুপ করে আছি, ঠিক কি বলব ভাবছিলাম, তখন দিদিই ফের বললেন, ‘সাঈদ জানে, কোথায় পাওয়া যায়।’
বললাম, ‘কোন সাঈদ?’
‘ওই যে, হামিদুরের ভাই সাঈদ। হামিদুর তো আর্টিস্ট। আর সাঈদ নাটক লেখে।’ আর্টিস্ট হামিদুর রাহমানের ভাই নাট্যকার সাঈদ আহমেদের কথা বলছেন দিদি। আমি জানাইনি, সাঈদ আহমেদ মারা গেছেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি পড়ে সে রাতে কাগজ ছিল না বলে ঋত্বিক যে তাঁর একটি শাদা শাড়ির উপরেই চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন, দিদি বলেন সে কথা। কথায় কথা বাড়ে, কথার শুরু আছে, শেষ নেই। নেই?
আছে। কথারও নিশ্চয়ই কোনো স্টেশন আছে, যেখানে কথারা একটু দাঁড়ায়, কথা একটু এদিক-ওদিক চায়। হয়তো তখন আরো কিছু এসে ফের যুক্ত হয়, দাঁড়িয়ে পড়া কথার পাশে। ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে আমাদের কথা আর শেষ হতেই চায় না। কথা আবার নতুন শক্তিতে চলতে থাকে। কথা চলতে থাকে ‘কোমল গান্ধার’ ছুঁয়ে, কথা আমাদের ‘সুবর্ণরেখা’ নদীর ধারে নিয়ে যায়। সেখানে নিশ্চয়ই একটি নতুন বাড়ি পাওয়া যাবে। আমাদের কথারা সেই নতুন বাড়িতে উঠে পড়বে! আমাদের কথারা দেশভাগের এতবছর পরেও ঋত্বিক কুমার ঘটকের ছবির ভেতর দিয়ে ধাবমান থেকে যাচ্ছে। কথার সঙ্গে যাচ্ছি আমরাও। আমরা কারা? আমরাও কি কিছু কথা হয়ে থেকে যাচ্ছি, নদীর মতো বেঁকে যাচ্ছি, স্বপ্ন-টপ্ন রেখে যাচ্ছি? কার জন্যে রেখে যাচ্ছি?
ঢাকায় জন্ম নিলেও ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ছিল রাজশাহী। পদ্মাপাড়ে। রাজশাহী হলেও আদিতে তাঁরা পাবনার লোক। পাবনায় কি তাঁরা কোনোকালে বাগচী ছিলেন? এই তো আবার মনে পড়ল নীলকণ্ঠ বাগচীর কথা, যিনি ‘যুক্তি-তক্কো আর গপ্পো’তে বলছেন, ‘আমি হচ্ছি কোলকাতার ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল।’ যিনি সারাক্ষণ মদিরার ঝুলন মায়ায় দুলছেন, যিনি খালি বোতলটা রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে বলছেন, ‘ওহ! কী উন্মুক্ত এই হাওয়া, তরী অকুলে ভিড়ছে।’
আবার সেই কথা এসে গেল। আমার প্রথম প্রজেক্ট ‘ব্ল্যাকআউট’ যা অধ্যাবধি আনরিলিজড এবং ‘ব্ল্যাকআউট’ টাইটেলে উৎসর্গ করা হয়েছে ঋত্বিক কুমার ঘটককে। ঘটকের একেকটি ছবি আমি কতবার দেখেছি ও দেখি, হিসেব নেই। সিনেমার আড্ডায় কতবার ঋত্বিক ঘটক প্রসঙ্গক্রমে আসেন, কতভাবে আসেন, কি ঢাকায় কি কোলকাতায়- হিসেব নেই। সত্যি, এত অনিবার্য তিনি! বিস্ময় ফুরোয় না। বিস্ময় এসে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়। বিস্ময় এসে চোখের মধ্যে বাসা বোনে। কেন? এত শক্তি তাঁর?
যন্ত্রণাই কি শক্তির উৎস হয়ে আছে? দেশভাগই কি নির্মাণ করেছে এই নির্মাতাকে? ভালবাসাই কি প্রবল প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে? আমাদের কথা চলতেই থাকে, আমরাও চলতে থাকি কথার সঙ্গে, যেন কথার সঙ্গে আমরা একটি নতুন বাড়িতে পৌঁছুব। হঠাৎ দেখি, এক বৃদ্ধ নদীপাড়ে বসে খোলাগলায় গান ধরেছেন-‘এপার পদ্মা, ওপার পদ্মা, মধ্যে জাগনার চর, তারই মাঝে বইসা আছেন শিবু সওদাগর…’
আমাদের কথারা নদীর মতো, বহে বহে যায়। সেই নদী ভাগ হয়ে যায়। নদী কী করে ভাগ হয়? যমজের জন্যে মাতৃজঠর কি করে ভাগ হয়? মনে হয়, আবার কথার সঙ্গে আমাদের হণ্টন শুরু হলো। আমরা কথার সঙ্গে আবার হাটতে থাকি, আমাদের ধাবমান পা, ধাবমান আমাদের মন, আমরা কোথায় যাচ্ছি? কথা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?