| 29 মার্চ 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা’২০২১

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা গল্প: শেষ খেয়া ।  শকুন্তলা চৌধুরী 

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

“বড়দি’ ফোন করেছে দিদা, নাও… এসে ধরো।” ভেতরের ঘর থেকে মণিকা ডাকলো। কোনো উত্তর নেই।“কই গো দিদা, এসো?” মণিকা আরেকটু গলা তুললো। তাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। অথচ বাইরের ঘরেই বসে আছে দিদা, মণিকা দেখে এসেছে এক্ষুণি। একহাতে ফোন আর আরেক হাতে কাপড়ের বালতি নিয়ে, সে-ই বা আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে!  অগত্যা ফোনটা আবার কানে চেপে ধরলো মণিকা- “বড়দি, তুমি একটু বাদে ফোন করবে? দিদা বোধহয় বাথরুমে ঢুকেছে।” 

ফোনের অপরপ্রান্তে বিরক্তি ফুটে উঠলো কুহুর গলায়- “বোধহয় বাথরুমে ঢুকেছে মানে? এইটুকু তো ফ্ল্যাট! তুমি জানো না মা কোথায় আর কি করছে?… তুমি কি করছিলে?” 

মণিকা প্রমাদ গুণলো, মা’কে না পেয়ে বড়দি’ এবার তাকে নিয়ে পড়বে!  পারতপক্ষে সে বড়দি’র সামনা-সামনি পড়তে চায় না, কিন্তু আজকে আর উপায় নেই! দিদা যে ইচ্ছে করেই সাড়াশব্দ দিচ্ছেনা, তাতে মণিকার কোনো সন্দেহই নেই। অগত্যা সে হাত থেকে বালতিটা নামিয়ে, আমতা আমতা করে বললো— “আমি ছোট বাথরুম থেকে আমার কাপড় কেচে এই বেরুলুম, বারান্দাতে মেলতে যাচ্ছিলুম…তখন ফোনটা এলো। দিদা যে কোথায়…?” 

কুহু বললো, “হয়েছে হয়েছে! আর কাহিনী ফেঁদে বসতে হবে না।… যেমন মা, তেমন তার পুষ্যি! তুমি কাজ করতে যাও। মা বেরোলে বলে দেবে আমাকে ফোন করতে।”  মণিকা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। ফোনটা রেখে, কাপড় শুকোতে দেওয়ার বদলে, সে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়ালো। যা ভেবেছে তাই! দিদা চুপচাপ বসে খবরের কাগজে পাজল্ খেলছে। 

মণিকা বললো— “তুমি বড়দি’র ফোন এলেই এমন করো কেনো গো, দিদা?… আমি ডাকলাম এতোবার – কানে তুমি কিছু কম শোনো না, সে আমি ভালোই জানি!”  মিসেস বাসু কাগজ থেকে চোখ না তুলে বললেন, “জানিস্ যদি তো কথা বাড়াচ্ছিস কেন?…যা কাপড়গুলো মেলে দিয়ে আয় বারান্দায়, তারপর ইংরেজী ট্র্যানস্লেশন কি করেছিস এনে দেখাবি।”

-“বড়দি’ তোমায় ফোন করতে বলেছে। আমি কিন্তু বলে দিলুম – নইলে বড়দি’ শেষে আমাকেই বকুনি দেবে।”

মিসেস বাসু কাগজে চোখ রেখেই বললেন, “তোমার কাজ তুমি করে দিয়েছো। আমায় বলেছো, আমি শুনেছি।… এবারে যা করতে বললাম করো, নইলে এ’বাড়ীর কাজ ছেড়ে বড়দি’র বাড়ি কাজ ধরো।” মণিকা মুখের একটা ভঙ্গি করে, কাপড় মেলতে চলে গেলো। 

সে ভালোই জানে যে দিদা তাকে কাজ থেকে ছাড়াবে না। এইরকম একটু আধটু ধমকি চলে তাদের মধ্যে। কখনো দিদা বলে তাকে চলে যেতে, কখনো দিদা বেশী রেগে বকুনি দিলে সে বলে যে ছেড়ে দেবে। কিন্তু ঐ বলা পর্যন্তই, তার বেশী না। দিদারও তাকে ছাড়া চলে না, আর তারও একটা কেমন যেন টান পড়ে গেছে দিদার ওপর। মানুষটার সব থেকেও কেউ নেই, তাই বোধহয় মেজাজটা একটু ‘রুক্ষু’ মত – ভাবে মণিকা।

দিদার ‘দাদু’কে সে ছবিতে ছাড়া দেখেনি। টাই-কোট পরা গম্ভীর মুখের ছবি। তিনি নাকি এক মস্ত বিলেতি কোম্পানীর বড়ো সাহেব ছিলেন। তা’ হবে, নইলে আর এমন জায়গায় এতোবড়ো একটা ফ্ল্যাট? প্রথমদিন যখন নার্সিং সেন্টার থেকে তাকে পাঠালো, তখন এমন সাজানো বাড়ি দেখে তো মণিকা ‘হাঁ’। যেমন বাড়ি তেমন বাড়ির মালকিন্। সোনালী ফ্রেমের চশমা, ঘাড় অবধি ছাঁটা চুল আর হাউসকোট-পরা মালকিনকে দেখে মণিকা তো একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলো। সে যেসব বাড়িতে কাজ করেছে এখন অবধি, তারা সব অন্যরকম আর বিছানায় শোওয়া রোগী। 

দিদার একটা ছোট অপারেশন হয়েছিলো, বম্বে থেকে বড়ো মেয়ে এসে সাতদিন ছিলো। কিন্তু তার অফিস আছে, তাকে এবার চলে যেতে হবে। এখনও ক’দিন ওষুধপত্র চলবে আর বাড়ীতে দিদা একা। দাদু মারা যাওয়ার পর তখন বছরও ঘোরেনি। মেয়েরা তাই লোক রাখার ব্যবস্থা করেছিলো। চেনাজানা লোকের নার্সিং সেন্টার থেকে নেবে বলে, নাহলে মণিকা কি আর এই বাড়ীতে কাজ করতে আসতো? দিদা তো রাখতেই চাইছিলো না প্রথমে— “সুরমা দু’দিন রাতে থাকবে বলেছে, অন্য লোক লাগবে না….” বলছিলো, আরো কিসব ইংরেজীতে কথা। কিন্তু বড়দি’ও তো ছাড়ার লোক নয়, আর দিদা বেশী তর্ক করতে ভালোবাসে না। অতএব মণিকা বহাল হলো।

তবে মণিকাকে শেষ পর্যন্ত কেন জানি ভালো লেগে গেলো দিদার, ইংরেজী জানা না হলেও। সুস্থ হওয়ার পরেও দিদা তাকে ছাড়লো না। ঠিকে লোক যেমন কাজ করছিলো করতে থাকলো। মণিকা রইলো টুকটাক কাজ, রান্না, এ’দিক-ওদিক সঙ্গে যাওয়ার জন্যে। মণিকারও ঘরের টান নেই। কম বয়সে বিয়ে হয়েছিলো, বর তো কবেই ছেড়ে চলে গেছে। এক ছেলে, সে-ও কাজের ধান্দায় এদিক-সেদিক ঘোরে। ন’মাসে-ছ’মাসে বাড়ি আসে। তাই মণিকাও রয়ে গেলো, রাতেও এখানেই শোয়। ছেলে এলে ও বাড়ী চলে যায় দু’দিনের জন্য। আসার আগে ছেলে সেলফোনে জানায় মণিকাকে। মায়ের কাছে সারাদিন একজন সঙ্গী আছে জেনে মেয়েরাও নিশ্চিন্ত হলো – এই নার্সিং সেন্টার ব্যাকগ্রাউণ্ড চেক্ করে কাজে ঢোকায়, সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। সেই থেকে আছে মণিকা, পাঁচবছর হয়ে গেলো। দিদার সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরেও আসে মাঝেমধ্যে। একবার গেছিলো মায়াপুর, একবার জয়রামবাটী-কামারপুকুর। শখ হলে মণিকাকে নিয়ে সারাদিনের জন্যে কলকাতা ঘুরতেও বেড়িয়ে পড়ে দিদা। দাদু মারা যাওয়ার পর তো নিজেদের গাড়ি বিক্রী করে দিয়েছে, তাই দিদা একটা গাড়ি ভাড়া করে নেয় সেদিন। সায়েন্স সিটি ঘুরে, ‘সোনার বাংলা’য় খেয়ে ফিরেছিলো আগেরবার। তার আগে একবার প্ল্যানেটোরিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, আউটরাম ঘাট ঘুরে এসেছিলো। এছাড়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, গাড়ি ভাড়া করে রাত্রে পুজোর ঠাকুর দেখতে যাওয়া- এইসব তো আছেই। এই করতে করতে কবে যেন এই সোনালী চশমা পরা মালকিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো মণিকার। নিজের ঘরের গল্পও যেমন বলেছে মণিকা, দিদার ঘরের গল্পও তার সব জানা হয়ে গেছে আস্তে আস্তে। 

দিদার মেয়েরাও সব সাহেবী সাহেবী। দিদার বয়স আশীর কাছাকাছি আর কলেজে-পড়া বড়ো বড়ো নাতি-নাতনী থাকলেও, দিদার মেয়েদের দেখলে কিছুতেই ‘মাসী’ বলে ডাকা যায় না। সুতরাং ‘দিদা’র মেয়েদের ‘বড়দি’ ‘ছোড়দি’ বলেই ডাকে মণিকা, ঠিকে কাজের লোক সুরমার দেখাদেখি।

ছোড়দি’ কেকা থাকে লণ্ডনে— বছরে একবার আসে স্বামী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে। মেমসাহেবদের মতো ফরসা রঙ আর গায়ে বিলেত-বিলেত গন্ধ হলেও, তার কথাগুলো খুব মিষ্টি। যখনই আসে, মণিকাকে অনেকগুলো টাকা দেয়। তাছাড়া পুরোনো সিল্কের শাড়ী, শ্যাম্পু, সাবান সব এনে দেয়। বারবার করে বলে, মা বকলেও যেন মণিকা কাজ না ছেড়ে দেয়। দিদাও খুশী থাকে ক’দিন। তারপর তারা চলে গেলে বলে, “সব মরশুমি পাখি।…চল্, এবার তোর খাতা নিয়ে আয়। তালেগোলে ক’দিন ইংরেজী ট্র্যানস্লেশন হয়নি।” 

বড়দি’ কুহু থাকে বম্বেতে। সে তো দেশেই সারাক্ষণ প্যান্ট-শার্ট পরে চুল কেটে ঘুরে বেড়ায়। আর কী কটকটে কথা! তাকে দেখলেই ভয়ে মণিকার প্রাণ শুকিয়ে যায়, তো কথা শুনবে কি? বড়দি’ প্রায়ই কলকাতায় আসে, সবাইকে নিয়ে না হলেও একাই চলে আসে। আর সেই ক’দিন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে মণিকা। দিদাও খুব স্বস্তিতে থাকে বলে মনে হয় না।

দিদার অপারেশনের সময় দরকারে পড়ে তাকে কাজে রাখলেও, এখন মণিকাকে একদম সহ্য করতে পারে না বড়দি’। মণিকা সেটা বেশ বুঝতে পারে। ওর সঙ্গে সবসময় রাগ রাগ করে কথা বলে আর কলকাতার বাড়িতে এসে কিছু খুঁজে না পেলেই দিদাকে বলে, “ওটাও কি তোমার পুষ্যিকে দিয়ে দিয়েছো নাকি?” 

দিদা চুপ করেই থাকে। একদিন শুধু চোখ তুলে গম্ভীর গলায় বলেছিলো, “কেন? যদি দিয়েই থাকি- আমার জিনিস আমি যাকে খুশী তাকে দেবো। সব কি তোকে দিতে হবে নাকি? তোরই বা কলকাতায় এলেই আলমারি ঘেঁটে সব জিনিস দেখার কি দরকার?” 

বড়দি’ একটু থতোমতো খেয়ে গেলেও, হটে যাওয়ার লোক নয়। 

গলা তুলে বললো, “মাইন্ড ইয়োর ওয়ার্ডস্ মা! দিন দিন যে কি হচ্ছে তোমার… যার তার সামনে কী সব বলছো? আগে এইসব মেইডসদের সঙ্গে কথাই বলতে না তুমি, এখন এরা তোমার বন্ধু!… দ্যাট্ পার্টি-কুইন্ মিসেস বাসু… হোয়াটস্ হ্যাপেনিং টু ইউ?”  

দিদা আর কিছু বললো না, বড়দি’ও মায়ের মেজাজ বুঝে সেদিন আর বেশী ঘাঁটালো না। 

আসলে দিদা গতবার শীতে তাকে একটা গায়ের চাদর আর সামনে খোলা উলের সোয়েটার দিয়েছিলো, সেই থেকে বড়দি’র রাগ আর সন্দেহ। সোয়েটারটা ছোড়দি’ বুঝি ক’বছর আগে লণ্ডন থেকে এনে দিয়েছিলো। পরলে খুব গরম হয়। দিদা অনেক পরেছে, কিন্তু এখনো খুব ভালো আছে। দিদা তো আজকাল আর অত রঙীন জিনিস পরে সাজে না, তাই ছোড়দি’ দিদাকে হাল্কা ক্রীম রঙের আরেকটা এনে দিয়েছে। এটা তোলাই ছিলো, ক’দিন খুব ঠাণ্ডা পড়ায় দিদা সোয়েটারটা পরে ওকে বেরোতে বলেছিলো। দিদা আর ওটা ফেরত নেয়নি, ওকেই দিয়ে দিয়েছিলো। 

দু’দিনের ছুটিতে কলকাতায় এসে, বড়দি’র সে কী রাগ মণিকার গায়ে ঐ সোয়েটার দেখে! সব ইংরেজী বুঝতে না পারলেও, তাকে আর তার সোয়েটার নিয়েই যে কথা হচ্ছে সেটা বুঝতে পেরেছিলো মণিকা। দিদার কাছে রোজ ইংরেজী শিখতে শিখতে, কয়েকটা কথা তো মণিকার জানাই। 

‘দ্যাট গার্ল’… ’সো এক্সপেনসিভ কার্ডিগান’… ’কেকা যদি শোনে’… ’হোয়াটস্ দ্য নীড’ – সব বুঝছিলো মণিকা। আর তারপর ‘বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা’ যখন বললো বড়দি’, তখন তো মণিকা বুঝতেই পারলো যে ‘বাঁদর’টা কে! 

পাশের ঘর থেকে সে শুনতে পেলো যে দিদা বলছে, “কেকা ডাজন্ট কেয়ার, সো হোয়াটস্ ইওয়োর প্রবলেম? তোমার তো কম কিছু নেই, তাহলে একটা পুরোনো জিনিস মণিকাকে দিয়েছি বলে তোমার এতো রাগ কিসের?… গয়না-গাঁটি সবই তো তুমি নিয়েছো, কেকা তো কিছু চায়ও না!”  

বড়দি’ রেগে গিয়ে বললো, “প্লিজ্ ডোন্ট স্টার্ট দ্যাট, মা!… এতোই যদি ‘কেকা’ ‘কেকা’, তো থাকো না কেন সেখানে গিয়ে? আমার তাহলে ছোটা-ছুটিটা একটু কমে! দরকারের সময়, শরীর খারাপ হলে তো সেই আমাকেই ছুটে ছুটে আসতে হয়! কোথায় থাকে তখন তোমার কেকা?” 

দিদা যদিও শক্তগলায় বলেছিলো যে, “তোমার নিজের দরকার না হলে, তুমি আর আমার এখানে এসো না কুহু”, কিন্তু দিদার চোখে সেদিন জল দেখেছিলো মণিকা।বড়দি’ রাগ দেখিয়ে পরদিন বম্বে ফিরে গেলো, আর দিদা দু’দিন গুম্ হয়ে রইলো। মণিকাই শেষে দিদাকে সাধাসাধি করে মোঙ্গলি থেকে বিরিয়ানি আনালো। 

টেবিলে সব বেড়ে দিয়ে বললো, “এসে খাও তো এখন। তুমি তো ভালোবাসো এটা – ভালো করে খাও। ঐসব ছেঁড়া কথা বাদ দাও দিকিনি। মা-মেয়েতে অমন ঝগড়া হয়। আমার ছেলের সঙ্গেও অমন কত হয় আমার।…তোমাকে তো ভালোও বাসে বড়দি’, কতো করে তোমার জন্যে – বম্বে থেকে ছুটে ছুটে আসে। দু’দিন বাদেই আবার ফোন করবে, দেখো!” -“থামো, তোমাকে আর ওকালতি করতে হবে না!” দিদা আবার ধমক দিয়ে কথা বলছে দেখে, মণিকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।খাওয়ার শেষে বারান্দায় এসে বসলো দু’জনে। 

বারোতলার ওপর থেকে কলকাতা শহরকে খুব সুন্দর লাগে রাতের বেলা। দিদার বারান্দায় সবসময় চেয়ার-টেবিল পাতাই থাকে। দিদা একটায় বসে, মণিকা পাশেরটায়। সামনের দিকে তাকিয়ে মিসেস বাসু আস্তে আস্তে বললেন, “তুই যে বাড়ি তুলবি বলেছিলি গ্রামে, তার কি হলো?” 

-“জমি তো কিনে রাখলুম গত বছরে, কিন্তু বাড়ী তোলা কি চাট্টিখানি কথা? জমির দাম শহরের চেয়ে কম হলেও, বাড়ি বানাতে যা টাকা হাঁকে না মিসতিরিরা! বলে ‘ইঁট-সিমেন্টের দাম কলকাতায়ও যা, এখানেও তা… দু’স্টেশন গেলেই তো কলকাতা’।… দেখি, ছেলেটা ঠিকেদারির ধান্দায় এদিক-সেদিক ঘুরছে। পাকাপাকি কিছু একটা হয়ে গেলে হাতে টাকা আসবে। কারখানায় আর কটা টাকা দেয়, বলো!”

-“ছেলের ভরসায় থাকিস্ না। জমি কার নামে কিনেছিস্?”

– “জমি তো আমার নামেই কিনলুম।”

-“তবে বাড়ীও তোর নামেই কর্। দোতলা তোল্ – স্টেশনের কাছে বললি না? একতলা ভাড়া দিয়ে আরেক তলায় থাকবি। একটু বাগানের ব্যবস্থা রাখবি পেছনে – লঙ্কা, বেগুন, কলা, মুলো ফলাবি।… বিশ্বকর্মা পূজোর জন্যে সামনের সপ্তাহে বাড়ি যাবি তো?” 

-“হ্যাঁ গো, দিদা। তোমায় বললুম না যে ছেলে বাড়ী আসবে? কারখানায় বিশ্বকর্মা পূজোতে ছুটি যে ছোট্টুদের! পূজোয় তো আসতে পারবে না, বন্ধুদের সঙ্গে দীঘা যাবে। সে ভালোই হবে- তুমি আমি মিলে ঠাকুর দেখতে বেরোবো রাতে। আমি এই সামনের সপ্তাহে যাবো, আর তারপর আবার সেই লক্ষ্মীপুজোতে যাবো- তখন আবার ছোট্টু আসবে।” 

-“হুম্, বুঝলাম। তা’ সামনের সপ্তাহে রাজপুত্তুরের সঙ্গে যখন দেখা করতে যাবি, তখন মিস্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কাগজে বাড়ি তোলার পুরো খরচা লিখে নিয়ে এসে আমাকে দেখাবি, ভুল হয়না যেন।… ক’দিন আর লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করবি? বুড়ো বয়সে ছেলের হাততোলা না হয়ে, স্বাধীনভাবে থাকবি।” 

-“দিদা, আমার কি তোমার মতো এতো টাকা আছে গো যে নিজের মতো থাকবো? বুড়ো বয়সে তো সেই ছেলের রোজগারই ভরসা করতে হবে।” 

-“না-ও ভরসা নাও করতে হতে পারে, যদি তুমি এখন থেকে ঠিকভাবে সব করো।… যা বললাম, মিস্ত্রীকে দিয়ে দোতলা তোলার পুরো খরচ লিখিয়ে এনে আমায় দেখাবে। ভুল হলে কিন্তু দরজা থেকেই আবার বাড়ি পাঠাবো আর পরের ছুটিটার জন্য মাইনে পাবে না তুমি।” 

গজগজ করতে করতে বাড়ি গেলো মণিকা। দিদার মাথায় মাঝেমাঝে এমন পোকা চাপে! 

বরেন মিস্ত্রীকে যদি এখন দোতলা তোলার খরচ লেখাতে ডাকে, সে নির্ঘাত পাঁচটা কথা শুনিয়ে দেবে। এমনিতেই বারদুয়েক তার কাছে ঘুরঘুর করেও শেষ পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি মণিকা। সে ব্যস্ত লোক, অতো সময় নেই তার। সোনারপুর লাইনের এই আধা-গ্রাম আধা-শহরে যত কাজ হয়, সবই প্রায় বরেন মিস্ত্রী তুলে দেয়। তবু, যাকে বলে ‘ঠ্যালার নাম বাবাজী’! যেতেই হলো মণিকাকে। 

বরেন মিস্ত্রী তাকে এককথায় উড়িয়ে দিলো, “ভিত গড়ার মুরোদ নেই, দোতলা!… তুমি কি স্বপ্ন দেখতিছো দিদি?” প্রাণের দায়ে মণিকা একটা মিছে কথাই বলে দিলো, “না গো বরেনদাদা, একজন ধার দেবে বলেছে।” চোখের কোণ দিয়ে তাকে একবার দেখলো বরেন মিস্ত্রী, তারপর বললো— “বোসো ঐখেনে। হাতের কাজগুলো আগে সেরে নিই।” দুটি ঘন্টা তাকে বসিয়ে রেখে লোকেদের সঙ্গে বকবক করলো সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে বললো, “চলো দিকি তোমার রাজপেসাদের খরচা কত হবে মাপি গে।” দরমার বেড়া দিয়ে ঘেরা একটুকরো জমি। স্টেশন থেকে পাঁচমিনিটের হাঁটাপথ। বেদখল যাতে নাহয়, সেই ভয়ে মণিকা আর তার ছেলে ছোট্টু সারাক্ষণ পাড়ার ছেলেদের তোষামোদ করে চলে। 

এদিক-ওদিক দেখে, অনেক ভেবেচিন্তে, বরেন মিস্ত্রী যে সংখ্যাটা কাগজে লিখলো সেটা দেখে তো মণিকার চক্ষু চড়ক গাছ! সে আমতা আমতা করে বললো, “এতো?… এট্টু কম হয় না বরেনদাদা!” বরেন মিস্ত্রী ঘাগু লোক। দাঁতে বিড়িটা চেপে ধরে বললো, “সে তুমি আমারে দাদা-ই বলো আর বাবা-ই বলো, ইঁট-সিমিন্টের দাম তো আর তাতে কমবেনি?” মণিকা তবু অনেক কাকুতি-মিনতি করলো। বরেন মিস্ত্রী শেষপর্যন্ত পাঁচহাজার টাকা কম করলো। “বরেন অ্যান্ড সনস্” লেখা কাগজটায় তারিখ আর নতুন দাম বসিয়ে, বরেন মিস্ত্রী জানালো, “এই হলো গে ফাইনেল, বাস্। আর সামনের বছরের মদ্যি যদি কাজ না হয়, তো নতুন ইস্টিমেট।” 

কাগজটা হাতে নিয়ে, নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলো মণিকা। পাঁচু আর পাঁচুর বৌয়ের মনোহারী দোকানের পেছনে একটা ঘরে ভাড়া থাকে সে। ওপরে পাঁচু থাকে তার সংসার নিয়ে। ছেলে যখন ছোট ছিলো, মণিকার বয়স ছিলো আরও কম, তখন থেকেই এই ব্যবস্থা। ঘরটা একটু ঘুপচি অন্ধকার হলেও, পাঁচু লোক ভালো। ভাড়া বেশী নেয় না আর ওপরে মানুষজন থাকায় মণিকারও ভয় নেই। আর এখন তো সে প্রায় থাকেই না, ছেলেও না। দমদমের দিকে কাজ করে ছেলে, সেখানেই একজনের সঙ্গে ঘর নিয়েছে। বাড়ি আসার আগে মাকে ফোন করে। মণিকাও তখন ক’দিনের জন্য বাড়ি আসে। আজও বিকেলে আসবে ছোট্টু, কাল বিশ্বকর্মাপুজোর ছুটি। পরশু সকালের ট্রেন ধরে মা আর ছেলে ফিরবে। মণিকা নামবে ঢাকুরিয়া স্টেশনে, ছেলে চলে যাবে দমদম। 

মিসেস বাসু দরজা খুলেই হাত বাড়ালেন, “বাড়ির খরচের হিসেব কই?” 

মণিকা কাগজটা বার করে দিদার হাতে দিয়ে বললো, “হয়েছে? এবারে ঢুকতে দেবে তো, নাকি?” মিসেস বাসু কাগজটা হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে, দুর্গাপুজো শেষ হলেই মায়ের নাম নিয়ে কাজ শুরু করে দে তুই। লক্ষ্মীপুজোতে গিয়ে মিস্ত্রীকে বলে আসবি। একবছরের মধ্যে যেন বাড়ী উঠে যায়।” 

-“খেপেছো তুমি? টাকা কোথায় পাবো? ”মিসেস বাসু খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বললেন, “আমি দেবো।” মণিকা ‘হাঁ’ হয়ে গেলো।

-“আর আমি অত টাকা শুধবো কেমন করে?”

 -“শুধতে বলেছি তোকে আমি?”

মণিকা হাঁউমাউ করে উঠলো, “না, না, দিদা! বড়দি’ তাহলে আমাকে মেরে ফেলবে গো!…আর তুমিই বা খামকা অতগুলো টাকা দেবে কেন? না, না!” মিসেস বাসু খবরের কাগজটা আবার তুলে নিলেন চোখের সামনে। “বড়দি’ এরমধ্যে কোথা থেকে আসছে? তুমি রোজ বড়দি’কে ফোন করে গল্প করো নাকি?” 

-“ফোন করে গল্প করতে যাবো কেন? তাই বলে কি তুমি ভাবো কথা চাপা থাকবে? বড়দি’ ঠিক জানবে আর তখন তোমার সঙ্গে আমারও খোয়ার হবে!” মিসেস বাসু এবারে কাগজটা রেখে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ালেন। 

তারপর মণিকার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “কেউ কিছু জানবে না আর জানলেও কিছু এসে যাবে না। এই নিয়ে যেন আর একটা কথাও না শুনি আমি।… কাল ব্যাঙ্কে গিয়ে তুমি আমার সঙ্গে একটা জয়েন্ট এ্যাকাউন্ট খুলবে। আমার এ্যাক্সিস ব্যাঙ্কে নয়, আমরা যাবো অন্য কোথাও- এস বি আই তে। তোমার আর আমার নাম থাকবে শুধু এ্যাকাউন্টে। তোমার ছেলের নাম ঢোকানোর কোনো দরকার নেই। আমার কাছে চেকবই থাকবে। যেমন যেমন বিল করবে মিস্ত্রী, তেমন তেমন চেক কাটা হবে। বাড়ি তোমার একার নামে রেজিস্ট্রি করবে। রেজিস্ট্রেশনের কাগজ আমাকে দেখাবে, তারপর বাড়ির শেষ পেমেন্ট যাবে। আর আমি যতদিন না মরছি তুমি এই বাড়িতেই থাকবে, অন্য কোথাও যেতে পারবে না। কাগজে লিখে দিতে হবে… যদি যাও তো বাড়ি তৈরীর পুরো টাকাটা শোধ দিতে হবে।… ঢুকেছে মাথায়?” মণিকা ঘাড় নাড়লো, তারপর বললো, “কিন্তু তুমি তাহলে আমাকে আবার মাইনে দেবে কেন?” 

মিসেস বাসু এবারে হাল্কা গলায় বললেন, “সাধে তোকে আমি বলি মুখ্যু? বাড়িটা হলো তোর ভবিষ্যতের ইনভেস্টমেন্ট, আর মাইনে হলো তোর এখনকার খরচ চালানোর জন্য রোজগার। কোনোটাই বাদ দিলে চলবে না। অফিসে যদি চাকরি করতি, তাহলে মাইনের সঙ্গে সঙ্গে রিটায়ারমেন্টের পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও পেতি তো? ধর্, ঐ বাড়ি বানানোর টাকাটা তোর প্রভিডেন্ট ফান্ডের রোজগার। এতো বছর কাজ করলি, আরও কয়েক বছর করতে হবে। তার জন্য একস্ট্রা তো কিছু পাবি!…আজ বাদে কাল আমি মরে গেলে, তখন আবার কাজ খোঁজা! এইভাবে ক’দিন চালাবি? তার চেয়ে বাড়ি তৈরী শুরু হলেই পাঁচুর দোকানে বলে রাখবি ভাড়াটে জোগাড়ের জন্য। ওর কাছে পাঁচরকম লোক আসে, মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে যাবে। বাড়ি বসতযোগ্য হলেই ভাড়াটে বসিয়ে দিবি।” মণিকার চোখে জল চলে এলো। নীচু হয়ে সে দিদাকে হঠাৎ একটা প্রণাম করে বসলো। 

-“খুব হয়েছে! অত ভক্তি দেখাতে হবে না।… এবারে গিয়ে একটু রান্নাটা দেখো- দু’দিন তোমার ছুটির জ্বালায় তো সেদ্ধভাত খেলাম। আজও কি তাই খাবো নাকি?” 

মণিকা চোখ মুছে, হাসতে হাসতে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত