Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ইরাবতী উৎসব সংখ্যা শিশু: মাতৃরূপেন সংস্থিতা । বনবীথি পাত্র

Reading Time: 5 minutes

ট্রেনটা ছেড়ে চলে যেতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় মিলুর। এই ট্রেনেই দাদাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা শহরে চলে গেল। ফিরবে সেই দ্বাদশী-তেরোদশীর দিন। আজ তো সবে তৃতীয়া। আঙুলের কর গোনে মিলু। ন-দশদিন পর তবে ওরা ফিরবে। আরও কদিন পরে গেলে কী হয় কে জানে! পুজো তো সেই ষষ্ঠীর দিন সন্ধে থেকে। বাবা অবশ্য বলে, শহরে নাকি চতুর্থী থেকেই পুজো আরম্ভ হয়ে যায়। আলোর মালায় শহরটা সেজে ওঠে তারও কদিন আগে থেকে। তাই তৃতীয়ার মধ্যে শহরে পৌঁছাতে না পারলে কোন প্যাণ্ডেলেই ঢাক বাজানোর বায়না পাওয়া যাবে না। মিলু তো সেই ছোট থেকে মায়ের কাছে গল্প শুনে এসেছে, মা দুগ্গা ছেলেপুলেদের সঙ্গে নিয়ে কৈলাশ থেকে মাত্র চারদিনের জন্যই মর্ত্যে আসে। শহরের গল্প তবে বুঝি অন্যরকম! যখন ছোট ছিল, বাবার কাছে কত বায়না করত দাদার সঙ্গে ওকেও একবার শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবা সে কথা কানেই তুলত না। পথে মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকা মানেই রকমারি ঝক্কি। এখন আর ওকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথাই তোলে না মিলু।

ওদের আনন্দডোবা গ্রামে একটাই দুর্গাপুজো হয়। আনন্দডোবা নামটা একদম পছন্দ নয় মিলুর। আনন্দডোবা আবার একটা নাম হল! আনন্দটাই যদি ডুবে যায় তাহলে জীবনে আর থাকে কী! গুটি গুটি পায়ে ছোট স্টেশনটা থেকে বেরিয়ে আসে মিলু। গতকালকেও সারাদিন ছিপছিপে বৃষ্টি হয়েছিল। আজ অবশ্য সকাল থেকে আর বৃষ্টি হয়নি। সারা আকাশ জুড়ে যেন সোনা রোদের লুটোপুটি। স্টেশন থেকে নেমেই ডানদিকে পটুয়া পাড়া যাওয়ার রাস্তা। গত শ্রাবণ মাসেই ওই রাস্তার মোড়েই পদ্মপুকুরের পাড় ঘেঁষে একটা ছোট করে  বারোয়ারি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। মিলু ওই শিবমন্দিরের সিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। প্রতি বছর বর্ষা ফুরোলেই পদ্মপুকুরে একটা দুটো করে পদ্মফুল ফুটতে শুরু করে। এবার প্রচুর ফুল হয়েছে। গরমকালে গায়ে ঘামাচির মত সারা পুকুর জুড়ে গিজগিজ করছে ফুল। একটা ছেলে পুকুরে নেমেছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে একটা লোক কথা বলছে ছেলেটার সঙ্গে। ওদের কথা শুনেই মিলু বুঝতে পারে, পদ্মপাতা তোলার জন্য ছেলেটা জলে নেমেছে। লোকটা মনে হয় মল্লিকদের বাড়ির কেউ হবে। পুজোয় তো শহর থেকে কম মানুষজন আসে না মল্লিকবাড়িতে! এই গ্রামে শুধু ওই মল্লিকবাড়িতেই দুর্গাপুজো হয়। খুব ঘটা করে পুজো হয়। সপ্তমীর দিন সারা রাত যাত্রা হয়। অষ্টমীর দিন বলি হয়। নবমীর দিন বিশাল বড় করে ফাংশান হয়। কলকাতা থেকে বড় শিল্পীদের ভাড়া করে আনে ফাংশানে গান করার জন্য। দশমীর দিন বিসর্জনের সময় নদীর ধারে কত যে আতস বাজি পোড়ায় তার ঠিক নেই। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে সারাদিনে কতবার যে ওই মল্লিকবাড়ির নাটমন্দিরের যেত তার ঠিক থাকত না। মা চলে যাওয়ার পর মিলু আর চণ্ডীমণ্ডপেই যায় না। দুগ্গামায়ের মুখটা দেখলেই মায়ের মুখটা মনে পড়ে যায় ওর। আর তখনই বুকের মধ্যেটাতে কেমন যেন হাকুলি বিকুলি করে ওঠে। খুব কষ্ট হয় ওর। বাবা আর দাদা তো প্রতিবছর দুর্গাপুজোতেই শহরে চলে যায়। পুজোর দিনগুলো ঘরের মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখে মিলু। পাশের বাড়ির সদুপিসি দুবেলা ওকে খাবার দিয়ে যায়, রাতে শুতে আসে ওর কাছে। এবার অবশ্য সে সব ঝামেলা নেই।

তিন-চার মাস হল বাবা আবার বিয়ে করে নতুন মাকে নিয়ে এসেছে। নতুন মায়ের সঙ্গে খুব যে একবারে গলায় গলায় ভাব মিলুর তাও নয়। তবে আবার সরকার পাড়ার চন্দনার সৎমায়ের মত সবসময় মারধোর, খেতে না দেওয়া অমনটাও নয়। মানুষটা খুব যে খারাপ এমনটা মনে হয় না মিলুর। সারাদিন তো মুখ বুজে সংসারের কাজই করে যায়। অবসর সময় সদুপিসির কাছে ঝুড়িবোনা শেখে। সন্ধেবেলা সদুপিসি খুব ডাকাডাকি করলে তবে ক্লাবঘরে টিভি দেখতে যায়। মিলুর, ওর দাদার যতটা সম্ভব খেয়াল রাখে। বাবা কোন কারণে বকাঝকা করলেও নতুন মাকে কখনও রাগ করতে বা বাবার সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেনি মিলু। অথচ মায়ের সঙ্গে তো বাবার নিত্যি কিছু না কিছু নিয়ে খুটোখুটি লেগেই থাকত। তখন আর কিছুটা ছোট থাকলেও মিলু কতদিন মাকে রাগ করে না খেয়ে শুয়ে পড়তে দেখেছিল। নতুন মায়ের যেন কোন রাগ, অভিমান, হাসি, দুঃখ কিছুই নেই। মিলুর তো মাঝেমধ্যে নতুন মা মানুষটাকে কেমন যেন কলের পুতুলের মত মনে হয়। নতুন মাও মনে হয় সবকিছুতেই মিলুর মত সংকোচবোধ করে। কারও সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে মিলুরও তো কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করে। ফেনি, বুলি, ময়না, টেঁপি, কুসুমরা সবাই এবারের পুজোর যাত্রায় পার্ট করছে। পরাণখুড়ো তো মিলুকেও পার্ট দিতে চেয়েছিল। যদি মহড়া দেখতে গেলে ওকে জোর করে অভিনয় করতে বলে সেই ভয়ে একদিনও যাত্রার মহড়াই দেখতে যায়নি মিলু। বিকাল থেকে তো ওরা সবাই মহড়াতেই ব্যস্ত থাকে। আগের মত চু কিতকিত, কুমির ডাঙা, কানামাছি কিছু খেলাই হয় না আর। মিলু একা একাই নদীর ধারে, জমির আলপথ ধরে ঘুরে বেড়ায়। গোবিন্দখুড়ো কাছে মাছ ধরার জন্য গতরাতে পেতে রাখা বিত্তি থেকে মাছগুলোকে বের করে টকুইতে ভরে, একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে দেখে মিলু। গোবিন্দখুড়ো তো কতদিন একমুঠো চুনোমাছ মিলুকে,

-কড়কড়ে করে ভেজে দিতে বলবি তোর মাকে। খেতে যা লাগবে, দেখবি আর কোন তরকারি লাগছে না।

অতগুলো জ্যান্ত মাছ, হাতের মুঠোয় করে বাড়ি অবধি নিয়ে যেতে যেতে অর্ধেক তো পড়েই যাবে! ফ্রকের ঝুলটা তুলে ধরে গোবিন্দখুড়োর হাত থেকে মাছকটা নিয়ে, একটুখানি হেসেই ছুট দেয় বাড়ির দিকে। আসতে আসতে ভাবে মা চুনোমাছের যেমন ঝাল করত, অমনি করতে মাছকটা রাঁধতে বলবে নতুন মাকে। কিন্তু বাড়ি ঢুকে নতুন মা সামনে এসে সেটা আর বলতে পারে না মিলু। শুধু বলে,

-একটা ঝুড়ি দাও।

নতুন মা একটা ঝুড়ি নিয়ে এলে মাছকটা ঝুড়িতে দিয়েই পিছন ফেরে মিলু। নতুন মা নীচুস্বরে বলে,

-আঁশের ঠেকা জামাটা ওই পেয়ারাতলায় ছেড়ে রেখে অন্য একটা জামা পরে তারপর আবার ঘুরতে যেও।

মিলুর খুব ইচ্ছা করে নতুন মা ওকে মায়ের মতই তুই করে কথা বলুক। জামার কোঁচড়ে করে মাছ আনার জন্য বকুক। পিঠে দুটো কিল বসিয়ে দিক গুমগুম করে। তারপর বলুক, “আর একদম বাড়ি থেকে বেরবি না। চুপ করে আমার পাশে বসে থাকবি। তোর বাবা ফিরুক, তোকে ইসকুলে ভর্তির ব্যবস্থাটা করতেই হবে। নাহলে তোর এই পাড়া বেড়ানি স্বভাব যাবে না।” এসব কিছুই বলে না নতুন মা। জামা ছেড়ে মিলুর নিজেরই আর ইচ্ছা করে না ঘুরতে যেতে। চুপ করে বাড়ির বাইরের একফালি রোয়াকটাতে বসে আনমনে পা দোলাতে থাকে।

একটা সাইকেল ভ্যানে মাইকে করে কী বলতে বলতে আসছে বাসস্ট্যাণ্ডের দিক থেকে। মিলু এক ছুটে পাকা রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। এবার ফাংশানে কোন কোন শিল্পী আসবে, কী কী অনুষ্ঠান হবে সেইসব বলছে। গোলাপী, হলুদ কাগজ ছড়িয়ে দিচ্ছে রাস্তার দুপাশে। অনেকে কুড়িয়ে নিচ্ছে। বেশিরভাগ কাগজই রাস্তায় পড়ে থাকছে। পড়তে পারবে না জেনেও একটা গোলাপী কাগজ তুলে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে মিলু। মা মরে যাওয়ায় ওর আর ইস্কুলে ভর্তি হওয়াটা হয়ে ওঠেনি।

এবার পুজো দেরিতে। ধানগাছগুলো এর মধ্যেই বেশ শীষ নিয়ে উঠে পড়েছে। মিলু হাঁটতে হাঁটতেই হাতের কাগজটা দিয়ে একটা নৌকা বানিয়ে রাস্তার পাশের নয়ানজুলিতে ভাসিয়ে দেয়।
শরীরটা সকাল থেকে কেমন যেন লাগছিল মিলুর। প্রথমে ভেবেছিল বাবা দাদাকে নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছে বলে বোধহয় ওর মনখারাপ। দুপুরে ভাতের পাতে ডিমের বড়া থাকা সত্ত্বেও একটুও ভাত খেতে পারল না মিলু। বিকালবেলাও একা একা বসে থাকল ঘরের মধ্যে। কিছুই ভালো লাগছিল না ওর। সেই রাত থেকেই ধূম জ্বর মিলুর। সারা শরীর, মাথা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। এর বেশি কিছু আর ওর মনেও নেই। শুধু মনে আছে নতুন মা সবসময় ওকে একেবারে আগলে রেখেছিল। গাঁয়ের পঞ্চানন কবিরাজের মুখটাও যেন একদিন দেখেছিল জ্বরের ঘোরে। ক’দিন যে বিছানায় পড়ে ছিল খেয়ালও নেই মিলুর। যেদিন বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরের দাওয়ায় এসে বসল, প্রথমবার এবারের পুজোর ঢাকের আওয়াজ শুনতে পেল। ঢাকির মেয়ে বলেই বোধহয় অসুস্থ শরীরেও ঢাকের বোলটা চিনতে অসুবিধা হয় না মিলুর। ঢাকের বাদ্যির সুরটা বড় স্পষ্ট। “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।” নতুন মা বার্লির গ্লাসটা নিয়ে মিলুর কাছে এলে মিলু মৃদুস্বরে শুধায়,

-পুজো শেষ হয়ে গেল!

কোন উত্তর দেয় না নতুন মা। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় মিলুর মাথায়। বেশ কদিন পর আজ দুপুরে জিওল মাছের ঝোল দিয়ে এক মুঠো ভাত খায় মিলু। মা ঠিকই বলত, “পেটে মা লক্ষ্মীর দানা পড়লে শরীরে এমনিই বল ফিরে আসে।” ভাত খেয়েই শুলে ঠাণ্ডা লাগবে বলে পেঁপে গাছের তলার রোদটুকুতে আসন পেতে বসেছিল মিলু। নতুন মা কাজকম্ম সেরে সবে পুকুর থেকে ডুব দিয়ে ফিরেছে, তখনই সদুপিসি আসে।

-আজ তো মেয়েটা একটু ভালো আছে রে নতুন বৌ। চটপট কাপড়খানা পরে তৈরি হয়ে নে দেখিনি। এতবড় পুজোতে একবারও তো মায়ের মুখদর্শন অবধি করিসনি। সধবা মানুষ হয়ে মাকে একটু সিঁদুর পরিয়ে বরণ না করলে চলে!

নতুন মা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মিলুর কাছে এগিয়ে এসে শুধায়,

-যাবি মায়ের বরণ দেখতে?

নতুন মায়ের মুখে এই ডাকটুকু তো সেই কবে থেকে শুনতে চাইছিল মিলু। অকারণেই যেন কান্না পেয়ে পেয়ে যায় তার। গলার স্বরটা হঠাৎ করেই যেন বুজে আসছে মনে হয়। মিলু কোন কথা না বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। বাক্স থেকে গত বছরের পুজোর জামাটা বের করে দেয় নতুন মা। শহর থেকে বাবা কিনে এনে দিয়েছিল জামাটা। প্রতিবছরই শহর থেকে জামা নিয়ে আসে বাবা। পুজোর পরেই মিলুর পুজোর জামা হয় প্রতিবার। চণ্ডীমণ্ডপে খুব ভিড়। জ্বরে ভুগে কদিনে বড্ড দুর্বল হয়ে গেছে মিলু। এত মানুষের ঠেলাঠেলিতে ওর যাতে অসুবিধা না হয় সেইমত একটু ফাঁকা জায়গায় মিলুকে দাঁড় করিয়ে নতুন মা গেছে মাকে বরণ করতে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে যতবার দুর্গা ঠাকুরের মুখটা দেখত, মায়ের মুখটা মনে পড়ে গিয়ে কান্না পেত মিলুর। আজ তিনবছর পর দুর্গা মায়ের মুখটা দেখে কান্না পাচ্ছে না ওর। সধবা মহিলারা একে অপরের সিঁথিতে, হাতের নোয়ায় সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছি। গালে, মুখেও এঁকে দিচ্ছে খুশির সিঁদুর চিহ্ন। সিঁদুর মাখা সব মুখগুলো যেন খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। সবার মুখগুলোকেই যেন মা দুর্গার মত দেখতে লাগছে। আর মা দুর্গার মুখটাতে আজ যেন বারবার নতুন মাকে খুঁজে পাচ্ছে মিলু…।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>